#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪১.
[পিন কমেন্ট চেক করবেন]
শরীরটা ভিজে চপচপে হয়ে উঠেছে ঘামে। নিজেকে ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ হওয়ার মতো লাগছে সানার। চোখদুটো ক্লান্ত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ স্থির হলো ঘুমন্ত শারফানের মুখের ওপর। তারপরের প্রতিক্রিয়াটা হলো শূন্য সেকেন্ডের মাঝে—কমফোর্টারসহ গড়িয়েই নেমে এল সে তার বুকের ওপর থেকে৷ জ্বরের ঘোরে টালমাটাল অবস্থায় ছিল বিধায় উষ্ণতা বাড়াতে একেবারে রোলের মতো ওকে কোমফোর্টারের মধ্যে পেঁচিয়ে নিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল শারফান৷
ভেজা মাটির ওপর থেকে সরে এসে চটের এক কোণায় বসল সানা। গায়ে হাত দিয়ে বুঝল‚ জ্বর অনেকটাই ছেড়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আরেকবার ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিল শারফান‚ মনে পড়ল সেটা। কিন্তু শরীরের দুর্বলতা আরও বেড়েছে। ওড়নার কোণা দিয়ে ঘাড়‚ গলা আর বুক মুছতে মুছতে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে শারফানের দিকে। লোকটা ওভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল কী জন্য? আশ্চর্য! একদম ভালো লাগেনি ওর৷
মেঝেতে রাখা খাবারের বক্সগুলোর দিকে চোখ পড়ার পরই গ্লাসের পানিতে ভেজানো জলপটি দেওয়া কাপড়টাই গিয়ে নজর থমকাল ওর। আবছা আবছা চোখে দেখেছিল সে‚ ওকে জলপটি দিচ্ছে শারফান৷ তখনই বেশ বিস্ময়পূর্ণ লেগেছিল ব্যাপারটা। তারপর যেন কী কী বলল লোকটা? মনে করার চেষ্টা চালানোর মাঝেই খাবারের গন্ধে মারাত্মক ক্ষুধা অনুভব হলো ওর৷ প্রতিটি বক্সের ঢাকনি আধাআধিভাবে খুলে রাখা৷ একটাই খিচুড়ি‚ আরেকটাই ভাত আর কী কী ভর্তা যেন‚ আর পলিথিন ব্যাগের মধ্যে কলা‚ কমলালেবু‚ আঙুর ফল। নিজের বাড়ি ছাড়া বাইরে কোথাও খাবারের ব্যাপারে ওর মাঝে ভীষণ চক্ষুলজ্জা কাজ করত আগে। কিন্তু টানা কতগুলো দিন অভুক্ত থাকায় তার ছিটেফোঁটাও আর নেই এ মুহূর্তে। তাছাড়া খাবারগুলো যেহেতু ওর জন্যই আনা‚ সেখানে চুপচাপ না খেয়ে বসে থাকার প্রয়োজন কী? ঘুমন্ত শারফানকে এক নজর দেখে নিয়েই খিচুড়ির বক্সটা এগিয়ে নিল সে।
বেশ সাবধানে ডান চোখটা অল্পখানি খুলে শারফান দেখল ওকে৷ সে মোটেও ঘুমায়নি। এমন পরিবেশে এক মিনিটের জন্যও তার ঘুম হয় না৷ উপরন্তু সানার গায়ের তাপে বেশ অস্বস্তি লাগছিল৷ তবুও কোমল শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে বেশ ভালো লাগছিল বলেই বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখদুটো বুঁজে ছিল কেবল। দুজনের কিছু বিশেষ বিশেষ স্মৃতিগুলোকে উলটে পালটে দেখছিল আর মনের গহিনে তা নিয়ে এবং এ কদিনে তার মাঝে বয়ে চলা কিছু অনুভূতিকে নিয়ে হিসাব কষছিল। এর মাঝেই নড়েচড়ে ওঠে সানা‚ আর তখন ওর প্রতিক্রিয়া জানার জন্যই চুপচাপ ঘুমের ভান ধরে সে পড়ে থাকে।
ধীর গতিতে ছোটো ছোটো লোকমা তুলে মুখে পুরছে সানা। ওই লোকমা দেখেই শারফানের বোঝা হয়ে গেল‚ সর্বোচ্চ আর পাঁচ-ছয় লোকমা খেতে পারবে মেয়েটা। দৃশ্যটুকু দেখে আত্মদহনের আঁচে বুকের বাঁ পাশটাই ব্যথা জেগে উঠল তার‚ আর সেই সুযোগে বিবেকটা যেন বলে উঠল‚ “ওর জীবন থেকে এই সাত-আটটা দিন তুই মুছে দিতে পারবি কখনো? পারবি না তো। তাহলে তোর এসব কষ্ট ফস্ট পাওয়ার ধার ধারে কে?”
বুক চিরে ছুটে আসা দীর্ঘশ্বাসটা ফেলল শারফান খুব সংগোপনে৷ চোখদুটো বুঁজে নিয়ে সানার পরবর্তী সময়গুলোতে কিসের মুখোমুখি হতে হবে‚ তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আচমকা একটা চিন্তা উদয় হলো। সে শাস্তি পেলেও যে সানা আগের মতো সুখী মেয়েটা হয়ে যাবে‚ তা তো নয়। একজন ছেলের নিখোঁজ হওয়া আর একটি মেয়ের নিখোঁজ থাকার কথাটা শুনতে একরকম লাগলেও এর ভাবার্থ সমাজের কাছে দুরকম। চরিত্রে কাদা কেবল মেয়েদেরই লাগে—ছেলেদের নয়৷ মেয়েটা ভবিষ্যতে ভালো চাকরি করলেও তার জীবনের মূল ঠিকানা হতে হয় স্বামীর ঘর৷ সেখানে মেয়েটার চরিত্রের বদনাম রটে গেলে কি আর কখনো ভালো পাত্রস্থ করা সম্ভব হয়? যেমন জারাকে নিয়ে এখনই জেসমিন বেগমের মাঝে এ চিন্তা ঢুকে পড়েছে কঠিনভাবে। নিশ্চয়ই সানাকে নিয়েও ওর বাড়িতে তা-ই হবে?
তাহলে এখন উপায়? কী করে ওর চরিত্রের কালিমা মুছবে সে? যতটুকু খোঁজ নিয়েছিল হাসিবের থেকে‚ ওর পরিবারটা এখনো ঢাকাতেই৷ সানাকে পাওয়ার পর তারা হয়ত ফিরে যাবে ফরিদপুর। তারপর কী হবে ওর‚ সে খবর জানার উপায় থাকবে না আর৷ তার আগেই কিছু একটা করতে হবে ওর জন্য।
এ ভাবনার সঙ্গে আরও একটি ভাবনা যুক্ত হলো তার মনে। এ ঘরে এ সাত দিনের প্রতিটি রাত সানার চোখে ছিল হয়ত মৃত্যুকূপ। এ দিনগুলোর ভয়ের ছাপ যদি মাথায় গেঁথে যায়‚ তবে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি প্রয়োজন ওর মানসিক সুস্থতাও৷ যেমনটি জারার ক্ষেত্রেও চলছে। সানার জন্যও এমনই একটা ব্যবস্থা করতে হবে তাকে৷
ওর জীবনটাকে ঠিক আগের মতো করে দেওয়ার ক্ষমতা যদিও নেই তার। কিন্তু ওর ক্ষত সাড়িয়ে তোলার জন্য যতখানি করতে হয় তাকে‚ ততখানিই করবে সে৷ ওর সুস্থতা থেকে শুরু করে প্রয়োজনে ওর জন্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত নিজেরই পরিচিত বা ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু‚ বা বড়ো ভাই‚ অথবা নিজের কোনো ব্যবসায়িক শুভাকাঙ্ক্ষী—যারা প্রকৃত পুরুষ বলে বিবেচিত‚ তাদের কাউকেই ওর জন্য নির্বাচন করে দেবে। তার মতো অমানুষের স্মৃতিগুলো ওকে যত্ন করে‚ ভালোবেসে ওর মন থেকে মুছে দিতে পারবে যে পুরুষ‚ তেমন কাউকেই পাঠাবে সে ওর জীবনে৷ এটুকু ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়েছে।
সানা খেতে খেতে ভাবনাচিন্তা চালাতে থাকল শারফান৷ এর মাঝেই খাবার গলায় আটকাল সানার। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে৷ “ওই যে‚ তোমার হাতের বাঁয়েই পানির বোতল”‚ বলল অস্থির গলায়।
