মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-৪২ এবং শেষ পর্ব

0
52

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#অন্তিম_পর্ব (প্রথম অংশ)

“আমি ভেবেছি, অভ্রকে এবার ওর টাকা বুঝিয়ে দিবো বউমা। অনেক তো হলো লুকোচুরি। সে তার কথা রেখেছে। বিয়েটা করেছে। নাতবউয়ের ভালোবাসা আদায় করেছে। সে আমার দেওয়া সব শর্তই পূরণ করেছে। এবার এই টাকাটা তার প্রাপ্য। কি বলো?”

আউওয়াল সাহেবের কথাগুলো কানে আসতেই পা আটকে গেলো ঐন্দ্রিলার। মস্তিষ্কে তীব্র ঝাকুনি খেলো যেনো। স্তব্ধ হয়ে গেলো চিন্তাশক্তি। বোঝার চেষ্টা করলো শ্বাশুড়ী এবং দাদা শ্বশুরের কথোপকথন। কানন শ্বশুরের প্রস্তাবে প্রসন্ন স্বরে বললো,
“যা ভালো মনে করেন বাবা। তবে আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ভাগ্যিস টাকার মুলো ঝুলালেন। নয়তো আমার ছেলেটা কখনো বিয়ে করবে এমন কল্পনা স্বপ্নেও আনতে পারি নি। ছেলেটার অবশেষে একটা হিল্লে হলো। যখন হুট করে জেদ ধরলো ঐন্দ্রিলাকে বিয়ে করবে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বিয়ের নাম শুনতেই ছ্যাৎ করে উঠা ছেলে আমার বিয়ের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। পরে জানতে পারলাম, আপনি তাকে নতুন দোকানের জন্য টাকা দিবেন। সব ভালো হচ্ছিলো কিন্তু বিয়ের সময় যা ঘটনা ঘটলো, আমি তো ভয়েই ছিলাম। একেই আমার ছেলের কোনো জিনিসের প্রতি মন টিকে না, উপর থেকে ঐন্দ্রিলার সম্মতি নেই। এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি? জেদের জন্য বিয়ে কি টিকে?”
“এজন্যই আমি শর্তটাকে আরোও বাড়ালাম। বললাম, যদি একবছরের মাঝে নাতীর মুখ না দেখায় তবে আমিও টাকা দিবো না। আমার নাতীও শর্ত মেনে নিলো। বাকুয়ী বংশের ছেলে তো শর্তে হারার পাত্র না। তবে মানতেই হবে নাতীর মুরোদ আছে। ঠিক ঐন্দ্রিলাকে নিজের বশে নিয়ে এসেছে। যে মেয়ে তাকে দেখলেই খ্যাক করে উঠতো সেই মেয়ে তাকে চোখে হারায়। জন্মদিনে তার জন্য রান্না করছে, ভাবা যায়? এখন আমার চিন্তা নেই বৌমা। আমার প্রপৌত্রের মুখ দেখে এখন মরতে পারবো। তাই চিন্তা করেছি, শুধু টাকা নয়, ঘাটের জমিটাও ওর নামে লিখে দিবো। কি বলো বৌমা?”

ঐন্দ্রিলার মনে হল তার পুরো শরীরটা অসাড় হয়ে গেছে। সত্যের তীব্র আঘাতে তার তিলে তিলে গড়া বিশ্বাস টলমলে হয়ে গেলো। সংসার সংসার বলে অকৃত্রিম মায়ায় জড়িয়েছিলো তা কি কেবল ছলনা ছিলো? সব মিথ্যে ছিলো? শুধু টাকার জন্য অভ্র তার সাথে নাটক করেছে? এত যত্ন, আহ্লাদ, স্নেহ সবই কি মিথ্যে ছিলো? সব কিছু কেবল ঠুংকো শর্তের জন্য? আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরে গেলো। বিছানায় বসলো সে। ঘরময় সুখময় স্মৃতি। দেওয়ালও সাক্ষী দিচ্ছে তাদের মুহূর্তগুলো। মাথার পেছনটা তীব্র ব্যাথায় ঝাঝিয়ে উঠছে। ঘরের প্রণয়মুহূর্তগুলো খুব তিতকুটে লাগছে। বিছানার উপর শাড়িটা পড়ে আছে। অভ্রর জন্য একটা কালো ঘড়ি কিনেছিলো। বাহিরে যেতে পারছে না বলে অনলাইনে অর্ডার করেছিলো সে। ঘড়িটা বিছানার উপর ই রাখা। ঘরটাকে সাজানোর জন্য কত কিছুর ব্যবস্থা করেছিলো সে। এখন সব বৃথা লাগছে। বিছানা থেকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা দেখা যাচ্ছে। সেই আয়নায় ক্লান্ত দৃষ্টিতে লাগলো সে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখতেই তিক্তটা বাড়লো বাজে ভাবে। এতোটা অথর্ব সে? একটা মানুষ কি করে বারবার মানুষ চিনতে ভুল করে? নিজের নির্বুদ্ধিতার উপর প্রচন্ড রাগ হলো। সেই সাথে নিজের উপর জমলো ঘৃণা; এতো ভালোবাসার লোভ কেনো তার? ক্রোধ, বিতৃষ্ণা, বিষাদে ঝাঁঝরা হয়ে উঠলো সে। বিছানার পাশে রাখা তাদের দুজনের ফটোফ্রেমটা ছুড়ে মারলো সে আয়নার দিকে। হলুদের ছবি, যেখানে অভ্র একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুহূর্তেই তীব্র ঝংকার তুলে গুড়িয়ে পড়লো আয়নাটি। ফটোফ্রেম ভেঙ্গে কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো মেঝেতে। অবহেলায় পড়ে রইলো ছবিটি। ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে। মানুষের চোখও নাটক করতে পারে বুঝি?

ঘরময় হুলস্থূল কান্ড। ঘরের নিষ্পাপ জিনিসগুলো নিজের আহুতি দিলো বিনা কারণে। ভাঙ্গা কাঁচ, এলোমেলো বিছানা চাঁদর, ভাঙ্গা শোপিচ, ফুলদানি, মাটিতে অবহেলায় পড়ে থাকা শাড়ি সাক্ষী দিচ্ছে ঐন্দ্রিলার আহত হৃদয়ের। ঐন্দ্রিলার চাহনী শান্ত। অশ্রু শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে চোখের নিচে। ভাঙ্গা কাঁচে পা টা কেটে গেছে, রক্ত পড়ে জমাট বেঁধে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে কিন্তু অনুভূতি শুন্য। ফোন বাজছে অক্লান্তভাবে। অপরপাশের মানুষটির বেশ ধৈর্য্য। সে অক্লান্তভাবে ফোন দিচ্ছে শুধু। ঐন্দ্রিলা নির্লিপ্ত চাইলো ফোনের দিকে। অভ্র নামটা জ্বলজ্বল করছে। এখন ঐন্দ্রিলার ঔষধ খাবার সময়। নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেবার জন্য ফোন করেছে। প্রতিদিন সে বাঁধাধরা সময়গুলোতে ফোন দিবেই। এটা একেবারে নিয়মমাফিক। ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। ফোনটা ধরা হলো না। কেটে গেলো বাজতে বাজতে। মনটা আবার দূর্বল হয়ে গেল। ভালোবাসার ক্ষুধার্থ হৃদয় মস্তিষ্ককে বুঝালো, “ভুল হচ্ছে, কোথাও ভুল হচ্ছে। কেউ সারাক্ষণ নাটক করতে পারে না। একটা মানুষ সারাক্ষন মিথ্যের মুখোশ পড়ে থাকতে পারে না”। ঠিক ই তো, অভ্র কখনো তার উপর সম্পর্ক চাপিয়ে দেয় নি, ধৈর্য্য ধরেছে তার মনের দরজা খোলার। দূর্ঘটনার পর থেকে মানুষটি তাকে পুতুলের মত আগলে রেখেছে। যেনো একটু রুঢ়তা তাকে ভেঙ্গে ফেলবে, গুড়িয়ে দিবে। একটা মানুষ তো সারাক্ষণ নাটক করতে পারে না। কোথাও একটা ভুল নিশ্চয়ই হচ্ছে। অভ্রর সাথে কথা বললে বোধ হয় সব সমাধান হয়ে যাবে। ঐন্দ্রিলা ফোনটা হাতে নিলো। অভ্রর নাম্বারে ফোন দিলো কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ। ফলে সে উঠে দাঁড়ালো। পা থেকে এখনো চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়ছে। তীক্ষ্ণ ব্যাথা মস্তিষ্ককে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তবুও ঐন্দ্রিলা হাটতে লাগলো। গন্তব্য অভ্র। অনেক প্রশ্ন বাকি। উত্তর চাই।

******

বিল্লালের মাথার চুল ছেড়ার যোগাড়। কখন থেকে কিছু হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মিলছে না। একশত আটষ্টটি টাকার একটা গ্যাপ থেকেই যাচ্ছে। হিসেব এমন একটি জিনিস যা যতক্ষণ না পর্যন্ত মিলবে ততসময় পর্যন্ত বিরক্তি কাটে না। মিললে শান্তি, আর না মিললে মাথার প্রতিটি নিউরণে এতো উন্মাদ হয়ে উঠে যে চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। ঘড়ির দিকে একদফা তাকালো। তৃষা অপেক্ষা করছে। তার যাওয়া উচিত। গতরাতে মাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা বলেছে সে। বিল্লালের বাবা গত হয়েছে আজ পনেরো বছর। মা-ই তার সব। বিল্লালের মাও ছেলেঅন্তপ্রাণ। তাই তো ছেলের পছন্দে তার দ্বিমত নেই। শুধু একটাই চিন্তা সেটা হলো, তৃষার পরিবার। স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে সে। তাদের মতো পরিবারে মানিয়ে নিতে পারবে? বিল্লালের মা একটা ছোট এনজিওতে চাকরি করতেন। সেই টাকা দিয়ে টেনেটুনে সংসার, ছেলের পড়াশোনা চালাতেন। ছেলে অনার্সটা শেষ করেই অভ্রর সাথে ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। যেহেতু তার নিজের কোনো অর্থ নেই, তাই সে ম্যানেজার হিসেবেই ছিলো। অভ্র বন্ধুর জায়গাতেই তাকে রেখেছে। কখনো কর্মচারীর মতো আচারণ করে নি। বিল্লালের যা বেতন, তাতে মোটামুটি মা-ছেলের বেশ ভালোভাবেই চলে যায়। সম্পত্তি বলতে দাদাবাড়ি থেকে পাওয়া তিনটি ঘর আর বিল্লালের একটি মোটরসাইকেল। সেখানেই তাদের অবস্থান। তৃষা এই সবকিছু জানে। তবুও সে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবগত। নীলাদ্রির মত ছেলেকে যদি সরকারি চাকরির মুলো ঝুলায় শ্বশুর তাকে না জানি কোন অস্ত্রে বধ করে। অভ্রকে জানিয়েছে ব্যাপারখানা। বিল্লাল চেয়েছিলো একটা ভালো বেতনের চাকরি খুজতে কিন্তু তাতে অভ্রর চাকরি ছাড়তে হতো। এতো বিশ্বাসী মানুষ এবং বন্ধুকে হারাতে চায় না অভ্র। তাই অভ্র তাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছে। অভ্র তাকে তার ব্যবসার পচিশ শতাংশের মালিকানা দিতে চায়। যার মুল্য বিল্লাল কখনো তাকে ছেড়ে যাবে না। বিল্লাল এই ব্যবসার পেছনে কম শ্রম দেয় নি। এই ব্যবসার সাফল্যে বিল্লালের ভূমিকা অনেক। তাই তাকে পচিশ শতাংশের অংশীদারিত্ব দেওয়া ভুল নয়। তাই বিল্লালের কাজের চাপ বেড়ে গেছে। আগামীকাল তৃষার বাবার সাথে দেখা করবে সে। তাই এই হিসেবের ঝঞ্জাট আজ শেষ করবে। কিন্তু তৃষার সাথে দেখাও করতে হবে। মেয়েটির ছুটি হয়ে যাবে। বিল্লাল আবার হিসেবে মুখ গুজলো।
“বিল্লাল সাহেব কি ব্যস্ত?”

