মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
12

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আর্যাব খান চলে গেল খান বাড়িতে। ইথিকাকে তার সাথে ফিরতে না দেখে ইলিনা বেগম বলল,

“ইথু কোথায়?”

আর্যাব খান সোজা ঘরে চলে যেতে লাগল। ইলিনা বেগম তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে বলল,

“কথার জবাব দিচ্ছ না কেন আর্য?”

আর্যাব খান উত্তর দিল,”ফোন করে জেনে নাও। ওর নাম আমার সামনে নেবে না। হাতের কাছে পেলে গলা টিপে মারব। নিজের ভাইকে সবার সামনে ভিলেন বানিয়ে ছাড়ল! হারামজাদি বোন আমার।”

ইলিনা বেগম কিছু বুঝতে পারলেন না। উনার বিরক্ত লাগছে। ইথিকাকে তিনি ফোনের পর ফোন দিয়ে যাচ্ছে। রিসিভ হচ্ছে না। ইথিকা কি ঘরে নেই? মেয়েটা কি চাচ্ছে? এই সম্পর্ক থেকে তার সরে আসা উচিত। পরে এমন পরিস্থিতিতে যেন পড়তে না হয় যে চাইলেও আর ফিরে আসা যাচ্ছে না। কি চাইছে সে?

আকাশে মেঘ ডাকছে। এখন বর্ষাকাল। দেওয়ান বাড়ির ছাদটা রাজকীয়। কলিমউদ্দিন দেওয়ান নিজ হাতে বাড়িটা নির্মাণ করেছিলেন। বড়ো শখের বাড়ি উনার। আজ শেষ বয়সে এসে বাড়িটা দেখে কতশত স্মৃতি মনে পড়ে।

বাড়ির ছাদে এসে বসেছে দেওয়ান বাড়ির পুরুষরা। কাবির নেই যদিও। কামরান দেওয়ানকে আনা হয়েছে। এই ছাদে উনি ঠিক কতবছর পর এসেছেন নিজেরও হিসেব নেই। এখানেই তো কানিজের লাশটা পড়েছিল। সকালে একদম গলা জড়িয়ে ধরে কোলের উপর বসেছিল। হয়ত চিরতরে চলে যাবে বলে শেষ আলিঙ্গন ছিল। কামরান দেওয়ানের বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত ব্যাথা মোচড় দিয়ে উঠে। এত কষ্ট লাগে। নিঃশ্বাসটা নিতে কষ্ট হয়। ইচ্ছে করে জাগতিক সব মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে যেতে। কানিজের দেখা মিলবে সেখানে গেলে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হচ্ছে না।

কলিমউদ্দিন দেওয়ান শেষ বয়সে এসে পৌঁছেছেন। তাদের বংশে পুরুষ লোকেরা অনেক হায়াত পায়। কলিমউদ্দিন দেওয়ান আর আখতারুজ্জামান খানের বাবাও একশো চার বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। যদিও সাত বছর বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। কিন্তু কলিমউদ্দিন দেওয়ান চান হাত পা অক্ষত থাকা অবস্থায় ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করতে। যে মানুষ আজীবন শিরদাঁড়া উঁচু করে বেঁচেছে সেই মানুষ শেষ বয়সে এসে ছেলেমেয়ে সন্তান সন্ততিদের উপর বোঝা হতে চান না।

কিন্তু আল্লাহ পাক ডাকে সাড়া না দিলে কি করার আছে? তিনি কপালে যেভাবে মৃত্যু লিখেছেন সেভাবেই হবে। বয়স বিরানব্বইয়ে এসে পড়েছে। এখনো মোটামুটি হাঁটাচলা করা যাচ্ছে। কিছুদিন পর বোধহয় সেটাও সম্ভব হবে না।

কল্পনা বাবার পায়ের কাছে এসে বসেছে। বেশ যত্ন করে পায়ের নখ কেটে দিচ্ছে। কলিমউদ্দিন দেওয়ান তা দেখে বলল,

“দেখলে কামরান তোমার মেয়ে কতবড় হয়ে গেছে? মেয়েটা তার মায়ের মতো হয়েছে।”

কামরান দেওয়ান কল্পনার দিকে তাকায়। দেওয়ান বাড়ির রক্তে কালো কিংবা শ্যাম বর্ণের কেউ নেই। শুধু কল্পনার গায়ের রঙটা তার মায়ের মতো শ্যামবর্ণ হয়েছে। কিন্তু এতে তার সৌন্দর্যে একফোঁটাও ভাটা পড়েনি। মায়ের চোখ পেয়েছে মেয়েটা। তার মায়ের চোখের দিকে তাকালে যে কারো মায়া হতো। যে কেউ সহজেই ভালোবেসে ফেলতো। অমন একটা নরম দিলের মানুষকে কেন প্রাণে বাঁচতে দিল না অন্তরা? খুন করার সময় তার কি চোখদুটো দেখে কি একটুও মায়া হয়নি?

কামরান দেওয়ানের চোখের কোণা কেমন চিকচিক করে উঠে। কল্পনা খেয়াল করেছে বাবা তার দিকে বড়ো দুঃখ নিয়ে চেয়ে থাকে। সে মায়ের মতো বলে? তাকে দেখলেই কি বাবার মাকে মনে পড়ে? আচ্ছা বাবার মতো জীবনসঙ্গী কি সব মেয়েরা পায়? সে পাবে? কিরণ পাবে?

বাবার মতো দুর্লভ ভালোবাসার মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে আছে বলেই হয়ত ভালোবাসা এখনো পৃথিবীতে বিরাজ করে। বড় ভাই, মেঝ ভাই, সেঝ ভাইরাও কি তাদের জীবনসঙ্গীকে এভাবে ভালোবাসতে পারবে? কল্পনার মাঝেমধ্যে গর্ব হয় বাবাকে নিয়ে। কি চমৎকার মানুষ উনি! মাকে ভালোবেসে খুনী তকমা অনায়সে গ্রহণ করেছে, তবুও একবারের জন্যও উনার মনে হয়না উনি ভুল করেছেন। কি অবাক ভালোবাসা তাদের! মা কি উপর থেকে দেখছে মানুষটাকে কি যন্ত্রণার মাঝে ফেলে গেল সে? দেখছে এখনো একরত্তি ভালোবাসা কমেনি মায়ের প্রতি। এখনো তার কথা মনে পড়লে বাবার মতো অমন বজ্রকঠোর মানুষটার চোখের কোণা চিকচিক করে উঠে?

“ওর বিয়ের বয়স হয়েছে?”

একসাথে সবাই হেসে উঠে। কাওসার দেওয়ান হেসে উঠে বলল,

“কি যে বলো না। মেয়েদের বিয়ের বয়স তো আঠারো পেরোলেই হয়ে যায়। কল্পর বাইশ তেইশ হয়েছে।”

কল্পনা তখনো মাথা নীচু করে নখ কেটে চলেছে। নখগুলো ভীষণ শক্ত। কাটতে কষ্ট হচ্ছে তার। কাদিন তার বাবাকে প্রশ্ন করল,

“কল্পকে বিয়ে দিলে তোমার সেবা কে করবে?”

কলিমউদ্দিন দেওয়ান ধমকে উঠেন,

“বাড়িতে মানুষ আর নেই। কি যা তা বলছিস?”

কাদিন হাসে। কামরান দেওয়ান কল্পনার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তাহলে তো বিয়ে দিতে হবে। কাবিরের সাথে কথা বলব আমি।”

বড়দের কথার মাঝখানে কল্পনা চুপচাপ তার কাজ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কাবির এল। এসেই চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপচাপ সবাই। শেষমেশ কলিমউদ্দিন দেওয়ান কথা বলে উঠল,

“তাকে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। এটাই শেষ সুযোগ। ওই মেয়ের হাত থেকে নিস্তার না পেলে জীবনটা জাহান্নাম হয়ে যাবে।”

কাবিরের কপাল ঘামছে। সে ঘাম মুছে নিয়ে বলল,

“হুম।”

কাওসার দেওয়ান সরু চোখে তাকিয়ে বলল,

“হুম মানে কি? তুমি কি চাইছ? ওর ভাইয়ের হাতে ওকে ছেড়ে দিলে না কেন? ওকে সুযোগ দিলে ও পাল্টাবে না। যাদের রক্তে নষ্টামি আছে তারা জীবনেও শোধরায় না। একটা সময় পর শোধরে যাওয়া মানুষগুলো আলাদা। এরা শোধরাবে না। এদের রাস্তা খোলা নেই। এরা যা যা কর্মকাণ্ডে জড়িত সেইসব থেকে সরে আসার রাস্তা খোলা নেই। ওদের মরতে হবে পাপ করে করে।”

কাসেদ জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে কাবিরের দিকে এগিয়ে দিল। কাবির গ্লাসটা নিল। অল্প অল্প পানি খেল। মাও তার উপর রেগে গেছে। ওই মেয়েকে তিনি এই বাড়িতে দেখতে চান না। কাওসার দেওয়ান বলল,

“ওই মেয়েকে তালাক দিয়ে দাও। ঝামেলা বিদেয় করো।”

কামরান দেওয়ান একদৃষ্টে কাবিরের দিকে চেয়ে আছে। কাবির পানি খেতে খেতে উনার দিকে তাকান। উনি একটু সময় নিয়ে বলেন,

“আমার জন্য তোমার জীবনটা..

কাবির তৎক্ষনাৎ বাঁধা দিয়ে বলল,

“এটা আমার দায়িত্ব ছিল। একজন সন্তান তার বাবাকে বাঁচানোর জন্য এটুকু করতেই পারে।”

কামরান দেওয়ান বলল,”সে যেতে চাইছেনা কেন?”

