মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-৩৯+৪০

0
67

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩৯.

পরনের অর্ধখোলা জামাটা সেদিনের জামা‚ যেদিন মেলাতে জারার সঙ্গে কথা হয়েছিল ওর৷ কেমন জড়বস্তুর মতো শুয়ে আছে মেয়েটা‚ আর তার সঙ্গে ওই লোকটা ফারনাজ! তাকে চেনা মাত্রই নিজের বিপদের ভয় ভুলে গেল সানা। সীমাহীন বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। সেদিন কেন শারফানের মুখে ‘কিডন্যাপার’ কথাটা শুনেছিল‚ এ মুহূর্তে তা একেবারে পরিষ্কার হয়ে উঠল। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ফারনাজ আবারও শিকার করল আরেক নিরীহ‚ নিরপরাধ মানুষকে! জারাকে খুব আদর করে শারফান—তা মনে পড়ল সানার। মনে প্রশ্নেরও উৎপত্তি হলো অনেক। কিন্তু তা জিজ্ঞাসা করতে চেয়ে চোখ তুলতেই শারফানের টলটল করা নিবিড়‚ নিষ্পলক চোখদুটো তাকে থমকে দিল। মুহূর্তে কেমন করে উঠল যেন তার বুকের ভেতর—লোকটা কাঁদছে!

“ভালো লেগেছে নিশ্চয়ই?” বিদীর্ণ কণ্ঠে হঠাৎ বলে উঠে শারফান। তারপর আর থামল না।

“পহেলা ফেব্রুয়ারিতে ওর আঠারো হলো৷ কিন্তু আমি কোনোবারই ওর জন্মদিন ঠিকমতো মনে রাখতে পারি না৷ তার জন্য ফোন করে রাগারাগি করত আর বলত‚ ‘ডাবল গিফ্ট চাই।’ ডাবল গিফ্ট পাওয়ার আশায় ফেসবুকের নোটিফিকেশন পেয়েও যেন মনে না করতে পারি তাই নিজের বার্থডেট হাইড করে রাখত পাগলটা। এবারে আর আমাকে ডাবল গিফ্ট দিতে হয়নি৷ উলটে আমাকে দিয়েছে ও৷ জানো কী বলেছিল ও‚ যখন জিজ্ঞেস করলাম এর কারণ? ‘মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছিস তুই—এটাই আমার গিফ্ট।’ ”

শেষ কথাটা বলেই শারফান হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল—একেবারে শিশুর মতো। দু’গাল নোনাজলে ভিজে উঠল। হাতের পিঠে মুছে ফেলল দ্রুত চোখদুটো। বোধ হয় তৃষ্ণা অনুভব হলো ওর এতটুকু বলেই। বোতল তুলে ঢকঢক করে একদমে গিলে নিল মদ অনেকটা। অশ্রুবিহ্বল কণ্ঠে আবার বলতে শুরু করল‚ “ওর যখন মাত্র দুই বছর বয়স‚ তখন থেকেই সবাই বলত‚ ‘তোর বোন একদম তোর মতো দেখতে রে‚ শায়াফ!’ কিন্তু আমি তো কালো‚ সাধারণ‚ একেবারেই অসুন্দর। আর ও ছিল একদম উলটো—কত মায়ায় ভরা ও‚ সব থেকে সুন্দর! তাই রাগ লাগত খুব‚ যখন কেউ আমাদের একসঙ্গে তুলনা করত। ছোটবেলায় গালাগালও করে দিতাম এমন বললে! একবার সাত বছর বয়সে‚ খেলতে খেলতে প্রতিবেশী এক কাকার মেয়ের সঙ্গে তার বাড়িতে চলে গিয়েছিল ও। আম্মু তখন রান্নায় ব্যস্ত ছিল‚ খেয়াল করেনি। আব্বু বাসায় ফিরে এসে দেখে‚ ও নেই বাড়ির কোথাও! রাস্তাঘাট‚ এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করে সবাই হয়রান‚ পাগল হওয়ার দশা। আমি তখন ঢাকায়। খবর পেয়েই গাড়িতে উঠে বসি। গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনি—ও ফিরে এসেছে। সেই থেকে সবাই আরও কড়া নজরদারিতে রাখতে শুরু করলাম ওকে। যত বড়ো হতে থাকল‚ তত আগলে আগলে বড়ো করেছি ওকে এই বুক দিয়ে। কিন্তু পারলাম না… তাও রক্ষা করতে পারলাম না ওকে। কতগুলো জানোয়ার ওকে তুলে নিয়ে গেল… জ্যান্ত কবর দিল ওকে… সারা দুনিয়ার মানুষগুলো ওর…” আর বলতে পারল না সে।
বুকের মাঝখানে হাত চেপে ধরে যেন ব্যথাটা আটকাতে চাইল। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল অবিশ্বাস্যভাবে‚ অসহায়ভাবে। মাথা নিচু থাকায় অশ্রুবিন্দুগুলো টুপটাপ করে পড়ে যেতে লাগল ওর কোলের ওপর।

“আমিও জানোয়ার! আব্বু অমানুষও বলে”‚ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল সে। গলা যেন ভার হয়ে আসছে নিজেরই বলা কথার ভারে। “কিন্তু কোনোদিন কোনো মেয়েকে বেইজ্জতি করিনি। অমানুষের বাচ্চা বলে আব্বু নিজেকেই গালি দিয়ে আমাকে সাবধান করত‚ ‘তোর ঘরেও বোন আছে৷ আরেকজনের বোনের সাথে যা করবি তা যদি আল্লাহ তোর বোনের সঙ্গে ফিরিয়ে দেয়—সহ্য করতে পারবি তা?’ আমি আব্বুর সব কথা অগ্রাহ্য করতাম। কিন্তু এই কথাগুলা… আমাকে গেঁথে ফেলেছিল কোথাও! তাই আমার চরম শত্রুও যে মেয়ে‚ তবু তার সম্মান নিয়ে আমি কখনো খেলিনি। তাহলে আমার বোনের সঙ্গে এমনটা কেন করল আল্লাহ?”

সে সত্যিই যেন উত্তর চায়। চোখের তারায় বেদনাপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে সানার কান্নাভেজা চোখের দিকে চাইল—নিঃশব্দে একটা ব্যাখ্যার আশা করল যেন। কিন্তু হঠাৎই চাউনিজোড়া বদলে গেল ওর। কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল‚ “তোমাকে বিরক্ত করতাম‚ জোর করে ছুঁয়েছিলাম—আমার এই অপরাধের শাস্তিই কি তবে ওকে দিল?”

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ চেয়েই রইল সানার দিকে। ভাবুক মুখ‚ কিন্তু চোখে তীব্র অভিমান আবার ক্ষোভও। “ডিড্ন্ট গিল্ট টাচ্ মি?” ধীরস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল সানাকে‚ “ডিড্ন্ট আই আস্ক ফর পারডন? তাও আমাকে ক্ষমা করলে না‚ সানা? তাহলে আরেকবার আমাকে মারতে বলতে ফারনাজকে? পিষে দিতে বলতে ট্রাকের নিচে? আমার বদলে আমার ছোটো চড়ুইটাকে কেন?”

আচমকা চিৎকার করে উঠল তারপরই‚ “আমাকেই আবার কেন মারলে না?” গলা কাঁপছিল‚ চোখদুটো টলমল করছিল মর্মবেদনায়। আর সামলাতে না পেরে উপচে পড়ল চোখের জল।

“আমার এইটুকু অন্যায়ের সাজা আমার বোনকে এত বিরাট করে দিলে কী করে‚ সানা?” বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আর থামলই না। পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে বকতে লাগল‚ “ডাক্তারও ঠিকঠাক বলতে পারে না ও কবে ভালো হবে‚ কবে হাঁটবে‚ কবে দৌড়াবে! ও নিঃশ্বাস নিতে পারে না ঠিকমতো… শুধু মরে যাওয়ার ভয় পায়। আমাকে বলত‚ ‘দ্যাখ ভাইয়া‚ তোরা আমাকে পাইলট বানাবি। আমি তোদের মতো ওসব আটা-ময়দা‚ তেল নিয়ে ব্যাবসা ট্যাবসা চালাতে পারব না‚ বলে দিলাম! আমি কত লম্বা দেখেছিস! আমাকে পাইলটেই মানাবে।’ ওকে খ্যাপাতে মুখে খু্ব না না করতাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে পরিকল্পনা ছিল—ওকে কোথায় পড়তে পাঠাব‚ কীভাবে গড়ে তুলব। ওর মতোই কল্পনা করতাম ওকে পাইলটের ইউনিফর্মে দেখার। কিন্তু এখন… আমার বোন আর কোনোদিনও স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। তোমাদের মতো চঞ্চল হয়ে চলতে ফিরতে পারবে না… ওকে এখন সারা জীবন সাবধানে বাঁচতে হবে। কত নাজুক হয়ে গেছে ও! কবে ভুলতে পারবে ও‚ এই বিনা পাপের কলঙ্ক—জানি না। মিড-ইয়ার এক্সামে রেজাল্ট খারাপ করায় কী ভীষণ মন খারাপ করেছিল! আর আজ সে এপ্রিলের বোর্ড পরীক্ষাতেই বসতে পারবে না। এই ব্যর্থতা বারবার মনে করিয়ে দেবে ওকে আজকের দিনের কষ্টগুলো। আবার বন্ধুরা যখন ভার্সিটি লাইফ শুরু করবে। ও তখন কতটা যন্ত্রণা নিয়ে শুধু তাকিয়ে দেখবে। আমার চাঁদটা কত ছোটো… কিন্তু অসুখ দিল আল্লাহ কত বিশাল একটা। এত বড়ো অসুখ ওর মতো ছোট্টো একটা মেয়ের শরীর কি বইতে পারে? এটা কি ওকে মানায়? আল্লাহ কি বোঝে না ও পারবে না সইতে? তাও দিল সে বিনা দোষে এমন আজাব। কেন দিল‚ সানা?”

খালি পেটে নেশা চড়ে বেশি‚ সে তো জানা কথাই। কেবল তীব্র মদ্যপানের অভ্যাস থাকায় একটু দেরি হচ্ছিল ওর মাতাল হতে। বোতলের বাকিটুকুও সাবাড় করার জন্য উঠে পড়ে লাগল সে। সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরু হলো অসংলগ্ন বিলাপ‚ “আমার বাপটাকেও ছাড়ল না আল্লাহ। এর চেয়ে আমাদের সবার জানই নিয়ে নিত।”

এরপর খানিটকা থেমে গেল। ভূতগ্রস্তের মতো মাথাটা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রইল চুপচাপ—একটা দীর্ঘ‚ ভারী নিস্তব্ধতা ওকে ঘিরে। তারপর ধীরে ধীরে ঘাড়টা ফিরিয়ে তাকাল সানার দিকে। চোখদুটো কেমন অস্বাভাবিক শীতল‚ নির্জীব।

সে দৃষ্টিতে সানার ভেতরটাই ছ্যাঁৎ করে উঠল সহসাই। শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সেই পুরনো দমবন্ধ করা আতঙ্ক। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস হলো না। পুরুষ মানুষের কান্না দেখছে সে এই প্রথম নয়। বাবার পর আজ দ্বিতীয় এই পুরুষের কান্না ওর অন্তরের কোথাও খুব নাড়া দিচ্ছে। আবার একই সাথে ওকে ভয়ও হচ্ছে। অথচ যাকে কিনা ঘৃণা করা উচিত পুরোদস্তুর।