কিন্তু সানা বেশ অপ্রস্তুত হলো। লজ্জায় শারফানের কথা যেন কানেই ঢুকল না ওর। তাই শারফানই এগিয়ে এসে দ্রুত বোতলের ঢাকনা খুলে ওর মুখে কাছে ধরল‚ “হাঁ করো।”
বোতলটা তখন সানা নিজে হাতে ধরতে চাইলে তা দিল না শারফান। বলল কোমল স্বরে‚ “তুমি হাঁ করো‚ আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।”
বাধ্য মেয়ের মতো কথা মানল সানা। শারফান স্নেহের স্পর্শে ওর চিবুকটা ধরে পানি খাওয়াতে লাগল তখন। কিন্তু এই সাধারণ মুহূর্তটাও যে ওকে অপরাধবোধে ভোগাবে‚ তা কি জানত? নিমেষহীন তাকিয়ে রইল সানার ভিজে ওঠা চোখদুটোই।
তার মনে পড়ল নিজের ছেলেবেলার কথা। বাবার হাতে মার খেয়ে বুকে কষ্ট নিয়ে নিজেকে যখন গুটিয়ে রাখত ঘরের মধ্যে‚ মা খেতে বললেও খেত না। তখন শাফিউল সাহেব হাতে খাবারের থালা নিয়ে এসে আদর সুরে ডাকতে ডাকতে মুখের সামনে ভাতের লোকমা তুলে ধরতেন। চেপে রাখা সব কষ্ট তখন গাল বেয়ে তার নেমে আসত নোনাজল হয়ে।
সানার চিবুক ধরে পানি খাইয়ে দেওয়ার সময় ওর মাঝে সেই মুহূর্তটাই প্রকাশ পেল যেন। কান্না ধরে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে কাঁপতে লাগল ওর ঠোঁটজোড়া আর চিবুকটাও। তবুও বড়ো বড়ো কয়েক ফোঁটা অশ্রু নীরবেই ঝরে পড়ল।
না‚ শারফানের পক্ষে আর সম্ভব হলো না সানার চোখে চোখ রাখার। পরিচয়ের পর আজ অবধি যতবারই তার সামনে কেঁদেছে মেয়েটা‚ মনটা ততবারই কেমন করে উঠত তার৷ তবে আজ এ মুহূর্তের কান্নামুখটা সব থেকে বেশি ধাক্কা দিল ওকে৷ বোতলটা রেখেই সে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
সারা রাত অঝর ধারায় বৃষ্টির পর গাছের পাতাগুলো ভিজে ঝকঝক করছে—সতেজ‚ নির্মল এক প্রকৃতি। ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে চারপাশ। কাকেদের কা কা আর জানা‚ অজানা সকল পাখির কিচিরমিচিরে জেগে উঠছে যেন জঙ্গলটা৷ বেরিয়ে পড়ার সময় হয়ে গেছে ওদের৷ শারফান আর সানার মুখোমুখি হলো না। মৌসুমিকে ডেকে তুলে কল করল নাফিসকে। তার সঙ্গে কথা বলার মাঝেই হঠাৎ রিহানের কল আসলো৷ এত ভোরে ওর কল দেখে চমকাল সে৷ জলদি রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করল‚ “কীরে‚ সব ঠিক আছে তো?”
“আছে”‚ প্রচণ্ড গম্ভীর স্বরে বলল রিহান‚ “তুই কই এখন‚ সেটা বল।”
ভয়মুক্ত হলো শারফান। উত্তর দিল সেও একই সুরেই‚ “যেখানে থাকার সেখানে আছি৷ কল দিয়েছিস কী কাজে তাই বল?”
“তোর গাড়িটাকে গ্যারেজ থেকে নিয়ে যাব না-কি‚ সেটা শুনতেই কল দিলাম।”
“কীহ্?” ভ্রু কুঁচকে গেল শারফানের। ওপাশ থেকে রিহান তখন ধমকে উঠল আচমকা‚ “জানোয়ারের ছা‚ আমি তোর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এখন৷ পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে হাজির হবি তুই৷ এখানে এসে আবার কী আকাম-কুকাম ঘটাচ্ছিস‚ হ্যাঁ?”
“তোর আর তোর মামার…” দাঁতে দাঁত চেপে গালি একটা দিতে গিয়েও শারফান আটকাল নিজেকে৷ তারপর ধমকে উঠল সেও‚ “কোন সাহসে আমার পিছে ফেউ লাগিয়েছে তোর মামা?”
“চুপ হারামজাদা! যার পয়দা হয়ে হাতির মতো দেহ বানিয়ে মানুষের পাছায় গুঁতো মেরে বেড়াচ্ছিস‚ তার সাহসেরই আবার হদিস করিস?”
চটে যাওয়া মেজাজ নিয়ে ফোনটা ঠাস করে কেটে দিল শারফান৷
***
সকাল ৭: ২০ মিনিট।
নিজের নোংরা ভরা জামাটা পরনে ওঠাল সানা। ওড়না চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল তারপর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনে অপেক্ষারত শারফান আর মৌসুমিকে এক পলক শান্ত চোখে দেখল—তারপর দেখল ভেজা এই প্রকৃতিকে‚ যে প্রকৃতি ভ্রমণপ্রিয় মানুষগুলোর কাছে স্বর্গ লাগলেও ওর কাছে ছিল এতদিন বন্দি নরক। যেখান থেকে আর কোনোদিনও ওর মুক্তি মিলবে না বলে ভেবেছিল৷ বিষাদপূর্ণ এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সানা।
এগিয়ে এল মৌসুমি‚ “আমার হাতডা ধইরা নাইমা আসো।”
মৌসুমি সবটা জানার পর থেকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে শুরু করেছে—তা খেয়ালই করল না সানা৷ ওকে দেখে মনে হচ্ছে হৃদয়টা ওর দেহ ত্যাগ করে চলে গেছে পার্থিব এই জগত ছেড়ে।
শারফান সানার পায়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল। মনে হলো কিছু বলতেও চাইল। কিন্তু বলল না৷ চলতে শুরু করল সে‚ আর তার পিছু পিছু ওরা দুজন৷
একে তো শরীর দুর্বল‚ মাথাটাও হঠাৎ হঠাৎ ঘুরছে সানার‚ উপরন্তু কাদার মধ্যে ওর স্লিপার আটকে যাচ্ছে বারবার—হাঁটতে গিয়ে বেচারিকে বেশ নাজেহাল হতে হচ্ছে। ওর জন্য মৌসুমিও ঠিকঠাক এগোতে পারছে না৷ পেছন ঘুরে যখন ওদেরকে নিজের থেকে দশ হাত দূরে পড়ে থাকতে দেখল শারফান‚ তখন আবার ওদের কাছে ফিরে আসতে হলে তাকে। ওই সময় সানার পায়ের দিকে চেয়ে যা ভাবছিল ওকে বলার জন্য‚ তা সে বলল এখন‚ “আমার বুটটা পায়ে ঢোকাও। নয়ত স্লিপ কাটতে পারো।”
“হ‚ তুমার স্যান্ডেলের তলা সুমান”‚ মত দিল মৌসুমিও‚ “ওইডার জন্যই এই কাদার ভিত্রে হাঁটবার পারতাছ না ভালাভাবে।”
পাথরমূর্তির মতো অভিব্যক্তিশূন্য মুখটা সানার। মৃদুস্বরে প্রত্যাখ্যান করল মৌসুমির প্রস্তাবকে‚ “বুটও পরব না।”
“আরে…” শারফানের ইশারায় থেমে যেতে হলো মৌসুমিকে।
“তোমরা আগে চলো”‚ স্থির চোখে সানাকে দেখতে দেখতে বলল শারফান‚ “আমি পেছনে থাকছি।”
সামনে যত এগোল‚ কাদা ততই বাড়ল। আরেকটু এগোনোর পর মৌসুমির পা গেঁথে পড়ল কাদাতে৷ তাই আর সানাকে ধরে নিয়ে হাঁটা সম্ভব হলো না তার৷ যার যার মতো এগোতে লাগলে এক পর্যায়ে দেখা গেল পিছলে পড়ার বদলে সানা পড়ে যেতে লাগল আচমকা মাথা ঘুরে উঠে৷ মৌসুমি পাশে থাকায় দ্রুত ধরতে গিয়ে বেচারি ওকে নিয়েই পড়ল কাদার মধ্যে।
“আশ্চর্য! এটা কী করলে‚ মৌসুমি?” এগিয়ে এসে দুজনকেই টেনে ওঠাল শারফান।
সে ছিল ওদের থেকে হাত তিনেক দূরত্বে। তার হাসি তো পেলই না। বরঞ্চ মৌসুমির বোকামিতে মেজাজ বেশ খারাপ হলো। কারণ‚ মৌসুমি সানার গায়ের ওপরে পড়ায় যা ব্যথা পাওয়ার তা শুধু সানাই পেয়েছে।
“সরি‚ সার”‚ ওড়নায় কাদামাখা হাত মুছতে মুছতে মৌসুমি অপরাধী চোখে তাকাল সানার দিকে। জিজ্ঞেস করল ওকে‚ “কই ব্যথা পাইছ‚ আপু?”
