মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-৩৯+৪০

0
42

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৩৯তম_পর্ব

“মরে গেলে আসিস”

এই বাক্যটাই যেন যথেষ্ট ছিলো অভ্রকে নাস্তানাবুদ করতে। একপ্রকার ছুটে এলো সে। উন্মাদের মত জড়িয়ে ধরলো ঐন্দ্রিলাকে। মুহূর্তবাদে ঐন্দ্রিলা অনুভব করলো তার কাঁধে উষ্ণতরলের উপস্থিতি। অভ্র কাঁদছে? মুখখানা ঐন্দ্রিলার গলার কাছটায় মিশিয়ে রেখেছে অভ্র। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস চিরে যাচ্ছে শুষ্ক চামড়া। হাতের বাধন শক্ত কিন্তু নমনীয়, পাছে মেয়েটি ব্যাথা করে। এতো আগলে কাচের পুতুলকেও কেউ রাখে না। গরম নোনাজলে ভিজতে লাগলো ঐন্দ্রিলার গলা, কাঁধ। কেউ কোনো কথা বলছে না। একইভাবে বসে রয়েছে তারা। ঐন্দ্রিলা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ফলে হাতের বাঁধন আরোও শক্ত হলো। ঐন্দ্রিলার শুষ্ক, ফাঁটা ঠোঁটের কোনায় উঁকি দিলো হাসি। মনশহরে বৃষ্টি হচ্ছে; শীতল, স্নিগ্ধ বর্ষণে ধুয়ে যাচ্ছে অভিমানের ধুলো। সাবেরার উদ্দেশ্যে কানন কন্ঠ খাদে নিয়ে বললো,
“বলেছিলাম না, আমার ছেলেকে ছাড়া তোমার মেয়েও ভালো নেই। বিশ্বাস তো করলে না”

সাবেরা উত্তর দিলো না। রুদ্রমূর্তিতে বেরিয়ে গেলো। কাননও বিরহের আগুনে দগ্ধ মানবমানবীকে একা ছেড়ে দিলো। তাদের বিশেষ মুহূর্তে কাবাবে হাড্ডি হবার ইচ্ছে নেই তার। রুমে শুধু অভ্র, ঐন্দ্রিলা এবং তাদের না বলা মহাকাব্যের দীর্ঘশ্বাস।

*****

সময় গড়ালো কতখানি জানা নেই। অভ্র এখনো জড়িয়ে ধরে রেখেছে ঐন্দ্রিলাকে। পিপাসু মনের ঐন্দ্রিলা নামক তৃষ্ণা মেটাচ্ছে সে। গত এক সপ্তাহে তিল তিল করে জমানো তৃষ্ণাটা এখন প্রবলভাবে জানান দিচ্ছে। ঐন্দ্রিলাকে ছেড়ে দিলে সে পিপাসায় কাতর হয়ে হয়তো মরেই যাবে। ঐন্দ্রিলা অভ্র চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে খুব ক্ষীন ভাবে। শরীরে শক্তি নেই। তবুও ভালো লাগছে। তখন দরজায় টোকা পড়লো। কর্কশ নারী কন্ঠ শোনা গেলো,
“আসছি?”

কন্ঠটা নার্সের। অভ্র না চাইতেও ছেড়ে দিল ঐন্দ্রিলাকে। মহিলা অনুমতির অপেক্ষা করলো না। ঢুকে পরলো। এসেই খ্যাকিয়ে উঠলো,
“আপনি রোগীর বেডে কেনো বসেছেন, সরেন”

প্রায় রুক্ষ্ণভাবেই সরিয়ে দিলো অভ্রকে। অভ্র বিনাবাক্যে সরে গেলো। ভুলে গিয়েছিলো তার স্ত্রী এখনো সুস্থ নয়। এখনো অনেকক্ষণ বসে থাকতে পারে না ঐন্দ্রিলা, শরীরে একটুও জোর নেই। নিজে নিজে উঠতে পারে না। হাসপাতালের সেমি ইলেক্ট্রিক বেডটাই ভরসা। প্রযুক্তি কত এগিয়ে তাই না? একটা বাটন চিপলেই খাট উঠে যায়। যাক গে, এতে সুবিধা হয়েছে। কসরত করে উঠে বসতে হয় না। মহিলা বাটন চেপে একটু তুললো বেডটা। হাতের ক্যানোলাতে একটা নল প্রবেশ করালো, স্যালাইনে মিশিয়ে এন্টিবায়োটিকের প্যাকেট ঝুলিয়ে দিলো। অভ্রকে বলল,
“একঘন্টা পর আমাকে ডাকবেন। আমি খাবারের আগের ঔষধ দিয়ে যাবো”

অভ্র মাথা নাড়ালো। নার্স চলে গেলে গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো ঐন্দ্রিলা। তারপর হাতের ইশারা করলো। নিজের পাশের জায়গা দেখিয়ে বুঝালো বসতো। অভ্র বসলো। এতোসময় পর ছেলেটিকে দেখলো সে। অভ্র শুকিয়ে গেছে। গায়ে ময়লা একটা শার্ট। চুলের ঝট মাথায় হাত দিয়েই টের পেয়েছিলো। চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। চোখজোড়া কেমন বিষন্ন। নারীর মনে দামামা বাজানো পুরুষকে বিরহের উপন্যাসের ছ্যাকা খাওয়া নায়ক মনে হচ্ছে। ঐন্দ্রিলা বিদ্রুপ টেনে বলল,
“আইসিউতে এলি না কেনো? একবার নিজের থোবড়াটা তো দেখাতেই পারতি”

অভ্র কাতর নয়নে চাইলো। উত্তর দিলো না। সেই আঁখিজোড়ার অব্যক্ত বেদনা ঠিক টের পেলো ঐন্দ্রিলা। সদা আত্মদম্ভ, আত্মবিশ্বাস, জেদে দগ্ধ পাহাড়ের মত অটল পুরুষকে ভঙ্গুর, দূর্বল, অসহায়রুপে দেখতে খুব মায়া হলো ঐন্দ্রিলার। এই পুরুষটিকে ভালো না বাসলে কাকে ভালোবাসবে? তীক্ষ্ণ, প্রখর চোখজোড়াতে কি তীব্র বিষাদ, অসহায়ত্ব। ঐন্দ্রিলার নিজেকে অভ্রের অ্যাকিলিস হিল মনে হলো। যে দূর্বলতা কেউ জেনে গেলে এই পুরুষকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিবে। অভ্র এখনো নিশ্চুপ। ঐন্দ্রিলা অধৈর্য্য স্বরে বলল,
“কি হলো? কথা বলিস না কেনো? টেকো বউয়ের সাথে বুঝি কথা বলা যায় না! আমাকে দেখতে আর ভালো লাগছে না তাই না?”
“কে বলেছে তোকে?”

