মনের অনুরণন পর্ব-১২+১৩

0
4

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১২

আয়েশা বেগমের কথায় আজ সবাই মিলে গ্ৰামে যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে। আবরাহাম নিজের গাড়িতে নিয়ে এসেছে একসঙ্গে যাবে বলে।

সামিয়া আজ একটা কালো রঙের গাউন পড়েছে। যাতে হালকা সুতার কাজ করা। উপরে কালো রঙের একটা জ্যাকেট নিয়েছে। শীতের প্রভাব পড়েছে খানিকটা। চুলগুলো লম্বা বেনী করেছে। কাজল দিয়েছে চোখে টানা করে।

আবরাহাম, আনিসা আর রেদোয়ান গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলো। তখন মেইন গেট পেরিয়ে গাড়ির দিকে আসতে লাগল সামিয়া। ঠোঁটে তার সবসময়ের মতো মুচকি হাসি। আনিসা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। আবরাহাম সেদিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেল সামিয়ার উপর। হৃদস্পন্দন যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে। কেমন যেন অস্থির লাগছে। এসির মধ্যেও ঘামছে সে। এই মেয়ে কি মেরে ফেলবে নাকি তাকে। কেন তার এই মেয়েকে দেখলে এমন হয়। কেন সামিয়ার প্রতি এই আকর্ষণ, যা সে কোনোমতেই এড়াতে পারছে না।

আবরাহাম নিজের অনুভূতিকে সামলানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু যতবার সে সামিয়ার দিকে তাকাচ্ছিল, তার ভেতরে যেন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। এই মেয়ে তার মনের ভেতরে এমন এক জায়গা তৈরি করেছে, যেখানে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

রেদোয়ান ভ্রুযুগল কুচকে আবরাহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রেমে পড়লি নাকি!”

রেদোয়ানের কথায় হুশ ফিরলো আবরাহামের কাঠকাঠ গলায় বলে উঠলো,
“কি পাগলের মতো কথা বলছিস! পিচ্চি মেয়ের প্রেমে আমি পরবো। তোর সব ফালতু কথা পকেটে রাখ।”

রেদোয়ান ঠোঁট টিপে হাসি দিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
“হুমমম, তাই তো পলকহীন তাকিয়ে আছিস।”

আবরাহাম কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তুই কি এখন চুপ করবি নাকি তোকে ঔষধ দিতে হবে।”

রেদোয়ান বুঝতে পারলো এখন আর কথা বাড়ানো যাবেনা। তাই চুপ হয়ে গেল।

আবরাহাম রেদোয়ানের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল, কিন্তু তার মনের ভেতর ঝড়টা এখনও থামেনি। সামিয়ার আসার দৃশ্য তার চোখের সামনে থেকে সরছিল না। কেন এমন হচ্ছে, তা বুঝতে পারছিল না সে। নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে চাপা দিয়ে গম্ভীর ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু রেদোয়ানের সেই মজার কথায় তার ভিতরের দ্বিধা যেন প্রকাশ পেয়েই গেছে।

সামিয়া গাড়ির কাছে আসতেই আনিসা তার হাত ধরে বিভিন্ন কথা বলছে, কিন্তু আবরাহামের চোখের কোণ সামিয়ার দিকেই ছিল। সে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করছিল, এটা একটা ক্ষণিকের দুর্বলতা মাত্র, কিছুই নয়। কিন্তু এই অস্বস্তি, এই আকর্ষণ তাকে আর একা থাকতে দিচ্ছে না।

আনিসা সামিয়াকে গাড়ির দরজা খুলে বসতে বলল, আর সামিয়া বসার সাথে সাথেই গাড়িতে যেন এক অন্যরকম আবহাওয়া তৈরি হলো। আবরাহাম সোজা হয়ে বসল, চেষ্টা করছিল একেবারে নির্লিপ্ত থাকতে, কিন্তু সামিয়ার উপস্থিতি, তার মুচকি হাসি, তার চুলের বেনী—সব কিছুই তার মনকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