“কোমরে”‚ বলে ব্যথায় ঠোঁট চেপে রইল সানা। এমনিতেই সারা শরীর বিষের মতো ব্যথা ওর।
“সার”‚ কাঁচুমাচু মুখ করে মৌসুমি বলল‚ “ওই এমনেও হাঁটবার পারত না। কাইল যেরাম কোলে নিছিলেন এহনো সেরামই কোলে উডায় লন তো।”
“না না… খবরদার…” সানা বলতেও পারল না সম্পূর্ণ বাক্য। এক ঝটকায় ওকে পাঁজাকোলা করে নিয়েই শারফান কয়েক মিনিটের মধ্যে লম্বা লম্বা পা ফেলে পৌঁছে গেল রাস্তায়। এর মাঝে দুজনের কেউ-ই এক মুহূর্তের জন্য একে অপরের মুখে চাইল না।
ইতোমধ্যে রিহানকে দেখা গেল রাস্তার ওপারে নিজের গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। শাফিউল সাহেবের নির্দেশে যে লোক শারফানকে গোপনে অনুসরণ করত‚ তার খবরের ভিত্তিতেই সে চলে এসেছে একেবারে মূল জায়গায়।
রাস্তা পার হয়ে সোজা রিহানের কাছে এল শারফান। “ডোর ওপেন কর”‚ নির্বিকার গলায় বলল তাকে।
আদেশ মানল বটে রিহান৷ কিন্তু চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইল সানা‚ শারফান‚ দুজনের দিকেই।
সানাকেই যে বন্দি বানিয়ে রেখেছিল‚ তা আবিষ্কার করে সে অবাক হতে চেয়েও পারেনি৷ কেননা‚ জারার স্বীকারোক্তি পাওয়ার পর তার নিজেরই একবার ইচ্ছা হয়েছিল পুলিশকে জানিয়ে দেবে সানা সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে৷ সেখানে শারফানের ক্রোধ যে সীমা ছাড়াবে‚ এ তো জানায়৷ কিন্তু এরপরই জারাকে আর মামাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে একদম খেয়াল করার সময় পায়নি শারফানের মতিগতি।
ছেলে ঠিকঠাক অফিস বসছে না‚ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে—এ খবর পাওয়া মাত্র ছেলের ওপর নজরদারির হুকুম দেন শাফিউল বিশ্বস্ত এক লোককে। তারপর যখন তথ্য পেলেন এমন একটা জায়গায় ওর আসা যাওয়া চলছে—তিনি নিশ্চিত হয়ে যান‚ জারার ক্ষতির সঙ্গে জড়িত কাউকেই হয়ত ধরে বন্দি করে রেখেছে তার অমানুষ ছেলেটা। চিন্তায় অস্থির হয়ে কী করবেন‚ না করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না যখন‚ তখন রিহানই দায়িত্ব নেয় এ মামলার৷ গতকাল ঢাকায় পৌঁছানোর পর এখানে আসতে পথে মনে মনে খুঁজে চলেছিল‚ ঠিক কাকে শিকার করতে পারে শারফান? এক মুহূর্তের জন্য সানার নামটাও মাথায় এসেছিল তার৷ তবে এ সম্ভাবনা রেখেছিল সে মাত্র পাঁচ ভাগ৷
এখন সে যতটুকু বিস্মিত হলো‚ তা অন্য এক কারণে। সানার শারীরিক অবস্থা দেখে চোখদুটোই কেবল কৌতূহল ফুটে উঠল তার‚ আর অবাক হলো বোনের অপরাধীকে শারফান কোলে নিল কেন হঠাৎ—এই ভেবে।
গাড়ির পেছনের সিটে সানা আর মৌসুমি। সামনের সিটে রিহানের পাশে বসেছে শারফান। আপাতত গন্তব্য গ্যারেজ—সেখানে গাড়ির সঙ্গে অপেক্ষায় আছে পাভেল আর নাফিস। এ ক’মুহূর্তের জন্য রিহান আর কোনো কথা তুলল না। গ্যারেজে পৌঁছে শারফান জানালার ফাঁক দিয়ে নিজের গাড়ির চাবিটা ছুড়ে দিল নাফিসকে। তারপর সবাই মিলে এগিয়ে গেল সামনের বাজারের দিকে।
এর মাঝে অনুচ্চস্বরে শারফান সানার নির্দোষ হওয়ার বিষয়টা এবং নিজের ভুলের কথাও খুলে বলল রিহানকে। গত রাত থেকে রিহান না খাওয়া। ক্ষুধায় মাথা তাই বেশি গরম হয়ে ছিল শারফানের প্রতি৷ সব জানার পর তাকে দেখাল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ক্ষুধার অস্তিত্বও আর বুঝল না পেটের মধ্যে৷
বাজারের ধারে গাড়িটা দাঁড় করাল সে। শারফান তখন বলল‚ “আমার তেমন খিদে নেই৷ ওরাও খেয়ে এসেছে। নাফিসদের সঙ্গে গিয়ে তুই নাশতা করে আয়।”
“আমি কোথাও নামতে পারব না”‚ বাচ্চাদের মতো জেদি সুরে বলল রিহান। “তুই পার্সেল করে আন। আমি গাড়িতে বসেই খাব।”
“মেজাজ এমনিতেই ভালো না‚ রিহান”‚ বিরক্ত স্বরে বলল শারফান‚ “খেতে মন চাইলে যা‚ আর নয়ত গাড়ি টান দে।”
“আমার মাথাও বাল গরম হয়ে আছে”‚ পাগলের মতো আচমকা চেঁচিয়ে উঠল রিহান।
আর সেই চিৎকারে চোখ বুঁজে সিটে নেতিয়ে থাকা সানা চমকে উঠল ভারি। তা দেখে ভয়ঙ্কর এক থাপ্পড় শারফান রিহানকে দিতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে থেমে গেল দয়া দেখিয়ে। কারণ‚ বাইরের দুটো মেয়ের সামনে তার সম্মান নষ্ট হবে। পরিস্থিতি বুঝে অবধারিতভাবে তাই সে-ই গাড়ি থেকে নেমে গেল।
এদিকে মৌসুমি তাকিয়ে রইল রিহানের দিকে বেকুবের মতো। শারফানকে দেখলেই যে ভয় লাগে তার‚ আর সেই লোকের ওপর এমন চোটপাট করছে শুকনা‚ চুপচাপ ধরনের চেহারার এই ছেলেটা! ওর সাহস দেখে চোখ যেন কপালে উঠল তার।
কেবল বিকারশূন্য সানা৷ কারও প্রতি‚ বা আশেপাশের কোনো কিছুতেই তার নেই কোনো আগ্রহ‚ নেই কৌতূহল৷ পরিবারের কাছে ফিরবে পারবে‚ এই উত্তেজনা আর আনন্দটুকুও ভেতরে চাপা অবস্থায় রয়েছে ওর।
রিহান পেছন ফিরে তাকাল৷ মৌসুমির হাঁ করে থাকা মুখটার দিকে এক পল চেয়ে মনোযোগ দিল সানার দিকে৷ জিজ্ঞেস করল ওকে‚ “তুমি কিছু খাবে‚ সানা?”
জবাবে রোবটের মতো ঘাড়টা শুধু ডানে-বামে নাড়াল সানা৷
“একটু বাইরে বের হবে?”
“আমি দাঁড়াতেই পারছি না‚ মাথা ঘুরছে।”
এত মিষ্টি কণ্ঠ! সেই কণ্ঠে দুর্বলতা‚ বিষণ্ণতা আর ক্লান্তি—সবটাই টের পেল রিহান‚ আর মনে মনে ততটাই রাগ-ক্ষোভে ফাটল শারফানের প্রতি৷ মেয়েটার ক্ষতি তো সে করলই—এমনকি নিজেরও যে কত বড়ো সর্বনাশ করে ফেলেছে শয়তানটা‚ তা বুঝতে পেরেও কোনো হেলদোল নেই ওর মাঝে!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিহান আসল কথা পাড়ল‚ “আমারও তোমার কাছে মাফ চাওয়া উচিত‚ সানা। একে তো জারার ওই অবস্থায় কারও মাথা ঠিক ছিল না। তার ওপর যখন তোমার দোষটা হাইলাইট করল ও‚ সেই উত্তপ্ত মুহূর্তে আমিও তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম।”
“জারা হাইলাইট করেছিল?” ঠিকঠাক যেন বুঝে উঠতে পারল না সানা৷ তা টের পেয়ে রিহান সেদিনের পরিস্থিতি গুছিয়ে বলল।
অপরাধবোধ তো ছিলই‚ কিন্তু এখন খোলাসাভাবে জানার পর সেই অপরাধবোধের ওজনটা আরও বাড়ল সানার‚ আর তা যেন চেপে বসল ওর বুকের ওপর৷ ধরতে গেলে মেহার বয়সীই তো জারা। সেই ছোটো মেয়েটা মানসিকভাবে কতটা শেষ হলে নিজের জানও শেষ করতে চেয়েছিল সেদিন—তারপর হেরেই গেল নিজেকে সামলে ওঠার বদলে! কণ্ঠ বুঁজে এল ওর আত্মগ্লানিতে। কোনোরকমে বলে উঠল‚ “জারার চোখে আমি কতটা হীন!”