এবার মুখ খুললো অভ্র, রুঢ় স্বরে শুধালো। ঐন্দ্রিলা হাসলো। ম্লান স্বরে বলল,
“কারো বলতে হবে কেনো? আমি নিজেই জানি। মাথা ভর্তি চুলগুলোকে ওরা কেটে দিলো। যে চুলের গন্ধ নিতি মাঝরাতের আধোঘুমে, সেই চুল এখন নেই। চুলছাড়া মেয়েদের ভালো লাগে? ধ্যাত, টেকো ভুতের মত লাগছে আমাকে। উপর থেকে শুনেছি নাকি ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ব্রেইন নাকি নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। হাটতে চলতে পারি কি না কে জানে? তখন আরেক জ্বালা। এমনেই কত খরচা হলো!”

অভ্রর মুখোভঙ্গি বদলে গেলো। তীব্র যন্ত্রণা প্রকাশ পেলো মুখবিবরে। খুব ক্ষীন স্বরে বললো,
“আমি বেঁচে থাকতে তোর কিছু হতে দিবো না দেখিস। দরকার হলে আরোও ভালো চিকিৎসার করাবো। বিদেশ নিইয়ে যাবো। কিন্তু তোর কিচ্ছু হবে না”

ঐন্দ্রিলা নিরবে হাসলো। কিন্তু হাসি লুকিয়ে বললো,
“বাবাহ, টেকো বউয়ের জন্য এতো দরদ? তুই তো শাহজাহানকে টেক্কা দিবি। অবশ্য এগুলো তোর মুখের কথা। আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস। রুপ না থাকলে মায়াও থাকে না, আমি জানি”
“কচু জানিস তুই”
“জানি না বলছিস?”
“হ্যা, জানিস না। তোর চুল কেনো, সব রুপ খসে গেলেও আমার চোখে তুই ধরণীর সবথেকে সুন্দরী ললনা”

দৃঢ় স্বরে বললো অভ্র। ঐন্দ্রিলা একরাশ কৌতুহল নিয়ে শুধালো,
“দাঁত পড়ে গেলেও?”
“হু”
“চামড়া কুচকে গেলেও?”
“হু”
“যদি কেঁচো হয়ে যাই তাও?”
“হু?”

ঐন্দ্রিলা সশব্দে হেসে উঠলো। অভ্র দু চোখ মুদে তার হাসি দেখলো। মোহনীয় হাসি। চোখের তৃষ্ণা নিবারণের একমাত্র মাধ্যম যেন এই হাসি। তীব্র গরমে একমুঠো শীতল দমকা হাওয়া যা মুহূর্তেই শীতল করে দেয় চিত্ত। এই হাসির মাঝে মরতেও শান্তি।

*****

আশ্বিনের শেষ সপ্তাহ। তীব্র গরমে খা খা করছে ধরণী। বাহিরের তৃষ্ণার্ত কাকটাও নিরিবিলি বসে আছে কেবিনের বারান্দার রেলিং এ। হয়তো ডাকার ইচ্ছে হচ্ছে না। বিষন্ন চোখে দেখছে পৃথিবীকে। ঐন্দ্রিলা বিছানায় বসে বসে দেখছে একা কাকের কাজকর্ম। এই কাকটিকে সে চিনে। কাকটির গায়ে একটা লাল দাগ আছে। কালো গায়ে লাল দাগটা খুব বেশি বোঝা যায় না। কিন্তু ঐন্দ্রিলা সেটা খেয়াল করে দেখেছে। হয়তো কাকটির কোনো সঙ্গী নেই। তার কোনো বন্ধু নেই। তাই সে প্রতিদিন এগারোটা বাজলেই এখানে চলে আসে। যেনো ব্যাপারটা একটা প্রোগ্রামের মতো তার সিস্টেমে বেধে দেওয়া হয়েছে। ঠিক এগারোটায় তাকে হাসপাতালের আটতালার চার নম্বর কেবিনের বারান্দাতেই এসে বসতে হবে। আচ্ছা কাকরা কি ঘড়ি চেনে? পাখি সমাজে কি তাদের ঘড়ি চেনানো হয়? এমন কি হয় তাদের কোনো স্কুল কলেজ আছে? যেখানে সকাল হলেই খড়খুটো নিয়ে উপস্থিত হতে হয়? নীলাদ্রিকে বলতে হবে। তার বিষদ জ্ঞান প্রকৃতি নিয়ে। সে হয়তো কিছু বলতে পারবে। ঐন্দ্রিলা হাই তুললো। বিছানায় বসে বসে তার মোট তিনটে কাজ; খাওয়া, ঘুমানো আর জগৎ সংসার নিয়ে চিন্তা করা। আজ পনেরোদিন সে কেবিনে শুটকির মতো পড়ে আছে। জগৎ সংসার নিয়ে চিন্তা করার এতো চমৎকার সময় তাকে সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন যে সে এখন কাক নিয়ে গবেষনা করছে। আজ অবশ্য তার মন ভালো। মাথার সাদা জঞ্জাল খুলে দেওয়া হয়েছে। সেলাইয়ে কোনো ঝামেলা হয় নি অভ্রর বিশেষ যত্নের কারণে। ছেলেটা পারেও। ঐন্দ্রিলার আগে মনে হত জগৎ সংসারে একমাত্র তার বাবাই যত্নশীল। কিন্তু সেই ধারণাকে একেবারে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছে অভ্র। তার থেকে যত্নশীল কেউ আছে কি না সন্দেহ। এই পনেরোদিন যাবৎ অক্লান্ত শ্রম দিয়ে যাচ্ছে সে। দোকানের ভার বিল্লালের ঘাড়ে সপে নিজেকে ঐন্দ্রিলার চব্বিশ ঘন্টা নার্সরুপে নিযুক্ত করেছে। ঐন্দ্রিলার খাবার, গোসল, ঔষধ, ব্যায়াম, বিনোদন সবকিছুর দায় যেনো কেবল তার। ঐন্দ্রিলার পুরো জীবনের ভারটাই নিজের কাঁধে উঠিয়ে নিয়েছে। অথচ এক চিলতে বিরক্তি নেই। নারীদের বুঝি জন্ম থেকেই আহ্লাদ পাওয়ার একটা নেশা থাকে। তারা যত আহ্লাদ পায় আরোও আহ্লাদ চায়। মনে মনে তীব্রভাবে চায় তার পুরুষ তাকে রানীর মতো রাখুক। অভ্রর আচারণ ঐন্দ্রিলাকে খুব করে বিষয়গুলো অনুভব করাচ্ছে। এই অনুভূতির মাঝে একটা তিক্ততাও আছে। তা হলো, ঐন্দ্রিলার প্রচন্ড নেতিবাচক চিন্তাভাবনা। এই যে এতো শান্তির মাঝেও তার মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে মনকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলছে, “অভ্র এগুলো করছে অপরাধবোধে”। এই কথাটা স্মরণ হলেই ঐন্দ্রিলা ভালোলাগাগুলো কেমন মিয়ে যায়। মনে হয় সে বালু খাচ্ছে। তাই সে মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বজ্রকঠিন সিদ্ধান্ত। বাসায় গেলেই অভ্রকে চিঠিটা ধরিয়ে বলবে,
“ভালোবাসবি আমাকে? বেশি না। অল্প। ক্ষীন। এক বিন্দু হলেও চলবে। তবে সেই বিন্দুখানা যেন স্বচ্ছ হয়। ক্ষুদ্র হলেও সেখানে যেনো আমার প্রতিবিম্ব থাকে। কেবল আমার”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঐন্দ্রিলা। কবে বাসায় যাবে? আর তো সহ্য হচ্ছে না। এর মাঝেই অভ্র এলো। তার চোখমুখ উজ্জ্বল। এসেই চুলহীন মাথায় চুমু খেলো। উচ্ছ্বাসিত স্বরে বললো,
“আর বসে বসে কাকের পালক গুনতে হবে না। আমরা বাসায় যাচ্ছি”

