মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-১৯+২০

0
47

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১৯তম_পর্ব

“তুই কি করে জানিস আমি সাঁতার পারি না”

অভ্র হাসলো স্মিত। মৃদু স্বরে বলল,
“এটা তো শুধু সাঁতার বাবু, তোর সম্পর্কে এমন অনেককিছুই আমি জানি যা হয়তো তুই নিজেও জানিস না। এই যেমন তোর বেগুন অপছন্দ। কিন্তু সবাইকে বলে বেড়াস তোর বেগুনে এলার্জি। ভাঙচুর করে তোর রাগ কমে কারণ ওই ভাঙ্গা অংশগুলো দেখলে তোর আফসোস লাগে। সেই আফসোস থেকে অব্যক্ত বিষন্নতা তোকে ঘিরে ধরে। সেই বিষন্নতা কাটে যখন আংকেল তোকে আইসক্রিম খাওয়ায়। কি ঠিক না?”

অভ্ররের হাসিতে দুর্বোধ্য রহস্য। ঐন্দ্রিলা হতবাক চেয়ে রইলো। বিমূঢ় কন্ঠে বললো,
“আমার সত্যি বেগুনে এলার্জি”

অভ্রের হাসি প্রশস্ত হলো। সে পকেটে হাত পুড়ে পা বাড়ালো নিরিবিলির দিকে। কিছুটা এগিয়ে ঐন্দ্রিলাকে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
“কি হলো? ভুতের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
“আমার সত্যি বেগুনে এলার্জি। খেলেই গা লাল হয়ে যায়, চুলকাতে থাকে”
“হয়েছে, বুঝছি। চল, আইসক্রিম খাবি তো? চকবার?”

******

অভিমানী মেঘেদের টানা বর্ষণের পর মলিন প্রকৃতি নির্মল লাগছে। ভেজা ঘাসে যখন পড়ন্ত সূর্যের কিরণ এসে পড়ছে অলীক মায়াবী লাগছে সেই তুচ্ছ ঘাস। নদীর কানায় কানায় ভরে উঠেছে। টলমল করছে স্বচ্ছ পানি। সেই সাথে মৃদু বাতাস। এদিকটা একেবারে নিরিবিলি। কাঁদা পেরিয়ে আসতে হবে বলে পর্যটক কেউ এমুখো হচ্ছে না। ভেজা ঘাসের উপর পলিথিন বিছিয়ে বসে আছে অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা। নির্মল প্রকৃতির মাঝে দুই মানব মানবী। শীতল বাতাস, নদীর কল্লোল ধ্বনির সাথে মিলে কানে কানে গুনগুন করে বললো,
“তুমি খুশি থাকো,
আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো”

ঐন্দ্রিলা ধীরে ধীরে কামড় বসাচ্ছে তার চকবারে। তার হুল্লোড়, হুক্কাহুয়া থেকে বেশি ভালো লাগে নিরিবিলি। যেখানে শুধু সে থাকবে আর থাকবে সরল নীরবতা। সে অবাক হচ্ছে পাশের মানুষটির মুখেও কোনো কথা নেই। সবসময় হট্টোগোল করা ছেলেটাকে এমন নীরব থাকতে দেখা যে অলীক কোনো কল্পনা। ঐন্দ্রিলার আইসক্রিম গলতে শুরু করেছে বাতাসের আদ্রতায়। ফলে হাতজোড়া আঠালো হয়ে গেলো। সেই সাথে গলে পড়ছে তার হাত বেয়ে। বাতাসে চুলগুলো উড়ায় ঐন্দ্রিলায় খুব বিরক্ত লাগছে। আঠালো হাতে চুল ঠিক করতে পারছে না। পাশের মানুষটির কাছ থেকে সাহায্য সে নিবে না। ফলে কিছুক্ষণ ব্যার্থ চেষ্টা করলো। পাশের মানুষটি ব্যাপারটি লক্ষ্য করলো। হাসলো নিঃশব্দে। ঐন্দ্রিলা যখন তার হাতের উলটো পাশ দিয়ে চুল সরাতে সরাতে ক্লান্ত, ঠিক তখনই চুলগুলো আলতো করে ধরে আলগা খোঁপায় বাধলো। টিস্যু ভিজিয়ে হাত মুছে দিতে দিতে বললো,
“তুই এখনো বাচ্চাই আছিস ঐন্দ্রি। এখনো আইসক্রিম খেতে গেলে হাত ভরিয়ে ফেলিস”

ঐন্দ্রিলা কথা বললো না। সে শুধু দেখলো অভদ্র, বেয়াদব ছেলেটির শান্ত, যত্নশীল রুপ। এটা কি প্রকৃতির বিভোরমুখী নেশা! নাকি ছেলেটার স্বভাবের আচারণে কোথাও এমন স্বভাবটিও ছিলো! ঐন্দ্রিলা জানে না। কারিণ সে কোনোদিন অভ্রকে জানার চেষ্টাও করে নি৷

*****

ঘরটা অন্ধকার। দরজা জানালা গুলো দেওয়া। আলো বাতাস ঢোকার উপায় নেই। ঘরের ভেতর থেকে বোঝা যাচ্ছে না বাহিরের আবহাওয়া। সালাম সাহেব এসে ঘরের আলো জ্বাললেন। সাবেরা চোখ বুজে শুয়ে আছেন। দুপুরে সে খায় নি৷ সবাইকে খাবার পরিবেশন করে যে ঘরে এসেছেন, সেই থেকে বের হন নি। না খেয়েছেন, না গোসল করেছেন। শুয়ে আছেন। গতরাত থেকেই তার মনখানা বিষন্ন। ঐন্দ্রিলার শূন্যতা তাকে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করবেন না। কিন্তু কিছু মানুষ অব্যক্ত কথাও বুঝতে পারে। তারা নিঃশব্দে চুপকথা পড়তে পারে। তাই সালাম সাহেবও স্ত্রীর মনোবস্থা বুঝতে সময় নিলেন না। এসে বসলেন তার মাথার কাছে। আলতো করে হাত বুলিয়ে ডাকলেন,
“সাবেরা, এই সাবেরা”

সাবেরা চোখ মেললেন। চোখজোড়া ভেজা, ক্লান্ত। সালাম সাহেব তা দেখেও স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“আযান দিচ্ছে, এখন ঘুমিয়ে থাকবে?”

