মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-২১+২২

0
36

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২১তম_পর্ব

“নাও, বাবা মিষ্টি খাও”
“না ফুপু, আমি মিষ্টি খাই না। আসলে আমার মিষ্টি পছন্দই না। সেটা হোক খাবার বা মানুষ। এইজন্যই বুঝি ঐন্দ্রিলা আমার বউ। ভাগ্যিস সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। নয়তো মিষ্টি মেয়েদের মাঝে আমাকে পিষতে হতো”

খুব বিনয়ী স্বরে কথাটা বললো অভ্র। তার কন্ঠে অভদ্রতা, কটাক্ষ ছিলো না। ফলে হ্যাপি তাকে বেয়াদব আখ্যা দিতে পারলো না। তবে তার মুখবিবরে নেমে এলো মেঘ মেদুর। অভ্রের এমন উত্তরে সালাম সাহেবের মুখে যেনো চারশত ভোল্টের হাসি ফুটে উঠলো। তার জামাই তাকে আজ শুধু চমকে দিচ্ছে আর মুগ্ধ করছে। একজন বাবার জন্য কি এটাই সর্বপ্রাপ্তি নয় যে তার মেয়ের জামাই মেয়ের জন্য সোচ্চার। তাকে আগলে রাখে অপমানিত হবার সুযোগ দেয় না। সাবেরা মুখে গর্বের ছাপ। সে মানুষ চিনতে ভুল করে না। নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ালো প্লেট হাতে। যাবার সময় ঐন্দ্রিলার কানে কানে বলে গেলো,
“দেখেছিস! অতিসত্ত্বর মজুমদার বংশে নতুন এডিশন হবে”

নীলাদ্রির কথাটা বিনাবাক্যে শুনলো ঐন্দ্রিলা। কোনো প্রত্যুত্তোর না করে নাস্তা শেষ করলো। উঠে যেতে নিলে সাবেরা বললো,
“তোমার জন্য পায়েশ রেধেছি। তোমার তো পায়েশ দিয়ে রুটি পছন্দ”
“আমার খাওয়া হয়ে গেছে”

নির্লিপ্ত স্বর ঐন্দ্রিলার তার কন্ঠের ধার টের পেলো সাবেরা। মেয়েটা কেমন কঠিন হয়ে গেছে। নিজের চার পাশে তুলেছে শক্ত দেওয়াল। সেই দেওয়াল কি একদিনে ভাঙ্গা সম্ভব! ঐন্দ্রিলা চলে গেলো নিজ ঘরে। সাবেরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অভ্র ব্যাপারটা খেয়াল করলো খুব নিপুন চোখে। শ্বাশুড়ির হাত ধরে বললো,
“একটু সময় দিন মা। অভিমান যত বেশি হয় তা ভাঙ্গতে সময় বেশি লাগে”
“ভয় হয়, যদি অভিমান ঘৃণায় পরিণত হয়!”

ম্লান হেসে কথাটা বললো সাবেরা। সাবেরার কথার উত্তরে অভ্র বলল,
“ও বোকা মেয়ে শ্বাশুড়ি মা। এতো সহজে ও ঘৃণা করে না। আমাকে ঘৃণা করতে ওর আঠারো বছর লেগেছে। সেখানে আপনি তো তার মা। চিন্তা করবেন না”

সাবেরা হাসলো। অভ্র তাকালো একবার ঐন্দ্রিলার ঘরের দিকে। জেদি মেয়েটা এখনো জেদ ছাড়ে নি। তার এই জেদের প্রাচীর কবে ভাঙ্গবে কে জানে!

****

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। বাতাস থমকে আছে। আকাশের চাঁদরে কিছু অভিমানী মেঘ জমেছে। সেই মেঘের অভিমানে সবকিছু থমকে গেছে। সূর্যও ঢেকে আছে সেই অম্বুদের অভিমানে। যেমনটা ঐন্দ্রিলার মনের উচ্ছ্বাসগুলো মিলিয়ে আছে মায়ের প্রতি অভিমানের যাতাকলে। সে মায়ের উপর অভিমানটা ছাড়তে পারছে না। মা তার জন্য অনেক কিছু করছেন। নিজের ভালোবাসা জাহির করতে চাইছেন। কিন্তু এগুলো ঐন্দ্রিলা চায় না। সে চায় শুধু একটা ছোট্ট “সরি”। যেখানে সে থাকবে অনুতপ্ত। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। এর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করলো অভ্র। হাতে কফির মগ। কড়া কালো কফি। ঐন্দ্রিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পাশে দাঁড়ালো। হাতে কফির মগ ধরিয়ে বললো,
“নে তোর কালা কফি। কালা কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা কর”

