মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-১০

0
146

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১০ম_পর্ব

সৌরভ ঐন্দ্রিলার প্রথম প্রেম, উহু প্রথম না পাওয়া রক্তিম অনুভূতি। যার গল্পটা সূচনা হবার আগেই নিষ্ঠুর হস্তে তা মাটি চাপা দিয়েছিলো অভ্র। ঐন্দ্রিলার এখনো মনে আছে যেদিন সৌরভের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল।

ঐন্দ্রিলা তখন স্কুল পেরিয়ে কলজের সিড়িতে পদার্পন করেছে। কিশোরী সত্ত্বার আবেগময়ী সময়। হুট করেই স্কুল নামক গন্ডি থেকে এক টুকরো পাকা আকাশ পেয়ে যাবার গল্প যেন। আগের মত নিয়মের বালাই নেই। হুট করেই মনে হলো মনের আকাশে বিস্তর পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের মাঝে মন বাগিচায় সদ্য পরিষ্ফুটিত হলো একটি নতুন আবেগ, অনুভূতি। যে অনুভূতির নাম প্রেম। বান্ধবীদের আড্ডাস্থলেও যেন এই অনুভূতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা। ঐন্দ্রিলা ভেবে পায় না এই আবেগের রহস্য কি। সদ্য প্রেমে হাবুডুবু বান্ধবী যখন তার প্রেমিককে নিয়ে বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলে ঐন্দ্রিলা মুখ বাকায়। ছেলে বলতেই তো এক অভ্রকেই দেখেছে। যে তার চুল টেনেছে, তার পুতুল ভেঙ্গেছে। তার জীবনে হুট করেই নাক বাড়িয়ে ঢুকে পড়েছে। পাড়ায় মারপিট করবে, সবার উপর হুকুম ফলাবে। আর ঐন্দ্রিলার সাথে যেনো আলাদাই শত্রুতা। তাকে একবিন্দু শান্তি দিতে নারাজ। ক্রিকেট খেলে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে দেয় তো কখনো ইচ্ছেকৃত ঐন্দ্রিলার জন্মদিনের কেকে কেঁচো ছেড়ে দেওয়া। ঐন্দ্রিলার মনে আছে একবার অভ্রের শখ হলো ইদুর পালার। এক সাথে দশটা ইদুর পাললো, তারপর সুযোগ বুঝে ঐন্দ্রিলার ঘরে ছেড়ে দিলো। সেই ইদুঁর ঐন্দ্রিলার সব বইগুলো কুঁচি কুঁচি করে কেঁটে ফানা ফানা করে দিলো। এমন ছেলের প্রেমে কি করে পড়বে ঐন্দ্রিলা? বরং দেখলেই রাগে গা রি রি করে। তাদের কথার মাঝে ঝগড়া হবে না এমন কি হয়? শুধু একজন আরেকজনের মাথা ফাটানোর দেরি। অভ্রের হাসি দেখলেই ঐন্দ্রিলার ইচ্ছে করে ইট ছুড়ে মারতে। ফলে ঐন্দ্রিলা ধরেই নিয়েছে ছেলে মানেই অসভ্য, অভদ্র, লাফাঙ্গা।

ঐন্দ্রিলার এই চিন্তাধারা মিথ্যে করে দিলো একটি ছেলে। শান্ত সমীরণের মিষ্টি দোলার মত আগমন যেন। তীব্র বর্ষণে ধরণী তোলপাড়। বাসস্ট্যান্ডের এককোনায় দাঁড়িয়ে ছিলো ঐন্দ্রিলা। অপেক্ষা একটি রিক্সার। সময়টা আর পাঁচটি দিনের মত নয়। মাসিকের বিশ্রী ব্যাথায় মুখখানা তার নীল হয়ে গেছে। উপরন্তু ছাতাও নেই। ছাউনিতেও বৃষ্টির ধারার আক্রমন থেকে মুক্তি নেই। বুকের সাথে কলেজ ব্যাগটি শক্ত হাতে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। বৈশাখের কালো মেদুরের অতর্কিত হামলায় সবাই যে যারা আশ্রয় নিতে ব্যাস্ত। পিচের রাস্তায় শুধু বর্ষণের জলকেলি। ঐন্দ্রিলার অস্থির চোখ শুধু একটা রিক্সার অপেক্ষায় ছিলো। এর মাঝেই একটি পুরুষালী স্বর কানে এলো,
“তুমি কি অসুস্থ?”