সাবেরা উঠে বসলেন। শক্ত শরীরটা কেমন মূর্ছিত হয়ে আছে। যেন অনেক দিন পর শরীর ছেড়ে দিয়েছে। মনখানা খুব ক্লান্ত, শ্রান্ত। সাবেরা চোখ মুছে বললেন,
“সন্ধ্যে হয়ে গেছে?”
“হ্যা, তুমি তো কিছু খেলে না। আজ অবশ্য রান্নাটা মজাও হয় নি। কেমন নোনতা, নোনতা, বিরস।”

সাবেরা হাসলেন৷ স্বামীর স্বভাব তার জানা। এই মানুষটিকে নুন ভরে খাবার দিলেও সে কখনো বলে না “সাবেরা খাবার ভালো হয় নি”। সাবেরা মলিন স্বরে বললো,
” সবসময় কি খাবার ভালো হয়?”
“তাও ঠিক। উঠ”
“ঘুম পাচ্ছে গো, ক্লান্ত লাগছে খুব”
“তাহলে বিয়ে দিতে গেলে কেনো মেয়েকে। ভালোই তো ছিলো, থাকতো আমাদের কাছে”

সালাম সাহেবের কথাটা শুনতেই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন সাবেরা। সালাম সাহেব হেসে বললেন,
“একটা কথা আছে, ছেলে মেয়েদের পায়ের জুতোর সাইজ যখন বাবা-মার জুতোর সমান হয় তখন তাদের বন্ধু হয়ে যেতে হয় সাবেরা। তুমি কেনো সেটা বুঝলে না সাবেরা! ঐন্দ্রিলা আমার জেদি মেয়ে। ও একবার মুখ ফেরালে তাকে সেমুখী করা কত কষ্টের তুমি তো জানো। তাহলে কেনো এতো জেদ করলে?”
“লেকচার দেবার বেলায় বাঙালি সবার আগে, তুমি পেরেছো নিজের ছেলের বন্ধু হতে। সে এখন গাছে থাকে। তার ঘরটাও কবজা করে আছো”

সালাম সাহেব হাসলেন। স্ত্রীর হাতখানা ধরে সহাস্য স্বরে বললেন,
“আমি তো বোকা মানুষ। আর তোমার ছেলে একটা গাধার বাচ্চা। কিন্তু তুমি তো বুদ্ধিমতী। আর আমার মেয়েটা কতটা নরম সেটা তো জানো। শুধু মানুষকে দেখায় সে শক্ত কিন্তু সে একটা প্যাচহীন সরল নারী। যাকে ভালোবাসার লোভ দেখালেই গলে যায়৷ আমার মেয়েটা তো ভালোবাসা চায় সাবেরা। তার কি চাওয়াটা কি খুব বেশি। তুমি যে সবসময় বলো আমি তাকে কেনো প্রশ্রয় দেই, আমি তাকে কেনো প্রশ্রয় দিবো না বলোতো। আমি ছাড়া আমার মেয়েকে কে প্রশ্রয় দিবে। সবাই যে তাকে শুধু সমাজের বিভিন্ন মাপকাঠিতে তুলতেই ব্যস্ত। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে নতুন আমদানী করা আমাদের জামাই ছেলেটা ভালো। সেও আমার মতোই আমার মেয়েকে প্রশ্রয় দেয়”

সাবেরা ঠোঁট উলটে কেঁদে দিলেন। ফুপিয়ে বললেন,
“এজন্যই তো আমি এতো শক্তহাতে বিয়েটা দিয়েছি”

সালাম সাহেব তার চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,
“তুমি এখনো কিশোরীর মতো জেদি রয়ে গেলে সাবেরা। তোমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন এমন করে কে কাঁদে?”
“আমি কি অন্যপুরুষের সামনে কাঁদছি?”
“আচ্ছা, ঘাট হয়েছে৷ কাঁদো, কেঁদে মন হালকা কর। কাল মেয়ে আসছে। তখন কেঁদো না যেনো”

সাবেরা কাঁদছেন। সালাম সাহেব খুব নিপুন হাতে তার অশ্রু মুছে দিচ্ছেন। যে কেউ দেখলে ভাববে কোনো প্রেমিক তার কিশোরী প্রেমিকার অভিমান ভাঙ্গছে খুব সন্তর্পণে।