তবে তার ভেতর আরেকটি ভাবনার চোরাস্রোত বয়ে গেল নিঃশব্দে। স্পষ্টভাবে আবিষ্কার করল—এই মানুষটি‚ যে রাগে উন্মত্ত হয়ে পশুপ্রকৃতি ধারণ করেছে, গালি-গালাজে মুখ রাঙিয়েছে‚ অমানুষিক কষ্ট দিয়েছে তাকে। সে মানুষটিই আবার ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ‚ ভেতরে ভেতরে অবিশ্বাস্যরকম নাজুকও। না হলে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়া‚ হেরে যাওয়া ভগ্ন চেহারায় আত্মসমর্পণের মতো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া—এসব কি সম্ভব? অথচ সব সময়ের প্রকাশ পাওয়া রূপটা কী ধারাল‚ কঠিন আর নিষ্ঠুর এক মুখোশ ওর! আজ সেই মুখোশের আড়ালের মানুষটিকে দেখতে পেল সানা—এ যেন এক দুর্ভাগ্যজনক উপলব্ধি।

এমন সময় হঠাৎ মনে পড়ে গেল শারফানের বহু আগের বলা একটি কথা‚ “ঝাল, তিতা খাওয়ার দুর্ভাগ্য তোমার কোনোদিন না হোক!” সেদিন এ কথার গভীরতা বুঝতে পারেনি সানা। আজকের এই পরিস্থিতি হাড়ে হাড়ে সে কথার গূঢ় অর্থ তাকে বুঝিয়ে দিল। না চাইলেও ভাগ্য ঠিকই তাকে সেই দুর্ভাগ্যের শিকার বানিয়ে দিয়েছে।

“আমিও কি একইভাবে রিভেঞ্জ নেব‚ সানা?” মাতাল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল শারফান‚ “আমার কাছেও ফারনাজের বোনের মজার ভিডিয়ো আছে‚ জানো? দেখবে? দাঁড়াও দেখাই।” বলে ফোন ঘাটাঘাটি করতে শুরু করল। খুঁজে পেতে সময় লাগছে বলে ভ্রু-কপাল কুঁচকে বিড়বিড়িয়ে গালি দিল নিজেকেই‚ “আবালচো** রেখেছিস কোথায়?”

এক সময় খুঁজে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে সানার সামনে ধরল “এই যে‚ দেখো দেখো… বুড়ো বরটাকে চাঙ্গে রেখে শালী কীরকম কর্মচারীর সঙ্গে খেলছে খাট কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে।” হতাশ মুখে বিড়বিড় করল‚ “কত আগেই তো ছিল আমার কাছে এটা! কিন্তু শালা আহাম্মকচো** আমি! তখন কেন যে কাজে লাগালাম না?” আফসোস আর দুঃখে মুখটা ভার করে ফেলল।

সানার আর রুচি হচ্ছিল না দেখতে। শারফানও অবশ্য বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ দিল না। এক পা খাঁড়া আর আরেক পা সোজা করে বসে আবার বোতলে চুমুক দেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷

বাইরে বৃষ্টির শীতলতা থাকলেও নেশার পানীয় শরীর গরম করে তুলছিল। বেজায় ঘেমে উঠল সে। টি-শার্টটা খুলে ঘরের এক কোণে ছুড়ে ফেলে দিল। চুমুক দিতে দিতে আবার বিড়বিড় শুরু করল কত সব অর্থহীন কথার জগাখিচুড়ি। হঠাৎ একসময় গলা চড়িয়ে চিৎকার করে উঠল‚ “চুত**, ল্যাওড়া ছাড়া মাদার**… তোর তো আমাকে কিছু করার হেডম নাই! তোকে হিজড়া দিয়ে তোর পেছনে গুঁতাব আমি! তোর…” সীমাহীন অশ্রাব্য ভাষায় একের পর এক গালাগাল করে যাচ্ছিল সে ফারনাজকে। এমনকি তার বাবা-মা আর বোনকেও ছাড়ল না।

শেষে আর সহ্য করতে না পেরে সানা অনুনয়ের গলায় বলে উঠল, “চুপ করুন‚ প্লিজ…”

কিন্তু নিজের চিৎকারের নিচে সানার মৃদুস্বর চাপা পড়ে গেল। হাঁপিয়ে ওঠা পর্যন্ত গাল দিতে দিতে অবশেষে থামল শারফান। চোখ লাল হয়ে উঠেছে‚ শরীর দুলছে। নেশা একদম মাথায় উঠে গেছে। দৃষ্টি অস্থির‚ যেন সবকিছু ওলটপালট দেখছে। সানার দিকে তাকাতেই ঠান্ডা গলায় বলল, “তোমার নাগরকে আমি জেলে ঢুকেই খুন করে আসব। তারপর তোমাকে বিধবা বানিয়ে রাখব চিরকাল। যে খা** পোলা তোমাকে নিকে করতে আসবে‚ তাকেই ধরে কেটে দেব… ”

“ছি! চুপ করুন না”‚ অশ্লীল শেষ শব্দটা উচ্চারণের আগেই সানা বাধা দিল ওকে।

কিন্তু শারফানের মুখের বাঁধ যেন কোনিয়াকের বন্যায় ভেঙে পড়েছে৷ জড়ানো গলায় মুখে যা আসতে থাকল তাই বলে চলল অনর্গল। সানাকেও বাদ দিল না বকাঝতা করতে। এলোমেলো কথার এক পর্যায়ে যখন জারার নামটা মুখে এল‚ থমকে গেল তখনই। গলার সুর নিস্তেজ হয়ে এল। কিছুক্ষণ পর আবছা চেতনার মধ্যেই সে আবার বলতে লাগল জারার অসুস্থতার কথা আর সেই সাথে বাচ্চাদের মতো কাঁদতেও শুরু করল।

কেমন এক অস্বাভাবিক‚ খাপছাড়া পরিবেশ ঘরটাই। আর সানার ভেতরে চলল অগোছাল অদ্ভুত অনুভূতির ঢেউ। কখনো তীব্র ভয়‚ কখনো শারফানের অপ্রত্যাশিত কান্নাকাটিতে বিষম বিস্মিত হওয়া‚ কখনো বা এই ভেঙে পড়া পুরুষটির কান্নায় হৃদয়ে মোচড় লাগা।

শারফান একটু থিতু হতেই এ সুযোগ সানা জানতে চাইল ওর কিছু প্রশ্ন। বেশ নেতিয়ে পড়েছে শারফান। সে উত্তর দিল বটে‚ তবে এলোমেলোভাবে। প্রতিটি কথাতে সে তাকে দোষারোপ করে‚ তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে গেল‚ “কেন ফারনাজের কথায় আমার বোনটাকে তুলে দিলে ওদের হাতে? হাসিবের কাছে কেন পাঠালে ওকে? যদি ওর জায়গায় আজকে মেহা থাকত‚ পারতে এমনটা করতে?”

ওর এই এলোমেলো কথা আর ওর যন্ত্রণার ভেতর থেকেই সানা বুঝে নিল সবটা। ধীরে ধীরে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলে গেল তার। কিন্তু বোঝার পর থেকে যে বিবেকের আয়নায় নিজের অজান্তে হওয়া পাপটা ভেসে উঠবে—এ তো প্রত্যাশা ছিল না। “হাসিব!” ফিসফিস করে নামটা একবার উচ্চারণ করল শুধু। খুব চেনা মানুষের বর্বরোচিত কাজটা তার এখনো বিশ্বাস হতে চাইল না। কিন্তু তা যে সত্য।

কয়েক মুহূর্তের ভেতরে পুরো শরীর থেকে যেন প্রাণটাই সরে গেল তার কোথাও। কতটা নিখুঁতভাবে হাসিবের নিকৃষ্ট পরিকল্পনার সামিল হয়েছিল সে‚ তা মনে করে কণ্ঠটা বুঝি গিলে ফেলল ওর নিজস্ব নিঃশ্বাসই—হাঁসফাঁস লাগতে শুরু করল। আরও একবার… তার ভুলের জন্যই আরও একবার একই বয়সী আরেকটা প্রাণ শেষ হওয়ার পথে। কী করলে এই ভুলের মাশুল দিতে পারবে এখন? তাতে কি জারা আগের মতো সুস্থ হবে? না পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে তার অসম্মানটুকু‚ অপবাদটুকু? কিছুই আর ফিরে আসবে না। যেমন আর ফিরে আসেনি বাপ্পি। এক পর্যায়ে কান্নাটুকু গলা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইলে তা সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল তার৷ “ও রব…” মুখটা চেপে ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল‚ “এত ভুলের বোঝা‚ এত পাপ নিয়ে আমি কীভাবে বাঁচব…!”

শারফান ঢলে পড়েছে একেবারে। হাত-পা দুটো ছড়িয়ে ছিটিয়ে চোখ বুজে প্রলাপ বকে চলেছে এখনো। তবে সে প্রলাপ কেবল সানার প্রতি অভিমান আর অভিযোগে পরিপূর্ণ।

অপরাধবোধের ভারে‚ না দীর্ঘদিন না খাওয়ার ক্লান্তিতে কে জানে‚ সানার শরীরটাও নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। চটের বিছানার পুরোটা জুড়ে শুয়ে আছে শারফান‚ তাই দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিজেকে গুটিয়েই বসে রইল সে। আর নীরব শ্রোতা হয়ে শুনে যেতে লাগল শারফানের ছন্নছাড়া কথাগুলো‚ ওর কষ্টগুলো।

“আপনি আমার জন্য সঠিক শাস্তিই বেছে নিয়েছেন, শায়াফ…” ক্ষীণ সুরে ফিসফিস করে বলল সানা‚ “একটি ছেলের প্রাণ গেল‚ আর একটি মেয়ের সম্মান… জীবনের সুতোটাও যার ছিঁড়ে যাওয়ার মতো। আমি তাহলে কী করে হাসিখুশি‚ সহজ-সরল জীবন ডিজার্ভ করি? আমার মুক্তি মিললেও আমিও তো আমার পরিবারের জন্য এক কলঙ্ক হয়ে থাকব… আমার চরিত্রেও উঠবে আঙুল… আপনাদের মতোই আমার আব্বু-আম্মু‚ আমার বোনও আর কোথাও সম্মানের সঙ্গে মাথা তুলে চলতে পারবে না। খুব ভালো শাস্তি দিলেন আমাকে…” পরমুহূর্তেই ফেটে পড়ল কান্নায়৷ শব্দহীন নয়‚ বুকভরা বেদনার বিস্ফোরণ ঘটল যেন। চারপাশটা ভারী করে তুলল ওর প্রতিটি নিঃশ্বাসভরা আহাজারিতে।

“উমমম…” নড়েচড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে বিরক্তি ছড়াল শারফান‚ “থামো বলছি! গলা টিপে ধরব নইলে।” বলেই আবার ঘুমের দেশে পা বাড়াল।

কিন্তু সানার কান্না থামল আরও অনেক পরে। নেশায় তলিয়ে যাওয়া শারফানকে আর জাগাল না তার আর্তনাদ। তার অনাহারী দুর্বল শরীরটা মানসিক যন্ত্রণার ধকল আর সইতে পারল না একটা সময়। বুকভাঙা কষ্টের ভার যেন পিষে ফেলেছে তাকে। শারফানের ফোনের ফ্লাশের আলোয় আলোকিত ঘরটা কয়েক পলের মধ্যেই তার চোখে ডুবে গেল গভীর অন্ধকারে। দেহটা হেলে পড়ল এক পাশে—অসাড়‚ নিথর বেশে।

***

ভোরের আলো ঠিকঠাক নামার আগেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ৷ এখন বেলা নটা। একঘেয়েভাবে পড়েই চলেছে বৃষ্টির ফোঁটা। বারান্দায় জাংকে বসিয়ে খেতে দিয়ে মৌসুমির পায়চারি চলছিল অনেকক্ষণ ধরে। এর মাঝেই আগমন ঘটল নাফিসের৷ হাতে নাশতার প্যাকেট। কোনোদিন সে আসে‚ আর নয়ত পাভেল। নাফিসকে দেখা মাত্রই মৌসুমি যেন প্রাণ ফিরে পেল শরীরে‚ “আইছোস রে ভাই!”

