মনের অনুরণন পর্ব-২+৩

0
4

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ২

হুমায়রা সামিয়ার কাধে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কিরে কি এতো ভাবছিস!”

“না তেমন কিছু না। পরীক্ষার এডমিট কার্ড দেওয়ার পর কিন্তু স্কুলে আসবো না।”

“হুম, পড়তে হবে দোস্ত। অনেকটাই গ্যাপ পড়ে গেছে।”

———————

মানিকগঞ্জের সভা শেষ করে আবরাহাম খান ফিরছিল বাসায়।
গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নম্বরটা দেখে একটু হেসে নিলো। বিরবির করে নিজের মনেই বলতে লাগল,

“এবুকে আজও কেবল বর্ষা নামে। আগে ভরসা ছিলি তুই। মেয়াদ ফুরোতেই তোর মত, বদলে যায় সমস্ত ঋতুই।”

নম্বরটা চিনতে পেরেছিল সে। দীর্ঘদিনের এক সম্পর্ক, যা আজ শুধুই তার জন্য কষ্টের কারণ। আবরাহাম ধীরে ধীরে ফোনের স্ক্রিনে হাত বুলিয়ে সেটাকে ব্লক লিস্টে ফেলে দিলো। নিজের মনের চাপা কষ্টটা গোপন করার চেষ্টা করে আবার বলল,

“আজ যে তুই আসিসনি আমাকে ভালোবেসে। এসেছিস আমার অর্থ-সম্পদের নেশায়। কিভাবে মেনে নিই তোকে!”

আবরাহামের চোখে যেন এক ঝলক বিষাদ ফুটে উঠল। তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ব্যথা বাইরে বেরোবার সুযোগ খুঁজছিল। অথচ, যতই সামনে তাকানোর চেষ্টা করুক, অতীতের সেই সম্পর্ক যেন তাকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সে জানতো, ক্ষমতা ও দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে চলতে হয়, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষত থাকে যা ভেতরে লুকিয়ে রাখা কঠিন।

গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আবরাহাম খান ভাবতে লাগল, এই অস্থিরতাকে সে কিভাবে কাটিয়ে উঠবে।

গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আবরাহাম খান প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে পেলেও মনের ভেতরে অশান্তি কাটছিল না। চারপাশের জীবন যেন তার নিজের জীবনের বিপরীত মেরুতে। মানুষজন, গাছপালা, রাস্তাঘাট—সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, অথচ তার ভেতরে যেন এক শূন্যতা কাজ করছে।

মনে মনে ভাবতে লাগল, কবে থেকে সে এমন অসহায় বোধ করছে? নিজের সাফল্য, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি সবকিছু থাকতেও কেন যেন কিছু একটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সেই পুরোনো সম্পর্কটা কি এতটাই গভীর দাগ রেখে গেছে তার জীবনে যে আজও সে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না?

গাড়ি বাসার সামনে এসে থামল। আবরাহাম খান নীরবে গাড়ি থেকে নামল। গাড়ির থেকে নামতেই তার ব্যক্তিগত সহকারী রেদোয়ান এগিয়ে এসে জানালো,
“স্যার, আগামীকাল মিটিং এর জন্য কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। কয়েকটি জরুরি ফাইল সাইন করতে হবে।”

আবরাহাম খান সোজা উত্তর দিল,
“ঠিক আছে, ফাইলগুলো আমার স্টাডি রুমে পাঠিয়ে দাও। আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।”

ঘরে ঢুকতেই আবরাহাম খান একবার নিজের ফোনের দিকে তাকালো। ব্লক করা নম্বরটা আবারও মাথায় ঘুরছিল। সে জানত, এটা ঠিক নয়, কিন্তু কৌতূহল মনের কোণে রয়ে গিয়েছিল। কী হতে পারত, যদি সম্পর্কটা অন্যরকম হতো?