******

বাকুয়ী ভবনে হুল্লোড় হবার জন্য কারণ লাগে। সেই কারণটি খুব সুন্দর করে দিয়েছে এই বাড়ির ছোট ছেলে আহাশ। জার্মানী থেকে ভোরের ফ্লাইটে এসেছে সে। এগারো ঘন্টার জার্নি, সেই জার্নি শেষে অবশেষে বাসায় আসলো আহাশ। কানন ছেলেকে দেখছে আড়াই বছর পর। খুশি ধরছে না। ঘর তার পরিপূর্ণ আজ। আহাশের আগমনে আউওয়াল সাহেবও বেশ প্রসন্ন। আহাশ, অভ্রের মত নয়। খুব গোছানো, শৃঙ্খল ছেলে। তার কথাবার্তাও বেশ মার্জিত, ম্যাচিউর। জার্মানী ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করছে হ্যামবার্গ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজিতে। আহাশ ভাইয়ের বিয়ের আগেই আসতো কিন্তু টিকিটের ঝামেলা হচ্ছিলো। ব্যাগ ট্যাগ রেখে সোফায় গা এলিয়ে বললো,
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে ভাইয়া ঐন্দ্রিলা আপুকে বিয়ে করলো। দুজনের সে দা কুমড়ো সম্পর্ক। আমি তো জার্মানী যাবার আগেও তাদের ঝগড়া করতেই দেখেছি”

কানন হেসে বললো,
“আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার ছেলেটা সংসারী হয়েছে”

আউওয়াল সাহেব তখন খবরের কাগজ পড়ছিলেন। কাগজ থেকে চোখটা তুলে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“বউ, তোমার ছেলে সংসারী হলেই হয়। একদিনে কি আর বোঝা যায়!”

তখন খালারা সহ নবদম্পতি ফিরলো। হাতে খাবার দাবার। আহাশ এসেই ঐন্দ্রিলার পায়ে ছুঁয়ে সালাম করলো। ঐন্দ্রিলা চমকে উঠলো। আড়াই বছর আগের কিশোর ছেলেটা এখন যৌবনে পা রেখেছে। রোগাপাতলা, ছিচকে ছেলেটা এখন ভাইয়ের মত সুঠাম দেহী, সৌম্যকান্ত হয়েছে। ঐন্দ্রিলা প্রথমে চিনতে পারে নি। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো অনেকটা সময়। অবশেষে চিনতে পারলো,
“আহাশ! তুমি তো ব্যাটা হয়ে গেছো”

আহাশ লজ্জা পেলো। কিঞ্চিত লাজুক স্বরে বললো,
“সবাই তাই বলে। এখন তার চোখে পড়লেই হয়”

শেষ কথাটা বললো আস্তে। ঐন্দ্রিলার কানে গেলো না ঠিক। বাহির থেকে আনা খাবার গুলো সে পরিবেশনে ব্যস্ত। অভ্র ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তাহলে? কতদিন থাকা?”
“একমাস। এরপর আবার পাড়ি দুরদেশে। অবশেষে ঐন্দ্রিলা আপুকেই বিয়ে করলে? বলেছিলাম না, তুমি তাকে ভালোবাসো!”

সাথে সাথেই কান মুলে দিলো অভ্র। ফিসফিসিয়ে বলল,
“এসব ভারী শব্দ কোথা থেকে শিখেছিস। আজাইরা”
“তাহলে বলছো, ভালোবাসো না?”

অভ্র কিছুসময় চুপ রইলো। নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো ঐন্দ্রিলার দিকে। অতঃপর বাঁকা হেসে বললো,
“আমি আমার জিনিসে কারোর ভাগ পছন্দ করি না। ঐন্দ্রিলা আমার পুতুল। তার ভবিতব্য আমি”

আহাশ চুপ করে গেলো ভাইয়ের উত্তরে। বুক চিরে বের হল দীর্ঘশ্বাস।

****

ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আঁচড়াচ্ছিলো ঐন্দ্রিলা। অভ্রের মোবাইলটা সেখানে অবহেলায় পড়ে আছে। জনাব গোসলে গেছেন। একঘন্টা হয়ে গেছে। এখনো বের হবার নাম নেই। এর মাঝেই ফোনটা বাজছে কর্কশ স্বরে। ঐন্দ্রিলা দুশ্চিন্তায় পরলো। ফোনটা কি ধরবে? বেশ কয়েকবার বেজেছে। অবশেষে সে ফোনটা হাতে নিলো। ধরতে পারলো না। ফোনটা কেটে গেল। তবে অভ্রের ফোনটা হাতে নিতেই চমকে গেলো ঐন্দ্রি। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। কারণ ফোনের স্ক্রিনের ছবিটা তার। হলুদের দিনের ছবি। হলুদ শাড়িতে গালভর্তি কাঁচা হলুদে একেবারে হলদে গোলাপ লাগছিলো তাকে। নিচের দিকে তাকিয়ে হাসছিলো কোনো অজানা কারণে। বিষাদময় সেই রাতের এক টুকরো হাসি। কখন ফটোগ্রাফার ছবিটা তুলেছে সেটা জানা নেই। তার বিয়ের সেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। ছবিগুলো অভ্র তার মানে আদায় করে নিয়েছে। শুধু করেই নি তার ছবিটা ফোনের ওয়ালে রেখে দিয়েছে। অভ্রের কাজ গুলো খুব ই অবাক করছে ঐন্দ্রিলাকে। সে এক দৃষ্টিতে ছবিটা দেখছিলো, ঠিক তখন ই অভ্র খপ করে নিয়ে নিলো মোবাইলটা। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“আমার মোবাইল ঘাটছিস কেনো? কি মতলব? স্পাইগিরি করছিস, তোর অবর্তমানে কারো সাথে প্রেমলীলা করছি কিনা?”

ঐন্দ্রিলা তার প্রশ্নগুলো উপেক্ষা করে শুধালো,
“তোর ওয়ালে আমার ছবি কেনো?”