চিকন মেয়েলী কন্ঠে চোখ তুলে তাকালো বিল্লাল, হতবাক স্বরে শুধালো,
“একি, তুমি এখানে?”
“কেনো আসা বারণ? পাপ করে ফেললাম?”

তৃষার প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো বিল্লাল। ব্যস্ত হয়ে বললো,
“না, না সেটা কখন বললাম? তুমি ভুল বুঝছো”
“বুঝেছি, বুঝেছি। আর কথা ঘুরিও না। তোমার কাছে আসি নি। এসেছি, ব্যাংকের বার্তা নিয়ে। অভ্র কোথায়? ওকে ফোনে পাচ্ছি না”
“ও একটা ক্লাইন্টের কাছে গেছে। আমাকে বলো”
“আচ্ছা, কাল একবার ব্যাংকে এসো তো। ঢাকা থেকে ভিজিটে আসছে। অভ্রর লোন বাড়ানো নিয়ে কথা হবে। এই নাও লেটার। আমি চললাম”

বলে যেতে নিলেই হাত টেনে ধরলো বিল্লাল। তৃষাকে নিজের কাছে টেনে শুধালো,
“তাহলে আমার কাছে আসো নি?”
“আজ্ঞে না”
“কষ্ট পাইলাম কিন্তু”
“পাও, আমার কি?”
“এভাবে প্রেমিককে শাস্তি দিলে কিন্তু ভোগান্তি আছে”
“কি ভোগান্তি?”

বিল্লাল কথাটা শেষ করার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই এলোমেলো ভঙ্গিতে প্রবেশ করলো ঐন্দ্রিলা। তাকে খুব অন্যরকম লাগলো যেনো। চোখ মুখ শুষ্ক, মলিন। এসেই শুধালো,
“অভ্র আছে?”

বিল্লাল সেপ্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালটা শুধালো,
“তোমাকে এমন লাগছে কেনো? শরীর খারাপ নাকি?”
“আমি ঠিক আছি, অভ্র কোথায় সেটা বলো। ওর ফোনটা বন্ধ আসছে”
“ক্লাইন্টের সাথে গেছে। তুমি বসো না?”

ঐন্দ্রিলার কিছু ভালো লাগছে না। অভ্রর সাথে কথা বলাটা জরুরি। খুব জরুরি। তাকে অন্যমনস্ক দেখে তৃষা চেয়ারটা এগিয়ে বললো,
“তুমি বসো ঐন্দ্রিলা। তোমাকে অসুস্থ লাগছে”

এতোসময় বাদে তৃষাকে খেয়াল করলো ঐন্দ্রিলা। তৃষাকে দেখতেই হৃদয়ের তিক্তটা আরোও গাঢ় হলো। নিজের বৈশিষ্ঠ্যর বিরুদ্ধে সে জঘন্য একটি কাজ করে বসলো। অহেতুক তৃষাকে কথা শুনিয়ে দিলো, তাও কটু কথা। রুঢ় স্বরে বললো,
“তুমি এখানে কি করছো?”

তৃষা বেশ অপ্রস্তুত হলো ঐন্দ্রিলার কন্ঠে। বিল্লালের দিকে তাকালো একবার। নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে সহজ গলায় বললো,
“অভ্রর কাছে এসেছিলাম, ব্যাংকের বিষয়ে। একটা নিউজ দেবার ছিলো”
“তুমি কি ডাকবাহক? না মানে তোমার ই আসতে হয়েছে? আর কেউ ছিলো না?”

খুব তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালো ঐন্দ্রিলা। এটা ভুল নয় যে এই সামান্য বিষয়ে তৃষার আসার প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু সে এসেছে বিল্লালের সাথে দেখা করতে। তৃষা কথাটা চেপে গেলো। নিচু স্বরে বললো,
“ছিলো, কিন্তু নিউজটা দেওয়া খুব জরুরি ছিলো। অভ্র আমার ফোন ধরছে না, তাই আসা……”
“আচ্ছা তৃষা, তোমার সমস্যাটা কি বলো তো!”
“বুঝলাম না ঠিক”
“মানে টা খুব সহজ তৃষা। তুমি ছেলেমানুষ নও। অভ্র বিবাহিত। ক্লাস টেনের অপূর্ণ প্রণয় এখন পূর্ণ করার স্বপ্ন থাকলে আমি বলবো তুমি স্বপ্নটা ছেড়ে দাও তৃষা। নানা উছিলায় অভ্রর আগে পেছনে ঘোরা, তার সাথে গলে গলে পড়া ব্যপারগুলো দৃষ্টিকটু। সেদিনের ঘটনা কিন্তু আমি ভুলি নি তৃষা। তুমি যদি ভেবে থাকো আমার বরের গায়ে তুমি ঢলে পড়বে আর আমি চুপ থাকবো তবে ভুল। আমি আমার জিনিস কারোর সাথে ভাগ করায় অভ্যস্ত নই। যদি আমার জিনিস নিতে হয় তবে তোমাকেও তার কঠিন দাম দিতে হবে”

ঐন্দ্রিলার কথাগুলো চাবুকের মতো আঘাত করলো তৃষার আত্নসম্মানের দেওয়ালে। কান ঝাঁঝিয়ে উঠলো। ইহজীবনে তার চরিত্রে এমন কালিমা কেউ লেপ্টে পারে নি। সে কি না বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইছে? এতো বড় মিথ্যে অপবাদ? তীব্র অপমানে মুখ লাল হয়ে উঠলো মেয়েটির। বিল্লাল ঐন্দ্রিলার উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাবিআপু, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে”
“না, আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না বিল্লাল। আমি তো না জেনে বলছি না”

তৃষা তখন প্রতিবাদ করে উঠল তীব্রভাবে,
“তুমি আসলে কিছুই জানো না ঐন্দ্রিলা। তুমি আসলে কুয়োর ব্যাঙ, যার কাছে আকাশটা খুব ছোট আর গোল। তাই তো আজ আমাকে অপবাদ দিতে তোমার বাধছে। শোনো ঐন্দ্রিলা, আমার ঠ্যাকা পড়ে নি তোমার বরকে নিয়ে টানাটানি করবো বা তার উপর গলে পড়বো। এই সবকিছু তোমার বরের পরিকল্পনা ছিলো। আমার টার্গেট ফিলাপে ক্লাইন্ট দরকার ছিলো, আর তোমার বরের তোমাকে প্রেমে ফেলতে একটা মেয়েসঙ্গ। তাই আমরা একে অপরকে সাহায্য করেছি এতোটুকুই। অভ্র জানতো তুমি মুখে যাই বলো না কেনো তুমি একটা বোকা মেয়ে। প্রেমে পড়তে তোমার সময় লাগবে না। অন্য বউদের মতো তুমিও অভ্রকে কারোর সাথে সহ্য করবে না। নিজে হেটে ওর কাছে ধরা দিবে। আর ওর পরিকল্পনা সফল হবে। তুমি ওর প্রেমে ধরা দিলে, ওর সাথে সুষ্ঠুভাবে সংসার করলে তো দাদার কাছ থেকে সে টাকা পেয়ে যাচ্ছে। আফটার অল সে তো টাকার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছে।“

বিল্লাল তৃষাকে বাঁধা দিতে চাইলো, কিন্তু সে থামলো না। ঐন্দ্রিলা স্তব্ধ তাকিয়ে রইলো। ছলছল করছে তার চোখে ভাঙ্গা স্বপ্নের হাহাকার। তৃষা তোয়াক্কা করলো না তার ভঙ্গুর মনোস্থিতি। বিদ্রুপ টেনে বললো,
“তুমি তো মনে হয় জানোও না তাই না? অভ্র তোমাকে টাকার জন্য বিয়ে করেছে। দোকান করতে এডভান্স লাগতো। তুমি সেই টাকা পাওয়ার মাধ্যম। আর আমি তোমাকে প্রেমে ফেলার মাধ্যম। আমার এতো খারাপ দিন আসে নি যে অভ্রকে নিয়ে চিন্তা করবো”

ঐন্দ্রিলার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে কেউ ভোতা ছুরি দিয়ে আঘাতের মত আঘাত দিতে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে হৃদয়টা। এতোদিন খুব যত্নে লালিত প্রণয়ফুলটাকে কেউ রুক্ষভাবে উগড়ে ফেললো যেনো। বারবার স্বার্থান্বেষী মানুষদের স্বার্থ উদ্ধারের মাধ্যমই কেনো হয় সে? প্রথমে সৌরভ, এখন অভ্র। সবাই শুধু স্বার্থের দায়েই তার সাথে ভালোবাসার নাটক করে। কি নির্মম পরিহাস ভাগ্যের। ঐন্দ্রিলা আর দাঁড়াতে পারলো না। চলে যেতে নিলে বিল্লাল বললো,
“ভাবিআপু কোথায় যাচ্ছ? আমার মনে হয় তোমার অভ্রর সাথে কথা বলা জরুরি”

ঐন্দ্রিলার কঠিন স্বরে উত্তর দিলো,
“কোনো প্রয়োজন নেই, আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি”

বলেই সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা বাড়ালো। বিষন্ন মনটাকে জোর করে টেনে নেওয়া শুধু।

বিল্লাল বারবার অভ্রকে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু ফোনটা বন্ধ। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে রাগী স্বরে তৃষার উদ্দেশ্যে বললো,
“কি প্রয়োজন ছিলো তৃষা এতো কথা বলার?”