“কী হইছে?” খাবারের প্যাকেটগুলো বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল নাফিস।

“সার এহনতরিত ঘরতে বাইর হয় নাই”‚ চুপিচুপি স্বরে বলল মৌসুমি‚ “কাইল রাইতে সারের কান্দাকাটি‚ গালাগালি শুনিছি ম্যালাক্ষুণ। তারফরই আবার ছেমরিডাও চিক্কুর দিয়া কান্দিছে৷ আমি ডরে তালা খুলার সাহস পাইতেছিনে।”

একটু যেন চিন্তায় পড়ে গেল নাফিসও। শারফানের স্বভাব‚ চরিত্রের ব্যাপারে মোটামুটি অবগত সে। তাই মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু করে থাকলেও তা অবিশ্বাস লাগবে না তার৷ কিন্তু সেটা মেনে নেওয়া কিছুটা কষ্টকর হবে আরকি৷ মৌসুমিকে কিছু না বলে দরজায় কড়া নাড়ল সে আর ডাকাডাকি করল শারফানকে‚ “ভাই? ও ভাই?”

অনেকক্ষণই ডাকল। কিন্তু ভেতর থেকে সানা বা শারফান‚ কারও কণ্ঠই এল না দেখে দুশ্চিন্তা বাড়ল নাফিসের। মৌসুমির থেকে চাবি নিয়ে তালাটা খুলে দ্রুত ভেতরে ঢুকল সে। চমকে উঠল তারপরই। মৌসুমির ইঙ্গিতই সঠিক—তা বুঝতে সময় লাগল না তার। মৌসুমিও ঢুকল ভেতরে৷ নাফিসের সামনে দারুণ লজ্জা পেল সে৷ তবুও ফিসফিসিয়ে বলল তাকে‚ “ডাইকা উডাও সাররে।”

ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা টি শার্টটা তুলে নিয়ে নাফিস এগিয়ে এসে শারফানকে ডাকল ধীরে ধীরে৷ কোনো হুঁশে নেই যেন শারফান। তাই বাধ্য হয়ে ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল সে‚ “ভাই‚ উঠেন৷ বেলা হয়ে গেছে‚ ভাই৷ খাবার নিয়াইছি।”

“হ্যাঁ? কী?” ম্রিয়মাণ স্বরে বলে উঠে শারফান আবার ঘুমে হারাল।

নাফিস তখন গলা চড়িয়ে ডেকে বলল‚ “ভাই‚ আমি নাফিস৷ তাড়াতাড়ি উঠেন। বাসায় ফিরবেন না?”

নাফিসের নাম শুনতেই কাজে দিল এবার। অস্বাভাবিক রক্তিম চোখদুটোই জুলজুল করে তাকাল শারফান। মাথাটা একটু পাশ ফেরাতেই বুঝল‚ সে ঘুমিয়ে ছিল কারও কোল জড়িয়ে ধরে। ঝট করে ছেড়ে দিল সানার পা জোড়া। দ্রুত উঠে বসতে গিয়ে মনে হলো মাথার মধ্যে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে ওর—এত যন্ত্রণা! চোখের সামনে কনিয়াকের বোতলটা দেখে রাতের ঘটনাগুলো একে একে সব ধরা দিল। সানার দিকে তাকাল তখন। কয়েক মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে বসে রইল তারপর৷ কী করতে এসেছিল আর কী করে বসল সে? “হোয়াট দ্য হেল ওয়াজ আই থিঙ্কিং?” বিরক্তিতে এবার নিজেকেই বকেঝকে উঠল‚ “কী সুন্দর মাস্টারপিস মাতাল হয়ে গেলাম একদম? ভ্যাড়াচো**র মতো কান্নাকাটি করতে এসেছিলাম? আবার যাকে গালাগালি দিয়েছি‚ রাতভর তার কোল জড়িয়েই ঘুম মারিয়েছি! আই অ্যাম সাচ আ ব্লাডি ডিকহেড।”

মৌসুমি‚ নাফিস দুজনই শুনতে পেল ওর বিড়বিড়ানি৷ বুঝল‚ যা কিছু করেছে শারফান‚ সবটাই মাতাল হয়ে৷ কিন্তু কিছু বলল না কেউ এ নিয়ে৷ নাফিস শুধু জিজ্ঞেস করল‚ “ঠিক আছেন‚ ভাই?”

উত্তর দিল না শারফান। মেজাজ পুরো তিতা হয়ে গেছে ওর৷ নেশা কেটেছে ঠিকই। কিন্তু শরীর হ্যাংওভারের মতো ভার ভার লাগছে। একই সাথে মাথা ব্যথাও৷ উঠে দাঁড়িয়ে নাফিসের হাত থেকে টি শার্ট নিয়ে গায়ে ঢোকাল৷ এক ঝলক সানাকে দেখে নিয়ে মৌসুমিকে বলল‚ “ওকে জাগাও।”

সানার কাছে এসে তাকে ডাকাডাকি করল মৌসুমি অনেকবার। গা নাড়িয়েও কাজ হলো না—ঘুম ভাঙল না তার। সবটাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল শারফান আর নাফিস। চিন্তা ফুটল শারফানের মুখে। এর মাঝে মৌসুমি হঠাৎ বলে বসল‚ “টচ্চার মনে অয় বেশি হইয়্যা গ্যাছে।”

“কী?” জোর আওয়াজে বলল শারফান‚ “কিসের টর্চার? আমি কিছু করেছি না-কি? সে সুযোগই তো পেলাম না।”

থতমত খেল মৌসুমি—সঙ্গে নাফিসও৷ যা ধারণা করেছিল ওরা‚ তা ভুল ছিল তবে? ওদের চেহারা দেখে শারফান টের পেয়ে গেল ওদের চিন্তাভাবনা। কটমট চোখে মৌসুমিকে দেখতেই মৌসুমি বেজায় ভয় পেল৷ তারপর এসে বসল শারফান সানার সামনে। “পানি দাও”‚ রুক্ষ গলায় বলল মৌসুমিকে।

মৌসুমি দ্রুত পানি এনে ওকে দিতেই পানি ছিটিয়ে দিল সানার মুখে৷ তবুও সানার ঘুম ভাঙল না দেখে বুঝল সবাই‚ সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে।

“একটানা না খাইয়া থাওনের লাইগা অজ্ঞান হইছে”‚ বলে উঠল মৌসুমিই।

শারফান তা শুনে নাফিসকে জিজ্ঞেস করল‚ “নাশতা এনেছিস?”

“হ‚ ভাই। আপনার আর মৌসুমির নাশতা আনছি। আর এই মাইয়ার জন্য যা আনবার কইতেন‚ তাই আনছি৷ বাসি পান্তা।”

“ফেলে দে। আমার নাশতা নিয়ে আয়৷”

“না না…” আপত্তি জানাল মৌসুমি‚ “আমি ঘুম ভাইঙ্গাই মুড়ি খাইছি। আমার খিদা নাই আর। আমারডা নিয়া আহি।”

নিষেধ করল না শারফান৷ বেশ কয়েকবার সানার চোখে-মুখে পানি ছোড়ার পর সানা চোখ খুলল আস্তে আস্তে। গায়ে এক বিন্দুও বল নেই। তাই মনে হলো চোখজোড়া খুলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার৷

মৌসুমি খাবার বেড়ে নিয়ে আসার পর তাকে বলল শারফান‚ “খাইয়ে দাও ওকে৷ যেন পেট ভরে।” বলেই বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। নাফিসও ওর পিছু পিছু এলে তাকে জানাল‚ আর দরকার নেই নষ্ট খাবারের৷ সাধারণ ভাত-তরকারিই দেয় যেন সানাকে আজ থেকে।

জাং এসে পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকল শারফানের৷ কিন্তু শরীরটা ম্যাজম্যাজ করায় ওর কিছুই ভালো লাগছে না একদম। গোসল নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল খুব৷ কিন্তু বৃষ্টির তেজ কম৷ তাও নেমে পড়ল বারান্দা থেকে। পিছু নিল জাংও৷

মাথার ওপর গাছের ছাউনি—দেখার উপায় নেই মেঘলা আকাশটাকে৷ কিন্তু চারপাশটা ধূসর মেঘে ঢেকে আছে তা বোঝা যায়৷ রোদ নেই‚ তবে আলোর অভাবও নেই। বরং সবুজের গভীরতা আর আর্দ্রতার স্পর্শে প্রকৃতি থমকে আছে শান্ত আর কোমল হয়ে।

পাতার ওপর টুপটাপ শব্দ তুলছে ইলশেগুঁড়ি। গাছের ডালে জমে থাকা শিশির আর বৃষ্টির জল এক হয়ে ছোটো ছোটো ধারা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে গায়ের ওপর। মাটিতে ধুলোর গন্ধ নেই। আছে ভেজা মাটির একরাশ সোঁদা ঘ্রাণ—যা নিঃশ্বাসে মিশে যেতে চাচ্ছে। দূরের গাছের মাথায় কয়েকটি কাক ঠান্ডায় গা গুটিয়ে বসে আছে। বাতাস নেই‚ তবে বৃষ্টির ফোঁটায় পাতারা নিজেরাই দুলছে… মৃদু কাঁপছে।

জলাধারের সামনে এসে দাঁড়াতেই শারফানের ইচ্ছা হলো এর মাঝেই কটা ডুব দিয়ে উঠবে কি-না! কিন্তু জোঁকের শিকার হওয়ার কথা মনে হতেই ইচ্ছাকে তাড়িয়ে দিল৷ ফিরে আসার সময় আবার কী মনে করে একবার ঘুরে তাকাল জলাধারটার দিকে। তারপর আধভেজা শরীরটা নিয়ে ঘরে ঢুকে খেতে বসে গেল।

***

বেলা ১২ টা ।

শারফান এখনো চরগাঁওতে। তবে নাশতা শেষে সানার মুখোমুখি হয়নি। খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়েছে। সে সুযোগে সানা ঘন্টা তিনেক হলো ঘুমিয়ে৷

জাংকে নিয়ে শারফান এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে দেখছিল চারপাশ৷ সন্দেহজনক কোনো কিছু চোখে পড়েনি ওদের৷ ফিরে এল ঘরে৷ জাংকে দরজার বাইরে অপেক্ষা করতে বলে সানার কাছে এল সে আবার৷ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সানা৷ সরল-সুন্দর চেহারার মানুষের ঘুমন্ত মুখটা যেন আরও বেশি মায়া জাগায়—সেটাই কতক্ষণ চুপ করে দেখল শারফান।

অদ্ভুত এক প্রশান্তি মিশে ছিল সানার মুখে। সেই শান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ওর মনে হলো‚ এই মুখে ছলনার ছায়া নেই‚ নেই কোনো কুচক্রী ষড়যন্ত্রের ছাপ। এ যেন কষ্টে-গড়া‚ যত্ন মেশানো ভালোবাসারই প্রতিচ্ছবি। একটু নরম হয়ে এল শারফান। তারপর আস্তে করে ডেকে তুলল। পিটপিট করে সানা তাকাতেই বলল‚ “উঠে পড়ো… এই ইনোসেন্ট ডল মুখটার অভিনয় অনেক দেখেছি আমি। ঘুমিয়ে থেকেও এমন নিপুণভাবে মুখ সাজিয়ে রাখো কীভাবে? ফেইক অ্যাঞ্জেলরা তো তোমার কাছেই ট্রেনিং নেয় মনে হয়।”