“ও চোখের দেখায় সবটা বিচার করেছে তো! আমরাও তো সেভাবেই বিচার করেছিলাম৷ আসলে… পরিস্থিতিটাই অমন ছিল যে কোনো সূত্র ছিল না তোমাকে যাচাই করার। জারা সুস্থ হলে আমরা বুঝিয়ে বলব। তুমি টেনশন কোরো না।”
কারও জীবন সঙ্কটে পড়ার দায় নিজের কাঁধে আসা যে কতখানি যন্ত্রণার—তা সানা বোঝাবে কী করে রিহানকে? কোনো কথাই বলতে পারল না সে।
রিহানকে এরপর দেখাল বেশ ইতস্ততবিক্ষিপ্ত আর দ্বিধান্বিতও। তবুও সে বলল‚ “আমি ঠিক জানি না কীভাবে তোমার কাছে মাফ চাওয়া উচিত শায়াফের৷ রাগের মাথায় আজ তোমাকে যে কষ্টটা দিয়ে ফেলেছে ও‚ তা আসলে ক্ষমার অযোগ্যই হয়ত। এদিকে এখনো জারাকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে‚ মামাকে গত পরশু কেবিনে শিফট করা হয়েছে‚ মামির শরীরও ভালো না। এর মাঝে যদি আবার ওকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে নেয়—ওর পরিবারের ওপর আবার আরেকটা ঝড় যাবে৷ জারার কানে না পৌঁছানো হলেও মামা শোনা মাত্রই তার যে কী অবস্থা হবে‚ তা ভাবতেও পারছি না। আমার চলে যাওয়ার কথা ছিল এ মাসের শুরুতেই৷ ওদের এই বিপদের মধ্যে ফেলে যেতে পারছি না শুধু৷ সানা‚ আমার রিকুয়েস্টটা খুব অমানবিক শোনাবে হয়ত। তাও করছি‚ এই মুহূর্তে কোনো স্টেপ নিয়ো না প্লিজ। জারা আর মামার সিচুয়েশন আরেকটু স্টেবল হোক… তারপর তোমার যা ডিসিশন নেওয়ার নিয়ো। ও যেটা ডিজার্ভ করে…”
“রিহান!” জানালার কাছ থেকে আকস্মিক শারফানের বর্জ্রকণ্ঠী হুঙ্কার ভেসে এল।
সবাই ওকে দেখতে পাওয়া মাত্রই ও গাড়ির দরজা খুলে রিহানকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনল। “বান**‚ তোকে ওকালতি করতে বলে গেছি আমি?” দাঁত খিঁচিয়ে বলল তাকে‚ “তুই ওকে বলার কে ও কখন ডিসিশন নেবে? ও যদি এখনই চায় আমাকে সরাসরি থানায় নিতে—তো নেবে! তুই বাধা দিতে যাস কোন সাহসে?”
“এই বান**‚ ওকালতি এমনি এমনি করছি আমি?” বিশ্রীভাবে খেঁকিয়ে উঠল রিহান। উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল ওদের মাঝে। “আমি তোর জন্য ওর হাতে-পায়ে ধরছি‚ ভাবছিস? জীবনেও না”‚ ক্ষিপ্ত মেজাজে বলল সে‚ “তোকে তোর জাঙের মতো হাজারটা কুত্তা দিয়ে চো** মারা হলেও ওর ক্ষতিপূরণ হবে না৷ তাই তোর সাথে এখন দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ হলেও আমার আফসোস লাগবে না। আমি কেবল ভাবছি ওই যে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও যে বুড়ো লোকটা একটা রাতও ঘুমাতে পারছে না তোর টেনশনে৷ তোর বোন এখন পর্যন্ত কতবার তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে জানিস? ওদের এরকম ডিপলোরেবল কন্ডিশনে তোর কোনো খারাপ সংবাদ ওদের জন্য কতটা বিপজ্জনক—আমি শুধু এটা চিন্তা করেই কথাগুলো বলেছি ওকে৷ কিন্তু তুই ওদের কথা ভাবিসনি এতটা খারাপ হওয়ার আগে। মামা একটা কথা ঠিকই বলে—এই রাগই তোকে একদিন ধ্বংস করবে।”
“চোপ্”‚ বাজখাঁই গলায় ধমক বসিয়ে বলল শারফান‚ “আমার বাপ আর বোনের সুস্থ‚ অসুস্থতার দায়ভার ওর না‚ যে তুই ওকে তাদের চিন্তা করে ডিসিশন নিতে বলবি। আমার বাপ-মা‚ বোনের মতো ওর বাপ-মা আর বোনও ডিপলোরেবল সিচুয়েশন ফেইস করছে। সেটাও মাথায় রাখা উচিত ছিল তোর। এত নীতিবচন ছাড়ছিস! অথচ সেই তো আমার মতোই সেলফিশ হয়েই চিন্তাটা করলি।”
জবান এখানেই থেমে গেল রিহানের৷ টনকটা নড়ল তার। আসলেই তো! সে মুখে যা-ই বলুক‚ সে তো এখানে শারফান আর শারফানের পরিবারের কথায় ভাবছে শুধু—একদম স্বার্থপরের মতো৷ সানার এই পরিণতিতে সানার মনের কী অবস্থা‚ আর ওর পরিবারটাও যে ভালো নেই‚ একটাবার তো এ চিন্তাগুলো করল না! চরম লজ্জায় দৃষ্টি নত করে ফেলল সে।
খেপা শারফান খাবারগুলো সিটের ওপর ছুড়ে ফেলে সানার পাশের দরজাটা খুলল। “দুজনই বেরিয়ে এসো”‚ থমথমে গলায় ডাকল সানা আর মৌসুমিকে।
রিহান কিছু বলার আগেই তাকে চড়া গলায় নির্দেশ দিল‚ “নাফিস আর পাভেলকে নিয়ে আসবি তুই।”
এর মাঝেই হঠাৎ ইলশেগুঁড়ি পড়তে লাগল। সানাকে নিয়ে মৌসুমি চলে এল শারফানের গাড়িতে৷ শারফান অবশ্য পেছনে বসতে দিল না সানাকে। বলল‚ “কিছু কথা আছে তোমার সাথে‚ সামনে বোসো।”
সব কথায় নিঃশব্দে সায় দিচ্ছিল সানা‚ যেন সে নিছক এক কলের পুতুল। কিন্তু গাড়ি ছুটতে ছুটতে অনেকটা সময় কেটে গেল—শারফানের মুখে এল না একটাও শব্দ। চোয়াল শক্ত‚ স্টিয়ারিং চেপে ধরা হাতদুটোর শিরাগুলো এমনভাবে ফুলে উঠেছে‚ যেন মাংসপেশির নিচে জেগে আছে শক্ত‚ প্যাঁচানো দড়ি। সামনে ছুটে চলা পথে স্থির‚ কঠিন এক চাহনি নিয়ে বসে আছে সে নির্বাক‚ রুক্ষ‚ অনড় বেশে।
“জারার অসুখটা কি খু্ব কঠিন?” নিস্তব্ধতা ভাঙল সানাই। সেদিন রাতে জারার শারীরিক অবস্থার কথা শারফানের মুখে শুনেছিল সে ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে। আজ রিহান কিছুটা খুলে বলায় ওর এখন স্পষ্টভাবে জানতে ইচ্ছা হচ্ছে মেয়েটার অসুখটা সম্পর্কে।
প্রশ্নটা কানে এলেও শারফান তাকাল না। এবং জবাব দিল অনেকক্ষণ পর‚ “ওর অবস্থা প্রথমে ছিল টাকোৎসুবো কার্ডিওমায়োপ্যাথি—মানে‚ ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম।”
অবুঝ চোখে চেয়ে থাকল সানা। তা দেখতে পেয়ে সে ভেঙে বলল‚ “তীব্র মানসিক ধাক্কা থেকে ওর হার্টের ওপর প্রচণ্ড চাপ ফেলে। তখন শরীরে কিছু হরমোন হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যায়‚ যেটা এক সময় ওর হার্টের পাম্প করার ক্ষমতাকেই দুর্বল করে দেয়। এই অবস্থায় অনেকেই সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু…” একটু থামল শারফান এরপর। কথাগুলো বলতে ওর যে খারাপ লাগছে‚ তা বুঝল সানা৷ সে রাতে মাতাল থেকেও কষ্ট পাচ্ছিল সে বলার মুহূর্তে—তা মনে পড়ল ওর।
“ওর ক্ষেত্রে জটিলতা হয়েছে”‚ শারফান বলতে শুরু করল আবার‚ “হার্টের দুর্বলতা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওর শরীর। তাই এখন ও হার্ট ফেইলিউর-এ ভুগছে। এখন থেকে জীবনটা অন্যরকম হবে ওর।”
“বলছিলেন সেদিন রাতেও—ও আমাদের মতো নরমাল জীবনযাপন করতে পারবে না। এটার মানে কী?”