অভ্র একটু থমকালো। তারপর ফিঁচেল হেসে বললো,
“আমি যখন খুব টেনশনে বা বিপদের সম্মুখীন হই, যখন আমার মাথা একেবারেই কাজ করে না; ভয়, দুশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন আমাকে ঘিরে ধরে তখন আমি তোর ছবি দেখি। আমার মনে সাহস জন্মায়। মনে মনে বলি তোর মত ডাকাত বাঘিনীকে যদি আমি সহ্য করতে পারি তাহলে পৃথিবীর এই যাবতীয় সমস্যা কি? এগুলো তো তোর সামনে অতিতুচ্ছ, নগন্য”

ঐন্দ্রিলা চোখ ছোট ছোট করে শুধালো,
“আমি তোর জীবনের সমস্যা?”
“মহাসমস্যা”
“তাহলে বিয়ে করেছিস কেনো?”
“কারণ সুখে থাকতে আমাকে ভুতে কিলায়। তাইতো খাল কেটে কুমির না ডাকাত এনেছি”

ঐন্দ্রিলা দাঁতে দাঁত পিষে ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। অভ্রের নগ্ন গায়ে লেপ্টে আছে জলকনা। চুল ভেজা। অবহেলায় টাওয়াল ফেলে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ঐন্দ্রিলা তৎক্ষণাৎ এসে খাটের ঠিক মাঝ বরাবর একটা সীমা বানালো। বালিশ দিয়ে বর্ডার অংকন হল। তারপর কঠিন স্বরে বললো,
“আজ যদি আমার ধারে কাছেও আছিস আমি তোর মুখ ভেঙ্গে দিবো। এটা বর্ডারের সীমা। এদিকে এলেই তোর ভবলীলাসাঙ্গ”

অভ্র কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। তারপর হাসলো কৌতুক করে। সেই হাসির মর্ম ঐন্দ্রিলা বুঝলো মাঝরাতে যখন বালিশের জায়গায় বালিশ থাকা সত্ত্বেও পাথরসম হাত আর পা ঠিক উঠে এলো তার শরীরের উপর। সরাবার চেষ্টা করলেও কাজ হলো না। বরং সমস্ত শরীরের ভার ছেড়ে তার গলায় মুখ গুজলো কুম্ভকর্ণের মত ঘোড়া বেঁচে ঘুমন্ত অভ্র। ঐন্দ্রিলা হাল ছেড়ে দিলো৷ আর গায়ে শক্তি নেই এই বিশালকায় পুরুষকে নাড়ানো। ফলে বাধ্য হয়েই চোখ বুঝলো সে। এতো অস্বস্তির মাঝেও স্বস্তির ঘুম ভর করলো নেত্রপল্লবে।

****

বৌভাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে শহরের বড় কমিউনিটি সেন্টারে। ঐন্দ্রিলার পরণে সাদা একখানা মসলিনের শাড়ি। হালকা মেকাপ। নির্মল সাদা কাঠগোপালের মতো লাগছে কোমলমতীকে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে আরোও জাকজমকপূর্ণ করলো। এর মাঝে ঐন্দ্রিলার স্বস্তি ফিরলো যখন পিউকে নজরে পড়লো। স্টেজ থেকে ডাকলো তাকে। এদিকে বিখ্যাত ফটোগ্রাফারের তর সয় না। শুধু বলে,
“আপু, পোজ দেন”

হাজার খানেক ছবি সে তুলেছে। ঐন্দ্রিলার পা ব্যাথা করছে এখন। পিউ বান্ধবীর ডাকেই স্টেজে উঠলো। কেমন মলিন যেন মুখখানা। ফলে ঐন্দ্রিলা শুধালো,
“তুই নেতায় গেলি কেনো? আর সকালে যে ফোন করেছি একটাবার তোলা যায় না। জানিস আমি কি চিন্তায় ছিলাম”
“আসলে আমি ভয়েই এই মুখো হই নি। আন্টি যদি আমার পিঠ ভেঙ্গে দেয়”

অতীব কৃত্রিম স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো পিউ। ঐন্দ্রিলা তার দিকে চোখমুখ কুচকে তাকালো,
“তুই কি আমার মায়ের ঘরে আসতি? আসতি আমার ঘরে”
“বাহবা একদিনেই অভ্রের ঘর তোর ঘর হয়ে গেছে! কি উন্নতি!”

ঐন্দ্রিলা হেসে বললো,
“শুধু ঘর! ওর সবকিছু হাতিয়ে দেউলিয়া করে দিবো। তারপর পুটলি বেঁধে সোজা হিমালয়”

বান্ধবীকে হাসতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো পিউ। জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমি চাই তুই যেন খুব সুখী হস”

এর মাঝেই দুকুলের অজানা মানুষের ভিড় হলো স্টেজে। কিছু হোক না হোক বউ আর বরের সাথে ছবি তোলা একটা ট্রাডিশন। ফলে পিউয়ের নেমে যেতে হলো। স্টেজ থেকে নামতে গেলেই কুঁচিতে বাধলো পা। অমনি হুমড়ি খেতে উদ্ধত হলো। ঠিক সেই সময় সিনেমার নায়কের মত ধরে ফেললো তাকে কেউ। পিউ মাথা তুলেই দেখলো একটি শুভ্র মুখ। নির্মল হেসে বলল,
“তুমি ঠিক আছো পিউ আপু?”

সৌম্যকান্ত পুরুষকে দেখে চিনতে পারলো না পিউ। পিউকে সোজা করলো সে। মৃদু হেসে বলল,
“আমাকে চিনছো না তাই না? আমি আহাশ”
“আহাশ! তুই তো একেবারে দামড়া ছেলে হয়ে গেছিস রে। না না একেবারে ড্যাশিং ম্যান”

অবাক চোখে সহাস্য স্বরে বললো পিউ। আহাশের হাসি চওড়া হলো। প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
“অবশেষে পুরুষরুপে তোমার নজরে আসলাম তাহলে!”……….