খানিকবাদেই আয়েশা বেগম, ইকবাল সাহেব, ইয়ানা আর ইহসান সবাই আসলো।

গাড়ি চলতে শুরু করল, কিন্তু আবরাহামের মন যেন ছুটে চলেছে সামিয়ার দিকেই।

সামিয়া আনিসার সঙ্গে গল্প করছিলো। হুট করেই লুকিং গ্লাসে চোখ পরতেই চোখাচোখি হলো আবরাহামের সাথে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলো সামিয়া। বুকটা ধকধক করছে। আবরাহাম তার দিকে তাকিয়ে ছিলো ভাবতেই গায়ের শিরা উপশিরা কম্পিত হলো তার। এতটা সময় চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলো সে। আর যেই তাকালো তার এমন চোখাচোখি হলো। সামিয়া চুপ হয়ে গেল। আবরাহাম পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে চোখে দিলো। রেদোয়ান আড়চোখে দেখে গাড়ি চালানোতে মন দিলো। আনিসা বলে উঠলো,
“ভাইয়া তুমি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছো?”

আনিসার কথায় সবাই তার দিকে তাকালো। আনিসা ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,
“আজকে তুমিও কালো পড়েছো আর সামিয়াও। বাই দ্যা রাস্তা তোমরা কি প্লানিং করে পড়েছো নাকি!”

আবরাহাম কপাল কুচকালো। তাকিলো নিজের দিকে। হালকা ঠান্ডা পড়ায় সে আজ কালো হুডি আর কালো জিন্স পড়েছে। সাথে কালো ঘড়ি। সামিয়াও আবরাহামকে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু গাড়িতে তার সোজা বরাবর আবরাহাম বসায় দেখতে পেল না। আবরাহাম গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“প্লানিং করতে যাবো কেন! ড্রেসের কালার এক হতেই পারে। তাতে কি সমস্যা!”

আবরাহামের এমন কথায় আনিসা মুখ ভেংচালো। আবারও সামিয়া, ইয়ানা আর ইহসানের সাথে গল্প জুড়ে দিলো।

আবরাহাম সানগ্লাস চোখে রেখেই দেখছে সামিয়াকে। আয়েশা বেগম চোখ বুজে আছেন। জার্নি তার একদম সহ্য হয় না। ইকবাল সাহেব জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে স্ত্রীর মাথা কাধে নিয়ে।

গ্রামের রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করতেই চারপাশের দৃশ্য পাল্টে গেল। শহরের কোলাহল আর ধোঁয়ার বদলে এখন সাদা কুয়াশার মায়াবী চাদর ঢেকে রেখেছে রাস্তার দুপাশ। মাটির গন্ধ ভেসে আসছে হালকা বাতাসের সঙ্গে, শীতের আবেশ গায়ে লেগে আছে। রাস্তার ধারে সারি সারি শীতল খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে, যেগুলো থেকে মাঝে মাঝে শুকনো পাতা মাটিতে পড়ে হালকা ঝনঝন শব্দ তুলে।

আকাশে কালো মেঘ জমেছে, যেন যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ঠান্ডা হাওয়া গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, আর সেই বাতাসে শীতলতার স্পর্শে সামিয়ার শিরায় শিরায় যেন এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট বাড়িঘর, ধানের ক্ষেত, আর মাঝে মাঝে দেখা মেলে গরুর গাড়ির, যা ধীরে ধীরে গাড়ির পাশ দিয়ে চলে যায়।

আবরাহাম গাড়ির ভেতরে বসে ছিলো, কিন্তু তার মন যেন উড়ে চলে গেছে এই শান্ত গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে মিশে থাকা শীতল হাওয়ার মধ্যে। সামনে তাকালে শুধু দূরে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের রেখা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পথের ধারে দেখা মিলছে চাষিরা মাঠে কাজ করছে, মাথায় গামছা বাঁধা। দূর থেকে ভেসে আসছে গ্রামের শিশুদের হাসির শব্দ।

একটু পরেই গাড়ি মেঠো রাস্তায় উঠল। সেই রাস্তার কাঁদা আর ছোট ছোট পাথরের উপর দিয়ে গাড়ি চলছিল ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে চাকা হালকা গর্তে ঢুকে যাচ্ছিল, কিন্তু চারপাশের পরিবেশ যেন সেই অস্বস্তিকেও উপভোগ্য করে তুলছিল। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছিল ধানের গাছগুলো বাতাসে নুয়ে পড়ছে, আর দূরে কোথাও কোথাও গ্রাম্য মাটির বাড়িগুলোর কুয়াশায় ঢাকা ছাদগুলো ধরা পড়ছিল।