ঐন্দ্রিলা তার দিকে তাকালো। তার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে বটে। কিন্তু কাউকে সে বলে নি। অভ্রের এমন হুটহাট উদ্ভট কাজগুলো খুব বিরক্ত করছে। যে ছেলেটা সারাজীবনি তার অস্থিমজ্জা জ্বালিয়ে আসছে সে হুট করে এমন আচারণ কেনো করবে। এতোটা তো যত্নশীল অভ্র নয়। অভ্র পকেটে হাত ভরে দাঁড়িয়ে আছে। ঐন্দ্রিলা মগটা জানালার ধারে রেখে চোখ ছোট ছোট করে শুধালো,
“সোজা সাপ্টা বলতো তোর উদ্দেশ্য কি! এইসব করে কি লাভ তোর! দুইদিন ধরে দেখে যাচ্ছি। কি ভাবিস আমি বুঝি না। তোর অভিনয় ধরতে আমার সময় লাগে না। বাবা-মাকে পটাতে হলে তাদের সামনে ঢং কর। আমার সামনে ভালো সাজার ঢং কেনো করিস! উদ্দেশ্য কি তোর?”

ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে তার দিকে শান্ত চোখে তাকালো অভ্র। হাসলো কৌতুক করে। যেনো পৃথিবীর সব থেকে মজার জোকস শুনেছে সে। তারপর গাঢ় স্বরে বললো,
“আমার উদ্দেশ্য তোকে আমার প্রেমের জালে ফেলা। তারপর চুটিয়ে সংসার করা! বিয়ে তো মুখ দেখার জন্য করি নি”

অভ্রের কথায় স্তব্ধ হলো ঐন্দ্রিলা। থমকালো সে। অভ্রের চোখের গাঢ় মায়ায় খাবি খেলো ভীষণভাবে। ফলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। থমথমে স্বরে বললো,
“সংসার করতে প্রেম লাগে না। যদি সংসার করতে চাস আমার আপত্তি নেই। তবে প্রেম আমার কাছে অভিশাপ। আমি নিজেও জানি না বিয়েটা কেনো করেছি! এই বিয়ের ভবিষ্যত কোথায় সেটাও জানি না! পৃথিবীর আর পাঁচটা মানুষকে দেখাতে সংসার করতে হলে করবো। স্ত্রী হিসেবে যা যা করতে হবে করবো। তবে অহেতুক প্রেমের জন্য সময় নষ্ট করিস না। নশ্বর শরীর ভোগ করতে চাইলে বলিস আমার আপত্তি নেই। ভাঙ্গা হৃদয়ে রাজত্ব করার অলীক স্বপ্ন ছেড়ে দে”

কথাটা শেষ করার পূর্বেই এক গাছা চুল মুষ্টিবদ্ধ করে ক্ষিপ্রভাবে ঐন্দ্রিলাকে নিজের দিকে টেনে আনলো অভ্র। তাদের মাঝের দুরত্বখানা মাত্র কয়েক ইঞ্চি। অভ্রের ক্ষিপ্ত, রক্তিম আঁখির দিকে চাইতেই শরীর কেঁপে উঠলো ঐন্দ্রিলার। ভয় গ্রাস করলো হৃদয়। অভ্রের শক্ত হাতের জোরে ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠলো সে। কাঁপা স্বরে বললো,
“ছাড়।”
“কেনো! ছাড়বো কেনো!”