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২০তম_পর্ব

“অবশেষে পুরুষরুপে তোমার নজরে আসলাম তাহলে!”

পিউ হাসলো আহাশের কথায়। পায়ের পাতায় ভর করে এলোমেলো করে দিলো ছেলেটার সুসজ্জিত চুল। মিষ্টি স্বরে বললো,
“এছাড়া উপায় আছে। কি থেকে কি হয়ে গেছিস। আমি তো চিনতেই পারছিলাম না। পাটকাঠি থেকে মেহগনি হয়ে গেছিস। একেবারেই সৌম্যপুরুষ। প্রেম ট্রেম করছিস নাকি হ্যা! বিদেশী মেম পেলি বুঝি”

পিউয়ের কথায় লজ্জায় আহাশের কাল রক্তিম হলো। বামকানটা একটু ডলে লাজুক স্বরে বললো,
“তুমিও না পিউ আপু! আমার মন ওই বিদেশী মেম টেমএ গলে না”
“তাহলে বলছিস, দেশী কারোর কেশের দোলায় হৃদয় হারিয়েছিস?”
“তা বলতে পারো!”

পিউয়ের দিকে গাঢ় নয়নে চেয়ে উত্তর দিলো সে। পিউ এবার সশব্দে হেসে উঠলো। ব্যাঙ্গ করে বললো,
“বাহবা, এ ছেলে তো দেখছি একেবারে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, আবার লজ্জা পাচ্ছে। থাক আর লজ্জা দিবো না। তা থাকছিস তো কিছুদিন, নাকি উড়াল দিবি আবার”
“না না, আছি বেশ কিছুদিন। আর যতদিন আছি তোমার শিডিউলে আমার জন্য সময় কিন্তু রাখতেই হবে। যতদিন আমি দেশে থাকছি তোমার সময় আমার”
“বুকিং দিচ্ছিস নাকি?”
“না আর বলতে, তোমার তো বৃত্ত সুবিশাল। সে বৃত্তে আমার মত নগন্য মানুষের কি ভাত আছে। তাই বুকিং দিতে হয়। আড়াই বছর পর ফিরেছি, এটুকু তো আমার হক”

পিউ হাসতে হাসতে বললো,
“তুই এখনো লেউটা রয়ে গেলি রে!”
“আমার লেউটাপনা তো সবার জন্য নয় পিউ আপু”

আহাশ বিড়বিড় করে কথাটা বললো। পিউ হট্টগোলের সুরে শুনতে পেলো না। ঠিক তখন ই নীলাদ্রি এক প্রকার ছুটে এলো। পরণের শার্টটা ঘামে ভিজে আছে। তার কপাল ঘামের বিন্দুতে অলংকৃত। হাঁফাতে হাফাতে বললো,
“পিউ একটু চলো তো আমার সাথে, ইমার্জেন্সি”

পিউ হতচকিত হলো। বিস্মিত স্বরে বললো,
“কি হয়েছে নীলাদ্রি ভাই?”
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। তুমি এক্ষুনি আমার সাথে চলো”
“আপনি একটু শান্ত হন। শান্ত হন। জোরে শ্বাস নিন। কুল কুল”

নীলাদ্রি জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে একটু শান্ত করলো। এরপর বললো,
“আমি শান্ত হয়েছি। চলো এবার”

বলেই পিউয়ের হাতটা ধরলো আলতো করে৷ এর মাঝেই আহাশ বাধা দিয়ে বললো,
“নীলাদ্রি ভাই, কি হয়েছে আমাকে বলুন। আমরা যেহেতু প্রোগ্রাম এরেঞ্জ করেছি তাই ঝামেলা হলে সমাধান আমরাই করতে পারবো। পিউ আপু খামোখা যেয়ে কি করবে। পিউ আপু, তুমি বরং কাউন্টারে যাও। আমি তোমার পছন্দের কালোজামের ব্যবস্থা করেছি। উপরে বাদাম কুঁচিও দেওয়া”

আহাশের কথায় তীব্র বিরক্তি নিয়ে নীলাদ্রি বললো,
“এই ছোকরা! আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি? আমার ঝামেলা তুমি সমাধান করতে পারলে আমি তো তোমার কাছেই আসতাম। উচ্চতর পর্যায়ের গর্দভ কোথাকার। এই পিউ চলো তো”

পিউ কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না। একপ্রকার হাতখানা টেনে নীলাদ্রি তাকে নিয়ে গেলো। আহাশ কাতর নয়নে তাকিয়ে রইলো। বুকটা ঝা ঝা করছে তার। এমন কেনো হয়! যাকে মনশহরে নিমন্ত্রণে হৃদয় ব্যকুল সেই মানুষটিই এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে না। আহাশের মনোক্ষুন্ন হলো। চোখে মুখে স্পষ্ট হলো বিষন্নতা।

****

পিউয়ের সামনে একটি হালকা বাদামী ছোট কুকুর। সে লেজ নাড়ছে, আর গোলগোল ঘুরছে। নীলাদ্রি তাকে টেনে কমিউনিটি সেন্টারের বাহিরে নিয়ে এসেছে৷ হাতখানা ছেড়ে বললো,
“দেখো”

পিউ হতবাক স্বরে বলল,
“আপনি আমাকে কুত্তা দেখাতে নিয়ে এসেছেন নীলাদ্রি ভাই?”
“কুত্তা বলো না তো, শুনতে পেলে কষ্ট পাবে। বেঁচারারও মন আছে”