——————————–

সামিয়া এবং হুমায়রা স্কুলের ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার পথে। সামিয়ার মনেও চলছে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। নেতামশাইকে দেওয়া চিঠির কথা বারবার মাথায় ঘুরছে। হঠাৎ হুমায়রা বলল,
“তুই জানিস, তুই যদি সত্যি চিঠির কোনো উত্তর পাস, তাহলে তোদের মধ্যে কিছু একটা হতে পারে।”

সামিয়া কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কি বলিস এসব! উত্তর আসবে না, আর আসলেও এর কোনো মানে নেই। উনি তো অনেক বড় মানুষ। আমার এসব ভাবা উচিত না।”

হুমায়রা মুচকি হেসে বলল,
“মানুষ বড় ছোট হয় না, দোস্ত। তুই শুধু নিজের মনের কথা বুঝতে পারছিস না। সময় নে, তুই নিজেই বুঝবি একদিন।”

সামিয়া কিছু বলল না, তবে হুমায়রার কথা তার মনের কোণে যেন দাগ কেটে গেল।

————–

সামিয়া বাড়িতে ফিরেই কলিংবেল বাজাতে লাগল অনবরত। সামিয়ার মা আয়েশা বেগম রান্নাঘর থেকে দ্রুত পায়ে এসে দরজা খুলে দিলেন। সামিয়া ভিতরে ঢুকতেই আয়েশা বেগম দরজা লাগাতে লাগাতে বললেন,
“কিরে মন খারাপ!”

সামিয়া সোফায় গা এলিয়ে দিলো। মৃদু সুরে বলল,
“আম্মু পরীক্ষা নিয়ে টেনশন হচ্ছে।”

আয়েশা বেগম মেয়ের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বললেন,
“পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করিস না, মা। তুই তো ভালোই পড়াশোনা করেছিস। সব ঠিকঠাক হবে, ইনশাআল্লাহ।”

সামিয়া একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে মায়ের কাধে মাথা রাখলো। আয়শা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“যা গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নে। আমার খাবার বাড়ছি যা।”

সামিয়া মায়ের কাঁধ থেকে মাথা তুলে ধীরে ধীরে বলল,
“ঠিক আছে আম্মু, ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

সে দ্রুত ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে গোসল করতে ঢুকল। পানি মাথায় পড়তেই যেন তার মনের সব অস্থিরতা একটু হলেও প্রশমিত হলো। কিন্তু মনের ভেতর কোথাও যেন একটা অদ্ভুত টানাপোড়েন কাজ করছিল—নেতামশাইয়ের চিঠির উত্তর আসবে কিনা, আর এলেও তা কেমন হবে?

গোসল শেষে নিজেকে হালকা লাগলেও চিন্তাগুলো যেন ঠিক তেমনই রয়ে গেল। নিজেকে বোঝাল, পরীক্ষার ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত এখন, অন্যসব চিন্তা সময়ে সময়ে মিটে যাবে।

খাওয়ার টেবিলে বসে মা মৃদু হাসি দিয়ে বললেন,
“তোর কি সবসময় এমন চিন্তা করতে হবে? দেখ, মন ভালো রাখলে পরীক্ষায়ও ভালো করবে। চিন্তা করে করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সামিয়া মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল,
“ঠিক বলেছো আম্মু, চেষ্টা করবো আর চিন্তা না করার।”

আয়েশা বেগম সন্তুষ্ট মনে বললেন,
“এটাই তো চেয়েছিলাম শুনতে।”

সামিয়া চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে গেল।

——————–

আবহাওয়া খারাপ। বৃষ্টি আসবে হয়তো। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সামিয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। হাত খোপা করে রাখা ভেজা চুলগুলো আস্তে করে খুলে। মুহুর্তের মধ্যেই ঘন কালো চুলগুলো কোমড় বেয়ে নেমে পড়লো। বাতাসে মাটির সুবাস ভেসে আসছে।সামিয়া মাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে আকাশের দিকে তাকালো। বৃষ্টি এখনো শুরু হয়নি, তবে মেঘগুলো একত্রিত হয়ে যেন ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে।

হঠাৎ একটা ঝাপটা বাতাস এসে তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। সামিয়ার মনটা যেন অস্থির বাতাসের মতোই ছুটে বেড়াচ্ছে। মনের গভীরে নেতামশাইয়ের সেই চিঠির প্রতীক্ষা বারবার ফিরে আসছে।

সে জানে, এখন পরীক্ষার পড়ায় মন দেওয়া জরুরি, কিন্তু সেই এক অজানা প্রত্যাশা তার মনকে অবশ করে রাখছে। নেতামশাইয়ের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া এলে কী করবে, কী বলবে—এসব প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরছে।

বৃষ্টি শুরু হতেই সামিয়া হাত বাড়িয়ে দিলো বাইরে। ফোঁটা ফোঁটা পানি এসে পড়ছে সামিয়ার হাতে। সামিয়া মুচকি হাসলো।

