মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-১৫+১৬

0
38

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১৫.

“এসব লাস্ট এই ছয় মাসের কেস”‚ অনিহার সঙ্গে ঠোঁট বাঁকাল শারফান‚ “রুচি নেই আর একটার ওপরও।” বিদ্রুপ হেসে তাকাল তারপর সানার দিকে‚ “এখন বলো‚ এরা যদি আমার অরুচির হয় তাহলে তুমি কি আমার রুচির হতে পারো‚ যে তোমাকে চেখে দেখার জন্য তোমার পিছু পড়ে থাকব?”

শেষ কথাটাই একেবারে নিয়ন্ত্রণ হারাল সানা মেজাজের। হাতটা চলেই গেল শারফানের গাল লক্ষ করে। কিন্তু নিমিষেই ওর কব্জি ধরে ফেলল শারফান। মাত্র কদিনেই মেয়েটার কাজকর্ম‚ কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গি সম্পর্কে তার গভীর ধারণা হয়ে গেছে যেন কী করে! তাই এই মুহূর্তে এমন সাহস যে দেখাবে এরও অগ্রিম ধারণা ছিলই তার। তবে আশ্চর্যভাবে রাগতে পারল না সে। অধিকন্তু রাগ‚ লজ্জা আর কান্নাকাটিতে রক্তিম হওয়া সানার ভরাট গাল‚ নাকের ডগা‚ চোখের স্ক্লেরা‚ সব শেষে শক্ত করে রাখা গোলাপী ঠোঁটদুটোই এসে নামল তার গাঢ় দৃষ্টি জোড়া৷ তা দেখতে দেখতে নিম্ন ঠোঁট কামড়ে হঠাৎ দুষ্টু দুষ্টু মুচকি হাসল। “সাবধান”‚ নজরটা সানার ঠোঁটে রেখেই বলল‚ “আমাকে উষ্কে দিচ্ছ কিন্তু। সেকেন্ড টাইম এই স্পর্ধা দেখালে মার্কা বসিয়ে দেবো জায়গা পছন্দ করে।”

তবে হাতটা ছাড়ল না সানার৷ মাথা ফেটে যেতে চাওয়া রাগ নিয়ে তাই মোচড়ামুচড়ি শুরু করল সানা হাত ছোটানোর জন্য৷ তা দেখে ও বলল শারফান‚ “ক্লাইম্যাক্স বাকি এখনো। স্থির হয়ে বসো৷”

কিন্তু সানা থামল না৷ বিরক্ত দেখিয়ে শারফান তখন আচমকা ওর হাত ধরে টেনে আনল নিজের কাছে। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল‚ “যে জন্য ভয় পাচ্ছ সেসব আমি তোমার সাথে এমন পরিবেশে করব না‚ ছুঁড়ি৷ অন্তত গাড়ির ভেতরে তো না৷ আমার রুচি আর পছন্দ অনেক হাই৷ তেমনই আমি খুব চুজি৷ সেটা ব্যক্তি হোক আর স্থান। চুপচাপ ঠান্ডা হয়ে বসো এবার।” বলে হোয়াটসঅ্যাপের অন্য এক কনভারসেশনে ঢুকল সে।

সানা চেঁচাল তারপরই‚ “আমার হাত ছাড়ছেন না কেন?”

“ধরে রাখতে ভালো লাগছে”‚ সরল স্বীকারোক্তি শারফানের। তবে মনোযোগ ফোনের স্ক্রিনেই৷ সানা তার এমন নির্বিকার ভাব দেখে চিৎকার করতে যাবে ঠিক সে সময়ই নিভল ওর চোখের আগুন৷ একটা ভিডিয়ো চালু করেছে শারফান৷

মিস বাংলাদেশ রুশা রিয়ানা আবারও৷ কিছুক্ষণ আগে তার সম্পূর্ণ নগ্ন ছবি দেখলেও এখন ভিডিয়োতে সে অর্ধ নগ্ন৷ কিন্তু ব্যাপারটা সেটা নয়৷ তার সঙ্গে থাকা পুরুষটি ফারনাজ‚ তা মোটেই বিশ্বাস হলো না সানার। কারণ‚ ভিডিয়ো যে এডিটিং করা যায় এ জ্ঞান আছে ওর। রাগের চোটে তাই এবার শারফানকে গালি-গালাজ করার জন্য ঠোঁটদুটো ফাঁক করল আর অমনি ভিডিয়োতে নতুন আরও দুটো মুখ এসে হাজির হলো৷ থেমে গেল সানা পুনরায়। দলের বয়স্ক দুই বড়ো নেতা তারা। টিভিতে খবরে এদেরকে দেখা যায়৷ রুশা রুয়ানা এতক্ষণ কেবল ফারনাজের সামনেই নাচছিল আর মদের গ্লাস ভরে দিচ্ছিল তাকে৷ বয়স্ক নেতা দুজন আসা মাত্রই তারা নাচতে আরম্ভ করল মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে৷ আর ফারনাজ বসে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সেসব দেখল আর কেমন করে যেন হাসল৷ হাসিটা ঠেকল শয়তানি হাসি।

নির্বাক চোখে সানার দেখার মধ্যেই ফোনটা বন্ধ করে দিলো শারফান৷ ওর বিমূর্তভাব কেটে গেল তখন। “এসব কি সত্যি?” প্রশ্নটা শারফানকে খুব করতে ইচ্ছা করল। কিন্তু কথায় বের হতে চাইলো না গলা থেকে।