কল্পনা দিল জবাবটা।

“ও শোধরাতে চায়।”

হেসে উঠেন কলিমউদ্দিন দেওয়ান।

“ওসব মুখের কথা। এখনো সময় আছ দাদুভাই। আমাদের কথায় তুমি বিয়েতে মত দিয়েছ। এখন আমরা তোমাকে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে বলছি। আমরা দেখেশুনে এবার একটা ভালো মেয়েকে তোমার বউ করে আনব। এই মেয়ের কথা ছাড়ো। ও শোধরে গেলেও তোমার যোগ্য হবে না।”

কাবির রাগ নিয়ে তাকাল। কাওসার দেওয়ান তাকে সতর্ক করার আগেই কাবির কঠোরভাবে বলল,

“বিয়ে কি ছেলেখেলা দাদাভাই? বেশ আমি ওকে তালাক দেব। কিন্তু আর কোনোদিন বিয়ের সম্পর্কে জড়াতে পারব না। সেটা মানলে আমি ওকে তালাক দিয়ে দেব অনায়াসে। যেহেতু আমার পক্ষে অন্য কোনো মানুষের সাথে জড়ানো সম্ভব নয় তাই আমার তাকে শেষ সুযোগ দিতে হবে।”

সবাই চুপ করে গেলেন। কাওসার দেওয়ান শান্ত কণ্ঠে বললেন,

“তুমি শান্ত হও কাবির। দাদাভাইয়ের সাথে রাগ দেখিয়ে কি হবে? যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে।”

কাবির গ্লাসটা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,

“আসছি। কাজ আছে।”

কাওসার দেওয়ান কিছু বলতে চাইলেন। কামরান দেওয়ান বাঁধা দিয়ে বললেন,

“ও শান্ত হোক আগে। তারপর বাকি কথা বলিস। কাদিন নীচে যাও।”

কাদিন মাথা দুলিয়ে নীচে চলে এল।

লুবনা বেগম কাবিরের উপর অসন্তুষ্ট। বড় ফুপু মনোয়ারা বেগম এসেছেন। তার বড় ভাই কামরান দেওয়ানকে দেখতে। তিনি উচ্চস্বরে কথা বলেন।

ইথিকাকে বকে যাচ্ছেন উনি একনাগাড়ে। লুবনা বেগমকে বলছেন,

“ছেলেকে বোঝাও ওই মেয়েকে ছেড়ে দিতে। ওই মেয়ে শোধরে গেলেও কাবিরের পাশে ওকে মানাবে না। ওই বাড়ির সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক রাখার দরকার নেই। সুযোগ যখন এসেছে তখন সেটা কাজে লাগাতে বলো। আমার ওই খানদের দুচোখে সহ্য হয় না।”

লুবনা বেগমের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না। উনি একদম চান না ইথিকা এই বাড়িতে থাকুক। মনের মতো ছেলের বউ ইথিকা কখনো হতে পারবে না। শুধু কাবিরের প্রতি মায়া, সম্মান, শ্রদ্ধা থাকলে হবে না। বাড়ির প্রতিটা মানুষকে তার সম্মান করতে হবে। কালকের রাতের ঘটনাটি তিনি এখনো ভুলতে পারছেনা। কাবির কি করে তাকে শেষ সুযোগ দিচ্ছে? লুবনা বেগমকে বিষয়টা ভাবাচ্ছে। কাবির কি মেয়েটার মায়ায় পড়ে গেল?

কাবির বড় ফুপুর সব কথা শুনতে পেয়েছে। মায়ের অভিমানী চেহারার কারণটা বুঝেছে। কল্প কিরণের বিরক্তির কারণ টের পেয়েছে। কিন্তু তার কিছু করার নেই। আনঝিলকে সে শেষ সুযোগ দেবে। স্বামী হিসেবে এটা তার শেষ দায়িত্ব কর্তব্য বলা চলে। আনঝিল যদি তাও না শোধরায় তখন? বারবার একই ভুল করে চলে?

সে ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখল ইথিকায় পিঠের নীচে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসেছিল। কাবিরকে দেখামাত্রই বিছানা থেকে পা নামাল। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে কাবিরের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,

“আমি চলে যাই। আমি চলে গেলে সবাই শান্ত হয়ে যাবে। আপনি ভালো দেখে আপনার পরিবারের কথামতো কাউকে বিয়ে করে নেবেন।”

কাবির অন্যত্র তাকিয়ে বলল,”যেতে চাইলে যাও।”

ইথিকা থমকে গিয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। তার নড়চড় না দেখে কাবির তার চোখের দিকে তাকাল। এই ছলছলে চোখদুটোর আড়ালে কি ছলনা লুকিয়ে আছে? নাকি সে যা দেখছে সেটাই সত্যি? আনঝিলের সুবুদ্ধি হয়েছে এত তাড়াতাড়ি? কাবির তাকে পরখ করে নিতে চাইল। বলল,

“তুমি আমার সাথে অভিনয় করছ?”

ইথিকা চোখ সরিয়ে নিল। কাবির বলল,

“লাস্ট চান্স!”

ইথিকা তৎক্ষনাৎ তাকাল। কাবির কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল,

“আমি এককথার মানুষ। তুমি যদি আমার সাথে ছলনা করো আর আমি যদি তা জানতে পারি তাহলে আমি তোমাকে সেইদিনই তালাক দেব। আর পরিবারের কথামতো তারপরের দিন বিয়ে করে নেব। তোমার চাপ্টার ওইদিনই ক্লোজ করে দেব আমি। আমার কথার নড়চড় হবে না।”

ইথিকা কোনোকিছু বলল না। এত অবিশ্বাস নিয়ে সংসার হয় না। তার চলে যাওয়ায় উচিত। সে কাবার্ডে হাত রাখতেই কাবির বলল,

“নেক নিয়ত থাকলে সেই মানুষ পরীক্ষা দেয়, না থাকলে ময়দান ছেড়ে পালায়।”

ইথিকা তার দিকে ফিরে চাইল চোখে জল নিয়ে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর যখন কাবিরও তার দিকে তাকাল তখন সে কাবিরের সামনে এসে দাঁড়াল।

“আমি আপনার মুখে একটা কথা শুনতে চাই।”

কাবির সটান দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

“বলো।”

ইথিকা কাঁপা গলায় জানতে চাইল,

“আপনি আমাকে আপনার জীবনে চান?”

কাবির উত্তর দিল না। ইথিকা বামচোখ থেকে একফোঁটা জল পড়ল। সাথে সাথে সেটা মুছে নিয়ে সে বলল,

“বিয়েটা আপনিও স্বার্থের জন্যই করেছেন। স্বার্থ ফুরিয়ে গেছে তাই আপনি আমাকে সরিয়ে ফেলতে চাইছেন।”

কাবির তার দিকে কপাল ভাঁজ করে তাকাল। হঠাৎ কি যেন হলো। বাহু শক্ত করে চেপে ইথিকাকে টেনে এনে বলল,

“একদম ন্যাকা সাজবে না। তুমিও কি আমার সাথে সংসার করার জন্য বিয়েটা করেছিলে?”

ইথিকা হাতের ব্যাথা কুঁকিয়ে উঠে বলল,

“এভাবে ছেড়ে যাওয়ার জন্যও করিনি। আমার রাগ হয়েছিল আমার প্রতি আপনার ঘৃণা দেখে। তাই জেদ চেপেছিল বিয়ে করার। আর করেও নিয়েছি। আপনাকে পাওয়ার জন্যই আমি এসব করেছি। তখন রাগ ছিল। এখন নেই। পার্থক্য এটাই।”

“কি বাজে রকমের মিথ্যে বলছ আনঝিল। চোখেমুখে সব ভাসছে। নিজের ইগোকে স্যাটিসফাই করার জন্য তুমি বিয়েটা করেছ।”

ইথিকা বলল,”হ্যাঁ হ্যাঁ তাই। কিন্তু এখন আমার মত বদলেছে।”

“হঠাৎ করে মত বদলালো কেন? মামলা তুলে নিয়েছি বলে?”

“আপনি যা মনে করেন। একটা মানুষের উপর থেকে রাগ কমে যাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে।”

“তাহলে এটাও জেনে রাখো মামলটা তুলেছি তোমাকে তালাক দেয়ার শর্তে।”

ইথিকা চোখ ভরে উঠল জলে।

“তাই নাকি? আমার মাথায় আসেনি কেন কাবির দেওয়ান এত মহান কাজটা কেন করল? তাহলে তো আমাকে মূল্য চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। বেশ গেলাম তাহলে। ছাড়ুন।”

নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে ব্যাগপত্র গোছগাছ করতে লাগল। কাবির দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ইথিকা একে একে তার সব কাপড়চোপড় ভরে নিল। চোখের জল মুছতে মুছতে ওড়নার কোণাটা ভিজে উঠল। কিন্তু কাবির একপাও সরলো না। তার আনঝিলকে আটকানো উচিত? শেষ সুযোগটা দেয়া উচিত? সে দোটানায় পড়ে গেল। ও এত সহজে পাল্টে যাবে? তার বদভ্যাসগুলো ছেড়ে দেবে? নাইট ক্লাবে যাবে না? বাজে পোশাক পরবে না?

ইথিকা ব্যাগ স্যুটকেস সব গুছিয়ে নিয়ে আশিষ খানকে ফোন করল। ফোন রিসিভ হলো না। সে পরপর তার ভাইদের ফোন দেয়ার পর আমিন খানকে ফোন দিল। ফোন রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে আমিন খান জানতে চাইল,

“কি হয়েছে মা?”

ইথিকা কেঁদে ফেলল। গাল মুছতে মুছতে বলল,

“আমি যাচ্ছি পাপা। একটা গাড়ি পাঠিয়ে দাও।”

আমিন খান কিছু বলার আগেই কাবির ফোনটা কেড়ে নিল। বলল,

“কোনো গাড়ি আসবে না এখানে। কেউ কোথাও যাবে না।”

বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মারল। ইথিকা চমকে গেল। কাবির তার হাত ধরে লুবনা বেগমকে ডাকতে ডাকতে টেনে বাইরে নিয়ে এল। লুবনা বেগম এসে পড়লেন। হাঁপিয়ে উঠে জানতে চাইলেন,

“কি হয়েছে কাবির?”

ইথিকার পুরো গাল ভেজা। তখনো কাঁদছে সে। লুবনা বেগমের নরম মন খানিকটা ভিজল বৈকি। মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেন? কি চাইছে সে?

কাবির ইথিকাকে মায়ের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,

“ওকে মানুষ করো আজ থেকে। ও কথা দিচ্ছে সংসারী হবে। দিয়েছ কথা?”

ইথিকা কাঁদতে লাগল। লুবনা বেগম কাবিরকে শান্ত করানোর জন্য বলল,

“আচ্ছা আমার উপর ছেড়ে দাও ওকে। তুমি যাও।”

কাবির ইথিকার কান্নারত মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে দ্রুত সরে পড়ল। বাড়ি ফিরল না সারাদিন। তার অফিসে নেয়েখেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। কিছু হিসেব মেলানোর দরকার ছিল।

রাতে বাড়ি ফিরল। ততক্ষণে বাড়ির পরিবেশ শান্ত। রাতের খাবার সাজিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে তার জন্য। খাবার টেবিলে কেউ ইথিকার ব্যাপারে কথা তুললো না। কল্পনার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা চললো।

__________

বড় জেঠা কল্পনার বিয়ে নিয়ে ভাবছেন এটা শোনার পর থেকে কাবিরের মাথায় শুধু একটাই নাম ঘুরছে “জোসেফ”। ও কল্পনাকে পছন্দ করে। কথায়, ইশারায়, ইঙ্গিতে সবকিছুতে কাবির এটা লক্ষ করেছে। কিন্তু কল্প কি চায়? সে জোসেফকে কি পছন্দ করে না?