তৃষা শক্ত মুখে বসে ছিলো। বিল্লালের এমন কথায় তার ছাইচাপা রাগ স্ফুলিঙ্গের রুপ নিলো। ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,
“প্রয়োজন ছিলো, ঐন্দ্রিলার একটু রিয়েলিটি চেক হওয়া প্রয়োজন। আর তুমি এখন ঐন্দ্রিলার পক্ষ নিয়ে মোটেই কথা বলবে না বিল্লাল”
“তৃষা শান্ত হও”
“না আমি শান্ত হব না। কেউ আমার চরিত্রে আঙুল তুলবে আর আমি চুপ করে বসে থাকবো? আমি কি ফেলনা মেয়ে? কোনো চিপ, ক্যারেক্টরলেস মেয়ে নাকি যে বিবাহিত পুরুষকে চাইবো? আর তুমি আমাকে বলছো শান্ত হতে! নাকি তুমিও আমাকে এমন মেয়ে ভাবো বিল্লাল? এজন্য কি আমাকে এড়িয়ে যেতে তুমি?”

তৃষার প্রশ্নের বানে ক্ষতবিক্ষত হলো বিল্লাল। মেয়েটির মুখমন্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। মুখভাব কঠিন। বিল্লালকে চুপ করে থাকতে দেখে তৃষা আরোও অধৈর্য্য হলো৷ চাপা আর্তনাদ প্রকাশ পেলো,
“তুমি চুপ করে আছো কেনো?”
“কারণ আমি এখন যাই বলি না কেনো তুমি বুঝবে না। তাই বলছি ঠান্ডা হও। তুমি ঠান্ডা হলে আমি উত্তর দিবো”
“আমি ঠান্ডাই আছি। বেশি কথা বলবে না। আমার প্রশ্নের উত্তর আগে দাও। আমাকে কেনো এড়িয়ে চলতে? আমাকে এতো অপছন্দ করতে কেনো তুমি?”
“কারণ আমি তোমার প্রেমে পড়তে চাই নি”

তৃষা স্তম্ভিত হলো। এমন উত্তরের জন্য যেনো প্রস্তুত ছিলো না সে। বিল্লাল মৃদু স্বরে বললো,
“আমি কখনো তোমার প্রেমে পড়তে চাই নি তৃষা, তুমি বাধ্য করেছো। নয়তো আমি স্বপ্নেও ভাবি নি ক্লাসের নেকুপিসির প্রেমে আমি আপাদমস্তক ডুববো। তাই এড়িয়ে যেতাম”

তৃষা আর কথা বাড়ানোর সুযোগ পেলো না। রাগটা গলে যাচ্ছে যা খুবই অনুচিত কাজ।

*****

অভ্রর ফোনে চার্জ নেই। ক্লাইন্টের সাথে মিটিং শেষ। ব্যাটা খুব পাকিয়েছে। মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। এখন আর দোকান যাবে না সে। সরাসরি বাসা। ঐন্দ্রিলার সাথে কথা হয় নি সারাদিনে। মেয়েটা তখন ফোন ধরে নি। ব্যস্ত ছিলো কি? আচ্ছা তাকে চমকে দিলে কেমন হয়? এখন অভ্রর বাসায় যাবার সময় নয়। আজ তার জন্মদিন। নিশ্চয়ই ঐন্দ্রিলা কোনো সারপ্রাইজের ছক কষেছে। হুট করে পৌছে তার পরিকল্পনা ভেস্তে দিলে কেমন হয়? রেগে লাল হয়ে যাবে। আর সেই রাগী মুখখানা চোখ মুদে দেখবে অভ্র। যে ভাবা সেই কাজ। অভ্র রওনা হলো বাসার পানে। বাসায় আসতেই দেখা গেলো বসার ঘরে সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। অভ্র সহজ গলায় শুধালো,
“কি হয়েছে?”
“ঐন্দ্রিলা বাসায় নেই। কোথাও পাচ্ছি না। ও বাড়িতেও যায় নি। কোথায় গেছে কেউ জানে না”…………………

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#অন্তিম_পর্ব (দ্বিতীয় অংশ)

বাসায় আসতেই দেখা গেলো বসার ঘরে সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। অভ্র সহজ গলায় শুধালো,
“কি হয়েছে?”
“ঐন্দ্রিলা বাসায় নেই। কোথাও পাচ্ছি না। ও বাড়িতেও যায় নি। কোথায় গেছে কেউ জানে না। ফোন দিচ্ছি কখন থেকে ফোনটাও বন্ধ। আমার তো ভয় করছে”

কাননের কন্ঠে তীব্র দুশ্চিন্তার ছাপ। তার উজ্জ্বল, সুন্দর মুখখানা শুকিয়ে গেছে। শ্বশুরের সাথে কথা বলে নিজের ঘরে এসে বসতেই তীব্র ভাঙ্গচুরের শব্দ কানে এলো। ভরদুপুরের এমন বিকট শব্দটা কোথা থেকে আসছে! আজকাল হুট করেই বানরের উপদ্রব হয়েছে এই এলাকায়। এই তো সেদিনের কথা পশ্চিমের রব্বানীদের বাড়ির সাথে এমন দুপুরের সময় কোথা থেকে একদল বানরের আগমন হলো। একা বানর নয়, একেবারে আত্মীয়-স্বজন, গুষ্টি নিয়ে আগমন। মোট সাতটা বানর। দাপাদাপি, লাফালাফি করে একাকার অবস্থা। তাড়ানোর উপায় নেই। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! কাছে গেলেই খামছি দেয়। ছাদটা এখন পুরোই বানরের দখলে। রব্বানীদের বাড়ির নতুন নাম এখন “বানরমহল”। বানরগুলো কি এখন তার বাড়িতে এসেছে দখলের জন্য? ভয় পেলেন কিঞ্চিত কানন। একটু সংকোচ হল। ইদ্রিশ সাহেব বাসায় নেই। উনি থাকলে সাহস পাওয়া যেত। অভ্রও নেই। উপরের ঘরে ঐন্দ্রিলা একা। মেয়েটা ভীষণ ভয় পেতে পারে। ফলে ভয় গিলে বানর অনুসন্ধানে উপরে আসলেন তিনি। উপরে গিয়ে প্রথমে গেলেন অভ্রর ঘরে। দরজাটা ভেজানো। হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। ঘরের অবস্থা দেখে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন কানন। ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী বিধ্বস্ততা বুঝি একেই বলে। ঘরে কেউ নেই, ঘরের প্রতিটি জিনিসের ভঙ্গুর অংশ আত্মচিৎকার করে জানান দিচ্ছে ঐন্দ্রিলার অন্তস্থলের ঘূর্ণিঝড়ের। কাননের বুকে কু ডাকলো। তার সুন্দর করে গুছানো সংসারের টলমলে অবস্থা যেনো খুব নিপুন ভাবে আঁচ করতে পারলেন তিনি। সাথে সাথেই ফোন করলেন অভ্রকে। কিন্তু পোঁড়া ফোনটা বন্ধ। চিন্তায় গলা শুকিয়ে এলো কাননের। অপেক্ষা করলেন। এক ঘন্টা, দু ঘন্টা। কিন্তু ঐন্দ্রিলার খবর নেই। ফোনটাও ফেলে গেছে। ইদ্রিস সাহেব ফিরলে জানালেন সবকিছু। ইদ্রিস সাহেব স্ত্রীর নির্বুদ্ধিতায় বেশ বকাবকিও করলেন। অবশেষে খোঁজ খবর নেওয়ার অধ্যায়ের সূচনা হলো আনুষ্ঠানিক ভাবে। ও বাড়ি খোঁজ নিতেই জানা গেলো ঐন্দ্রিলা আসে নি। ভয়ের মেঘ গাঢ় হলো। চিন্তার কুহেলিকা ঘন হল। কি করবে বুঝতে পারছে না তারা। সাবেরা কঠিন মুখে বসে আছেন। কানন অপরাধীর মতো এতটা সময় বসে ছিলেন। অসুস্থ বউমা কাউকে না জানিয়ে কোথায় চলে গেছে? অবশেষে অভ্রর আগমণ ঘটলো।

কাননের কথা মস্তিষ্কে আন্দোলিত হলো অভ্রর। অনুধাবন করতে সময় লাগলো। অভ্র কোনো কথা না বলেই নিজের ঘরের দিকে ছুট দিলো। ঘরে প্রবেশ করতেই তার মুখ রক্তশুন্য হয়ে গেলো। চূর্নবিচূর্ন ঘরটা দেখে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না আসলে কি ঘটেছে। ঐন্দ্রিলার রাগ সহ্য করেছে এই জড় বস্তুগুলো। কিন্তু রাগের উৎসটুকু মস্তিষ্কে ধরা দিচ্ছে না। অভ্র এমন কিছু করে নি যাতে ঐন্দ্রিলা ক্ষিপ্ত হবে। মায়ের সাথে তার সম্পর্ক ভালো। শ্বাশুড়ির সাথে সম্পর্কটা এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে এই তান্ডবের হেতু কি? তার চেয়ে প্রথমে ঐন্দ্রিলার ঠিকানা জানা প্রয়োজন। ঐন্দ্রিলার শূন্যতা চাবুকের মতো আঘাত করছে অভ্রকে। অন্তস্থলে চিনচিনে ব্যাথা মস্তিষ্ক অবশ করে দিচ্ছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাগছে তার। মেঝেতে এখনো ঐন্দ্রিলার রক্তের দাগ। মেয়েটি আঘাত পেয়েছে, নিশ্চয়ই স্যাভলন লাগায় নি। কোথায় খুঁজবে? পিউ ছাড়া ঐন্দ্রিলার বান্ধবী নেই এর ঘরে। পিউ এখন বান্দরবানে। ওবাড়ি যায় নি সে। মাথাতা মোটেই কাজ করাতে পারছে না অভ্র। উচাটনে অন্ধকার লাগছে সব। ঠিক সেই সময়ে ইদ্রিস সাহেব এলেন। ফোন এগিয়ে উৎকুন্ঠিত গলায় বললেন,
“বিল্লাল তোমাকে খুঁজছে”
“পরে কথা বললো”
“ঐন্দ্রিলার ব্যাপারে কিছু বলতে চায়”

সাথে সাথেই ফোনটা হাতে নিলো। ওপাশের মানুষটি ম, চ বর্গীয় গালি দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে শুধালো,
“কই ছিলি তুই?”
“ঐন্দ্রিলার সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছিলি। সেটা বল আগে। ফাও প্যাচাল পাড়তে ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনোটাই নেই”
“ঐন্দ্রিলার সাথে তোর কথা হয় নি? ও দোকানে এসেছিলো তোকে খুঁজতে”
“কখন?”
“দুপুরের একটু পর”
“ধ্যাত্তেরি, ও কি কিছু বলেছে তোকে?”
“নাহ, কিছু বলে নি। কিন্তু এখানে ক্যাচাল হয়েছে”
“কি ক্যাচাল?”