বেশ কঠিনতা প্রকাশ পেলো নীলাদ্রির স্বরে। পিউ তার বাক্য শুধরে বললো,
“আচ্ছা আপনি আমাকে ডগ দেখাতে নিয়ে এসেছেন?”
“এটা যে সে কুকুর নয়। খেয়াল করে দেখো এটা মিক্সড ব্রিড। নেড়ি কুত্তা আর পমিরিয়ানের কম্বো। আশ্চর্য ব্যাপার। এই কুকুরগুলো শহরে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় সাজেকের রাস্তায়। আরেকটা অবাককর ব্যাপার আমি একটাকে এডাপ্ট করেছিলাম। কিন্তু সেটা তো বান্দরবান। তাকে দেখা শোনা করছে আমার সাবেক এসিস্ট্যান্ট অজল সাঙ। অথচ এই কুকুরটা দেখতে হুবুহু তার মতো। স্ট্রেঞ্জ৷ সে আমার কথাও বুঝে। দেখ আমি সিট বললে বসবে”

নীলাদ্রি সিট বলতেই কুকুরটা বসলো। নীলাদ্রি হতবাক কিন্তু খানিকটা উল্লাসিত স্বরে বললো,
“দেখেছো? স্ট্রেঞ্জ, শকুনতলা এতো দুর থেকে এলো কি করে বলোতো? পাঁচশত সতেরো কিলো যেখানে দুরুত্ব”
“শকুনতলা কে?”
“আমার কুকুরের নাম। সে কুকুর হয়েছে তাতে কি তার কি নাম হবে না। আমি তার নাম রেখেছি শকুনতলা। পাঁচ অক্ষরের নাম। কারণ ওকে শকুনতলা ডাকলে সে পাঁচবার ঘেউ করে।”

পিউ মুখে হাত দিয়ে বললো,
“ও যে মেয়ে জানলেন কি করে? পরীক্ষা করে দেখেছেন? যদি ছেলে হয় তাহলে নাম কি হবে? কদমআলী? পাঁচ অক্ষর আছে।”
“অজল বলেছে ও মেয়ে। তাই মেয়েদের নাম। শকুনতলা”
“সারনেম দেন নি? কুকুর হয়েছে তো কি? একটা সারনেম থাকবে না? শুধু নামে তো কষ্ট পেতে পারে। ওকে বরং শকুনতলা মজুমদার বলে ডাকবেন। নীলাদ্রি মজুমদারের কুত্তা থুক্কু ডগ শকুনতলা মজুমদার”

নীলাদ্রি চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,
“তুমি মজা করছো আমার সাথে পিউ?”
“মজা করছি না নীলাদ্রি ভাই, আমি সিরিয়াস। দেখুন আমি কি হাসছি”

বলেই মুখ এগিয়ে দিলো। নীলাদ্রি কিছুসময় দেখলো পিউকে। তার মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই সে কৌতুক করছে নাকি সিরিয়াস। সে কথা ঘুরিয়ে বললো,
“আচ্ছা ও এখানে এলো কি করে পিউ! তুমি তো অনেক বুদ্ধিমতী একটু বলোতো”
“এই কুকুর যে শকুনতলা মজুমদার আপনি কি শিওর! ওর নাম ধরে ডাকুন। দেখি সে পাঁচবার ঘেউ করে কিনা”

নীলাদ্রি সত্যি সত্যি ডাকলো। আর আশ্চর্যজনকভাবে কুকুরটা পাঁচবার ঘেউ করলো। নীলাদ্রি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো,
“সি! ও শকুনতলা”
“হুম্ম…. আমার মনে হয় ও বান্দরবান থেকে আপনার জন্য চলে এসেছে। ওদের নাক তো অনেক তীক্ষ্ণ হয়। শুকতে শুকতে চলে এসেছে। স্ট্রেঞ্জ, নীলাদ্রি ভাই। আপনি বরং বান্দরবান যাওয়া বাদ দিয়ে দিন। এখানে থেকে কুকুরের উপর রিসার্চ করুন। রিসার্চের বইয়ের নাম “আমার কুকুর শকুনতলা মজুমদার””
“তুমি আবার মজা করছো পিউ?”
“মোটেই না। আমি সিরিয়াস। দেখুন আমি হাসছি না”

নীলাদ্রির মুখে ভীষণ চিন্তা ভর করলো। সে ফোন বের করলো। নিজের সাবেক এসিস্ট্যান্টকে ফোন করলো। সে ফোন ধরলো না। ফলে আরোও চিন্তায় পড়লো নীলাদ্রি। কাল সকালে বাস। অথচ এখন এই শকুনতলা কান্ড ঘটলো। সেই কান্ডের সমাধান ছাড়া তো যাওয়াও যাবে না। পিউ ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আমি এখন যাই নীলাদ্রি ভাই! কালোজামের কাউন্টার শেষ হতে চললো”
“তুমি যেও না, প্লিজ। আমার কাছে বসে থাকো। আমার না ভয় লাগছে”
“কিসের ভয়!”
“জানি না, দেখো আমি ঘামছি। প্লিজ আমার কাছে থাকো”

পিউ হাসলো। নিজের শাড়ির আঁচলখানা দিয়ে আলতো করে মুছে দিলো নীলাদ্রির কপাল। তারপর সহাস্য স্বরে বললো,
“আমি আছি, ভয় নেই নীলাদ্রি ভাই। আপনি বললে আমি সারাজীবন আপনার পাশে থাকবো”
“ধন্যবাদ পিউ”

পিউ দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে নিলো। নীলাদ্রি হাটু গেড়ে কুকুরটার সামনে বসেছে। সে যতবার তাকে ডাকছে সে ঘেউ ঘেউ করছে। তাও ঠিক পাঁচবার। পিউ এই পাগলামি দেখছে। মুগ্ধনয়নে। তার কালোজাম আজ খাওয়া হবে না। তবে আফসোস নেই। এই পাগল পুরুষটাকে দুচোখ মুদে দেখতে তো খারাপ লাগছে না।