কাবির খেতে খেতে মৃদুস্বরে বলল,”পাত্র আমার কাছে আছে। বড় জেঠা চাইলে বলতে পারি।”

কামরান দেওয়ান বললেন,

“আমি তোমার সিদ্ধান্ত কখনো হতাশ হয়েছি?”

কাবির ধীরেসুস্থে বলল,”আমার জোসেফকে ভালো লাগে।”

কল্পনা তার নাম শোনামাত্রই চমকে গেল। কাবির বলল,”যদিও ওর পরিবার সম্পর্কে কিছু জানিনা। কিন্তু বিশ্বাস আছে ওর পরিবারও ভালো হবে। কারণ মানুষের কথাবার্তায় বোঝা যায় সে কেমন পরিবারের সন্তান।”

কলিমউদ্দিন দেওয়ান বলল,”তার কাছে তো আমার এক জীবনের ঋণ। তার জন্য আবার কামরানকে ফিরে পেয়েছি। নইলে ওরা কি হাল করতো ওর!”

কল্পনা মনে মনে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করল। আসলেই তো। ওই মানুষটা বুদ্ধি কাটিয়ে কাজটা না করলে বাবা আজ তাদের মাঝে থাকত? খানরা এমন অনেক মানুষকে খুন করে তার প্রমাণ মুছে দিয়েছে। কেউ কিছু করতে পেরেছে? বাবাকে মেরে অস্বীকার করলে তাদের কি করার ছিল? মাজহাব ভাইকে খুন করে চিহ্নও রাখেনি। যদিও সেই খুনের কথা তার স্বীকার করে কিন্তু প্রমাণ কোথায়?

“কল্প?”

দাদাভাইয়ের ডাকে কল্পনার হুঁশ ফিরল।

“জি দাদাভাই।”

“তোমার জোসেফকে কেমন লাগে?”

কল্পনা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কাবির, কাদিন, কাসেদ কেউ তার দিকে তাকিয়ে লজ্জা দিল না। কল্পনা আমতাআমতা করে সেখান থেকে সটকে পড়ল। বড় ফুপু হেসে উঠে বলল,

“মেয়ে লজ্জা পেয়েছে।”

কাবির বলল,”আমি জোসেফের সাথে কথা বলব তাহলে।”

কামরান দেওয়ান তাকে খুশি করতে তার মতামতকে সম্মান করল। মেজাজ শান্ত হয়েছে এই বেশি। এত অশান্তি আর ভালো লাগেনা।

______

খাওয়াদাওয়া শেষ করে কাবির যখন শুতে গেল তখন দেখল লুবনা বেগম ভাতের প্লেট নিয়ে বেরোচ্ছেন। অর্ধেক খেয়েছে বাকিটা খায়নি আনঝিল। সবসময় এভাবে খাবার নষ্ট করে।
কাবিরকে দেখে লুবনা বেগম থমকে গেলেন। কাবির মাকে দেখে অবাক হয়ে গেছে। সকালে তিনিই চাচ্ছিলেন না আনঝিল তার জীবনে থাকুক। অথচ এখন চোখের জল দেখে গেলে গেছেন।

কাল যে মেয়ে তাকে অপমান করেছে বাজেভাবে সেই মেয়েকে তিনি আজ খাওয়াচ্ছেন নিজ হাতে। মাকে দেখে কাবিরের মাঝেমধ্যে রাগ হয়। মা কেন এত সহজে মানুষের দেয়া আঘাত ভুলে যায়? মায়ের মতো সে যদি সবার সব বাজে কথাগুলো ভুলে যেতে পারত? যায় না এমনও না। কিন্তু মায়ের মতো তৎক্ষনাৎ ভালো আচরণ করতে পারে না। মায়ের কাছে সে ফেল এটা অস্বীকার না করে উপায় নেই।

“আমি ওকে খাইয়ে দিয়েছি। তুমি আর কিছু বলো না ওকে।”

কাবির চুপচাপ মাথা নাড়ল। লুবনা বেগম চলে যেতেই কাবির ঘরে পা রাখল। ইথিকা তার দিকে তাকাল। লুবনা বেগম হয়ত তাকে মাথাভর্তি তেল দিয়ে খোঁপা পাকিয়ে সারাদিন ঘুম পারিয়ে রেখেছে। চোখদুটো ফোলা ফোলা লাগল। হেয়ার কাট দেয়ায় চুল সমান না তাই খোঁপা খুলে চুল তরেতরে নেমে এসেছে।

কাবির তার দিকে না তাকিয়ে জোসেফকে ফোন করল। তাদের মধ্যে আধঘন্টার মতো কথা হলো। কথা বলা শেষে কাবির খুশিমনে বলে ফেলল,

“জোসেফ তার পরিবার নিয়ে কাল পরশু আসছে।”

বলতে বলতে ইথিকাকে চোখে পড়ামাত্রই হাসি হাসি চেহারাটা মলিন আর গম্ভীর হয়ে এল। চোখ সরিয়ে সোজা বিছানায় ঘুমাতে চলে গেল সে। ইথিকা কিছু নিজ থেকে জানতে চাইল না। না বলতে চাইলে জিজ্ঞেস করবে কেন?

কাবির বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। ইথিকার সাথে কোনোরূপ কথা বললো না। ইথিকাও আগবাড়িয়ে তার সাথে কথা বললো না।

ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই কাবির অভ্যাসমতো শোয়া থেকে উঠে গেল। যদিও অন্যদিনের তুলনায় দেরীতেই ঘুম ভেঙেছে।

ইথিকা তখনো ঘুম। কাবির আলো জ্বালায়নি।

ফ্রেশ হয়ে ওযু করে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ল। নামাজ শেষে সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত শেষ করে বিছানায় নড়াচড়া টের পেয়ে দেখল ইথিকা ঘুমঘুম চোখে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

কাবির নামাজ শেষ করে উঠে গেল। জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে ইথিকার দিকে তাকাল। ইথিকা এখনো চেয়ে আছে। কাবির জায়নামাজটা জায়গামতো রেখে মাথার টুপি খুলে হাতে নিয়ে কপাল উঁচিয়ে বলল,

“নামাজ কালাম জানো?”

ইথিকার মুখ চুপসে গেল। হ্যাঁ জানতো। প্র্যাক্টিস না থাকায় ভুলভাল হয়ে যায়। সেটা এভাবে জিজ্ঞেস করার কি দরকার? মেয়েরা সব পারে। সেও সব পারবে।

কাবির তার চাহনি দেখে কটাক্ষের সুরে বলল,

“এভাবে না তাকিয়ে কাল থেকে সময়মতো উঠে জায়নামাজ বিছানোর দায়িত্ব নিলে খুশি হবো।”

ইথিকা এখনো চেয়ে আছে। কাবির টুপি রেখে দিয়ে ভেজা চুল ঝেড়ে বলল,

“আমি যথেষ্ট সুন্দর সেটা জগত জানে।”

ইথিকা মুখ ঝামটি মেরে বলল,

“নিজের প্রশংসা নিজে করছে। লজ্জা নেই।”

“কার?”

কাবিরের প্রশ্নের ধরণে ইথিকা আরও চটে গেল। বলল,”আমারও নেই। আমার বরেরও নেই।”

কাবির আওয়াজ ছাড়াই ছাড়াই হাসল। ইথিকা সোজাসাপটা বলল,

“আমি ভুলভাল নামাজ জানি। শিখতে হবে আগে। না শিখে ভুলভাল পড়ে আপনার হাসির খোরাক হতে চাই না।”

বলেই লজ্জায় চোখ ঘুরিয়ে নিল অন্যত্র। কাবির মনে মনে হাসল। তাকে অমন করে ঠোঁটের কোণা টেনে হাসতে দেখে ইথিকার রাগ হলো। হনহনিয়ে বিছানা থেকে নেমে ধপধপ পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমের দিকে এগোবে তার আগেই টেবিলের কোণার সাথে তার বুড়ো আঙুলের সংঘর্ষ। হুমড়ি খেয়ে কাবিরের দিকে ঝুঁকে পড়তেই কাবির তার দিকে বাম হাত বাড়িয়ে দিল। ইথিকা বাম হাতটাকে সম্বল বানিয়ে কোনোমতে পড়ে যাওয়া থেকে আটকালেও আঙুলের ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠল।

কাবির তার খামচে ধরা বুকের জায়গায় তাকিয়ে বলল,

“আগে রাক্ষসীর বেশভূষা ছাড়ো। তারপর মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো।”

ইথিকা ব্যাথা ভুলে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“রাক্ষসীর বেশভূষা নিয়েছি আমি?”

“তা নয়ত কি? এত বড় বড় নখ মানুষে রাখে? এই নখ আর নেইলপালিশ নিয়ে নামাজ হবে না। গলার পাশে একটা ট্যাটুও দেখেছি।”

ইথিকা চুপসে গেল। বুড়ো আঙুলটা টনটন করছে। কাবির বলল,

“মানুষ হোঁচট কখন খায় জানো?”

“কখন?”

“কেউ মনে মনে গালি দিলে।”

ইথিকা তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

“গালিবাজ লোক।”

সে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। কাবির বলল,

“রাতে নখ গেঁথে দিয়েছ আমার গলায়। এখন বুকে।”

ইথিকা তার দিকে ফিরে বলল,

“কলিজায় গাঁথা বাকি। রক্ত চুষে খাব। রাক্ষসী উপাধি দিয়েছেন না?”

কাবির তার পায়ের আঙুলকে লক্ষ করে বলল,

“নিজের রক্ত নিজে খাও। মেঝে ভেসে যাচ্ছে।”

ইথিকা পায়ের দিকে তাকিয়ে রক্ত দেখে চেঁচিয়ে উঠল। নখ উল্টে গেছে। তাই এত রক্ত!

কাবির বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ইথিকা পায়ের আঙুলটা ধরে বসে থাকল। চোখে জল নামল। কিন্তু সে তা মুছে নিল পড়ার আগেই।

কাবির কিছুক্ষণ পর এল। ইথিকা ঠাঁই বসে রইল। কাবির বলল,”উঠো।”

ইথিকা উঠল না। চলে গিয়েছে যখন আবার এল কেন? তার কারো সাহায্য দরকার নেই।

কাবির তাকে আরও কয়েকবার বলল। শেষে ইথিকার মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করল,

“তুমি চাইছ আমি তোমাকে কোলে নিয়ে বসাই?”