“আমার ইউজড জিনিসে আগ্রহ নেই কোনোকালেই।” কটাক্ষের সঙ্গে বলল শারফান‚ “তোমার ভাইয়ের সাথে রুশার চলাফেরা আমারও আগে থেকেই। ওরা দুজন শুয়েছে কি শোয়নি সেটা আমার শিউর হওয়ার প্রয়োজনও মনে হয়নি কখনো। স্রেফ আজ মনে হলো ফারনাজকে আমার থেকে বেশি তোমার জানা জরুরি। তাকে যদি আরও জানতে চাও তাহলে কিছু ইনফরমেশন তোমাকে সেন্ড করব।

“দরকার নেই”‚ অবিলম্বেই জবাব দিলো সানা। কিছু পল নিশ্চুপ রইল তারপর৷ নীরবতা শেষে বলল‚ “সে আমার কেউ নয়৷ সম্পর্ক সূত্রে ভাই ডাকতে হয়‚ মানতে হয় কেবল৷ এর বাইরে সে আমার কিচ্ছু না। এবার আমাকে যেতে দিন প্লিজ।” কণ্ঠ ভীষণ ঠান্ডা শোনাল ওর। চোখের তারাতেও নেই একটু আগের ক্রুদ্ধভাব‚ অস্থিরতা।

“এ ব্যাপারে কথা বলতেই তোমাকে আটকেছিলাম।” দরজার লক খুলে দিয়ে বলল শারফান‚ “কথা শেষ। যেতে না দেওয়ার তো কোনো প্রশ্ন আসে না।”

“বুঝতে পেরেছি।” বেরিয়ে এলো সানা। তারপরই শারফানকে বিস্মিত করে বলল সে‚ “থ্যাঙ্কস এজন্য।” বলে আর দাঁড়াল না। ওর যাত্রা পথে বিস্ময়টুকু নিয়ে নিষ্পকল তাকিয়ে রইল শারফান—বেশ কিছুক্ষণ।

***

খুব ছোটো বেলার স্মৃতি। তখনের শীতে মোস্তফা সাহেব দুই লিটারের চার-পাঁচটা বোতল ভর্তি খেজুরের রস কিনে নিয়ে আসতেন যেন কোথা থেকে৷ মক্তব থেকে ফিরেই কাঁচা খেজুরের রস পুরো এক বোতল সাবাড় করে ফেলত সানা আর মেহা। ফারনাজ থাকলে সঙ্গে যোগ দিতো সেও। শুক্রবার এলে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সানা ছুটত নার্সারিতে। যেসব ফুল অনেক বড়ো আর সুন্দর দেখাত‚ সেসবের এক পাঁজা চারা নিয়ে বাড়ি ফিরত সে। দইয়ের হাঁড়ি‚ প্লাস্টিকের ভাঙা বালতি আর গামলায় সেসব লাগিয়ে দিতেন মোস্তফা সাহেব। বাবার থেকেই চারা রোপণের সঠিক সময় আর নিয়মকানুন জেনেছে ওরা। আর তখন সেসবের যত্ন নিয়েছে মা। ফারনাজ এসে যখন দেখত এসব ফুল গাছ৷ তারপর থেকে আসলেই হাতে করে আনত টব সমেত গাছ৷ যাতে ভাঙা বালতি আর গামলার প্রয়োজন না হয়।

মিঠে রোদ্দুরে বসে ফারনাজের আনা শেষ গাছটির দিকে চেয়ে আছে মেহা ভেজা চোখে৷ দু হাঁটু উঁচু করে তাতে চিবুকে ঠেকানো। গত তিনদিন ধরে সানার সঙ্গে তার তর্ক বিতর্ক চলছিল ফারনাজকে কেন্দ্র করেই। সেদিন শারফানের কাছ থেকে ফেরার পর সানা সবটা খুলে বলে সাফ সাফ মানা করেছিল তাকে‚ আর কখনোই যেন ফারনাজকে নিয়ে সে না ভাবে৷ কিন্তু মেহা বিশ্বাস করতে পারেনি ওসব৷ শারফানকে গালি-গালাজ করে সে বোনকে বোঝাতে চেষ্টা করে‚ ফারনাজ যেমনই হোক অন্তত চরিত্র তার খারাপ হতেই পারে না। সানা তারপরও বহু চেষ্টা করে মেহাকে বিশ্বাস করানোর। এ নিয়েই গত তিনদিন দুজনের মাঝে চলছে মন কষাকষি। কিন্তু আজ সকালে সানা ধৈর্য আর মেজাজের বাঁধ হারায় মেহার তর্ক দেখে। চটাস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় বোনের গালে৷ তারপর থেকেই মেহা নীরবে কেঁদে চলেছে।

কলেজের সময় হয়ে গিয়েছে বলে নাজমা বেগম ডাকাডাকি করছেন তাকে৷ মায়ের ডাক শুনে ফিরে এলো সে ঘরে। সানাও বের হবে কলেজের উদ্দেশে৷ এ মাসে আজকের মতো শেষ ক্লাস করবে সে। গোসল করে এসে মেহা খাবার প্লেট নিয়ে বসেছে বিছানাতে। বোনকে নিজের হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে চুল বাঁধতে দেখেই হাঁক ছেড়ে উঠল‚ “খবরদার! আমার হেয়ার ব্যান্ড নিবি না তুই।”

“থাপ্পড় আরেক গালে না খেতে চাইলে চুপচাপ ভাত খা”‚ সানা বলল ঢিলে সুরে।

“লজ্জা করছে না আমার জিনিস নিতে?”