*****

নীলাদ্রির পড়াশোনার মাত্রা বেড়েছে তীব্রভাবে। ঐন্দ্রিলা বাড়ি এসেছে। এখন আর চিন্তা নেই। রিসার্চ সেন্টারে আবেদন করেছে সে। সে আর ল্যাবে যাবে না। যদিও প্রফেসর বেশ অবাক হলেন এমন সিদ্ধান্তে। কিন্তু নীলাদ্রি সরল হাসি ঠোঁটে লেপ্টে বললো,
“আমি সরকারি জবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি”
“তুমি মাথায় চোট পেয়েছো নীলাদ্রি? এই শেষ সময়ে তুমি রিসার্চ ছেড়ে সরকারি চাকরি করবে?”
“আমার মাথা শতভাগ সুস্থ স্যার। আসলে এটা আমার শ্বশুরের ইচ্ছে”
“তুমি বিবাহ করেছো?”
“জি স্যার। এক মাস হতে চলেছে”

নীলাদ্রির প্রফেসরের মুখখানা কেমন বাংলার পাঁচের মত হয়ে গেলো। অবাক স্বরে শুধালো,
“বুঝে শুনে করেছো নাকি ধরে বেধে করিয়েছে?”
“কি বলছেন স্যার? ধরে বেধে করাবে কেনো? অবশ্য পিউয়ের সাথে কেউ আমাকে ধরে বেধে বিয়ে দিলেও আমি খুশিই হতাম”

প্রফেসর মুখ বাঁকালেন। মনে হল কেউ জোর করে বালু খাইয়ে দিয়েছে তাকে। আফসোসের সুর টেনে বললেন,
“মানুষ দুই, জীবিত এবং বিবাহিত। তুমি এখন আর জীবিত নেই। ব্যাপার না। কিছু বিষ মধুময় হয়। তোমার মধুময় বিষের জন্য শুভেচ্ছা”

নীলাদ্রির ইচ্ছে করলো লোকটিকে কড়া করে দুকথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু অহেতুক বাক্য খরচ করে সময় নষ্ট হবে। কি দরকার? এর চেয়ে দু পাতা বেশি অংক কষলে কাজে দিবে। নীলাদ্রি এখন অংক কষছে। তৈলাক্ত বাশে বাঁদরের নাচন অংক। নীলাদ্রির মনে হয় এই বাঁদরটা একটা চূড়ান্ত পর্যায়ের বেয়াকুব। তেল লাগানোর বাশের প্রতি এতো কিসের আগ্রহ বুঝতে পারে না নীলাদ্রি। এর মাঝেই একজোড়া ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পেলো চোখের উপর। কোমল দুটো হাত তার চোখ চেপে ধরেছে। কিশোরীদের খেলা। অপরজনের জানার ইচ্ছে তাকে মানুষটি চিনতে পেরেছে কি না। নীলাদ্রি জানে মানুষটি কে। কারণ কেবল এই মানুষের থেকেই মিষ্টি একটা গন্ধ পায় সে। তাই কোনো সময় নষ্ট না করেই বললো,
“পিউ”
“ধ্যাত, চিনে গেলে?”

পিউয়ের কন্ঠে মেকি রাগ। কিন্তু নীলাদ্রি জানে সে খুশি হয়েছে। নীলাদ্রি তার হাতখানা টেনে ধরে নিজের সামনে দাড় করালো। কোমড় চেপে ধরে বললো,
“তোমাকে আমি হাজার ক্রোশ দূর থেকেও চিনতে পারি”
“মিথ্যে কথা”
“বিশ্বাস হয় না?”
“নাহ, হয় না। যে পুরুষের মন বইয়ের পাতাইয় বদ্ধ সে নারীর মন কি করে চিনবে?”
“আংশিক সঠিক। তবে আমার মতে আমার পিউয়ের মন এই বাঁদরের অংক থেকেও সরল”
“কি বাজে উপমা”

বলতে বলতেই হেসে ফেললো পিউ। কিন্তু হাসি বেশি সময় স্থায়ী হলো না। বসার ঘর থেকে সোরগোল শোনা যাচ্ছে। আউওয়াল সাহেবের কঠিন বজ্রকন্ঠ শোনা যাচ্ছে,
“আমার পৌত্রবধু আমার বাসায় থাকবে। তুমি কি বলতে চাও সাবেরা, আমার পৌত্রবধুর যত্নে অবজ্ঞা করছি আমরা?”………………………

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৪০তম_পর্ব

“আমার পৌত্রবধু আমার বাসায় থাকবে। তুমি কি বলতে চাও সাবেরা, আমার পৌত্রবধুর যত্নে অবজ্ঞা করছি আমরা?”