বৃষ্টি জোরে আসতেই বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এসে সে জানালা বন্ধ করল। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। সামিয়া মন স্থির করে পড়ার টেবিলে বসলো। ফিজিক্স খাতা আর বই বের করে কয়েকটা তপ্ত শ্বাস ফেলল। খোলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে, মনের মধ্যে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল,
“এখন পড়ার সময়, অন্যসব চিন্তা বন্ধ কর সামিয়া।”

সামিয়া পড়ার টেবিলে বসে ফিজিক্সের সূত্রগুলো একের পর এক পড়তে লাগল। কিন্তু মনের ভেতরের অস্থিরতা তাকে পুরোপুরি পড়ায় মনোযোগ দিতে দিচ্ছিল না। নেতামশাইয়ের চিঠির প্রত্যাশা, বৃষ্টির শব্দ, আর আসন্ন পরীক্ষার চাপ—সবকিছু একসাথে তার মাথায় ঘুরছিল। সে জানত, এখন মনোযোগ ধরে রাখাটা সবচেয়ে জরুরি, কিন্তু সেই পুরোনো প্রশ্নগুলো মাথায় বারবার ফিরে আসছে।

বইয়ের পাতায় চোখ রাখলেও, মনটা যেন বাইরে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য সে ভেবে নিল, হয়তো চিঠির কোনো উত্তর আসবে না। নিজেকে শান্ত করার জন্য সে আবার বইয়ের দিকে মন দিল।

———————

আবরাহাম স্টাডি রুমে বসে ফাইল দেখছিলো। ঝড়ো হাওয়ায় বারান্দার সাদা পর্দাগুলো উড়ছে। এখন জানালা দরজা বন্ধ না করলে হয়তো রুমের সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে যাবে। আবরাহাম ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। থাই গ্লাসগুলো টেনে দিলো। মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানলার গ্লাসে বাড়ি খাচ্ছে বৃষ্টি স্বচ্ছ পানির ধারা। আবরাহাম গ্লাসে হাত রাখলো। মনে হচ্ছে বৃষ্টির বারিধারা তার হাতে বাড়ি খাইতে চাচ্ছে। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছেনা। সে জানালার গ্লাসে হাত রেখেই বৃষ্টি দেখছিল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন তার মনের অস্থিরতা প্রতিফলিত করছিল। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির আঘাতে বাইরের পৃথিবী যেমন তছনছ হয়ে যাচ্ছে, তেমনি তার ভেতরেও চলছিলো এক গভীর টানাপোড়েন। পুরোনো সম্পর্কের তিক্ততা আর অতীতের কিছু স্মৃতি তাকে শান্ত হতে দিচ্ছিল না।

হঠাৎ আবরাহামের ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনের নাম্বারটা দেখে সে কিছুক্ষণ স্থির থাকল, তারপর ফোনটা তুলে নিল। কিছু বলার আগেই অপর প্রান্ত থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো:

“তুমি কেমন আছো, আবরাহাম?”

আবরাহাম কিছুটা থমকে গিয়ে বলল,
“তুমি আবার কেন ফোন করলে? আমি তো তোমার নম্বর ব্লক করেছিলাম।”

অপর প্রান্ত থেকে আসা কণ্ঠটা শান্ত ছিল। “কিছু কথা ছিল, যেগুলো বলা হয়নি। আমি… ক্ষমা চাইতে চেয়েছিলাম।”

আবরাহাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ক্ষমা? তুমি জানো, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আর তোমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো মানে নেই।”

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর আবার কথা এলো,
“হয়তো ঠিক বলেছো। তবে কিছু সম্পর্কের শেষ হয়েও হয় না, আবরাহাম।”

আবরাহাম খান ফোনটা রেখে দিলো। তার মনের ভেতর আবারও সেই পুরোনো কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বারবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও, অতীতের স্মৃতি যেন তাকে ছাড়তেই চায় না।

বাইরে বৃষ্টি থেমে এসেছে। কিন্তু আবরাহামের ভেতরের ঝড় যেন আরও তীব্র হয়েছে। সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের ভেজা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রইলেন। বৃষ্টি থেমে গেলেও, আকাশে এখনো মেঘ জমে আছে। মনে হচ্ছে, আরেকবার ঝড় আসতে পারে।