বিল্লাল একটু সময় নিলো, তারপর সবটা খুলে বললো। বিল্লালের কথা শেষ হলে স্তব্ধ বসে রইলো অভ্র। স্বীকার না করলেও এই ভয়টা সর্বদা কন্ঠস্থি চেপে ধরে থাকতো। বিয়েটা সে দাদার শর্তে করেছে এটা সত্য। তিক্ত সত্য। ভালোবাসার অনুভূতিটা প্রাচীন হলেও এই সত্য থেকে মুখ ফেরানোর ক্ষমতা অভ্রর নেই। দাদার শর্তবিহীন তাদের গল্পটা হয়তো কোনো পরিত্যাক্ত স্টেশনের চেয়ারের মতোই পড়ে থাকতো। অভ্রর মনে ঐন্দ্রিলার হৃদয়ের নরপতি হবার ইচ্ছেটা হৃদয়ের এক কোনায় পড়ে থাকতো হয়তো। দূর থেকে বিমুগ্ধ নয়নে তাকে দেখতো কিন্তু ছোঁয়ার স্পর্ধা করতো না হয়তো। হয়তো! এই ঘটনা যদি আগে ঘটতো, অভ্র থাকতো বেপরোয়া। আগের মতো নির্লিপ্তভাবে ঐন্দ্রিলার অভিসম্পাত মেনে নিতো। বরাবরের মতো সে থাকতো দায়সারা। কিন্তু যখন থেকে নিজের অনুভূতিগুলোকে আলিঙ্গন করলো অভ্র তখন থেকেই কুৎসিত সত্যটাকে ভয় পেতে শুরু করলো অভ্র। অন্তরে কাঁটা দিলো ঐন্দ্রিলার অভিশাপ পাবার আশংকা। ঐন্দ্রিলার চোখে নিজের জন্য ঘৃণা যে তাকে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দিতে পারে সে সম্পর্কে হৃদয় ধারণা দিলো। এর চেয়ে সাংঘাতিক ভীতি যা তাকে কাবু করতে লাগলো তা হলো ঐন্দ্রিলার শূন্যতা। সেই ভয় এখন বাস্তবিক রুপ ধারণ করেছে। নিজের উপর তীব্র রাগ হলো অভ্রর। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ঘরময় আরেকবার চাইলো সে। তার ঐন্দ্রিলা নেই, তার রাজ্য আজ রিক্ত। পৃথিবীটা এতোটা যন্ত্রণাময় লাগছে কেনো? জীবনটা এতো অভিশপ্ত ঠেকছে কেনো? অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, ঐন্দ্রিলা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে”

নিজের দাম্ভীক, অহংকারী ছেলেকে দ্বিতীয়বার পরাস্ত অবস্থায় দেখলেন ইদ্রিস সাহেব। ছেলেটার দম্ভ চুরমার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শান্তি লাগছে না কেনো? হয়তো মানুষের স্বাভাবিক সত্তাই আমাদের মন-মস্তিষ্কের অভ্যস্ত থাকে, যতই মনের তীব্র বাসনা হোক ভিন্নতা আমরা সইতে পারি না।

*****

পাহাড়ের বৃষ্টি স্রষ্টার অনন্য দৃশ্যপট। আকাশের মেঘেরার তখন ধীরলয়ে নেমে আসে পাহাড়ের চুড়ায়। তারপর জলনৃত্য। প্রকৃতিও সেই নৃত্যে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে। এই অলৌকিক সুরম্য দৃশ্য দুচোখ মুদে উপভোগ করছে পিউ। থানচি উপজেলার রেমাক্রি খালের গায়েই নীলাদ্রির দোতালা কটেজ। সম্পূর্ণ কাঠের কটেজটি। নিচে একটি রুম এবং রান্নাঘর। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলে পাশাপাশি দুটো রুম। রুমের সামনে টানা বারান্দা। বারান্দায় সারিবদ্ধ টব। তাতে নানা পাহাড়ি ফুল। কুরুক ফুলের ডালটি ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। শ্বেতকাঞ্চন ফুটবে ফুটবে করছে। বিমখানায় মাথা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিউ। থানচিকে ধীরে ধীরে আপন করে নিয়েছে সে। চাকমাদের ভাষা সে বুঝে না। তবে নীলাদ্রির এসিসট্যান্ট এবং এই কটেজের কেয়ারটেকার অজয়ের বদৌলতে সে কিছুটা হলেও শিখছে। যেমন খাবোকে তারা হেম বলে। “মুই ভাত হেম” অর্থ আমি ভাত খাব। আমার খিদে নেই হলো “মোর পেট ন পুড়ের”। আমি ভালো আছি বোঝাতে বলতে হয় “মুই গম আগং”। পিউয়ের বেশ মজা লাগে। আপাতত সে তিনটে লাইনই বলতে পারে। বাকি ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিছু শব্দ বলতে পারে। পুরো কথোপকথনের জন্য নীলাদ্রি আর অজয়ের সাহায্য তার চাই। সে যতটা কঠিন ভেবেছিলো পাহাড়ে থাকা তত কঠিন নয়। বরং প্রকৃতিকে প্রাণ খুলে উপভোগ করা যায়। এই যেমন বর্ষার এই স্নিগ্ধতা ইট পাথরের শহরে কোথায় পাবে? শ্বেতকাঞ্চনের মিষ্টি গন্ধ কি নিজের ঘরে পেতো?
“কফি চলবে?”

প্যাকেট কফি বানিয়ে এনেছে নীলাদ্রি। নিশ্চয়ই চৌবাচ্চার অংকে মাথা ধরেছে নীলাদ্রির। পিউ মিষ্টি হেসে বলল,
“এদিকে আসুন”

কাঠের রেলিং এ কাপজোড়া রাখলো নীলাদ্রি। পিউ দু হাত মেলে তাকে আলিঙ্গনের আমন্ত্রণ জানালো। নীলাদ্রিও অসহায় বিলাইছানার মতো তাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজলো। কাতর স্বরে বললো,
“এভাবেই থাকি কিছুসময়?”
“থাকো”

এমন সময় অজয়ের কন্ঠ কানে এলো,
“স্যার, হাঁচর নিচে আস”

নীলাদ্রি বিরক্ত হল। কোথায় একটু বউয়ের আদর উপভোগ করছিলো, এই অজয়ের শান্তি নেই। নীলাদ্রির পিছু পিছু পিউও নামলো সিড়ি বেয়ে। নিয়ে আসতেই চোখ চরাগগাছ হলো। অস্পষ্ট স্বর বেড়িয়ে এলো,
“ঐন্দ্রিলা”

*****

ঐন্দ্রিলা কাউকে কিছু না জানিয়ে একা একা এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। তাকে বিধ্বস্ত লাগছিলো। হাতে একখানা হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া কিছু নেই। কাপড়টাও ঘরে পড়ার। চোখজোড়া ফুলে আছে। ক্লান্তি মুখে। সে কোনো ফোন নিয়ে আসে নি। কি করে পথ চিনে এতটা দূর এলো সেই চিন্তা সর্বপ্রথম এলো নীলাদ্রির মাথায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়লো, গত বছর এবং তার আগের বছর মোট দুবছর ঐন্দ্রিলা এখানে এসেছিলো। তবুও মেয়েটা সাংঘাতিক কাজ করেছে। যদি পথে কিছু হয়ে যেত? পাহাড়ে মানুষ উদবাস্তুর মতো আসে না, আসে একেবারে আটঘাট বেঁধে। সে কিছু বলতেই চাচ্ছিলো কিন্তু ঐন্দ্রিলা ক্লান্ত স্বরে বললো,
“আমি একটু ঘুমাবো, শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে”

পিউ তাকে কেবিনে নিয়ে গেলো। পায়ের জখমী অবস্থা নজর এড়ালো তার। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
“যখন ভালো লাগবে আমাকে খুলে বলিস কি হয়েছে”
“ও বাড়ি থেকে ফোন আসলে প্লিজ বলিস না আমি এখানে এসেছি”

পিউ আর প্রশ্ন করলো না। বান্ধবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে সে অবগত। বিশ্রাম নিক। সময় হলে সবটা জানতে পারবে।

******

ঐন্দ্রিলা ঘর ছেড়ে বের হলো তিনদিন পর। এই তিনদিন খাওয়াদাওয়া ঘরেই করেছে। নিজেকে পৃথিবী থেকে আড়ালে রাখতেই যেনো স্বাচ্ছন্দবোধ করছিলো সে। বাহিরে বের হলেই তিক্ততা তাকে কাবু করছিলো। না চাইতেও অভ্রর প্রতারনা তাকে আঘাত করছিলো। দোকান থেকে বের হবার পর প্রথম যে জিনিসটা অনুভব হয়েছিলো তা হলো তার যাবার জায়গার অভাব। ভাগ্যবশত ব্যাগে টাকা ছিলো আর নীলাদ্রির আবাসস্থলের পথখানা পরিচিত ছিলো। সারাটা রাস্তা শুধু শুন্যচোখে দেখেছে এই উদার ধরণীতে। আপন মানুষ ব্যাতীত এই ধরণী খুবই কলংকিত ঠেকে। একাকীত্ব মানুষের সবচেয়ে বড় অভিশাপ।

চেয়ার টেনে বসলো ঐন্দ্রিলা। নীলাদ্রি সূঁচালো নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে মুখে তীব্র আকাঙ্খা সত্য জানার। পিউ ঐন্দ্রিলার প্লেটে খিঁচুড়ি বেড়ে বললো,
“খেয়ে নে”

ঐন্দ্রিলার অরুচি হচ্ছে। খেতে ইচ্ছে করছে না। অনেক ক্ষুধা অথচ খাবার দেখলেই অনীহা চলে আসে। চারপাঁচবার বমিও করেছে সে। হয়তো এতো বড়ো জার্নিটা শরীর নিতে পারছে না। সেদিন দুপুরের পর থেকে কিছুই খায় নি সে। সেই না খাওয়া অবস্থাতেই জার্নি করেছে। এই তিনদিন ঔষধও খাওয়া হয় নি। ঔষধ গুলো বাসায় ফেলে এসেছে। নামও জানে না। অভ্র জানে। সব কিছু ঘুরে ফিরে অভ্রতেই আটকে যাচ্ছে। নীলাদ্রি গম্ভীর স্বরে বললো,
“মা ফোন করেছিলো। তোকে না পেয়ে হন্নে হয়ে খুঁজছেন তারা”
“ওহ”
“তুই এখনো বলবি না কি হয়েছে?”

ঐন্দ্রিলা খিঁচুড়ি নাড়া চড়া করতে করতে একরাশ অনীহা নিয়ে বললো,
“আমি ফিরবো না”
“কেনো?”