ঐন্দ্রিলা মাথা তুলে তাকালো। ক্লাসের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট, জ্ঞানী ছেলে সৌরভ। একবছর যাবৎ একই ক্লাসে পড়ার পরও তার সাথে ঘুম একটা বন্ধুত্ব নেই তার। ঐন্দ্রিলা রীতিমত ঘামছে অসহনীয় ব্যাথায়। মুখখানা রক্তশূন্য লাগছে। তবুও মাথা নেড়ে বললো,
“না”

সৌরভ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলা আরোও জড়সড় হয়ে গেলো। ছাউনির একেবারে কোনায় দাঁড়ানোতে ঐন্দ্রিলার গায়ের একপাশ ভিজে গিয়েছে। ছেলেটি নিপুন চোখে লক্ষ্য করলো। কিছু বললো না। হুট করেই ছুটে বের হলো বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। মিনিট বিশেক বাদে একটি রিক্সা এবং একবোতল পানি নিয়ে ফিরলো। পানি খানা এগিয়ে বলল,
“নেও। রিক্সায় উঠে পড়ো। আমার মনে হয় তোমার শরীর ভালো নেই”

সৌরভের দিকে বোকার মত চেয়ে রইলো ঐন্দ্রিলা। ছেলেটি ভিজে একাকার অবস্থা। এই তুমুল বর্ষণ উপেক্ষা করে সে ঐন্দ্রিলার জন্য রিক্সা নিয়ে এসেছে ব্যাপারটি ভীষণভাবে অবাক করলো ঐন্দ্রিলাকে। ঐন্দ্রিলা শুধু ছোট করে বললো,
“ধন্যবাদ”

তারপর রিক্সায় উঠে পড়লো সে। নরম মনে সৌরভের প্রতি প্রচন্ড কৃতজ্ঞতাবোধ হলো। কৃতজ্ঞতাবোধ হুট করে গ্লানিতে পরিবর্তিন হলো যখন দেখলো পরদিন ছেলেটি ক্লাসে আছে নি। দুদিন পর জানা গেলো বৃষ্টিতে ভেজার জন্য তার জ্বর এসেছে। এতোদিনের ছেলেদের নিয়ে যে ধারণাগুলো ছিল সৌরভের আচারণে সব যেন বদলে গেলো। অগোচরেই কিশোরীর মস্তিষ্ক, হৃদয়ে সৌরভের প্রভাব বিস্তার হলো। মুগ্ধ করলো যুবক। শুধু মুখচেনা ছেলেটি এখন তার কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু। ছেলেটি খুব অদ্ভুত। তার কোনো বন্ধু নেই। দেখতে সুদর্শন সে নিঃসন্দেহে। কিন্তু দাম্ভিকতা নেই। নিজের জগতে সে মগ্ন। ক্লাসে আসবে, ক্লাস করবে, বাড়িতে চলে যাবে। খুব জনপ্রিয় নয় সে। যেখানে কলেজে উঠেই এক এক জন নিজেকে হনু ভাবা শূরু করেছে। অহেতুক হৈহুল্লোড়, কথা কাটাকাটি, নিজেকে জাহির করার মাঝে ছেলেটি একেবারে ছিলো না। এমন ছেলেও হয় বুঝি।

সৌরভ কখনোই কারোর সাথে মিশতো না। তবে তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ পেলো প্রথম বর্ষের ইয়ার ফাইনালে। ছেলেটি কলেজে টপ করলো। স্যাররা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ঐন্দ্রিলা চেষ্টা করলো তার সাথে সখ্যতা গড়ার। উপায় পেতে ভুগতে হলো না। সেদিনের পর একটু আধতু তো কথা হতোই। সেই একটু আধটুকে বন্ধুত্বের সিড়িতে পৌছে দিলো প্রি টেস্ট পরীক্ষা। একদিন হুট করেই কেমিষ্ট্রি বই নিয়ে সৌরভের সামনে হাজির ঐন্দ্রিলা। তখন কলেজ মাত্র ছুটি হয়েছে। সৌরভ বাসায় যাচ্ছিলো। ঐন্দ্রিলা পেছন থেকে ডাকলো,
“এই জ্ঞানী ছেলে?”