“আর কলেজ শেষ হলে সরাসরি রিকশায় উঠবি”‚ মেহার কথাকে পাত্তা না দিয়ে আদেশ গলায় বলল সানা‚ “হেঁটে আসার দরকার নাই।”

জবাবে মুখ ভেংচাল মেহা। মনে মনে জেদ করল‚ রিকশা করে তো আজ আসবেই না। বরঞ্চ আরও দেরি করে ফিরবে সে বাড়ি।

***
বেলা ১:২০ মিনিট

অন্যান্য দিনের মতো আজ আর নিম্নচাপ নেই। সকাল থেকেই ঝকঝকে রোদ‚ পরিষ্কার আকাশ। আবহাওয়া দারুণ সুন্দর লাগছিল সানার। কিন্তু রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি দেখে মন‚ মেজাজই নষ্ট হয়ে গেছে৷ রিয়ার সঙ্গে অম্বিকার পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছিল সে৷ তার মাঝেই দেখা পেলো লম্বা এক বিক্ষোভ মিছিলের। কোন পক্ষের মিছিল তা খেয়াল করেনি। আশেপাশের মানুষের থেকে কিছুটা আভাস পেলো‚ এক প্রতিপক্ষের লোকজন আরেক প্রতিপক্ষের লোকের গায়ে হাত তুলেছে‚ মারধোর করেছে৷ সেজন্যই এই বিক্ষোভ মিছিল। কিন্তু কেবল এই মিছিলেই নাকি সীমাবদ্ধ থাকবে না৷ বড়োসড়ো এক হাঙ্গামাও হবে আজ৷ সানার কেন যেন মনে হচ্ছে এই দুই প্রতিপক্ষের একজন হয় ফারনাজ নয়তো শারফানের চাচা।

“আগে জানলে তো বাসা থেকেই বের হতাম না”‚ রিয়া বলল।

“অনি ভাইয়া কিছু জানত না?”

“জানার তো কথা৷ কিন্তু কোনো বারণ টারণ তো করল না বের হওয়ার সময়।”

“তাহলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না হয়তো৷ তাই নিষেধ করেনি বের হতে। চল এগোই।”

ফুচকার বিল মিটিয়ে ওরা গল্প করতে করতে চলে এলো মূল সড়কে। আরেকটু এগিয়েই দুজন চমকে উঠল কয়েকজন লোকের দৌড়াদৌড়ি দেখে৷

“কীরে!” রিয়ার বিস্ময়োক্তি‚ “মারামারি লেগে গেছে নাকি সত্যি সত্যিই?”

সানা তাড়া দিলো‚ “দ্রুত রিকশায় উঠে পড়ি‚ চল।”

“আরে দাঁড়া‚ এত ভয় পাস ক্যান? আরেকটু এগিয়ে দেখি। সত্যিই মারামারি লাগলে রিকশায় উঠব।”

“কোনো দরকার নাই। চল তো!”

“ধুরঃ! কিচ্ছুই হয়নি। মিছিলে শামিল হওয়ার জন্য ব্যাটারা দৌড়েছে ওভাবে। গিয়ে দেখিস সামনে”‚ বলে সানার হাত টেনে ধরে নিয়ে চলল রিয়া।

এগিয়ে আসার পর বান্ধবীর কথা সত্যই মনে হলো সানার৷ মিছিলে লোক বেড়েছে প্রচুর। সামনে কী চলছে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু পেছনের পরিবেশ শান্ত। সেখানেই দাঁড়াল ওরা।

“কাদের মিছিল এটা?” জিজ্ঞেস করল সানা।

“ফারনাজ ভাই’র”‚ জবাব দিলো এক ছেলে।

“কীরে‚ তোর তো এখন মিছিলের আগে থাকা উচিত”‚ ঠাট্টা করে হাসল রিয়া।

গালি দিয়ে বসল সানা‚ “বাল থাকব। রিকশা ডাক এখন।”

খালি রিকশার খোঁজার জন্য রিয়া আশেপাশে তাকাতেই হঠাৎ দেখতে পেলো ভিড়ের মধ্যে মেহাকে৷ মিছিলের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সে দুজন বান্ধবীর সঙ্গে।

“ওই”‚ সানাকে কনুইয়ের গুঁতো দিলো রিয়া‚ “সামনে তাকা৷ তোর বোন ওই দ্যাখ। কই যাচ্ছে?”

“কী!” চমকে তাকাল সানা রিয়ার ইশারাকে অনুসরণ করে৷ ছুটির পর সোজা বাড়িতে আসার বদলে বান্ধবীদের নিয়ে এদিক-ওদিক চক্কর কেটে বেড়াচ্ছে দেখে পায়ের স্লিপার খুলে বোনের গালে বসাতে মন চাইলো ওর। “তুই রিকশা ডাক। আমি নিয়ে আসি ওকে।”

“রাস্তার মধ্যে আবার মারিস টারিস না।”

রিয়ার নিষেধ-বারণ কানেই তুলল না সানা। “ভাইয়া‚ একটু সাইড দিন প্লিজ… আঙ্কেল‚ একটু যেতে দিন” করতে করতে এক গাদা ব্যাটা ছেলের গা ঘেঁষে ভেতরে ঢুকতে হলো ওকে৷ রাগের মাত্রা তাতে আরও বেড়ে গেল। মেহার দ্বিতীয় গালে তাই আরেকটা চড় পড়লে পড়তেও পারে। সে বেশ সামনে থাকায় গলা ছেড়ে ডেকে উঠল সানা‚ “এই মেহ! মেহা দাঁড়া।”

দুই ডাকেই চারপাশের প্রায় সব পুরুষের দৃষ্টি টেনে নিলো সে৷ কী একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ল বেচারি! অথচ যার জন্য এত পেরেশানি সে কানে শুনতেই পায়নি।