হতভম্ব হলো নীলাদ্রি। সহজ গলায় উত্তর দিলো ঐন্দ্রিলা,
“মিথ্যে মিথ্যে সংসার খেলা ভালো লাগছে না। ক্লান্ত লাগছে। একটু জিরিয়ে নেই”

পিউ তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“মিথ্যে সংসার তো তোর নয় ঐন্দ্রিলা”
“এই ভুল ধারণা আমার এতোদিন ছিলো। ভেঙ্গে গেছে”

পিউ কিছু বলতে চাইলে নীলাদ্রি তার হাত চেপে ধরলো। শান্ত স্বরে বললো,
“যতদিন ইচ্ছে, তুই থাক এখানে”

*******

অভ্রর অবস্থা পাগলপ্রায়। গত পাঁচদিন যাবৎ ঐন্দ্রিলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচটা দিন, একশ বিশ ঘন্টা, মিনিটে হিসেব করলে তা সাত হাজার দুশো মিনিট। সেকেন্ডের হিসেব জানা নেই অভ্রর। শুধু এটুকু জানে সে অকথিত নরকে বাস করছে। পৃথিবীটা তার কাছে অগ্নিগ্রহের মত ঠেকেছে। এই পাঁচটা দিন পথহারা পথিকের ন্যায় শুধু ঐন্দ্রিলাকেই খুঁজছে। থানা, হাসপাতাল, মর্গ কিছুই বাকি রাখে নি। কিন্তু ফলাফল শুন্য। যাযাবরের সে শুধু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঐন্দ্রিলাকে। খাওয়া-দাওয়ার কোনো খবর নেই। যখন বাসায় ফিরে তখন তাকে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় মনে হয়, পরিশ্রান্ত, কাবু, দূর্বল। ওজন কমে গিয়েছে হয়তো। জানে না অভ্র। শুধু এটুকু জানে জীবনে বিতৃষ্ণা ছেয়ে গেছে। তিক্ত লাগে সবকিছু। নিঃশ্বাস তো নেয় কিন্তু সে মৃতপ্রায়, ম্লান। ঘরে এসে ঐন্দ্রিলার ওড়নাটা জড়িয়ে শুয়ে থাকে। গন্ধটুকু মিলিয়ে গেছে। প্রতিটি কোনার স্মৃতিগুলো গলার কাঁটার মতো বিঁধছে। বেঁচে থাকা এতোটা কষ্টের হবে কখনো ভাবে নি।

ফোন বাজছে অভ্রর। থানা থেকে ফোন এসেছে? আবার কোনো লাশ পেয়েছে কি তারা? এই অবধি তিনবার এমন আতংকিত ফোন এসেছে। নিঃশ্বাস আটকে যায় এমন ফোনে। মনে হয় কেউ গলা চিপে ধরেছে। মর্গে যেয়ে স্বস্তি মেলে, না ঐন্দ্রিলা নয়। এখন আবার তেমন অনুভূতি হচ্ছে। কাঁপা হাতে ফোনটা ধরলো। ওপাশ থেকে চিকন কন্ঠ এলো,
“হ্যালো, অভ্র তোর সাথে কথা আছে”

****

জানালার ধারে হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে ঐন্দ্রিলা। বৃষ্টিতে সদ্য ফোঁটা শ্বেতকাঞ্চন ফুলটা ভিজছে, যেনো কোনো অবাধ্য কিশোরী। বৃষ্টিটা মোটেই ভালো লাগছে না ঐন্দ্রিলা। স্মৃতিগুলো কেমন জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই বৃষ্টিভেজা রাত, ঐন্দ্রিলার নিদারুন আত্মসমর্পন। পূর্ণিমার সেই আকন্ঠ ডুবে যাওয়া। অভ্র উষ্ণ বুকে ঠাঁই নেওয়া, উজার করে ভালোবাসার আকুতি জানানো সবকিছুতে এখন তিক্ততা অনুভূত হয়। অভ্রর অধিকারবোধ, যত্ন, স্নেহ সবকিছুই নিছক স্বপ্ন মনে হচ্ছে, সেই সাথে তীব্র হাহাকার কাবু করে দিলো কঠিন সিদ্ধান্তকে। স্বপ্নের এতো সুন্দর হওয়া পাপ, মহাপাপ।

দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ। পিউ হয়তো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। বান্ধবীর হৃদয়ভাঙ্গন তাকে বিচলিত করছে। ঐন্দ্রিলা বুঝতে পারছে। তাই তো একটু পর পর খোঁজ নেওয়া। ঐন্দ্রিলাও বাঁধা দিচ্ছে না। শান্তিতে থাকুক সবাই। পৃথিবীর দুঃখগুলো নাহয় তারজন্য তোলা থাক। মুঠোভর্তি দুঃখ অন্তরে পুষে অন্তর কঠিন হোক। দরজা ঠেলে কেউ ঢুকলো। ঐন্দ্রিলা পিছু চাইলো না। সে পাহাড়ের চুড়ায় জমায়িত মেঘ দেখতে ব্যস্ত। পিউ চলে যাবে কয়েকপল বাদে। কিন্তু গেলো না। মানুষটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঐন্দ্রিলা না ফিরেই বললো,
“কিছু বলবি পিউ?”
“ঐন্দ্রি”

আকুতিময় চিরচেনা স্বরখানা শুনতেই টলমলিয়ে উঠলো অন্তর। পেছনে ফিরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। সামনের মানুষটিকে ভোলার জন্য এতোটা দূরে পাড়ি দেওয়া সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আকুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখজোড়ায় তীব্র তৃষ্ণা, আকুলতা, যন্ত্রণা। এমন মূর্ছানো লাগছে সুঠামদেহী ছেলেটাকে। কাছে আসতে নিলেই ঐন্দ্রিলা শীতল স্বরে বললো,
“তুই চলে যা অভ্র……”

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#অন্তিম_পর্ব (শেষাংশ)

“ঐন্দ্রি”

আকুতিময় চিরচেনা স্বরখানা শুনতেই টলমলিয়ে উঠলো অন্তর। পেছনে ফিরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। সামনের মানুষটিকে ভোলার জন্য এতোটা দূরে পাড়ি দেওয়া সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আকুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখজোড়ায় তীব্র তৃষ্ণা, আকুলতা, যন্ত্রণা। এমন মূর্ছানো লাগছে সুঠামদেহী ছেলেটাকে। কাছে আসতে নিলেই ঐন্দ্রিলা শীতল স্বরে বললো,
“তুই চলে যা অভ্র”

বলেই চোখজোড়া সরিয়ে নিলো ঐন্দ্রিলা। অভিমানিনীর কাছ থেকে যেনো এমন প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলো অভ্র; অভিমান, অভিসম্পাত। তবুও মান ভাঙ্গাবেই। ম্লান মুখখানা পরখ করলো নীরব চোখে। সাতটা দিন পর মেয়েটাকে দেখছে সে। ক্লান্ত, বিষন্ন ভঙ্গিতে বসে রয়েছে সে। সৌন্দর্য্য মলিন হয়ে গেছে, চোখে বিষাদের মেঘ মেদুর। বেদনার সুরটা চাবুকের মতো প্রহার করলো যখন ঐন্দ্রিলা ছোট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ম্লান স্বরে বিদ্রুপ টেনে বললো,
“আমি তোর মত অভিনয় করতে পারি না, আমার সময় লাগবে নিজেকে গুছিয়ে নিতে”

হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়লো শূন্যতা। ভেতরের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা তীব্র রুপ নিলো। মুখে ফুটে উঠলো তীব্র বেদনার ছাপ। অভ্র পরাস্ত, হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো হাটু গেড়ে বসে পড়লো তার পায়ের কাছে। ব্যাকুল স্বরে বলল,
“প্লিজ ঐন্দ্রি, এমন নিষ্ঠুর হইস না। তুই ছাড়া আমি আমাকে কল্পনা করতে পারি না”

বলেই তার হাতখানা ছুঁতে চাইলো। এবার ঐন্দ্রিলা তার দিকে তাকালো। ব্যাথাতুর দৃষ্টি। হাতখানা সরিয়ে নিলো। নির্লজ্জ, বেহায়া হৃদয়টা আবারোও দূর্বল হবার ছুতো খুঁজছে। মূর্ছানো প্রণয়ফুলটা বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। চোখগুলো টলমলে হয়ে উঠলো ঐন্দ্রিলার। মুখে ফ্যাকাশে হাসি এঁকে বললো,
“আমি নিষ্ঠুর? সত্যি কি তাই?”

অভ্র উত্তর দিতে পারলো না। ঐন্দ্রিলার চোখ ভিজে এলো। এতোটাদিন খুব কষ্টে নিজেকে সামলেছিলো। বুঝিয়েছিলো। সান্ত্বনা দিয়েছিলো। আজ সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। অভিমান বিষাদসিন্ধুর স্রোতের রুপ নিলো। বুকের মানে আগলে রাখা ঝড়, তান্ডবদের মুক্তি দিলো সে। অশ্রুমিশ্রিত স্বরে বলল,
“বলেছিলাম তোকে অভ্র, আমার দ্বারা দ্বিতীয়বার বিশ্বাস ভাঙ্গার যন্ত্রণা সহ্য করা সম্ভব না। আমি ঠকতে চাই না। অথচ আমি আবার ঠকে গেলাম অভ্র, আমি আবার বিশ্বাস করে ঠকে গেলাম। আবার ভালোবেসে ঠকে গেলাম। ঠকতেই যখন হবে তবে কেনো আমাকে স্বপ্ন দেখালি? কেনো মিথ্যে ভালোবাসার চোরবালিতে আটকালি? কেনো?”
“আমি মানছি আমি সেই সময় বিয়েটা টাকার জন্য করেছিলাম। দাদা যদি শর্ত না ছুড়তেন আমি কখনো বিয়ের জন্য উতলা হতাম না। মানছি সংসারজীবনে আমি টাকার লোভে পা দিয়েছি। অন্যায় করেছি। পাপ করেছি। আমি সব মেনে নিচ্ছি। কিন্তু তোর প্রতি আমার ভালোবাসায় খুঁত নেই, কখনো ছিলোও না। কারণ আমার জীবনে নারী, প্রেয়সী, স্ত্রী— সবকিছুই তুই। আমার ভালোবাসায় কোনো প্রতারণা নেই। আমি তোকে সত্যি তোকে ভালোবাসি”

অভ্রর মুখে “ভালোবাসি”—কথাটা শোনার জন্য তীব্র পিপাসু ঐন্দ্রিলা। অথচ আজ সেই কথাটায় ভরসা পাচ্ছে না। ভৎসনা করে বললো,
“তাহলে আমি কেনো দেখতে পাচ্ছি না? আমি কেনো শুধু লোভ আর স্বার্থপরতা দেখছি। কেনো আমার কাছে সব মিথ্যে লাগছে? কেনো?”

অভ্র নিঃস্ব মানুষের মতো তার পাজোড়া আঁকড়ে ধরলো। কোলে মাথা রেখে কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি বলবো না আমাকে বিশ্বাস কর, আমি বলবো না আমাকে ক্ষমা কর। তুই ঘৃণা কর আমাকে, মার, কাট—যা খুশি কর। শুধু আমাকে ছেড়ে যাস না ঐন্দ্রিলা। আমি বাঁচবো না। এতোদিন আমি ভাবতাম, তুই আমার পুতুল আর আমি তোর অধিপতি। ভুল, আমি ভুল ছিলাম। তুই আমার রানী, আমি তোর সামান্য দাস। তোর শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো শুধু আমাকে তোর জীবন থেকে মুছে ফেলিস না। আমি তোকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি”

পায়ে গরম তরলের অনুভূতি হলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র কাঁদছে। একটা মানুষ কি এতটা অভিনয় করতে পারে? কিসের জন্য টাকার জন্য?