“একটু ধীরে‚ একটু হিসেব করে বাঁচতে হবে ওকে। ওর হার্ট একদম আগের মতো আর ফিরবে না। হার্ট এখন ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না। ডক্টর বলেছে এটা পার্মানেন্ট। মানে‚ ভালো হবে না পুরোপুরি। এটা নিয়েই ওকে সারাজীবন চলতে হবে। রাগ‚ দুশ্চিন্তা‚ কষ্ট—সবকিছুই ওর জন্য বিপজ্জনক। অল্প হাঁটলেও দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে‚ বুক ধড়ফড় করবে। ওষুধ প্রতিদিন‚ প্রতিটি ঘড়ির কাঁটা মেনে খেতে হবে। খাওয়ার লবণ থেকে পানি কতটুকু খাবে‚ সেটাও হিসেব করে খেতে হবে। ঠান্ডা লাগা‚ একটু ইনফেকশন… সব কিছুতেই সাবধান হতে হবে।”
ক্লান্ত ভঙ্গিমায় মাথাটা সিটে এলিয়ে দিল সানা—স্তব্ধীভূত দেখাল ওকে৷ পেছনে বসা মৌসুমিরও খুব মায়া হলো জারার জন্য।
কিছুক্ষণের নীরবতার পর শারফান সানাকে বলল‚ “এর দায় তোমার না। ডোন্ট বি সুয়েড বাই রিহান। তুমি কী শাস্তি চাও আমার‚ সেটা বলো।”
“কী শাস্তি চাওয়া উচিত আমার?” চোখজোড়া বুঁজেই ফিসফিস করল সানা‚ যেন প্রশ্নটা শারফানকে নয়—নিজেকে করল সে।
“তুমি যা চাও‚ তাই!”
মাথাটা সোজা করে নিজের কোলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সানা। বুকের ভেতর কোথাও কিছু ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অসহনীয় কষ্টটা কান্নারূপে গলা বেয়ে উঠে আসতে চাইল ওর৷ কান্না অবরুদ্ধ কণ্ঠেই তাই বলল‚ “শাস্তি তারাই দিতে পারে যারা ক্ষমতাবান—যেমন আপনি। তাই আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার আপনাকেই দিলাম৷ আশা করছি আমার ক্ষেত্রেও যোগ্য বিচারক হবেন আপনি।”
বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টি ছুড়ল শারফান‚ আর সানার অশ্রুনীরে ডোবা চোখদুটো ছুটল তখন জানালার বাইরে। এক মুহূর্তের জন্য বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল শারফানের ঠোঁটে। বলল সে সংগোপনে‚ “আমার মতো অমানুষের শাস্তি আর বিচারগুলোও হয় অমানুষিক। বেশ… তবে তাই হবে—যা আমার প্রাপ্য।”
তারপর জিজ্ঞেস করল সানাকে‚ “ভেবে বললে তো? অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু।”
“জানি”‚ ক্ষীণ সুরে জবাবটুকু দিয়ে বলল সে‚ “অপেক্ষার ধৈর্য আমার আছে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
ভোর রাতে বলা শারফানের প্রতিটি কথাই মনে পড়েছে সানার৷ জারার পরিণতি জানার পর মেয়েটার সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিচার হোক—তা সে এখন খু্ব করে চায়‚ আর শারফানের সে ক্ষমতাও যেহেতু আছে। এখন যদি সে ফারনাজকে কেটে টুকরো টুকরোও করে‚ তাতে এতটুকুও মায়া বা মানবতাবোধ জন্মাবে না ওর মাঝে।
আবার কিছুক্ষণ মৌনতা কাটার পর শারফান বলল‚ “নাফিস‚ পাভেল‚ মৌসুমি‚ এরা কেউ আমার মতো খারাপ নয়। ছোটোখাটো উপকারের ঋণ শোধ করার আগ্রহে আমার কথায় প্রভাবিত হয়েছিল তিনজনই। সত্যিটা জানার পর ওরা খুব অনুতপ্ত। তবে অন্যায় তো অন্যায়ই। তাই ওদের শাস্তির ভাগটাও আমিই নিলাম।”
“মৌসুমি আপু নিজের দায়িত্ব পালনের বাইরেও মানবিকতা দেখিয়েছেন আমার প্রতি৷ যতটুকু সারভাইভ করতে পেরেছি‚ তার কৃতিত্ব মৌসুমি আপুরই৷ আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।”
অপরাধবোধ আর লজ্জায় মুখে ওড়না চেপে কেঁদে ফেলল মৌসুমি৷ তা কেউ অবশ্য ফিরে দেখার প্রয়োজনবোধ করল না।
“কিন্তু বাসায় ফিরে কী বলবে তুমি?” চিন্তা ফুটল শারফানের চেহারায়। “পুলিশ ইন্টারোগেট করবে তোমাকে৷ তাদের ম্যানেজ করা সম্ভব তোমার পক্ষে?”
“জানি না।”
গাড়িটা থামিয়ে শারফান তখন কল করল রিহানকে৷ তাকেও থামতে বলল৷ পেছনেই ছিল রিহানের গাড়ি। এসে থামল ওর গাড়ির পাশেই। শারফানকে নামতে দেখে নামল সেও। তারপর আলোচনা করা হলো সানার পরিস্থিতি সামলানোর পরিকল্পনা নিয়ে।
***
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪২.
বিকাল ৪ টা ।
মেঘে ঢাকা শহরে বৃষ্টির দেখা নেই এখনো। কেবল গুমট ধরে আছে আকাশটা‚ সাথে ভ্যাপসা গরম। মোস্তফা সাহেব গাড়ি থেকে নামতেই একটা দম বন্ধ করা উত্তেজনা নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালের ভেতর। পিছু পিছু সানার মামা ওয়াজিদ আর মামাত ভাই প্রিন্স। লিফটে চড়ে দোতলায় পৌঁছালেন তারা। ওয়ার্ডের দিকে যেতে যেতে মোস্তফা সাহেবের চোখ আটকাল সাইড বেঞ্চে বসে থাকা একটি মেয়ের দিকে। চোখে তার ভীতি আর কপালে চিন্তার ভাঁজ। এই মেয়েটিই কি কল করেছিল তাকে—ভাবলেন তিনি।
কেবিনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন এরপর৷ সোনালি নামপ্লেটে লেখা‚ কেবিন ৫১২৷ কেবিন নাম্বার এটার কথায় শুনেছিলেন ফোনে। ভেতরে ঢুকলেই মেয়ের দেখা পাবেন‚ তা ভাবতেই হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল মোস্তফা সাহেবের৷ শরীরটাও কাঁপতে লাগল। ধীরে পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন তিনি। এসির শীতল বাতাস একপাশ থেকে ছুঁয়ে গেল তার কাঁধ—তবু শরীরে ঘাম। আর বুকের ভেতরে থেমে থাকা হাজার শব্দ‚ হাজার প্রশ্ন‚ আর কেমন একটা ভয়।
ভেতরের পরিবেশ শান্ত‚ কিন্তু নীরব নয়। দেওয়ালের পাশে মাউন্ট করা মনিটরটা নিঃশব্দে কাজ করছে। হার্টবিটের মৃদু পিং পিং শব্দ যেন ঘরের মাঝখানে ঝুলে আছে‚ আর সফেদ বিছানায় শুয়ে আছে সানা—আধো-আধো বুলিতে আব্বু ডেকে তাকে পরিপূর্ণ করা তার প্রথম সন্তান।
বন্ধ চোখের নিচে গভীর ছায়া সানার‚ শ্বাস প্রশ্বাস খুব হালকা‚ গালের হাড় দুটো বেরিয়ে এসেছে‚ ঠোঁট শুকনো‚ আর হাতে স্যালাইন৷ পাশে মনিটরের স্ক্রিনে ওর হার্টবিটের রেখা টুকটুক শব্দ করছে—একমাত্র প্রাণের চিহ্ন সেখানে। শ্লথ পায়ে এগিয়ে এসে মেয়েকে ডেকে উঠলেন‚ “সানা…” শব্দটা এত কাতর সুরে বের হলো‚ যেন নিজের কণ্ঠটাই চিনতে পারলেন না তিনি।
হঠাৎ সানার চোখের পাতা একটুখানি নড়ল। ধীরে চোখ মেলে তাকাল সে। দৃষ্টিটা প্রথমে অস্পষ্ট‚ তারপর স্পষ্ট হয়ে স্থির হলো বাবার মুখে। আহ্লাদ‚ আবেগে ব্যাকুল হয়ে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল ছোট্ট শিশুর মতো। “আব্বু…” কেঁপে উঠল ওর কণ্ঠটা।
মুহূর্তেই কেবিনের পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠল‚ বাবা-মেয়ের নিঃশব্দ কান্নায়। মেয়েকে বুকে নিতে না পেরে অস্থির হয়ে ওর হাতটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন মোস্তফা সাহেব। ওয়াজিদ সাহেব আর প্রিন্স এসে সামলালেন ওদের‚ নার্সও বারবার থামতে বলল।
এর মাঝে ডাক্তারের প্রবেশ ঘটল কেবিনে৷ তাকে দেখে চোখের পানি মুছে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন মোস্তফ। নিজেদের পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলেন ওয়াজিদ। ডাক্তার তখন জানালেন সানার ব্লাড প্রেসার কম‚ পালস দুর্বল‚ শরীরে ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ সম্পর্কে। রক্ত পরীক্ষা আর প্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে ফেলেছেন তারা ইতোমধ্যে—তাও বললেন। শরীরে কুকুরের আঁচড় আর জোঁকের কামড়ের চিহ্ন সম্পর্কেও অবগত করলেন। ওষুধ আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বলার পর ওর মানসিক সেবাও কতটা জরুরি‚ সেটার গুরুত্বও বোঝালেন। গত সাত দিন সে যে ভয়াবহ মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছে‚ তার জন্য তাকে নিয়মিত কাউন্সেলিং দিতে হবে। তাই একজন ভালো মনোরোগ চিকিৎসকের নামও জানালেন ডাক্তার৷ তার ভিজিটিং কার্ড নিলেন ওয়াজিদ সাহেব৷ এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ “এ ছাড়া আর কোনো শারীরিক ক্ষতি হয়নি ওর?”