সৌরভ অবাক চোখে পেছনে তাকালো। ঐন্দ্রিলা এগিয়ে আসল তার কাছে। চোখে চোখ রেখে বললো,
“আমাকে জৈব রসায়নটা বুঝিয়ে দিতে পারবে?”
“আমি?”
“ক্লাসে তো জ্ঞানীর তকমা অন্য কেউ পায় নি। পেয়েছো তুমি? শুনেছি গত পরীক্ষায় ৯৫ পেয়েছিলে। তাই তোমাকে ছাড়া আর কারোর থেকে সাহায্য নিতে ইচ্ছে করছে না”
“আমি পারব না”

সৌরভের অকপটে মানা করা সহ্য হলো না ঐন্দ্রিলার। এগিয়ে এসে পাটা উচু করে ঠিক মুখোমুখি হয়ে বললো,
“তুমি তো খুব হিংসুটে দেখছি। জ্ঞানী ছেলেরা বুঝি হিংসুটেও হয়”

সৌরভ বিব্রত হলো। ঐন্দ্রিলা সরে যেয়ে বললো,
“থাক থাক, আমরা না হয় তোমার মত ভালো ছাত্রী নই। কিন্তু এতোটা হিংসুটে নই। কি হবে একটু পড়ালে। আমি কি তোমার নম্বর নিয়ে নিব?”

সৌরভ মাথা চুলকে বললো,
“তুমি আমার কাছে পড়বে?”
“হ্যা”
“আমার সাথে মিশতে তোমার আপত্তি নেই?”
“কেনো আপত্তি হবে?”

সৌরভ বিদ্রুপের হাসি টেনে বললো,
“শুনেছি বন্ধুত্ব সবসময় সমান সমানে হয়। আমি তো তোমাদের মত নই”

সেদিন সৌরভের কথা না বুঝলেও পড়ে ঠিক বুঝেছিলো ঐন্দ্রিলা। সৌরভের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো ছিলো না। তার মা একটি দোকানে দর্জির কাজ করত। সেজন্য হীনমন্যতায় ভুগতো সে। কখনো কারোর সাথে মিশত না সে এইকারণেই। এমনকি কেউ নিজের বাসার ঠিকানাও জানতো না। এর আগে পাঁচবার স্কুল পরিবর্তন করেছিলো সে শুধু বেতন দিতে পারতো না বলে। কলেজে উঠার পর পার্টটাইম চাকরি শুরু করে সে। ফলে এখন আর বেতনের সমস্যা হয় না। ঐন্দ্রিলা কথাটি জানতে পারে যখন একটি ডিপার্টমেন্টাল দোকানে সৌরভকে সেলসম্যানের কাজ করতে দেখে। ঐন্দ্রিলার সৌরভের প্রতি সম্মান জাগে। ছেলেটিকে আগে শুধু ভালো লাগতো, ধীরে ধীরে সেই ভালো লাগা গাঢ় হতে থাকে। যেদিন সৌরভ তার কাছে ধরা পড়ে যায়, সৌরভ তার হাত ধরে বলে,
“তুমি প্লিজ কাউকে বলো না”
“কেনো? তুমি তো চুরি করছো না। তাহলে লজ্জা কিসের?”
“তুমি বুঝবে না”
“হয়তো, কিন্তু বিশ্বাস করো আমার কিন্তু তোমাকে দেখে একটু হীনবোধ হচ্ছে না। বরং আমার চোখে তোমার সম্মান বেড়ে গেলো। এবার আমাকে পড়াবে তো”