নীরবে তাকিয়ে থেকে শারফানকে দেখল সানা কয়েক পল। চেহারায় ওর অস্থিরতার ছাপ‚ চোখজোড়ায় অবসন্নতা আর বিশৃঙ্খল চুল। গতরাতে ওর সেই কান্নার মুহূর্তগুলো চোখে ভেসে উঠল সানার। তারপর নিজের ভুলগুলোও স্মরণে এল—কেমন ভিজে উঠল হৃদয়টা চকিতেই। জারার জন্য আর শারফানের জন্যও। উঠে বসল ধীরে ধীরে। কিছুটা শক্তি জুটেছে শরীরে। চোখে চোখ রাখল শারফানের। কিছু বলতে চাইল ওকে৷ কিন্তু তার আগেই শারফান ঠান্ডা সুরে বলল‚ “হাসিব কোথায়? জানি না বোলো না৷ কারণ‚ আমার ইনটুইশন বলছে তুমি জানো। আর কিচ্ছু বলতে হবে না। শুধু ওর খোঁজটা দিলেই তোমার শাস্তি নেই৷ হয়ত ছেড়েও দেব।”

শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে ঢোঁক গিলল সানা৷ তারপরই দরজার দিকে চোখ গেল তার। জাংকে দেখা মাত্রই শিউরে উঠল। তা লক্ষ করল শারফান। বলল‚ “ঠিকঠাক আন্সার করলে জাং এ ঘরে ঢুকবে না।”

দুর্বল দৃষ্টিতে তাকাল সানা। দ্বিধায় ডুবে আছে তার মনটা। সেই মনটা কেন যেন বিশ্বাস করতে চাইছে হাসিবকে। যেটা করেছে হাসিব নিশ্চয়ই বাধ্য হয়ে করেছে সে? বাধ্য করিয়েছে ফারনাজ—এমনটাই বলছে তার মন। এখন হাসিবের অবস্থান জানিয়ে দিলে ওর সঙ্গে শারফান কী করতে পারে‚ এ ধারণা তার হয়ে গেছে৷ হয়ত মেরেই ফেলবে! নিস্তরঙ্গ গলায় বলল শুধু‚ “আমার ভুল আমি অস্বীকার করতে পারব না৷ কিন্তু জেনে-বুঝে ভুলটা করিনি আমি।”

“আচ্ছা?” ঠোঁট বাঁকিয়ে বিষণ্ণ হাসি হেসে ঠান্ডা গলায় বলল শারফান‚ “কতটা অবুঝ তুমি তা না হয় হাসিবের মুখ থেকেই শুনব‚ কেমন? বলো‚ ছেলেটা কোথায়? ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেই ক্লু নিয়ে খুঁজে বের করেছি ওর অ্যাড্রেস। মধুখালী রেলওয়ে স্টেশনের পাশেই ওর বাড়ি। কিন্তু বাড়ি থেকে উধাও ও সেদিন থেকেই। ওর বাপ-মা আর বোনগুলোও ওর জন্য কান্নাকাটি করছে৷”

“কী করবেন ওকে পেলে?” ভীত-সন্ত্রস্ত গলায় জিজ্ঞেস করল সানা‚ “মেরে ফেলবেন?”

“তুমি চাইলে তোমার পাশের ঘরেই ওর থাকার ব্যবস্থা করে দেব”‚ মুচকি হেসে বলল ও‚ “স্বচক্ষে দেখবে তখন… জানতে পারবে কী করব ওকে। তবে তোমাকে যা করতে পারছি না‚ সেটা ওর সঙ্গে করব নির্দ্বিধায়।”

মনের চোখে দেখতে পেল সানা নিজের ওপর হিংস্র জাঙের ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্যটুকু—বুকটা কেঁপে উঠল তার। সেদিন শারফান না থামালে আজ তার মৃতদেহটা পড়ে থাকত এখানে৷ কিন্তু হাসিবের বেলায় আর দয়া করবে না বুঝি!

“কী হলো? বলবে না?”

সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারল না সানা। বর্তমান হাসিবই পরিবারের হাল ধরার চেষ্টায় আছে। কারণ‚ ওর বাবার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়েছে—শুনেছিল তা মায়ের কাছ থেকে। এর মাঝে আবার বোনের বিয়েও সামনে৷ কিছু যদি হয়ে যায় ছেলেটার—পরিবারটা ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে একদম।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল শারফান৷ “ঠিক আছে‚ বোলো না। চলো তাহলে। গোসল করো না অনেকদিন। আজকে গোসলের সুযোগ দেব তোমাকে৷ ভালো লাগবে শরীরটা।”

“না‚ করব না”‚ মৃদুস্বরে বলল সানা।

“কেন করবে না?” শান্ত গলাটা মুহূর্তেই কর্কশ হয়ে গেল শারফানের।

সানা জবাব দিল না এ প্রশ্নের। বলল নিজের স্বপক্ষের স্বীকারোক্তি‚ “আমি সত্যিই জানতাম না জারাকে সেদিন কিডন্যাপ করা হবে। ফারনাজের সঙ্গে আমার কোনোরকম ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করুন!”

“আমি বলেছি তোমাকে গোসল করতে”‚ ধমকে উঠল শারফান‚ “ উঠে দাঁড়াও।”

চমকে উঠে জলদি দাঁড়িয়ে পড়ল সানা৷ একটু সাহস করে জিজ্ঞেস করল‚ “আমি গোসলের পর কী পরব?”

“আগে গোসলটা তো শেষ করো”‚ বলেই সে চোখের ইশারায় নির্দেশ দিল বেরিয়ে পড়ার।

কিন্তু এক পা এগোতেই মাথাটা ঘুরে উঠল সানার৷ পেছনেই ছিল শারফান৷ মনের অজান্তেই দ্রুত ধরে ফেলল তার বাহুজোড়া। বুকের সঙ্গে তার পিঠটা লাগতেই আবার সরিয়েও দিল আরও দ্রুত।

“হাঁটো”‚ বেজায় গম্ভীর গলায় শারফান নির্দেশ দিতেই সানা এগোল জাঙের পিছু পিছু।

জাংকে বলতে হয়নি অপরাধীকে পাহাড়া দিয়ে চলতে৷ ইয়াজের প্রশিক্ষণের গুণে নিজেই তা বুঝে নিয়েছে জাং।

বৃষ্টিতে ভরে আসা ওই জলাধারের সামনে তিনজন পৌঁছাল৷ “চমৎকার পানি”‚ সানাকে বলে উঠল শারফান স্ফূর্তিপূর্ণ কণ্ঠে‚ “যাও‚ নেমে পড়ো। সাঁতার জানো তো‚ না? না জানলেও অসু্বিধা নেই৷ আমি আছি তো। আমার জাংও আছে।”

“এটা তো কাদা পানি”‚ নাক কুঁচকে ফেলল সানা।

“কাদা পানিই তোমার জন্য আজ থেকে গোসলের পানি। নয়ত কি সারা জীবন গোসল না করে থাকবে?”

বিষণ্ণ চোখদুটো কান্নায় ভরে উঠল সানার। এখান থেকে সত্যিই কি আর কোনোদিন বের হতে পারবে না?

“নামো”‚ আবার ধমক লাগাল শারফান।

সানা বুঝে গেল‚ এটাও তার শাস্তিরই আরেক ধরন। তাই না নেমে উপায় নেই। কাদার মধ্যে পা ডুবিয়ে নেমে পড়ল জলাধারের কোণায়। পানি দাঁড়াল তার কোমর অবধি।

“আমি যখন বলব তোমার গোসল শেষ”‚ নির্বিকার শারফান বলল‚ “তখনই উঠতে পারবে।”

দাঁড়াল না সে তারপর৷ জাংকে রেখে চলে গেল অন্য দিকে। মিনিট দশেক পার হলো এর মধ্যে৷ সারা শরীর চুলকাতে আরম্ভ করল সানার৷ উঠে পড়তে চেয়েও সাহস হলো না মানুষরূপী মালিকের কুকুররূপী প্রহরীটার ভয়ে। একদম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে তাকে পাহাড়া দিচ্ছে জাং।

আরও পাঁচ মিনিট যেতেই সানা চিৎকার করে উঠল। পিঠের মাঝে চুলকাতে গিয়ে হাতে জোঁকের অস্তিত্ব টের পেয়েছে সে। সারা শরীরেই যে তা ছড়িয়ে আছে তা বুঝতে পেরে ভয়ে কান্নাকাটি আর চিৎকার করে স্বভাবজাত ডাকতে লাগল মাকে৷

শারফান চলে এল সেই ডাক শুনে৷ সানা ওকে দেখেই কাঁদতে কাঁদতে উঠে পড়ল। কিছু বলল না শারফান৷ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েই বাচ্চাদের মতো লাফাতে লাফাতে কাঁদল আর বলল‚ “ও আল্লাহ… আমার গায়ে জোঁক ভরেছে… কিছু করুন জলদি। আমি ভয় পাই এসবে৷ মরেই যাব আমি‚ ও আম্মুউউউ! জোঁকগুলো ছাড়িয়ে দিন তাড়াতাড়ি… আমাকে বাঁচান‚ শায়াফ।”

শারফানের মায়া হলো কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু এমন লাফালাফি দেখে না চাইলেও হাসি এল ওর। ঠোঁটের কোণে দমিয়ে রাখা হাসি নিয়ে বলল‚ “বাঁচাব কেবল এক শর্তে। যা জিজ্ঞেস করব সব বলবে।”

“বলব…” কথার শেষে সুরটা কান্নার মাঝেই স্থায়ী হলে কয়েক সেকেন্ড। লাফালাফিটাও থামল না সানার৷

তা দেখে আর পারল না শারফান নিজেকে সামলাতে। কোমরে এক হাত‚ আর দ্বিতীয় হাত চেহারায় চেপে অন্য দিকে ফিরে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করল সে৷ তার মাঝেই হঠাৎ ভারী কিছু মাটিতে পতন হওয়ার শব্দ হলো৷ দ্রুত পিছু ফিরে দেখল‚ সানার লাফালাফি একেবারে থেমে গেছে আর কান্নাকাটিও। গাল ফুলিয়ে এক লম্বা শ্বাস বের করে দিল সে। “এত নরম যে! অথচ তার মনটা কেন জটিল হলো?” বিড়বিড় করল জ্ঞানহারা সানাকে দেখতে দেখতে।

শেষমেশ তুলে নিল সানাকে পাঁজাকোলা করে। ঘরে ঢুকে মৌসুমিকে ডাকল শারফান৷ ওকে শোয়ানোর পরই ঘরে ঢুকল মৌসুমি৷ তাকে বলল‚ “জোঁক গেঁথেছে ওর শরীরে৷ ছাড়িয়ে দিয়ে মেডিসিন লাগিয়ে দাও।”

ভয়েই ফ্যাকাশে হয়ে উঠল মৌসুমির মুখ‚ “জোঁক!” আমতাআমতা করে বলল “জোঁক ধইরলো কুনহান্তে‚ সার?”

শারফান তাকাল তার দিকে। চেহারার ভাব দেখে জিজ্ঞেস করল‚ “তুমিও ভয় পাও না-কি জোঁকে?”

“পায় না কেডায়?”

“আমি পাই না।”

“তয় আফনেই ছাড়ায় দ্যান‚ সার”‚ ইতিউতি চেয়ে বলে দিল মৌসুমি।

ভয় পেলে আর জোর করবে কীভাবে? তাই বাধ্য হলো শারফান নিজেই দায়িত্বটা নিতে। কিন্তু তখনই ওর খেয়াল হলো‚ জামাটা খুলে ফেলতে হবে যে!

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪০.