তেমনি আবরাহামের মনের গভীরে জমে থাকা মেঘগুলোও হয়তো শিগগিরই ফেটে পড়বে। আবরাহাম জানালা খুলে দিলো। জানালা খুলতেই ঠান্ডা বাতাস এসে তার সারা শরীরে বাড়ি খেল।

#চলবে

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ৩

আবরাহাম চোখ বন্ধ করে শীতল বাতাসের ছোঁয়া অনুভব করল। হাওয়ায় যেন একটা প্রশান্তি ছিল, যা তাকে ঘিরে রেখেছিল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে নিঃশব্দে জ্বালাল, তারপর ঠোঁটে ফেলে গভীরভাবে টান দিল। কিছুক্ষণ পরপর নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া বের হচ্ছিল তার মুখ থেকে, যা ঠাণ্ডা বাতাসকে যেন এক মুহূর্তেই ভারী ও গরম করে তুলল।

তবুও, সে এসবের কোনো গুরুত্ব দিল না। চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সামনের আমগাছের দিকে। পাতা থেকে টপটপ করে পড়া পানির ফোঁটা, প্রতিটা ফোঁটার পর যেন আরও কিছু সময় আটকে থাকার চেষ্টা করছিল। সে অদ্ভুত এক নিষ্ঠায় সেই দৃশ্য দেখছিল, যেন প্রকৃতির এই নিঃশব্দ কারুকাজ তার চিন্তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।নিঃশব্দে বয়ে চলা এই ক্ষণিকের মুহূর্ত তাকে কোথাও দূরে নিয়ে যাচ্ছিল, এক অন্তহীন চিন্তার জগতে, যেখানে শুধুই একাকীত্ব আর শান্তি মিশে ছিল।

দরজায় টোকা পড়তেই ধ্যান ভাঙলো আবরাহামের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো
“দরজা খোলাই আছে।”

তখনই সেখানে খাবার প্লেট নিয়ে হাজির হলো আবরাহাম এর বোন আনিসা। মুচকি হাসি দিয়ে খাবারটা টেবিলে রেখে ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া খাবার খাবে না।”

আবরাহাম আগেই সিগারেটটা ফেলে দিয়েছিলো। বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে সে তাকালো তার ছোট বোনটার দিকে।

বোনের হাসিমুখ দেখে অজান্তেই তার ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুই খেয়েছিস?”

আনিস চোখ ছোট ছোট করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এমনটা কি কখনো হয়েছে!”

আবরাহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বোনটাও না। এমন করলে কি করে হয়! সে ব্যস্ত মানুষ তার জন্য এমন করে না খেয়ে বসে থাকলে হয়। আবরাহাম এবার খানিকটা গম্ভীর কন্ঠেই বলে উঠলো,
“তোকে না করেছিলাম না আমি। ঠিকমতো খাস না কেন! তুই কি এখনো বাচ্চা আছিস!”

আনিসা আবরাহামের কথা পাত্তা না দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে সোফায় বসালো।

আবরাহাম আনিসার চোখে গভীর এক স্নেহময়ী অভিব্যক্তি লক্ষ্য করল। বোনের হাতের উষ্ণ স্পর্শ তাকে মুহূর্তের জন্য ফিরিয়ে আনল বাস্তবে। আনিসা মৃদু হেসে বলল,
“ভাইয়া, তুমি তো জানো আমি কেমন। তোমাকে না দেখে খেতে মন চায় না।”

আবরাহাম আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কিন্তু এইবার তার মন কিছুটা নরম হয়ে গেল। বোনের প্রতি এই ভালোবাসা আর যত্নের একটুকরো প্রকাশ তাকে নীরব করে দিল। খাবারের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কতদিন হলো একসঙ্গে ঠিকমতো খাওয়া হয়নি।

আবরাহাম আস্তে করে বলল,
“ঠিক আছে, চল, একসঙ্গে খাই।”

আনিসা এক পলক তার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন এই ক্ষণটা অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিল। সে মৃদু হাসল, তারপর ধীর পায়ে গিয়ে টেবিলে রাখা খাবারদুটো তুলে নিয়ে এল। আবরাহামও কোনো কথা না বলে চুপচাপ তার পাশে বসল।