প্রৌঢ় মানুষটির হুংকার নীলাদ্রির ঘর পর্যন্ত আসছে। এই তামাশা চলছে তিন ঘন্টা যাবৎ। নীলাদ্রি নিচে যায় নি। বয়স্ক মানুষের গ্যাঞ্জামে যেয়ে মাথা নষ্ট করার মানে নেই। বাঁদরের গণিত যথেষ্ট মাথা নষ্ট করার জন্য। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে ঐন্দ্রিলার হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জের পর। সাবেরা জেদ ধরেছেন মেয়ে সুস্থ হবার আগ অবধি তার বাড়িতে থাকবে। ঐন্দ্রিলার সুস্থ হতে সময় লাগবে। মস্তিষ্কের পেছন ভাগে সে অংশ ফুলে গিয়েছে তা কমতে সময় লাগবে। সাবেরার জেদ আউওয়াল বাকুয়ীর দম্ভচিত্তে আঘাত হানলো। তার কাছে এই প্রস্তাব অপমানের। সেই অপমানের ফয়সালা করতেই ছুটে এসেছেন। কিন্তু সাবেরা অনড় তার সিদ্ধান্তে। খুব শান্ত কন্ঠে বললো,
“চাচা, আপনি তিলকে তাল বানাচ্ছেন। আমি একবারো বলি নি আপনারা ঐন্দ্রিলার যত্নে অবজ্ঞা করছেন। আমি বলেছি শুধু মেয়েটা আমার কাছে থাকুক। আমি তো অন্যায় প্রস্তাব দেই নি”
“অন্যায় প্রস্তাব না এটা? তুমি কি কোনো ডাক্তার নাকি? ফু দিয়ে নাতবউকে ঠিক করে ফেলবে?”
“আজব, আমার মেয়ে আমার কাছে থাকতে পারবে না?”
“না, সে এখন আমার পৌত্রবধু”
“চাচা, আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। ভুলে যাচ্ছেন, আজ আমার মেয়ের অবস্থা আপনার পৌত্রের জন্য। ঐন্দ্রিলার ভাগ্য ভালো যে তার আঘাত খুব গুরুতর ছিলো না। এমন আঘাতে মানুষ কোমায় চলে যেতে পারে, মা’রাও যেতে পারে। আমি তো একবার দোষারোপ করছি না। শুধু চাইছি মেয়েটা ভালো হওয়া পর্যন্ত আমার কাছে থাকুক। আমি ভুল কি বলেছি?”
“তোমার প্রস্তাব আমি খারিজ করছি”
“আপনার খারিজ করাটাতে আমার যায় আসে না”
“তুমি আমাকে অপমান করছো!”
“আপনার বয়স হয়েছে, ব্রেইন নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাকে অতিসত্ত্বর ডাক্তার দেখানো উচিত। কানন কি করে এমন বুড়োর সাথে সংসার করে কে জানে”
“তুমি আমাকে বুড়ো বললে?”
“বাংলা অভিমানে আছে, বুড়ো কোনো গালি নয়”

আউওয়াল বাকুয়ীর রাগ আকাশ ছুলো। সালাম সাহেব বাদশাহকে দিয়ে লেবু পানি আনালো। গ্লাস এগিয়ে মোলায়েম স্বরে বললো,
“চাচা, উত্তেজিত হবেন না। শরীর খারাপ করবে। বয়স হয়েছে”
“চুপ কর বেয়াদব। তোর বাপ আমার বন্ধু ছিলো বলে তোর বউকে কিছু বললাম না। নয়তো ওর রাবিশ কথা ছুটিয়ে দিতাম। মানহানির মামলা করতাম”

সালাম সাহেব শান্ত স্বরে বললেন,
“চাচা, ছাড়েন আপনি লেবু শরবত খান।“
“তুই খা, আহাম্মক কোথাকার”
“তুই তুকারি করবেন না চাচা। জানি তুই, শালা এগুলো মনের তৃপ্তি। তাও আপনার একটা আভিজাত্য আছে। জমিদারদের বংশ আপনি। এই শব্দগুলো আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্য। আমরা বলতে পারি, “এই কুত্তার বাচ্চা, তোরে ধরে আছাড় দিমু। থুথু দিয়ে তোর মুখে মোনালিসা বানামু” –কিন্তু আপনার মুখে ঠিক মানাচ্ছে না”

সালাম সাহেবের কথা কাজে দিলো। আউওয়াল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রাগ সংযত করলেন। নিজের থুবড়ে পড়া আভিজাত্য আবার সাজিয়ে নিলেন। সভ্য প্রৌঢ়রুপে নিজেকে আবার স্থাপন করলেন। তাকে দেখলে কেউ বলতে পারবে না তিনি একটু আগে তুই-তুকারি করছিলেন। খুব স্থবির স্বরে বললেন,
“ঐন্দ্রিলা, আমার বাড়িতেই থাকবে”
“সেই সিদ্ধান্ত আমার মেয়ে নিজে দিবে”

দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠলো বৃদ্ধের। আর বসে রইলেন না। হনহন করে রওনা দিলেন নিজ বাড়িপানে। নীলাদ্রি নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এটাকে বাড়ি না বলে মাছের বাজার আখ্যা দিলে যথার্থ হতো। শব্দ করে বইটা বন্ধ করলো। চরম বিরক্তি আসছে। ইটপাথরের কৃত্রিম প্রাণহীন জীবন তাকে সর্বদাই বিরক্ত করে। তার ভালো লাগে পাহাড়ে গা ঘেষে দাঁড়ানো কাঠের ঘর। যেখানে এই কৃত্রিমতা নেই। আছে শুধু প্রকৃতির মুগ্ধতা। বৃষ্টিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেজা রেলিংয়ের উপর জড়ো হওয়া পানির স্তুপ দেখতে ইচ্ছে হয় না। বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে ভালো লাগে। ছাদে বসে নির্জীব কালো আকাশে সেই মজা নেই, যতটা অন্ধকার পাহাড়ের তারাময় আকাশ দেখতে অনুভূতি হয়। সেই ছন্দহীন হাওয়ার পরশ কতদিন নেওয়া হয় না। পিউ তার চুলে আলতো বিলি কেটে বললো,
“মাথা ব্যাথা করছে? কি খাবে চা না কফি”
“দুটোই দিতে পারো, এক চুমুক চা আর এক চুমুক কফি। তোমার আধপাগল শ্বশুরবাড়ি থাকতে থাকতে আমার এনার্জি মাইনাসের দাঁড়ে চলে এসেছে”
“আহারে”