খানিকবাদেই তারা পৌঁছে গেল তাদের গন্তব্যে। বিশাল বড় বাড়ি। আগের আমলের জমিদার ছিলেন সামিয়ার নানা। সামিয়া এর আগে বেশ কয়েকবার এসেছে। নানির বাড়ি মানেই পাগল সে। ছুটি পেলেই ছুটি আসে।

কিন্তু আবরাহাম আজ আসছে তেইশ বছরপর। ছোটবেলার স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে মনে। ছোটবেলায় এই সারা বাড়ি ছুটে বেড়িয়েছে সে।

অন্যদিকে আনিসা গোলগোল চোখে তাকিয়ে সবটা দেখছে। কারণ সে আগে কখনোই দাদু বাড়ি আসেনি। আনিসাকে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রেদোয়ান ওর মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল,
“হা বন্ধ কর গ্ৰামের বড় বড় মশা মাছি ঢুকে যাবে তোর মুখে।”

আনিসা মাথায় ঘষতে ঘষতে কটমটিয়ে রেদোয়ানের দিকে তাকালো। রেদোয়ান ভাবলেশহীন।

সামিয়া এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। তার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে। নানার পুরোনো বাড়ি, বড় উঠান, আর গাছপালা—সবকিছুতেই সামিয়ার অন্যরকম আনন্দ।

আবরাহাম ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামল। অনেক বছর পর এই বাড়িতে পা রাখছে সে। উঠানের ধারে দাঁড়িয়ে, চারপাশটা একবার চোখ বুলাল। অনেক কিছুই বদলেছে, কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। তার মনে পড়ছে ছোটবেলায় সে আর আনিসা এই বাড়িতে কত দৌড়াদৌড়ি করত, দাদুর কাছে গল্প শুনত।

আবরাহাম দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ জমেছে, হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাড়ির চারপাশটা যেন এক অদ্ভুত নীরবতায় মোড়া। কিন্তু এই নীরবতার মধ্যেই তার ভেতরের অস্থিরতা যেন ক্রমশ বাড়ছে। সামিয়ার উপস্থিতি তার মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে, আর সেটাই তাকে বিচলিত করছে।

আবরাহামের দাদি মিসেস হালিমা ছুটে এলেন আবরাহামের কাছে। এতবছর পর বড় ছেলের একমাত্র ছেলেকে পেয়ে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। আবরাহামের মুখে অসংখ্য চুমু এঁকে দিয়েছেন। আবরাহামও দাদিকে জড়িয়ে ধরেছে। হালিমা বেগম আনিসার সঙ্গেও বেশ কিছুসময় কথা বলেন। কথা বললেন বললে ভুল হবে, কান্নাকাটি করে অস্থির।

অনেকক্ষণ তিনি রান্না করতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। সাথে সাথে সামিয়াদের কাজিনরা এসে জড়ো হলো সামিয়া, ইয়ানা আর ইহসানের কাছে।

আয়েশা বেগমরা পাঁচ ভাইবোন। আবরাহামের বাবা সবচেয়ে বড়। ওনার পরে রায়হান খান আর ইয়াসিন খান, তারপর আয়েশা বেগম আর ওনার বোন রাবেয়া।

রায়খান খানের একটাই মেয়ে তনয়া। বিয়ে হয়েছে দুবছর আগে। ইয়াসিন খানে এক মেয়ে নিঝুম সামিয়ার সাথে আর দুই যমজ ছেলে রাদিফ রায়ান এবার ক্লাস ফাইভে পড়ে। রাবেয়া বেগমের তিন ছেলেমেয়ে। মাইশা ক্লাস ফোর, মীম ক্লাস টু আর মানাফ এখনো স্কুলে পড়েনা।

সামিয়ারা আসবে শুনে সবাই হাজির হয়েছে। আনিসা হা হয়ে সবাইকে দেখছে।

#চলবে

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১৩

আনিসা এর আগে কখনোই এতো মানুষের মাঝে থাকেনি। সামিয়া একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আনিসা ওদের সঙ্গে ভালোই মিশে গেছে।

আবরাহাম বসে বসে ফোন টিপছিলো। রেদোয়ানও ওর পাশে বসে টুকিটাকি কথা বলছে সামিয়াদের সাথে। কিন্তু আবরাহাম কোনো কথাই বলছেনা। তার সব মনোযোগ মনে হয় ফোনের ভিতরে।

আবরাহামের চাচারা বাজার গিয়েছে বলে তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। চাচিরা রান্নাঘরে কাজ করছে। মাঝে সবার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছে।

আবরাহাম ফোন টিপছিলো তখনই নিঝুম ওর সামনে দাঁড়িয়ে রিনরিনিয়ে বলল,
“ভাইয়া কেমন আছেন?”