****

নিচের কেবিনে পঙ্গপাল বসে আছে। দুই পরিবারের কোনো প্রাণ বাকি নেই। এতটা পথ এই বয়সে আউওয়াল সাহেবও পাড়ি দিয়েছে। কারণ নাতবউকে অনেক কিছু বলার আছে তার। ছোট মেয়েটার কাছে সারাজীবনের জন্য নয়তো অপরাধী হয়ে যাবেন। নিজেকে সর্বদা বুদ্ধিমান এবং বিবেকসম্পন্ন মানুষ ভেবে যে দম্ভ করতেন তা গুড়িয়ে যাবে। ধুলো থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে যাবেন নিজের কাছে। এদিকে সালাম সাহেব নীলাদ্রিকে অকথ্য ভাষায় গা’লা’গা’ল করছেন,
“আহাম্মক কোথাকার, এই মুল্লুকে কে থাকে? আসতে আসতে কতবার গাড়ি বদলাতে হয়েছে জানিস? গাধা কোথাকার”
“আমি তো আপনার জন্য বাড়ি বানাই নি বাবা”

নিরুদ্বেগ কন্ঠ নীলাদ্রির। ফলে সালাম সাহেব আরোও চেতে গেলেন,
“তা বানাবি কেনো? গাধার বাচ্চা”
“হ্যা, আমি আপনার ই বাচ্চা”

বলেই পিউয়ের কাছে গেলো সে। পিউ যে এমন মীরজাফরের মত কাজ করে আশা করে নি। মেয়েটা অভ্রকে জানিয়ে দিলো। ফলে রাগী স্বরে জানতে চাইলো,
“তুমি এই কাজটা কেনো করলে?”
“কোন কাজ?”
“এই যে অভ্র আর এই গুষ্টিকে খবর দিলে”
“এছাড়া কি করতাম? তোমার বোন তো ঘরে বেবাগী হয়ে পড়েছিলো”
“তাই বলে খবর দিয়ে দিবে। ও মানা করেছিলো। এই সুযোগে বদের হাড়িকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানো যেতো”
“ওরে বুদ্ধি। একেবারে বুদ্ধির ঢেকি! আচ্ছা, বোনটা যে আড়ালে এতো কষ্ট পাচ্ছিলো সেটা নজরে পড়লো না? অভ্রকে শায়েস্তা করাটা জরুরি নয়, ঐন্দ্রিলার কষ্ট কমানো জরুরি। তোমার বউ হবার আগে ওর বান্ধবী আমি। তাই বান্ধবী হিসেবে সেটাই করেছি যেটা ওর জন্য ভালো”

নীলাদ্রি আর তর্ক করার উপায় পেলো না। পিউ সালাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, শরবত করে দিই”
“দাও তো পিউ মা, শরীর ব্যাথা হয়ে গেছে এতো জার্নিতে। একটু রিফ্রেশ লাগবে। দাও দাও”

সাবেরা ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
“তুমি কি এখানে শীতের ছুটি কাটাতে এসেছো? মেয়ের রুমে তো অভ্র গেলো এখনো আসলো না”

*****

কতটা সময় কেটে গেছে জানা নেই। বৃষ্টি থেমে গেছে। সাদা পেজো মেঘ বেড়িয়ে এলো কৃষ্ণ মেঘের আড়াল থেকে। এক ভঙ্গিতে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। অভ্র এখনো তার পা ধরে রেখেছে। ক্লান্ত স্বরে বললো,
“তুই চেয়েছিলি আমার অশ্রুরা যেনো তোর হয়; অথচ দেখ আমার চিরকালের অশ্রুর কারণ হয়ে গেলি তুই”

ঐন্দ্রিলার শ্রান্ত বিলাপে চূর্ণ বিচূর্ণ হলো অভ্রর হৃদয়। মেয়েটির সম্পূর্ণ অধিকার আছে অভিসম্পাতের। কিন্তু এই প্রথম মেয়েটির অশ্রু তাকে আঘাত করছে। চিরটাকাল মেয়েটির অশ্রুর আধিপত্য চেয়েছিলো, কাঁদাতে চেয়েছিলো কারণে অকারণে। আজ সবকিছুই অভিশপ্ত লাগছে। ঐন্দ্রিলার অশ্রুর কারণ হওয়া কতটা যন্ত্রণার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যেনো। অভ্র জোর করে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। আকুতিময় স্বরে বললো,
“আমার গর্দান তোকে সপেছি, তুই যে শাস্তি দিবি মাথা পেতে নিবো। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাস না, প্লিজ”

উত্তর দিতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। মাথাটা দুলে উঠলো। চোখের সম্মুখে নেমে এলো নিগূঢ় অন্ধকার। ঢলে পড়লো অভ্রর বুকে। পেলব শরীরটা দ্বিতীয়বার নিথর হয়ে লুটিয়ে পড়লো তার কোলে। অভ্রর মনে হলো পৃথিবীটা মুহূর্তেই থমকে গেছে। আর্তনাদ করে উঠলো সাথে সাথে,
“ঐন্দ্রিলা”

****

নিচের কেবিনে থমথমে মুখে বসে রয়েছে অভ্র। তার মুখে কোনো কথা নেই। গুমোট হয়ে আছে পরিবেশ। সালাম সাহেব তো রেগেমেগে আগুন হয়ে গেছেন। অভ্রর উপরে তীব্র ক্ষোভ ঝাড়লেন,
“এই ছেলে তুমি কি করেছো? ও বেহুশ কেনো হবে? নিশ্চয়ই তুমি এমন কিছু করেছো যে ঐন্দ্রিলার মাথায় চাপ পড়েছে। কোন দুঃখে যে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছি আমি? একটা রাবিশ, আস্তো রাবিশ”

অভ্রর হাত কাঁপছে। ঐন্দ্রিলার সব রিপোর্ট নরমাল আসার পরও কেনো এমন বেহুশ হয়ে গেলো। না চাইতেই আবার মানসিকভাবে আঘাত করে বসলো কি সে? অভ্রর পর সালাম সাহেবের টার্গেট হলো নীলাদ্রি,
“এই গাধার বাচ্চা গাধা, তোর এসিসট্যান্টটা কই? এক গাধা আরেক গাধাকে এসিসট্যান্ট বানিয়েছে। ওকে আমি থাপড়ে সোজা করে দিবো। বললাম, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবো না বদ্যি ধরে এনেছে। আমার মেয়ের যদি কিছু হয় আমি তোকে, অভ্রকে আর তোর এসিস্ট্যান্ট গাধাকে দেখে নিবো”

পায়চারি করছে নীলাদ্রি। মেজাজ অত্যধিক খারাপ হচ্ছে। কটেজ থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটু দূরে। বদের হাড্ডি অজয়টা একটা মারমা বৈদ্য ধরে নিয়ে এসেছে। বৃদ্ধ, ছোটখাটো মহিলা, মুখে বৈধ্যক্যের ছাপে চোখ দেখা যাচ্ছে না। মহিলার বয়স নাকি ছিয়াশি বছর। তার চিকিৎসা জ্ঞান এতোটাই প্রসিদ্ধ গ্রামে যে সবার মুখে মুখে এক কথা “মাংখাই সব রোগ ঝাটাপেটা করে ভাগায়”। তাই অজয় ছুটে যেয়ে মাংখাইকে ধরে এনেছে। মহিলা পড়াশোনার “প” জানে না অথচ সে রোগ ঝাটাপেটা করবে। আহাম্মকের শিরমনি অজয়ের মাথা থেকেই এমন বুদ্ধি আসবে। সালাম সাহেব এদিকে চটে তান্ডব করছেন। নীলাদ্রিও মনে মনে গুনে গুনে দশটা গালি দিলো অজয়কে। এর মাঝেই পিউয়ের সাথে মাংখাই নেমে এলো নিচে। মহিলার মুখখানা থমথমে। সবার মাঝে আতংক। সাথে সাথে অভ্র আগে ছুটলো তার কাছে। উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালো,
“ঐন্দ্রি, কেমন আছে?”

মহিলা একটু সময় নিয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে মারমা ভাষায় কিছু বললো। তার মুখোভাব দেখে আতংকিত হলো সবাই। শুধু অজয়ের মুখেই আনন্দের বলিরেখা দেখা গেলো। উৎফুল্ল স্বরে ভাঙ্গা বাংলায় বললো,
“স্যার, আপনে মা হবে”

নীলাদ্রি চেতে উঠে বললো,
“এই গাধা, আমি মা কি করে হবো? আমি কি মহিলা নাকি? ছাগল কোথাকার! তোমাকে সাংগু নদীতে দিনে দশবার চুবাবো, যদি বুদ্ধি খুলে”

সালাম সাহেব ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
“যেমন গাধা, তেমন তার এসিসট্যান্ট”

অজয় মাথা নাড়িয়ে তাকে বুঝাতে চাইলো কিন্তু নীলাদ্রি সেই সুযোগ দিলো না। মনভরে তাকে ঝাড়লো দুজন। এর মাঝেই পিউ তাকে থামিয়ে বললো,
“তুমি মামা হতে চলেছো বুদ্ধির ঢেকি। ও বুঝাতে চাইছে ঐন্দ্রিলা মা হতে চলেছে”

“ঐন্দ্রিলা মা হতে চলেছে”—কথাটার মাঝে কি যেনো ছিলো। নিমিষেই নিচের কেবিনে খুশির লহর বয়ে গেলো। অভ্রর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর উত্তাল অনুভূতিগুলো বেসামাল হয়ে গেলো। এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে যেতে নিলো উপরে। কিন্তু বাধা দিলেন আউওয়াল সাহেব, গম্ভীর স্বরে বললেন,
“আমি নাতবউয়ের সাথে কথা বলবো”

*****

ঐন্দ্রিলা একাকী ঘরে বসে আছে। তার হাতখানা পেটের উপর। তার ভেতর একটি ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে, অনুভূতিটা এতোটা স্নিগ্ধ, মোলায়েম যে বোঝানো সম্ভব নয়। আনমনেই যত্নশীল হয়ে যাচ্ছে সে। চিন্তা হচ্ছে, এতোটা জার্নি করা কি ঠিক ছিলো? ভাবাচ্ছে তাকে। এই ছোট জান তার অংশ।
“আসবো”

প্রৌঢ় স্বরে শুনতেই উঠে বসলো সে। দাদাজান প্রবেশ করলেন ঘরে। চেয়ার টেনে বসলেন একটু দূরে। গম্ভীর স্বরে শুধালেন,
“কেমন আছো নাতবউ?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো”
“এই বুড়োকে তুমি ঘৃণা কর তাই না?”