*******

অভ্রের খালারা আজ চলে যাবে। বাস রাত এগারোটায়। কিন্তু অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা তাদের বিদায় দিতে পারবে না। কারণ এখন তারা ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি যাবে নাইওরে। ফলে খালারা ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন,
“বউ আর দেখা হবে না রে। তুই তো তোর বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছিস। আমাদের ভুলিস না। আমাদের তোরে খুব ভালা লাগছে। আমাদের বাড়ি আসিস কিন্তু। একেবারে মাস দুই তিনেক জন্য আইবি, ওই ছোটা কাজের মানুষের মতো আইবি না কইলাম। আমি তোরে পিঠা খাওয়ামু। হাস রাইন্দে খাওয়ামু। কথা দে আইবি”
“আপনারা আর কিছুদিন থেকে যান না খালা। আমি বাড়ি এসে ঘুরতে যাবো”
“নারে, জানিস তো পোলাদের পরীক্ষা। তুই আসিস বউ”

বলেই অশ্রু ছেড়েদিলেন তিনজন। মাত্র দুইদিনে কারোর এতো মায়ায় পড়া যায় বুঝি! ঐন্দ্রিলার মনে হলো তারা তিনজন তার আপন খালা। মায়ের কোনো বোন নেই। তাই খালার আদর কখনো পায় নি ঐন্দ্রিলা। এই তিনজনের মাথায় বেশ সমস্যা আছে বটে। কিন্তু তারা মনের দিক থেকে খুবই ভালো মানুষ। তাই ঐন্দ্রিলাও কেঁদে দিলো। তারা জড়াজড়ি করে কাঁদছে। একখালা বলছে,
“তুই যাইস না”
“আমি যাব না খালা”

অভ্র হতবাক নয়নে এই চারজন নারীকে দেখছে। তার ঠিক কেমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত জানা নেই। কোনো বধু নাইওরে যাবার সময় কাদে এই ঘটনা বিরল। বিল্লাল ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভাবীআপু কানতেছে কেন?”
“যা জিগায় আয়”
“ছিঃ স্বামী হলে এটুকুও জানিস না!”

ধিক্কার জানালো বিল্লাল। বিল্লালের দিকে কঠিন নয়নে তাকালো অভ্র। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো। খালাদের থেকে ছাড়ালো ঐন্দ্রিলাকে। ঐন্দ্রিলার কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে যাবার উপক্রম। অভ্র তাকে একহাত জড়িয়ে ধরে খালাদের বললো,
“এখন কিন্তু বেশি সময় নেই। বাস মিস করবা। সতেরো টাকার টিকিট। লস হবে কিন্তু পাঁচ হাজার একশত টাকা”

টাকার কথা শুনে তারা কান্না থামালো। অবশেষে ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলো। ঐন্দ্রিলা আরোও কিছুদিন কাঁদলো। এই মেয়ে তার বিদায়তেও কাঁদে নি। অথচ নাইওরে যাবার সময় কাঁদছে। অভ্র তাকে দেখে মৃদু হাসলো। তারপর একটা টিস্যু দিয়ে চোখে মুছে বললো,
“থাক! আমরা যাবো খালাদের বাসায়। কাঁদিস না”
“সত্যি”
“হ্যা, সত্যি”

****

অবশেষে নিজের ঘরে আসলো ঐন্দ্রিলা। কেমন যেনো শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে। বাহিরে দরজা ধরে অভ্রের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছে ঐন্দ্রিলার ফুপাতো বোনেরা। অভ্র ঘরে এসেই আগে ওয়াশরুমে গিয়েছে।ঐন্দ্রিলা নিজের খাটে শুলো। দুদিন মনে হচ্ছে দুই বছর। এই দুদিন ঘুমাতে পারে নি পাথরের বস্তার জন্য। চট করেই মাথায় একটা বুদ্ধি চলে এলো। পাশে পানির বোতল রাখা ছিলো। খাটের বামপাশটায় পুরো বোতল পানি ঢেলে দিলো সে। মনে মনে পৈশাচিক হাসি হাসলো সে। এর মাঝেই বেরিয়ে এলো অভ্র ভেজা মুখ মুছতে মুছতে। ঐন্দ্রিলা তাকে দেখে ঢং করে বললো,
“আহারে অভ্র, তোর জায়গাটা তো ভিজে গেছে। ভেজা জায়গায় কি করে ঘুমাবি? তোর আবার বামপাশ ছাড়া ঘুম হয় না! আর আমি মোটেই শ্রেষ্ঠ স্ত্রী ট্যাগ নেবার জন্য আমার অংশটা তোকে ছেড়ে দিবো না। এখন কি হবে অভ্র? তুই কি ভেজা অংশে ঘুমাবি নাকি আমি তোকে নিচে বিছানা করে দিবো?”