মেয়েলি কন্ঠ পেয়ে আবরাহামের কপাল কুচকে এলো। একটু আগেই রেদোয়ান ওয়াশরুমে গেছে এখানে সে ছাড়া কেউ নেই। আবরাহাম চোখ তুলে গম্ভীর চিত্তে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকালো। তার কপালের ভাঁজ আরো গভীর ভাবে পড়ল। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী—নিঝুম, যার মুখে মিষ্টি হাসি। আবরাহাম কিছুটা বিরক্ত হলো, কারণ সে এতোক্ষণ নিজের শান্তিতে থাকতে চাইছিল। তার মুখে একটা গম্ভীর ভাব ফুটে উঠলো।

নিঝুম যেন আবরাহামের গম্ভীরতা বুঝতে পারলো না, তার চঞ্চল ভঙ্গিতে আবার বলল, “কি হলো বলেল না যে। সবাই কথা বলছে আপনি চুপ করে আছেন। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলি।”

আবরাহাম কিছুক্ষণ নিঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপর ধীরে ধীরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ, ভালো আছি।”

তার সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়ার পরও, নিঝুম সরছে না দেখে আবরাহাম ফোন কানে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে উঠানের দিকে গেল। নিঝুম মুখ ঝুলিয়ে তাকিয়ে রইলো আবরাহামের যাওয়ার দিকে।

সামিয়া এতটা সময় সবটাই আড়চোখে দেখেছে। আবরাহামের নিঝুমকে এমন ইগনোর করায় অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো সামিয়ার।

উঠানে আসতেই আবরাহামের দেখা হয়ে গেল তার চাচাদের সঙ্গে। কুশল বিনিময় করে একসঙ্গে ভিতরে আসলো তারা। কিছুক্ষণবাদেই দুপুরের খাওয়ার জন্য ডাক পড়লো তাদের।

বড় খাবার টেবিলটি ছিল বেশ জমকালো। প্রাচীন কাঠের টেবিলের উপর পরিষ্কার সাদা টেবিলক্লথ বিছানো, তার উপরে সাজানো বিভিন্ন পদ। টেবিলের চারপাশে সবাই একে একে বসছে। আবরাহাম, রেদোয়ান, সামিয়া, আনিসা, নিঝুম এবং অন্যান্য অতিথিরা সবই জায়গা নিয়েছে। টেবিলের একপাশে বসেছেন আবরাহামের চাচারা, চাচিরা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন, দাদিও খেতে বসেছেন সবার সাথে।

টেবিলের উপরে রাখা রয়েছে গরম ভাত, পাশে ডাল, মাছ ভাজি, রুই মাছের ঝোল, গরুর মাংসের কষা, মুরগির রোস্ট, শাক, ভর্তা, সালাদসহ নানান আইটেম। তেল মসলায় ভরপুর এসব পদে দারুণ ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে পুরো ঘরে। মিষ্টি হিসেবে রাখা হয়েছে পায়েস ও জিলাপি। খাবারের এমন আয়োজন দেখে সবার চোখে প্রশংসার ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল।

আবরাহাম গম্ভীর মুখে বসে থাকলেও তার চারপাশে চলছে আলাপ-আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা। সামিয়া খেয়াল করে দেখলো, নিঝুম বারবার আবরাহামের দিকে চেয়ে আছে, যেন কথা বলার সুযোগ খুঁজছে।

সবার এতোসব কথার মাঝেও আবরাহাম নিজের দুনিয়ায় বন্দী হয়ে আছে। টেবিলের উপরে রাখা খাবারের দিকে তাকিয়ে কোনো অভিব্যক্তি করছে না। রেদোয়ান তার পাশে বসে একটা কৌতুক বললো, কিন্তু আবরাহাম স্রেফ একবার তাকিয়ে আবার নিজের মোবাইলে মন দিলো। সামিয়ার দৃষ্টি তখন আবরাহামের দিকে। সে জানে আবরাহাম এমন গম্ভীর থাকলেও তার ভেতরে কিছু একটা চলছে।