হঠাৎ এমন বাচ্চামো প্রশ্নে অবাক হলো ঐন্দ্রিলা, উত্তর দিলো না। আউওয়াল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি তোমার অপরাধী। বিয়ের শর্তটা আমি ই অভ্রকে দিয়েছিলাম। বিয়ের দিন তুমি যখন পালিয়ে গেলে আমি ভয় পেলাম, ভয় পেলাম যে আদৌ তোমাদের সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যত আছে কি না। কিন্তু দেখো আজ আমি চোখের সামনে ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি। ভবিষ্যতের টলমলে ভবিষ্যত। এতো সুন্দর দিনে তোমাদের মধ্যে বিবাদ। এখন তোমার সাথে আমার বংশধরের কাছেও আমি অপরাধী। তাই তোমাকে কিছু বলা প্রয়োজন। জানো নাতবউ, আমার শর্তটা পুরো বৃথা হয়ে গেছে। অভ্রকে আমি টাকাটা সেধেছিলাম তোমার অসুস্থতার সময়। তখন অভ্রর টাকার প্রয়োজন ছিলো খুব। ও লোনের টাকাটা সব খরচ করে ফেলেছিলো। কিন্তু ছেলেটাকে টাকা নেয় নি। কি বলেছে জানো? বলেছে, “আমি টাকাটা নিলে আমাদের সম্পর্কটা দরকষাকষির সম্পর্ক হয়ে যাবে। আমার ভালোবাসা বিবর্ণ হয়ে যাবে”। আমার নাতী বলে বলছি না, ছেলেটা সত্যি তোমাকে ভালোবাসে। ও আমাকে বলেছিলো, ও তোমাকে টাকার জন্য বিয়ে করে নি। শুধু টাকার লোভে তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছে। কিন্তু বিয়ে যখন ই করতো তোমাকেই করতো। আমি বিশ্বাস করি নি। তবে এখন সেটা উপলব্ধি করি। ছেলেটি তোমাকে কত ভালোবাসলে নিজেকে ভাঙতে পারে আমি দেখেছি। আমি বলবো না ওকে ক্ষমা করে দাও। তবে একটা সুযোগ দাও। নিজের জন্য, যে আসছে তার জন্য”

খুব শান্ত, স্থিরভাবে কথাগুলো বললেন দাদাজান। ঐন্দ্রিলা কিছুই বললো না। শুধু শুনলো। দ্বিধান্বেষী হৃদয় সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। অভ্র যা করেছে, এতো জলদি সব ভুলে যাওয়া সম্ভব?

***
দাদাজানের সাথে কথা বলার পর পর ই প্রবেশ করল অভ্র। ঐন্দ্রিলা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। শুন্যদৃষ্টি বাহিরের দিকে। অভ্র বিছানার কাছে এসেই দাঁড়িয়ে গেলো। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে। ইচ্ছে হলো পৃথিবীর সব আনন্দের খোড়াক তার পদতলে বিছিয়ে দিতে। তার দাস হয়ে তার সব অভিমান, কষ্টের ভার বয়ে নিয়ে। কিন্তু সেই সুযোগ দিলো না ঐন্দ্রি। ম্লান স্বরে বললো,
“আমি বাড়ি যাবো”

কথাটা শুনতেই অভ্রর মনে হলো প্রাণে পানি ফিরলো। হাটু গেড়ে বসলো ঠিক তার সামনে। আকুতিভরা টলমলে স্বরে বললো,
“সত্যি?”
“হ্যা, তবে এটা যদি ভেবে থাকিস যে আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি তাহলে ভুল ভাবছিস। আমি শুধু আমাদের দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে চাই। কারণ যে আসছে তার তো দোষ নেই। তোর শাস্তি সে কেনো পাবে?”

অভ্র চুপ করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। একটা সান্ত্বনা। তার পুতুল তার কাছেই থাকবে। শুধু ভালোবাসাটা মলিন হয়ে গেছে। অভ্র মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে তার অভিমানিনীর মান ভাঙ্গাবে। ভাঙ্গাতেই হবে।

***

আজকের সকালটি অন্যরকম। সোনালী রোদের কিরণে কেমন খুশি খুশি মেজাজ। আজ ডাক্তারের কাছে যাবে অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা। আল্ট্রাসোনোগ্রাম করা হবে ঐন্দ্রিলার। বান্দরবান থেকে আসার পর টেস্ট করে কনফার্ম হয়েছে তারা। সাবেরার পরিচিত একটা ভালো ডাক্তারের সাথে আজ যাবে তারা। বান্দরবান থেকে আসার পর থেকে ঐন্দ্রিলা তীব্র শীতল হয়ে গিয়েছে। না পারতে কথা বলে না সে। রাতে ঘুমানোর সময় বুকে শোবার বাহানা করে না। কিন্তু অভ্র সব মেনে নিয়েছে। সে প্রচেষ্টা ছাড়ছে না। পারলে হৃদয় অর্পন করতো তার চরনে। বাইক বেঁচে দিয়েছে। একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনেছে সে। যেনো কোনো সমস্যা না হয় ঐন্দ্রিলার। গাড়ির দরজাটাও খুলতে দেয় না ঐন্দ্রিলাকে। ঐন্দ্রিলা তবুও নীরব।

তিনজনের পর ঐন্দ্রিলার সিরিয়াল এলো। ডাক্তার একজন বৃদ্ধ মহিলা। চশমার ফাঁক থেকে ঐন্দ্রিলাকে দেখে বললো,
“এই প্রথম আল্ট্রাসাউন্ড?”
“জ্বী”
“আচ্ছা শোও, আর তুমি বাহিরে যাও”

অভ্রকে বাহিরে যেতে বলায় সে কপাল কুঁচকে ফেললো,
“কেনো?”
“তুমি এখানে থাকবে নাকি?”
“হ্যা, আমার বাচ্চার হার্টবিট শুনবো আমি”
“কি অদ্ভুত, পুরুষরা তো থাকে না বাবা”
“আমি থাকবো। আমার বউয়ের আল্ট্রাসাউন্ড হচ্ছে, অন্য মহিলারটা দেখছি নাকি?”

এসিস্ট্যান্ট হেসে ফেললো। ডাক্তার বিপাকে পড়লো। ঐন্দ্রিলা বিরক্ত হয়ে বললো,
“থাক বাদ দেন তো। থাকুক”

ডাক্তার হাল ছেড়ে দিলো। তিনি তার কাজ শুরু করলেন। স্ক্রিনে ঐন্দ্রিলার পেটের ভেতরে ছোট কিছু দেখা যাচ্ছে। অভ্র ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলো। সে ঐন্দ্রিলার হাত আঁকড়ে ধরলো। তার হাত কাঁপছে। ধীরে ধীরে ডাক্তারের চোখ মুখ কুঁচকে এলো। চিন্তিত স্বরে বললো,
“আপনারা প্রস্তুত তো?”
“কিসের জন্য?”

ঐন্দ্রিলার অবাক প্রশ্নে মহিলা ডাক্তার কিঞ্চিত চিন্তিত মুখে বললেন,
“ট্রিপলেটের জন্য! আমি তো তিনটে আলাদা হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি। এক, দুই, তিন”
“তিনটে? আপনার ভুল হচ্ছে না তো”
“কি বলছো মেয়ে, আমি কি আজকের ডাক্তার। পঁচিশ বছর এই লাইনে”

ডাক্তারের কথাটা শুনতেই তড়াক করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো সে অভ্রর দিকে। অভ্রর চোখ মুখ উজ্জ্বল। আনন্দ যেনো ঠিকরে পড়ছে। ঐন্দ্রিলার চাহনীর মর্মার্থ বুঝতেই অসহায় স্বরে বললো,
“আমার দোষ নেই”

ডাক্তার বিরবির করে বললেন,
“স্ট্রেঞ্জ”

এবার সাউন্ড বাড়িয়ে দিলেন। ছোট, কিন্তু স্থির হার্টবিট শুনতে ফেলো অভ্র। তার চোখ ভিজে এলো। ঐন্দ্রিলার হাত ধরা হাতের বাধন আরোও শক্ত হলো। ডাক্তার বললো,
“বংশে, জমজ বা ট্রিপ্লেটের হিস্ট্রি আছে?”
“চৌদ্দ গুষ্টিতে নেই”
“এটা খুব ইউনিক কেস জানেন তো? আপনারা কি প্রস্তুত? কারণ ট্রিপলেট জন্ম দেওয়া, পালা খুব কঠিন”

ঐন্দ্রিলা এবার কিঞ্চিত ভয় পেলো। চিন্তার মেঘ নেমে এলো মুখে। কিন্তু অভ্র আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললো,
“আমি সামলে নিবো, ইনশাআল্লাহ”

*****

তিনটে বাচ্চার কথা শুনে পরিবারের সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বেশি উৎফুল্ল হলেন সালাম সাহেব। তার ধারণা তার পাল্লাভারী হচ্ছে। আউওয়াল সাহেব খুশিতে গদগদ। বারবার কেঁদে উঠছেন বৃদ্ধ মানুষটি। কানন এবং সাবেরার নজরদারি বেড়ে গেলো। এরা পারে না ঐন্দ্রিলাকে মাথায় তুলে রাখতে। রুম বদলে নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু অভ্র সবার উদ্দেশ্যে বললো আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললো,
“আমার বউয়ের খেয়াল আমি রাখতে পারবো। এতো উত্তেজনার প্রয়োজন নেই”

কথাটা ফলেও গেলো। প্রথম তিন মাসে ঐন্দ্রিলার খাবারের প্রতি তীব্র অনীহা এবং অরুচি দেখা গেলো। সে কিছুই খেতে পারে না। যা খায় উগড়ে দেয়। এমনও হয়েছে সে পানিও বমি করেছে। এই পুরো মুহূর্তগুলোতে অভ্র তার পাশে ছিলো। সে উদ্বিগ্ন হতো, ব্যাকুল হত। কিন্তু প্রকাশ করতো না। যা খেতে ভালোবাসে ঐন্দ্রিলা সেটাই তার সামনে এনে দেবার চেষ্টা করলো। একদিন রাত সাড়ে তিনটের সময় চটপটি খাবার বায়না করলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র সাথে সাথেই ফোন করলো বিল্লালকে। রাত সাড়ে তিনটায় এক দোকান খুলিয়ে চটপটির জিনিসপত্র কিনে আনলো। ইউটিউব দেখে দেখে সেটা বানানোর চেষ্টা করলো। সারা রাত কাটলো এভাবেই। অবশেষে সকাল দশটায় চটপটি পরিবেশন করা হলো। ঐন্দ্রিলা এক চামচও খেতে পারলো না। বমি করে ভাসিয়ে দিলো। কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই অভ্রর। ঐন্দ্রিলা অবাক হয় ছেলেটার ধৈর্য্য দেখে। এই ছেলেটি কি সে যে কলেজের সামনে মারপিট করে বলতো,
“পাছা দিয়ে ভালোবাসা বের করে দিবো”

হাসি পায় ঐন্দ্রিলার। অভিমানের দেওয়ালটা কমতে লাগলো ধীরে ধীরে। কিন্তু এতো বড় অন্যায়ের শাস্তি তো এতো কম হলে হয় না। তাই নিজেকে কঠিন বানিয়ে রাখলো সে।

*****

ধীরে ধীরে পেটখানা বড় হতে লাগলো ঐন্দ্রিলা। ভারী হয়ে যাচ্ছে পা। হাটতে কষ্ট হয়। যত দিন যাচ্ছে ভেতরে লালিত তিনটে প্রাণ বলিষ্ট রুপে নিজেকে জানান দিচ্ছে। এই তো সেদিন রাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো ঐন্দ্রিলার। পেটে তীব্র ব্যাথা অনুভূতি হলো। ছোট ছোট পায়ের জোর অনুভূতি হলো। সেই লাথিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো অভ্ররও। অভ্রর এই কদিনে একটা স্বভাব, ঘুমাবার সময় ঐন্দ্রিলার পেটে হাত রেখে ঘুমায়। পর পর তিনটে লাথিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে বসে নিষ্পলক তাকালো ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলার চোখমুখ চকচক করছে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি তার পেটের দিকে। অভ্র পেটের কাছটায় মুখ নিয়ে শুধালো,
“আম্মা, তুমি কি বাবার কন্ঠ শুনতে পাচ্ছো?”