“না‚ আর কোনো ক্ষতি হয়নি ওঁর”‚ ডাক্তার নিশ্চিত করে বললেন।
কিন্তু ওয়াজিদ সাহেব ভাবলেন‚ ডাক্তার হয়ত বোঝেননি তিনি কিসের ইঙ্গিত করেছেন। তাই নিচুস্বরে বললেন‚ “আমি আসলে শারীরিক টর্চারের কথা জানতে চাইছি।”
মৃদু হাসলেন ডাক্তার‚ “আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কী জানতে চেয়েছেন। মেয়েটা নিখোঁজ ছিল তা আমি শুনেছি ওর মুখ থেকেই। সেক্ষেত্রে এমন ধরনের আশঙ্কা করাটাই স্বাভাবিক। তবে আলহামদুলিল্লাহ বলুন‚ দেয়ার ইজ নো এভিডেন্স অফ সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ।”
বুকের ওপর থেকে যেন পাথর সরল ওয়াজিদ সাহেবের৷ কিন্তু মোস্তফা সাহেব সবটা শুনলেন একদম চুপটি হয়ে। এরপর কেবিনের বাইরে এসে পরিচয় পেলেন সেই মেয়েটির‚ যে ফোন করে সানার সন্ধান জানিয়েছিল তাদের। এবং সে মেয়েটি মৌসুমিই।
সম্পূর্ণ গল্পটা দাঁড় করানো হয়েছে এভাবে—সানা ঠিক জানে না কারা ওকে তুলে নিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে পেয়েছিল একটা ছোটো‚ অন্ধকার‚ অগোছাল ঘরে। যারা আটকে রেখেছিল তারা সবসময় মুখ ঢেকে রাখত‚ খুব কম কথা বলত। চিৎকার-চেঁচামেচি করলে একবার কুকুরের আক্রমণ করিয়ে ভয় দেখিয়েছিল ওকে। বাইরে পাহারাতেও ছিল সেই কুকুর। হঠাৎ একদিন ভোরে তারা ঘরে ঢোকে আতঙ্কগ্রস্ত ভঙ্গিতে। কিছু বলার আগেই ওকে আবার অজ্ঞান করে ফেলে। যখন জ্ঞান ফেরে‚ নিজেকে সে পঁচা ডোবার ধারে পায়। শরীরে তখন জোঁক লেগে ছিল‚ ভেজা ছিল জামাকাপড়। তারপর কোনোমতে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় উঠে আসে। সেখানে পথচারী মৌসুমির দেখা পেয়ে ওর হাত-পা জড়িয়ে ধরে অনুরোধ জানায় সাহায্যের জন্য। গায়ে তখন জ্বর ছিল‚ দুর্বলতা ছিল। তাই হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে। সে সময় মানবতাবোধ থেকে মৌসুমি ওকে পথচারীদের সাহায্যে হাসপাতালে নিয়ে আসে। জ্ঞান ফেরার পর সানা নিজের বাবার ফোন নম্বর দেয় তাকে‚ আর সেখান থেকেই খবর পৌঁছে যায় ওর পরিবারে।
সন্ধ্যার মধ্যেই নাজমা বেগম আর মেহা ছুটে এলেন হাসপাতালে। খালা আর খালাত ভাই-বোনেরা বাড়িতে ফিরে গেছে‚ তারা সবাই ফোন করে খোঁজ নিতে লাগল‚ ভিডিয়ো কলে কথা বলল সানার সঙ্গে। কেউ কোনোরকম আপত্তিকর বা ওকে বিষণ্ণ করে তুলতে পারে‚ এমন কথাবার্তা বলল না৷ ওয়াজিদ সাহেবের কাছ থেকে এমন নির্দেশনায় পেয়েছে তারা। আবার তারা নিজেরাও ভীষণ সতর্ক ছিল এ ব্যাপারে। আজকের রাতটা হাসপাতালেই থাকতে হবে সানাকে।
রাত আটটার দিকে মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার সানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন কিছুক্ষণ। কিন্তু তার দেওয়া জবানবন্দি থেকে তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার মতো কোনো নির্দিষ্ট সূত্র মেলেনি। ঘটনাটা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ কিন্তু অনুসন্ধানযোগ্য নয়। কারণ‚ অপরাধীরা ছিল মুখঢাকা‚ নামহীন‚ চিহ্নহীন। তদ্ব্যতীত‚ অফিসার দেখলেন সানা মানসিকভাবে ভীষণ বিধ্বস্ত। তাই ওকে বেশি চাপ দেওয়া অমানবিক বলে বিবেচনা করলেন তিনি।
এবং অভিজ্ঞতা থেকে অফিসার একটি সম্ভাব্য ধারণা তৈরি করেন—সানা হয়তো কোনো হিউম্যান ট্রাফিকিং চক্রের হাতে পড়েছিল। সম্ভবত সেই সময়েই চক্রটির নেটওয়ার্কে কোনো গোয়েন্দা বাহিনী ঢুকে পড়ে। আতঙ্কে তারা পরিকল্পনা বাতিল করে তখন‚ আর সানাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
পাখির ছানার মতো মেয়েকে বুকের মধ্যে আগলে নিয়ে বসে আছেন নাজমা বেগম‚ আর অবিরত চোখ ভিজিয়ে চলেছেন। এ কটা দিনে শুধু সানার শরীরই ভেঙে পড়েনি—পরিবারের বাকি তিন সদস্যেরও একই অবস্থা৷ একটা মুহূর্তের জন্যও মেহা বোনের কাছ থেকে নড়ছে না৷ বোনের হাতটা জড়িয়ে ধরে মায়ের মতো কেঁদে চলেছে সেও৷ ওদেরকে চিন্তামুক্ত করতে ওয়াজিদ সাহেব বললেন‚ “ও যতদিন পর্যন্ত শারীরিক‚ মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ না হয়—ততদিন ও আমার কাছেই থাকবে৷ ডাক্তার যে সাইক্রিয়াটিস্টের কথা বলল‚ কালই তার সঙ্গে যোগাযোগ করব আমি।” তারপরই বললেন চিন্তামগ্ন মোস্তফা সাহেবের উদ্দেশ্যে‚ “কাজকর্ম ফেলে অনেক ছোটাছুটি করেছেন‚ ভাই৷ আজকে থেকে রেস্ট করবেন শুধু৷ আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করেছেন। কত বড়ো ক্ষতি হতে পারত আমাদের মেয়ের! তার কিছুই হয়নি তো‚ তাই না? আমরা নিজেরা ছাড়া কেউ জানছেও না এই সাতদিনের ঘটনা৷ এত চিন্তা কিসের তাহলে? আর কেউ কোনো চিন্তা করবেন না তো।”
কথাগুলো সান্ত্বনার হলেও মিথ্যা তো নয়। তাই অনেকটাই দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছে সবাই৷ ওয়াজিদ সাহেব মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে কেবিনের বাইরে এলেন৷ সানার মানসিক অবস্থা সত্যিই ভীষণ শোচনীয়—এ নিয়েই দুজন আলোচনা করতে লাগলেন। আলোচনার একটা পর্যায়ে ওয়াজিদ বললেন‚ “ভাই‚ আমার বিবেচনায় যা আসে তা হলো‚ ও পুরো সুস্থ স্বাভাবিক হওয়ার পর ভালো ছেলে দেখতে হবে আমাদের৷ এমন ঘটনা আসলে কখন‚ কার মুখ থেকে কোথায় ছড়িয়ে পড়বে—তার তো ঠিক নেই৷ বড়ো আপা লুকিয়ে রাখলেও দেখা গেল তার শ্বশুরবাড়ির লোকগুলো এদিক-ওদিক গল্প করবে৷ ওভাবেই ঘটনা জানাজানি হবে একদিন৷ তাই এর আগেই বিয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি৷”