নিঝুম আবরাহামের পাশে বসার সুযোগ পেয়েছে, আর সেই সুযোগেই বারবার কিছু বলার চেষ্টা করছে।

“ভাইয়া, আপনি কি সবসময় এমনই চুপচাপ থাকেন?” নিঝুম একটু হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো।
আবরাহাম মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে শুধু বললো,
“হ্যাঁ, বেশি কথা বলার অভ্যাস নেই।”

নিঝুম একটু হেসে বলল,
“আমার কিন্তু কথা বলতে ভালো লাগে।”

আবরাহাম এবার একটু বিরক্ত হয়ে তাকালো, কিন্তু কিছু না বলে সামনের খাবারের দিকে মন দিল। নিঝুমের কথা শুনতে শুনতে সামিয়া এবার হাসি চাপতে পারলো না। সে আবরাহামের দৃষ্টি এড়িয়ে সামনের প্লেটে ভাত তুলে নিচ্ছিল। আবরাহামের এমন রুক্ষ ব্যবহার দেখে তার মনে মিশ্র অনুভূতি জাগছে।

হঠাৎ আয়েশা বেগম সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সবাই খাওয়া শুরু করো। অমন চুপ করে বসে থাকলে হবে না। রিহু বাবা তুই কিন্তু সব খাবার খাবি।”

আয়েশা বেগমের মুখে রিহু বাবা শুনেই ফিক করে হেসে দিলো আনিসা। সবাই তার দিকে তাকালো। আনিসা দাঁত বের করে আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ফুপি রিহু বাবা নামটা কিন্তু সেই।”

আবরাহাম কটমটিয়ে তাকালো আনিসার দিকে। আনিসা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“রিহু বাবা খাও।”

সামিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো। রেদোয়ানও হেসে দিলো।

আয়েশা বেগম গরুর মাংসের বাটিটা সামিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“রিহু বাবাকে একটু তুলে দে তো।”

সামিয়া খানিকটা ইতস্তত হলো। কাঁপা হাতে মাংস তুলে দিলো আবরাহামের প্লেটে। আবরাহাম কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, সামিয়ার হাতে ধরা চামচের দিকে। তারপর নিঃশব্দে প্লেটে খাবার খেতে লাগল, কিন্তু তার মুখে তখনও একটা গম্ভীর ভাব লেগেই রইলো।

লাঞ্চ শেষে সবাই একে একে উঠে গেলো। সামিয়া টেবিল গুছাতে সাহায্য করছিলো, রান্নাঘরে চাচিদের সাথে আনিসা আর নিঝুমও মিলে কাজ করছিলো। আবহাওয়াটা ক্রমশ মেঘলা হয়ে আসছে, জানালার বাইরে হালকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। আবরাহাম উঠানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো, চারপাশের পরিবেশ দেখছিলো। ছোটবেলার কত স্মৃতি মনে পড়ছে এই উঠানকে ঘিরে, কিন্তু এখন সবকিছু কেমন শূন্য মনে হচ্ছে তার কাছে।

রেদোয়ান পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“কি রে, কি ভাবছিস এত?”

আবরাহাম এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থাকলো, তারপর ধীরে ধীরে বললো,
“কিছু না, পুরোনো কিছু ভাবছিলাম।” তার কন্ঠে এক ধরনের ক্লান্তি ছিলো।

এদিকে সামিয়া রান্নাঘরে কাজ শেষ করে উঠানে আসছিলো। তার চোখ পড়লো আবরাহামের দিকে, যিনি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন। সামিয়া তাকে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার চোখে সেই একই কঠিন অভিব্যক্তি, সামিয়া ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে পাটি আনতে গেল।

পানির বোতল আর পাটি নিয়ে সবাই ছাদের দিকে পা বাড়ালো। বড়রা রুমে গিয়ে রেস্ট নিচ্ছে। সামিয়া, ইয়ানা, ইহসান, তনয়া, তনয়ার স্বামী হাসিব, মাইশা, মীম, নিঝুম, রায়ান, রাদিফ, মানাফ, আনিসা, রেদোয়ান সবাই ছাদে গোল হয়ে বসেছে আড্ডা দেওয়ার জন্য।

আবরাহাম প্রথমে আসতে চাইছিলো না। পরে আনিসা টেনে এনেছে। আবরাহামে একটা কল আসায় ও দূরে গিয়ে কথা বলছে ফোনে। কিছুক্ষণ বাদে ফোন রেখে সবার সাথে এসে বসলো পাটিতে। তার মুখে এখনও সেই চিরচেনা গম্ভীর ভাব। চারপাশে হাসি-ঠাট্টা, গল্প চলছে, কিন্তু আবরাহাম যেন অন্য এক দুনিয়ায়। আনিসা ওর পাশে বসে আবরাহামের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো, কিন্তু আবরাহাম সেই চাহনিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলো।

“আরে, ভাই! কিছু বল না,” হাসতে হাসতে বলল রেদোয়ান।
“তোর মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না!”