সাথে সাথেই আরেকটা লাথি অনুভূত হলো। অভ্রর গলা ধরে গেলো। অজস্র চুমু খেলো পেটে। ধীর স্বরে বললো,
“বাবা তোমাদের অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছে আম্মু। তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু”

*****

ঋতু বদলের ছোঁয়ায় প্রকৃতি নতুন সাজে সাজতে ব্যস্ত। মানুষের জীবন তীব্র গতিতে চলমান। ঝরাপাতার গাছে এখন ফুল ধরেছে। শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম শেষে বর্ষা নেমে এসেছে ধরনীতে। ঘাসফড়িংয়ের দাপাদাপি ঘাসের উপর বিদ্যমান। দেখতে দেখতে সাইত্রিশ সপ্তাহ কেটে গেছে। ডিলেভারীর ডেটের আগেই ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বলেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যাচ্ছে, যেমন পানি শুকিয়ে আসছে, অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তাই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত দিয়েছে ডাক্তার। সকাল সকাল ভর্তি হল তারা। নীলাদ্রি-পিউ চলে এসেছে। নীলাদ্রির বিসিএসের রিটেন পরীক্ষা সামনের সপ্তাহে। তবুও সব ছেড়ে চলে এসেছে। পরিবারের প্রতিটি প্রাণ উপস্থিত। বিল্লাল এবং তৃষাও এসেছে। কিছুদিন আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। প্রথমে তৃষার বাবা আপত্তি জানালেও অবশেষে বিল্লালের সততা তাকে অভিভূত করতে পেরেছে। একটু পর অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করানো হবে ঐন্দ্রিলাকে। নরমাল ডিলেভারী করা সম্ভব নয়। সিজারিয়ান হবে। যখন নার্সরা এলেন তাকে নিয়ে যেতে ঐন্দ্রিলার হৃদয় নড়েচড়ে উঠলো। ভয় হলো ভীষন। অভ্রর দিকে চাইলো কাতর নয়নে। নয় মাসে ছেলেটাকে শাস্তি দেবার নামে নিজেদের মাঝে একটা দেওয়াল তুলে রেখেছিলো। এখন ভয় হচ্ছে যদি আর ফেরা না হয়? তাহলে কি তাদের গল্পটা অসম্পূর্ণই থাকবে? অভ্রর হাতখানা শক্ত করে ধরে ধীর স্বরে বললো,
“আমাদের হিসেবটা এখনো শেষ হয় নি কিন্তু, অপেক্ষা করিস। আর যদি না ফিরি”
“খবরদার এমন কথা বলবি না, আমি তোর অপেক্ষায় থাকবো”

অভ্রর দৃঢ় স্বর। ফ্যাকাশে হাসলো ঐন্দ্রিলা। অবশেষে তাকে নিয়ে গেলো নার্সরা।

***

অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে অপেক্ষা করছে সবাই। আড়াই ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। অভ্র থমথমে মুখে বসে আছে। দু ব্যাগ রক্ত লেগেছে। নীলাদ্রির মুখখানা ভীত। পিউয়ের হাত ধরে বললো,
“পিউ তুমি ভেতরে গেলে আমি তো বেহুশ হয়ে যাবো”
“ভালো হবে তো, আমরা দুজন ই বেডে শুয়ে থাকবো অজ্ঞান হয়ে”
“মজা করো না”
“আচ্ছা, হাদারাম করবো না। তুমি একটু সাবধান হইয়ো। বলা যায় না, আমারও তিনজন হলে! তোমার যে স্ট্যামিনা”
“তুমি দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছো”

হেসে উঠলো পিউ। অবাক হবার ভান করে বললো,
“বেশি নষ্ট না কম নষ্ট?”

এর মাঝেই নার্সরা বেরিয়ে এলো। তিনটে নবজাতক হাতে। একটি মেয়ে এবং দুটো ছেলে। মেয়েটির আদল একেবারে ঐন্দ্রিলার অনুরুপ। ছেলেরা অভ্রর প্রতিচ্ছবি। ছোট ছোট তিনটে শরীর। অপারেশন শেষ হয়েছে। অভ্র প্রথমেই শুধালো,
“আমার স্ত্রী?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, নিন বাবুদের কোলে নিন”

অভ্র মেয়েকে কোলে নিলো। তুলতুলে শরীরটা কোলে নিয়ে পৃথিবীর সর্বসুখী মানুষের তালিকায় উত্তীর্ণ হলো যেনো সে। সালাম সাহেব নাতীকে কোলে নিয়ে বলল,
“অবশেষে নানা হয়েই গেলাম ইদ্রিশ ভাই? আসলের থেকে সুদের মায়া তো অনেক”
“ঠিক সালাম ভাই”

আউওয়াল সাহেবের জীবনচক্র আজ পূর্ণ। একটুপর আজান দেওয়া হলো বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে। বাচ্চাদের নাম রাখা হলো জিহান, দিহান এবং অথৈ। অভ্র অনুমতি চাইলো ঐন্দ্রিলাকে দেখার। অনুমতি পেতেই ছুটে গেলো সে।

ক্লান্ত, ব্যাথাতুর মুখখানায় চুমু খেলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা চোখ মেলে চাইলো। চাহনী খুব ক্লান্ত, অমলিন স্বরে বললো,
“বাবুরা কেমন হয়েছে?”
“সুন্দর”
“আমি কিন্তু ফিরেছি”
“ধন্যবাদ”
“শুধু ধন্যবাদ?”
“তোর জন্য আমার প্রাণ হাজির। শুধু বল একবার”
“হৃদয় নিঙরানো প্রেম নিবেদন”
“যথাআজ্ঞা মহারানী”

*****

চারদিন পর বাসায় আনা হলো ঐন্দ্রিলাকে। তিনটে বাচ্চা সামলানো কি মুখের কথা। কিন্তু শ্বাশুড়ি এবং মা থাকায় একটু সহজ হচ্ছে। এদিকে অভ্র তো আছে। মেয়েভক্ত বাবা। ছেলেদের দিকে খেয়াল না থাকলেও মেয়েকে চোখে হারায় সে। তার সবকিছু নিজ হাতে করে। মেয়েটার স্বভাবে একেবারে ঐন্দ্রিলার মত। নাক উঁচু, জেদি। বাবা কোলে না নিলে সে ঘুমাবে না। আর ছেলেগুলো একেবারে শান্ত। শুধু খিদে লাগলে একসাথে চিৎকার করে। সালাম সাহেব সারাক্ষণ নাতীদের মুখে তাকিয়ে থাকেন। তা দেখে অভ্র শ্বশুরের উদ্দেশ্যে বললো,
“কি শ্বশুর আব্বা, আমার প্রোডাক্ট কেমন দেখছেন? টপ নচ না?”

অভ্রর কথা শুনে সালাম সাহেব মুখ বাকিয়ে বললেন,
“ছাগলের ঘরে ছাগল বলে কি! এ যেন তার কৃতিত্ব! আমার নাতি-নাতনী তো আমার মতো সুন্দর হবে এটাই সাইন্স”
“গুষ্টির দূর দূর থেকে এমন ইউনিক প্রোডাকশন দেখেছেন কখনো? একসাথে ৩টে? এটা আমার ভালোবাসা বুঝলেন। আমি যে আপনার মেয়েকে কতটা ভালোবাসি এই তার প্রমাণ, বুঝলেন শ্বশুর আব্বা”

নির্লজ্জ ছেলেটার কথা শুনে ঐন্দ্রিলা পারে না মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়ে। বাবা হয়েছে অথচ মুখে লাগাম নেই।

*****

বিকালের রোদ নরম হয়ে এসেছে। অবশেষে বাচ্চারা ঘুমে। অভ্র তিনজনকে শুইয়ে দিয়েছে। বারান্দায় এসেছে ঐন্দ্রিলা। ক্লান্তি মুখমন্ডলে লেপ্টে আছে। অভ্র ধীর পায়ে এসে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ঐন্দ্রিলা তার উষ্ণ স্পর্শে নিজেকে এলিয়ে দিলো। হেসে শুধালো,
“কেমন লাগছে জনাব?”
“খুব শান্তি। আমি তোকে বোঝাতে পারবো না বাবু। থ্যাংকিউ সো মাচ এতো চমৎকার গিফটের জন্য”
“আর আমার গিফট?”

অভ্র হাসলো। তাকে ছেড়ে হাটু গেড়ে হাত বাড়িয়ে গাঢ় স্বরে বললো,
“আমার মনশহরের প্রতিটি ইটে তোর নাম খোদাই করা। বাতাসে শুধু তোর গন্ধ। অলিতে গলিতে তোর হাসির গুঞ্জন। অম্বরজুড়ে ভাসমান মেঘেরা ধরণীতে গলে পড়ে তোর প্রতীক্ষার বিরহে। প্রতিটি প্রহর তুইতে সাজতে চায়। পথহারা পথিকের মতো বসে আছে শুধু তোর অপেক্ষায়। এই ছেড়া নোটের উদাসীন মনশহরে নিমন্ত্রণ জানালাম। আসবি কি?”

হেসে উঠলো ঐন্দ্রিলা। এই ছেলেটার উপর কি আর অভিমান করে থাকা যায়! যে হৃদয় নিঙড়ে নিমন্ত্রণ জানায় সেই মনশহরের নিমন্ত্রণ কি ফেরানো সম্ভব! ঐন্দ্রিলা পারলো না। অবশেষে ছেড়া নোটের মনশহরে নিমন্ত্রণ অকলুষিতভাবেই গ্রহণ করলো আমড়া কাঠের ঢেকি। চলতে থাকতো তাদের টক, ঝাল, মিষ্টি গল্পটি………………….

||সমাপ্ত||