নীলাদ্রি পিউয়ের কোমড়খানা আরেকটু শক্ত করে ধরে বললো,
“একটা আবদার করবো পিউ?”
“কি?”
“আমার সাথে পাহাড়ে যাবে? এই কৃত্রিম শহর, আরামের খনি ছেড়ে অকৃত্রিম, অপরিশোধিত প্রকৃতির কাছে যাবে? আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি জানি নিজের জীবন ছেড়ে একটা অন্য মানুষের জীবনধারা এডাপ্ট করা কঠিন। তোমার একটা পৃথিবী আছে, কিন্তু এই পৃথিবীতে আমি অথর্ব ছাড়া কিছু নই। উপর থেকে এই ছেলেমানুষী বই গিলে সরকারী চাকরীর প্রতিযোগিতায় নামায় আরোও প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছি। আমার মেঘের বাড়িতে যাবে? সেখানে এতো সুবিধা নেই। ইলেক্ট্রিসিটি নেই তেমন। সবসময় মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না। হাতের কাছে সব পাওয়া যায় না। ট্রেকিং করতে হয়। ফুচকা পাওয়া যায় না। সেখানে পাহাড়িদের মাঝে থাকতে হয়। আপন বলতে তারাই। তোমার জীবনযাত্রা থেকে অনেক আলাদা। তবুও ওখানে শান্তি আছে। ভাসমান মেঘের সকাল, পিচ্ছিল পাহাড়ের গাত্র বেয়ে উন্মুক্ত ঝর্ণার কলকল ধ্বনি সবকিছু আমাকে পাগল করে। যাবে পিউ?”

নীলাদ্রির কন্ঠে অনুনয়। কেমন ব্যাকুল শোনালো তাকে। ঐন্দ্রিলার বিয়ের জন্য এসেছিলো। সে তো বিয়ের পরদিন ই বলেছিলো চলে যাবে। কিন্তু গেলো না। শকুনতলা চলে এলো, তার রিসার্চ করতে করতে আহাশের সাথে ঝামেলা করলেন, সেই ঝামেলা থেকে বিয়ের প্রস্তাব। এখন তারা বিবাহিত। গল্পের গতি বদলে গেলো, সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেলো। কিন্তু বাবা-মা ছেড়ে, নিজের শহর ছেড়ে পাঁচশত সতের কিলো দূরে থাকাটি কি সহজ হবে? সেখানের জীবনযাত্রাও ভিন্ন। মানুষ ভিন্ন। নীলাদ্রি তার হাতজোড়া ধরে বললো,
“আমি তোমার বাবাকে দেওয়া কথা রাখবো। বিসিএস ক্যাডার হবো দেখো। তোমার সেখানে কোনো সমস্যা হবে না। আমি তোমার জন্য ফ্যান লাগাবো কটেজে। যদিও ওখানে কোনো ফ্রিজ, এসি, মাইক্রোওভেন নেই। কিন্তু তুমি কষ্ট পাবে না দেখো। সবার বাসায় তো ফ্রিজ, এসি থাকে না তাই না?”
“আমি ভেবে জানাই?”
“তুমি যাবে না?”

নীলাদ্রির সরল মুখখানা দেখে খুব মায়া হলো তার। তার আবদারে অসহায়ত্ব। উদাসীন চোখজোড়ায় উত্তরের অপেক্ষায় তীব্র আকাঙ্খা। পিউ যদি তাকে না করে দেয় তবে এখনই তার হৃদয় ভেঙ্গে চার টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু সে পিউয়েরকথা ভেবে আক্ষেপ প্রকাশ করবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার খুলবে মোটা অংকের বই। কষতে শুরু করবে বাঁদরের অংক। প্রকৃতিপ্রেমী নীলাদ্রিকে চাইলেই এই ইটপাথরের শহরে আটকাতে পারে পিউ। পিউ জানে এখন তার সেই ক্ষমতা আছে। কারণ নীলাদ্রি তার প্রতি তীব্র ভাবে দুর্বল। দুর্বলতাকে কাজে লাগানো সহজ। তবে প্রেমের নীতিতে প্রণয়নের দুর্বলতাকে হাতিয়ার বানানো গর্হিত অপরাধ। যদিও জ্ঞানীরা বল, “Everything is fair in love and war”— কথাটা ঠিক নয়। ভালোবাসায় সব কিছু জায়েজ নয়। ভালোবাসা দুটো মনের আবেগের ফসল। খুব যত্ন করে তাকে পোষন করতে হয়। সেই যত্নে খাবার রুপে থাকতে হয় সম্মান, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, আত্মত্যাগ, সমন্বয়। আরোও অনেক ক্রিয়া বিশেষণ যুক্ত করতে হয়। নয়তো ভালোবাসা একটা ফাঁকা খোল ছাড়া আর কিছু থাকে না। যা শুধু নামেই। একটা প্রাণহীন শব্দ। পিউ দু হাতে নীলাদ্রির গালজোড়া ধরলো। ঠোঁটে গভীর চুম্বন আঁকলো। তারপর ধীরস্বরে বললো,
“শোনো স্বামী, তুমি যদি আমাকে মঙ্গলগ্রহেও নিয়ে যাও আমি তোমার হাত ধরে যাবো”