ইথিকা বলল,”না নিতে পারলে ওসব মাথায় আনেন কেন?”

কাবির বলল,”তুমি মস্তবড় সেয়ানা।”

ইথিকা আবারও ব্যাথায় ঠোঁট বাঁকাল। কাবির তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। আঙুলটা মুছে দিয়ে তুলো দিয়ে এন্টিস্যাপ্টিক ক্রিম লাগিয়ে দিতে দিতে ইথিকার দিকে তাকাল। ইথিকাকে চেয়ে থাকতে দেখে গর্ব করে বলল,

“আমি নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ। সবসময় ভালো কাজ করি।”

ইথিকা পা’টা নিজের দিকে টেনে এনে বলল,

“তাই তো থেকে গেছি।”

কাবির কপাল কুঁচকে তাকাল। ইথিকাও সেইভাবে কপাল কুঁচকে তাকাল।

“আপনি এত অল্প হাসেন কেন?”

কাবিরের জবাব,”কারণ নেই তাই।”

______________________

কল্পনা আগে শাড়িটাড়ি কেনেনি কখনো। সে সেলোয়ার-কামিজ পরে অভ্যস্ত। পাত্রের মা বোনের সামনে কোন শাড়িটা পরবে ঠিক করতে পারছিল না। কোনোটাই তার পছন্দ হচ্ছে না। মোটকথা তার নতুন শাড়ি কেনার শখ জেগেছে। লুবনা বেগম শেষমেশ বলল,

“তোর ভাবির কাছে দেখ।”

কল্পনা সোজা না করে দিল। ওই মেয়ের কোনো জিনিস সে নেবেনা। লুবনা বেগম বললেন,

“আচ্ছা, আমি কাদিনকে বলছি তোদের যেন মার্কেটে নিয়ে যায়।”

কথাটা বলার সময় কোথাথেকে যেন কাবিরও চলে এল। কাবির বলল,

“আনঝিলের অনেক শাড়ি আছে। ওর কাছ থেকে নাও।”

কথাটা সে বলেছে যাতে ইথিকার সাথে কল্প কিরণ সহজ হয়। ইথিকার সাথেও তাদের একটা বন্ডিং হয়। লুবনা বেগম এই ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন। তাই তিনিও ছেলের মন যোগাতে কল্পনাকে ইশারা করলেন ইথিকা সম্বন্ধে কিছু না বলতে। আর শাড়ি নিতে রাজী হতে। কল্পনাও কাবিরের কথায় হ্যাঁ বলল। সেখানে ইথিকা এল কিছুক্ষণ পর। কাবির বলল,

“কল্পকে তোমার শাড়ি গুলো দেখাও। ওকে দেখতে আসবে আজকে।”

ইথিকা খুশিমনে মাথা দুলিয়ে বলল,”ওকে।”

তার পিছু পিছু কল্পনা আর কিরণ ফিসফিস করতে করতে গেল। তাদের একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না ওর কাছ থেকে শাড়ি নিতে। ইথিকা তার সব শাড়ি বের করে দিল। সবগুলোই সুন্দর। কিন্তু যেগুলো কল্পনার পছন্দ হয়েছে সেই শাড়িগুলো পাতলা। ব্লাউজের গলা বড়, নয়ত স্লিভলেস ব্লাউজ। ইথিকা জানতে চাইল,

“পছন্দ হয়নি?”

কিরণ বলল,”এই ধরণের ব্লাউজ আপু পরেনা।”

ইথিকা বলল,”ওহ।”

কল্পনা বলল,”বড় ভাইয়ের সামনে বলতেও পারব না এখন।”

ইথিকা জানতে চাইল,”কেন?”

কল্পনা বলতে চাইল না। কিন্তু শেষমেশ বলে ফেলল।

“উনি মনে করবেন আমি তোমার শাড়ি পছন্দ করছিনা। মানে দোষটা ঘরের মানুষকেই দেবেন উনি।”

ইথিকা ব্যাপারটা বুঝতে পারল। তারপর হঠাৎ বলে উঠল,

“আচ্ছা কোনো ব্যাপার না। আমি কাবিরকে গিয়ে বলছি।”

কল্পনার বারণও শুনল না সে। সোজা কাবিরের কাছে চলে গেল। কাবির কামরান দেওয়ানের সাথে জরুরি কথা বলছিল। তাকে দেখামাত্র কামরান দেওয়ানের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। কাবির জানতে চাইল,

“কোনো সমস্যা?”

“ওরা মার্কেট থেকে নতুন শাড়ি কিনে আনুক। আমার ব্লাউজ পিস কল্পর সাথে যাচ্ছে না।”

কাবির রাজী হলো। মাথা দুলিয়ে বলল,

“ঠিক আছে। কল্পকে ডাকো।”

ইথিকাকে চলে গেল। কল্পনাকে পাঠাল। কল্পনা ড্রয়িংরুমে এসে কাবিরকে বলল,

“ভাইয়া ডেকে পাঠিয়েছিলেন?”

কাবির কথার মাঝখান থেকে তাকে বলল,

“মার্কেটে আনঝিলকে সাথে করে নিয়ে যাও।”

কল্পনা মৃদুস্বরে বলল,”হুম।”

তারপর ঘরে এসে কিরণ আর সে চুপিচুপি কথা বলছিল, তখনই লুবনা বেগম দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলে উঠলেন,

“কাবির যা বলে তাই করো। পরে ভাববে আমরাই তার বউকে আপন করতে পারছিনা।”

কিরণ চমকে গেল মাকে দেখে। রাগ নিয়ে বলল,”এখন ওই মহিলাকে আমাদের সবকিছুতে ইনভলভ করতে হবে বড় ভাইয়ের খুশির জন্য?”

“হ্যাঁ, করতে হবে।”

___

মার্কেটের উদ্দেশ্যে বেরোনোর সময় ইথিকা কাবিরকে দেখতে পেল বাইরে। কাবির ড্রাইভারকে সবটা বুঝিয়ে দিল। তারপর ইথিকার দিকে শাড়ি কেনার টাকাপয়সা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“শাড়ির সাথে যা যা লাগে সব কিনে দেবে ওদের।”

কিরণ তা দেখে রেগে গেল। কল্পনাকে বলল,

“এখন বউয়ের হাতে টাকা দিচ্ছে। এর মূল্য দেবে ওই মেয়ে?”

ইথিকা টাকাগুলোর দিকে চেয়ে বলল,

“কিন্তু আমাকে কেন?”

কাবির বলল,”যাচাই করার জন্য। মেরেটেরে দিলে অবশ্য অবাক হবো না।”

ইথিকা টাকাগুলো তার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তেই লুবনা বেগম তাকে আটকে ফেলল। কাবিরকে বলল,

“কি বলেছ আবার?”

কাবির নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল,

“টাকাপয়সা সামলে রাখতে বলেছি। হালালভাবে পয়সা রোজগার করতে কষ্ট আছে।”

বলেই ইথিকার রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণা টেনে হাসল। ইথিকা বলল,

“আমি যাব না। আপনার ছেলে বলছে আমি নাকি টাকা মেরে দেব।”

লুবনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,”কাবির!”

কাবির বলল,”না যেতে চাইলে জোর নেই। কল্প আর কিরণ একাই পারবে। ওরা আগেও একা একা শপিং করেছে।”

ইথিকা কি যেন ভেবে আবারও এগিয়ে এল। টাকাগুলো কাবিরের পকেট থেকে চোঁ মেরে নিয়ে নিল। তারপর ত্যাড়ছাভাবে বলল,

“টাকা ফেরত এলে একটা টাকাও দেব না।”

“বিড়াল মাছ ফেরত দেবে এই আশায় বসে থাকেনা কাবির দেওয়ান।”

ইথিকা মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল কল্পনা আর কিরণকে নিয়ে।

_______

শাড়ির দোকানে বসে কল্পনা আয়নার সামনে একটা একটা শাড়ি মাথায় দিয়ে দেখছিল। সে দুটো শাড়ি নেবে। ইথিকা আয়নায় কল্পনাকে দেখছে। এই মেরুন শাড়িটা কল্পনাকে মানিয়েছে। সে কিছু বলতে যাবে তখুনি আয়নায় আশিষ খানকে দেখা গেল। মিউজিক নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুণ তাকো সচারাচর পাওয়া যায় না। আজ সে এখানে কি করছে? তাকে নিয়ে যেতে? মেঝ ভাইয়া পাঠিয়েছে? কল্পনা আয়নায় দেখল আশিষ খান হনহনিয়ে হেঁটে এসে ইথিকাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

ইথিকাকে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে আশিষ খান। ইথিকা চেঁচাচ্ছে। সে যেতে চাইছেনা। কল্পনা ঘোমটা সরিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগে ইথিকা আর নেই। আশিষ খান তাকে নিয়ে গেছে। তার পরিবর্তে আর্যাব খান এসে দাঁড়িয়েছে। সে এদিকওদিক তাকিয়ে ইথিকাকে খুঁজছে হয়তো। কিরণ তাকে দেখামাত্র লুকিয়ে পড়ল। এখানে অসভ্যতামি শুরু করে দেবে এখন। কল্পনাও ঘোমটা আরও টেনে দিয়ে শাড়িটা নড়াচড়া করতে লাগল। দূর হোক তাড়াতাড়ি। ভাবিকে বোধহয় নিয়ে যেতে এসেছে সবাই মিলে।

কিছুক্ষণ পর ঘোমটার আড়াল হতে তাকাতেই কল্পনা দেখল আর্যাব খান সরু চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে। কল্পনা ঘোমটা আরও টানতেই আর্যাব খান চোখ সরিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল। কল্পনা ঘোমটা ফেলে দিল। কিরণকে ডাকবে তক্ষুণি দেখল আর্যাব খান এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক আগের জায়গায়। কল্পনা হকচকিয়ে গেল। আর্যাব খান বদমায়েশি হেসে কল্পনার দিকে আঙুল তুলে বলল,

“এই বেয়াইন! দেখে ফেলেছি কিন্তু।”

কল্পনা বিড়বিড়িয়ে গালি দিল। তারপর দোকানদারকে বলল, শাড়ি দুটো প্যাক করতে। দোকানদার প্যাক করে দিতেই কিরণ বলল,

“আপু টাকা তো ভাবির কাছে।”

কল্পনা ফোন নিয়ে ইথিকাকে ফোন দিল। ফোনটা বাজল কিরণের পাশে শাড়ির ভাঁজের উপর। কল্পনা শাড়িদুটো করে বলল,

“এগুলো রাখুন। আমি টাকা নিয়ে আসি।”