“ও মা গোওও… শাস্তিডা সার কারে দিল? এরে দিল না আমারে দিল গো আল্লাহ….” গুনগুনিয়ে কান্না করতে থাকল মৌসুমি‚ আর প্লাস্টিক পলিথিন পেঁচানো হাতে একটা একটা করে জোঁক ছাড়াতে লাগল চেতনাশূন্য সানার।

পেছনে দু হাত বেঁধে শারফান ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে। বিশ মিনিট ধরে মৌসুমির কান্নাকাটি শুনে শোকের মাতম চলছে মনে হচ্ছে ওর—বিব্রতও হচ্ছে বেশ। কারণ‚ শেষ পর্যন্ত দায়িত্বটা মৌসুমিকেই নিতে হয়েছে। তখন ওর চিন্তিত চেহারা দেখে মৌসুমি বুঝে গিয়েছিল সমস্যাটা। সে একজন মেয়ে থাকতে পরপুরুষ হয়ে সানার জামা-কাপড় খুলবে শারফান! এটা তো আসলেই দৃষ্টিকটু।

অপেক্ষার মাঝে খট করে দরজাটা খুলে গেল। মৌসুমির হাতে বড়ো এক পাত্র। তার মাঝে গড়াগড়ি খাচ্ছে পেট ভরে রক্ত খাওয়া জোঁকগুলো। ভীতিবোধ আর ঘৃণায় চেহারা কুঁচকে বিকৃতি করে ফেলেছে সে। শারফানের পায়ের কাছে সেটা রেখেই আহত গলায় বলল ওকে‚ “সার গো‚ এরাম কুনো শাস্তি আর দিয়েন না—যার ভোগান্তি আমারও পুহানো লাগে।”

বিব্রত মুখটা শারফানের বোঝা গেল না গম্ভীরতার নিচে ঢাকা পড়ে। শুষ্ক গলায় জিজ্ঞেস করল‚ “জ্ঞান ফিরেছে ওর?”

“না‚ সার৷ হেব্বি ডরাইছে। আমারই শরীলডা আর ভালা ঠেকতেছে না”‚ জোঁকগুলোর দিকে শেষবার চেয়ে বলল মৌসুমি৷

“ঘরে যেতে পারব?”

“হ‚ জামা পিন্দায় দিছি। ওষুধও লাগাইছি।”

ঘরে ঢুকেই সানার রুগ্ন দেহটাই দৃষ্টি স্থির রাখল সে কতক্ষণ। এগিয়ে এসে তার শিথানের কাছে বসে ভাবল—সানার দুর্বল শরীরের যা অবস্থা এখন‚ তাতে স্যালাইন দেওয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মনের কোথাও ওর একটুখানি অনুশোচনাও উঁকি দিতে চাইল বোধ হয়। প্রথম যখন দেখেছিল মেয়েটিকে‚ তখন একদম মানানসই স্বাস্থ্য ছিল। প্রায় পাঁচ মাস পর আজ সপ্তাখানিকের ব্যবধানে সেই স্বাস্থ্য অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে৷ গলার হাড় জেগে উঠেছে‚ চোখের নিচ আরও ডেবে গেছে‚ গালের মাংস শুকিয়ে চোয়ালের হাড়ও স্পষ্ট হয়ে উঠতে চাইছে৷

পরিচিত আজ কেউ যদি সানাকে দেখতে পেত‚ তাদের ভীষণ মায়া লাগত তার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে। শারফানেরও যে হচ্ছে না একদম—তা নয়৷ কেবল তা গভীরভাবে অনুভব করতে চাইছে না সে৷ তবে ভাবান্তর ঘটল ওর অন্য বিষয়ে৷ আর কোনো শারীরিক নির্যাতন করবে না সে সানাকে৷ বলা ভালো‚ করতে পারবে না। আর পরবর্তী দিনগুলোতে ঠিক কী করা উচিত সানার সঙ্গে‚ সেটা নিয়েও চিন্তায় পড়ল৷ কেন যেন এভাবে আটকে রাখাটা উচিত হয়নি বলে মনে হচ্ছে এখন৷ এও মনে হচ্ছে‚ রাগের উন্মত্ত ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে তাকে তুলে আনার সিদ্ধান্তটা খুব একটা যুক্তিসঙ্গত হয়নি৷ বরং পুলিশের হাতেই তুলে দিলে যা করার তারাই করত। কিন্তু সেদিন পরিস্থিতিই যে উত্তপ্ত ছিল। বিবেচনার দরজা বন্ধ ছিল বোনকে মৃত্যুর পথে হাঁটতে দেখে। রাগ‚ প্রতিহিংসা আর আবেগের তাণ্ডবে সুস্থ বিচারবুদ্ধি নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল ওর।

প্রলম্বিত শ্বাসটা ফেলে সানার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল শারফান৷ সময় লাগল না সানার চোখের পাতা নড়তে। কিন্তু ওকে সানা দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করল না। বেরিয়ে এসে মৌসুমিকে বলল দুপুরের খাবারটা তাকে খাইয়ে দিতে। তারপর বারান্দা থেকে নেমে চলে গেল সামনে। কল করল মাকে।

বিকাল ৫: ৫০ মিনিট।
ডালপালা আর পাতার ফাঁক গলে ভেজা মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে গোধূলির শেষ আলো। পাখিরা ঘরে ফেরার গান গাইছে। কোথাও একটা শালিক ডেকে উঠছে‚ আর সানার ঘরের পেছনটাই কাকের ঝাঁক সমস্বরে কা কা করতে করতে নিজেদের একান্ত জায়গা বুঝে নিচ্ছে। গাছের ছায়াগুলোকে আরেকটু বাদেই দেখাবে বিরাট লম্বা একেকটি দৈত্যের মতো। বাতাসে শুকনো পাতার খসখস‚ শিয়ালের ক্ষিপ্র পদধ্বনি আর অজানা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ মিলে জঙ্গল যেন নিজস্ব ভাষায় বলছে দিন শেষের গল্প। নরম আলোয় বন যেন ক্লান্ত—যেমনটি ক্লান্ত সানা।

“আমি তো সত্যিই দোষী। ওঁকে বলবেন‚ মৃত্যুর থেকে কঠিন শাস্তি আর কিছু হয় না। আমাকে তিনি সেটাই দিতে পারেন। আল্লাহর কাছে তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না”‚ শরীর ব্যথায় কাতর স্বরে আকুতি পেশ করল সানা মৌসুমির কাছে।

তার মুখের কাছে তখন ভাতের লোকমা ধরে আছে মৌসুমি। দুপুরে খেতে পারেনি সানা। তাই নিজ দায়িত্বেই বা বলা উচিত মানবিকতা থেকে মৌসুমি দ্বিতীয়বার খাওয়াতে চেষ্টা করছে তাকে।

ঘরের বাইরে পাভেল আর নাফিস দাঁড়িয়ে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে কথা বলছে ওরা শারফানের সঙ্গে। কিন্তু শারফানের এক কান ঘরের দিকেই। তাই অনায়াসেই শুনতে পেল সানার আবেদন। কথাটার জবাব দিতে এবং কিছু জবাব নিতে শারফান ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে ঘরের ভেতর এল। চোখদুটো বুজে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে সানা। এক লোকমা মুখে নেওয়ার পর থেকে একটা দানাও আর খেতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে তার গা গুলিয়ে বমি আসবে এক্ষুনি। মৌসুমি তার কথাকে পাশ কাটিয়ে সাধাসাধি করতে থাকল আরও কয়েক লোকমা খাওয়ার জন্য৷

“খেতে না পারলে জোর করার প্রয়োজন নেই”‚ বলতে বলতে সানার সামনে এসে দাঁড়াল শারফান।

“হাসপাতালে নেওন লাগব তইলি”‚ মৌসুমি জবাব দিল‚ “ভাব-গতিক ভালা না ওর শরীলির।”

“যার শরীর সে-ই সিদ্ধান্ত নেবে খাবে কি খাবে না”‚ বিকারশূন্য গলায় বলল শারফান। “তুমি যাও একটু। আমি ওর সঙ্গে এখন শেষবারের মতো কিছু কথা বলব।”

ভাতের থালাটা নিয়ে বেরিয়ে গেল মৌসুমি৷ বৈঠকি ভঙ্গিতে বসল শারফান সানার সামনে। দুজন কয়েক পল নীরব ভাষা বিনিময় করল একে অপরে চোখে চেয়ে৷ শারফানের দৃষ্টি বোঝার ক্ষমতা হলো না সানার৷ কিন্তু সানাকে দেখাল সে সকল ভয় আর কষ্টের ঊর্ধ্বে চলে গেছে—কেমন নিস্পৃহ চাউনি। আর কোনো কিছুতেই তার কিছু এসে যায় না যেন। তা লক্ষ করে বলে উঠল শারফান‚ “এতটুকুতেই জীবনের মায়া ছেড়ে দিলে? অথচ আমার পূর্ব পরিকল্পনা আরও কত অসহনীয় ছিল তোমার জন্য—তা জানলেই না৷ আর জানতেও হবে না তোমাকে।” বলে হাসল মৃদু।

সানার চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল তখন৷ কিন্তু কথা বলার শক্তি‚ আগ্রহ‚ কোনোটাই পেল না৷ তাই শারফানই জানাল‚ “খুনি দশটা খুন করলেও যে সাজা‚ একটা করলেও তাই৷ তেমন কিডন্যাপ একজনকে করলেও যা হবে আমার‚ আরও দুই জনকে করলেও তাই।”

“আর কার দুর্ভাগ্য হলো আমার মতো?”

“হয়নি এখনো—হবে। আমার বোনের অপরাধীদের যতদিন আমি না খুঁজে পাবো‚ ততদিনই চলবে সৈয়দ গোষ্ঠীর মেয়েদের লাপাত্তা হওয়া। হাসিবের বিয়ে ঠিক হওয়া বোন‚ ফারনাজের ছোটো বোন আর তোমার ছোটো বোন‚ কাউকেই হয়ত বাদ দেব না। যদিও নিজের বোন ছাড়া বাকিদের বেলাতে তোমার কিছু যাবে আসবে না।”

সানার বেদনাবোধহীন দৃষ্টিজোড়ায় আতঙ্ক ফিরে এল আবার‚ “মেহাকে পাবেন কীভাবে আপনি?”

শারফান হাসল‚ “এটা কোনো ব্যাপার হলো? ট্র্যাপ তৈরি করা মিনিটখানিকের মামলা। তুমি যদি দেখতে চাও ওকে নিজের পাশে—তবে হাজির করি?”

না‚ অবিশ্বাস হলো না সানার। অন্তত নিজের হাল দেখার পর সে বিশ্বাস করে শারফান এখন যা কিছু করতে পারে। আজ সারাটাদিনে নিজের মুক্তির জন্য যা করেনি‚ তা-ই সে এখন করে বসল। আচমকা শারফানের পা জড়িয়ে ধরল। কান্নাভেজা গলায় মিনতি করল‚ “না জেনে হোক‚ অন্যায়টা আমি করেছি। আমাকেই যা করার করুন। এই পরিস্থিতিতে মেহারও কিছু হয়ে গেলে আব্বু-আম্মু শেষ হয়ে যাবে।”

স্বীকারোক্তির বদলে এমন কাণ্ডে রাগ হলো শারফানের৷ দ্রুত সানার হাতটা ছাড়িয়ে দিল আর দৃঢ় গলায় বলল‚ “আজকে রাতেই নিজের বোনকে পাশে পাবে‚ যদি এক্ষুনি হাসিবের হদিস না পাই আমি।”

“বলব‚ কিন্তু…” এক মুহূর্ত থেমে নিঃশব্দে কেঁদে উঠল সানা। তারপর বলল‚ “হাসিব ভালো ছেলে ছিল৷ আমার আব্বু ওকে খুব স্নেহ করত। ও যে এমনটা করেছে তা আমাকে ভাবাচ্ছে খুব৷ আমার মন বলছে ফারনাজ ওকে হয়ত কোনোভাবে বাধ্য করিয়েছে। ওকে মারধর করার আগে ওর মুখ থেকে ওর কথাগুলো শুনবেন প্লিজ৷ ওর বাবার লিভার ক্যান্সার। তাই ও-ই একমাত্র সম্বল ওর পরিবারটার জন্য।”

“তুমি এত পরোপকারী কি শুধু নিজের রিলেটিভের জন্য?” তিরস্কার ছুড়ে দিল শারফান।

কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না সানা। কেবল হাসিবের অবস্থান জানিয়ে দিল ওকে।