“মেহা…” গলা আরও উঁচু করল সানা৷

সে সময়ই হঠাৎ সামনের দিকে শোনা গেল চিৎকার-চেঁচামেচি আর অশ্রাব্য গালাগালি। ঝামেলা লেগে গেছে৷ পাশ থেকে কয়েকজনের কথা শুনে সানা জানল‚ দুই প্রতিপক্ষের প্রথম সারির নেতারা একত্র হয়েছে এখানে ঝামেলার সুরাহা করার জন্য। কিন্তু কথায় কথায় তাদের মধ্যেই লেগে গেছে আবার। একজন‚ দুইজনের মাঝে হাতাহাতি থেকে সবার মধ্যে শুরু হয়ে গেছে মারামারি। ভয়েই বুক কেঁপে উঠল সানার৷

কিছুক্ষণের মাঝে মারামারি‚ হাতাহাতি শুধু সামনেই সীমাবদ্ধ রইল না৷ পেছনের লোকেরাও ছোটাছুটি করে এগিয়ে যেতে শুরু করল সামনে৷ এর মাঝে পড়ে নিজের অবস্থা কী হবে সে চিন্তা মাথাতেই আনতে পারল না সানা। শুধু ভাবল মেহার কথা। কান্না করে বসল বোনের চিন্তাতে। “মেহা… এই মেহা”‚ কাঁদতে কাঁদতে ডাকাডাকি করতে থাকল সামনে চেয়ে৷ কিন্তু মেহাকে আর দেখা গেল না৷ কী করবে এখন‚ কোনদিকে এগোবে‚ এসব ভেবে যখন দিশাহারা হয়ে পড়ল সে। তখনই দুপাশ থেকে ধাক্কাধাক্কি আরম্ভ হলো৷ ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে মাথা নুয়িয়ে সে বের হওয়ার পথ খুঁজল। সেই সাথে বিড়বিড় করে একবার মেহার নাম নিতে থাকল‚ আরেকবার আল্লাহর। আকস্মিক জামার পেছনের গলাতে টান পড়ল ওর৷ একই সাথে ওড়নাতেও। পেছন ফিরতেই ছেড়ে দিয়ে সরে পড়ল এক ছেলে। কী হতে যাচ্ছে নিজের সাথে তা বুঝতে পেরেই কান্নার বেগ বেড়ে গেল ওর ৷ চারপাশের পুরুষগুলোকে অনুরোধ গলায় বলল‚ “আমাকে প্লিজ বের হতে দিন না!”

কিন্তু যাদের উদ্দেশে বলল তারা কোনো কথা শোনার জ্ঞানেই যেন নেই। আরও যে আপত্তিকর কিছু ঘটতে চলেছে ওর সঙ্গে তা তো টেরই পেলো না৷ ঠেলা‚ গুঁতো খেতে খেতে অসহায় চোখে চারপাশে বোনকে খুঁজে চলল আর এখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা চালাল৷ এর মাঝেই এক মধ্য বয়সী লোক হাত বাড়াল। ওর নিতম্বের দিকে৷ ছুঁয়ে ফেলার ঠিক আগ মুহূর্তেই কোথা থেকে এসে তার কব্জি চেপে ধরল শারফান৷ মস্ত এক ঘুষি মারার ইচ্ছাটা গিলে ফেলে শুধু গরম চোখে চেয়ে বলল‚ “বিচি গেলে দেবো‚ মাদার**! যা সর।” শেষে দিলো বিশাল ধমকটা।

শারফানের চেহারা দেখে আর কণ্ঠ শুনেই কাঁচুমাঁচু মুখ করে লোকটা সটকে পড়ল দ্রুত। পরিস্থিতি হয়ে গেছে ভয়াবহ। পুলিশ এসে পড়েছে৷ সবাইকে এলোপাথাড়ি মারতে আরম্ভ করেছে সামনের দিকে৷ যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে এখন। এর মাঝে শারফান লোকটার গায়ে হাত তুললে শুরু হয়ে যেত মারামারি এখানেও। সানাকে নিয়ে আর সহজে বের হওয়া হবে না তখন।

ধমকটা সানার কানেও এসেছে। শারফানের কণ্ঠ চিনতে ভুল হয়নি ওর৷ কিন্তু পিছু ফিরে দেখার পূর্বেই এক ছেলে ওকে আড়াল করে সামনে দাঁড়াল আর পেছন থেকে এক জোড়া হাত আঁকড়ে ধরল ওর বাহু। পিঠের সঙ্গে তার বুক ঠেকেছে তা স্পষ্ট অনুভব করল সে। ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই শারফানের গলা শুনল পেছন থেকে‚ “লাগল কেমন ডলাডলি‚ চটকা-চটকি?”

এক ঝটকায় ঘাড় ফেরাল সানা। কালো মাস্ক আর কালো সানগ্লাস পরা থাকলেও শারফানকে সে চিনে নিলো ঠিকই৷ ওকে তাকাতে দেখে একটু সময়ের জন্য মাস্ক টেনে নামাল শারফান। যাতে চিনতে পারে তাকে।

এতটা মিশে আছে দুজন দুজনের সাথে‚ যে শারফানের নিঃশ্বাসের স্পর্শ পেলো সানা কপালের ওপর। দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে ওর চোখে চাইলো শারফান৷ কাঁদছিল দেখে বিদ্রুপ করে বলল‚ “আমার সামনে বসে ভাব নাও যেন ফারনাজ একটা তিতা‚ বিষ‚ যক্ষ্মা। কিন্তু রাস্তায় তাকালেই দেখি কাহিনি পুরোটাই মাখন মাখন রসালো৷ ঘটনা সত্য কোনটা তাহলে‚ হুঁ? একেবারে রাজপথে নেমে পড়ে ভাইয়ের জন্য কান্দোন শুরু করেছ! বাবারে পিরিত!”

“উলটা-পালটা কথা বলা বন্ধ কর‚ বেয়াদব”‚ সানার সামনের ছেলেটা ধমকে বলল শারফানকে‚ “জলদি সরে পড়তে হবে আমাদের এখান থেকে।”

এবার তার দিকে ফিরল সানা। চিনতে পারল না ছেলেটাকে৷ কারণ‚ সেও মাস্ক আর সানগ্লাস পরে। চেহারা না দেখা গেলেও বোঝা গেল ছেলেটা রোগা-সোগা একটু৷ কিন্তু লম্বা শারফানের মতোই। আর গায়ের রং ফরসা কিছুটা শারফানের থেকে৷ প্রশ্ন চোখে আবার ঘাড় ঘুরে তাকাল সে পেছনে৷ জিজ্ঞেস করল শারফানকে‚ “আপনাদের সাথে ঝামেলা হচ্ছে ফারনাজ ভাইদের?”

“নাহ”‚ শয়তানি হাসি হাসল শারফান। আকস্মিক সানার কানের সাথে ঠোঁট মিশিয়ে বলল‚ “কিন্তু হওয়াচ্ছি আমরাই।”

বিস্ময়ে মূক দেখাল সানাকে।

“আমাদের সাথে সাথে এগোবে‚ ঠিক আছে?” ওকে আদেশ দেওয়ার মতো করে বলে শারফান ডাকল সামনের ছেলেটাকে‚ “এই রিহান‚ বি কেয়ারফুল… ও.কে?”

“ডোন্ট ওরি”‚ বলে রিহান সানাকে নির্দেশ দিলো‚ “আমাদের মাঝে থেকেই আপনি হাঁটার চেষ্টা করবেন।”

“আমার বোন ছিল এর মাঝে।” মেহার কথা মনে পড়তেই ঠোঁট ভেঙে এলো সানার৷ কান্না আটকানো গলায় বলল‚ “ওকে দেখেই ঢুকেছিলাম মিছিলের ভেতর।”

চিন্তিত মুখে রিহান ফিরে তাকাল শারফানের দিকে। এই ছোটাছুটি‚ দৌড়াদৌড়ির মাঝে কয়েকজন পুরুষ‚ মহিলাকে নিচে পড়ে যেতে দেখা গেছে। নিচে পড়া মানেই তোরপদদলিত হওয়া। আর মারধোরের বিষয় তো রয়েছেই।

শারফান ভাবতে থাকল‚ সাদ্দামদের কাউকে কল করে বলবে কিনা মেহাকে খোঁজার কথা৷ কিন্তু পুলিশের নজরে বা ফারনাজের ছেলেপুলের কারও নজরে পড়লেই ঝামেলা হয়ে যাবে। রিহানও একই বিষয় ভাবল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল সানাকে‚ “দেখতে কেমন? ছবি থাকলে দেখান তো।”

“তুই যেতে চাচ্ছিস?” জিজ্ঞেস করল শারফান।

“কী করা উচিত?” পালটা প্রশ্ন করে জবাব রিহানই দিলো‚ “আমি মুখ চেনা নই অত৷ মাস্ক আর চশমা খুলেই যাই৷ যাতে ডুবিয়াস না লাগে।”

“পুলিশ বানচো** কিন্তু এক ঠাঁসা ভ্যানে ওঠাচ্ছে। বুঝছিস তো‚ থানায় নিতে পারলেই টাকা? সো খু্ব সাবধান।”

সানা এর মাঝে ফোনের গ্যালারি থেকে মেহার ছবিটা বের করেছে। কিন্তু শারফানের গালি-গালাজওয়ালা কথাবার্তা শুনে এতক্ষণে ওর ভাবনা হলো‚ এই শয়তানটা হঠাৎ এত উপকার করছে কেন ওকে? আর দেখলই বা কীভাবে ওকে মিছিলের ভেতরে?

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১৬.

প্রয়োজনের চেয়েও একটু বেশিই শারফান জড়িয়ে ধরেছে সানার বাহু। অস্বস্তি আর লজ্জায় কেমন কুঁকড়ে যেতে চাইছে ও। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না শারফানকে৷ কারণ‚ সমস্ত ধাক্কাধাক্কি আর ঠেলাঠেলি থেকে ওকে আগলে নিয়ে বের হচ্ছে সে গোলমালের ভেতর থেকে। আর রিহান একটু আগেই চলে গেছে মেহাকে খুঁজতে।

অবশেষে ওরা দুজন একদম নিরাপদ স্থানে চলে এলে শারফান ছাড়ল সানাকে৷ তারপর প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ওকে মিনিটখানিকের জন্য দাঁড়াতে বলল একাকী৷ কলটা বাজছিল অনেকক্ষণই। তা শুনতে পাচ্ছিল সানাও৷ একটু দূরে সরে কথা শেষ করে ফিরে এলো সে‚ “চলো।” বলেই রাস্তার বাঁ পাশে পার্ক করা সেডানের দিকে চলল।

“কোথায় যাব?” পেছন থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল সানা।

“আমার গাড়িতে”‚ এক সেকেন্ডের জন্য ফিরে তাকাল শারফান। তারপর গাড়ির কাছে গিয়ে দরজাটা খুলল।

“আমি…” ছত্রভঙ্গ মিছিলের দিকে তাকাল সানা‚ “আমি মেহাকে ছেড়ে যেতে পারব না। ও ফিরুক আগে।”

“আমি এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না”‚ রাস্তার ওপাশ থেকে একটু চেঁচিয়ে জানাল শারফান‚ “আমার জন্য সেটা সমস্যা।”

“আপনি চলে যান। মেহা এলে আমরা রিকশা নিয়ে নেব।”

শক্ত দৃষ্টিতে তাকাল শারফান। দুম করে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে এলো আবার ওর কাছে। চমকে দিয়ে ওর কব্জি চেপে ধরে বলল‚ “উদ্ধার করার দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছিলাম‚ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও পালন করব।”

সানাকে টেনে নিয়ে শারফান এগোতে থাকল এরপর। হাত ছোটানোর চেষ্টা করতে করতে ও কিছু বলতে গেলেই তখনই ওকে কঠিন ধমক লাগাল শারফান‚ “চুপ থাকবে! রাস্তার মধ্যে সিন ক্রিয়েট করলে চটকা-চটকি করা লোকগুলোর থেকেও খারাপ হবো আমি।”

“আপনি আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছেন না কেন? আমার বোন…”‚ কান্না করে দিলো সানা আবার।

“তোমার বোন এখানে থাকলে রিহান ঠিকই খুঁজে বের করবে। যথেষ্ট দায়িত্বশীল ছেলে। পেলে ও নিজ দায়িত্বে জানাবে আর প্রয়োজন পড়লে পৌঁছেও দেবে।” শেষে একটু থেমে শারফান মৃদুস্বরে বলল‚ “ও ভালো ছেলে৷ আমার মতো না। এখন গাড়িতে ওঠো।”

কান্না করতে যেন ভুলে বসল সানা এই মন্তব্যে। অদ্ভুত কিছু দর্শন করার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে দেখতে থাকল শারফানকে। বিড়বিড় করে হঠাৎ বলে বসল‚ “নিজে যখন জানেনই খারাপ৷ তাও বলছেন আমাকে গাড়িতে উঠতে?”

“হুঁ”‚ মাথা নাড়াল সে। দুঠোঁট চেপে কেমন জোর করে মুচকি হেসে বলল‚ “বিকজ আ লিটল হোয়াইল অ্যাগো‚ দিস ব্যাড বয় সেইভড ইউ।”

জবাবে হতবাকের মতো মুখ দেখাল সানার৷ শারফান তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করল না৷ গাড়ির দরজা খুলে কেমন অধিকারবোধ দেখিয়ে ওকে ভেতরে বসিয়ে দিলো৷ তারপর দোকান থেকে ঠান্ডা এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কিনে এনে ধরিয়ে দিলো ওকে।

সানার মাথার মধ্যে এলোমেলো লাগছে সব৷ কোথা থেকে কী সব ঘটতে শুরু করল! সুপারম্যানের মতো এসে শারফান ওকে বিপদ থেকে বাঁচাল‚ জোরপূর্বক অধিকার দেখিয়ে গাড়িতে তুলল‚ যত্নআত্তি শুরু করল। এই ছেলের মনের ভেতরে আসলে চলছে কী কে জানে! উপকার পেয়েও উপকারগুলো হজম হতে চাইছে না ওর৷ একবার মনে হচ্ছে কোনো না কোনো ঘাপলা আছে শারফানের মধ্যে আর নয়তো যতটা খারাপ ভেবেছিল তাকে‚ ততটাও খারাপ হয়তো না সে।

***

রাত ১১ টা

খাবার টেবিলে দুই হক সাহেব আর শারফান‚ রিহানের মাঝে নির্বাচনি আলোচনা চলছে অনর্গল৷ সাথে খাওয়াও থেমে নেই৷ এই গোষ্ঠীর পুরুষেরা আবার ভীষণ ভোজনরসিক। এমনো গল্প আছে শাফিউল হকের বাবারা যে সাত ভাই ছিলেন‚ তারা সাত ভাই এক সঙ্গে একটা গরু মেরে খেয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখতেন। খাওয়ার সেই স্বভাব এসেছে শাফিউল সাহেবের ভাই-বোনদের মাঝেও। নেহাৎ সুস্থতার দিকে নজর রাখতে এখন না চাইতেও খাওয়া-দাওয়াতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখেন তিনি। এদিকে তার ছেলেটাও হয়েছে একদম তার যুবককালের সময়টার মতোই৷ আচার বৈশিষ্টে‚ দেখতে-শুনতে আর খাওয়া-দাওয়াতেও। তবে ওর শয়তানি আর প্যাচানো বুদ্ধিসুদ্ধিটা হলো একান্ত ওরই প্রকৃতি।

এই যে আজকে যে ঝামেলাটা হলো স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারনাজ আর ভিন্ন এক দলের প্রার্থী খোকনের মাঝে—এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব শারফান আর ওর বন্ধুদলের। যার আগাম পরিকল্পনা সম্পর্কে বাপ-চাচাকে একটুও অবগত করেনি সে৷ তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফারনাজ প্রচণ্ড সতর্ক থেকেছে আর রেখেছেও দলকে একদম শান্তিপূর্ণ‚ নির্ভেজালভাবে থাকার৷ কেউ উস্কালেও উস্কায়নি সে আর দলেও কাউকে উস্কে যেতে দেয়নি৷ মারামারি‚ দাঙ্গাফ্যাসাদ থেকে যথেষ্ট দূরে থাকার চেষ্টা করেছে ক্লিন ইমেজ রক্ষার জন্য৷ কিন্তু শারফান যে আদা-জল খেয়ে তার পিছু পড়ে গেছে! জনগণের চোখে তাকে কালার করা থেকে ভোটে হারানোর সবরকম পরিকল্পনা গোছানো শেষ ওর। এবং আজকের ঝামেলার পরিকল্পনাটা শুরু করেছিল সে তিন দিন পূর্বেই৷ রাজনৈতিক মহলে স্বল্প পরিচিত শারফানের কিছু বন্ধু দুই দলে বিভক্ত হয়ে একটা সংখ্যা ফারনাজের দলে ঢুকে পড়ে আর আরেকটা সংখ্যা খোকনের দলে। তারা এই তিনদিন যাবৎ ফারনাজের বিরুদ্ধে ওই খোকনের দলের কাছে আর খোকনের বিরুদ্ধে ফারনাজের দলের কয়েকজনের কান ভারী করার কাজটা সম্পন্ন করেছে প্রচণ্ড জোরালোভাবে৷ যার ফলস্বরূপ আজকের দিনের এই মহা হাঙ্গামা। ফারনাজ অবশ্য বারবার সতর্ক থাকতে বলেছিল তার লোকেদের৷ কিন্তু বেছে বেছে অতিরিক্ত মাথা গরম লোকগুলোকেই খেপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে তার সতর্কতা কোনো কাজে লাগেনি৷

রাজনীতিতে এর চেয়েও নোংরা ষড়যন্ত্র চলে অবশ্য। তবুও শাফিউল সাহেবের মনে হচ্ছে ছেলেটা ভয়ানক এক কুটিল মনের মানুষে পরিণত হচ্ছে দিন দিন। সত্য হলো‚ আগামীবার থেকে তিনি আর চান না শারফান চাচার হয়ে রাজনীতির মাঠে নামুক। ব্যবসায়িক হিসেবেই শারফানের চিন্তাভাবনার কৌশল বেশ অসৎ আর বিপজ্জনক হয় মাঝেমধ্যে। মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে ছেলেটা। সেখানে যদি কোনোদিন রাজনীতিতে প্রবেশ করে সে‚ তবে তিনি নিশ্চিত স্বার্থ হাসিলের জন্য বড়ো বড়ো অন্যায়েও লিপ্ত হয়ে যাবে অনায়াসেই৷

খাওয়া শেষ করলেন তিনি। বেশ গম্ভীর গলায় বললেন শারফান আর রিহানকে‚ “আজ আর বের হবি না বাইরে৷ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড় দুজনই।”

“কিছু কাজ ছিল তো ওদের”‚ বললেন শাকিবুল সাহেব।

“আজকের ঘটনায় এমনিতেই সন্দেহের তালিকায় আছে শায়াফ৷ তাই এখন আর বের না হওয়ায় ভালো।”

উদরপূর্তি শেষে শারফান পিঠ টানটান করে বসল। “ঠি…ক আছে”‚ পেট ডলতে ডলতে সায় জানাল বাবাকে রঙ্গ সুরে।

শাকিবুল এদিকে আড়চোখে ভাইকে পরখ করার চেষ্টা করলেন। কিছু একটা ভেবেই যে ছেলেকে বারণ করছেন শাফিউল‚ তা তিনি বুঝতে পারছেন বেশ। কিন্তু কী এমন কারণ যে তার কাছে আড়াল রাখতে চাইছেন? আবার বাবার আদেশ এত সহজে শারফানকে মান্য করতে দেখলেন তিনি বহুদিন পর। এই দুই বাপ-বেটার সম্পর্কের ভাবগতি তিনি ঠিক বুঝেও যেন বোঝেন না।

***

মাড়িতে মাংস ঢুকে গেছে। বাবার ঘর থেকে টুথপিক একটা নিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে শারফান ঘরের দিকে পা বাড়াল। রিহান ক্লান্ত দেহটা ততক্ষণে বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে৷ হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে চিৎপটাং হয়ে আছে সে৷ শারফানকে আসতে দেখে হাঁপানো কণ্ঠে বলল‚ “তোদের সাথে খেতে বসে হুজুগে হুজুগে তোদের মতো গলা অবধি খেয়ে ফেলেছি রে! মনে হচ্ছে কাত হতে গেলেই সব চাপ খেয়ে নাক-মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে।”

“হেগে আয়”‚ বলতে বলতে ব্যালকনির দিকে গেল শারফান‚ “বের হলেও পাছা দিয়ে বেরিয়ে যাবে।”

“ন্যাস্টি শালা!” নাক কুঁচকে উঠে পড়ল রিহান। দ্রুত হজমের জন্য একটু হাঁটাহাঁটি করবে ঘরের ভেতর এখন। শারফানের শোবার ঘরটা ভালোই বড়ো আছে।

বেশ ঠান্ডা বাইরে৷ ব্যালকনিতে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর উপায় নেই। চারপাশে গাছগাছালি থাকায় গরমের দিনে ঘরটা শীতল থাকে‚ আরাম লাগে৷ কিন্তু শীতের দিনে আর আরাম লাগে না অতিরিক্ত ঠান্ডায়। ঘরে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াতেই ফোনটা বেজে উঠল শারফানের। পকেট থেকে বের করে দেখল সানার নাম্বার। দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে নাম্বারটার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বিদ্রুপাত্মক হাসল সে৷ নিশ্চয়ই আজকের উপকারের জন্য ধন্যবাদ‚ কৃতজ্ঞতা‚ এসব তথাকথিত সৌজন্য প্রকাশ করবে? এই ভেবেই অমন করে হাসল আরকি।

ইচ্ছা করেই একটু দেরিতে রিসিভ করল কলটা। চুপ থাকল সানা কথা না বলা পর্যন্ত৷ ওদিকে সানাও চুপ করে আছে শারফানের কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু আধা মিনিট নীরবতা দেখে সে ডেকে উঠল‚ “হ্যালো‚ ভাইয়া?”

“বলো”‚ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ ভার স্বরে উত্তর নিলো শারফান।

“ব্যস্ত আছেন?”

“হুঁ”‚ হাতের টুথপিকটা দেখতে দেখতে কপট ব্যস্ততা আর গাম্ভীর্য প্রকাশ করল সে‚ “বলো কী বলতে চাও?”

“রিহান ভাইয়ের নাম্বারটা দিতে পারবেন প্লিজ?”

“হোয়াট?” শারফানের গলা চড়ে গেল হঠাৎ‚ “রিহানের নাম্বার চাইলে তুমি?”

“হ্যাঁ”‚ সানা থতমত খেলো আচমকা অমন তেজী কণ্ঠ শুনে। “কোনো সমস্যা”‚ মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল শারফানকে।

“এজন্য ফোন করেছ তুমি?” সন্দিগ্ধ শারফান চঞ্চল গলায় জানতে চাইলো।

“হ্যাঁ‚ ওনাকে একবার থ্যাঙ্কস জানাতে চাইছি আরকি।”

“ওকে থ্যাঙ্কস জানানোর কী আছে?” কেমন এক বিশ্রী বিরক্তি আর রাগ কাজ করল শারফানের‚ “সেইফ তো করলাম আমি তোমাকে। গাড়ি করে পৌঁছেও দিলাম আমি। তাহলে তোমার সো কলড থ্যাঙ্কস ফ্যাঙ্কস বলার হলে আমাকে বলার কথা না?”

“হ্যাঁ‚ নিশ্চয়ই”‚ প্রচণ্ড অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সানা। শারফানকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কথা তো মাথাতেই আসেনি তার৷ যেভাবে জোর করে গাড়িতে তুলে সারা পথ ফারনাজকে নিয়ে খোঁচা দেওয়া কথা শোনাতে শোনাতে পৌঁছে দিয়েছিল তখন! তাতে বাড়ি আসার পর ওর জন্য কৃতজ্ঞতা বোধের পরিবর্তে গালাগাল করে গেছে সে আপন মনে। “আসলে আমি রিহান ভাইয়াকে মেহার জন্য থ্যাঙ্কস বলতে চাইছিলাম। উনি তখন না খুঁজতে গেলে মেহাকে ইনজুরড অবস্থাতে কে হসপিটাল নিয়ে যেত আর কে-ই বা বাসায় পৌঁছে দিতো? তাই ওনার সাথে আব্বুও কথা বলতে চাইছিল একবার।”

“আশ্চর্য! আমিই তো ওকে পাঠিয়েছিলাম। তোমার কী অবস্থা হতো আমি সময় মতো না এলে? আমাকে কেন থ্যাঙ্কস জানানোর কথা মনে হলো না তোমাদের? মিনিমাম কার্টেসি জানো না দেখছি তোমরা! হুহ্!”

“না না‚ ভাইয়া…”‚ তড়িঘড়ি করে বানিয়ে বলে দিলো সানা‚ “আপনার সঙ্গে তো আমার কিছুটা চেনাজানা আছে৷ তাই ভেবেছিলাম সামনাসামনি আপনাকে থ্যাঙ্কস বলব।”

“ও… আচ্ছা”‚ এবার একটু নিচু হলো গলা শারফানের৷ কণ্ঠের বিরক্তি আর রাগটাও দূর হতে থাকল। বদলে সেখানে ফিরল খানিকটা প্রফুল্লতা আর মশকরা‚ “তো তুমি দেখা করতে চাইছ আমার সঙ্গে?”

“তা কখন বললাম?” ফট করেই বলে উঠল সানা।

“মাত্রই তো বললে সামনাসামনি থ্যাঙ্কস বলবে ভেবেছিলে”‚ অনেকটা ধমকানোর সুরে বলল যেন শারফান।

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ…”‚ করুণ এক অপ্রস্তুত সুরে বলল সানা‚ “তাই তো‚ তাই তো। আমি… মানে আরকি…”

“হয়েছে থামো”‚ ধমক বসাল শারফান। সে বুঝে গেছে সানার মনের কথা। তার উপকারের দাম দিলো না বলে রাগও হচ্ছে খুব৷ রাগের চোটে বলে দিলো‚ “রিহান ঘুমাচ্ছে। এখন কথা বলা যাবে না ওর সঙ্গে৷ আমি ব্যস্ত আছি৷ নাম্বার টাম্বার বলার সময় আমার নেই। রাখো ফোন।”

“ইয়ে… ভাইয়া‚ তাহলে কাল দিতে পারবেন?”

“রাখতে বলেছি না?” সব থেকে বড়ো ধমকটা দিলো শারফান এবার। সানা কল কাটার আগে সেই দিলো কেটে।

“নিমকহারাম‚ হাড় বজ্জাত! ন্যাকামার্কা ছেমড়ী একটা”‚ ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে সানাকে বকতে বকতে ঘরে ঢুকল সে। অকস্মাৎ ধাক্কা খেলো তখন রিহানের সাথে৷ মুহূর্তেই তাকেও ধমক লাগাল‚ “হাতে-পায়ের তলে থাকিস কেন? হাগা চাপলে বাথরুমে যা।”

জবাবে বক্রোক্তি করল রিহান‚ “তোকে নিয়ে যাই‚ চল৷ মুখ ঠেঁসে ধরি কমোডের মধ্যে।”

গরম চোখ করে তাকে দেখে পাশ কাটিয়ে বিছানায় এসে বসল শারফান।

“তোর মনে যে পরিমাণ শয়তানি আর হিংসা”‚ প্রচ্ছন্ন নিন্দাবাদ করল রিহান। “জীবনে মেয়ে মানুষের মধ্যেও এতটা দেখিনি।”

চলবে।