বেরোনোর সময় আর্যাব খান পথ আটকে দাঁড়াল। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলল,

“ওই মাল দে।”

কল্পনা বলল,”কোনো দরকার নেই।”

আর্যাব খানের ধমকে দোকানদার শাড়ি দুটো এনে দিল। টাকা দিয়ে দিল আর্যাব খান। কল্পনা আর কিরণ চুপ। এসব নাটক সহ্য হচ্ছে না। ভাবির কাছ থেকে নিয়ে মুখে ছুঁড়ে মারবে সে টাকাগুলো। নইলে শাড়িগুলো সে পরবে না।

আর্যাব খানের পিছু পিছু দোকান থেকে বেরিয়ে এল দুজন। আর্যাব খানের ফোন বেজে উঠল তখুনি। কল রিসিভ করে সে বলল,

“হ্যাঁ হ্যাঁ টাকা দিয়ে দিয়েছি। দুটো আট হাজার। আর দুই হাজার যে দায়িত্ব নিয়ে পেমেন্ট করেছে তার।”

কল্পনার রাগ তরতরিয়ে বাড়ল। সে থেমে গেল। পায়ের আওয়াজ থেমে যেতেই আর্যাব খান ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। কান থেকে ফোন নামিয়ে পকেটে পুরতে পুরতে তার চিরাচরিত হাসিটা দিয়ে বলল,

“আর্যাব খান সবসময় পকেট গরম করতে ভালোবাসে। পকেট খালি করার তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। আপনি ভাববেন না আমি পে করে দিয়েছি। পে করেছে আপনার ভাবি। তার হাত থেকে টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে এই ছিনতাইকারী। দশ হাজার টাকা থেকে আট হাজার মাইনাস। বাকি দুই হাজার এই তো।”

বলেই দুহাজার টাকা বের করে সে দেখাল। তারপর নিজের পকেটে টাকাগুলো ভরে নিতে নিতে বলল,

“পকেট এবার বেশ খোশমেজাজে আছে। আপনারা চাইলে আমি তিন বোতল কিনে আনতে পারি। মাতলামি করতে করতে দেওয়ান বাড়ির পথে যাত্রা। বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার স্যাপার। ভাবতেই নেশা নেশা লাগছে।”

বলেই ঠোঁট কামড়ে হাসল। কল্পনা কিছু বলতেও পারছেনা রাগে। জুতো খুলে মুখে ছুঁড়ে মারতে পারলে রাগটা কমতো। আর্যাব খান কিরণকে বলল,

“ছোটে বেয়াইন সাহেবা দু হাজার টাকা থেকে দুশো টাকা আপনাদের জন্য মাইনাস না করলে বাকি আঠারোশো টাকা আমার পেটে হজম হবে না। আমাকে দুশো টাকা খরচ করতে দিয়ে উপকার করুন।”

কিরণও চুপ। দুজনেই রাগে ফাটছে। কিন্তু কিছু বলছেনা। কল্পনা কিরণকে নিয়ে শেষমেশ বেরিয়ে এল। আর্যাব খান ডাকল,

“বেয়াইন এত রাগ করলে কিন্তু অভিমান হয়। কান্না পায়। বড়ো দুঃখ লাগে।”

কল্পনা বিড়বিড়িয়ে বলল,”গাড়ির নীচে পিষে মর।”

চলমান…

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ইথিকাকে ছাড়াই অনেক কষ্টে বাড়ি ফিরল কল্পনা আর কিরণ। আর্যাব খানের হাত থেকে কোনোমতে পালিয়ে এসেছে তারা। কী বেয়াড়া, নির্লজ্জ মানুষ! কল্পনার ইচ্ছে করছিল ওই ঘুষখোর পুলিশটাকে জুতো খুলে পেটাতে। জীবনে এত গায়েপড়া দুর্নীতিপরায়ণ বেহায়া পুলিশ অফিসার দেখেনি সে। রাগে, ঘেন্নায় গা ছমছম করছে তার।

বসার ঘরে বসে সবাই কথাবার্তা বলছিল। কাবিরও সেখানে বসা। তারা ঘরে ঢুকতেই কাবির চোখ তুলে তাকাল। কল্পনার পিছুপিছু কিরণ ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করছিল। অমন সময় কাবির প্রশ্ন করল,

“আনঝিল কোথায়?”

কল্পনা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। কোনো রাখঢাক না রেখে সবটা খুলে বলল। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল,

“দুই হাজার টাকা আর ফেরত দেয়নি। পকেটে ভরে নিয়েছে। অথচ শাড়ির দাম এসেছে আট হাজার।”

কাবিরের কপাল কুঁচকে গেল। সেখানেও আর্যাব খান? এরা এবার যা তা শুরু করে দিয়েছে। তাদের জন্য বাড়ির মেয়েরা কি বাড়ির বাইরেও বেরোতে পারবে না?

কিরণ গম্ভীর গলায় বলল,

“আমার মনে হচ্ছে, ভাবিকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেছে ওরা। আর্যাব খান কাল যেভাবে জোর করছিল, তার সাথে না যাওয়ায় রাগ হয়ে থাকতে পারে। তাই এখন ভাবিকে তুলে নিয়ে গিয়ে বকাঝকা করবে।”

কাবিরের মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। চোখ দুটো উত্তাপে জ্বলছে। পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত কল দিল ইথিকাকে। দীর্ঘ সময় ধরে রিং হলো। কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না। কপালটা আরও কুঁচকে উঠল তার। কিরণের দিকে জানতে চাইল,

“কে কে ছিল ওখানে?”

কিরণ বলল,”আর্যাব খান আর আশিষ খান,”

কাবির ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর কল রিসিভ না হওয়ায় আর কিছু না বলে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল।

কল্পনা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে সোফায় বসতেই, লুবনা বেগম এসে দাঁড়ালেন সামনে।

“তোদের ভাবি কোথায়?”

কল্পনা বিরক্ত মুখে বলল, “ওর ভাইরা নিয়ে গেছে। আমি এজন্যই ওকে নিয়ে বেরোতে চাইনি। ওর ভাইগুলো কুত্তার মতো ঘেউঘেউ করে আমাদের দেখলে।”

কল্পনার রাগী রাগী চেহারা দেখে লুবনা বেগম টের পেলেন ইথিকার ভাইরা কেউ ওকে বাজে কথাটথাও বলেছে। অতবড় বড় বড় দামড়া ছেলেগুলোর কি আক্কেল জ্ঞান বলতে কিছু নেই? ওদের কি কেউ শাস্তি দিতে পারেনা? দুনিয়াটাই যেন অন্যায়ের পক্ষে রায় দিচ্ছে আজকাল। এত অন্যায় করেও এরা দিনদুপুরে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে বড্ড আশ্চর্য লাগে উনার।

কল্পনা শাড়ি দুটো বের করে বলল,”ভালো হয়েছে?”

“দাম কত নিয়েছে রে?”

“একটা চার হাজার। বাকি দু হাজার ফেরত দেয়নি আর্যাব খান।”

বলতে বলতে আবারও রাগে ফেটে পড়ল কল্পনা। লুবনা বেগম বললেন,

“থাক বাদ দে। ওদের সাথে তর্কে যাবে কে? ইথিকা নিয়ে নেবে পরে। কাবির কোথায় গেছে?”

কিরণ বলল,”জানিনা। মনে হয় খান বাড়িতে যাবে। বড় ভাই আজকাল বউকে চোখে হারাচ্ছে।”

লুবনা বেগম ধমকে উঠেন,

“বড় ভাই সম্পর্কে এসব কেমন কথা কিরণ?”

কিরণ চুপ করে গেল। সে কল্পনার মতো সচরাচর রাগ করেনা। কিন্তু রাগ করলে তা সহজে কমে না। এমনকি যার উপর রাগ করে তাকে সে ভালোই এড়িয়ে যেতে পারে। তাই মাকেও সেভাবে এড়িয়ে গেল সে।

_________

গাড়ি ছুটে চলেছে ফাঁকা রাস্তায়। চারদিকের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। পশ্চিম আকাশে সূর্যরশ্মির শেষ ছটা। কাবির স্টিয়ারিং চেপে ধরে রেখেছে শক্ত হাতে। চোখদুটো তীক্ষ্ণ, কপাল জুড়ে গভীর চিন্তার ভাঁজ, মুখটা থমথমে।

হঠাৎ ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠল “আর্যাব খান।”

কাবির বুঝে গেল ঘুষখোরটা এখন সস্তা রসিকতা শুরু করবে। চোখদুটো বিরক্তিতে বুঁজে এল তার। কলটা কেটে দিতে গিয়েও কাটল না সে। ইথিকা কোথায়, কেন তাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা জানতে হলে তাকে আর্যাব খানের সাথে কথা বলতে হবে। কলটা রিসিভ করে সে ঠান্ডা গলায় সরাসরি বলল,

“তোর বোন কোথায়?”

আর্যাব খান বলল,”আছে খান বাড়ির চিপায়চাপায়। বরের জন্য কাঁদছে। এত অল্প সময়ে আমার সাধাসিধা বোনটাকে পটালে কি করে বলোতো?”