সানা ঢাকা প্রবেশের দুদিন পর হঠাৎ সকালে হাসিব কল করে তাকে৷ বোনের বিয়ে সামনের মাসে৷ দুলাভাইয়ের জন্য বিয়ের কেনাকাটা করতে ঢাকায় এসেছে সে। এবং আরও কিছু কাজে ওকে পাঠিয়েছে ওর বাবা—এমনটাই জানায় সে সানাকে। তারপরই ওর থাকার মতো একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করে বসে‚ যেন সানা নিজের মা বা বাবার সঙ্গে কথা বলে ওর হয়ে। অবিশ্বাসের মতো কোনো কথা নয় বলে সানা মামির সাথে কথা বলে ওকে চলে আসতে বলে মালিবাগে।

মূলতঃ ঢাকায় ডাক্তার দেখানোর জন্য গত বছর হাসিব আর ওর বাবাকে নাজমা বেমগের কথায় অতিথি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সানার মামিই। সেখানেই দ্বিতীয়বার থাকার সুযোগ চাচ্ছিল সে৷ তবে জানত না সানা নিজেও উপস্থিত সেখানে৷

ফারনাজ কথা দিয়েছিল হাসিবের থাকা-খাওয়ার খেয়াল রাখবে৷ কিন্তু নিজের বিপদ সামলাতে গিয়ে ওর কথা একদম ভুলে বসে সে৷ তাই বাধ্য হয় হাসিব সানার কাছেই সাহায্য চাইতে। ওকে সন্দেহ করার মতো সুযোগটা সানা পায়নি এতদিনে। কাজের কথা বলে দিনের প্রায় পুরোটা দিনই হাসিব বাইরে ঘুরে বেড়াত। আর ওদিকে খালাত-মামাত ভাই-বোন একত্র হওয়ায় আনন্দের মাঝে সানাও সেভাবে খেয়াল করতে পারেনি ওর অস্বাভাবিকতা।

আরেকবার মৃদু হাসল শারফান—বিষণ্ণ আর তাচ্ছিল্যতাপূর্ণ‚ “তাহলে দুজন এক সঙ্গেই লুকিয়ে ছিলে?”

“লুকোইনি তো”‚ কান্নায় আটকে আসা গলায় বলল সানা‚ “আমার কাছে তো নিজের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। আপনি হাসিবের স্বীকারোক্তিতে যা পাবেন‚ তা পাওয়ার পর যদি মনে হয় আমি এভাবেই শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তবে… তবে ফিরে এসে আমাকে একদম শেষ করে দেবেন। কিন্তু একটা অনুরোধ রাখছি‚ অন্তত আমার লাশ যেন আব্বু আম্মু দেখতে পায়।”

কোটরে ঢুকে থাকা ভেজা চোখদুটো আর নিজের মৃত্যুর আবদার করা ফ্যাকাশে‚ শুকনো ঠোঁটজোড়া নিবিড়ভাবে চেয়ে দেখল শারফান। তারপর সারা মুখটাই চোখ বুলাল৷ আজ সারাটাদিন তার সঙ্গে কাটানোর ফলে ক্ষণে ক্ষণেই ওর বিবেকে কড়া নাড়ছে একটি প্রশ্ন—এত বড়ো অন্যায় এই সরল‚ কোমল মুখের মেয়েটি কখনো করতে পারে? হৃদয়টাতেও কেমন উথাল-পাথাল করছে সানার কষ্টে‚ কান্নায়। যেন কেউ বারংবার বলছে ওর কানে-কানে‚ “তুমি ভুল করছ‚ শায়াফ। তুমি যে কান্না সহ্য করতে পারছ না‚ ক্লান্তবোধ করছ‚ সে কান্নাতেই তোমার জবাব—ও নিরপরাধ।”

এখনো যেন কথাগুলো মনের আনাচে-কানাচে ঘুরপাক খেয়ে চলছে৷ সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল শারফান৷ একটুও আর দেখতে চাইল না সানার বুক ভাঙা কান্না‚ শুনতে চাইল না তার অসহায়‚ করুণ আর্জি। বেরিয়ে পড়ল দ্রুত ঘর থেকে৷ নাফিস আর পাভেলকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল তক্ষুনি। ড্রাইভ করল পাভেল আর প্যাসেঞ্জার সিটে বসে সারাটা পথ শারফান ভেবে গেল কেবল সানাকেই।

***

রাত প্রায় ৯ টা।
হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ রেলগেটের পাশের ছোট্ট পথে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল হাসিব। তারপর ফোনটা বের করে কল দিল অচেনা সেই নাম্বারটিতে—বেশ কিছুক্ষণ আগে যে নাম্বার থেকে কল এসেছিল৷ পরিচয় দিয়েছিল ফারনাজের লোক। খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর বলে পাঠিয়েছে নাকি ফারনাজ।

ফারনাজের জেলে যাওয়ার সংবাদটা এখনো পৌঁছায়নি ওর কাছে। মোস্তফা সাহেবের থেকে জানার সুযোগ ছিল কেবল৷ কিন্তু সানা নিখোঁজ হওয়ার কারণে সবাই দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত। নিজেও সঙ্গ দিচ্ছে তাদেরকে। নিজের কর্মের জন্য তো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলই সে‚ এখন সানার জন্যও দুশ্চিন্তায় অস্থির সে। এখনো চলছে রোজ পুলিশের কাছে তাদের অনুনয়-বিনয়৷ মোটাদাগে টাকা খাওয়ার কারণে পুলিশও কিছুটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে মামলাটা৷

কল রিসিভ হওয়ার অপেক্ষা করল হাসিব৷ কিন্তু ধরল না লোকটা। কেমন ভয় ভয় লাগছে শুনশান জায়গাটায় এসে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন লুকিয়ে থাকতে হবে সেটা জানার জন্যই মনের ভয়কে দূর করে চলে এসেছে সে৷ সামনে আবার এইচএসসি পরীক্ষা। বাড়িতে হয়ত সবাই চিন্তায় পাগল হয়ে গেছে। তারা কেউ ধারণা করতে পারছে না‚ সে সানার মামার বাড়িতে এসে থাকতে পারে৷ নয়ত কবেই সন্ধান করত এখানে এসে! যে ফোন নাম্বারটা ব্যবহার করছে‚ সেটাও তেমন কারও জানা নেই৷ কেবল সানাকেই কল করা হয়েছিল সেদিন৷ কিন্তু ফারনাজের কাছে নাম্বারটা কী করে পৌঁছাল সেটা একদম মাথায় এল না হাসিবের।

অপেক্ষার মাঝে পাশের ঝোপে কী যেন নড়ল—বুক কেঁপে উঠল হাসিবের৷ কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল কিছু। কিন্তু দেখা গেল না কোনো মানুষকে‚ কোনো কুকুরকে। তখনই একটা মাইক্রোবাস গেটের পাশে এসেই থেমে গেল। দরজা খুলে গেল এক ঝটকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল হাসিব। দেখল‚ গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। ভালোভাবে কিছু বোঝার আগে নেমে এল নাফিস আর পাভেল। জিজ্ঞেস করল নাফিস‚ “তুমিই হাসিব?”

এই কণ্ঠটাই হাসিবের সাথে কথা বলেছিল। তাই হাসিব বিশ্বাস করে এগিয়ে গেল তার কাছে‚ “জি‚ ভাই। ফোন করছিলাম আপনাকে।”

কথাটা সম্পূর্ণ করার সুযোগ পেল না হাসিব। তার মাঝেই ঝট করে মুখে রুমাল চেপে ধরল পাভেল৷ জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত চেপেই রাখল। তারপর দুজন ধরাধরি করে ওকে গাড়িতে তুলে নিল। ঘন্টাখানিক পর চলে এল একটি ফাঁকা গোডাউনের ভেতর৷ হক ইন্ডাস্ট্রির গোডাউন এটা। আপাতত কেউ নেই এখানে৷

হাসিবকে মেঝেতে শুইয়ে দেওয়ার পর তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনল নাফিস। শারফান একটা চেয়ার টেনে এনে বসল তার সামনে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা বিদ্রুপ স্বরে বলে উঠল‚ “শালার অপরাধীদের চেহারা যদি এত ভালো হয়‚ তাহলে ভালো মানুষরা আল্লাহর কাছে কী দোষ করেছিল বুঝলাম না।”

পাশ থেকে পাভেলও হাসল। চোখ কুঁচকে বলল‚ “দুনিয়াতে ওরা ধোঁকা দেবে বইলাই তো আল্লাহ এগের চেহারা খাসা বানাইয়া পাঠাইছে।”

চোখ খুলতেই ফ্লাডলাইটের তীব্র আলো যেন চোখদুটো ঝলসে দিতে চাইল হাসিবের। চারদিক তার ঝাপসা লাগল কিছুক্ষণ। সামান্য সময় দিল শারফান‚ ধাতস্থ হওয়ার জন্য। কিছুটা স্বাভাবিক হতেই কাঁপা চোখে সামনে তাকাল হাসিব। তখনই হুকুম এল শারফানের কণ্ঠে‚ “উঠে বস।”

ঘরের মধ্যে গুমোট গরমে সবাই ঘেমে উঠেছে ইতোমধ্যে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তড়িঘড়ি উঠে বসল হাসিব। তটস্থ সুরে জিজ্ঞেস করল শারফানকে‚ “আপনি কে‚ ভাইয়া? ফারনাজ ভাইয়ের লোক না?”

“তোর ফারনাজ ভাইয়ের জন্য আজরাইল আমি‚ আর এখন তোর জন্যও”‚ ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল শারফান।

ওকে ভালো করে দেখতেই বুঝে গেল হাসিব‚ এই চেহারার পেছনে রয়েছে সেই ভয়ঙ্কর পরিচয়। জারার ভাই—শারফান। সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল সানার সেদিনের সতর্কবার্তাও। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল শারফানের পায়ে। কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল‚ “ভাইয়া… আমি ভুল করছি। মাফ করে দেন ভাইয়া‚ প্লিজ!”

কিন্তু শারফানের মনে পড়ল—এই ছেলেটিকেই তো অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছিল ওর বোন। সে বিশ্বাসকে পুঁজি করেই সে ঠেলে দিয়েছিল জারাকে মৃত্যুসম বিপদের মুখোমুখি। সানার বেলায় যেটুকু সহনশীলতা আর মায়া ওকে পশু হয়ে ওঠা থেকে থামিয়ে রাখত‚ এ মুহূর্তে সেই মানবিক প্রবৃত্তির এক বিন্দুও অবশিষ্ট রইল না ওর মধ্যে।

ও যেন আগুন হয়ে উঠল। হাসিবের চাঁদির ওপরের চুল শক্ত মুঠোয় ধরে একের পর এক থাপ্পড় মারতে থাকল তার মুখে। নিঃসাড় গোডাউনের ভেতর প্রতিটি আঘাত যেন ধ্বনিত হতে থাকল বজ্রের মতো‚ আর তার ফাঁকে ফাঁকে মিশে যাচ্ছিল হাসিবের কাতরতা‚ অসহায় কান্নাকাটির শব্দ। গালদুটো ফুলে গরম হয়ে উঠল তার‚ প্রতিটি আঙুলের ছাপ গেঁথে যেতে লাগল কালচে দাগ তৈরি হয়ে। একসময় ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল‚ নাক দিয়েও গড়িয়ে পড়ল রক্ত। গোডাউনের কংক্রিট মেঝে নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল উন্মাদ ক্রোধের‚ হিংস্র প্রতিশোধের‚ আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণের।

“আমি চাই নাই‚ ভাইয়া… আমি চাই নাই জারার সাথে মিশতে…” চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ল হাসিব। “আমাকে ফারনাজ ভাই হুমকি দিয়েছিল…”

শারফান থেমে গেল। কানে ঢুকল কথাটা‚ কিন্তু হাতের মুঠোয় চুল চেপে ধরা রইল একইভাবে। “কিসের হুমকি? ঠিকঠাক করে বল। সত্যি বলবি—না বললে তোর বোনেরও সেই পরিণতি করব‚ যা তুই আমার বোনের সাথে করছিস।”