বিষয়টা আলাদা করে না বললেও এ নিয়েই চিন্তায় মশগুল ছিলেন মোস্তফা সাহেব৷ মেয়েকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেওয়াতে কোনো আপত্তি নেই তার৷ কিন্তু মফস্বলের মতো জায়গায় একবার কোনোভাবে এমন ঘটনা রটিয়ে গেলে সবার নিন্দেমন্দ কথা কানে এলে মেয়েটার মানসিক অবস্থা যে আরও খারাপ হবে তখন। কারণ‚ ভেতর থেকে যে তার এই মেয়েটা ভীষণ নরম। দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারে না ও কখনোই৷ এই যে এখনই ওর মুখটার দিকে তাকালে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে তার। কেমন নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো হয়ে আছে ও! তার সম্মান নষ্ট হওয়ার চেয়েও তাই বেশি চিন্তা করতে লাগলেন মেয়ের জীবনটা নিয়েই।
***
২৬ মার্চ
দুপুর ২: ২০ মিনিট ।
ক্লান্ত এক দুপুর—শারফানের গাড়িটা এসে থামল সেই গোডাউনের ভেতর‚ যেখানে হাসিবকে ধরে আনা হয়েছিল। আর আজ আনা হলো জারার জীবনের ঘৃণ্য এক অপরাধী—দিপুকে৷ হাসিব এখান থেকে মুক্তি পেয়ে মায়ের কোলে ফিরতে পারলেও দিপু কি বেঁচে ফিরবে? প্রশ্নটা নাফিস আর পাভেলের মাঝে৷
সানাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকে শারফান আবিষ্কার করল‚ ওর সঙ্গে যা হচ্ছে—সবটাই ভালো হচ্ছে৷ জারার মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে৷ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। শাফিউল সাহেবও সুস্থ অনেকটা। আর ঠিক গতকালই একদম অপ্রত্যাশিতভাবে দিপুর সন্ধান মিলে গেল ওর৷ অথচ সে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে গেছে বলেই নিশ্চিত করেছিল পুলিশ। কিন্তু তবুও যে মেসে থাকত দিপু‚ তার রুমমেটের সকলকে টাকায় কাবু বানিয়ে শারফান তাদের বলে এসেছিল—দিপুর সঙ্গে তাদের যেদিনই সাক্ষাৎ হবে‚ সেদিনই যেন ফোনে ওকে খবর দেয় তারা৷ এবং সে কথা রেখেছেও ছেলেগুলো৷ গতকাল মাঝরাতে দিপু ভূতের মতো হাজির হয় মেসে৷ তার মুখ থেকে জানা যায়‚ রোহান নিজের ব্যবস্থা করলেও তার ব্যবস্থা করেনি৷ তাকে ফেলেই দালালের সাহায্যে চলে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে‚ বিএসএফ-এর হাতে গুলি খেয়ে সেখানেই নাকি প্রাণ হারায় রোহান৷ এ ঘটনা লজ্জাজনক বিধায় দেশের কোনো খবরের চ্যানেলে প্রচার করা হয়নি। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে হয়ত দাফনও করা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
আর দিপু ছিল কেবল উত্তপ্ত পরিবেশ ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষায়। সিলেটে এক আত্মীয়র বাসায় লুকিয়ে ছিল সে এতদিন৷
তিন ফিট লম্বা একটা মোটা রড হাতে নিয়ে দিপুর সামনে এসে দাঁড়াল শারফান৷ একই হাতিয়ার নাফিস আর পাভেলের কাছেও৷ জ্ঞানহারা দিপুর জ্ঞান ফেরার পর আর তাকে একটা মুহূর্তও সময় দিল না শারফান পরিস্থিতি বুঝে ওঠার। চোখদুটো সে খোলা মাত্রই রডটা মাথার ওপর তুলে চোখের পলকে নামিয়ে আনল তার পিঠের ওপর। “ও মাআআ” বলে চিৎকার করে উঠতেই আরও একবার পড়ল তার কাঁধে। লাগাতার কতগুলো বাড়ি দেওয়ার পর শারফান থামল।
মারের চোটে গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে প্যান্টই ভিজিয়ে ফেলল দিপু। এর মধ্যে নাফিস আর পাভেল এসে তার গায়ের জামা-কাপড় খুলে নিয়ে চার হাত-পা বেঁধে দিল। এমনিতেই সে শারফানকে দেখে প্রাণ হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত ছিল। এতে সে আরও ভয় পেয়ে বুকে ভর করেই এগোল শারফানের পায়ের কাছে। কেবল জানে বাঁচার জন্য গলা ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ডেকে উঠল‚ “আব্বা… আমার আব্বা… আমারে মাফ করে দেন‚ ও আব্বা!”
স্টিলের একটা মাঝারি সাইজের পাত্র—ভেতরে আধা বোতল কেরোসিন ঢেলে দিল পাভেল। একটা ম্যাচবক্স থেকে কাঠিটা ঘষে কেরোসিনে ছুঁইয়ে দিতেই শোঁ করে আগুন লেগে গেল। তার মাঝে রডটা ধরল সে। আগুনের কমলা আলোয় রডটা যেন রক্তের মতো লাল হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। শারফান অপেক্ষা করল রডটা যতক্ষণ না একেবারে গরম লোহা হয়ে ওঠে।
নিজের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে তা বোঝা হয়ে গেছে নগ্ন দিপুর। তার চিৎকার থামাতে তারই খুলে নেওয়া শর্টস মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়েছে নাফিস৷
এরপর শুরু হলো তার চূড়ান্ত দুর্ভোগ। জ্বলন্ত রডের প্রতিটি আঘাত সারা শরীরে মরণ যন্ত্রণার মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার। ফাঁকে ফাঁকে নিজের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরও আদায় করতে গিয়ে শারফান আবিষ্কার করল একটি ভয়ঙ্কর নাম—রাজন ভুঁইয়া! চিন্তার মোড় বদলে গেল ওর। ফারনাজকে ধরার জন্য যার সাহায্য নিয়েছিল ও—সে বাবলু ভুঁইয়া৷ এরা দুজন একই গোষ্ঠীর‚ এবং একই রক্তের। কিন্তু সম্পর্ক দুজনের মাঝে চরম শত্রুর চেয়েও খারাপ। কারণ‚ একই বনে যেমন বাঘ আর সিংহ এক সাথে টিকতে পারে না৷ তেমনই গল্প এদের দুজনের মাঝেও৷ একই শহরে দুজন সমান শক্তিধর সন্ত্রাস তারা। এই রাজনকে শিকার করা দিপু‚ হাসিবকে শিকার করার মতো সহজ নয়৷ যাকে টক্কর দিয়ে চলতে গিয়ে বাবলুকেই নাস্তানাবুদ হতে হয়। কিন্তু তাই বলে কি ছেড়ে দেবে সে রাজনকে? নিজের আপনজনের বেলায় সে তো বাবলুর মতো লাভ-ক্ষতি হিসাবের ধার ধারে না৷
চেয়ারের ওপর রাখা ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল‚ ওর এই গভীর চিন্তার মাঝে। স্ক্রিনে নম্বরটা সেভ না থাকলেও তা চেনা। এবং গত দুদিন এ নম্বরে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে ওর৷ তাই রিসিভ না করে থাকতে পারল না। দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিয়ে ফোনটা কানে ধরল সে‚ “হ্যাঁ‚ বলুন‚ রায়হান ভাই। কী অবস্থা?”