কাবিরের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কেন যেন সে এসব রসিকতা একদম নিতে পারেনা। এই আর্যাব খানের সাথে তার কথায় বলতে ইচ্ছে করেনা। কাবির কাঠকাঠ গলায় বলল,

“আমি ওকে আনতে যাচ্ছি। ওকে নিয়েই ফিরব।”

আর্যাব খান হেসে বলল,

“এই না হলে খান বাড়ির জামাই। বউ ছাড়া তার এক মিনিটও চলবে না। বউসোহাগা বর। আই লাইক ইট।”

কাবির ফোনটা নির্বিকার ভঙ্গিতে কেটে স্টিয়ারিংটা সে আরও শক্ত করে চেপে ধরল। ঠোঁটদুটো কঠিনভাবে আঁটসাঁট করে চেপে ধরে রেখেছে। তার ভেতরে বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকল। এমন একদিন আসবেই যেদিন খান পরিবার নামক অভিশাপটা তাদের জীবন থেকে চিরতরে মুছে যাবে। সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়, আর সেই দিনই তারা প্রথমবারের মতো বুকভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে।

________

কাবিরের গাড়ি গিয়ে থামল খান বাড়ির সামনে। বিশাল লোহার গেট। গেটে আঁকা খান পরিবারের মনোগ্রাম। দুটি খোদাই করা অক্ষর, ‘KH’। গেট খুলতেই চোখে পড়ল দীর্ঘ প্রাইভেট ড্রাইভওয়ে। দুপাশে ফুলগাছে ঘেরা। ঝকঝকে পাথরের পথ।

বাড়িটা তিনতলা। জানালাগুলো ফ্লোর টু সিলিং গ্লাস। বাড়ির ভেতরের ঝলমলে আলো দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। ঝরনা সিস্টেমে পানি পড়ে চলেছে সুবিশাল সুইমিং পুলে। নীল পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে বাড়ির ঝিলমিল আলো। সুইমিং পুলের চারপাশে মার্বেলের ফ্লোরিং, রিক্লাইনার চেয়ার, বড় বড় ছাতা।

নিশ্ছিদ্র নকশায় গড়া বাড়ির এক কোণে ছোট্ট একটা বারকোণ। আধুনিক সাজসজ্জায় সাজানো ঝলমলে আলোয় ঝকঝক করছে বারটা। নামী-দামি ব্র্যান্ডের মদের বোতল সারি সারি সাজানো আছে সেখানে। সকাল বিকাল উচ্ছ্বাস আর উৎফুল্লতায় তারা সেসব খায় আর মাতলামি করে। কাবিরের চোখে এই বাড়িটা একটা সাজানো-গোছানো জাহান্নামের মতো।

এই বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থের ভিত্তির উপর। দুর্নীতির কালো টাকা, ঋণ খেলাপের পাপবিদ্ধ সম্পদ, আর মানুষের হক মেরে নেওয়া নোংরা সম্পদের স্তুপ এই বাড়িটা। অবৈধ পয়সার ওপর ভর করেই চলে এদের এই বিলাসবহুল, জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন। বাইরে থেকে ঝলমলে, ভেতরে পঁচা ও বিবর্ণ।

কাবির ভেতরে পা রাখতে না রাখতেই দেখতে পেল বাড়িতে নতুন দুজন কাজের লোক রাখা হয়েছে। কোনো মহিলা এই বাড়িতে কাজ নিতে চায় না এই খান বাড়ির চার বাঁদরের ভয়ে। বড়লোকের বখাটে ছেলেগুলোর চরিত্র নিয়ে বড় সংশয় আছে। এরা যা ইচ্ছে করতে পারে যেকোনো মেয়ের সাথে। নিজের মা আর বোন ছাড়া অন্য মেয়ে মানুষ তাদের চোখে মানুষই না।

আর্যাব খান ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। কাবিরকে দেখামাত্রই সে তড়িঘড়ি করে নীচে নেমে এল। কাবিরের সামনে এসে দাঁড়ানোর পর তার মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠল। কাবির তার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আনঝিলকে ডাক।”

আর্যাব খান এগিয়ে এসে বলল,

“নেই ও।”

“কোথায়?”

“হাসপাতালে।”

কাবিরের গম্ভীর হয়ে বলল,

“একদম মশকরা করবি না। ওকে ডাক। কথা আছে।”

আর্যাব খান সোফায় বসল এক হাঁটুর উপর পা তুলে। পা নাচাতে নাচাতে বলল,

“প্রথম কথা ও হাসপাতালে। দ্বিতীয় কথা ও তোমার সাথে যাবে না আর। তোমার সাথে ও থাকতে চায় না। মানে দেওয়ান বাড়িতে ও আর ফিরবে না।”

কাবির এবার গর্জে উঠল,

“ওকে হাসপাতালে যেতে হলো কেন? বাড়ি থেকে সুস্থ শরীরে বেরিয়েছিল।”

আর্যাব খান ঠোঁট হাসল। জবাব দিল না। সিগারেট ধরাল। ধোঁয়ায় নাকমুখ ভরিয়ে তুলে বলল,

“মেরেছি। বড্ড বাড় বেড়েছে। মেরে কপাল ফাটিয়ে দিয়েছি। আমাকে অপমান? ও জানেনা আমি রেগে গেলে তখন আর ওর ভাই থাকিনা। বদমাশ মেয়ে। দুদিন হয়েছে বিয়ে হয়েছে। এরিমধ্যে কোলেপিঠে করে মানুষ করা ভাইদের চিনতে পারছেনা। দিয়েছি ইচ্ছামত।”

কাবিরের মুষ্টি শক্ত হয়ে এল। দাঁতে দাঁত চেপে সে আর্যাব খানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। আর্যাব খান তার দিকে চেয়ে হেসে বলল,

“তুমি চাইলে তোমার বউকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসতে পারো। ওখান থেকে তোমার বউ তুমি নিয়ে যাও। এই বাড়িতে ওই মেয়ের আর জায়গা নেই।”

কাবির হন্তদন্ত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখুনি দেখল একটা গাড়ি এসে থেমেছে খান বাড়ির ড্রাইভওয়েতে। গাড়ি থেকে নামছে ইলিনা বেগম, আসলাম খান আর আমিন খান। ইলিনা বেগম ইথিকাকে ধরে রেখেছে। ইথিকার গায়ে একটা সাদা সেলোয়ার-কামিজ। বাড়িতে এটা পরেছিল সে। সবার চেহারা মলিন। কাবিরকে দেখে ইথিকাও কিছুক্ষণ থমকে গেল।

আমিন খান তাকে বলল,”কবে এসেছ দেওয়ান?”

“এইমাত্র।”

“ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কপাল ফেটেছে। আমি চাই ও কিছুদিন থাকুক এই বাড়িতে। চলো ভেতরে গিয়ে বসি।”

ইলিনা বেগম ইথিকাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে। কাবির আমিন খানের সাথে হেঁটে আবারও ভেতরে গিয়ে বসলো। আর্যাব খান এককোণায় বসে সরু চোখে সবাইকে দেখছে। ইথিকা তার দিকে একবারও তাকায়নি। চোখদুটো লালচে। থমথমে চেহারা। আর্যাব খান তাকে দেখতে দেখতে হাসল। আজকাল জম্পেশ মার দিচ্ছে সে। এক চড়ে ইথুরাণী বেকায়দায় ছিটকে পড়ে কপাল ফাটিয়ে ফেলল। ইন্টারেস্টিং! ওর বর তাকে যে চড় মেরেছে তার শোধ নেয়া শেষ। আর্যাব খান একটু ডিফরেন্ট ওয়েতে রিভেঞ্জ নিতে ভালোবাসে। নিয়েছেও। মনে মনে সে ভীষণ হাসল।

কাবির সৌজন্যেতার খাতিরে সোফায় বসেছে। চেহারা গম্ভীর। আমিন খান ব্যবসায়িক কথাবার্তা তুললো। এমনকি এটাও জানাল যে, নতুন কোম্পানির শেয়ারটা তারা ইথিকার জন্য কিনে নিয়েছে। যেহেতু তার ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চ সায়েন্টিস্টের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এতে কাবিরের আপত্তি থাকলে তা যেন বলে।

কাবির চোখ তুলে একপলক ইথিকার দিকে তাকাল। ইথিকার সাথে চোখাচোখি হতেই কাবির বলল, এসব বিষয়ে সে ইথিকার সাথে পরে কথা বলবে। আপাতত সে বাড়ি ফিরবে।

আসলাম খান বলল,”ও এখন যাবে না। আগে সুস্থ হোক। আমাদের পারিবারিক কিছু সমস্যা মীমাংসা হবে। তারপর সে ওই বাড়িতে যাবে।”

কাবির দাঁড়িয়ে পড়লো। ইথিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি থাকবে নাকি চলে যাবে?”

ইথিকা কিছু বলার আগে আসলাম খান বলল,

“যাবে না ও। তুই যা।”

কাবির সাথে সাথে রেগে গিয়ে বলল,

“তোর সাথে কথা বলছিনা আমি। আমাদের মাঝখানে নাক গলাবি না।”

আর্যাব খান হেসে উঠল। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলল,”তোমার বউকে যদি আমার হাতে আরও মার খাওয়াতে চাও তবে নিয়ে যাও।”

ইলিনা বেগম ধমকে উঠল।

“আর্য!”

আমিন খান রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। ইথিকা তার দিকে জলভরা চোখে চেয়ে থাকল। তারপর রাগ সংবর্ধনা করতে না পেরে রিমোট তুলে আর্যাব খানের দিকে ছুঁড়ে মারল। আর্যাব খান রিমোটটা খপ করে ধরে হো হো করে হেসে উঠল। বলল,

“এবার কপাল ফাটিয়েছি। পরেরবার মাথা ফাটাব। তাড়াতাড়ি ওই বাড়ি যাহ।”

ইথিকা তেড়ে গিয়ে সোফার কুশন নিয়ে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো আর্যাব খানকে। শেষমেশ আসলাম খান তাকে থামাল। ইথিকা ঝরঝরে কেঁদে উঠে বলল,

“আমি তোমাকে ভাই ডাকব না আর।”

আর্যাব খান তার কলার ঠিক করতে করতে গম্ভীর মুখে বলল,

“আমি বসে আছি তোর ভাই ডাক শোনবার জন্য।”

আসলাম খান বলল,”ওই ওকে সরি বল।”

আর্যাব খান হেসে উঠে বলল,

“আমার বউ মরলেও বলব না।”

ইলিনা বেগম বললেন,”তুমি কাজটা ঠিক করেছ? তোমার ছোট বোন হয়। আমি ওর গায়ে কোনোদিন হাত তুলেছি? তোমার সাহস কত আর্য!”

“অনেক সাহস।”

তন্মধ্যে কাবির ইথিকার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। এসব ফ্যামিলি ড্রামা সে আর নিতে পারছেনা। আসলাম খান বলল,

“আরেহ ওকে নিয়ে যাচ্ছিস কেন? থাম। কাবির!”

কাবির থামল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। বলল,

“আমার অনুমতি ছাড়া যদি ওকে আর কখনো তুলে আনিস তাহলে তোদের আমি….

ইথিকা চট করে বলল,”আমি যাব না।”

কাবির তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। ইথিকা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

“আপনি চলে যান। আমি কিছুদিন বাড়িতে থাকব। সুস্থ হলে তারপর।”

কাবির কপাল ভাঁজ করে খান বাড়ির সদস্যদের দিকে তাকাল। ওকে কি জোরজার করেছে এরা? যাতে তালাকটা হয় আর ব্যবসায়িক শর্তগুলো পূরণ হয়?