সেদিনের পর থেকে সৌরভের সাথে সম্পর্কটা যেন বন্ধুত্বের সিড়িতে পদার্পন করতো। যদিও সেই বন্ধুত্ব সকলের সম্মুখে নয়। আড়ালে আবডালে। সৌরভের ইতস্ততা দেখে ঐন্দ্রিলাও জোর করতো না। সে কাউকে বলে নি এই বন্ধুত্বের খবর এমন কি পিউকেও না। এই খবর জানতো কেবল তার ডায়েরি। যেখানে সে লিখতো আর মনপ্রকোষ্ঠের জমানো অনুভূতি। ঐন্দ্রিলার কিশোরী মনে সৌরভ অগোচরেই নিজের রাজত্ব গড়লো যেন। ঐন্দ্রিলা আবিষ্কার করলো ছেলেটি মারাত্মক সুন্দর করে হাসে। সেই হাসি বিশদ সমুদ্রের মত। একবার ডুবে গেলে যেন তল পাওয়া ভার। একদিন ক্লাস শেষে কলম নিয়ে বসলো ঐন্দ্রিলা। ক্লাসে কেউ নেই। পিনপতন নীরবতা, সে আর ডায়েরির পাতা।

এই যে জ্ঞানী ছেলে,
তোমাকে একটা কঠিন প্রশ্ন করবো। কঠিন প্রশ্ন পুরো দশ মার্কের। উত্তর না দিতে পারলে বুঝবো তুমি আসলে জ্ঞানী ছেলে না, একটা বোকা। আচ্ছা বলতো, তুমি নামক মানুষটা আমার উপর কি জাদু করেছো? আমি একদম ভালো নেই। পাগল পাগল হয়ে গেছি৷ এই ভালো এই খারাপ, বন্ধুদের আড্ডায় হুট করেই খেই হারিয়ে ফেলছি। পড়তে বসলেও আমার মস্তিষ্কে তোমার মুখখানা ভাসছে। বিনা নোটিসে কাঁদতে ইচ্ছে করে, আবার কোনো বিষন্ন সন্ধ্যায় তোমাকে দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে নিয়ে চিন্তা করাই যেনো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর কাজ। এই জ্ঞানী ছেলে, বলোতো আমার কি হয়েছে? আমি কি তোমার প্রেমে পড়েছি? তুমি কি চুপিচুপি আমার হৃদয়কে মায়াবদ্ধ করেছো? উত্তরটা দিও কিন্তু! না দিলে কলেজময় জানিয়ে দিবো তুমি একটা বোকা ছেলে”

এটুকু লিখেই আটকে গেলো ঐন্দ্রিলার কলম। হটাৎ কেউ এক ঝটকায় ডায়েরিটা নিয়ে নিলো। মাথা তুলতেই ঐন্দ্রিলার কপালে পড়লো প্রগাঢ় ভাঁজ,
“অভ্র, দে আমার ডায়েরি”

অভ্র কি দেয় সেটা, সে নির্লজ্জের মত ডায়েরি পড়তে লাগলো। একটা সময় তার মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো। সে হাতটা একটু নামাতেই খপ করে ডায়েরিটা কেড়ে নিলো ঐন্দ্রিলা। রেগে বললো,
“তুই কি ম্যানারসও জানিস না। কারোর পার্সোনাল জিনিস এভাবে নিতে হয়?”

অভ্র পাত্তা দিলো না ঐন্দ্রিলার প্রশ্নের। হাই বেঞ্চে বসতে বসতে ভৎসনার স্বরে বললো,
“বাবা ঐন্দ্রি, তুই তো কবি হয়ে গেছিস। তা এই প্রেমপত্র কার জন্য?”
“কারোর জন্য নয়”
“আমাকেও বলবি না তুই? আমি না তোর ছোটবেলার বন্ধু?”

বলেই ফিঁচেল হাসলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা চোখ গরম করে বলল,
“বন্ধু না তুই শত্রু। আমার জীবনের শত্রু তুই”

বলেই ডায়েরিটা ব্যাগে পুরলো সে। চলে যেতে নিলেই অভ্র বললো,
“তুই কি সৌরভকে লিখছিলি চিঠিটা?”