দাঁত দাঁত পিষে কথাটা বললো অভ্র। তার ক্রোধিত মুখখানা হিম ধরালো শিরদাঁড়ায়। অভ্র তাকে উত্তর দেবার সুযোগ দিলো না। রাগে গর্জে উঠলো,
“কি ভাবিস আমাকে! আমার শরীরের লোভ শুধু! শোন এই মাহাবুল হকের মেয়ের অভাব নেই। তোর শরীর ভোগের জন্য আমি হেন্দিয়ে মরছি না”
“অভ্র লাগছে, ছাড়”

অভ্র তার মুষ্টি আরো শক্ত করলো। ফলে অসহনীয় ব্যাথায় নীল হয়ে গেল ঐন্দ্রিলার মুখ। কিন্তু অভ্র তার বেদনাতুর মুখখানা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো,
“আমি ভালো মানুষ না ঐন্দ্রিলা। আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না। আমি খারাপ হলে সহ্য করতে পারবি না। এখনো ওই ভেড়া সৌরভের শোকে দেবদাস সেজেছিস নাকি! বড় বড় কথা হাকাচ্ছিস। একটা কথা মাথায় রাখ। এই সৈয়দ মাহাবুল হক তোর জীবনের ভবিতব্য। আমার সাথেই তোর সংসার করতে হবে। তাও ভালোবেসে”
“ভালোবাসা কি জোর করে হয়!”
“আমি তো এখনো জোর করি নি। আমাকে বাধ্যও করিস না জোর করতে”

বলেই ছেড়ে দিলো সে। হনহন করে হেটে ঘর ছেড়ে চলে গেলো সে। ঐন্দ্রিলা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চুল ব্যাথা করছে। ছেলেটা এমন কেনো! মুহূর্তেই যত্ন করে আগলে রাখবে মুহুর্তেই ক্ষতবিক্ষত করবে! এমন মানুষকে আদৌও ভালোবাসা যায়। ঐন্দ্রিলার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এটা মাথা ব্যাথা নাকি অন্তরের দহন জানা নেই। বিকট শব্দ করে অভিমানী মেঘেদের কান্না ভিজিয়ে দিলো ধরনী। ঐন্দ্রিলা গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে কোমল গালজোড়া।

*****

আহাশ ছাতি হাতে অপেক্ষা করছে পিউয়ের বাসার সামনে। আজ তাদের ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা হয়েছে। যদি বৃষ্টিটা পরিকল্পনায় ছিলো না। তবুও বৃষ্টির জন্য পিউ এর সাথে সময় কাটানোর সুযোগ হারাতে চায় না সে। পিউ জানালার ফাঁক দিয়ে ছেলেটাকে দেখতেই অবাক হলো। এই তীব্র বর্ষণে কেউ কি করে ঘর থেকে বের হয় সেই অংকই মেলাতে পারলো না সে। ফলে নেমে এলো সে ছাতি হাতে। পরণে একটা পুরোনো সেলোয়ার কামিজ। চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে জটলা পেকে আছে। আহাশ তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখলো। এই নারীকে তার সব রুপেই ঐশ্বরী মনে হয়। সহাস্য গলায় বললো,
“তুমি তৈরি হও নি”
“পাগল তুই? এই বৃষ্টিতে কই যাবো?”
“যাবে না তুমি পিউ আপু?”

করুন স্বরে শুধালো আহাশ। পিউ পড়লো মহাবিপাকে। ছোটবেলা থেকে আহাশকে চিনে পিউ। অভ্রের থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম। রুদ্র অভ্রের নরম ভাই সে। মনটা একেবারেই তুলতুলে। ছেলেটা সেই ছেলেবেলা থেকেই বেশ লেউটা কিসামের। তাকে দেখলেই রাস্তার বেড়ালছানার মত লাগে। যেন তার মালিক তাকে মাছ চুরির জন্য কান ধরে বের করে দিয়েছে। এখন যদি সে তাকে বলে “না যাবো না” তাহলে বেড়ালের মতো কাচুমাচু করে চেয়ে রইবে। ছেলেটার এই স্বভাব আড়াই বছরে যে বদলায় নি সেটা বুঝতে বাকি রইলো না পিউয়ের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“বেশি দূর যাবো না। ধারেকাছেই”
“চা খাবে? আর পিয়াজু?”
“না হালিম খাবো। দাঁড়া আসছি আমি”

বলেই সালোয়ার-কামিজটা বলতে পাঁচ মিনিটের মাঝেই নেমে এলো পিউ। চুলগুলো চিরুনি না দিয়েই খোঁপা করেছে। ছোট ভাইয়ের সাথে বের হবে এতো সাজের ঘটার কি প্রয়োজন। বের হতেই তার ফোন বেজে উঠলো। “ঐন্দ্রিলা” নামটা উজ্জ্বল। ফোনটা ধরতেই ওপাশের মানবী বলে উঠলো,
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ি আয়”

বলেই ফোনটা কেটে দিলো সে। পিউ আহাশের দিকে তাকাতেই যে বললো,
“চলো”
“আজ থাক। আমি বরং কাল যাবো”

আহাশ ঠিক বেড়ালছানার মতো মুখটা কাচুমাচু করে ফেললো। পিউ বললো,
“আচ্ছা চল, আমাকে ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি নিয়ে চল। এটাও একপ্রকারের ঘোরাই হবে তাই না?”