“এখানে থাকতে হবে না। চলো আমার সাথে।”

ইথিকা দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,”না। পরে যাব। এখন না।”

কথাগুলো সে নতমুখে বলছে চোখদুটো আড়াল করে। কারণ তার চোখ সত্যি কথা বলে। কাবির সবটা বুঝে গেল এবার। এরা কত নিকৃষ্ট! এখন নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য মেয়ের ঘর ভাঙছে যখন সে স্বেচ্ছায় ঘর করতে চাইছে। কাবির বলল,

“বেশ, তাই হোক। কিছুদিন পরও নয়। তোমাকে আর ওই বাড়ি ফিরতে হবে না।”

বলেই সে বেরিয়ে গেল। কিছুদূর যাওয়ার পর ফিরে চাইতেই ইথিকা তাকে পিছু করে দাঁড়াল।

“তুমি কিন্তু আর কখনো দেওয়ান বাড়ি ফিরতে পারবে না।”

ইথিকা বলল,”ফিরব না।”

কাবির চলে গেল। আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না।

পরদিন, কাবিরদের নতুন কোম্পানি “DK Nexa Pharmaceuticals” আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো। তার মধ্যে, খানদের শেয়ার ছিল ৪০ শতাংশ। প্রথম দিনের মিটিংয়ের প্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিল কাবির এবং কাওসার দেওয়ান, আর খানদের পক্ষ থেকে ছিল আমিন খান ও ইথিকা। কাবির ইথিকাকে দেখেও এড়িয়ে গেল। তাকাল না। কথা বলল না। শুধু হাতে হাত মিলিয়েছে। বৈধতা না থাকলে তাও করতো না। ইথিকা তার এড়িয়ে যাওয়া টের পেয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই।

শুরুতেই ফিতা কেটে ভেতরে প্রবেশ করেছে সবাই। দুটো ফিতার একটা কেটেছে কাবির অন্যটা ইথিকা। তখনো দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল অথচ দূরত্বটা অনেক বেশি।

মিটিংয়ের শুরুতে, কাওসার দেওয়ানের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে আমিন খান বললেন, “শর্ত অনুযায়ী কাজ হবে। তোমাদের সব শর্ত আমরা মেনেছি। আশা করি তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।”

কাওসার দেওয়ান আসন গ্রহণ করে শান্ত সুরে বলল, “দেওয়ানরা কখনো কথার খেলাপ করেনি। আজও করবে না।”

দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি সুষ্ঠুভাবে স্বাক্ষর হলো। কাবির স্বাক্ষর করল, তারপর পাশে বসা ইথিকাও তার স্বাক্ষর দিল। তারা দুজনেই সবার সামনে পাশাপাশি বসে ছিল। বাকিরা মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।

শুরুতেই ইথিকাকে তাদের প্ল্যানিংয়ের কিছুটা অংশ শেয়ার করার দায়িত্ব দেওয়া হলো। ইথিকা খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রোডাকশন সিস্টেম, রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট, গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডস নিয়ে কথা বললো। কাবির তার কথার ভুল ধরলে সে পাল্টা জবাব দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করল। বোঝায় গেল না পাশাপাশি বসে থাকা দু’জন নর নারী সম্পর্কে শুধু বিজনেস পার্টনার নয় স্বামী স্ত্রীও।

শেষে কাবিরও তার বক্তব্য রাখল। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনল। ইথিকা তার একটা ভুলও ধরতে পারল না। মনে মনে প্রশংসায় ভাসল সে।

বিজনেস মিটিং শেষ হওয়ার পর কাবিরকে খুঁজছিল ইথিকা। কিন্তু পেল না। আকাশটা থমথমে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টিও নামল।

শেষে ইথিকা দেখল কাবির গাড়ির দিকে এগোচ্ছে। ইতোমধ্যে সে ভিজেও গেছে। ইথিকা ছাতা হাতে ছুটে এসে ডাকল,

“কাবির!”

কাবির ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ইথিকা ছাতাটা তার মাথার উপর তুলে দাঁড়াল। এক ছাতার নীচে দুজন। কাবিরের চাহনি দেখে ইথিকা বলল,

“আপনি কি রেগে আছেন?”

কাবির চলে যাচ্ছিল। ইথিকা তার মাথার উপর ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আমি ভালো লাইফ পার্টনার হতে নাই বা পারলাম। ভালো বিজনেস পার্টনার হয়ে দেখাব।”

কাবির তাকে থামিয়ে দিল। ছাতাটা সরিয়ে দিয়ে বলল,

“তোমাকে চোখের সামনে না দেখলেই বোধহয় শান্তিতে থাকব আমি। কিন্তু আফসোস সেটা কোনোদিন হবে না।”

ইথিকা চুপ করে রইল। কাবির গাড়িতে উঠে গেল। যে মেয়ে বিজনেস পার্টনার হওয়ার লোভে পড়ে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় সুযোগ পাওয়া স্বত্বেও তার সাথে কাবিরের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা। ভালোই হয়েছে বরং। দুজন দুই প্রান্তের মানুষ তারা। মানিয়ে নিতে কষ্টই হতো।

কাদিন আর কাসেদ এসে গাড়িতে উঠে বসল। ইথিকা দাঁড়িয়ে রইল। গাড়িটা তাকে কাঁদায় ডুবিয়ে দিয়ে চলে গেল। ইথিকা ছাতা হাতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কাবির কি মন থেকে তাকে চায়? তার সাথে সংসার করতে চায়?

ড্রাইভার এসে বলল,

“ম্যাডাম চলুন।”

ইথিকা ড্রাইভারের পিছুপিছু হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসলো। আমিন খান তার পাশে বসে জানতে চাইল,

“কি হয়েছে আম্মি?”

ইথিকা তার মাথাটা বাবার কাঁধে রেখে চোখ বুঁজল।

___________________

কল্পনা সেজেগুজে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ির সামনের দৃশ্য দেখছিল। বাড়ির উঠানে জোসেফের পরিবার। কাবির, কাদিন আর কাসেদ তাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। কল্পনার চোখ সোজা জোসেফের দিকে পড়ল এবার। তখনই কিরণ তার পাশে এসে দাঁড়াল। মুচকি হেসে বলল,

“ওই দেখো তোমার হিরো।”

কল্পনা কনুই দিয়ে তাকে গুঁতো দিয়ে বলল, “চুপ থাক!”

কিরণ আবার হাসল, “তুমি হাসছ কেন আপু?”

কল্পনা মুখ গোমড়া করে বলল, “কোথায় হাসছি? সর।”

কিরণ হালকা করে হেসে বলল, ” তুমি লজ্জা পাচ্ছ? প্রেমে পড়লে মেয়েরা এভাবে লাজুক হাসে।”

কল্পনা শক্ত গলায় বলল, “মোটেও না। আমি তার প্রেমে নই, সে আমার প্রেমে পড়েছে। আমি কেন হাসব? বেশি কথা বলবি না কিরণ।”

কিরণ হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে হঠাৎ বলল,

“ভাইয়া আর ভাবির তালাকটা হয়েই যাবে। তোমার খুশি লাগছে? আমার কিন্তু এখন খুশি লাগছেনা। মনে হচ্ছে খুব তাড়াহুড়ো হচ্ছে।”

কল্পনার মুখ চুপসে গেল। কিরণ বলল,

“আমার এখন কিছু ভালো লাগছেনা। মনে হচ্ছে তাদের আরও কথাবার্তা বলা উচিত। তুমি জানো ভাবি ওইদিন সকালেই জেনে গিয়েছিল বাবা মামলা তুলে নিয়েছে ভাবিকে তালাক দেয়ার শর্তে। আর ওর বাবা ভাইও তালাকের পরিবর্তে বাকি সব ব্যবসায়িক সম্পর্ক আর চুক্তি ঠিক রাখতে চাইছে। তাই রাতারাতি তার অমন পরিবর্তন। যাতে ভাইয়া তাকে যেতে না দেয়।”

কল্পনা বলল,”তা তো বুঝেছি। নইলে এমন কিছু হয়নি যার জন্য ও ওর মত পাল্টাবে।”

কিরণ কিছুক্ষণ নীরব থাকল। একটু সময় পর বলল, “ও খারাপ হলেও ভাইয়াকে ছাড়তে চাইছেনা। এখানে থাকতে চাইছে। আমার মনে হচ্ছে ও সংসার করতে চায়। কিন্তু পরিস্থিতি ওকে সুযোগ দিচ্ছে না। তোমার কি মনে হয়?”

কল্পনা চুপ করে রইল। কিছু বললো না। ইথিকা খারাপ সেটা জগৎ জানে। কিন্তু খারাপ হওয়া স্বত্বেও সে ভাইয়ের সাথে থাকতে চাইছে। আর যাইহোক ভাইয়ার সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে না। তাকে শেষ সুযোগ দেয়া উচিত।

হঠাৎ তাদের ঘরের পাশ দিয়ে দুই তিন জোড়া ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল। একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল,

“কাবির সাহেবের ওয়াইফ কোথায়? উনাকে দেখা যাচ্ছে না।”

কাদিন জবাব দিল,”বাপের বাড়িতে গিয়েছে।”

কল্পনা ততক্ষণে উঁকি দিয়ে ফেলেছে কারা আসছে দেখার জন্য। জোসেভ আর দুই ভাইকে দেখে সে থমকে গেল। জোসেফ তাকে দেখামাত্র নিঃশব্দে হাসল। কল্পনা একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে পিঠ ঠেকিয়ে কিরণকে বলল,

“বজ্জাত তুই আগে দেখবিনা কারা আসছে।”

জোসেফ কাদিন আর কাসেদের সাথে দাদাভাইয়ের ঘরের দিকে পা বাড়াল। জোসেফ মনে মনে হাসছে যদিও কিন্তু কাদিন আর কাসেদের সামনে স্বাভাবিক।

চলমান….

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১৬
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

কলিমউদ্দিন দেওয়ান জোসেফকে পেয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। কাবির এসে দেখল দাদাভাই একা একাই বকবক করে যাচ্ছে। জোসেভ মাথা দোলাচ্ছে। কাবির ডাকল,

“জোসেফ?”

জোসেভ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। হেসে বলল,

“গল্প করছিলাম।”

কাবির বলল,”নাশতা করতে আসুন। কল্পর সাথে দেখা হয়নি বোধহয়।”

“দেখা হয়েছে। কথা হয়নি।”

“কথাও হবে একসময়। আসুন আগে।”

জোসেফ আর সে কথা বলতে বলতে নীচে নেমে এল। জোসেফের মা বোনরা কল্পনার ঘরে গেছে। সো যেহেতু নীচে আসবে না সবার সামনে। জোসেফকে দেখেই কামরান সাহেব হাসলেন। বললেন,

“আজ কিন্তু পাকা কথা হবে। পাত্র আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।”

জোসেফ হেসে বলল,”একদম ভয় পাচ্ছি না।”

কাওসার দেওয়ান বলল,”এই বিয়েতে মন খুলে আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করতে পারব। কাবিরের বিয়েতে….