ঐন্দ্রিলা থমকে গেলো। উত্তর দিলো না। অভ্রের সাথে সৌরভের ছিলো শীতল যুদ্ধ। অভ্র ক্লাসের সেই ছেলেটি ছিলো যে পড়াশোনায় ডাব্বা হলেও তার দাপটে ক্লাসের প্রতিটি প্রাণ ছিলো অন্ধ। এদিকে পড়াশোনায় ভালো করার সুবাদে সৌরভের জনপ্রিয়তা বাড়ছিলো। অভ্র এবং সৌরভ ধীরে ধীরে প্রতিপক্ষের মতো হয়ে গেলো। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না যেন। কিন্তু তারা সামনাসামনি কখনো ঝগড়াও করে না। তবে একে অপরের চক্ষুশুল তা গোটা ক্লাস জানে। ঐন্দ্রিলা কোন উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেলো। সিড়ি থেকে নামতেই দেখা হল সৌরভের সাথে, সৌরভ মিষ্টি হেসে বলল,
“আজ আমার সাথে এক জায়গায় যাবে?”

ঐন্দ্রিলার হৃদয়ে যেন দামামা বাজলো। সে মাথা নাড়িয়ে “হ্যা” বললো।

লেকের ধারে সারি সারি বেঞ্চি। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। ঐন্দ্রিলার কোলে একগুচ্ছ শুভ্র শিউলি। পাশে চুপ করে বসে আছে সৌরভ। সমীরণে উড়ছে ঐন্দ্রিলার বেনী থেকে আলগা হওয়া চুল। নিস্তব্ধতা বহু সময় ধরে। কারোর ঠোঁটেই কোনো কথা নেই। ঐন্দ্রিলার মোবাইল বাজছে। বাসায় যেতে হবে। ঐন্দ্রিলা ফুলগুলো বেগে ভরে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই নিস্তব্ধতা চিরলো গাঢ় স্বর,
“ঐন্দ্রিলা, আমি মনে হয় তোমার প্রেমে পড়েছি। ভালোবাসার নীল লাল অনুভূতি আমার মনেও ধরা দিয়েছে। চিন্তা করো, পড়াশোনা ছেড়ে এখন তোমাকে নিয়েই আমার চিন্তাগুলো বিস্তৃত হয়। ভীষণভাবে তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো ঐন্দ্রিলা। অনুভূতি গুলো এতোটা প্রগাঢ় যে লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তুমি সময় নেও। জরুরি নয় যে তোমার অনুভূতি গুলো আমার মত হবে। তবে লোভী মন চায় তুমিও যেনো আমাকে ভালোবাসো”

ঐন্দ্রিলা স্তব্ধ তাকিয়ে রইলো। জট পাকিয়ে গেলো সব চিন্তা। বাবা ফোন দিচ্ছে, বাসায় যেতে হবে। ফলে উত্তরটা দেওয়া হল না। ঐন্দ্রিলা ঠিক করলো পরদিন কলেজে যেয়েই উত্তর দিবে। কিন্তু পরদিন নানীবাড়িতে যেতে হলো ঐন্দ্রিলাকে। নানা খুব অসুস্থ, না গেলেই নয়। এক সপ্তাহ পর কলেজে আসলো ঐন্দ্রিলা। একদম সকাল সকাল পৌছালো কলেজে। সকল ভিড়ের মাঝেও তার চোখ খুঁজলো জ্ঞানী ছেলেটিকে। অদ্ভুত, ছেলেটি আসে নি। সারাদিন নিদারুন অস্থিরতায় কাটলো ঐন্দ্রিলায়। সৌরভ এলো তিনদিন পর। তার মুখশ্রীর অবস্থা করুন। ম্লান, শুষ্ক মুখবিবর। সেই হাসিটা কোথাও যেন গায়েব। ঐন্দ্রিলা তার সাথে কথা বলতে চাইলেও সে এড়িয়ে গেলো। ঐন্দ্রিলা অবাক হলো। ক্লাস শেষে তাকে টেনে আড়ালে নিয়ে গেলো সে। ব্যাগ্র কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে তোমার? এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো?”