হাসিব হাঁপাতে লাগল। শরীর নিস্তেজ‚ চোখ ঝাপসা। পানি খেতে মন চাইল। কিন্তু চাওয়ার সাহস হলো না। সে বলতে শুরু করল সমস্তটা—বোনের বিয়ে ভাঙার ভয় দেখানো‚ ক্যান্সার আক্রান্ত বাবার জন্য যখন আবার সাহায্যের দরকার হবে, সৈয়দ কবিরের বাড়িতে গেলে তখন খালি হাতে ফিরতে হবে—এই হুমকি। পরিবারে চলা অভাব‚ অসহায়তা‚ আর আত্মীয়দের দয়ার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার কষ্ট। প্রতিটি কথা যেন তার বুক চিরে বের হচ্ছিল।

নাফিসের মনে মায়া এসে ভিড়ল ছেলেটার কথা শুনে। নিজের শৈশব‚ কৈশোরের দুঃসহ দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল তার। হাসিবের তবু সাহায্য পাওয়ার উপায় আছে। তার পরিবারের যে তাও ছিল না। সে এগিয়ে এসে শারফানের কানে কানে বলল‚ “ভাই, এই পোলাডা হইলো ফারনাজের হাতের কাঙালি পুতুল। ওরে মারলে আপনার কোনো ফায়দা হইব না। লাভ হইব যা তা হলো ওর মা-বোন রাস্তায় ভিক্ষা করে বাঁচব। আপনার দরকার তো ওই বান্দির পুলাগুলারে, যারা কিডন্যাপে জড়িদ ছিল আর ভিডিওগুলা যাগো কাছে আছে। এই পোলা নিজেই আরাক ভুক্তভোগী। যে চো** দিছেন‚ যথেষ্ট এর জন্য।”

শারফান চুপচাপ শুনল। আসলে সেও সবই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু রাগ সামলে উঠতে পারছে না কেবল। যেমন করেই হোক‚ জারার আজকের পরিণতির পেছনে প্রথম অবদান এই ছেলেটার বিশ্বাসঘাতকতাই যে! আবার এটাও সত্য—তার মেসেজের কারণেই সেদিন রাতের মধ্যেই জারাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।

হাসিব প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে দেখে শারফান পাভেলকে ইশারা করল। পাভেল এগিয়ে এসে ওর মুখে ঠান্ডা পানি ছিটাল। কিছু পানি খেতেও দিল। একটু সুস্থ হতেই শারফান জিজ্ঞেস করল‚ “সানা তোদের প্ল্যানের সঙ্গে জড়িত ছিল না বলছিস?”

মাথা নেড়ে না জানাল হাসিব। “সানা আপুর সাথে সেদিন আচমকা দেখা হয়ে গেছিল”‚ দম ফুরিয়ে আসা কণ্ঠে বলল‚ “আপু কিছু জানত না৷ ভেবেছিল জারার সাথে আমার প্রেম আছে হয়ত। তাই বারবার নিষেধ করেছিল এ ব্যাপারে না এগোতে‚ আর আপনার কথা বলেও সতর্ক করেছিল খুব।”

নাফিস আর পাভেল এক অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শারফানের দিকে চাইল৷ তারপরই দেখতে পেল ওর প্রতিক্রিয়া। কিছুক্ষণ থমকে থেকে হঠাৎ অস্থির ভঙ্গিতেৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে। নিম্নঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠল‚ “তবুও তো দোষী। না জেনে হলেও সেদিন দায়ী ছিল ও-ও।”

নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে যুক্তি খুঁজতে থাকল। বিশ্বাস করতে চাইল‚ যেভাবে সে সানাকে শাস্তি দিয়েছে‚ তা হয়ত সঠিক। কিন্তু না… কোনো যুক্তিই দাঁড়াতে পারল না নিজের বিবেকের সামনে। ওর মন-মস্তিষ্ক কোনোটিই এখন আর সমর্থন করতে পারল না সানাকে দেওয়া শাস্তিগুলোকে৷ আজ সারাদিন ধরে তার মধ্যে যে অনুশোচনা ছায়ার মতো মিশে ছিল‚ সানা নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া মাত্র সেটাই রূপ নিল ভয়ানক আত্মরাগে—কেমন তেতো হয়ে উঠল মুখের ভেতরটা৷ নিজেকে আর সংবরণ করতে না পেরে সামনে থাকা চেয়ারটাই ভয়ঙ্কর এক লাথি মেরে বসল। ছিটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল সেটা‚ আর ওর ভেতরের বিষণ্ণতা ও দাহ যেন নিঃশব্দে গোটা ঘরটাকে ঢেকে ফেলল।

***

রাত ১১: ২০ মিনিট ।

হাইওয়ে ধরে প্রচণ্ড গতিতে শারফানের গাড়িটা ছুটে চলেছে চরগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে৷ একই সাথে মৌসুমিকে লাগাতার কল করে চলেছে। কিন্তু রিসিভ করছে না মেয়েটা। কেন করছে না ভেবেই চিন্তা বেড়ে গেছে ওর৷ হাসিবকে পাকড়াও করতে যখন ঢাকা পৌঁছাল ওরা‚ তার কিছুক্ষণ পরই নাফিসকে ফোন করেছিল মৌসুমি৷ জানিয়েছিল‚ সানার করুণ অবস্থার কথা৷ প্রচণ্ড জ্বরে বেহুঁশ হওয়ার দশা হয়েছিল নাকি৷ জ্বরের ওষুধপত্র খাইয়ে দেওয়ার নির্দেশ করে মাঝখানের সময়টাতে আর কোনো খোঁজ নেয়নি শারফান৷ কেবল হাসিবের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি পাওয়ার পরই সজাগ হয় ওর মনটা।

পথিমধ্যে হঠাৎ শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। উইন্ডশিল্ড ঝাপসা হয়ে উঠতেই ওয়াইপার দুটো থেমে থেমে একঘেয়ে ছন্দে কাচ মুছতে লাগল। বৃষ্টির পর্দা আর কাচের ওপরে ছুটে চলা জলের রেখার মাঝখানেই আচমকা ঘটল অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সামনের দিক থেকে আসা একটি গাড়ির তীব্র হেডলাইট চোখে পড়তেই মুহূর্তের জন্য যেন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলল শারফান। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া সেই ফাঁকেই সামনে চলতে থাকা একটি গাড়ির একেবারে পেছনে পৌঁছে গেল ওর গাড়িটা। তবে প্রতিক্রিয়া দ্রুত—শেষ মুহূর্তে ঝাঁকুনি দিয়ে ব্রেক কষে রক্ষা করল সম্ভাব্য সংঘর্ষ।

হাতে স্টিয়ারিং‚ পায়ের নিচে ব্রেক—সবকিছু ঘটে গেল কয়েক সেকেন্ডের ভেতর। ধাতব চাকার ঘর্ষণে রাস্তায় বিশ্রী এক শব্দ হলো। গাড়িটা থেমেছে আগের গাড়ির পেছন থেকে মাত্র এক চুল দূরে। মুহূর্তেই শারফানের শরীরজুড়ে যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল অ্যাড্রেনালিন।

যেতে পথে এক ট্রাক ড্রাইভার “শালা মাতাল নাকি” বলে গালি ছুড়ে চলে গেল৷ কানে এলেও গায়ে লাগল না কথাটা। শরীরের কাঁপন থামতেই মন স্থির করে আস্তেধীরে এগোল সে। সামনে বাজার পেল একটা৷ কী মনে করে যেন থামল সেখানে কিছুক্ষণের জন্য।

রাত ১: ২৫ মিনিট।
গাড়িটাকে প্রতিবারের মতো নির্দিষ্ট একটি গ্যারেজের দোকানে রেখে পায়ে হেঁটে নির্জন সড়ক পার করে চলে এল শারফান চূড়ান্ত গন্তব্যে। ছাতাটা মাথায় থাকলেও বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে গেল সে অনেকটাই৷ থপথপ পা ফেলে অবশেষে বারান্দায় এসে পৌঁছাল৷ এক কোণে ছাতাটা রেখে ডাকল মৌসুমিকে৷ কিন্তু ঘুম ভাঙল মৌসুমির দরজায় কড়া নাড়ার পর। তাড়াহুড়ো করে ফোনের আলো জ্বালিয়ে এসে দরজাটা খুলল সে৷ ওই শব্দে ঘুম ছাড়ল সদা সতর্ক থাকা জাঙেরও। শারফানের অস্তিত্ব টের পেয়েই বেরিয়ে এল দ্রুত।

“তোমাকে ফোন করেছি কতবার?” গমগমে আওয়াজ তুলে বলল শারফান‚ “ফোন কোথায় তোমার?”

জিভ কামড়ে কাঁচুমাচু মুখ করে উত্তর দিল মৌসুমি‚ “জ্বরেতে বেহুঁশির মতো ঘুমাইয়া গেছিলাম‚ সার৷ মাফ কইরা দ্যান।”

“তোমারও জ্বর এসেছে না-কি?”

“হ‚ সার। সন্দার পরতেই শরীলডা ভালা লাগতাছিল না। পাছে দেহি গাও গরম‚ মাথা ভার লাগে আমারও।”

“আর সানা? ওর কী অবস্থা? জ্বর কমেছে? বলেছিলে খেতে পারেনি রাতেও। কিছু খেয়েছে এরপর?”

“না‚ সার। দুফরতেই না খাওয়া ছেমরিডা৷ রাইতে খাওয়াবার যাইয়া দেহি জ্বরে ফুরাই বেহুঁশ৷ কোনোরহমে দুয়েক গাল ভাত দিবার পারলাম মুখি। কিন্তুক চাবাইতে পারল না। ওষুধ দিয়া শুয়ায় দেই তাই। এরফর আর খুঁজ নিবার পারি নাই। ক্যামনে যেনি মরার ঘুম ঘুমাই গেছি।”

“ঠিক আছে‚ দরজাটা খুলে দিয়ে তুমি শুয়ে পড়ো।”

“না‚ সার৷ আমি যাই ওর কাছে। দেহি কী অবস্থা! আফনে তো এক্কেরে ভিজাপুইড়া আইছেন… ঘরে যাইয়া গাও মুইছা বিশ্রাম লন।”

“বললাম তো তুমি যাও। রেস্ট করো। আমি দেখছি ওকে। আর সকালেই তোমার ছুটি।”

মৌসুমি কৌতূহল চোখে চাইলে তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলল শারফান‚ “সকাল হলে বলব৷ দরজাটা খোলো আগে।”

হাতে অনেকগুলো ব্যাগ শারফানের। সেগুলো কিসের—তা নিয়েও কৌতূহল জেগেছিল মৌসুমির৷ কিন্তু তা আর জানার সুযোগ হলো না। দরজাটা খুলে দিয়ে শারফানের আদেশে জাংকে নিয়ে চলে গেল সে৷

ঘরে ঢুকে ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে ভেতর থেকে দরজায় খিল দিল শারফান৷ সানার দিকে আলো ফেলে এগিয়ে এল ওর কাছে। হাঁটুজোড়া বুকের সাথে লাগিয়ে মাথা গুঁজে পড়ে আছে মেয়েটা৷ নিঃশ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না তাও বোঝা যাচ্ছে না৷ হঠাৎ হঠাৎ শরীরে কাঁপুনি দিচ্ছে তা দেখা গেল কেবল। একটা ব্যাগ থেকে শারফান দ্রুত কোমফোর্টার বের করে গায়ে জড়িয়ে দিল ওর। তারপর শিথানে বসে বৃষ্টিতে ভেজা শীতল হাতটা ওর কপালে রাখল—ধুম জ্বর টের পেল। ওষুধে কোনো কাজই হয়নি তবে। মৃদুস্বরে ডাকল বেশ কবার। সাড়া দিল সানা চোখের পাতা একবার কাঁপিয়ে। তাই আবারও ডাকল ওকে‚ “অ্যাই‚ শুনছ? সানা?”