সাথে সাথে সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল কাবিরের দিকে। কাবির গম্ভীরমুখে হাসির রেখা টেনে বলল,

“জোসেফ আগে খাওয়াদাওয়া তারপর কথাবার্তা। আঙ্কেল আপনারাও নিন।”

জোসেফের বাবা বলল,”খাচ্ছি। আপনারাও নিন।”

খেতে খেতে কথাবার্তা এগোলো তাদের।

ওদিকে কল্পনার ঘরে জোসেফের মা বোন কল্পনাকে ঘিরে বসেছে। লুবনা বেগম বললেন,

“ওর মা যখন মারা গেল তখন ও খুব ছোট। বড়দাও মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল। তখন থেকেই ও আমার কাছে মানুষ হয়েছে। আমি পেটে ধরিনি কিন্তু ওরা আমারই বাচ্চা কাচ্চা।”

কল্পনার প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। জোসেফের মা জাহানারা বেগম মাথা দুলিয়ে বললেন,

“জোসেফের মুখে শুনেছি।”

লুবনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

“ছেলে আপনাদের সব বলেছে?”

“জি বলেছে। কল্পনার কথা তো আরও আগে থেকেই বলেছে। ওর মিশন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।”

কল্পনা চুপচাপ বসে আছে। জোসেফের বোন জেসি কল্পনাকে বলল,

“আপনি কম কথা বলেন নাকি? আমরা সবাই কিন্তু বেশি কথা বলি।”

লুবনা বেগম বলল,”না না। কথা বলে। এখন লজ্জা পাচ্ছে।”

জাহানারা বেগম বলল,”এটা স্বাভাবিক।”

কল্পনার হাতে উনি একটা আন্টি পরিয়ে দিলেন নিশান হিসেবে। আকদের দিন তারিখ ঠিক করার দায়িত্ব পুরুষদের উপর বর্তাল। জোসেফের সাথে কল্পনার কথাবার্তা হয়নি। কেননা কামরান দেওয়ান, কাওসার দেওয়ান বিয়ের আগে এসব কথাবার্তা পছন্দ করেন না। তাছাড়া কল্পনা বলবেই বা কি? পাত্র অপছন্দ হওয়ার সুযোগ নেই। তবে কল্পনার ঘরের সামনে এসে মা বোনের পাশে কল্পনাকে দেখেছিল জোসেফ। দেখতে ভালো লাগছিল। এতটাই ভালো যে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছে তার। এই মেয়েটা তার বাড়িতে ঘুরঘুর করছে দেখার আগ অব্ধি তার স্বস্তি নেই।

তবে হ্যাঁ, তাদের ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে কল্পনার সাথে ফোনে কথা বলা যাবে। অবশ্য ফোন নাম্বার নেয়ার বদবুদ্ধিটা জোসেফের মাথায় এসেছে। কল্পনার নাম্বার যোগাড় করা যদিও তার বাঁ হাতের খেল। তবুও সে কাবিরের অনুমতি নিয়েই নাম্বারটা নিয়েছে। কাবির এমন অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল যে নাম্বারটা না দিয়ে উপায় ছিল না। খারাপ হয়নি বিষয়টা। তার বাপ জেঠাদের সব কথা তো আর মানবে না সবাই। বিয়ের আগে দুজন দুজনকে চেনাজানাটা ভীষণ জরুরি। সংসার তো দুজনকেই করতে হয়। বাকিরা শুধু মতামত জানায়। ধরো আর ছাড়ো।

___________

DK Nexa Pharmaceuticals এ পূর্ণোদ্যমে কাজ চলছে। কল্পনার বিয়ে সংক্রান্ত ঝামেলা আর অন্যান্য ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকায় কাবির কয়েকদিন ল্যাব ও কারখানা ভিজিট করতে পারেনি। তবে এই ক’দিনে কোম্পানির কাজ অনেকটাই এগিয়েছে।

ল্যাব সেটআপের কাজ প্রায় শেষের পথে। উন্নত টেকনোলজির এনালাইসিস ও রিসার্চের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ইনস্টল করা হয়েছে। গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের একটি দক্ষ টিম গঠন করা হয়েছে নতুন ওষুধের ফর্মুলেশন নিয়ে কাজ করার জন্য। সেই টিমের মধ্যে কাসেদ আর কাদিনও রয়েছে।

লাইসেন্স ও সরকারি অনুমোদনের বিষয়গুলোও প্রায় চূড়ান্ত। এইসব কাজ ইথিকা সামলেছে।

কাবির উপস্থিত না থাকলেও পুরো প্রকল্প তার নির্দেশনা অনুযায়ী এগিয়ে চলছে। কিন্তু এতকিছুর পরও তার অভাব টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ DK Nexa Pharmaceuticals-এর আসল চালিকাশক্তি যে সে নিজেই। অ্যাকাউন্টস ও ফিনান্স ম্যানেজার হিসেবে তার দায়িত্বের শেষ নেই সেখানে। তবুও ল্যাব আর কারখানা ভিজিট করে ভালো লাগছে এটা দেখে ইথিকার স্টাফরা ভালোই কাজ করছে।

যেহেতু খানদের কাছে ফোরটি পার্সেন্ট শেয়ার বিক্রি করেছে দেওয়ানরা সেহেতু ইথিকা কোম্পানিতে সিইও ছাড়াও অন্যান্য দায়িত্ব নিয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল লিগ্যাল অ্যাডভাইজর ও রিক্রুটমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে। পরে রিক্রুটমেন্ট ম্যানাজার হায়ার করবে।

আজকের মধ্যেই পঁচাত্তর জন কর্মীকে সে হায়ার করেছে। কাবিরের অফিসে সব ফাইল সে পাঠিয়েছে। কাবির অফিসে এসে নিজের আসনে বসে একে একে সব ফাইল খুলে এমপ্লয়িদের ডাটাগুলো দেখতে লাগল। ইথিকা সব যোগ্য মানুষকে চাকরি দিয়েছে। কোম্পানির সমস্ত কাজ সে মনোযোগ দিয়ে করছে ফোরটি পার্সেন্ট শেয়ার থাকা স্বত্বেও।

সংসারটা যদি এভাবে মনোযোগ দিয়ে করতো। তার শেয়ার তো হান্ড্রেডে হান্ড্রেড।

কাবির ফাইলগুলো একবার ভালো করে যাচাই করে নিল। তারপর বিশেষ সুইচটি চাপলো। সংকেত পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই দরজার স্বয়ংক্রিয় লক খুলে গেল একটানা ‘বীপ’ শব্দে। মুহূর্তের মধ্যে দরজার ওপাশ থেকে একজন ভেতরে প্রবেশ করল।

“ইয়েস স্যার।”

কাবির বলল,”আনঝিল খানমকে ডেকে পাঠান।”

“ওকে স্যার।”

কিছুক্ষণের মধ্যে সুমন ফিরে এল। মাথা নীচু রেখে বলল,

“ম্যাম বলছেন আপনাকে উনার অফিসে যেতে।”

কাবিরের কপাল কুঁচকে গেল।

“She is under my command”

“সরি স্যার। উনি বললেন তিনি আপনার অফিসে আসবেন না।”

কাবির হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। সোজা গিয়ে থামল ইথিকার অফিসের সামনে। চকচকে নেমপ্লেটের ওপর চোখ পড়তেই বড় হরফে লেখা—

“Anzill Khanam”
CEO, Advisor, Recruitment Manager

তবে কাবিরের দৃষ্টি আটকে গেল একদম নিচের দিকে। ছোট্ট লাল হরফে লেখা শব্দগুলো যা সাধারণত সবার চোখে পড়বে না।

“Access restricted. Only authorized personnel allowed.”

কাবির নক করল। ভেতর থেকে আওয়াজ এল।

“প্লিজ কাম।”

কাবির ভেতরে প্রবেশ করল। প্যান্ট-স্যুট পরা ইথিকা, পরিপাটি চুল, ক্লাসিক পনিটেল করে বাঁধা চুল। ইথিকা সামনের জনের সাথে কথা বলা শেষ করে কাবিরের দিকে তাকাল।

লোকটা চলে যেতেই কাবিরকে চেয়ার দেখিয়ে বলল,”প্লিজ বসুন।”

কাবির বসল না। বলল,

“কাদিনের রেফারেন্সে দুটো ছেলে এসেছিল। তাদের চাকরি হয়নি কেন?”

ইথিকা সোজাসাপটা জবাব,

“They were unfit for the position. I will not let the unqualified work under me.”

কাবির টেবিলে হাতের ভর রাখল শব্দ করে। ইথিকা চোখ তুলে তাকাল।

“তাদের জায়গায় যাদের নেয়া হয়েছে তারা আশিষ খানের রেফারেন্স এসেছিল।”

ইথিকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“They were qualified. That’s why I gave them the appointment letter.”

কাবির বলল,”আমি চারজনেরই সিভি দেখেছি। আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখানে পলিটিক্স চলছে। আমি ওদের ডেকে পাঠিয়েছি। ওদের চাকরি আমি দেব। আমি আপনাকে ওয়ার্ন করছি। ইচ্ছেমতে কাজ করবেন না এখানে। এখানে মানুষের বাঁচা মরার ঔষধ তৈরি হবে। সৎ থাকুন। নয়ত আসন ছাড়ুন।”

ইথিকা বলল,”আর কোনে অভিযোগ।”

কাবির বলল,

“বাকি সব কাজ ঠিকঠাক।”

“ঠিকঠাক ভাবে করতেই হবে। এই শেয়ারের জন্যই তো আমার সংসার হয়নি।”

কাবির আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল। ইথিকা ঠান্ডা স্বরে বলল,

“কিছুক্ষণের মধ্যে একটা পেপার যাবে। সাইন করে দেবেন।”

কাবির কোন উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর সত্যিই কয়েকটি পেপার তার ডেস্কে এসে পৌঁছাল। একটি প্রিন্ট করা সাদা কাগজ চোখে পড়ল। পেপারের শীর্ষে আদালতের অফিসিয়াল সিল, নীচে আইনের ধারা নম্বর উল্লেখ আছে। আইনি ভাষায় বিবাহ বিচ্ছেদের শর্তাবলী বিস্তারিতভাবে লেখা। সবগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়া শেষ হতে না হতেই সুমন এসে বলল,

“স্যার একটা মহিলা এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চাইছে। এত করে বলছি কিন্তু শুনছেন না।”

কাবির পেপারগুলো সরিয়ে বলল,

“আসতে দাও।”

মহিলাটি ভেতরে ঢুকে এল। কাবির চোখ তুলে তাকানোমাত্রই থমকে গেল।

“তুমি!”