“মাত্রই কাউন্সেলিং শেষ করলাম তোমার স্পেশাল পার্সনের। অর্থাৎ আমার পেশেন্টের। এবং আজ তার ভেতরের সমস্ত কথা আমি টেনে বের করতে পেরেছি। আমার মনে হলো তোমার তা জানা জরুরি।”
রায়হান আজাদ—সম্পর্কে শারফানের ভাই‚ বন্ধু কিছুই নয়। তবে সে জিসানের চাচাত ভাই৷ তার হদিস জিসানের থেকেই পেয়েছিল সে।
সানাকে হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ওকে যে ডাক্তার চিকিৎসা দিয়েছিলেন‚ তিনিও শারফানের কথাতেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এবং তিনি ছিলেন আদতে শাফিউল সাহেবের শুভাকাঙ্ক্ষী। যার সঙ্গে অতীতে শারফানের কেবল সৌজন্যসাক্ষাৎ ছাড়া বাড়তি কোনো কথা হয়নি কোনোদিন। সেই মানুষটির সঙ্গে সে সানার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করেছিল সেদিন। এবং সেদিনই প্রথম সে কোথাও বাবার পরিচয় ব্যবহার করে সু্বিধা গ্রহণ করল।
সানা এখনো মামা বাড়িতেই৷ চব্বিশ তারিখ থেকে সে মনোরোগ চিকিৎসক রায়হানের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছে। তার থেকেই ওর শারীরিক অবস্থা‚ মানসিক অবস্থার সকল তথ্যই প্রতিনিয় নিচ্ছে শারফান। বলা হয়নি‚ ওকে পৌঁছে দেওয়ার পর থেকে আজ অবধি প্রায় প্রতিটি মুহূর্তেই সে অদ্ভুত এক সমস্যায় ভুগছে—না চাইলেও তার কাজ‚ ঘুম‚ সব কিছুর মাঝেই সানাকে স্মরণ হচ্ছে বারবার এবং বারবার।
“কোনো সিরিয়াস কেস‚ ভাইয়া?” রায়হানের কথাতে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল শারফান৷ সেই সুযোগেই আপাতত মাথা থেকে সটকে পড়ল দিপু।
“আরে ঘাবড়িয়ো না৷ তবে তোমার জন্য কথাগুলো শক পাওয়ার মতো হতে পারে।”
রহস্য করে কথা বলা‚ বা উত্তেজনা বাড়াতে ভণিতা করা অসহ্যরকম অপছন্দ শারফানের৷ কেবল ফোনের ওপাশের মানুষটা রায়হান বলেই ধৈর্যের সুরে বলল‚ “ভাইয়া‚ কাইন্ডলি ডিরেক্ট পয়েন্টে আসবেন?”
“আচ্ছা সরি”‚ বলে একটু হাসল রায়হান শারফানের মনের অবস্থা টের পেয়ে। “সোজা কথাই আসি তবে৷ ট্রমা বন্ড বোঝো?”
“সাইকোলজির বিদ্যা আমার কি বোঝার কথা?” বিরক্ত হয়ে কাটকাট গলায় বলে উঠল শারফান।
“না‚ একদমই না। এক্সট্রিমলি সরি‚ তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে ফেলছি বারবার। ভেঙে বলছি আমি—কোনো মানুষ যখন যাকে ভালোবাসে৷ এবং সেই মানুষটির হাতেই সে নিপীড়িত হয়‚ তখন তার মনের মধ্যে একটা জটিল দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। যা সাইকোলজিতে ‘ট্রমা বন্ড’ নামে পরিচিত। আমার অর্থাৎ একজন সাইক্রিয়াটিস্টের দৃষ্টিকোণ থেকে সানার মানসিক প্রক্রিয়াকে কয়েকটি সংজ্ঞার মধ্যে দিয়ে বিশ্লেষণ করছি তোমাকে৷ তাহলে বুঝবে ওর মানসিক হালটা৷ প্রথমে বলি বিট্রেয়াল ট্রমার ব্যাপারে। তুমি যেটা করেছ ওর সঙ্গে তা ছিল ওর কাছে অবিশ্বাস্য ধাক্কা। অর্থাৎ ও তোমার থেকে এভাবে নির্যাতিত হবে সেটা ও ভাবতেও পারেনি। এই শারীরিক ও মানসিক আঘাত পাওয়ায় ওর মাঝে বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষত তৈরি হয়েছে৷ ভবিষ্যতে ভালোবাসার প্রতি ভয়‚ ঘনিষ্ঠতা গড়তে অসুবিধা আর নিজের মাঝে দ্বন্দ—লাইক ভুলটা কি আমারই ছিল?
দ্বিতীয়ত‚ স্টকহোম সিনড্রোম। লাইক ইমোশনাল কনফ্লিক্ট। যদিও তোমার আচরণ ছিল সহিংস। তবুও তোমার প্রতি কিছুটা কোমলতা বা অনুভূতির রেশ থেকে গেছে ওর মাঝে। এটাই ওর মাঝে প্রচণ্ড কষ্ট সৃষ্টি করছে। ভালোবাসা পুরোপুরি মুছে না যাওয়ায় সেটা দগদগে ক্ষতের মতো…”
“প্লিজ ওয়ান সেকেন্ড”‚ ভ্রু-কপাল কুঁচকে শারফান বলল‚ “আপনি এত ভেঙেচুরে বলার পরও আমি কিছু একটা মিস করে গেছি মনে হচ্ছে। মানে… আমাকে নিয়ে ওর মনে যেটা তৈরি হবে সেটা রাগ‚ ক্ষোভ‚ ঘৃণা‚ এগুলো‚ রাইট? সেখানে ইমোশনাল কনফ্লিক্ট সৃষ্টি হবে কেন?”
“কীরে ভাই… তোমারও দেখি একই অবস্থা৷ তোমাকে শুরুতেই তো এটার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিয়েছি—ট্রমা বন্ড। ট্রাজিক ম্যান‚ মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল! বুঝেছ? আমি আজ তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম‚ যখন ও তোমাদের পরিচয়ের শুরু থেকে এই দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত সমস্তটা খুলে বলল৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো‚ সরল মেয়েটা তোমাকে কীভাবে‚ কখন ভালোবেসে ফেলেছে তা নিজেও বোঝেনি৷ ইভেন আমার সঙ্গে কথা বলার আগ পর্যন্তও সে অজানা ছিল এ ব্যাপারে৷ এবং ওর সমস্যাটা এখানেই তৈরি করেছে৷ একটা মানুষ‚ যে ওকে সাতটা দিন আটকে রেখে এতটা কষ্ট দিয়েছে৷ সেই মানুষটাকে কেন্দ্র করে সে নির্দিষ্ট একটি অনুভবে আসতে পারছে না৷ যদি ও তোমাকে ভালো না বেসে ফেলত‚ তবে আজ তোমার জন্য অনায়াসেই ঘৃণা উৎপন্ন হত ওর মাঝে। আর সেটা হলেই মেয়েটা খু্ব বাঁচা বাঁচত। তুমি বুঝতেও পারছ না‚ কতটা জটিল মানসিক দ্বন্দে পড়ে সে মায়ের বুকে ফিরেও রাতে শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারছে না। না সে তোমাকে পুরোপুরি ক্ষমা করতে পারছে‚ না ঘৃণাও করতে পারছে। এই মানসিক দ্বন্দ্বই বেচারিকে কঠিন যন্ত্রণা দিচ্ছে।
এরপর আসি তোমার ওর কাছে আত্মসমর্পণ। যেটাকে আমরা বলি—ট্রান্সফার অফ এজেন্সি ফর পানিশমেন্ট। যদিও সে তোমাকে তোমার অন্যায়ের বিচার করতে বলেছে। কিন্তু তোমার সেলফ্ ইমপোজড রিডেম্পশন ওর দগ্ধ সহানুভূতিশীল হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে অলরেডি। যখনই ও একা থাকে ‚তখনই ওর মাঝে একেকরকম চিন্তা চলছে। একবার মনে হচ্ছে ওর‚ তুমি যেটা করেছ‚ সে হয়ত সেটারই যোগ্য। যেহেতু জারার সঙ্গে হওয়া বিপদটার জন্য সে নিজেকে অপরাধী ভাবে। আবার কখনো মনে করছে‚ তুমি যা করেছ তা অন্যায়ই৷ কিন্তু তারপর সেই তুমিই ওকে তোমার বিচারক হতে বলেছ। তাহলে কি তোমাকে সাজা না দিয়ে ও ভুল করছে? না কি তোমাকে ক্ষমা করা ওর দুর্বলতার পরিচয়? এই দ্বন্দ্ব মেন্টাল প্যারালাইসিস তৈরি করেছে ওর মাঝে। ও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ও কী অনুভব করছে! ভালোবাস‚ ঘৃণা না সহানুভূতি? এখানেই শেষ নয়‚ আরও সমস্যা আছে—গিল্ট রিভার্সাল‚ ডিলেইড হিলিং…”
“সবটা শোনার আগে…” নিশ্চলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা শারফান রায়হানকে বাধা দিয়ে বলল‚ “আমি একটা কথা আরেকবার শুনতে চাই‚ ভাই।”
“হ্যাঁ‚ বলো।”
“ও আমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিল? আর তা ওর মনেরই অজানা ছিল?”
“ইয়েস‚ ম্যান৷ এটাই ওকে করুণ অবস্থায় ফেলেছে। যদি পুরোটা শোনো‚ তাহলে আরও ভালো বুঝতে পারবে ওর মানসিক হাল কতটা দুঃখজনক।”
“শুনতে চাই”‚ চকিতেই জবাব দিয়ে উঠল শারফান। কিন্তু এতটাই হারিয়ে গেছে ও ‘ভালোবেসেছিল’ কথাটার মাঝে‚ যে পায়ের সামনে আগুন জ্বলতে থাকা পাত্রটার কথাই সে ভুলে বসল। অতঃপর ভাগ্য আরেকবার ওকে ঠেলে দিল মৃত্যুর মুখে।
চলবে।