আবরাহাম এক দমকা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে নিচ্ছিলো, মাথা নাড়লো না, শুধু একটু মৃদু হাসির আভাস দিল। তার মনের ভেতরে যেন অনেককিছু চলছে, কিন্তু সে তা প্রকাশ করতে চাইছে না।

আবরাহামের মৃদু হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো সামিয়া। সে যদি জানতো হাসলে তাকে কত সুন্দর লাগে। তাহলে সবসময় সে হাসতো। কিন্তু আফসোস হাসা তো দূরের কথা এই ব্যাটা তো কথাই বলে না ভালো ভাবে। সামিয়া এগুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

সামিয়া ছাদের অন্যপাশে বসে আবরাহামের দিকেই মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিলো। তার মনে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। আবরাহামের এমন চুপচাপ থাকা, তার ভেতরের অস্থিরতা সবকিছুই সামিয়া বুঝতে পারছিল। সে বুঝতে পারছে, আবরাহামকে সহজভাবে নেওয়া সহজ নয়, কিন্তু তার এই গম্ভীরতা সামিয়াকে আরও বেশি আকৃষ্ট করছে।

মাঝে মাঝে, সামিয়া হাসির ফাঁকে আবরাহামের দিকে তাকিয়ে দেখলো যে আবরাহাম তার ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে আছে। যেন সে এখানে থেকেও নেই। নিঝুম আবার কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু আবরাহামের মনোযোগ অন্য কোথাও।

“ভাইয়া, আচ্ছা, আপনি কি এমনই সবসময়?” নিঝুম এবারও হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করল।

আবরাহাম এবারও তেমন কোনো সাড়া দিল না, শুধু বলল,
“আমি এমনই।”

সবার মাঝে গল্পের একটা ঢেউ উঠলো। হাসি-মজার মধ্যেও আবরাহাম যেন পুরোটা এড়িয়ে যাচ্ছে। সামিয়া এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, সে আবরাহামের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আপনি সবসময় এত চুপচাপ কেন?”

আবরাহাম একটু চমকে উঠল। সামিয়ার এমন প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। একটু থেমে, ধীরে ধীরে বলল,
“চুপ থাকা অনেক সময় সহজ হয়।”

সামিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর হাসি চাপতে চেষ্টা করে বলল,
“সবাই কিন্তু সবসময় চুপ করে থাকতে পারে না।”

আবরাহাম মৃদু হেসে বলল,
“তোমরা পারো, আমিও পারবো না।”

সামিয়া আবরাহামের কথা শুনে মুচকি হেসে বলল, “আমরা চেষ্টা করলে পারি, কিন্তু আপনি তো চেষ্টা করেও বেশি কথা বলতে চান না, তাই না?”

আবরাহাম মুখে কোনো জবাব না দিয়ে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে যেন একধরনের বিষণ্ণতা ঝুলছে। সামিয়ার মনে হলো, আবরাহাম কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু কোন কারণে সে তা আটকে রাখছে।

এদিকে নিঝুম আর বাকিরা নিজেদের আড্ডায় মেতে আছে। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ আছে, আর মেঘলা আকাশ ধীরে ধীরে আরও ঘন হচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় আড্ডা দেওয়ার মজা আরও বেড়ে গেছে। নিঝুম বারবার আবরাহামের দিকে তাকাচ্ছে, যেন আরও কথা বলার সুযোগ খুঁজছে, কিন্তু আবরাহাম সবার মাঝে থেকেও একা।

তখনই রেদোয়ান আবরাহামের পাশে এসে বসল এবং কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কী রে, তুই তো পুরো আলাদা দুনিয়ায় আছিস! একটু এদিকে ফিরে তাকাবি?”

#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)