পনেরো মিনিটের পথটুকু একত্রে কাটানোর লোভে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আহাশের মুখখানা। ছাতিটা পিউয়ের মাথার উপর দিয়ে বললো,
“হেটে হেটে যাই। বৃষ্টিতে হাটতে খারাপ লাগে না”

পিউ মেনে নিলো। ছেলেটার হাসিটা অম্লান করার ইচ্ছে হলো না। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে বললো,
“তুই একটা পাগল”
“তোমার কাছে আমি পাগল, ছাগল, গরু সব হতে রাজি”

******

ঐন্দ্রিলাদের বাসায় পৌছাতেই হতবিহ্বল হলো পিউ। নীলাদ্রি তার শকুনতলাকে কোলে নিয়ে বৃ্‌ষ্টিতে ভিজছে। বাদশাহ তার মাথার উপর ছাতি ধরে আছে। নীলাদ্রির মুখখানা মুর্ছিত, ম্লান। পিউ তাকে শুধানোর সাথে সাথে সে কোলের শকুনতলাকে ছেড়ে সকলকে উপেক্ষা করে পিউকে জড়িয়ে ধরলো। নীলাদ্রির এমন কার্যে হতভম্ভ হলো পিউ৷ বাদশাহ তার নয়ন অন্যদিকে সরিয়ে নিলো। আহাশ স্তব্ধ হয়ে গেলো। ভাষা হারিয়ে ফেললো সে। পিউ কাঁপা স্বরে শুধালো,
“কি হয়েছে নীলাদ্রি ভাই!”

নীলাদ্রি উত্তর দিলো না। তবে পিউয়ের কাধে উষ্ণ তরলের অনুভূতি হলো। বাদশাহকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,
“নীলাদ্রি স্যারের বৃক্ষমহল বাজ পড়ার কারণে পুড়ে গেছে। তার সব জামা কাপড়, বইখাতা সব পুড়ে গেছে। এখন এককথায় সে দেউলিয়া। পথের ফকির”

নীলাদ্রি এখনো জড়িয়ে ধরে আছে পিউকে। পিউ শান্ত স্বরে শুধালো,
“আপনার কিছু হয় নি তো নীলাদ্রি ভাই!”
“নাহ, তবে ওই জল্লাদ হাসছে পিউ। আমার ঘর দখল করে নিয়েছে। এখন আমার থাকার জায়গা নেই”
“আপনার কিছু হয় নি এটাই শ্রেয়। বাকি কোথায় কি হয়েছে আপাতত ভুলে যান”

নীলাদ্রির শখের বৃক্ষমহল পুড়ে গেছে। খুব সাবধানতার সাথে ভেতরের কিছু অক্ষত জিনিসকে বাঁচানো গেছে। সেটা দেখে সালাম সাহেব খুশিতে কিছু সময় কোদাকোদি করেছেন, ভেঙ্গিয়েছেন ছেলেকে। পৈশাচিক হেসে বলেছেন,
“হেহে, ডাবল মাস্টার্স তোর বাড়ি উড়ে গেছে। এতো শিক্ষিত হয়ে এটুকু জানিস না যে বাজ পড়ে ঘরের তারে আগুন ধরতে সময় নেয় না। আহা কি আনন্দ। আমাকে টেক্কা দেওয়া। তুই আসলে একটা ছাগল, আহাম্মক। সার্টিফাইড গাধা”

নীলাদ্রি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলো। বাবার সামনে সে ঝুকবে না। কিন্তু এক ঘন্টা বাদে তার ঘরের চাবি নিয়ে পিউ তার হাতে ধরিয়ে বললো,
“নিন, আপনার সম্পত্তি আমি পুনোর্দখল করে দিলাম”
“কিভাবে করলে?”
“সেটা সিক্রেট, বলা বারণ। আচ্ছা নীলাদ্রি ভাই আপনি কি আপনার বইগুলোর জন্য কাঁদছিলেন?”
“না ”
“জামাকাপড়?”
“না”
“তাহলে?”
“বলা যাবে না। সিক্রেট। সময় হলে বলবো। সবার প্রথমে তোমাকেই বলবো”

তখনই নজর গেলো তার আহাশের উপর। ছেলেটা ছাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। নীলাদ্রি চোখ কুচকে শুধালো,
“এই গর্দভটা এখানে কেনো?”

পিউ সাথে সাথেই বললো,
“আমার সাথে এসেছে ও”
“তোমার সাথে ও আসবে কেনো?”
“আচ্ছা নীলাদ্রি ভাই। এই তুফান বৃষ্টিতে ও যদি আমাকে না নিয়ে আসতো আমি কি আসতে পারতাম? তাছাড়া”

পিউয়ের কথা শেষ হবার সুযোগ হলো না। তার আগেই নীলাদ্রি আহাশকে বললো,
“ছোকরা তুমি তোমার বাড়ি যাও”
“বাড়ি যাবো কেনো? আমি কি করবো সেটা আপনি বলবেন? আর আমি বাড়ি গেলে পিউ আপু বাড়ি যাবে কি করে?”

আহাশ বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো। তার কথায় নীলাদ্রির মুখখানা কঠিন হলো কিঞ্চিত। দৃষ্টি শানিত হলো। পরমুহূর্তেই কঠিন স্বরে বললো,
“সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না ছোকরা। দরকার হলে আমি নিজেই তাকে পৌছে দিবো”……

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২২তম_পর্ব

“সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না ছোকরা। দরকার হলে আমি নিজেই তাকে পৌছে দিবো”

নীলাদ্রির কঠিন বাক্য তীব্রভাবে আঘাত করলো আহাশের অন্তঃসত্ত্বাকে। সেও কঠিন কন্ঠে বললো,
“আপনার সাথে পিউ আপু যাবে কেন? সে আমার সাথে বেরিয়েছে আজ। আজকে সে আমার সাথেই থাকবে”

হাটুর বয়সী ছোকড়ার এমন তর্কযুদ্ধের আহবান সহ্য হলো না নীলাদ্রির। সেও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। তার স্বর ধাঁরালো হলো,
“কেনো! বডিগার্ড তুমি পিউয়ের। উট্টিন্না ছোকরা, মুখে যেন ফুলঝুড়ি। এই, আমি দিয়ে আসবো পিউকে। তোমার ডিউটি শেষ বাড়ি যাও”

নীলাদ্রির পাল্টা উত্তরে একপ্রকার শীতল যুদ্ধ শুররু হয়ে গেলো আহাশ এবং নীলাদ্রির মাঝে। মাঝে যাতাকলের বাদামটি হলো পিউ। এর মাঝে সে ভুলেই গেলো তাকে যে ঐন্দ্রিলা ডেকেছে। একটা সময় সে দুজনকেই শান্ত করতে চেঁচিয়ে উঠলো,
“আমাকে কারোর দিয়ে আসতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো”
“না, আমি তোমাকে দিয়ে আসবো”

একসাথেই চেঁচিয়ে উঠলো তারা। এর মাঝেই পিউয়ের ফোন বাজলো। ঐন্দ্রিলা ফোন করছে তাকে। হন্তদন্ত হয়ে ফোন ধরতেই ওপাশের রুদ্র স্বর শোনা গেলো,
“বার্গারের প্যাটি হওয়া হয়ে গেলে কি মহারানী উপরে আসবেন”

***

ঐন্দ্রিলার ঘরে পিউ বসে আছে। আহাশ আর নীলাদ্রিকে নিজের যুদ্ধের মাঝে একরকম ফেলে এসেছে সে। ঐন্দ্রিলা কঠিন নয়নে তাকিয়ে আছে পিউয়ের দিকে। পিউ কাচুমাচু করে বললো,
“কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?”
“আমি তোকে কখন আসতে বলেছি? এটা তোর সময় হলো! ভাইয়াকে দেখলে কি তুই জগৎ ভুলে যাস নাকি!”

পিউয়ের স্বর আরোও নরম হলো,
“এমন করিস কেনো তুই! জানিস তো নীলাদ্রি ভাইয়ের কষ্ট দেখলে আমার মন ঠিক থাকে নাম বেঁচারা কাঁদছিলো”
“ঐ ছাগলের কান্না, কান্না আর আমার কান্না তো তেজপাতা”
“এমনে বলিস না”
“বাদ দে, কথা সেটা না। কথা হচ্ছে আমি অভ্রের নামে নারী নির্যাতনের মামলা করবো”

ঐন্দ্রিলার কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেলো পিউয়ের। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“ও তোকেও ঘুষি দিছে?”
“না”
“তাহলে চড় মারছে?”
“না”
“তাহলে? কেস কেনো করবি?”
“কারণ ওর উপর আমি রেগে আছি। খুব রেগে আছি। ও কি ভাবে নিজেকে! আমি ওর হাতের পুতুল? ইচ্ছে হলো আদর করলো, ইচ্ছে হলো আমাকে ছুড়ে মারলো। কি ভাবে নিজেকে?”

পিউ ঐন্দ্রিলার কথার আগামাথা খুজে পাচ্ছে না। কেমন খেই হারিয়ে ফেলছে। হতবিহ্বল স্বরে শুধালো,
“আসলে খুলে বল তো হয়েছে কি!”

ঐন্দ্রিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আস্তে ধীরে দুদিনের সব কিছু খুলে বললো। পিউয়ের থুতনিতে হাত চলে গেলো। এখন সে ভাববে। ভাবার সময় সে কথা বলে না। অনেকসময় ভেবে বললো,
“দোস্ত মামলা তো জন্ডিস”
“মানে?”
“মানে অভ্র তোর প্রতি ডেস্পারেট। ব্যাপারটা আমার সন্দেহ ছিলো। কিন্তু এখন কেনো যেনো সত্যি লাগতেছে। ও সত্যি তোরে ভালো টালো বাসে না তো?”

পিউয়ের প্রশ্নে চুপ করে রইলো ঐন্দ্রিলা। মলিন স্বরে বললো,
“ভালোবাসা বুঝি এমন হয়!”
“সুন্দর ভালোবাসার নমুনাতো দেখলি ই। প্রথমে পিয়াল আর তারপর সৌরভ। মিষ্টতা দেখিয়ে তাদের ভালোবাসায় ছিলো শুধু স্বার্থ। আসলে ভালোবাসা কেমন হয় সেটা আমরা কেউ জানি না। কাব্যিক ভালোবাসা তো অনেক সুন্দর হয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে কাব্যের স্থান নেই। আমাকে দেখ, এক আস্তো পাগলকে ভালোবাসি। অথচ সেই পাগলের মনে কি চলে জানি না। সে যদি আমাকে ভালোবাসে তাহলে ভেবে দেখ সেই ভালোবাসা কেমন হবে! নিশ্চয়ই ওই গদ্য পদ্যের প্রেমিকের মত হবে না। প্রতিটা মানুষ আলাদা। অভ্র মানুষটাই সবার থেকে আলাদা। উড়াধুরা পাব্লিক। ওর ভালোবাসাও উড়াধুরা হবে। আমি বলি কি! অনেক তো মিষ্টি ভালোবাসার পেছনে ছুটেছিস, এবার একটু কড়া নিমপাতা ভালোবাসা সেবন কর। নিমপাতা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই নিমপাতা ভালোবাসাও ভালই হবার কথা”

পিউয়ের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো ঐন্দ্রিলা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ম্লান স্বরে বললো,
“ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরায় পিউ। আচ্ছা, বলতো একবার বিশ্বাস ভাঙ্গলে কি আবার বিশ্বাস করা যায়! একবার হৃদয় ভাঙ্গলে কি আবার ভালোবাসা যায়? আমার যে ভয় হয়। আমার ভাঙ্গা কাঁচে হাটতে পারবো না। পঁচা শামুকে তো দুবার পা কেটেছে।”

পিউয়ের কাছে উত্তর নেই। ঐন্দ্রিলা জানালার দিকে চেয়ে আছে। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। আজ বোধহয় বৃষ্টি থামবে না।

******

জরুরি কাজে আহাশকে বাসায় যেতে হয়েছে। তীব্র বৃষ্টিতে রিক্সা পাওয়া গেলো না। তাই নীলাদ্রি নিজ দায়িত্বে পৌছে দিতে এলো পিউকে। হেটে হেটে এসেছে তারা। পুরোটা সময় পিউয়ের মাথায় ছাতি ধরেছিলো সে। ফলে কাঁধের একাংশ তার ভিজে গেছে। পিউকে গেটের ভেতর অবধি পৌছে দিলো সে। পিউ ভেতরে ঢোকার সময় একবার ডাকলো,
“পিউ”
“কিছু বলবেন নীলাদ্রি ভাই!”
“আচ্ছা, ঐ ছোকরা তোমার আগে পিছে ঘুরে কেনো!”
“কে আহাশ!”
“হ্যা”

পিউ হাসলো। সহাস্য স্বরে বললো,
“আসলে দেশে এসেছে অনেকদিন পর তো তাই বায়না করেছে আমার সাথে থাকবে”
“মানে কি তুমি টুরিস্ট গাইড নাকি?”
“আপনি ওকে দেখলেই এতো চেতেন কেনো নীলাদ্রি ভাই?”

হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো পিউ। ভেবেছিলো মানুষটি উত্তর দিবে না। কিন্তু ভুল সে স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“কারণ আমার ভালো লাগে না তাকে। তোমার সাথে ঘেষাঘেষি করে। ইচ্ছে করে একটা চড় লাগাই। কিন্তু আমি চড় দিতে পারি না। আমি একজন সভ্য মানুষ। তাই সংযম করেছি”

নীলাদ্রির এমন উত্তরে পিউ ভাষাহারা হলো। বুদ্ধিমান পিউয়ের বুদ্ধিলোপ হলো। কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
“সে আমার ছোট ভাইয়ের মত”
“তাতে কি পিউ, সেও একটা পুরুষ। বয়স তো গ্যাদা না তার। কেনো তুমি তার সাথে এতো মেলামেশা করবে?”

নীলাদ্রির কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না পিউ। খানিকটা অধিকারবোধ প্রকাশ পেলো কি। বিমূঢ় স্বরে শুধালো,
“পুরুষ তো আপনিও নীলাদ্রি ভাই”
“আমি আর ওই ছোকরা এক?”
“আলাদা বুঝি?”

এবার থেমে গেলো নীলাদ্রি। তার মুখখানা শক্ত। পিউকে সে উত্তর দিলো না। কোনো কথাও বললো না। একরকম বিনা বিদায়ে হনহন করে হাটা দিলো সে বাড়ির দিকে। পিউ দাঁড়িয়ে আছে কেঁচিগেটের কাছে। এশার আযানের ধ্বনি কানে আসছে। বৃষ্টি এখনো থামে নি। ভাগ্যিস। নয়তো চোখের অশ্রু ধরা খেয়ে যেত।

****

রাত এখন বারোটা সতেরো। অভ্র সেই সকালে বেরিয়েছে এখনো ফিরে নি। সবাই মিনিটে মিনিটে জামাইয়ের খোঁজ নিচ্ছে। ফলে বিরক্ত হয়ে গেছে ঐন্দ্রিলা। বিরক্তির শেষ সীমা পার হলো যখন সাবেরা শুধালো,
“অভ্রকে একটা ফোন দিয়ে দেখতে পারছো না। ছেলেটা দুপুরে কিছু খেয়েছে কি না স্ত্রী হিসেবে জানা উচিত না তোমার?”

ব্যাস, বোমার মত ফাঁটলো ঐন্দ্রিলা। একপ্রকার রুক্ষ স্বরে বললো,
“সে আপনার আদরের জামাই। আমার ঠেকা পড়ে নি তার খোঁজ নিতে”

সাবেরা বেকুব হয়ে গেলো মেয়ের কথায়। সে কি খুব বেশি কিছু বলেছে! সালাম সাহেব দু-তিন বার ফোন করেছে কিন্তু ছেলেটার ফোন বন্ধ। মধ্যরাত এখনো তার ফোন বন্ধ। বাড়ির প্রতিটা প্রাণী ঘুমে থাকলেও ঐন্দ্রিলার ঘুম আসছে না। এটার যথার্থ কারণ আছে। আগামীকাল তারা শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। নাইওরে এসে জামাই বিলুপ্ত হয়ে গেলে শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাবার জো থাকবে না। তার রাগ হচ্ছে অভ্রের উপর। এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা পুরুষ কি করে হয়! একবার বাড়ি আসুক মাথা ফাটিয়ে দিবে। কিন্তু ছেলেটা বাসায় তো আসছে না। সময় বাড়ার সাথে সাথে চিন্তাও বাড়ছে। ছেলেটার তো স্বভাব ভালো না। কোথাও মারামারি করে পড়ে আছে কি কে জানে! বন্ধু বলতে তো তরুন আর বিল্লাল। তাদের কি একবার ফোন করবে ঐন্দ্রিলা! সাতপাঁচ ভাবছিলো ঠিক তখনই তার মোবাইল খানা কর্কশ স্বরে বেজে উঠলো। কেঁপে উঠলো ঐন্দ্রিলা। বিল্লালের নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোনখানা ধরতেই বিল্লাল বলে উঠলো,
“ভাবীআপু একটু নিচে আসো। তাড়াতাড়ি”

বিল্লালের কথা শুনেই নিচে নেমে এলো ঐন্দ্রিলা। মেইন গেট খুলতেই দেখলো তরুন এবং বিল্লাল দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ঘাড়ের উপর ভর করে আছে অভ্র। অভ্র যেনো হুশেই নেই। ঐন্দ্রিলা অবাক স্বরে শুধালো,
“কি হয়েছে ওর?”
“বললে মারবে না তো?”

ঐন্দ্রিলা প্রথমে বুঝতে না পারলেও একটু পর ঠিক বুঝলো যখন উৎকট বিশ্রী গন্ধ নাকে এলো। ঐন্দ্রিলা সাথে সাথে নাক চাপলো। কঠিন নয়নে তাকালো বিল্লাল আর তরুনের দিকে। বিল্লাল অসহায় স্বরে বললো,
“আমরা বারণ করেছি। এই বেদ্দপ শুনে নি! এখন ওকে কোথায় রাখবো?”
“আমার মাথায় রাখো। অসহ্য”

বিল্লাল এবং তরুন অসহায় মুখে চাইলো একে অপরের দিকে। ঐন্দ্রিলা ফোঁশ ফোঁশ করে বেশ কবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“এটাকে আমার ঘরে নিয়ে আসো। আমার দ্বারা এই হাতিকে ঘর অবধি নেওয়া সম্ভব না। আর একটা শব্দ যাতে না হয়। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না”

বিল্লাল, তরুন মাথা কাত করে ভালো বাচ্চার মত কাজ করলো। অভ্রকে চুপিসারে ঘরে শুইয়ে তারা পা টিপে টিপে বের হলো বাড়ি থেকে। এর মাঝে একবার হ্যাপির খপ্পড়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু ঐন্দ্রিলা তাকে লুকাতে সাহায্য করেছিলো। দরজা দিয়ে কোনো মতে ঘরে আসলো ঐন্দ্রিলা। তড়তড় করে ঘামছে সে। বুক ধকধক করহছে। এরমাঝে আধো সজাগ, আধো বেহুশ অভ্র নড়েচড়ে উঠলো। বিড়বিড় কিছু বললো। কিন্তু বুঝা গেলো না জড়তার জন্য। ঐন্দ্রিলা মুখখানা তার একটা কাছে যেতেই মানুষটি চোখ মিললো। হাসলো মৃদু। তার হাসি খুব বিচিত্র। ঐন্দ্রিলা খানিকটা অপ্রস্তুত হলো বটেই। কিন্তু সেই অপ্রস্তুতবোধ বিমূঢ়তায় পরিণত হলো যখন অভ্রের হাতখানা নির্বিঘ্নে তার চুলের ভেতর গলিয়ে ঘাড়ে চলে গেলো। বিনা ভনীতায় কাছে টেনে নিয়ে এলো ঐন্দ্রিলাকে সে। ঐন্দ্রিলা চমকালো, থমকালো। কিন্তু এটূকুতেই সীমাবদ্ধ রইলো না অভ্র। মধ্যকার দূরত্ব অচিরেই ঘুচিয়ে ঐন্দ্রিলার পাতলা অধরজোড়ায় উষ্ণ ঠোঁট মিশিয়ে দিলো সে……

চলবে