এবার একটুখানি খুলল চোখদুটো—নিভু নিভু দৃষ্টি। কিন্তু সামনে সবই ঝাপসা ওর৷ খুব ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখছিল—নিজের মৃত্যুর। অর্ধচেতন সানা ভেবে নিল তাই‚ সে মরেই গেছে৷ আত্মার দৃষ্টিতেই এখন দেখছে সব কিছু৷ “কই আমার কবর?” প্রলাপ বকতে শুরু করল হঠাৎ‚ “আমার কবর খোঁড়া হয়নি এখনো? আমার শেষ গোসলও তো হলো না… আমার জানাজা পড়ল না কেউ… আমাকে শেষবারের মতো দেখল না কেউ‚ আব্বু দেখল না… আম্মুও দেখল না—আম্মু কই তুমি?”

মাকে ডেকে ওঠার পর এক মুহূর্ত থেমে কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে‚ “কেউ কাঁদে না আমার জন্য? আমার লাশের কাছে কেউ নেই। মেহা… এই মেহা‚ তুইও নেই? তুই তো খুশি‚ না? আমার সব কিছু আজ থেকে তোর হয়ে গেল যে। আর তো আমি ঝগড়া করতে পারব না… মারও খাবি না আমার হাতে… আমি আর কোনোদিনই ফিরব না তোদের কাছে…”

মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে সব কথা শুনতে পেল শারফান৷ জারা আর তার বাবার বিপদের পর হৃদয়টা যেন আজ আবার ঠিক একইভাবে মোচড় দিয়ে উঠল… ভেতরে কোথাও কিছু একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে অনুভব হলো তার। হঠাৎই সানাকে টেনে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরল—ঠিক সেদিনের মতো‚ যেদিন জারাকে জড়িয়ে ধরে দৌড়েছিল হাসপাতালে। পাথরের মতো নীরব হয়ে জড়িয়ে রাখল ওকে‚ অনেকক্ষণ। মনে হচ্ছিল‚ জাগতিক সব কিছু ছেড়ে কোথাও হারিয়ে গেছে সে সানাকে সঙ্গী করেই।

আর সানার খেয়ালে এল তখন পুরোপুরি ভিন্ন দৃশ্যপট। “আব্বু…” বাবাকে ডেকে উঠে বিড়বিড় করল‚ “আমি মরে যাওয়ার পর বুকে নিলে তুমি?”

“চুপ‚ সানা”‚ কানের কাছে ঠোঁটটা নামিয়ে ফিসফিসানির মতো বলল শারফান‚ “তুমি বেঁচে আছ। কিচ্ছু হয়নি তোমার৷ তুমি জীবিতই ফিরবে তোমার আব্বুর বুকে। আলো ফুটতে দাও‚ আমি পৌঁছে দেব৷ চিনেছ আমাকে? তাকিয়ে দেখো একবার—আমি শায়াফ।”

কোনো জবাব দিল না সানা। নিঃশব্দে চোখদুটো পিটপিট করল কয়েকবার। শারফানও আর কোনো কথা বলল না৷ ওকে শুইয়ে দিল আবার৷ ব্যাগগুলো থেকে খাবারের বক্স বের করল এরপর৷ তখন বাজার দেখে খেয়ালে এসেছিল‚ জ্বরে ভুগতে থাকা সানার জন্য দরকার হবে এগুলো।

সে জানত—জ্বরের সময় মানুষ যতটা না ওষুধ খায়‚ তার চেয়েও বেশি দরকার হয় স্নেহ আর নরম কিছু খাবার। সানার ম্লান মুখ‚ ফ্যাকাসে ঠোঁট আর কম্পিত শরীর কল্পনা করে তার মনের ক্যালেন্ডারে ভেসে উঠেছিল নিজের পুরনো দিনগুলোর স্মৃতি—যখন অসুস্থ থাকলে মা গরম ভাতের মাড়ে একটু ঘি মিশিয়ে দিত‚ কিংবা ঝাল ঝাল খিচুড়ি। ঠিক সেইসব মুহূর্তের টানেই বাজারে ঢুকে পড়েছিল সে। নিজের অভিজ্ঞতা আর মায়ার সংমিশ্রণে যা যা দরকার‚ সব নিজে হাতে গুছিয়ে নেয়। হোটেলে স্যুপ বানানোর ব্যবস্থা না থাকলেও দোকান থেকে প্রস্তুত স্যুপের প্যাকেট কিনে নিয়ে হোটেলের রসুইঘরে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়ে নেয় সেটা। যেতে যেতে ঠান্ডা হবে ভেবে হটপটে ভরে নেয়।

কিন্তু খিচুড়ি খাওয়াতে পারবে কি-না‚ এ সংশয়ে ভুগে স্যুপটাই হাতে নিল শারফান৷ সানার কাছে এসে ওকে ডাকাডাকি করল‚ উঠে বসতে বলল৷ সানা তা শুনল না। কী করবে এখন—স্যুপের হটপট হাতে নিয়ে বসে সেটাই ভাবনাচিন্তা করল সে কিছুক্ষণ৷ মেঝেতে হটপটটা রেখে দিয়ে ওকে হঠাৎ কোলের মাঝে তুলে নিল৷ হুঁশে নেই ও‚ তাও কেমন অপ্রস্তুতবোধ করল শারফান। এভাবে যত্ন কোনোদিনও কাউকে করা হয়নি যে! এমন অভ্যাসও নেই তাই।

“অ্যাই‚ হাঁ করো একটু”‚ সানার মুখে কাছে চামচ ভর্তি স্যুপ ধরে ডাকল শারফান‚ “সানা? কথা শোনো। মুখটা খোলো।”

কেমন অবাধ্যের মতো পড়ে রইল সানা শারফানের বুকে। অনাভ্যাস হাতে চামচটা ওর ঠোঁটে আলতো করে ছোঁয়াল শারফান। তারপর আবার ডাকল‚ “সানা‚ হাঁ করো।”

ঠোঁটে গরম আঁচ পেতেই ঠোঁটদুটো ছড়াল সানা৷ প্রলম্বিত শ্বাসটা ফেলে তখন বেশ কবার খাওয়াল শারফান। বেশি করে লেবুর রস মেশানো সেই উষ্ণ স্যুপে জিভেতে একটু স্বাদ টের পেল সানা। তাই অরুচি দেখাতে পারল না।

রাত যেন থমকে আছে একই জায়গাতেই। হাত ঘড়ির কাঁটাও হাঁটছে নিঃশব্দে‚ যেন বৃষ্টির শব্দেই হার মেনেছে। বাইরে তখনো বৃষ্টি ঝরছে অবিরত—নরম অথচ জেদি ঝরনার মতো। টিনের চালে টুপটাপ করে পড়ে চলেছে একটানা জলের ছন্দ‚ আর সেই ছন্দে শারফানের মনের কোথাও মিশে আছে অন্তর্বেদনা‚ অনুশোচনা আর অব্যক্ত বাক্য। যা কোনোকালেই প্রকাশ করতে পারবে না সে৷

তার কোলের ওপর মাথা রেখে নির্জীব পাতার পড়ে আছে সানা। ওড়নার এক কোণা ছিঁড়ে নিয়ে ওকে জলপটি করে চলেছে সে। একটুও বিরতি নেই; কপালে‚ গালে‚ গলায় বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই ভেজা কাপড়। ঠান্ডা সেই স্পর্শে আরও গুটিয়ে গেল মেয়েটা। গায়ের কমফোর্টারেও শীত মানছে না দেখে সে গায়ের শার্টটা ওকে পরিয়ে দিল নির্দ্বিধায়‚ ভীষণ এক মায়ার তাড়নায়। একটা গরম শরীর আর গা-পোড়া জ্বরের মাঝখানে যেন দাঁড়িয়ে সে। শুধু চেষ্টা করে গেল ওকে একটুখানি আরাম এনে দিতে। কিন্তু জ্বরে যে সমস্ত শরীরটাই ব্যথা সানার৷ মুখে কোনো কথা নেই‚ শুধু আর্ত গোঙানি। তা শোনার মতোই‚ কিন্তু বোঝার মতো নয়৷

শারফান থমকাল। বুঝতে চেষ্টা করল‚ ও স্বপ্নে কাঁদছে না-কি কোনো যন্ত্রণায়? একটা হাত ওর কপালে রাখতেই ফিসফিসিয়ে ‘আম্মু’ ডেকে উঠে করুণ এক সুরে কেঁদে উঠল মেয়েটা৷ শারফান ভাবল‚ মাকে কাছে না পাওয়ার কথা স্মরণ হচ্ছে বলেই হয়ত এমন করে কাঁদছে সে৷ অনুতাপে পুড়ে ওকে আরও একবার আগলে নিল বুকের ভেতর। একটু ঝুঁকে ঠোঁটটা চেপে ধরল ওর কপালে। অনুভব করল‚ কপালটা একটু ঠান্ডা লাগছে এখন। তাপটা কি তবে কমেছে? হয়ত…

অপলক তাকিয়ে থাকল সে সানার মুখের দিকে। কোনো এক ভাবনায় ডুবল যেন। তারপরই ডেকে উঠল ওকে‚ “সানা? কোনো কষ্ট হচ্ছে?”

চোখ দুটো অল্প ঘুমে ডুবে আছে সানার৷ আর ঠোঁটের কোণে লেগে আছে কাতরতা। ফিসফিসিয়ে জবাব রাখল কিছু একটা। শারফান শুনতে পেল না সবটা। কেবল কানে এল ‘হাঁটুর মধ্যে’ শব্দদুটো৷ তাতেই বুঝে গেল জ্বরে গাঁটে গাঁটে ব্যথা হচ্ছে হয়ত। অসহায়বোধ করল সে। এত যন্ত্রণার উপশম সে করবে কী করে?

“একটু শুনবে‚ সানা?” ওর কপালে নিজের চিবুকটা মিশিয়ে ধরল শারফান। ঘন স্বরে বলল‚ “আর কয়েকটা ঘন্টা। তারপরই তুমি ঘরে পৌঁছাবে… তোমার আব্বু-আম্মু‚ তোমার বোনের কাছে। তুমি মুক্তি পাবে আমার দেওয়া সকল কষ্ট থেকে। তবে আমি যে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমায়‚ যে ক্ষতিটা করে ফেলেছি—তার কোনো মাফ নেই। তাই মাফ চাইব না… চাইতে পারিও না আমি। তবে আজ থেকে আমার মৃত্যুর আগ অবধি আমাকে ধ্বংস করার সমস্ত অধিকার পেলে তুমি। ইফ ইউ এইম ফর মাই চেস্ট‚ আই’ল স্টিল গিভ ইউ দ্য গান। আর যদি চাও আমি নিজেই সারেন্ডার করি পুলিশের কাছে—তাও করব৷ সারা পৃথিবীর সামনে দাঁড় করিয়ে আমার ফাঁসি চাইলে আমি তাতেও রাজি। তোমার সব শাস্তি মঞ্জুর‚ সানা৷ শুধু কয়েকটা দিন আমার জন্য লিখে দেবে? আমার বোনের ক্ষতি করা কুকুরগুলো এখনো স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে‚ ঘুরে বেড়াচ্ছে কত নিশ্চিন্তে। আমি ওদের জবান চিরতরে বন্ধ না করা পর্যন্ত মরেও শান্তি পাবো না৷ আমাকে জেলে পুরলেও আমি থাকব না সেখানে৷ কিন্তু আমি তোমার কাছে প্রমিজ করব‚ সানা‚ আমার কাজ শেষ হওয়া মাত্রই আমি তোমার সামনে এসে দাঁড়াব৷ তুমি ততদিনে ভেবে রেখো‚ কীভাবে আমায় শাস্তি দিলে তোমার আত্মা শান্তি পাবে৷”

চলবে।