****

আকাশটা আজ অভিমানী কিশোরীর মতো মুখগোমড়া করে রেখেছে। যেনো তার আবদারটা খুব নিষ্ঠুরতার সাথে তার প্রেমিক প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্ষণে ক্ষণে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। কান্নাটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব ঠিক করাচ্ছে। এমন বৃষ্টি খুব বিরক্ত লাগে বিল্লালের। গুড়ি গুড়ি, দম নেই বৃষ্টির। কিন্তু গা ভিজিয়ে দিবে। জ্বর বাঁধিয়ে দিবে। এই আবহাওয়ায় জাতীয় খাদ্য খিঁচুড়ি আর ডিম ভাজা। পেট ভরে খেয়ে ঢেকুর তুলে পিঠ উল্টিয়ে ঘুম। অথচ বাঙ্গালীর চিরচরিত স্বভাবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এখন ব্যাংকের চতুর্থ ডেস্কে বসে আছে বিল্লাল। তার সম্মুখে সুন্দরী রমনী। তার চোখ কম্পিউটারের স্ক্রিনে। একেবারেই গ্রাহ্য করছে না সে বিল্লালকে। ভাবখানা এমন যেনো বিল্লাল নামক কোনো ব্যাক্তির অস্তিত্ব নেই জগতে। সামনের ব্যক্তি অদৃশ্য। বেসরকারি ব্যাংকারদের কাজ তেল দেওয়া। সামান্য পাঁচশত টাকা ভরতে আসা ব্যাক্তিকেও তারা সৌজন্যতার সহিত বলবে,
“স্যার, কিছু চাই?”

সরকারী হলে হিসাব ভিন্ন। তাদের জগতের কারোর প্রতি মায়া নেই। তারা যে গদিতে বসে আছে এটাই কাস্টোমারের সৌভাগ্য। কিন্তু বিল্লালের মতো পার্টি যে কি না এমন খদ্দের যার প্রতিদিনের লেনদেন লাখ খানেক; তাকে এমন অনাদর মানা যায় না। দুপুর হয়েছে। একটু মিষ্টি করে বলা যেতেই পারে,
“আপনি কি লাঞ্চ করেছেন স্যার”

কিন্তু রমনী বেপরোয়া। তার কাছে পৃথিবীতে একটাই জিনিস গুরুত্ব পাবে তা হলো তার হাতের কাজ। বিল্লালের বিরক্ত লাগছে। এই ঢঙ্গী, অহংকারী রমনীকে তার স্থান দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। সে বলতেই পারে,
“খদ্দের বসিয়ে রেখে ল্যাপটপের কাজ করা কি তোমার সাজে?”

কিন্তু সে তা করতে পারছে না কারণ সে খদ্দের হিসেবে আসে নি। খদ্দেরের কাজটি রমনী বহুপূর্বেই করে দিয়েছে। পে অর্ডার ক্লিয়ার করে দিয়েছে। এখন বিল্লাল খামোখা তার সামনে বসে আছে। চাইলে সেই বিল্লালকে বলতে পারে,
“অহেতুক বসে না থেকে কাজে যান”

কিন্তু সে তাও করছে না। ফলে মৌন বিল্লাল অবশেষে তাদের নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো,
“তুমি কি কিছু ভাবলে?”

তৃষা হতচকিত হলো। কন্ঠে সেই চকিত ভাব বোঝা গেলো,
“কি বিষয়ে?”
“কবে তোমার বাবা-মায়ের সাথে আমার দেখা করা উচিত, সেই বিষয়ে?”

এবার বিষম খেলো তৃষ্ণা। খকখক করে কেশে উঠলো। বিল্লাল দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। সেই পানি নিমিষেই শেষ করলো সে। বিল্লাল ধীর স্বরে বললো,
“দুমাস হতে চলেছে তৃষা, আমি তীর্থের কাকের মত তোমার পেছনে ঘুরছি। জানি তুমি সুন্দরী, দাপটে সুন্দরী। কিন্তু একটা ছেলেকে এতোটাও ঘুরানো উচিত নয়”

তৃষা তার বিস্ময়কে ধামাচাপা দেবার জন্য বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করে বসলো,
“নারীকে চাও অথচ তার পেছনে ঘোরার ধৈর্য্য নেই। তাহলে বাপু হার মেনে পথ পালটে ফেলা উচিত”
“আমি তো বলি নি তোমার পেছনে ঘোরার ধৈর্য্য নেই। দুমাস ধরে ঘুরছি, নিশ্চয়ই ধৈর্য্য আছে। আমি হয়তো সারাটা জীবন ঘুরতে পারি। কিন্তু সমস্যাটা ভিন্ন। ফলাফলটা তো বোঝা দরকার। মানুষ পরিশ্রম করেই এই আশায় যেনো সফলতা আসে। কিন্তু দেখা গেলো আমি পরিশ্রম করেই গেলাম কিন্তু সেই পরিশ্রমটার ফল কোনোদিন পাবোই না তাহলে অহেতুক পরিশ্রম করার কি মানে? এত কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে যদি আমার যত্নে গড়া মুক্তোর মালা অন্য কারোর গলায় উঠে সেটা তো সইতে পারবো না”
“এতো উপমা তো বোঝা কষ্টকর”
“সোজা বাংলায় আমি তোমার মতামত জানতে চাইছি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?”

তৃষা চুপ করে রইলো। মাথা কাজ করছে না। একেই অফিসে প্রেসার যাচ্ছে। টার্গেট ফিলাপ না করতে পারলে ট্রান্সফার করে দিবে বলেছে। এর উপরে যদি একজন সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয় ব্যাপারখানায় ঠিক কি করে রেসপন্স করা উচিত বুঝতে পারছে না তৃষা। বিল্লাল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জলদগম্ভীর কন্ঠে বললো,
“দেখো, মেয়েদের পেছন পেছন ঘুরে জনে জনে বিয়ের প্রস্তার দেওয়া আমার স্বভাব নয়। তোমাকে দিচ্ছি কারণ…”
“কারণ সেদিনের ঘটনার দায় নিতে চাও”
“শুধু দায় নিতে চাই ব্যাপারটা ভুল। একখান দূর্ঘটনাবশত চুমুর জন্য কেউ বিয়ে করার জন্য হন্যে হয় না। ব্যাপারটা কান ধরে সরি বলেও রফাদফা করা যায়। কিন্তু আমি চাই না। আমি আমাদের মাঝে ব্যাপারটা রফাদফা করতে চাই না”
“কি চাও?”
“চাই আমাদের একটা গল্প হোক। ভিন্ন তবে মিষ্টি একটা গল্প। যার মুল চরিত্র তুমি আর আমি”
“আমি কেনো?”
“কারণ আমার সাথে তোমাকে মানায়”
“আমার সাথে তোমাকে নাও মানাতে পারে!”
“হ্যা, এটা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আমি নিজেকে তোমার সাথে মানিয়ে নিবো”
“এতোটা দায় কেন?”
“তোমার চুমুতে মা’রা পড়েছি। সারাজীবন তোমাকে চুমু খেতে চাই”

বিল্লালের কথায় বিহ্বল চাইলো তৃষা। তার বিস্ময় দেখে মজা পেলো বিল্লাল। বাঁকা হেসে উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে একটা দলামচা কদমফুল বের করে সামনে রাখলো। গাঢ় স্বরে বলল,
“আমি আগামীকাল আবার আসবো। উত্তরটা তৈরি রেখো কেমন?”