সৌরভ উত্তর দিলো না। তার মুখশ্রী কঠিন। সে চলে যেতে নিলে ঐন্দ্রিলা বাধা দিলো। তার আত্মসম্মানে লাগলো সৌরভের অবহেলা। অশ্রুসিক্ত নয়নে শুধালো,
“তুমি এমন করছো কেনো সৌরভ?”
“তুমি কি সত্যি বুঝছো না ঐন্দ্রিলা?”

ঐন্দ্রিলার বিস্ময় কাটলো না। সৌরভ মলিন স্বরে বলল,
“আমি তো তোমাকে বিশ্বাস করতাম ঐন্দ্রিলা। তুমি এমনটা কেন করলে?”
“আমি কি করেছি?”

সৌরভ আহত স্বরে বললো,
“আমি কখনো তুমি ধনী বলে তোমাকে ভালোবাসি বলি নি। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি কারণ তুমি আমাকে কখনো ছোট করো নি তাই। আমাকে অপছন্দ হলে বলে দিতে পারতে। কিন্তু কলেজে আমার নামে এতোটা রটনা নাও রটাতে পারতে”

সৌরভ ঐন্দ্রিলার হাত ছাড়িয়ে নিলো। ঐন্দ্রিলার বিহ্বল নয়ন তখনও তাকেই দেখছে। ক্লাসে আসতেই পিউ বললো,
“সৌরভ সত্যি তোকে প্রপোজ করেছে? বলিস নি তো”

অবশেষে জানতে পারলো কলেজময় বিশ্রী রটনা রটেছে। কে যেন সৌরভকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করতে দেখেছে। সেখান থেকে সৌরভের অবস্থা সম্পর্কে এতোদিনের ধোয়াশা হুট করেই কেটে গেছে। উপরন্তু ঐন্দ্রিলার সাথে ঘনিষ্ঠতা নিয়েও নানা কথা রটেছে। সবার মুখে একটা কথা, সৌরভ বামন হয়ে চাঁদ ধরতে চাইছে। ফলে তাকে দেখলেই তারা কানাগোসা করছে, টিটকারি বিদ্রুপের বান ছুড়ছে। এই বান এতোটা তিক্ত হলো যে একটা সময় অতীষ্ট হয়ে গেলো সৌরভ। টেস্ট পরীক্ষার ঠিক একমাস আগে সে কলেজ বদলে ফেলে। ঐন্দ্রিলার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে কিশোরী মন চুর্নবিচুর্ণ হয়ে যায়। প্রথম প্রেমের এমন বিচ্ছেদ সে কখনোই মানতে পারে না। নিজের নির্দোষীতার প্রমাণও দিতে পারে না সে। বিষাদের নীল যন্ত্রণার ছোবলে চঞ্চল ঐন্দ্রিলা হুট করেই শান্ত হয়ে গেলো যেন। কথা বার্তা কমিয়ে দিলো। পিউ এর সাথেও তার সম্পর্কটা শীতল হয়ে গেলো। শুধু ক্লাস করে আর বাসায় যায়। এই তার জীবনের রুটিন। জোর করে পড়াশোনায় ডুবতে চাইলেও ব্যর্থ হয় সে। রাত গুলো যন্ত্রণা বাড়ায়। হুট করেই শান্ত ছেলেটা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, নিয়ে গেছে সকল সুখ।

তীব্র তেজস্বী সূর্য। প্রাকটিক্যাল শেষে অলস পায়ে বাড়ি ফিরছিলো ঐন্দ্রিলা। ঠিক তখনই কানে আসলো,
“আমাদের ভাল ছাত্র শুনেছি শহর ছেড়ে পালিয়েছে। এই শহরেই থাকবে না সে। মানতে হবে অভ্র, তুই আসলেই বস। ঐ বইপোকাটাকে কি জব্দ না করলি, একেবারে পালিয়ে গেলো………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি