#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২২.
শাকিবুল হকের প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন কর্মী কেন্দ্রটি দখল করেছিল। কেন্দ্রের ছয়টি বুথের সব ব্যালট পেপার কেড়ে নিয়ে তারা সিল মেরে বাক্সে ভরেছিল। পুলিশ এসে সবটা নিয়ন্ত্রণে নিলে ভোট গ্রহণ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা হয়। এমন ঘটনা সদরের মাচ্চর ইউনিয়ন‚ কানাইপুর ইউনিয়ন‚ অম্বিকাপুর ইউনিয়নেও ঘটিয়েছেন শাকিবুল সাহেব। সেসব জায়গাতে পুলিশকে ডেকেও পাওয়া যায়নি। ফারনাজের কর্মীদের অনেকেই আহত। আর যেসব সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করা হয়েছিল তারা ছিল কলসেরই সমর্থক। প্রায় বেশিরভাগ কেন্দ্রেই দেখা গেছে কলসের সমর্থকই বেশি।
ভোট গণনার কাজ শেষের দিকে। হয়তোবা আর ঘণ্টাখানিকের মাঝেই ফলাফল জানা যাবে৷ শাকিবুল সাহেবের মার্কাতে জোর করে দেওয়া ভোটগুলোর প্রায় অর্ধেক ব্যালট পেপারের পেছনে পোলিং কর্মকর্তার সিল ও স্বাক্ষর ছিল না। সেগুলো বাছাই করে বাদ দিয়ে কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে প্রিজাইডিং অফিসার।
রাত ১০: ৪০ মিনিট।
হেলতে দুলতে ঘরে ঢুকল শারফান। রিহান বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে ফোন চাপছে দেখে ওরও ইচ্ছা হলো এক্ষুনি বিছানাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লম্বা এক ঘুম দিতে৷ সারাটাদিনে বিছানাতে গা ছোঁয়ানোর সময় পায়নি আজ৷ দুপুরে একবার বাসায় ফিরে শুধু গোসল আর খাওয়া সেরেই আবার বেরিয়ে পড়েছিল।
কোটটা গা থেকে খুলেই ছুঁড়ে মারল সে রিহানের মুখের ওপর। “অজাতের অজাত”‚ খ্যাক করে উঠল রিহান।
কোনো পাত্তা দিলো না শারফান৷ হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। ক্লান্ত গলায় বলল‚ “আর বের হতে মন চাচ্ছে না। ঘুমাই যাব আমি। তোর মামার চোদ্দগুষ্টির কেউ যেন ঘরে না ঢুকতে পারে।”
“তোর কুলনেস দেখে তো মনে হচ্ছে রেজাল্ট পেয়ে গেছিস।”
“তোর চ্যাটের বাল মামা যে ফাতরামি করে বেড়িয়েছে সবগুলো সেন্টারে”‚ গায়ের ফুল হাতা টিশার্টটা খুলতে খুলতে জবাব দিলো সে‚ “তার আর রেজাল্ট পাওয়া লাগে?”
“সত্যিই খুব বাড়াবাড়ি হলো”‚ উঠে বসে রিহান বলল‚ “যেখানেই গিয়ে দাঁড়াই শুধু মামার নিন্দেমন্দ শুনি। কেউ ভালো বলেনি ওনার কর্মকাণ্ডে।”
আর কোনো কথা বলল না শারফান৷ ব্যালকনি থেকে গামছাটা নিয়ে এসে ক্যাবিনেটের সামনে দাঁড়াল যখন‚ হঠাৎ ওর ঘাড়ের ওপর নজর যেতেই রিহান আঁতকে উঠল‚ “একি রে! লাঠি লুঠার বাড়ির সাথে কি খামচা-খামচিও করেছে তোকে? কোন খাগড়া বিড়ালের সঙ্গে লেগেছিলি? নখের দাগ বসিয়ে দিয়েছে একদম। শালা লেডিস বেডা!”
ঘাড়ে হাত চলে গেল তখনই শারফানের৷ সেখানে আঙুল বুলাতে বুলাতে মুচকি হাসল‚ “লেডিস বেডা না৷ লেডিসই।”
পিছু ফিরে থাকায় রিহান দেখতে পেলো না ওর হাসি৷ সে রাগ রাগ গলায় বলল তাই‚ “মামা শালা মাঠে লেডিসও খেলতে নামিয়ে দিয়েছিল? কী খাইশ্টার খাইশ্টা! ঘাড় ধরে একটা ঘুরলি দিলি না বেত্তামিজ মহিলার?”
“ইম্পসিবল”‚ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল শারফান। হাঁটতে হাঁটতে আয়নার সামনে গিয়ে কাঁধ আর গলার নিচটা দেখে হাসল আরও। যতটা সময় সানাকে বাঁধনে বেঁধে রেখেছিল‚ ততটা সময়ই ওর শরীরের ওপর তার প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের চেষ্টা চলেছে। লাল আঁচড়ের দাগগুলো এখনো পুরোটা মেশেনি। মৃদুহাস্য মুখে সেসব দাগ দেখতে দেখতে বলল‚ “সাগ্রহেই নিয়েছি এগুলো৷ বিনিময়ে ফ্রেঞ্চ ডেজার্ট থেকেও স্পেশাল ডেজার্ট খেয়েছি। ভাবছি কোনো অয়েন্টমেন্ট নেবো না৷ দেখি কতদিন থাকে। প্রথম কেউ চিহ্ন বসিয়ে দিলো। কিছুদিন তো যত্নে রাখা উচিত… কী বলিস?”
“হোয়াট?” অবাক হয়ে বলল রিহান‚ “হোয়াট ডু ইউ মিন বাই সাগ্রহে নিয়েছি অ্যান্ড স্পেশাল ডেজার্ট খেয়েছি?”
“যা বুঝেছিস তাই।”
“মানে কবে‚ কখন‚ কীভাবে?”
“আজ দুপুরে”‚ হাস্যরত ঠোঁটের কোনে আঙুল বুলাতে বুলাতে সে জানাল‚ “চেপে ধরে।”
লাফ দিয়ে উঠল রিহান বিছানা থেকে। গলায় সবটুকু বিস্ময় ঢেলে বলল‚ “চেপে ধরে মানে কী? তোর কাকা মাঠে খেলেছে আর তুই খাটে খেলে বেড়িয়েছিস? কোথায়‚ কার সাথে? আমি তো আরও ভেবেছি কী ব্যস্তই না ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করেছিস সারাটা দিন! তাহলে মাইর‚ গুঁতা যা খেয়েছিস সেটা কি চেপে ধরতে গিয়েই?”
হাসি সরে গেল শারফানের। ধমকে বলল‚ “ক বললে কোরকদি চলে যেতে কে বলেছে তোকে? গাধার বাচ্চা!”
“লুইচ্চার ভাতিজা‚ তুই-ই তো বললি আজ দুপুরে চেপে ধরে। তো দুপুরেই তো ফিরলি গায়ে ছ্যাঁচা-গুঁতা নিয়ে।”
বিরক্ত হয়ে আর কোনো কথায় বলল না শারফান৷ গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে গেল সে আর তখনই ছুটে এসে রিহান আটকাল ওকে বাহু চেপে ধরে‚ “কথা খতম না করে যেতে পারবি না তুই।” জোর করে টেনে ধরে নিয়ে এলো ওকে বিছানায়। তারপর জিজ্ঞেস করল‚ “তুই সত্যিই ব্যাচেলরহুড ত্যাগ করে দিয়েছিস? তোর কুমারত্ব খেয়ে দিতে পারল এমন ক্ষমতাধর মেয়েটা কে?”
কানের পাশের চুল টেনে ধরল শারফান রিহানের‚ “আমি কি মেয়ে যে আমাকে খেয়ে দেওয়া যাবে?”
“উহঃ! ছাড়‚ হারামজাদা”‚ চুল ছাড়িয়ে নিয়ে কিল বসিয়ে দিলো রিহান ওর পিঠের ওপর‚ “ক্লিয়ার করে বলছিস না কেন কী করেছিস কার সাথে? দুপুরবেলা সুযোগই বা পেলি কীভাবে? তোর কোনো হতভাগা বন্ধুর বোনের সাথে কেস ঘটিয়েছিস মনে হয়। বন্ধুকে কামলায় ভেজিয়ে দিয়ে ফাঁকা বাসায় গিয়ে কাজ সেরেছিস নির্ঘাত। কিন্তু সেই মেয়ে তোকে বিছানায় নিতে পারল কীভাবে? তাহলে তো ঢাকার জিনিসগুলোর থেকেও মনে হচ্ছে সেরা জিনিস সে।”
“বন্ধুর বোন না‚ বন্ধুর ছাত্রী”‚ বলতে বলতে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসল শারফান‚ “আর অতিরিক্ত জল্পনা কল্পনা বন্ধ কর৷ অত দূর যাইনি৷ যতটুকু গিয়েছি তাতেই আমার মরনের পরওয়ানা জারি করে দিয়েছে।”
“তার মানে দুজনের সম্মতিক্রমে না? জোরজারি করেছিস তার সাথে?”
ঠোঁট চেপে হেসে শারফান সায় জানাল মাথা ওপর-নিচ দুলিয়ে।
“অবিশ্বাস্য”‚ রিহানের চোখে-মুখেও অবিশ্বাসের ছাপ‚ “কে মেয়েটা?
“সানা।”
“সানা”‚ নামটা পুনরাবৃত্তি করে উঠল রিহান সঙ্গে সঙ্গেই। একই সাথে বিস্ময় আবার প্রশ্নও তার কণ্ঠে।
“ইয়েস‚ সানা”‚ মাথাটাও এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বুজে বলল সে‚ “মাথার মধ্যে গেঁড়ে বসেছিল কতগুলো দিন! একদিন স্বপ্নে এসে পঁয়ত্রিশ দিনের নিডসে পরিণত হয়ে ছিল। চাহিদাটুকু আদায় না করা অবধি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আর সে মেয়ে তো আর চাইলেই আসত না কাছে। তাই প্রথমে ট্র্যাপ করে তারপর ব্ল্যাকমেইল করে।”
“দ্যাট মিনস ইউ সেক্সুয়ালি অ্যাসলটেড হার?”
“অ্যাসলটেড?” মুহূর্তেই চোখ মেলল শারফান।
“নয়?” রসশূন্য‚ গম্ভীর গলায় বলল রিহান‚ “তার মর্জির বিরুদ্ধে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে তোর নিডস ফুলফিল করেছিস।”
“হুঁ‚ করেছি”‚ শ্রাগ করল শারফান। একটু ভাবনার সুরে বলল তারপর‚ “সেটা অবশ্য ওর ভালো লাগেনি একদম৷ খুব কাঁদছিল৷ তাই আর এগোইনি৷ পরে কেমন অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমাকে মরে যাওয়ার কঠিন অভিশাপ দিয়ে টিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে দাবি করে গেল যেন ওর ছবি আর ভিডিয়ো ডিলিট করে দিই।”
শেষের কথাটা মনে হতেই সে বিছানা ছেড়ে ড্রেসিংটেবিলের কাছে এলো৷ সেখান থেকে ফোনটা নিয়ে ছুঁড়ে দিলো রিহানের কাছে‚ “বেচারির এই দাবিটা পূরণ করব কথা দিয়েছি৷ কর তো ডিলিট। দ্যাখ‚ ওর নামে আলাদা ফোল্ডার করে রাখা আছে সব।”
কঠিন চাউনিতে তাকিয়েই ছিল রিহান৷ ফোনটা ক্যাচ করে জিজ্ঞেস করল ওকে‚ “ওর কান্না‚ অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে যাওয়া দেখে তোর খারাপ লাগেনি? রিগ্রেট ফিল করিসনি?”
উদাসীনের মতো হাসল শারফান‚ “ও যে কাঁদবে তা তো জানতামই। রিগ্রেট ফিল করার জন্য কি চুমু খেয়েছি? খেয়েছি রিল্যাক্স আর রিলিফ ফিল করার জন্য।” তারপরই হঠাৎ হাসি থামিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল রিহানকে‚ “কিন্তু ওর জন্য তুই এমন টেম্পার খাচ্ছিস কেন? কী সমস্যা?” গম্ভীর হলো সে আরও‚ “পছন্দ টছন্দ করতি না-কি ওকে?”
“আমি?” নিজের বুকে আঙুল তাক করে বিছানা থেকে উঠে এলো রিহান। “না-কি তুই? টের পাসনি একবারও মেয়েটাকে নিয়ে তোর ফিলিংস?”
“বোকা**র মতো কথাবার্তা শুরু করছিস আবার। সর তো”‚ বিরক্ত দেখিয়ে রিহানকে ধাক্কা মেরে চলল সে বাথরুমের উদ্দেশে।
“শালা ক্যাবলার বাল‚ তুই কবে কোন মেয়েকে এরকম হ্যারাজ করেছিস? বল‚ করেছিস? ডেস্পারেট হয়েছিস কখনো কারও জন্য এরকম?”
“হইনি”‚ বাথরুমের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে শারফান দৃঢ় গলায় বলল‚ “হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি কখনো৷ কারণ‚ আমার নাগরীরা ওর মতো রিজার্ভ‚ কনজার্ভেটিভ নেচারের ছিল না। অ্যান্ড শি ডাজেন্ট সুট মাই টেস্ট। শি বিকেম মাই অবসেশন জাস্ট ফর আ ফিউ ডেইজ। ক্লিয়ার?”
“ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ফার্স্ট— আর ইউ এক্সপ্লেইনিং ইয়োরসেলফ অর মি?”
“তোর হে*‚ শালা আমার”‚ মেজাজ দেখিয়ে সে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো ঠাস করে।
রেগে গিয়ে রিহান তেড়ে গেল তখন দরজার দিকে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই চেঁচাল সে‚ “মাদারবোর্ড‚ তোর ব্যাবসার বুদ্ধি মাথায় থাকলেও প্রেমের বুদ্ধি তোর পুট**তে৷ তোর মতো ঝুনা মালরা নিজেদের একের সেয়ানা ভাবিস সব সময়। এই কারণেই ওভার কনফিডেন্সের ঠেলায় একদিন মারা খাবি আচ্ছামতো।”
“খেলে তোকে নিয়েই খাবো… প্রেশার নিস না”‚ চেঁচিয়ে কৌতুক সুরে উত্তর দিলো শারফানও।
দরজায় একটা লাথি বসিয়ে রিহান চলে এলো বিছানায়‚ “আমি কেন প্রেশার নেব‚ হারামজাদা?” একা একাই বলে চলল‚ “তুই যে নিজের পাছা নিজেই কাঁচি দিয়ে ফাড়লি। সেটা আমি বুঝলেও তুই বুঝলি না৷ হাঁদার ছা হাঁদা‚ বুঝবি তো একদিন ঠিকই৷ একদিন কী‚ তাড়াতাড়িই বুঝবি। তখন দেখিস কেমন লাগে!”
***
রাত ১১: ২০ মিনিট।
প্রিয় চাচার বাসায় এখন অবস্থান ফারনাজের৷ নির্বাচনের ফলাফল সে এখানে বসেই জানতে চায়৷ তাই কবির সাহেবসহ কর্মীরাও এসে বসে আছে মোস্তফা সাহেবের বাসায়৷ দিনার বাড়ির সবাইও এখানেই। ফারনাজের আরও একটি কারণ আছে এখন এখানে থাকার। সানা ঝামেলার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল আর আজও ওকে রক্ষা করেছিল শারফান—এ ঘটনা জানার পরই আজ আর সে ধৈর্য ধরে রাখতে পারেনি আর না মেজাজ। ব্যস্তস্তা শেষ হতেই তাই চলে এসেছে চাচার বাড়ি৷ তারপর শুধু সুযোগের অপেক্ষা করে গেছে সানার সাথে আলাদা করে কথা বলার জন্য৷ সুযোগটা মাত্রই মিলেছে৷ তাই এই মুহূর্তে সে এখন সানার সামনেই বসে। ফলাফল জানার আগেই সে জানতে চায় কেন বারবার শারফানই এসে পড়ে ওর বিপদের মুহূর্তে? এটা কি নিছকই কাকতালীয় না-কি কোনো যোগসূত্র আছে দুজনের মাঝে?
বিছনার মাঝখানে পায়ের ওপর কম্বল টেনে বসা সানা। দুপুরে বাসায় ফেরার পর থেকে সে আর ঘর থেকে বের হয়নি। খাওয়া-দাওয়া না করে সেই তখন থেকে শুয়েই ছিল। শেষে রাত বেশি হলে মা আর দাদীর চেঁচামেচির জন্য কটা ভাত খেয়ে নেয়৷ কিন্তু বাসা ভর্তি আত্মীয়ের কারও সাথে কোনো কুশলাদি বিনিময় না করে ঘরে ফিরে আবারও গুম হয়ে বসে থাকে। আসার পর থেকে এ ব্যাপারটা ফারনাজও লক্ষ করে। সানার সাথে একাকী কথা বলতে মেহাকে কিছুক্ষণের জন্য ঘরের বাইরে থাকার অনুরোধ জানায়৷ পড়ার টেবিলের চেয়ারটা টেনে বিছানার কাছে বসা সে এখন। চোখে-মুখের অবস্থা অত্যন্ত গম্ভীর তার। ডেকে উঠল সানাকে‚ “ওই‚ আমি কী জিজ্ঞেস করেছি তা শুনিসনি?”
বিরক্ত লাগছে খুব সানার‚ সহ্য হচ্ছে না কারও উপস্থিতি৷ তবুও স্বাভাবিক গলায় বলল‚ “ঠান্ডার কারণে সাইনাস বেড়েছে। চোখ‚ মাথার যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছিল না তাই একটু কেঁদেছিলাম।”
“একটু কাঁদার জন্য চোখ ফুলে ঢোল হয়ে গেল?”
“গেল”‚ অবজ্ঞার সঙ্গে উত্তর দিলো সানা। তা দেখে আজ আর সহ্য হলো না ফারনাজের। ওকে ধমকে উঠল‚ “সানা‚ আমাকে ঠিকঠাক জবাব দিবি বলে দিলাম।”
“কী জবাব চান আপনি?” মেজাজ চড়ে গেল সানার‚ “মেয়ে মানুষের কান্নাকাটির হাজারটা কারণ থাকতেই পারে৷ তা জিজ্ঞেস করার রাইট শুধু তার ঘরের লোকের৷ আপনি ঘরের লোক না।”
“এতটা অ্যাগ্রেসিভ!” ফারনাজ আগুন চোখে চেয়ে রইল। ক্রুদ্ধ সে৷ অথচ অস্বাভাবিক শীতল কণ্ঠে বলল‚ “আমার সঙ্গে তোর আচরণের পরিবর্তনটা আমি দেখতে পাচ্ছি শারফানের সঙ্গে তোর পরিচয় হওয়ার পর থেকে। তুই রিলেশনশিপে গেছিস ওর সঙ্গে‚ তাই না?”
শারফান! এ নামটা শোনা মাত্রই সানার চোখে যেন বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেল‚ “ওই অমানুষ জানোয়াটার সঙ্গে!” মেজাজের সবটুকু নিয়ন্ত্রণ হারাল সে। শারফানের প্রতি পাহাড়সম ঘৃণা আর রাগ ঠেলে এলো ওর কান্নার মধ্য দিয়ে‚ “যাকে জবাই হতে দেখলেও আমার সম্মানটুকু ফিরবে না‚ আমার পরাণ জুড়াবে না‚ তার সঙ্গে?” গলার রগ ফুলে উঠল ক্রোধান্মত্ত সানার‚ “ওর নাম আমার সামনে নেবেন না‚ খবরদার! কখনোই নেবেন না।”
ফারনাজ ভড়কাল বেশ। অপ্রত্যাশিত ছিল এমন প্রতিক্রিয়া দেখবে সে। ভাবেইনি এভাবে নেতিবাচক জবাবটা পাবে ওর থেকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই চোখ আটকাল তার সানার গলাতে৷ উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে গিয়েই ওড়নাটা গলা থেকে সরে গেছে ওর৷ একটা গাঢ় কালশিটে দাগ হয়ে আছে সেখানে৷ ওই ক্ষত কী করে সৃষ্টি হয় তা বোঝা মাত্রই রক্ত ছলকে উঠল তার বুকের ভেতর। চেয়ার ছেড়ে ঝড়ের বেগে বিছানায় উঠে এলো। ওর ওপর ঝুঁকে পড়ে দাগটা নিয়ে প্রশ্ন করল‚ “এটা কীভাবে হলো?” উত্তেজিত হয়ে উঠল সে‚ “কে করেছে‚ সানা? কী হয়েছে আজ তোর সাথে‚ আমাকে বল?”
জবাবে ডুকরে উঠল সানা। দাগটা যতবারই দেখেছে সে ততবারই নিজের অসহায়তা মনে পড়ে এভাবেই ডুকরে কেঁদেছে। মায়ের কাছে‚ বাবার কাছে কিছু বলতে না পারার অপারগতায় আরও বেশি বিষাদ লেগেছে ওর নিজেকে। যখন সুযোগ ছিল বলার তখনই সে বাবার কাছে শারফানকে করেছে নির্দোষ প্রমাণ। তার পরের সময়টাতেও কিছু বলতে পারেনি। রাতের পর রাত শারফানের নাম্বার থেকে আসা ফোনকল‚ সেসবের কলের ব্যাপ্তিকাল মিনিট পেরিয়ে ঘন্টা‚ শারফানের কাছে থাকা ছবি‚ ভিডিয়ো‚ এসব দেখার পর যে-কেউই বলবে ওরা সম্পর্কে আবদ্ধ। তাই তো সে সাহস পেলো না আজও কাউকে কিছু জানানোর। হয়তোবা বিশ্বাস করতেন বাবা-মা। কিন্তু আদতে সে যে সত্যিই অপরাধী। শারফানের সঙ্গে না হোক‚ পান্থর সঙ্গে তো জড়িয়েছে সে৷ এই ফোনটা যখন দেখবে কেউ তখনই তা প্রমাণ হয়ে যাবে আর তাতে সে আরও বেশি নিচে নেমে যাবে সবার চোখে।
“শারফান?” ফারনাজ কঠিন স্বরে নামটা উচ্চারণ করল‚ “শারফান‚ হ্যাঁ?”
সানা মুখ না খুললেও ওর নীরব কান্না থেকেই জবাব নিয়ে নিলো সে। কিন্তু জিজ্ঞেস করল এরপর‚ “কখন হয়েছে‚ সানা? ও কি তোকে তুলে…”
শেষ করতে দিলো না সানা কথাটা‚ “ভুল আমারও। তাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম বলেই ক্লাসরুমের বন্ধ দরজার ওপাশে আমাকে সে ছুঁতে পেরেছে।”
“ছুঁতে পেরেছে? কতটা ছুঁয়েছে‚ সানা? বল… ঠিক কতটা ছুঁয়েছে শু**রটা?” ফারনাজের বুক দুরুদুরু করছে। সে যা আশঙ্কা করছে তা যেন না হয়‚ এটাই মনে মনে কামনা করতে থাকল। সানাও যেন টের পেলো তার মনের সন্দেহটা। বলল তিরস্কার করে‚ “হয়তো দয়া হয়েছিল বলে সর্বনাশটুকু করেনি। ছেড়ে দিয়েছিল।”
“আমি তো পর।” রাগের চটে বিছানার ওপর ঘুষি বসাল ফারনাজ‚ “মনিকাকাকে কিছু জানালি না কেন?”
কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়াল সানা‚ “আমি নিজেই সে পথ বন্ধ করে দিয়েছি।” বলতে থাকল ফারনাজকে‚ দুটো মাস যাবৎ কীভাবে শারফান ওকে ভয় দেখিয়ে গেছে‚ কীভাবে আজ ওকে ব্ল্যাকমেল করেছে। পান্থর কথা ভেবেও করুণ সুরে বলল‚ “আমি বিশ্বাস রাখিনি আব্বুর। বিশ্বাস ভেঙেছি ফোন হাতে পাওয়ার পর থেকে। আব্বুকে সব জানানোর পর আমি আর দাঁড়াতে পারব না তার সামনে৷ আর কোনোদিনও আমাকে বিশ্বাস করবে না আব্বু। আব্বুকে কিছু বোলেন না আপনি… প্লিজ!”
হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে পড়ল ফারনাজ। চোখে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ স্পৃহা। কিড়-মিড় করে বলে উঠল‚ “বলব না… কাউকেই কিছু বলব না। শুয়া** বাচ্চাটাকে স্রেফ ডলে দেবো রাস্তায়।”
“ভাই.. ও ভাই”‚ হঠাৎ ঘরের বাইরে থেকে ফারনাজকে ডাকল তার খালাতো ভাই। সানা চোখের পানি মুছে নিলো দ্রুত৷ ওকে একবার দেখে নিয়ে ফারনাজ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
“ভোট গুণা শেষ‚ ভাই। খবর ভালো না…” ঘরের বাইরে থেকে শুধু এটুকুই শুনতে পেলো সানা।
***
রাত বারোটার সময়ই বিজয়ের মিছিল বেরিয়ে গেছে শাকিবুল সাহেবের পক্ষ থেকে। ফরিদপুর সদরের তৃতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হলেন তিনি। কিন্তু খুব একটা ব্যবধানে জিতেননি ফারনাজের সঙ্গে৷ মাত্র দেড়শো ভোটের ব্যবধান। এ নিয়ে তিনি একচোট মেজাজ দেখিয়ে ফেলেছেন দলের কর্মীদের৷ কতগুলো সেন্টার থেকে যেভাবে জোরজবরদস্তি করে ভোট ফেলা হলো বাক্সে। তারপর তো ফারনাজের তার ধারেকাছে আসতে পারারও কথা না৷ সেখানে মাত্র দেড়শো ভোটের ব্যবধান! বিশ্বাসই করতে পারছেন না তিনি৷ তবে কি এত বেশি ভোট পড়েছে কলসে? না-কি তার কর্মীরাই কাজ করেনি ঠিকঠাক? যদি অনৈতিকভাবে ভোটগুলো না নিতেন তিনি তবে তো বিপুল ভোটের ব্যবধানে আজ হারতেন।
তার নির্দেশে বিজয়ের একটি মিছিল স্লোগান দিতে দিতে গেল ফারনাজের বাড়ির সড়কপথেও। আর এদিকে শারফান ঘুমে পুরো অচেতন। তাকে দরজার ওপাশ থেকে একটি ব্যক্তিও ডেকে জাগাতে পারল না।
অন্য দিকে ফারনাজের খুনে রাগের হদিসও কেউ জানল না।
***
৭ জানুয়ারি
বেলা ১২ টা
জেসমিন বেগম কাঁদতে কাঁদতে খাবার সামগ্রী ভরছেন শারফানের ব্যাগে ৷ সেই যে সতেরো বছরে পা দিয়ে ফরিদপুর ত্যাগ করেছিল ছেলেটা। তারপর যেন একেবারেই কাছ ছাড়া হয়ে গেল৷ বছরে দুটো ঈদ ছাড়া কখনো বাড়ি ফিরত না৷ আর এখন তো ব্যাবসাতে ঢোকার পর দেখা গেছে কোনো কোনো ঈদেও আসে না সে৷ দশটা বছরের ভেতর শুধু এবারই টানা এতগুলো দিন থাকল শারফান বাড়িতে৷
শাফিউল সাহেব বিছানাতে যখন বসেন‚ চিরাচরিতভাবে তার একটি নির্দিষ্ট জায়গা থাকে বসার। সেটা হলো তার শিথান৷ পা জোড়া তুলে এখন সেখানেই বসে আছেন তিনি আর দেখছেন একবার ছেলের মাকে‚ আরেকবার ছেলেকে৷ তার ড্রেসিংটেবিলের সামনে অন্তত পনেরো মিনিট হলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুলের মধ্যে কিসের ক্রিম মেখে যাচ্ছে ছেলেটা৷ সেই ক্রিম দিয়েই চুল একবার ডানদিকে খাঁড়াভাবে রাখছে তো আরেকবার বামদিকে বাঁকাভাবে৷ একটু বুঝ হওয়ার পর থেকেই ছেলেকে এই চুল নিয়ে কত কত তামাশা করতে দেখলেন তিনি! এখন যে বড়ো হয়ে গেছে তাও কোনো বদল নেই। ওদিকে মা’টা যে কেঁদেকেটে নাকের জলে‚ চোখের জলে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে ফেলছেন‚ তা ফিরেও দেখার খবর নেই হতচ্ছাড়াটার! বিরক্তের সঙ্গে তাই ধমক লাগালেন‚ “হয় নাই? আর কতক্ষণ ধরে চুল ত্যারা-বাঁকা করবি?”
“ত্যারা-বাঁকা মানে কী?” চুলে আঙুল চালাতে চালাতেই বলল শারফান‚ “হেয়ার স্টাইল বলতে হয় জানো না?”
“ছাতার মাথা বল তুই! একেবারে সোজা ফ্ল্যাটে গিয়ে নামবি বলে দিলাম৷ এদিক-ওদিক ঢুকলেই এসআই রায়হানকে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করব আমি নিজেই৷ কোনো ছাড় দেবো না এবার আর।”
এদিক-ওদিক বলতে শাফিউল সাহেব মদের বারকে বোঝালেন। এবং এই এসআইয়ের সঙ্গে শারফানের সম্পর্কটা সাপ আর নেউলের মতো। লোকটা সর্বক্ষণ তক্কে-তক্কে থাকে ওকে যে-কোনো এক অছিলায় শুধু থানাতে নেওয়ার৷ তার সারা জীবনের লক্ষ্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান এটাই৷ এই সুযোগটা যদি একদিনের জন্যও পায় সে‚ তবে ওই একদিনের ভেতরই ওর শরীরের প্রতিটি গাঁট খসিয়ে দেবে নিশ্চিত৷
শারফান কিছু বলার আগেই স্বামীকে রাগ দেখালেন জেসমিন বেগম‚ “যাওয়ার সময় আপনাকে এসব অলক্ষুণে কথা বলতে বলে কে?” বলে ছেলের কাছে এসে দাঁড়ালেন৷ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে সাফ সাফ গলায় বললেন‚ “একটা খাবারও কিন্তু দান করবি না কাউকে। আমি এত কষ্ট করে প্রতিবার রান্নাবান্না করে দিই কি গেটের দারোয়ান‚ ঘরের বাবুর্চিকে খাওযানোর জন্য? আমার কষ্টের দাম টাম নাই তোর কাছে?”
“বেশি বেশি দাও কেন? একা এত খাওয়া যায়? আর এক খাবার আমার প্রতিদিন খাওয়া সম্ভব না৷ ফ্রিজে রেখে রেখে খাওয়া তো আরও সম্ভব না।”
“একদিনের জন্যই দিয়েছি৷ কিচ্ছু ফেলবি না‚ কাউকে দিবি না।”
“হুঁ”‚ বলে বাবার দিকে তাকাল সে। জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি পরশু দিনই ঢুকছ তো? কোম্পানির ওপেনিংয়ের আর দেরি করব না কিন্তু।”
“ঢুকব”‚ গম্ভীর স্বরে বললেন শাফিউল সাহেব‚ “গিয়ে বোর্ড মেম্বারদের সঙ্গে মিটিংয়ের একটা ব্যবস্থাও করতে হবে দ্রুত৷”
“একটা পার্টি থ্রো করাও দরকার। নতুন‚ পুরোনো সব স্টেকহোল্ডারও জানল হক ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমার নতুন পার্টনারশিপের কথা।”
“মাথায় আছে আমার।”
জেসমিন বেগম আর ব্যবসায়িক কথা বাড়াতে দিলেন না৷ ছেলের গায়ে‚ মাথায় স্নেহের পরশ বুলাতে বুলাতে ভালো ভালো পরামর্শ দিলেন‚ উপদেশ দিলেন। এর মাঝে শাকিবুল সাহেবের পরিবারও এসে হাজির হলো৷ শারফান কেন তাদের বাসায় গিয়ে থাকে না তা নিয়ে নাকিকান্না করলেন কতক্ষণ চাচি হাফসা বেগম।
রিহানের কথা ছিল শারফানের সঙ্গেই ঢাকায় ফিরবে৷ কিন্তু পুরোনো বাড়িতে গিয়ে একবার আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করে আসতে বলেছেস মামারা। তাই তার যাওয়াও একদিন পিছিয়েছে৷
সবার থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার পর হঠাৎ কী মনে করে আবার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে এলো শারফান৷ গন্তব্যের পথে পা বাড়ানোর পর আজ অবধি কখনো পিছু ফিরে তাকায়নি সে‚ না কখনো থেমে গিয়েছে। আজই প্রথম এমনটা করল দেখে শাফিউল দম্পতি বেশ অবাক হলেন৷ বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াতেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সে৷ তবুও জড়তাটুকু কাটিয়ে নিচুস্বরে মাকে বলল‚ “খেয়াল রেখো তোমার শরীরের।” তারপর বাবাকে বলল ফিসফিসিয়ে‚ “শোনো আব্বু‚ আল্লাহর কাছে বোলো তো আমার আয়ু যেন লম্বাচওড়া করে দেন৷ তুমি হজ করা মানুষ তো৷ তোমার দোয়া তাই ঝুলে টুলে থাকবে না।” বলা শেষে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না সে৷
সাদ্দাম বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গেটের সামনে৷ শারফান ওর গাড়িটা গ্যারেজে সার্ভিসিংয়ে দিয়েছিল গতকাল৷ সেখান থেকেই তাই গাড়িতে উঠবে সে। একবার পেছন ফিরে দেখলও না মায়ের ছলছল করা দুটো চোখ। এতগুলো বছরে এই প্রথম কিনা এমন করে বিদায় নিলো সে! দেখল না শাফিউল সাহেবের স্বভাবগম্ভীর মুখটা। যেখানে এখন হতবাক আর কোমলতা এক সঙ্গে ভিড়েছে। বিস্ময়টুকু কাটিয়ে উঠিয়ে এক পর্যায়ে স্নেহের সুরে বিড়বিড়িয়ে বকলেন ছেলেকে‚ “ফাজিলের গাছ! এইভাবে নাকি দোয়া চায় কেউ বাপের কাছে! যেন ওর বাপ এক পাষাণ… ও না বললে সে জীবনে দোয়া করে না ছেলের হায়াত বৃদ্ধির।”
***
“ভাই… ও শারফান ভাই! নিয়া চলেন না আমারে! গাড়ি তো আপনার ফাঁকায় যাবে। আমার ভাড়াডা ইটু বাঁচায় দেন‚ ভাই”‚ সতেরো বছরের ছেলেটা অনুনয়-বিনয় করতে থাকল শারফানের হাত জড়িয়ে ধরে।
শারফান গ্যারেজ মালিকের সাথে কথা বলছিল গাড়ি নিয়ে। এর মাঝে গ্যারেজে কাজ করা বাপ্পি নামের এই বাচ্চা ছেলেটা এসে ঘ্যানঘ্যান শুরু করল তাকে যেন সাথে করে নিয়ে যায় সে। ঢাকায় নাকি তার কী কাজ আছে।
এই গ্যারেজ ছাড়াও বাপ্পি চায়ের দোকান চালায় একটা। গ্যারেজে কাজ শেষে দোকানে গিয়ে সময় দেয় সে। শারফানের কাছে প্রশ্রয় পায় ছেলেটা সব সময়ই। যখনই তার চায়ের দোকানে যায় শারফান‚ তার সারা দিনের উপার্জনের চেয়েও বেশি টাকা সেদিন একাই দেয় তাকে। এজন্যই ছেলেটা অন্ধের মতো ভালোবাসে শারফানকে। যেমন তার অন্ধ মা’টা ভালোবাসে তাকে।
টাকা পরিশোধ করে সিগারেটে একটা টান দিয়ে শারফান তাকাল বাপ্পির দিকে‚ “তোর ভাড়া বাঁচিয়ে দিয়ে আমার কী লাভ‚ হুঁ?”
দাঁত দেখিয়ে হাসল বাপ্পি‚ “আমি চালাই নিয়া যাবানে আপনারে… যদি ধরবার দেন আপনার ডার্লিংরে।”
গাড়ি যেবারই সার্ভিসিংয়ে দিতে এসেছে শারফান। সেবারই সে বাপ্পিকে ডেকে বলেছে‚ “ওই বাপ্পে‚ এদিকে আয় ব্যাটা। আমার ডার্লিংয়ের প্রেশার বেড়েছে না কমেছে এসে দ্যাখ তো।” সেই থেকেই বাপ্পি মজা পায় ওর গাড়িকে ডার্লিং ডেকে।
“হুঁ…. মনে ধরেছে তোর প্রস্তাবখানা।” সিগারেটে শেষ টান দিয়ে শারফান বলল‚ “ফায়দা ছাড়া আমি কাউকে হেল্প করি না‚ বুঝলি? তো চল‚ বস গিয়ে গাড়িতে।”
বেজায় খুশি হলো বাপ্পি। মালিকের থেকে বিদায় নিয়ে এক দৌড়ে গাড়ির ড্রাইভারের সিটে এসে বসল সে৷ শারফান বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে তারপর উঠল গাড়িতে। বাপ্পি ভালোই জানে গাড়ি চালাতে। তারপরও তাকে সাবধান করল যেন দেখেশুনে চালায়৷
ফেরি পার করল ওরা বেলা দেড়টার ভেতরে। মহাসড়কে গাড়ি ওঠার পর শারফান চোখ বুজে ফেলেছে৷ ওর গাড়িরই পেছন পেছন একটা বাইক আসছে৷ সেই বাইকে ওর পরিচিত একটি মানুষ আছে তা আর খেয়াল করতে পারল না তাই। আর বাপ্পি ছিল আনন্দে। শারফানকে দেখে ওর মতো এত দামী গাড়ি চালানোর স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখত। কোনোদিন ভেবেছে তা পূরণ হবে? কিন্তু আজ হয়েছে। তা হোক না হয় একদিনের জন্যই৷ শারফান ভাইকে তাই মনে মনে অনেক দোয়া দিচ্ছিল তার স্বপ্নটা এই একদিনের জন্য হলেও পূরণ করে দিয়েছে বিধায়।
ঠিক মিনিট চারেক পরের ঘটনা। গাড়ির ব্রেক কাজ করা কেন যেন বন্ধ করে দিলো৷ বাপ্পি প্রথমে চেষ্টা করল নিয়ন্ত্রণে আনার। তাই ঘুমন্ত শারফানকে ডাকল না। কিন্তু সময় যত এগোলো ততই সে বুঝল কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। ছেলেটা আতঙ্কিত হয়ে কেঁদেই ফেলল৷ কারণ‚ সে ভাবল তার জন্যই হয়তো কোনো কিছু হয়েছে৷ যেহেতু গাড়ি সার্ভিসিংয়ের কাজ সে-ই করেছিল৷
“ভাই‚ তাড়াতাড়ি উঠেন” ‚ কাঁদতে কাঁদতে সে চেঁচিয়ে ডাকল শারফানকে‚ “শারফান ভাই‚ গাড়ির বেরেক কাজ করতেছে না।”
ধড়ফড়িয়ে উঠে চোখজোড়া খুলল শারফান। বাপ্পিকে কান্নাকাটি করতে দেখে অবাক হলো‚ “কীরে‚ কাঁদিস কেন? কী হয়েছে?”
“গাড়ির বেরেক কাজ করে না‚ ভাই”‚ কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল বাপ্পির।
বুকটা কেঁপে উঠল শারফানের। এগিয়ে এসে চেষ্টা করল সেও। কিন্তু বুঝতে আর সময় লাগল না আরেকটু পর কী হতে চলেছে ওদের ভাগ্যে। ঝড়ের গতিতে চিন্তা চালাল সে৷ তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল‚ “বাপ্পি‚ সিটবেল্ট খোল। লাফ দিতে হবে।”
“কী কন‚ ভাই!” আঁতকে ওঠা কণ্ঠে বলল‚ “সাইধা মরব?”
“বসে থাকলে এমনিতেও মরব। মরার আগে তাই বাঁচার শেষ চেষ্টা হবে এটা”‚ বলতে বলতে সিটবেল্টটা খুলে নিলো শারফান।
বাপ্পি পরিস্থিতি বুঝলেও সে বুকে বল পেলো না শারফানের মতো৷ হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে চলল আর বলতে লাগল‚ “পারব না‚ ভাই৷ আপনি কিছু এটা করেন। আমি পারব না লাফাইতে।”
শারফান বোঝানোর চেষ্টা করল তাকে অনেকভাবে৷ কিন্তু কিছুতেই রাজি হলো না বাপ্পি।
পেছনে আসা বাইকটাও লক্ষ করল ওদের গাড়ির এঁকেবেঁকে চলাটা৷ তা দেখেই উত্তেজনা বেড়ে গেল বাইকারের। এর মাঝেই দেখল সে অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ঙ্ককর দৃশ্যটা দেখে বাইকটা আর এগোলো না তার। সামনে থেকে আসা মালবাহী এক ট্রাকে ধাক্কা খেলো গাড়িটা। সেটাকে ঠেলতে ঠেলতেই ট্রাকটা নিয়ে গেল বহুদূর। চোখের পলকেই লাল সেডানটা একদম দুমড়েমুচড়ে গিয়ে পড়ল রাস্তার পাশের এক খানাতে।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২৩.
সুদূর আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজাপেঁজা মেঘ। সাদা সেই মেঘের কাছে উড়ে চলেছে একটা চিল৷ না-কি পানকৌড়ি ওটা? দৃষ্টি কেমন ঝাপসা। প্রখর রোদের জন্যই চোখদুটো ঘোলা হয়ে আসছে কিনা কে জানে! বাতাসে ভেসে আসছে বিশ্রী এক পোড়া পোড়া ঘ্রাণ৷ এদিকে মুখের ভেতরে নোনা স্বাদ। কানের মধ্যেও কেমন বাজছে। তাই শুনতে পেলো না শারফান‚ থপথপ পা ফেলে কারও ছুটে আসার আওয়াজটা। মাথাটা বারবার তুলতে চেষ্টা করল—পারল না৷ আচমকা তখনই কেউ একজন মাথাটা তুলে ধরে ডাকাডাকি আরম্ভ করল ওকে‚ “শায়াফ! শায়াফ… এই ছেলে‚ শুনছ?”
চোখের মনি ঘুরিয়ে শারফান দেখল অপ্রত্যাশিত একটি মুখ—আতঙ্কে পাংশুবর্ণ ধারণ করা মুখটির চামড়ায় সবে ভাঁজ পড়ার আভাস‚ কানের কাছের চুলে গোটা কয়েক সাদা চুল৷
“আপনি”‚ ফিসফিসানির মতো বলে উঠল সে। সেটা প্রশ্ন সুরে না-কি বিস্ময় প্রকাশ করে‚ তা বোঝা গেল না।
“আমি সৈয়দ মোস্তফা”‚ মোস্তফা সাহেব উত্তেজিতভাবে বললেন‚ “উঠতে চেষ্টা করো আমাকে ধরে। পারবে না?”
“বাপ্পি…”‚ একই সুরে এবার নামটা ডেকে উঠল শারফান।
“বাপ্পি?” প্রশ্ন গলায় বলার পরই মোস্তফা সাহেব বুঝলেন কার কথা বলছে সে। তাই শশব্যস্ত হয়ে জানালেন‚ “আছে… ওকে গাড়িতে তুলছে লোকজন। তুমি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করো তো দেখি।”
তার সাহায্যে শরীরটাকে জোর করে তুলে দাঁড়াল শারফান আর মুহূর্তেই সারা দুনিয়া দুলে উঠল ওর। শুকিয়ে যাওয়া এক খালের ভেতর তারা দুজন। পায়ের ওপর আর স্থির দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না শারফানের। ঢুলে পড়ে যেতে গেলেই মোস্তফা সাহেব জাপটে ধরলেন ওকে শরীরের সাথে। তখনই তার হাত মাখামাখি হয়ে গেল টাটকা রক্তে। হাতটা ওর মাথার কাছে নিলেন তিনি। ছুঁতেই বুঝলেন গুরুতর আঘাত পেয়েছে সে মাথায়। তারপর বুঝতে চেষ্টা করলেন ওর কান থেকেও রক্ত আসছে কি-না। কিন্তু রক্তে এতটাই ভিজে উঠল তার হাত ‚ যে দ্রুত তিনি পকেট থেকে কোনোভাবে রুমালটা এনে আঘাত পাওয়া জায়গায় চেপে ধরলেন আর চেঁচিয়ে উঠলেন রাস্তার দিকে চেয়ে‚ “কেউ এদিকে আসেন… বেঁচে আছে একজন। জলদি আসেন কেউ।”
শারফানের ভারী দেহের সম্পূর্ণ ভার ধরে রাখতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন৷ ওকে বয়ে নিয়ে রাস্তায় ওঠা তার পক্ষে সম্ভবই নয়৷ আরও দুয়েকবার ডাকাডাকি করলে তিন-চারজন ছুটে এলো তাদের কাছে৷ শারফানকে তুলে নিয়ে ওঠানো হলো একটা অটো রিকশাতে।
***
“বাপ্পি… ভাই আমার। আমি কিছুই করতে পারছি না…”‚ গাড়ির এক্সেলেটরে পা দিয়ে‚ স্টিয়ারিং এলোমেলো ঘুরিয়ে‚ কখনো হ্যান্ডব্রেক জোরে চেপে ধরে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনার বৃথা চেষ্টা চালাল শারফান আর বাপ্পিকে অনুরোধ করল‚ “দরজাটা খুলে ঝাঁপ দে‚ ভাই। আমার কথা শোন… প্লিজ!”
“পারব না‚ ভাই৷ আপনি কিছু এটা করেন… আমি পারব না ঝাঁপ মারতি”‚ পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে একই কথায় বারবার বলে চলল বাপ্পি।
শারফানের কথা সে শুনলই না৷ তাকে কোনোভাবেই রাজি করাতে না পেরে রাগে‚ আতঙ্কে গালি দিয়ে উঠে চেঁচাল শারফান‚ “বান্দির বাচ্চা‚ ঝাঁপ দে… তোর মা’র কসম! যদি তাকে দেখতে চাস তো ঝাঁপ দে বলছি!”
অন্ধ মায়ের মুখটা মনে পড়তেই আকুল হয়ে কেঁদে উঠে তখন বলল বাপ্পি‚ “আপনি তয় আগে বাইর হন‚ ভাই৷ আপনারে দেইখে আমি সাহস করতি পারবানে।”
কখনো বাস‚ কখনো ট্রাক‚ কখনো বাইক‚ রিকশার সাথে লেগে যেতে যেতে বেঁচে যাচ্ছে গাড়িটা৷ কারণ‚ বিরতিহীন হর্ন বাজিয়ে চলেছে শারফান। বাপ্পির কথা মানতে পারল না সে। “তোকে রেখে আমি বের হতে পারব না‚ কুত্তা”‚ এ পর্যায়ে গলাটা কেঁপে উঠল ওর। মাকে‚ বাবাকে আর বোনটাকে শেষবার দেখার মুহূর্তটা মনের পর্দায় এলো নিমেষেই। কিন্তু পরিস্থিতি তো এভাবে আর বেশিক্ষণ ওদের টিকিয়ে রাখবে না। রাস্তাটা ব্যস্ত। যখন তখন লেগে যেতে পারে কোনো গাড়ির সাথে। তাই কান্না গিলে নিয়ে বাপ্পিকে উতলা হয়ে বলল‚ “সময় নাই আর৷ দরজাটা খুলে শুধু মাকে মনে করে একটা লাফ দে‚ বাপ্পি। আমি সত্যিই কিচ্ছু করতে পারছি না।”
“ও মাআআ… মা রেএএ”‚ ডাকতে ডাকতে হেঁচকি তুলে কাঁদল বাপ্পি। অশ্রুপূর্ণ চোখে শেষবারের মতো শারফানকে দেখে বলল‚ “আমি মইরে গেলি আমার মারে কইয়েন না‚ ভাই। কইয়েন আমি আমার আব্বার কাছে চইলে গিছি‚ আমার সৎ মার সংসারে।”
কান্নায় লাল হয়ে ওঠা চোখদুটোই শারফানও দেখল বাপ্পিকে শেষবারের মতো৷ কিন্তু বাপ্পির মতো কোনো শেষ বাক্য গলা দিয়ে এলো না ওর৷ “যা… বেরিয়ে যা”‚ নিচু স্বরে বলল কেবল এটুকুই।
চলন্ত গাড়ির দরজাটা খুলল দুজন এক সঙ্গেই৷ শারফান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল বাপ্পির আগে বের হওয়ার জন্য৷ লাফ দেওয়ার মুহূর্তে ভয়েই চোখ দুটো বুজে ফেলল বাপ্পি। তারপর লাফ দিলো সে। কী অবস্থা হলো তার তা দেখার বিন্দু পরিমাণ সময় পেলো না শারফান। ট্রাকটার সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার ঠিক পাঁচ সেকেন্ড পূর্বে সে ঝাঁপাল বাইরে৷ গড়াতে গড়াতে ইটের সাথে মাথার এক পাশটা ঠুকল ওর৷ শরীরটা যখন খালের মধ্যে পড়ে স্থির হলো তখন চেতনা যায় যায় মুহূর্ত। বাপ্পির খোঁজটুকু নেওয়ার আর অবস্থায় রইলো না।
রাত ৮:২৫ মিনিট ।
চোখের পাতা কাঁপছে শারফানের৷ বেডের একপাশে ডাক্তার‚ নার্স আর অন্য পাশে রিহান‚ শাফিউল হক ও মোস্তফা সাহেব। তাদের উদ্দেশে জানালেন ডাক্তার‚ “জ্ঞান ফিরছে ওর। সাবধান! কেউ উত্তেজিত হয়ে পড়বেন না আর কান্নাকাটি তো করবেনই না৷ ওর মনে চাপ পড়বে এমন কোনো কথাও এ মুহূর্তে বলবেন না।”
বদ্ধ চোখের সামনে সিনেমার চিত্রের মতো দেখতে পাচ্ছিল শারফান ওর আর বাপ্পির গাড়ির ভেতরের শেষ মুহূর্তগুলোই৷ কিন্তু আর বেশিক্ষণ পারল না চোখ বুজে থাকতে৷ মাথার অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব হতেই চোখজোড়া খুলে গেল। একটু সময় দেওয়া হলো ওকে নিজের অবস্থা আর অবস্থান বোঝার জন্য৷ কিছুক্ষণ পরই শারফান হঠাৎ বিড়বিড় করে উঠল‚ “আব্বু!”
জ্ঞান ফেরার পর নিজের অজান্তেই সে ডেকে উঠল আগে বাবাকে৷ অথচ সবাই ডাকে মা’কে‚ তাই না? এই ডাক শুনতে পেয়ে কী করে কান্না সামলাবেন শাফিউল সাহেব? তা বুঝে পেলেন না তিনি৷ কিন্তু ছেলের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকাইবা কি সম্ভব? ডাক্তারের আদেশ পেয়েই তিনি এগিয়ে এলেন শারফানের কাছে৷ চোখে পানি আসতে না দিলেও কণ্ঠের কাঁপুনি সামলাতে পারলেন না৷ কান্নারুদ্ধ গলায় ডেকে বললেন‚ “শায়াফ‚ আব্বু এই যে আছি। তোর কাছেই।” ছেলের ব্যান্ডেজ করা মাথায় খুব আলতোভাবে ছুঁয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিয়ে নিলেন হাত এই ভয়ে‚ যদি ব্যথা বাড়ে আরও!
জন্মের পর নার্স এসে প্রথম তার কোলেই দিয়েছিল ওকে। তখন একটু সময়ের জন্য কোলে নিতেই শারফান চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। তুলতুলে গা আর তার ওপর প্রিটার্ম শিশু ছিল বিধায় শাফিউল সাহেব ভেবেছিলেন তার শক্ত হাতের ছোঁয়াতেই ছেলেটা ব্যথা পেয়েছে। দ্রুত তাই মায়ের কোলে তুলে দিয়েছিলেন৷ তারপর ততদিন পর্যন্ত আর ছেলেকে কোলে নেননি যতদিন না ছেলেটা একটু শক্তপোক্ত হয়। ছুঁলেও এত কোমল করে ছুঁতেন ছেলেকে‚ যে তা দেখে সবাই হাসত আর মশকরা করত তাকে নিয়ে। আজ মনে পড়ে গেল তার সেই প্রথম বাবা হওয়ার দিনগুলোর কথা।
“বাপ্পি কই?” ভরাট গলার ভাঙা ভাঙা স্বরে শারফান জিজ্ঞেস করল বাবার কাছে‚ “ওকে আনোনি?”
ডাক্তারের দিকে তাকালেন তখন শাফিউল সাহেব। তার চোখের চাউনিতে প্রশ্ন‚ “জানানো কি উচিত?”
উত্তেজনা হয়ে পড়ে এমন কোনো কথা রোগীকে বলা এই মুহূর্তেই একদমই বারণ ডাক্তারের৷ মাথার আঘাতটা বিপজ্জনক ছিল শারফানের৷ এগিয়ে এসে ডাক্তারই তাই বললেন ওকে‚ “আপনি আগে সুস্থ হন। উঠে হাঁটা-চলা করার মতো ফিট হন। বুঝেছেন? খুব বেশি কথা বলবেন না এখন।”
বিরক্ত হলো শারফান‚ “প্রশ্ন তো করেছি দুই কথাই আর আপনি উত্তর দিলেন বারো কথায়।” কথাটুকু বলার পরই মৃদুস্বরে ‘উহঃ’ করে উঠল মাথার মধ্যে হঠাৎ চিনচিন করে ওঠায়৷
“নিষেধ করলাম। দেখলেন তো…”
“নিজেই তো কথা বাড়াচ্ছেন”‚ ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কথার মধ্যেই মেজাজ দেখাল শারফান৷ তারপর তাকাল বাবার দিকে‚ “বাপ্পি কোথায়‚ আব্বু? ওকে খুঁজে পাওনি না-কি নিয়ে আসোনি? ঠিকঠাক আছে ও?”
“নিয়ে এসেছি৷ আছে ও”‚ ঢিমে আওয়াজে বললেন শাফিউল সাহেব। “তুই সুস্থ হ একটু৷ তারপর ওকে দেখিস।”
মাথার যন্ত্রণায় আর কথা বাড়ানোর শক্তি পেলো না শারফান। বাবার কথায় আশ্বস্ত হয়ে চোখদুটো একটু বুজতে বাধ্য হলো। তখনই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন মোস্তফা সাহেব৷ এতটা সময় ছিলেন তিনি কেবল এটুকু নিশ্চিত হতে যে শারফানের বিপদটা কেটে যাবে কি-না৷ তার পিছু পিছু এলেন শাফিউল সাহেবও। এর মাঝে অসংখ্যবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তিনি মোস্তফার কাছে৷ কারণ‚ সাহায্য করার পাশাপাশি শারফানকে রক্তও দান করেছেন তিনি কোনো দ্বিধা ছাড়াই। প্রস্তাব দিলেন তাকে‚ “আপনাকে বাসায় ফেরার ব্যবস্থা করে দিই‚ ভাই। আমার গাড়িতেই যাবেন।”
বিনয়ী হেসে মাথা নাড়ালেন মোস্তফা‚ “সাভারে কাজ ছিল আমার। ওখানেই যাচ্ছিলাম৷ আল্লাহ চাইলে বাসায় কাল ফিরব। আপনি চাপ নিয়েন না৷ ছেলের কাছে থাকুন।” তারপর একটু থেমে চিন্তিত গলায় বললেন‚ “আপাতত জানিয়েন না বাপ্পির কথাটা৷”
“না‚ জানাব না”‚ ব্যথাহত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি‚ “পুলিশকে পোস্টমর্টেম করতে বারণ করলাম। এমনিতেই এক কষ্টের মৃত্যু হলো বাচ্চাটার৷ সেই শরীরটাকে আবার কাটাছেঁড়া করবে… ওর আত্মার কষ্ট আর বাড়াতে চাইলাম না।”
“ঠিকই করেছেন৷ চোখের সামনে দেখেছি ছেলেটার মরণ। ঝাঁপ দেওয়ার পর গাছের সাথে যেভাবে বাড়ি খেয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ল… উহঃ!” চশমাটা খুলে চোখজোড়া মুছতে মুছতে বললেন মোস্তফা বেদনাপূর্ণ গলায়‚ “অমন কষ্টদায়ক মৃত্যু আল্লাহ বাচ্চা ছেলেটাকে কেন যে দিলেন!”
শারফানের সঙ্গে ওকেও নিয়ে আসা হয়েছিল প্রথমে কাছের এক হাসপাতালে৷ সেখানে পৌঁছনোর পরই মোস্তফা সাহেব কল করেন শাফিউলকে৷ যোহরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে তখন মাত্র বেরিয়েছেন তিনি৷ কলটা পেয়ে আর বাড়িতে ফেরেননি। অস্থির হয়ে কাঁদতে কাঁদতে মসজিদের সিঁড়িতে বসে পড়ে কল দেন শুধু ড্রাইভারকে। বাড়ির আর কাউকে বলার কথা মনেও আসেনি তখন৷ গাড়ি নিয়ে রওনা হওয়ার পর খেয়াল হয় তা। তাই মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে রিহানকে কল করে ডেকে নেন শুধু। হাসপাতালে যখন পৌঁছান তখনই জানতে পারেন বাপ্পির মৃত্যুর সংবাদ। মাথার খুলি ফেটে গিয়ে প্রাণটা রাস্তাতেই বেরিয়ে গিয়েছিল তার। শারফানের অবস্থাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। অ্যাম্বুলেন্স করে তাই ওকে তখনই নিয়ে আসা হয় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে৷
“জানাজার ব্যবস্থাটাও তো তাড়াতাড়ি করা দরকার”‚ শাফিউল সাহেব বললেন‚ “ওর লাশটা নিয়ে আমি এখনই চলে যাব ফরিদপুর। শায়াফের মাকে আর সামলানো যাচ্ছে না৷ তাকে নিয়ে আসতে হবে আজই।”
***
৮ জানুয়ারি
বেলা ১ টা
সদর দরজা খুলে রেখেই বিমর্ষ সানা আর মেহা সোফায় বসে কথা বলছিল। এর মাঝে ঘরে পা রাখলেন মোস্তফা সাহেব। বাবাকে দেখা মাত্রই উচ্ছ্বাসিত হয়ে মাকে ডেকে উঠল দুবোন‚ “আম্মু‚ আব্বু চলে আসছে।”
সকাল থেকেই সৈয়দ বাড়িতে আজ যেন প্রাণ ছিল না। সকালবেলা নাশতায় সানা আর মেহা কোনোরকমে কটা ভাত খেয়ে নিলেও নাজমা বেগম এখন পর্যন্ত কিছু মুখে তুলেননি৷ স্বামীর চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিলেন তিনি।
গতকাল সাভারে মোস্তফা সাহেব রওনা হয়েছিলেন তার মুমূর্ষু এক খালাকে দেখতে যেতে। হঠাৎ করেই খবর এসেছিল মরো-মরো অবস্থা সেই খালার। এমন খবর পেয়ে সানার দাদী কান্নাকাটি জুড়লেন৷ এই একটি মাত্র বোনই বেঁচে আছেন তার। দূরের পথে ভ্রমণ করার মতো শারীরিক সুস্থতা তার নেই বিধায় ছোটো ছেলেটাকেই অনুরোধ জানান তিনি‚ যেন একবার গিয়ে দেখে আসেন তার বোনটাকে। মোস্তফা সাহেব সকাল সকালই রওনা হয়েছিলেন তাই। কিন্তু গতকাল রাত দশটা বেজে গেলেও তার পৌঁছানোর খবর পায়নি কেউ। কল করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ে সবাই। আজ-কাল আর আগের মতো চোখে স্পষ্ট দেখতে পান না বলে বাইক নিয়ে অতীতে দু’বার ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি। এ ভয়েই সবার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল৷ গতকাল রাত বারোটার পর গিয়ে সানারা খোঁজ পায় বাবার৷ ফোনে শুধু তিনি বলেছিলেন‚ বিরাট এক সমস্যায় পড়েছিলেন। তাই বাসায় কল করার মতো সুযোগ পাননি। ফিরে এসে বিস্তারিত জানাবেন।
বসার ঘরে ছুটে এলেন নাজমা বেগম। হাতের শপিং ব্যাগটা সোফার ওপর রেখে বসে পড়েন মোস্তফা গা এলিয়ে দিয়ে। মেয়েদের বললেন‚ “এক গ্লাস পানি দে‚ মা।” মেহা মুহূর্তেই ছুটে গেল পানি আনতে।
“অ্যাক্সিডেন্ট ঘটান নাই তো?” তার গায়ে-মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন নাজমা।
“আরে না‚ ঠিক আছি আলহামদুলিল্লাহ। চিন্তার কিছু নেই”‚ বলতে বলতে টিভির রিমোটটা খুঁজলেন। সেটা বুঝতে পেরে সানা খুঁজে এগিয়ে দিলো রিমোট। এসেই হঠাৎ টিভি চালু করার প্রয়োজন পড়ল কেন তার? এ দেখে জিজ্ঞেস করলেন নাজমা‚ “কী হয়েছে?”
“খবর দেখলেই বুঝবে। দাঁড়াও”‚ বলে চ্যানেল বদলে তিনি খুঁজতে থাকলেন এখন খবর হচ্ছে যে চ্যানেলে সেই চ্যানেলটা। এর মাঝে সানার চোখ গেল বাবার রাখা শপিং ব্যাগটার ভেতর৷ বাবার শার্ট মনে হচ্ছে! কিন্তু দলা করে রাখা কেন? এটা পরেই তো বেরিয়েছিলেন তিনি গতকাল। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখল নতুন একটা শার্ট এখন পরনে৷ সহসাই খারাপ কিছুর ইঙ্গিত পেলো ওর মনটা৷ দ্রুত শার্টটা বের করে দেখল সারা শার্টে রক্তের দাগ ভরে আছে। “আব্বু”‚ আঁতকে ওঠা কণ্ঠে ডেকেই বাবার কাছে এগিয়ে এলো সে‚ “তুমি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলে রাস্তায়?”
মেহা ঘরে ঢুকল। সে আর নাজমা বেগমও দেখল তখন শার্টটাকে৷ স্ত্রী‚ সন্তানকে ঘাবড়ে যেতে দেখে তিনি দ্রুত জানালেন‚ “আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি৷ হয়েছে শাফিউল হকের ছেলের।”
সে সময়ই টিভিতে সংবাদ পাঠিকা খবরের শিরোনাম পড়তে আরম্ভ করেছে৷ মোস্তফা সাহেব ঝট করে টিভির পর্দায় তাকালের। তার কথা শুনে কেউ প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে তার দেখাদেখি সবাই তাকাল টিভিতে৷ একে একে কয়েকটা শিরোনাম পড়ার পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সংবাদটা শুনতে পেলো সবাই৷ সদ্য এমপির ভাতিজা ও হক কোম্পানির অংশীদার হিসেবে শারফানের ভয়াবহ দুর্ঘটনার সংবাদটা চলে গেছে গণমাধ্যমে৷ তাছাড়া এর আরও একটি কারণ হলো পুলিশ গাড়িটাকে উদ্ধার করার পর তদন্ত শুরু করেছে কালকের মধ্যেই৷ তারপরই এক চাঞ্চল্যকর এক তথ্য জানিয়েছে তারা৷
গাড়িতে ব্রেকিং সিস্টেমের জন্য যে মাস্টার সিলিন্ডার থাকে সেই মাস্টার সিলিন্ডারে ব্রেক অয়েল পড়ে গিয়ে খালি হয়ে গিয়েছিল। এই ব্রেক অয়েল কমার বা না থাকার কয়েকটি কারণ থাকলেও শারফানের গাড়িতে যেটি হয়েছে সেটি হলো‚ মাস্টার সিলিন্ডার থেকে চারটি পাইপ গাড়ির চারটি চাকার সঙ্গে সংযুক্ত করা থাকে৷ ওই পাইপগুলোর মাধ্যমে ব্রেক অয়েলের সাহায্যে গাড়ির চাকাতে ব্রেক করা হয়। মাস্টার সিলিন্ডার এবং চাকার সঙ্গে এ পাইপের যে সংযোগ স্থানগুলো রয়েছে‚ সেখানে লিকেজ হয়ে ছিল বিধায় গাড়ির ব্রেক ওয়েল পড়ে গিয়ে মাস্টার সিলিন্ডার খালি হয়ে গিয়েছিল এক সময়। আর তখনই গাড়িটা ব্রেক ফেল করে বসে।
এ তথ্য জানার পরই শাফিউল সাহেব আজ নিঃসন্দেহে পুলিশকে জানান‚ কেউ তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। কারণ‚ গাড়িটা তো পুরো একদিন সার্ভিসিংয়ে ছিল। এবং যে ছেলেটার মৃত্যু হয়েছে সে-ই গাড়ি সার্ভিসিং করিয়েছিল৷ যদি লিকেজ শুরুতেই থাকত তবে কি গাড়িটা ছাড়ত সে? না নিজে সেই গাড়িতে চড়ত?
তার কথার ভিত্তিতে আজই গ্যারেজের মালিক ও তার কর্মীদের জেরা করতে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্যারেজের মালিক জানান‚ বাপ্পি গাড়ি সার্ভিসিং করার পর সেও সব কিছু চেক করে দেখে ঠিকঠাক আছে কি-না৷ তেমন গত পরশু রাতেও তিনি চেক করে দেখেছিলেন শারফানের গাড়ি৷ কোনো লিকেজ ছিল না। রাতে সে গ্যারেজ বন্ধ করেছিল প্রায় বারোটার সময়। তারপর সকাল দশটায় গ্যারেজ খোলা হলে বেলা বারোটায় শারফানকে গাড়ি দেওয়া হয়৷ এ দু ঘণ্টার মাঝে ওর গাড়িতে তার কর্মীদের কাউকে আর হাত দিতে দেখা যায়নি। এরপরই শুরু হয় কর্মীদের জেরা করা৷ তারা কেউ শারফানের গাড়িতে হাত লাগায়নি বলেই জানায় পুলিশকে৷ তাহলে লিকেজ হলো কী করে? এবং কখন হলো? এ দুই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ গ্যারেজের কাউকে এখন পর্যন্ত ছাড়েনি৷
শারফানের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়ি আর বাপ্পির লাশের ছবি একটু পরই খবরে দেখতে পেলো সানা। শারফানকে রাখা হয়েছে বেশ নিরাপত্তার মাঝে। তাই ওর কাছে যাওয়া বা ওর ছবি নেওয়ার কোনো অনুমতি পায়নি সাংবাদিক। যা প্রশ্ন করার‚ কথা বলার তা কেবল পুলিশের সাথেই হয়েছে তাদের। তবে ওর শারীরিক অবস্থার কথা জানানো হলো‚ বেশ আশঙ্কাজনক ছিল ওর অবস্থা৷ কিন্তু এখন সে বিপদমুক্ত।
“ওই গাড়ির পেছনই ছিলাম আমি”‚ মর্মাহত গলায় বলে উঠলেন মোস্তফা সাহেব।
“তারপর”‚ ভারি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন নাজমা।
চোখের সামনে দেখা সেই ত্রাসিত‚ হৃদয়বিদারী দৃশ্য বর্ণনা করলেন তিনি৷ বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে সবার চোখে-মুখে ফুটে উঠল গভীর মনস্তাপ। কিন্তু সানাকে দেখাল ত্রস্ত হরিণের মতো। কেউ ভাগ্যিস খেয়াল করল না ওর হাত-পায়ের কাঁপুনি। মনের ভেতর আচমকা একটা নামই বাজতে থাকল ওর‚ “ফারনাজ… ফারনাজ ভাই!”
দু ব্যাগ রক্ত দেওয়ায় শরীর অনেকটা দুর্বল মোস্তফা সাহেবের। তাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নাজমা বেগম তাকে নিয়ে৷ তার গোসলের জন্য সানাকে গরম পানির ব্যবস্থা করতে পাঠিয়ে নিজে গেলেন খাওয়ার জোগাড়‚ গোছালো করতে।
গ্যাসে পানি বসিয়ে দিয়ে মেহাকে খেয়াল রাখতে বলে সানা এলো হঠাৎ ছাদে। ছাদে উঠল না অবশ্য৷ সিঁড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে সে কল লাগাল ফারনাজকে৷ শরীরটা ওর এখনো কাঁপছে। কোনো এক কারণে কান্নার ঢেউ এসে উপচে পড়তে চাইছে চোখে৷ বেশ কয়েকবার কলটা বাজলে তারপর রিসিভ করল ফারনাজ‚ “কীরে‚ ঠিক আছিস?” স্ফূর্তির সুরে জিজ্ঞেস করল‚ “হঠাৎ কল করলি! নিজে থেকেই না-কি কাকি বলল?”
“আপনি কিছু করেছেন?” জবাবের বদলে জবাবদিহি চাইতে শুরু করল সানা‚ “শারফানের গাড়ির ব্রেক ফেইলটা হয়েছে কি আপনার জন্য? কিছুই জানেন না কাইন্ডলি এ কথা বলবেন না।”
“জানি নিশ্চয়ই। নিউজে দেখাচ্ছে যেহেতু”‚ গম্ভীরতা চলে এলো ফারনাজের কণ্ঠে‚ “কিন্তু তোর গলা কাঁপছে কেন? তুই কি কাঁদছিস? ভালো লাগেনি শারফানের পরিণতি? মনে হচ্ছে না ও শাস্তি ভোগ করল?”
“প্রশ্ন আগে আমি করেছি‚ ভাইয়া”‚ অধৈর্যের সঙ্গে জোর গলায় বলল সানা‚ “একটা নিরপরাধ ছেলের মৃত্যুও হয়েছে!”
কিছুক্ষণ নীরব রইল ফারনাজ৷ তারপর শুধু বলল‚ “আমি বাইরে আছি‚ ব্যস্ত। আসব ওখানে৷ এসে কথা বলব সরাসরি।”
সানা কথা বলার আগেই কলটা কেটে দিলো সে। বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না ওর। বিশ্বাস করতে তবুও কষ্ট হচ্ছে‚ ফারনাজ খুনি! যে ঠান্ডা মাথায় কাউকে খুন করার পরিকল্পনা করে ফেলতে পারে! এতটাই ভয়ঙ্কর সে? এই মানুষটাকেই ওর বাবা বুকে আগলে বড়ো করেছিলেন৷ তাহলে বাবার আদর্শে বড়ো হওয়া মানুষটা কবে আর কীভাবে এমন খুনিতে পরিণত হলো? স্বার্থপর‚ মুখোশধারী ভালো মানুষ আর আপনজনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া কাপুরুষ‚ সর্বোচ্চ এতটুকু খারাপ ফারনাজ—এটাই তো জানত সে। কিন্তু তার আসল রূপটা যে আরও বর্বর তার একটুখানি ধারণাও ওর ছিল না৷ ওর ধারণা তো পরের কথা‚ ওর বাবা মানুষটাই বা কি ধারণা রাখেন? এই সত্যটা সে কী করে জানাবে এখন বাবাকে?
ফারনাজের চেহারাটা মনে পড়লেও ভয় হচ্ছে ওর। এক নির্দোষ ছেলের প্রাণটা চলে গেল৷ তার জন্য লেশমাত্র অনুশোচনা‚ অপরাধবোধ পেলো না সে ফারনাজের কণ্ঠে! কী করে পারছে লোকটা প্রফুল্ল মেজাজে থাকতে? সে তো পারছে না। ওই ছেলেটার মৃত্যু বা শারফানকে হত্যার চেষ্টার পেছনে পরোক্ষভাবে নিজেকে যে দায়ী লাগছে ওর। এমন শাস্তিই কি চেয়েছিল সে শারফানের? কিংবা এমন কিছুই হোক তা কি জাহির করেছিল ফারনাজের কাছে? নয়তো কেন ফারনাজ খুন করার মতো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল অনায়াসেই? উত্তরটা পেতে সময় লাগল না ওর। নির্বাচনের পরাজয়! পরাজয়টা মেনে নিতে পারেনি ফারনাজ! উপরন্তু ওর ঘটনাটা তার ভেতরে থাকা ছাইচাপা আগুনকে দাবানলে পরিণত করেছিল সেদিন৷
মুখটা চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল সানা। নিজের অজান্তেই ফারনাজকে অন্যায় করার প্রশ্রয় দিয়েছিল সে সেদিন৷ কিন্তু তার কাছেই বা কেন সে নির্দ্বিধায় সবটা প্রকাশ করে ফেলেছিল? তবে কি ওর অবচেতন মন চেয়েছিল শারফান শাস্তি পাক ফারনাজের মাধ্যমেই? কারণ‚ ওর এই অবচেতন মনটা জানত শারফানকে কিছু করার ক্ষমতা যদি কারও থাকে তবে তা একমাত্র ফারনাজের। এজন্যই বুঝি খুব সহজে সে আশ্রয় নিয়েছিল ফারনাজের কাছে! না‚ ফারনাজের ক্ষমতার কাছে৷ কিন্তু এখন যে সেই মনটাই প্রতিবাদ জানাচ্ছে‚ এমন শাস্তি হোক শারফানের তা এই মন মানতে পারছে না৷ হয়তোবা শাস্তিটা আল্লাহ কতৃক হলে এই অপরাধবোধ অনুভব করত না সে আর না বাপ্পির মৃত্যুর জন্য এই কষ্টটা পোহাতে হতো ওকে। এখন সে কার কাছে যাবে অনুতাপে ভারী হয়ে আসা ওর বুকের ভারটা কমাতে?
টলমল করা পা জোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর লাগল সানার৷ কারও মৃত্যুর ভার—এই মানসিক চাপটা সহ্য ক্ষমতার বাইরে গেল ওর জন্য। মাথাটা তাই ঘুরে উঠল আচমকা। দেওয়ালটা আগলে ধরার আগেই সাতটা সিঁড়ি গড়িয়ে ওর অচেতন দেহটা পড়ল গিয়ে নিচে৷ ভ্রু ও কপালের কোন কাটল আর মাথায় চোটটা বেশি লাগায় খানিকটা রক্ত বেরিয়ে এলো।
***
রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুর।
জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে কয়েক কাতারে দাঁড়িয়েছে বহু মুসল্লি৷ পথচারীরাও এসে ভিড়ছে সেখানে৷ প্রথম কাতারে দাঁড়িয়েছেন শাকিবুল আর শাফিউল সাহেব৷ বাড়ির উঠোন থেকে বাপ্পির লাশটাকে কিছুক্ষণ আগেই নিয়ে আসা হয়েছে৷ কান্নায় ভেঙে পড়া ওর বাপটাকে ওর খাটিয়ার কাছ থেকে তুলে ইমাম ঠেলেঠুলে পাঠালেন কাতারে৷ শাফিউল সাহেব এগিয়ে গিয়ে তাকে এনে নিজের পাশে দাঁড় করালেন। তাকে শান্ত করা মুশকিলই হয়ে যাচ্ছে৷ দ্বিতীয় ঘরে ছোটো-ছোটো দুটো মেয়ে সন্তান আছে লোকটার। ছেলেটাকে নিজের কাছে এনে বড়ো করার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মাকে ছেড়ে বাপের অভাবশূন্য ঘরে যেতে চায়নি বাপ্পি কখনো৷ বাপের ভালোবাসাকে দূর থেকেই গ্রহণ করেছে সে।
হঠাৎ মাঠের পাশে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল। গাড়ির দরজা খুলে নামল আগে রিহান৷ তারপরই দেখা গেল সাদ্দামদের৷ ওরা গতকাল খবর জানার পরই চলে গিয়েছিল ঢাকা শারফানের কাছে৷ ওদের সবাইকে নামতে দেখে আর শাফিউল সাহেবের বুঝতে দেরি হলো না ছেলেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি কেউ। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেই সে ছুটে এসেছে৷ তিনি এদিকে ব্যস্ত থাকায় তাকে হয়তো কিছু জানাতেও দেয়নি ছেলেটা।
গায়ে ঢিলেঢালা নেভি ব্লু রঙা টিশার্ট আর কালো কার্গো প্যান্ট শারফানের৷ গাড়ি থেকে নামার জন্য রিহান সাহায্য করতে চাইলে সে নিলো না সাহায্য৷ একাই নামল৷ মাথার তুলনায় হাত-পা‚ গায়ের চোট সামান্যই। দাঁড়ানোর পরই মাথা কেমন দুলে উঠল একটু৷ তখন সে ধরল রিহানের কাঁধ চেপে। হাতের কয়েক জায়গাতে লাগানো ব্যান্ড এইড‚ মাথার চারপাশ জুড়ে পেঁচানো ব্যান্ডেজ আর চেহারাতে এক অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যতা৷ লালচে চোখে নির্নিমেষভাবে বাপ্পির খাটিয়াটা দেখতে দেখতে এগোলো ও জানাজার কাতারের দিকে৷ কিছুটা বিস্মিত হওয়া সবার দৃষ্টি ওর ওপরই৷ আশা করেনি কেউ হাসপাতাল থেকে এই জানাজায় সামিল হতে চলে আসবে সে।
রিহান শাফিউল সাহেবকে কিছু বলতে গেলে তিনি চোখের ইশারায় বারণ করে শারফানকে ধরলেন ভালোভাবে। মৃদুস্বরে কেবল জিজ্ঞেস করলেন ওকে‚ “দাঁড়িয়ে থাকতে পারবি তো?”
কোনো উত্তর দিলো না সে৷ পাথরের মতো ওর দৃষ্টিজোড়া স্থির রইল শুধু বাপ্পির খাটিয়ার কালো গিলাফের ওপর। বাপ্পির মুখটা দেখার জন্য ওর কতটা ছটফটানি হচ্ছে তা কেউ বুঝতেও পারছে না৷ ইমাম সাহেব সবাইকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়তে বলে উচ্চস্বরে তাকবির দিলেন‚ “আল্লাহু আকবর।”
জানাজার নামাজ শেষ হলে শেষবারের মতো বাপ্পিকে দেখার জন্য ছুটে গেল ওর বাপ‚ আত্মীয়স্বজন। শারফানকে ধরে নিয়ে শাফিউল সাহেবও এলেন খাটিয়ার কাছে৷ সে দেখল বাপ্পিকে৷ মাথায় বড়ো এক আঘাত‚ চোখের কোলদুটো কালো হয়ে ফোলা‚ চোয়াল ছিলে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখ৷ মুখটাই কেমন বদলে গেছে। খাটিয়ার ওপর ঝুঁকে একবার স্পর্শ করতে চাইলো ওই মুখটা। কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয় ওর শরীর আর বাপ্পি এখন পাকসাফ। নিজেকে নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগে তাই আর ছুঁলো না তাকে। হঠাৎ বিলাপ করা এক কান্নার সুর পেছন থেকে ভেসে এলো‚ “বাজান… বাজান গো আমার! আমার বুক খালি কইরা থুইয়া চইলে যাচ্ছ‚ বাজান?”
ফিরে তাকাল শারফান। জীর্ণ শরীরের বাপ্পির অন্ধ মা’টা আসছে দুর্বল পায়ে হেঁটে। তাকে বাড়িতে আর ধরে রাখা যায়নি। জোর করেই বেরিয়ে পড়েছে৷ এক আত্মীয় পুরুষ তাকে ধরে নিয়ে এলো খাটিয়ার কাছে। হাতড়ে হাতড়ে বাপ্পির গায়ের ওপর থেকে মুখে হাত দিয়ে আর্ত স্বরে খেদোক্তি করল‚ “আল্লাহ রে! আমার চোখ দুইটা তুমি ক্যা কাইড়া নিছো আইজকে বুঝলাম। মাইনষে কইতেছে আমার বাজানরে আর চিনা যাইতেছে না৷ আমি দেখবার পারলি সইহ্য করতি পারতাম না কইয়াই তুমি আমার চোখ নিয়া নিছো! আমি কতকাল দেহি না আমার বাজানের মুখ! আর পারুমও না কুনোদিন… আমারে কী ভালোবাসতো আমার সুনা আব্বাই! বাপের কাছেও ফিরত গিলো না আমারে ছাইড়া। কইতো আমারে ছাইড়ে গেলে আমি রাস্তাঘাটে গাড়ির তলে পইড়া মরুম। আমি তো মরলাম না‚ বাজান। আমারে সাথে কইরে তুমি নিয়া গেলা না ক্যা? আর কার জন্যি আমি বাঁচুম?”
বাবার হাতটা হঠাৎ ধরল শারফান৷ ওকে হাঁসফাঁস করতে দেখে শাফিউল সাহেব রিহানকে বললেন ওকে গাড়িতে নিয়ে যেতে। ও বাধ সাধল। শুষ্ক গলায় বলল‚ “আমি যাব গোরস্থান। কবরে মাটি ফেলব।”
নিষেধ করলেন না শাফিউল৷ ছেলের মনের হাল তিনি টের পাচ্ছেন ভালোই৷ তার কঠিন ধাঁচের ছেলেটা বড়ো কোনো কষ্ট না পেলে এমন আবেগী হয় না কখনোই৷ শেষ কবে ওকে এমন দেখেছেন তাই তো মনে নেই তার৷
কাঁধে খাটিয়ার ভার বহন করার ক্ষমতা থাকলে শারফান এ অবস্থাতেই তা বহন করত৷ তাই ওর পরিবর্তে সেই ভার তুলে নিলেন শাফিউল সাহেবই। ছেলেটার মনটা যেন কিছুটা হলেও তৃপ্ত হয় এই ভেবেই৷
কবরে বাপ্পিকে শোয়ানোর পরই শারফানের চোখে ভাসল বাপ্পির শেষ হাসি মুখটা৷ কানেও যেন বাজতে থাকল তার মশকরাগুলো৷ একদিন ওকে চায়ের দোকানে এসে বসতে দেখে মুগ্ধ হয়ে উঠে বলল‚ “ওরেএএএ ভাই… কী লাগতেছে আপনারে! আপনি যা গায়ে দ্যান তাই ভাল্লাগে আমার৷ আপনার মতো ওরাম ফোলা ডেনা ক্যাম্বাই বানাব কন তো? আপনার মতো শরীল হলি আপনার জামাগুলো তালি কাইড়া রাখতাম আমি।”
সাদা টি শার্টের ওপর আকাশী বর্ণের হাফ হাতার একটা শার্ট পরেছিল শারফান৷ বাপ্পির কথায় সে হেসে ফেলে মুহূর্তেই শার্টটা খুলে তাকে দিয়ে এসেছিল সেদিন। ছেলেটার কী লজ্জা তখন! নিতে কি চায় সহজে? বাচ্চাটা মজা করলেও শারফান তো ধমক দিয়েই শার্টটা তাকে নিতে বাধ্য করেছিল৷
খুব খারাপ লাগতে শুরু করল শরীরটা৷ রিহানের সঙ্গে ও চলে এলো গাড়িতে৷ শাফিউল সাহেব ফিরলেন দাফন কাজ শেষ করে। গাড়িতে উঠে ছেলেকে বললেন‚ “হসপিটাল ফিরতে হবে কিন্তু। ডাক্তার নিশ্চয়ই ডিসচার্জ করেনি?”
“বাপ্পির মা কই?” সিটে মাথা এলিয়ে চোখদুটো বোজা শারফান। রাশভারী গলায় বলল‚ “নিয়ে আসো ওর মাকে। বাড়ি যাব তাকে নিয়ে৷ কোনো হসপিটাল না।”
জেদি সুরটা বুঝে আর কথা বাড়ালেন না শাফিউল সাহেব৷ কারণ‚ তিনি ব্যর্থই হবেন এই কথার নড়চড় করাতে৷ তাই বাপ্পির মায়ের বাড়িতে গিয়ে তাকে কোমলভাবে শারফানের চাওয়াটা ব্যক্ত করলেন৷ শারফানের সাহায্যের কথা মাঝেমধ্যেই বাপ্পি বলত তার মাকে। তাই জন্যই বোধ হয় অসহায় ওই নারী কোনো দ্বিরুক্তি করল না৷ বাপ্পির স্মৃতি হিসেবে ওর জামা-কাপড়সহ কিছু জিনিস গুছিয়ে নিয়ে চলে এলো হক বাড়িতে৷ শারফানকে নিয়ে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাড়ির সবাই৷ এর মাঝে বাপ্পির মাকে নিয়ে ছেলের সিদ্ধান্তের কথা শাফিউল সাহেব আলাদাভাবে জেসমিন বেগমকে জানালে তিনি কোনো আপত্তিই করলেন না। তাকে সাদরে গ্রহণ করে নিলেন৷ কিন্তু হাফসা বেগম হঠাৎ বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন‚ “ভালোই হইছে‚ ভাই। জেসমিন একা একা সামলায় বাড়ির সব কাজ৷ ওরও সাহায্য সহযোগিতার লোক হইলো আর বেচারিরও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হইলো।”
সোফার এক কোনো গুটিসুটি মেরে বসে তখনো শোকে ডুবে বাপ্পির মা৷ এমন মন্তব্যে তার মাঝে কোনো বিকারই ঘটল না। জবাবে জেসমিন বেগম কেবল বলতে চাইলেন‚ “উনি এমনিতেই থাকবে এখানে৷ আমার কোনো সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন নেই‚ ভাবি৷ তাছাড়া মানুষটাও অন্ধ।”
কিন্তু তার আগেই উচ্চস্বরে অমার্জিতভাবে বলে উঠল শারফান‚ “আমার মায়ের কথা বলার সঙ্গী নেই বাড়িতে৷ আমি আমার মায়ের গল্পের লোক নিয়ে আসছি৷ সে কাজের লোক কে বলল আপনাকে? এই গল্পের লোকের দেখাশোনার জন্যই কাজের লোক রাখা হবে।”
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২৪.
“প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনের ধারাটা মিলে যায় কিন্ত নিখুঁতভাবে৷ এই যে প্রকৃতি আজ শীতের শুষ্কতাই জড়িয়ে৷ সে চাইলেও এই ধারাতে চিরটাকাল স্থির থাকতে পারবে না৷ যখন গ্রীষ্ম আসবে তখন তাপদাহে পুড়তে হবে তাকে‚ যখন বর্ষা ঘনাবে তখন গ্রীষ্মের পোড়া ক্ষতের জ্বালা কমাবে বর্ষণ। প্রকৃতিকে সারাজীবনই মানিয়ে চলতে হয়‚ মেনে যেতে হয়। কারণ‚ এই পরিবর্তনগুলো তারই অংশ”‚ বলে কিছুক্ষণ থামলেন শাফিউল সাহেব। ছেলের নির্লিপ্ত মুখটা দেখে নিলেন এই ফাঁকে।
তারপর আবার বললেন‚ “মানুষও তো চাইলে জীবনটাকে একই নিয়মে‚ একই ধারাতে স্থির রাখতে পারে না৷ প্রকৃতির পরিবর্তনের মতো তাদের জীবনের গল্পও বদলায়৷ সেটা কোনো না কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে। নয়তো কোনো ঘটনা দ্বারা৷ এই বদলটাকে মেনে নিয়েই মানিয়ে চলা শিখতে হয়৷ ঠিক যেরকম প্রকৃতি খাপ খায়িয়ে নেয় নিজেকে। ঝড়ে লন্ড-ভন্ড হওয়া প্রকৃতি থেমে থাকে না যেমন৷ জীবনের গতিটাও তেমন থেমে থাকে না। যতই এলোমেলো হয়ে পড়ুক জীবনটা৷ নতুন করে আবার গড়তে হয় নিজেকে। এটাই আমাদের মেইন নেচার অ্যান্ড ফিচার।”
নীরবে শারফান একবার তাকাল শুধু৷ চোখে নিস্পৃহতা নিয়েই আবার ফিরে তাকাল অদূরে‚ মূল ফটকের পাশে রাখা নতুন ফুলগাছের টবটার দিকে। রাত নটা প্রায়৷ শীতের আধিক্যটা আমলে না নিয়ে সে বসে আছে দীর্ঘক্ষণ বাবা-মার ঘরের বারান্দাতে। এটা ওর চিরাচরিত অভ্যাস। সময় খারাপ গেলে বা গভীর চিন্তায় থাকলে সে নিজের ঘর রেখে এ ঘরের বারান্দাকে দখল করে। অথচ বাড়ির সব থেকে রুচিশীল আর পছন্দসই ঘরটা শাফিউল সাহেব ওর জন্যই বরাদ্দ করেছেন। একা একা অনেকক্ষণ সময় কাটাতে দেখে একটু আগে এসে বসেছেন তিনি ওর পাশে।
বাপ্পির মৃত্যুর চারদিন হতে চলেছে আজ৷ কিন্তু শোকটা থেকে যেন বের হতে চাইছে না ছেলেটা৷ এদিকে চুপচাপ কোনো ওজর ছাড়াই ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চলছে‚ খাওয়া-দাওয়া করছে‚ ঠিক সময়ে ঘুমাচ্ছেও। সবার চোখে এটা স্বাভাবিক দেখালেও এই চুপচাপ হয়ে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক শাফিউল সাহেবের কাছে। ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছেন ওকে গত চারদিন ধরেই৷ বাপ্পির মৃত্যুর জন্য নিজেকে যেন দায়ী না ভাবে সেজন্য কত কিছু বলে বোঝানোর চেষ্টাও চালাচ্ছেন ওকে এ কটা দিন! কিন্তু কথার জবাবে কোনো কিছুই যদি না বলে সে‚ তবে বুঝবেন কেমন করে কী ভাবছে আসলে ছেলেটা? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি৷ হঠাৎ কিছু একটা ভেবে ছেলেকে জানালেন‚ “কাল ঢাকায় ফিরব তোর চাচার সাথে৷ কোম্পানির ওপেনিং আর হক ইন্ডাস্ট্রির পার্টি‚ দুটোই স্থগিত করব গিয়ে৷ যেদিন তুই ফিরবি সেদিন তোর সুস্থতার অনারে সহই পার্টি অ্যারেঞ্জ করব অনেক বড়ো করে।”
এবার তাকাল শারফান ভ্রুদুটো কুঁচকে। অভিব্যক্তিটা পছন্দ হলো শাফিউল সাহেবের। ছেলের স্বভাবজাত প্রতিক্রিয়াগুলোই তিনি দেখতে চাচ্ছিলেন বলে সিদ্ধান্তটা মাত্রই বানিয়ে ব্যক্ত করলেন৷ কাজে দিয়েছে বুদ্ধিটা৷
“কী হয়েছে?” কপট গম্ভীরতা বাড়িয়ে বললেন ওকে‚ “ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? পনেরো দিনের আগে তুই বাড়ি থেকে নড়তে পারবি না বলে দিলাম।”
“বলেছি নড়ব?” ঠান্ডা গলায় এতটুকু বলেই আবার গুম হয়ে রইল শারফান।
শাফিউল সাহেব কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলেন আরও কবার। কাজ হলো না আর৷ এরপরই হঠাৎ আগমন ঘটল শাকিবুল সাহেবের৷ হাতে তার দাবা বোর্ড। “আয় বাপ‚ খেলি কয় দান”‚ বলতে বলতে বসে পড়লেন তিনি শারফানের মুখোমুখি। “তোর বাপের খেলার যোগ্যতা নাই। তাই ও বাদ।”
“ওই বোর্ডে যতক্ষণ আঙুল চালাব”‚ বললেন শাফিউল তাচ্ছিল্যের সুরে‚ “ততক্ষণ আমার কয়েকশো দুরুদ শরীফ পড়া হয়ে যাবে।”
“যা তো তুই… তোকে চাচ্ছে কে?” বলে দাবার বোর্ড সাজাতে শুরু করলেন শাকিবুল।
“তোমার বাপও খেলবে না”‚ কথাটা শাফিউলের ঠোঁটের ডগায় চলেই এসেছিল প্রায়৷ কিন্তু তাকে নিরাশ করে‚ অবাক করে শারফান শুরু করে দিলো খেলা। অথচ মুখটা থমথমেই৷ ফাজিল ছেলেটার মতিগতি তিনি বুঝতেই পারছেন না কোনোভাবে।
এর মাঝেই আবার আগমন নিলো মিথি—হাতে চা আর কফির ট্রে। “নিয়ে আসছিস চা”‚ মেয়েকে দেখে আমুদে গলায় বলে উঠলেন শাকিবুল‚ “তোর কাকা আর ভাইয়াকে দে আগে।”
“দিচ্ছি”‚ মুচকি হেসে চায়ের কাপ মিথি শাফিউল সাহেবকে দিয়ে বলল‚ “আমি বানিয়েছি‚ কাকা। খেয়ে দেখেন সব ঠিক আছে কি-না।”
“আমার চায়ের আর ঠিকঠাক কী?” চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন তিনি‚ “আমি সব চা-ই খাই। চা নিয়ে ফিরিস্তি দেয় তোর বাপ।”
মিথি হাস্যোজ্জ্বল মুখে সম্মতি জানিয়ে এলো শারফানের কাছে। ওর সেদিনের আচরণের জন্য কোনো ভয় বা আড়ষ্টতাই নেই তার মাঝে। ওসব ধমকের কথা মনে রাখার প্রয়োজন কখনো মনে করে না সে৷ কতবার অমন ধমক খেয়েছে সে আজ অবধি! তার থেকেও বড়ো ভারী জিনিস পড়েছে তার দু’গালে অগণিতবার। সেই খবর তো কাউকে জানানোর সুযোগও পায়নি। আর তা ভুলেও গেছে সে৷ পছন্দের মানুষ মারবে‚ বকবে আবার সময় হলে ভালোওবাসবে‚ এটাই তার ধারণা। শারফানকে বলল‚ “তোমার জন্য কফি করেছি‚ ভাইয়া।”
দাবার গুটি সাজাতে সাজাতেই হাতটা বাড়িয়ে নিলো সে। কিন্তু শাফিউল সাহেব আপত্তি করে উঠলেন‚ “অমন কড়া কফি খেতে কে বলেছে তোকে? রাতে ঘুমানো লাগবে না?” মিথিকে বললেন‚ “কফিটা নিয়ে নে তো‚ মা।”
মিথির হাসিটা সরে গেল। মনে মনে বিরক্ত হলো বেশ চাচার ওপর। কত শখ করে বানিয়ে আনল সে শারফান খুশি হবে ভেবে। শারফানও তো সাগ্রহেই কফিটা নিলো৷ এখন নাকি সেটা ফিরিয়ে নেবে সে? মেকি হেসে তাই বলল‚ “ভাইয়া তো খাবে মনে হয়।”
“এখন টোটালি কফি টফি বাদ”‚ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি জেসমিন বেগমের উদ্দেশে‚ “এই‚ তুমি কী করো‚ হ্যাঁ? দুধ না খায়িয়ে কফি খাওয়াতে বলেছে তোমাকে ডাক্তার?”
ঠিক সে সময়ই হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল জারা‚ “আম্মুর ওপর চেঁচাচ্ছ কেন?” বাবাকে জানাল‚ “আম্মু দুধ জ্বাল করতে দিয়ে জোবেদা খালার ঘরে গিয়েছিল৷ সেই ফাঁকে মিথি আপা কফি বানিয়ে নিয়ে চলে আসছে।”
বলার পর জারা বিরক্তির সঙ্গে তাকাল একবার মিথির দিকে। তখন মিথির চেহারাটা বেশ বিব্রতপূর্ণ৷ তাকে মূলত নিষেধ করেছিল ও কফি করতে৷ কিন্তু ওর কথাকে অগ্রাহ্য করেই নিয়ে এসেছে সে কেবল শারফানতে সন্তুষ্ট করতে। শারফানও সত্যিই এত কথার ধার না ধেরে ইতোমধ্যে কফিতে চুমুকও দিতে শুরু করেছে৷ তা দেখে শাফিউল গিয়ে মগটা ছোঁ মেরে নিয়ে দিলেন এক ধমক ছেলেকে‚ “দুধের গ্লাস নে‚ ঘাউড়ার ছা!”
“তুমি খাও দুধ”‚ পালটা ধমক লাগাল শারফানও‚ “স্কুলের শায়াফ পেয়েছ?”
“তুই স্কুলের শায়াফ হ আর হক ইন্ডাস্ট্রির মালিক… থাপড়ে তোর কানপট্টি গরম দিতে পারব এখনো। দেখবি?”
“আরে কী শুরু করলি তোরা বাপ ব্যাটা”‚ হতাশার সুরে বললেন শাকিবুল‚ “আশেপাশের মানুষ শুনলে এতক্ষণে হাসাহাসি করত তোদের নিয়ে।”
ছেলেকে কটাক্ষপাত তবুও থামালেন না শাফিউল‚ “নিজেকে কত বড়ো সাইজের মালিক ভাবো‚ হ্যাঁ? বলে কিনা স্কুলের শায়াফ পেয়েছ! তুই ওরকম বাইশ‚ কুড়ি কোম্পানির মালিক হলেই বা কী? তোকে মান্য করবে আমার পায়ের মোজা।” শেষে বললেন মেয়ের উদ্দেশে‚ “দে‚ গ্লাস দে ওর হাতে।”
জারা দাঁত দেখিয়ে হাসতে হাসতে শারফানের হাতে জোর করে ধরিয়ে দিলো গ্লাসটা আর টিটকারির সুরে বলল‚ “আম্মু আবার তার গ্যাদার জন্য দুধে হরলিক্সও দিয়েছে। খা‚ গ্যাদা। তাড়াতাড়ি লম্বা হবি‚ হেলদি হবি।” বলেই দ্রুত সরে পড়ল ভাইয়ের হাতের কাছ থেকে৷ নয়ত ঝুঁকি থেকে যায় গালে এক থাবড়া পড়ার।
কিন্তু গোপনীয় বিষয় হলো‚ দুধের সাথে হরলিক্স গুলে খেতে স্বাদই লাগে শারফানের৷ শেষবার খেয়েছিল বোধ হয় এসএসসি নাকি এইচএসসি পরীক্ষার সময়গুলোতে যেন৷ মা-ই খাওয়াত৷ এজন্যই এই গোপন তথ্য আর কেউ না জানলেও জেসমিন বেগম জানেন। স্বাদটাও যেন এখনো ভোলেনি শারফান। তাই জারার ঠাট্টাকে পাত্তা না দিয়ে ঢকঢক করে মেরে দিলো দুধটুকু। তাতে অবশ্য বাকিরা অবাকই হলো৷ তাদেরও ধারণা ছিল‚ জারাকে মেজাজ দেখিয়ে হয় তাকে দেবে এক গাট্টা আর নয়তো দুধের গ্লাস দেবে ফিরিয়ে। ছোটো বাচ্চাদের মতো ধমকে যদি এমন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে দুধ খাওয়াতে চায় বাবা‚ চোটপাট তো সেখানে করারই কথা৷ তার ওপর যদি হয় ওর মতো রগচটা ছেলে।
“চিনি কম দিতে বলবি আম্মুকে”‚ স্বাভাবিক গলাতে বলে গ্লাসটা ধরতে ইশারা করল সে জারাকে।
শাফিউল সাহেব কিঞ্চিৎ অবাক হলেও তা প্রকাশ করলেন না৷ জারা গ্লাসটা ফিরিয়ে নিয়ে শেষ আরেকটা খোঁচা দেবে ঠিক সে সময়ই বাড়ির সদর গেটে প্রবেশ করল একটা বাইক। বাইকে বসা সাদ্দাম আর অনি। সেদিকে একবার তাকিয়ে নির্বিকারভাবে নজর ফিরিয়ে নিয়ে শারফান জিজ্ঞেস করল জারাকে‚ “তোর জোবেদা খালা খেয়েছে? কী করছে?”
“ওর জোবেদা খালা হলে তোর কী?” বাঁকা সুরে বললেন শাফিউল‚ “শুধু খালা বলা যায় না?”
ভদ্র‚ সভ্য মানুষের মতো শারফান কাউকে চট করেই আন্তরিক কণ্ঠে এমন সম্বোধন করতে পারে না কেন যেন। বেশ সময় লাগে এই ডাকাডাকির সঙ্গে ওর সহজ হতে। কিন্তু তাজ্জব ঘটনা ঘটেছে কেবল মোস্তফা সাহেবের বেলাতে। যাকে প্রথমবার দেখাতেই অনায়াসে ‘আঙ্কেল’ ডেকে উঠেছিল সে৷ ডাকার পূর্বে দু সেকেন্ডর জন্যও সঙ্কোচ হয়নি ওর। অথচ এক্ষেত্রে হলো বেশ। বাবার কথাকে এড়িয়ে তাই পূর্বের সম্বোধনে ফিরে গেল সে‚ “খোঁজ নিয়েছিস বাপ্পির মার?”
“হ্যাঁ”‚ জারা বলল‚ “আম্মু জোরাজুরি করে কটা খাওয়াতে পেরেছে। কিন্তু কান্নাকাটি থামে না। তখন নামাজে বসেও কাঁদছিল খুব৷ তা শুনেই তো আম্মু গেল ওনার ঘরে।”
“একা একা থাকলেই কাঁদে বেশি”‚ বলল হঠাৎ মিথি।
শাকিবুল সাহেব বললেন‚ “সবার শোক কেটে গেলেও মার শোক কাটতে সময় লাগে তো।”
ঘরে প্রবেশ করল এ সময় সাদ্দামরা। শাফিউল আর শাকিবুল সাহেবের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে এলো শারফানের কাছে। দাবার বোর্ড সরিয়ে রেখে অনি বলল‚ “চল ব্যাটা‚ নিচে থেকে হেঁটে আসি।”
“না”‚ প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করল শারফান‚ “রাস্তায় যেতে পারব না এখন।”
সাদ্দাম ছোটো করে এক থাপ্পড় বসালো ওর বাহুতে‚ “কেন রে শালা? নতুন বউ হয়েছ তুমি?”
“রাস্তায় না গেলে কর্টইয়ার্ডে যা”‚ বললেন শাফিউল‚ “হাঁটাহাঁটি করে আয় কিছুক্ষণ।”
মিথি আর জারা এর মাঝেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে৷ বাবার এ কথাকে আর অগ্রাহ্য করল না শারফান৷ বন্ধুদের সাথে নেমে এলো বাড়ির আঙিনাতে। সামনে ফাঁকা জায়গা অনেকখানিই৷ ছোটোবেলায় শীতকালে এখানে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট করা হতো৷ আশেপাশের ছেলেপুলেরা এসে রোজ খেলত শারফানের সাথে৷ মাঝেমধ্যে অনিরাও আসত। অতীতের স্মৃতিচারণ করে সাদ্দামই বলল‚ “একটা কোর্ট বানিয়ে ফেল‚ শারফান৷ বাড়ি যে কদিন আছিস‚ চল সে কদিন র্যাকেট খেলি। গায়ে গতরে চর্বি জমে যাচ্ছে সবগুলোর।”
“তোদের জমছে। আমার না”‚ বলল শারফান।
হঠাৎ রিহানকে দেখা গেল বাসার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে৷ শারফানের দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরদিনই ওর পরিবারও এসে হাজির হয়েছে হক বাড়িতে। চলে যাবে সবাই কাল-পরশুর মাঝেই।
রিহান এসে তাদের মাঝে দাঁড়ানোর পর অনি জিজ্ঞেস করল‚ “ইনভেস্টিগেশনের কী খবর? কত দূর এগোলো?”
“বালের ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে”‚ খিস্তি করে বলল রিহান‚ “কিছুই এগোয়নি। এর মধ্যে আবার…”‚ শারফানকে ইশারা করল সে‚ “ও পুলিশকে বলল গ্যারেজের সবাইকে ছেড়ে দিতে। ওরা নাকি নির্দোষ। শুধু শুধু ধোলাই দেওয়া হচ্ছে ওদের। তাই শুনে পুলিশ ওদের ছেড়ে দেওয়ার পর কাজে আরও ঢিলেমি শুরু করেছে তারা।”
“কাকা কিছু বলছে না?” পুনরায় জিজ্ঞেস করল অনি।
“পিবিআইকে কেস হ্যান্ডওভার করবে ঢাকায় ফেরার পর। সরাসরি কথা বলবে কোন এক চৌকশ অফিসারের সাথে যেন।”
এরপর সাদ্দাম জিজ্ঞেস করল শারফানকে‚ “গ্যারেজের কেউ যে জড়িত না তুই কীভাবে এনশিউর করলি পুলিশকে? তোর গাড়ি যেখানে হেফাজতে ছিল সেখানের কেউ যদি লিকেজ না করে তাহলে করবে কে?”
শারফানের উদাসীস দৃষ্টি দূরে উদ্দেশ্যহীন কোথাও গিয়ে পড়ে আছে। সাদ্দামের প্রশ্ন কানে গেলেও জবাবের পরিবর্তে হঠাৎ হাত বাড়াল তার দিকে। পকেট থেকে তখন সিগারেট আর গ্যাস লাইটটা বের করে দিলো সাদ্দাম৷ ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট গুঁজে নিয়ে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে কথা বলল শারফান‚ “কার বুকের পাটায় কত সাহস তা আমার জানা আছে।” বলে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সময় নিয়ে। তারপর বলতে শুরু করল‚ “এই এলাকার স্থানীয় কেউ কোনোদিন টাকার কাছে বিক্রি হয়ে হক বাড়ির মানুষের ক্ষতি করার আস্পর্ধা দেখাবে না৷ যেখানে আরও গ্যারেজের ওই ছেলেগুলোর সাথে একটা সময় স্কুল ছুটির পর এক সঙ্গে মাঠে-ঘাটে খেলে বেড়িয়েছি‚ সাঁতার কেটেছি। পুলিশের চো** খেয়ে মুখ বন্ধ রাখার মতো দম ওদের নেই। এ হিসেব আব্বুরও করা আছে বলেই আপত্তি করেনি ওদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলার সময়। তাছাড়া যদি কেউ জড়িত থাকেও তাহলে তাকে ছেড়ে দিয়েই ক্লু পাওয়া যাবে। আটকে রেখে নয়। নজরদারির ওপর আছে ওরা।”
“হুঁ‚ ঠিক”‚ সহমত পোষণ করল অনি।
“কিন্তু আমরা তো জানি এই খুনের পিছে কার ব্রেইন চলেছে।” রিহান প্রশ্ন করল‚ “তাহলে পুলিশ যখন জিজ্ঞেস করল আর কেউ সন্দেহভাজন আছে কিনা আমাদের দৃষ্টিতে? তখন মামাকে বলতে বারণ করলি কেন ফারনাজের নাম?”
“পিবিআইকেও তো বলতে দেবো না আমি।”
“কেন?” সমস্বরে জিজ্ঞেস করল তিনজনই।
“দ্বিতীয় কারণ‚ আমাকে অসংখ্যবার বলা হয়েছে ফারনাজ ঝানু মাল। ইলেকশনের আগে তার প্রমাণও টুকিটাকি পেয়েছিলাম ঢাকায় যখন লিংক লাগিয়েছিলাম।”
“আর প্রথম কারণ কী?” জিজ্ঞেস করল আবারও তিনজনই।
সময় নিয়ে জবাব দিলো শারফান ‚ “ওকে কুক করার জন্য আমি আমার রেসিপি ফলো করব… পুলিশের না।”
ওর পরূষ‚ তেজোদীপ্ত কণ্ঠে ভীষণ অশুভ কিছুর ইঙ্গিত পেলো সবাই৷ তারা কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর পূর্বে শারফানই বলল‚ “আমার কাজে সো কল্ড আইনি বাঁধা আসতে দিতে চাই না আমি। তাছাড়া…” একটু ভাবান্তর দেখাল ওকে‚ “আমাকে কনফিউজড করে রেখেছে বিশেষ আরেকটি মানুষ। আমি তাকে নিয়ে গত চারদিন ধরেও ভেবে কোনো ফাইনাল স্টেজে পৌঁছতে পারছি না৷ বিশ্বাস‚ অবিশ্বাসের দোলাচলে ভুগছি। কিন্তু ক্লিয়ার হতে হবে খুব দ্রুত তাকে নিয়েও।”
নামটা উল্লেখ করল না বিধায় সবাই বারবার জিজ্ঞেস করল ব্যক্তির পরিচয়। জিজ্ঞেস করল ফারনাজকে নিয়ে কী ভেবে রেখেছে সে? কিন্তু কোনোভাবেই আর কথা বলাতে পারল না কেউ শারফানকে৷ শুধু রিহান কিছুটা আন্দাজ করল ব্যক্তিটির পরিচয় সম্পর্কে।
রাত সাড়ে দশটায় অনি‚ সাদ্দাম বিদায় নিলো। কিন্তু যাওয়ার পূর্বে ওরা একবার আলাদাভাবে কথা বলল শাফিউল সাহেবের সঙ্গে৷ তার পরামর্শেই আজ এভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলেছে ওরা শারফানের সঙ্গে—ওর পেট থেকে কথা বের করার উদ্দেশে।
ওদের থেকে সব কিছু শোনার পর মোটেও চমকাতে দেখা গেল না শাফিউলকে৷ তিনি আগে থেকেই একটু অনুমান করতে পারছিলেন ছেলের অস্বাভাবিক চুপচাপ হয়ে থাকা দেখে৷ অনি তাই বলল‚ “কাকা‚ আপনার ছেলেকে আপনার থেকে ভালো আর কে বুঝবে? ঠিকই ভেবেছিলেন৷ ও যতটা না শোকগ্রস্ত‚ তার চেয়েও বেশি ব্যস্ত ভেতরে ভেতরে ফন্দি আঁটতে। যা কারও সঙ্গেই শেয়ার করতে চায় না বিধায় এমন ঠান্ডা মেরে আছে৷”
“কাকা‚ কিছু বদমেজাজি মানুষরা হয় এমন যারা শুধু রাগ জাহির করতে পারে চিৎকার-চেঁচামেচি আর ভাংচুর করে”‚ অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত বোঝাতে বলল সাদ্দাম‚ “তবে মাথার ভেতরটা থাকে তাদের খোখলা। আপনার ছেলে কিন্তু তেমন না। ও শর্ট টেম্পারড হতে পারে। কিন্তু ওর সময় বিশেষে ও হয়ে ওঠে ধীর মস্তিষ্কের খেলুড়ে। আমি এসে যখন ওকে দাবা বোর্ডের সামনে দেখলাম‚ তখনই বুঝেছি ও আর যা-ই হোক শোকে অমন চুপচাপ হয়ে যায়নি। নিজের গায়ে অমন আঘাত আর বাপ্পির মৃত্যু‚ এর কোনোটার জন্যই ও অল্পতে ছাড়বে না ফারনাজকে। প্রায় জারার বয়সী ছিল বাপ্পি৷ বাচ্চাটাকে তাই মনে মনে ভালোই স্নেহ করত। এখন চিন্তার বিষয় কী করতে চাচ্ছে ও ফারনাজকে।”
সাংঘাতিক চিন্তায় পড়ে যান তখন শাফিউল‚ “অফিস গিয়ে বসতেই হবে আমাকে৷ ও তো অসুস্থ। ভাইও তো সময় দিতে পারবে না বেশি। না যেয়ে উপায় নেই আমার৷ তোদের ওপর ভরসা করে ওকে রেখে যাব আমি৷ ও বাইরে বের হলে কোনোভাবেই ওকে একা ছাড়বি না। যতক্ষণ পারবি সবাই নজরে নজরে রাখবি ওকে। নয়তো আমি যে ওয়েতে ফারনাজকে হাজতে নিতে চাচ্ছি তার সুযোগ পাবো না৷” এ কথার পরই ওদের বিদায় জানান তিনি।
***
এঁটো হাতটা ধুতে ধুতে জিজ্ঞেস করল ফারনাজ‚ “জ্বর কমেনি সানার?”
“হ্যাঁ‚ আজকে দুপুর থেকেই কম”‚ বললেন নাজমা‚ “মাথার সেলাই কাটতে হবে কালকে।”
“হাসপাতাল নেওয়ার দরকার নেই। ফেরার পথে আমি রুহল ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে কথা বলব। উনি এসে কেটে দিয়ে যাবেন।”
“বলে রেখেছে তোর কাকা৷ সকালে আসতে চেয়েছে।”
“ও আচ্ছা‚ তো ঘুমাচ্ছে নাকি সানা?”
“হবে হয়তো”‚ একটু মন খারাপের গলায় বললেন তিনি‚ “তাড়াতাড়িই তো ঘুমিয়ে যাচ্ছে এ কদিন। মাথা ফেটেছে পর থেকে আজ কটা দিন ধরে শুধু ঘরেই শুয়ে‚ বসে থাকছে। কেমন মনমরা দেখায়। মেজাজও খিটমিটে হয়ে গেছে।”
“একটু দেখে আসি।”
ঘরে মেহাও আছে বিধায় আর আপত্তি জানালেন না নাজমা। টেবিলের এঁটো প্লেট গোছাতে শুরু করলেন তিনি৷ ফারনাজ সানার ঘরে ঢুকল তখন। টেবিলে বসে মেহা পড়ছে আর সানা লেপের নিচে প্রায় মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাত সবে দশটা। এত জলদি সে ঘুমায় না কখনো‚ তা সে জানে। গত চারদিনে যতবার এসে দেখেছে ওকে বুঝতে পেরেছে ততবারই‚ মেয়েটা গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে আছে। মনে অপরাধবোধের বিশাল পাহাড়৷
গত পরশু ওদের মাঝে কথা হয়েছিল কয়েক মিনিট। সরাসরি ফারনাজকে সানা অভিযুক্ত করেছিল শারফানের গাড়ি দুর্ঘটনার ব্যাপারে৷ কিন্তু স্বচ্ছন্দে ফারনাজ তা অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছে‚ সে কোনোভাবেই জড়িত নয় শারফানের দুর্ঘটনার সঙ্গে। কিছুই জানত না সে। যদিও তা বিশ্বাস করেনি সানা। কিন্তু তার পর থেকে ও ফারনাজকে কঠিনভাবে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। একটা বাক্য বিনিময় তো দূর‚ এমনকি গতকাল তাকে সবার সামনেই চরমভাবে অপমানের সুরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল। সেজন্য জন্য আবার বাবা-মা‚ দাদীর কাছে বেশ বকাঝকাও শুনতে হয়েছিল ওকে। নেহাৎ অসুস্থ বলেই অমন আচরণের জন্য কেউ জবাবদিহি চায়নি সেভাবে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সানাকে দেখতে দেখতে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল ফারনাজ৷ আর মনের সংগোপনে ওকে বলল‚ “আমি আশা করিনি তোকে এই অবস্থায় দেখতে হবে আমার। আমি সহ্যও করতে পারছি না তুই শারফানের পরিণতিতে খুশি না হয়ে উলটে তোর রোষানলে ফেলেছিস আমাকে। শারফান কি ওই ভয়ঙ্কর শাস্তিটাই ডিজার্ভ করে না‚ সানা? ও যা স্পর্ধা দেখিয়েছে আর যা করেছে আমার ক্ষতির জন্য‚ এর শাস্তিস্বরূপ ওকে তো এমনিতেই আমি নিকাশ করে ছাড়তাম। দুর্ভাগ্য ওই ছেলেটার যে নিজের অজান্তেই মৃত্যু ফাঁদে পা দিয়েছিল৷ তাই তার মৃত্যুর দায়ভার শুধু তারই৷ তোরও না‚ আমারও না৷ তাহলে বোকার মতো কেন তার মৃত্যুর দায়ভার নিজের কাঁধে নিচ্ছিস তুই? এত বোকা… এত সরল কেন হয়েছিস তুই?”
সে টেরও পেলো না তারই মতো গভীর চোখে তাকেও দেখছে কেউ। মেহার উপস্থিতি সে বেমালুম ভুলেই বসেছে।
আজ একটি বিষয় স্পষ্ট বুঝতে পারল মেহা। বোনের প্রতি ফারনাজের চাউনিটা অন্যরকম… ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ৷ আজ বললে ভুল হবে‚ এ বিষয়টি গত কয়েকদিন ধরেই লক্ষ করছিল সে৷ কিন্তু তখন দ্বিধায় ভুগলেও এ মুহূর্তে আর কোনো দ্বিধা হচ্ছে না নিজের ভাবনা নিয়ে। তবে আশ্চর্য লাগছে যে‚ তার কেন যেন খু্ব একটা কষ্ট অনুভব হচ্ছে না। এ মুহূর্তে সে আরও একটি বিষয় উপলব্ধি করল‚ সেই মিছিলে আহত হয়ে ফেরার দিন থেকেই ফারনাজকে কেন্দ্র করে তার আনাড়ি আবেগ কেমন মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। আর এতদিন সানা ফারনাজের স্বার্থপর চরিত্রটা নিয়ে যেখানে তাকে হাজারবার বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে‚ সেখানে মিছিলের ওই একটা দিনের ফারনাজের আচরণগুলোকে সামঞ্জস্য করার পর খুব সহজেই সে টের পেরেছে যে আত্মীয় হিসেবে ফারনাজ আদতেই কতখানি স্বার্থপর।
***
সকাল ৮:৫০ মিনিট ।
শারফানকে খিস্তিখেউড় করতে করতে রিহান গাড়িতে চেপে বসল। বসতে না বসতেই শাঁ করে গাড়িটা চলতে আরম্ভ করল। চোখে-মুখে কোনোরকমে ঠান্ডা পানির ঝাপট মারার সুযোগ পেয়েছিল সে। দাঁতটাও ব্রাশ করতে পারেনি।
মিনিট বিশেক আগে চোখের ওপর তীব্র আলো এসে পড়ায় ঘুমটা ভেঙেছিল তার। তখন বুঝল ঘরে লাইট জ্বালানো হয়েছে৷ আর তা কিনা জ্বালিয়েছে শারফান! যার ঘুমই ছাড়ে বেলা বারোটারও পরে গিয়ে৷ জুল-জুল চোখে তখন দেখতে পেলো সে‚ কালো ব্যাগি জিন্স আর ধূসরবর্ণের পশমি হুডি পরে শারফান তৈরি হচ্ছে। বুঝতে তার দেরি হয়নি কোথাও একটা বের হবে দাঙ্গাবাজটা৷ এই সাতসকালে কোথায় যাবে ও তা প্রশ্ন করেও উত্তর মেলেনি৷ এদিকে মামার কঠিন নির্দেশ যেন একা কোথাও ওকে যেতে না দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ মানতেই কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে সে দৌড় দিলো ওর পিছু পিছু৷
আগাপাছতলা ওকে দেখে মুখ বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল সে‚ “এমন ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার সেজে যাচ্ছিস কোথায়?”
“কী?” ভ্রু কুঁচকে তাকাল শারফান।
“কী আবার কী? হুডি মুড়ি দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে‚ কাউতে কিছু না বলে বের হলি কেন? এখন চলছিস কোথায়? মামা জানলে…”
কথা শেষ করতে দিলো না শারফান‚ “মামার নেংটি ছানা‚ তোকে কে বলেছে মামার কম্বলের তল থেকে ফাল মেরে উঠে আমার পিছু আসতে?”
“চুপ যা‚ হারামজাদা! তুই কি শান্তিতে কাউকে ঘুমাতে দিস? বল এখন‚ কোথায় যাচ্ছিস?”
মুখের অভিব্যক্তি শারফানের গুরুগম্ভীর‚ “লেজুড় যখন হয়েছিস তখন দেখতেই পাবি। চুপচাপ বসে থাক‚ কথা কম বল।”
“তা হুডি মুড়ি দিলি কেন হঠাৎ? তুই তো তোর বালের স্টাইল শো করে বেড়ানো ফটকাবাজ৷ আজকে সেই বাল ঢেকে ফেললি যে?”
“তা কী করব? পেছনের হাফ টাক দেখাব মানুষকে?”
সার্জারির কারণে মাথার পেছনে অনেকখানি চুল নেই শারফানের। তা মাত্র খেয়াল হলো রিহানের। হা হা করে ভিলেনদের মতো হাসতে মন চাইলো খুব৷ খেপানোর বিশাল একটা সুযোগ পেলো কিনা! কিন্তু এখন খেপানো যাবে না৷ কারণ‚ শারফানকে দেখাচ্ছে বেশ চিন্তানিমগ্ন।
কিছুক্ষণ পরই রিহান চিনতে পারল রাস্তাটা। কিন্তু অনুমান পুরোপুরি না মেলা পর্যন্ত কোনো কথা বলল না সে৷ মিনিট দশেক পরই যখন গাড়িটা থামল মোস্তফা সাহেবের বাড়ির সামনে তখন সে বিস্ময় নিয়ে মুখ খুলল‚ “সিরিয়াসলি? সানার বাড়িতে ঢুকবি তুই?”
কোনো উত্তর না দিয়েই শারফান গাড়ি থেকে নেমে গটগটিয়ে ঢুকে পড়ল বাসার গেটের ভেতর। রিহানের তো ওর পিছু নেওয়ায় কাজ।
মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপল মাত্র একবারই৷ নাজমা বেগম এসে খুললেন অল্প সময়ের মাঝেই৷ শারফানকে আগে না দেখলেও গত তিনদিন আগে ওকে টিভিতে দেখায় চিনতে পারলেন সহজেই৷ মেহার সাথে চেহারায় মিল আছে নাজমার৷ তাই শারফান টের পেলো তার পরিচয়৷ “আসসালামু আলাইকুম”‚ যতটা সম্ভব নম্রসুরে বলল তাকে‚ “মোস্তফা আঙ্কেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি৷ আছেন আঙ্কেল?”
“আপাতত বাসায় নেই৷ বাজারে গেছে একটা কাজে৷ কিন্তু চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই৷ তুমি ভেতরে এসে বসতে পারো।”
“থ্যাঙ্ক ইউ”‚ বলে ঘরে ঢুকে পড়ল শারফান চট করেই।
ওরা বসার পরই নাজমা শারফানকে বললেন‚ “তোমার কথা কাল রাতেও বলছিল সানার আব্বু৷ এখন কেমন আছ তুমি?”
যতটুকু জড়তা কাজ করছিল শারফানের তা একদম দূর হয়ে গেল ভদ্রমহিলা ওকে চেনেন বিধায়। মুচকি একটা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল সে‚ “আগের থেকে অনেকটা ভালো। আঙ্কেল যেভাবে হেল্প করেছিলেন তা আব্বুর কাছে শুনেছি। তাই একটু সুস্থ হতেই দেখা করতে এলাম ওনার সঙ্গে৷ থ্যাঙ্কস বললেও তো কম হবে আসলে।”
রিহানের অবস্থান এ মুহূর্তের অবাকের চূড়াতে। তার ত্যাঁদড় মার্কা মামাতো ভাইটা নাকি ধন্যবাদ জানাতে কারও বাসা অবধি চলে এসেছে! তাও কিনা যখন নাশতা করে মানুষ তেমন সময়ে! এই মহিলা যদি টের পান তার মেয়ের জীবনের বিভীষিকা এসে হাজির হয়েছে তার ড্রয়িংরুমে? তাও আবার সেই মেয়েকে দর্শন দিতেই? প্রতিক্রিয়া কী আসতে পারে তা আর ভাবতে চাইলো না সে৷
কুশলাদি বিনিময়ের মাঝে শারফান আচমকা জিজ্ঞেস করে বসল‚ “সানা আর মেহা কেমন আছে?”
অপ্রস্তুত হয়ে বসে থাকা রিহান একবার খেয়াল করল নাজমা বেগমের চেহারাটা৷ না‚ অস্বাভাবিক কিছু মনে করেননি তিনি৷ সাধারণভাবেই নিয়েছেন বোধ হয়৷
তিনি ওদের দু বোনের খবর জানানোর মাঝেই ভেতরের ঘর থেকে সানার কণ্ঠ এলো। কী জন্য যেন ডাকছে সে মাকে। গলাটা শোনা মাত্রই শারফান আফসোসের সুরে বলে উঠল‚ “আহারে! তিনটা সেলাই পড়েছে মাথায়! তাহলে তো বেশখানিক কেটেছিল৷ পড়াশোনাতেও তাহলে অনেক গ্যাপ পড়ছে।”
“হ্যাঁ‚ তা তো পড়ছেই”‚ আফসোস প্রকাশ করলেন নাজমাও‚ “প্রাইভেটেও যেতে পারছে না কতদিন হলো!”
“শুনে খারাপ লাগল বেশ”‚ কপট দুঃখী কণ্ঠে বলল শারফান৷ তারপরই চূড়ান্ত সাহসের পরিচয়টা দিলো সে। বলল নাজমা বেগমকে‚ “একটু ডাকুন ওকে। দেখি কী অবস্থা?”
এবার চেহারার অভিব্যক্তি কিছুটা বদলাল নাজমা বেগমের৷ আন্তরিকতার হাসিটা সরে পড়ে সন্দেহ এসে ভিড়তে চেষ্টা করল তার মুখটাই। রিহানের হাঁসফাঁস লাগল তা বুঝতে পেরেই৷ তাই ভুলেও আর তাকাল না সে তার দিকে।
অতীতে তিনবার শারফান উপকার করেছে তার পরিবারকে—এজন্যই পরিপূর্ণ আন্তরিকতা বজায় রাখলেন নাজমা। একটুখানি সন্দেহটা মনে নিয়েই ডাকলেন তিনি সানাকে৷
হাত-মুখ ধুয়েছে সবে সানা। মুখের পানি মোছা হয়নি এখনো৷ মায়ের ডাকে মুখটা মুছতে মুছতেই এলো সে বসার ঘরে৷ হাতে গামছা ধরে রাখা অবস্থাতে ওর দৃষ্টি পড়ল সোফায়—হৃৎপিণ্ডটা অমনিই যেন ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে উঠল৷ ওকে কথা বলতে বলে চলে গেলেন নাজমা নাশতার আয়োজন করতে আর মেহাকে ঘুম থেকে তুলতে৷ কারণ‚ পাহারাদারের দায়িত্ব গছাবেন এখন মেহার ঘাড়ে।
ভেতরের ঘরের দরজার পর্দাটা ফাঁকা হয়ে আছে কিছুটা৷ সেই ফাঁকা দিয়ে উঁকি দিয়ে শারফান দেখল‚ ওপাশের ঘরে কেউ আছে কি-না৷ মনে হলো কেউ নেই। আকস্মিক দাঁড়িয়ে পড়ল সে তখনই। পকেটে দু হাত পুরে হেঁটে এলো সানার কাছে৷ আপাতত সে স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই।
কেমন গভীর চোখে সানার সারা মুখটাতে চোখ বুলাল শারফান৷ ডান ভ্রুতে কাটা চিহ্ন‚ কপালের ডান কোনেই আরেকটা কাটা চিহ্ন৷ আর সেলাইটা পড়েছে বোধ হয় মাথার বাঁ পাশে। একটু আগে নাজমা বেগমের মুখে এই আঘাত পাওয়ার কথা শুনে খুব একটা খারাপ লাগা অনুভব হয়নি। কিন্তু সামনা-সামনি দেখতে কেন যেন মোটেও ভালো লাগল না ওর। এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করা‚ চোখের নিচটা দাবা‚ ভরাট গালদুটোও অনেকটা চেপে গেছে। অর্থাৎ জ্বরে পড়ে একদম শুকিয়ে গেছে। না-কি আরও কোনো কারণ থাকতে পারে? শেষ কথাটা হঠাৎই মনে হলো শারফানের।
“আমাকে সুস্থ দেখে নিশ্চয়ই খুশি হওনি?” একদম অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করল সে সানাকে।
চলবে।