বলেই পকেটে হাত গুজে ঢং করে হাটা দিলো। একবার পিছু চাইলো না। এদিকে তৃষার হৃদস্পন্দন তীব্র হলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। মস্তিষ্ক জুড়ে চক্রবৃদ্ধিহারে ঘুরপাক খাচ্ছে বিল্লালের কথাটা। এতো অসভ্য প্রেম নিবেদন কেউ কখনো করেছে? না করে নি। অথচ তৃষার গাল জোড়া রক্তিম হয়ে আছে। লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে বেসামাল হৃদয়। সে তো কিশোরী নয় তাহলে এতো লাজের কি আছে! অদ্ভুত।

****

কোলের উপর ঐন্দ্রিলার পা রেখে, পায়ের নখ কাটছে অভ্র। খুব মনোযোগ এবং যত্ন দিয়ে কাজটা করছে সে। মুখের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। এতোটা মনোযোগ কখনো সে পড়ালেখায় দিয়েছে কি না সন্দেহ। ঐন্দ্রিলা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তবাদে বিদ্রুপ টেনে বললো,
“বাকুয়ী বংশের রাজপুত্তুর বউয়ের পায়ের নখ কাটছে, তুই তো ইতিহাস গড়ছিস অভ্র। জমিদার বংশের রক্তরা জানলে হায় হায় করবে”

অভ্র বুড়ো আঙ্গুলের নখখানা কেটে কাগজের উপর রাখলো। নির্বিকার স্বরে বললো,
“জমিদার হোক আর পেয়াদা, পুরুষ মাত্রই বউয়ের একনিষ্ঠ ভৃত্য। যে পুরুষ তার বউকে মহারানীর মতো রাখতে পারে না, সে পুরুষ জাতের নামে কলংক। বউ ন্যাকামি করবে, ঢং করবে; পুরুষ তা চোখ মুদে দেখবে, মুগ্ধ হেসে বলবে, “করো করো, আরো ন্যাকামি করো”। তাকে আহ্লাদ করবে। এটাই তো পুরুষের একমাত্র দায়িত্ব এবং কর্তব্য। বউয়ের সব অভিমান, রাগের বোঝা নিজ দায়িত্বে মাথায় উঠাবে। এসব না পারলে চলে যাক না হিমালয়ে। হয়ে যাক চিরকুমার সাধু, কে মানা করেছে! যদি সংসারজীবন কাটাতে হয় এবং সুখী হয়ে কাটাতে হয় তবে এই বৈশিষ্ট্য থাকা অতীব জরুরী। কি বুঝলি?”
“আমি মহারানী বুঝি?”
“আমি জগৎ-সংসারের সাধারণ বউদের কথা বলেছি। তুই কি সাধারণ বউ নাকি!”
“তাহলে আমি কি?”

কৌতুহলের মাত্রা বাড়লো। অভ্র তার দিকে তাকালো। সাদা দাঁতগুলো বের করে বললো,
“তুই শাকচুন্নীদের সরদার”

কথাটা শেষ হওয়া মাত্র ঐন্দ্রিলা পাশের বালিশটা ছুড়ে মারলো। যা লাগলো ঠিক অভ্রর মুখে। তাতেও তার হাসি খসলো না। পায়ের পাতা টিপতে টিপতে বললো,
“কর বউ। আরো ন্যাকামি কর”
“চুলগুলো বজ্জাত ডাক্তারগুলো কেটে দিয়েছে। নয়তো আমার রুপে ঝলসে যেতি বেদ্দপ”
“চুল থাকতেও তুই শাকচুন্নির মতোই ছিলি। তখন আরোও ভয়ংকর লাগতো”
“তাহলে শাকচুন্নিকে বিয়ে করলি কেনো?”

অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দুঃখী, দুঃখী কন্ঠ করে খুব আফসোসের সুরে বললো,
“এটাই তো পুরুষজাতের দুর্বলতা। তারা আসলে জানেই না তারা কেনো তার পছন্দের নারীর প্রতি দুর্বল। সৌন্দর্য্য তো ধাধা। নয়তো চিন্তা কর, রাজামশাই চার্লস থার্ড কি না ডায়ানার মতো ডাকসাইটে সুন্দরীকে ছেড়ে ওই খবিস মহিলাতে মত্ত হয়! রাজা হওয়া তো বাহানা ছিলো, ওই খবিসটাকে রানী বানানোই আসল মতলব ছিলো। এটাই পুরুষের এক দোষ। তাদের মত্ত হবার কারণ থাকে না। তারা শুধু মুখ থুবড়ে নারীতে মত্ত হয়”
“তাহলে বলছিস এই শাকচুন্নীতে তুই মত্ত?”
“সন্দেহ আছে? শোন এই মাহাবুল হক অভ্র সবার সামনে কাঁদে না। সবার জন্য কাঁদে না”

ঐন্দ্রিলার চোখে চোখ রেখে অভ্র কথাটা বললো। তার গাঢ় নয়নের উন্মাদ চাহনী বুকে তীরের মতো লাগলো যেন। মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো,
“এই আত্মহারা হওয়া কিসের লোভে? শরীরের চাহিদা নাকি আত্মার খোরাক? ভালোবাসিস আমাকে?”