ঐন্দ্রিলার ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি। অভ্রের বুঝতে বাকি রইলো না তার শোবার অংশটা ভিজলো কি করে। কিছুসময় ধীর নয়নে চেয়ে থেকে সে হাসলো কিঞ্চিত। তারপর ঐন্দ্রিলার দিকে ঝুঁকে এসে বললো,
“শ্বশুরবাড়িতে জামাই মাটিতে শুলে তোর মা-বাপের সম্মান যাবে। বেচারা শ্বাশুড়ি মা এতো যত্ন করে জামাই আদর করছেন সব ভেস্তে যাবে। তুই চিন্তা করিস না, আমি তোর জায়গাতেই এডজাস্ট করে নিতে পারবো। তুই বরং আমার বুকের উপর শুয়ে যাস। স্বামী-স্ত্রী আমরা জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়বো”
“আমার ঠেকা পড়ছে নাকি!”
“তাহলে আমি বরং শ্বাশুড়ি মাকে বলি! আমাকে একটু শোবার জায়গা করে দিতে। আমার বউ তো আমাকে শুতে দিবে না। দেখি মা কি বলেন”

বলেই সে বাহিরের দিকে পা বাড়াতেই ঐন্দ্রিলা তার হাত টেনে ধরে তাকে বসালো খাটে। তার মুখখানা হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,
“চুপ করে বসে থাক। তোর ঘুমানোর শখ খুব না। তুই এই খাটে থাক।”

অভ্র ঐন্দ্রিলার হাতখানা নামিয়ে তাকে টেনে নিজের কোলে বসালো। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তা বললে হয় বাবু! আমার তো তোকে বুকে নিয়ে ঘুমানোর শখ”

ঐন্দ্রিলা অতিকষ্টে তার বাধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। রাগী স্বরে বললো,
“মরে যা”

বলেই আলমারী থেকে একটা কাঁথা আর বালিশ বের করলো। নিচে বিছালো। তারপর শুয়ে গেলো। অভ্র হাসছে পিচাশের মত। ঐন্দ্রিলার ইচ্ছে করছে এই ছেলেটার গায়ে আবার গোবর পানি ঢেলে দিতে। তারপর আবার গোসল করাতে। কিন্তু এখন কিছু করা যাবে ন। তবে শোধ তো সে তুলবেই। অভদ্র ছেলেটা এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দিলো। বলে ঠান্ডা লাগছে ঐন্দ্রিলার। সে কড়া নজরে তাকাতেই অভ্র নির্বিকার চিত্তে বললো,
“আমার গরম লাগছে বাবু। তুই চাইলে আমার বুকে এসে শুতে পারিস”
“বে য়া দ ব”

বলেই চোখ বুজে নিলো ঐন্দ্রিলা। সে কথা বাড়াবে না। মনে মনে বললো,
“সকাল হতে দাও বাঁছা”

*****

অন্যদিনের মতো বেশ আয়োজন করে সকালো হলো। পাখির কিচিরমিচির অবধি শোনা গেলো। জানালার শিখ গলে প্রবেশ করলো কাঁচা রোদ। ঐন্দ্রিলার ঘুম ভাঙ্গলো ধীরে ধীরে। চোখ মেলতেই বেশ অবাক হলো। সে খাটে শুয়ে আছে। তার গায়ে মোটা কম্বল। খুব অবাক হলো সে। অভ্রকে নজরে পড়লো না তার। সে উপরে কি করে এলো বুঝতে পারছে না। অভ্র তাকে উপরে শোয়ালো! ওই বেয়াদব এমন কিছু করবে নাকি!

খাবার রুমে যেতেই দেখলো হুল্লোড় পড়েছে। বাদশাহ ছুটছে একটা বাদামী কুকুরের পেছনে। রান্না শুরু হয়ে গেছে। গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নীলাদ্রি পাহাড়ে যায় নি। সে আয়েশ করে খিঁচুড়ি খাচ্ছে। খাওয়া শেষে হাড্ডি খাচ্ছে। ঐন্দ্রিলা বসতেই সে গম্ভীর স্বরে বলল,
“সাবধান হ, বিপদ সামনে। আমার মনে হচ্ছে যেভাবে আমাকে আমার ঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে তোকেও করা হচ্ছে। তোর জায়গা নিবে অভ্র। বেশি দিন বাকি নেই অভ্রকে মজুমদার বংশে দত্তক নেওয়া হবে”
“কেনো?”
“বাবাকে নিয়ে সকালে বাজারে গিয়েছে। বাবা মুগ্ধ তার বাজার করায়। সে অভ্রের মাঝে নিজেকে দেখিতে পাচ্ছে”

ঐন্দ্রিলা চোখ ছোট ছোট করে দেখলো অভ্রকে। ফুপুদের সাথে কি খাতির তার। ফুপুরা পারলে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। হ্যাপি তো বলেই বসলো,
“ঐন্দ্রিলার রাজকপাল। তোমার মতো জামাই পেয়েছে। নয়তো ওর যে স্বভাব আমি তো ভেবেই রেখেছিলাম ওর বিয়ে হবে না। বুঝলি ঐন্দ্রিলা অভ্রকে মাথায় করে রাখবি। ও সব জেনেও তোকে কি ভালোবাসে!”

হ্যাপি ফুপির কথার উত্তর কখনোই দেয় না ঐন্দ্রিলা। আজও তাকে এড়িয়ে গেলো। সালাম সাহেব বোনকে চোখ রাঙ্গালেন। কিন্তু হ্যাপি শুনল না। সে বলতেই লাগলো,
“তোমাকে বাবা আগ থেকেই বলে রাখি, আমার ভাতিজী মোটেই মিষ্টি স্বভাবের নয়। খুবই রাগী, আর ঝগরুটে। পরে বলো না”
“আপনি না থাকলে কি হতো ফুপু। ভাগ্যিস জানালেন”

অভ্র ব্যঙ্গ করে বলল। ফলে খুশি হয়ে গেলো হ্যাপি। মিষ্টির প্লেট এগিয়ে বললো,
“নাও, বাবা মিষ্টি খাও”
“না ফুপু, আমি মিষ্টি খাই না। আসলে আমার মিষ্টি পছন্দই না। সেটা হোক খাবার বা মানুষ। এইজন্যই বুঝি ঐন্দ্রিলা আমার বউ”. …………

চলবে