সন্ধ্যার নরম আলো ঘরটাকে শান্তিপূর্ণ করে তুলেছিল, আর সেই মুহূর্তে দুজন একসঙ্গে বসে খাবার শুরু করল। কোনো ব্যস্ততা নেই, কোনো শব্দ নেই, শুধু ভাইবোনের নিঃশব্দ বোঝাপড়া। খাবার গ্রহণ যেন তাদের ভেতরের মানসিক দুরত্বটুকু কমিয়ে দিল।

আবরাহাম ভাবল, এইসব ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই তো আসলে জীবনের বড় পাওয়া। পৃথিবীর যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, পরিবারের সঙ্গে কাটানো এই ক্ষণগুলোই তাকে শান্তি দেয়, একধরনের পূর্ণতা অনুভব করায়।

আনিসা মৃদু হেসে বলল,
“তোমার সাথে খেতে বসে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।”

আবরাহামও হালকা হাসল।
“হ্যাঁ, তখন তো এমনিতেই একসঙ্গে খেতে বসতাম, ব্যস্ততাই ছিল না।”

আনিসা সস্নেহে বলল,
“কিন্তু তোমার সিগারেটটা তখন ছিল না।”

দুজনেই এবার হাসল।

——————–

বৃষ্টির কারণে আর প্রাইভেটে যাওয়া হলো না সামিয়ার। সে টেবিলে বসে অংক করছিলো। তখনই তিন বাটি নুডুলস হাতে হাজির হলো সামিয়ার ছোট বোন ইয়ানা। রুমে ঢুকতে ঢুকতে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“বড় আপু নুডুলস এসেছি খেয়ে নে। আম্মু চা আনছে। পরে করিস এখন খেয়ে নে।”

সামিয়া খাতায় কলম চালাতে চালাতেই বলে উঠলো,
“ইহসান কোথায়? ও খাবে না।”

ইয়ানা বিছানায় পা তুলে বসে একটা বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বাংলাদেশের খেলা হচ্ছে।”

ইয়ানার কথায় মৃদু হাসলো সামিয়া। তার ভাই যে পাক্কা খেলা পাগল। সে কি আর খেলা ছেড়ে খেতে আসবে। সামিয়া অংকটা শেষ করে খাতা বন্ধ করতেই চা নিয়ে আয়েশা বেগম রুমে প্রবেশ করলেন।

আয়েশা বেগম ঢুকে দেখলেন, দুই মেয়ে ইতিমধ্যেই নুডুলস খেতে শুরু করে দিয়েছে। একটা মৃদু হাসি দিয়ে টেবিলে চা রাখলেন এবং বললেন,
“ইহসান কি আসবে না? সারাক্ষণ খেলার পিছনে পড়ে থাকে, খাবারেও মন নেই!”

সামিয়া মৃদু হেসে বলল,
“আম্মু, তুমি তো জানো, বাংলাদেশের খেলা হলে ও কিছুতেই উঠবে না। খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিভির সামনেই বসে থাকবে।”

ইয়ানা নুডুলসের বাটি হাতে নিয়ে বলল,
“আপু, আমরা কিন্তু ইহসানের নুডুলসও খেয়ে ফেলবো।”

আয়েশা বেগম হেসে বললেন,
“যাও, ডেকে আনো। নাহলে ওর খাবারও শেষ হয়ে যাবে।”

ইয়ানা সোজা টিভি রুমের দিকে রওনা দিল। ইহসানকে টিভির সামনে বসে বাংলাদেশের খেলা দেখায় মগ্ন দেখে মজা পেল। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
“ইহসান, তোর নুডুলস খেয়ে ফেলছি!”

ইহসান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, চোখ টিভির পর্দাতেই আটকে রইল। ইয়ানা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“আরে! খেলা শেষে খাবার পাস নাকি? আসিস না হলে তোরটা আমরাই খেয়ে ফেলব।”

একটু পরে ইহসান, যিনি খেলা ছাড়তে চায়নি, শেষে খাবারের লোভ সামলাতে না পেরে উঠে এল। সবাই মিলে আবার হাসিমুখে নুডুলস খেতে বসল, একসঙ্গে থাকার এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো যেন জীবনের রঙগুলোকে আরও উজ্জ্বল করে তুলল।