কিন্তু এমন কুৎসিত বেশে ভালোবাসা চাওয়া যায় না। ভালোবাসা চাইতে হয় সুন্দর বেশে। যেনো মনের ভেতর তার প্রতিচ্ছবি অংকন হয়। মানুষের খুব বাজে স্বভাব, তাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে কুৎসিত রুপ দেখাতে ভালো লাগে না। তারা চায় তাদের সবথেকে সুন্দর রুপটাই তাদের সামনে উপস্থাপিত হোক। আজকাল তো নিজেই নিজেকে আয়নায় দেখতে পারে না। বিদঘুটে লাগে তাকে। হালকা ছোটো ছোট চুল উঠেছে। কিন্তু তাতে তাকে আরোও কুৎসিত দেখায়। অভ্র কি করে মুগ্ধ নয়নে তাকায় সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় পুরুষটি হয়তো সত্যি তাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই কথাটা কেবল সন্দেহ। অভ্র কখনো নিজ মুখে স্বীকার যায় নি। পুরুষের আচারণ বোঝা দায়। তাদের অন্তরের ভাষা বোঝা আরোও দায়। ঐন্দ্রিলা শতভাগ নিশ্চিত হতে চায়। একেবারে সাদা খাতায় লেখা টাইপ নিশ্চিত। যেন পরে ঘুরে যাবার সুযোগ না থাকে। অন্তত প্রশ্নবিদ্ধ করা তো যাবে। তাই কথাটা সেখানেই থামিয়ে মোড় ঘুরিয়ে নিলো,
“আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবি?”
“চল”
“উহু, তোর ফটফটিতে বসে এদিক ওদিক টোটো করা না। সলিড ঘুরতে যাওয়া। পাহাড় তো চড়ার কসরত করতে পারবো না। সমুদ্রের ধারে নিয়ে যাবি? ঠান্ডা ঢেউয়ের মধ্যে পা ডুবিয়ে রাখবো। নোনাপানি এসে বালি সরিয়ে দিবে, ভিজিয়ে দিবে আমাকে। বাতাসে চুল উড়বে। ওহ আমার তো চুল নেই। থাক লাগবে না”

বলতে বলতেই হাসিখানা মিয়ে গেলো। মুখে মেঘ মেদুর জমলো। আবার সেই একজায়গাতেই কাঠি আটকে গেলো। অভ্র যেনো তা বুঝলো। উঠে এসে পাশে বসলো। তার গাল হাতের আদলে নিয়ে বললো,
“আমি তোর জন্য উইগ অর্ডার করে দিবো। যদিও নকল চুল, কিন্তু ফিলটা আসলের মতোই পাবি”
“ফাও বকিস না তো, মাথা ফিল পাবো”
“আচ্ছা, চুল না উড়লে বুঝি শাকচুন্নীর সরদার পদ থেকে পদচ্যুত হবি? এতো চিন্তা কেনো?”
“মানুষ হাসবে”
“আমার পুতুলের উপর হাসার সাহস কার আছে?”
“হাসলে কি করবি?”
“একটা এখনো হাসপাতালে”
“এতো সাহস হয়ে গেছে?”
“জেল খেটে জেলের ভয় কেটে গেছে”
“তাহলে তো বিপত্নীক হবার ভয়ও কেটে গেছে”

কথাটা শোনামাত্র মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো অভ্রর। কঠিন স্বরে বললো,
“একবার বলেছি না এমন বিরক্তিকর কথা বলবি না”
“কেন?”

অভ্র উত্তর দেবার পূর্বেই দরজায় টোকা পড়লো। অভ্র সেদিকে তাকাতেই দেখলো সাবেরা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ঐন্দ্রিলাকে নিতে এসেছেন। বেশ স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“ঐন্দ্রিলা চল”
“কোথায়?”
“বাসায়। যতদিন সুস্থ না হবে বাসায় থাকবে”

মায়ের এমন কথায় অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছালো ঐন্দ্রিলা। হতভম্ব স্বরে শুধালো,
“আমি তো এখানে ভালো আছি”
“জানি, কিন্তু আমার মনে হয় কাননের উপর অহেতুক চাপ পড়ছে। আমার মনটাও খুঁত খুঁত করছে। আমাদের ওখানে তুমি ভালো থাকবে”
“এটা তোমার ভুল ধারণা। আমার কাছে অভ্র আছে”
“অভ্র কি তিন/চার মাস নিজের সব কাজ ফেলে এখানে বসে থাকবে? পুরুষ মানুষের তো বাসায় থাকা কাজ নয় ঐন্দ্রিলা। আর এই ব্যাপারে তোমার বাবারও এক মত। সে তার মেয়েকে বাসায় নিয়ে যাবে। অহেতুক জেদ করো না”

ঐন্দ্রিলা কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই অভ্র বললো,
“মা ঠিক বলছেন ঐন্দ্রিলা। তোর ওই বাড়ি যাওয়া উচিত”

অভ্রর এমন কথায় চমকালো ঐন্দ্রিলা। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। রাগ হলো কেনো যেনো। অভ্র কি বিরক্ত তার খেয়াল রাখতে রাখতে। অভিমান হলো। ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“আমি তো এখানে ভালো আছি”
“তোর আরোও ভালো থাকা উচিত”
“তুই বুঝে শুনে বলছিস?”
“হ্যা”

নির্লিপ্ত উত্তর। ঐন্দ্রিলা আর কথা বাড়ালো না। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। এখন মাথায় চাপ দিতে পারে না। পেছনটা ব্যাথা করে। তাই চুপ করে গেলো সে। সাবেরা স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“ওর জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছি আমি। তুমি ওকে নিচে নিয়ে আসো”
“আপনি ব্যস্ত হবেন না, মা। নিচে যান। আমি সব গুছিয়ে আনছি”

সাবেরা কথা বাড়ালো না। চলে গেলো। অভ্র সুন্দর করে ঐন্দ্রিলার ব্যাগ গুছালো। ঐন্দ্রিলা নির্বাক্যে দেখলো। কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কেঁদে কি লাভ। এই পুরুষের ভাবে পরিবর্তন হবে না। সে নির্লিপ্ত, দায়সারা।

অভ্র নিচে নামলো তিনটে বড় বড় ট্রলির সাথে। ঐন্দ্রিলার মুখে আষাঢ়ের মেঘ। কানন মনক্ষুন্ন স্বরে শুধালো,
“এতো ব্যাগ কেনো? ঐন্দ্রিলা কি চিরকালের জন্য যাচ্ছে নাকি। পাশেই তো। যখন তখন জামাকাপড় নিয়ে যেতে পারবে”
“না মা, এখানে শুধু ঐন্দ্রিলার কাপড় নয়। আমারও কাপড় আর জিনিসপত্র আছে। আমিও তিন/চার মাসের জন্য শ্বশুরবাড়ি শিফট হচ্ছি……………………….

চলবে