নাস্তা শেষ করার পরেই হুট করেই কারেন্ট চলে গেল। আবারো বৃষ্টি শুরু হয়েছে তুমুল ভাবে। তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। ইহসান দৌড়ে গেল দরজা খুলতে। চার্জার লাইট নিয়ে আয়শা বেগম ছুটলেন। ইকবাল সাহেব কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সামিয়া গামছা নিয়ে এগিয়ে গেল বাবার কাছে।

ইকবাল সাহেব বসায় ঢুকে সোফায় বসে গামছা দিয়ে মাথা মুছতে লাগলেন। জিঙ্গাসু কন্ঠে বললেন,
“দরজা জানালা সব লাগিয়েছো ঝড় উঠতে পারে সামিয়ার মা।”

ইয়ানা পানি এনে দিলো বাবার হাতে। আয়েশা বেগম স্বামীর পাশে বসতে বসতে বললেন,
“হুম লাগিয়েছি সব। তুমি বৃষ্টিতে আসতে গেলে কেন! বৃষ্টি থামলে আসতে। ভিজে কি অবস্থা!”

ইকবাল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“এ বৃষ্টি থামার না। তুমি এক কাজ করো ইলিশ মাছ এনেছিলাম না। ভেজে ফেল ঝট করে। গরম ভাতের সাথে খাওয়া হবেনি।”

আয়েশা বেগম স্বামীর কথামতো চলে গেলেন রান্নাঘরে। ইকবাল সাহেব ছেলের কাছে খেলার খবর আর মেয়েদের কাছ থেকে তাদের পড়াশোনার খবর শুনে চলে গেলেন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে।

সামিয়া আর পড়তে বসলো না। কারেন্ট তো নাই এমন অবস্থায় আয়েশা বেগমও কিছু বলবেন না ভেবেই সামিয়া রান্না ঘরের দিকে গেল।

আয়েশা বেগম এক চুলায় ভাত তুলে দিয়েছেন আর অন্য চুলায় তেল গরম বসিয়েছেন। সামিয়া মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ইলিশমাছ ভাঁজা তার বেশ পছন্দ। তার উপর বাহিরে বৃষ্টি পড়ছে। আর কি চাই।

আয়েশা বেগম মাছে মসলা মাখিয়ে আস্তে আস্তে মাছের টুকরোগুলো ছেড়ে দিলেন তেলে। সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“যা এখানে গরম। টেবিলে বস হয়ে এসেছে আমার।”

সামিয়া বাধ্য মেয়ের মতো টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ইয়ানা আর ইহসান খুনসুটি করছিলো। সামিয়াকে দেখে ইয়ানা বলল,
“দেখনা আপু আমি বলছি বাংলাদেশ পারবেনা কতবার বলছি ইহু শুনছেই না।”

সামিয়া কিছু না বলে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো। ইহসান গাল ফুলিয়ে বলল,
“আপু দেখ আল্লাহ ভরসা। পারতেও তো পারে।”

সামিয়া একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। গরমে অস্থির লাগছে তার। একে তো কারেন্ট নেই তার উপরে ভ্যাবসা গরমে বেশ বিরক্ত হচ্ছে সামিয়া।

ইকবাল সাহেব টেবিলের কাছের জানালাটা আস্তে করে খুলে দিলেন। রুম করে কয়েকটা মোমবাতি নিয়ে এলেন। সামিয়া,ইয়ানা আর ইহসান চুপচাপ বাবার কান্ড দেখতে লাগল।

আয়েশা বেগম রান্নাঘর থেকে সব নিয়ে এলেন। ইকবাল সাহেব মুচকি হেসে স্ত্রীর হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। নিজেই ভাত মাখিয়ে এক এক করে সবার মুখে তুলে দিলেন। সবাই খুশি মনে খেয়ে ওনাকেও খাইয়ে দিলো। সামিয়ার বিরক্তি ভাব যেন একরাশ ভালো লাগায় পাল্টে গেল।

জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস আর মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় মুহূর্তটা আরো সুন্দর হয়ে উঠছে। সবাই টুকিটাকি গল্প বলে খাওয়া শেষ করলো।

খাওয়া শেষে মাকে কাজে সাহায্য করে রুমে এলো সামিয়া। আজ আর কারেন্ট আসবে বলে মনে হয় না। সামিয়া চার্জার লাইট দিয়েই বিছানে ঝেড়ে নিতেই ইয়ানা মশারি টাঙ্গিয়ে শুয়ে পড়লো।

সামিয়া এখন ঘুমাতে মন চাচ্ছেনা।

#চলবে