মনের অনুরণন পর্ব-৪+৫

0
4

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ৪

সামিয়া জানালা খুলে জানালার পাশে দাঁড়ালো। চারপাশে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে একদুটো বৃষ্টির ফোঁটা এসে আছড়ে পড়ছে সামিয়ার মুখে। সামিয়া চোখ বুজে নিলো। চোখ বুজতেই নেতামশাইয়ের গম্ভীর শ্যামবর্ণের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সামিয়া একচিলতে হাসলো। চোখ বুজেই রইলো সে।

———————–

খাওয়া শেষ করে আনিসা প্লেট গোছাতে গোছাতে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া মিসেস নীলিমা কল করেছিলো।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই আবরাহামের মুখটা লাল বর্ণ ধারন করতে লাগল। আবরাহাম হুংকার দিয়ে উঠলো,
“ওই মহিলা আবার তোকে কল করেছে। ওই মহিলাকে তো আমি..!”

আনিশা ব্যথিত কন্ঠে বলল,
“উনি তো আমাদের মা হয় ভাইয়া।”

আবরাহামের ঠৌঁটে তাচ্ছ্যিলের হাসি ফুটে উঠলো। তাচ্ছ্যিলের সুরেই বলল,
“মা এই শব্দটার অর্থ তিনি বুঝেন। জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় আনিশা।”

“কিন্তু ভাইয়া!”

আবরাহাম এবার চেঁচীয়ে বলে উঠলো,
“রুমে যাও। আমি আর কোনো কিন্তু শুনতে চাইনা। ওই মহিলার সঙ্গে তুমি আর কথা বলবেনা।”

আনিশা কান্নাভেজা চোখে একপলক তাকালো ভাইয়ের দিকে। শ্যামবর্ণের গম্ভীর চেহারা রাগে এক ভয়ংকর রূপ ধারন করেছে। আনিশা আর কিছু বলার সাহস পেল না। প্লেট নিয়ে ধীর পায়ে রুম ছেড়ে চলে গেল।

আনিশা চলে যেতেই স্টাডি রুমের ভিতরের দরজা দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল আবরাহান। বেডে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল নিজের রাগ সামলানোর জন্য। কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। রাগ কিছুতেই কমছেনা তার। রাগে গায়ের শিরা উপশিরা কাঁপছে থরথর করে। কপালের রগ গুলো ফুলে দপদপ করছে। এসি চলা সত্বেও ঘামে ভিজে যাচ্ছে সে।

আবরাহাম বুঝতে পারলো শাওয়ার না দেওয়া পর্যন্ত তার মাথা ঠান্ডা হবেনা। তাই আর কিছু না ভেবে আবরাহাম একটা টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

—————

সামিয়া চোখ খুলে বিছানার দিকে তাকালো ইয়ানা ঘুমিয়ে পড়েছে। সামিয়া মুচকি হেসে একটা মোমবাতি জ্বালালো। চার্জার লাইট বন্ধ করে রাখলো। মোমবাতিটা পড়ার টেবিলে রাখলো। কি যেন ভেবে বারান্দার দরজাটাও খুলে দিলো। বাতাস নেই এখন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। সামিয়া ডায়েরি আর কলম নিয়ে টেয়ারে পা তুলে বসলো।

মোমবাতির ক্ষীণ আলো আর টিপটিপ বৃষ্টিতে নিজের অনুভূতিগুলো গোটা গোটা অক্ষরে ডায়রির পাতায় লিখতে লাগল ষোড়শী। ঠোঁটে এক অদ্ভুত মায়াময় হাসি। যে হাসি দেই দেখুক না কেন মায়ায় পড়তে বাধ্য। কিন্তু সেই মায়ায় পড়ার মতো কেউ যে নেই। চার দেয়ালের মাঝেই বন্দি হয়ে আছে এই ষোড়শীর মায়াময় সিগ্ধতা।

———————-

আবরাহাম শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিনে নম্বরটা দেখে আবরাহাম মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো, যেন ফোনটা ধরবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। শেষমেশ ফোনটা ধরলো।

“হ্যালো?”

ওপাশ থেকে নীরবতা। কিছু বলছে না কেউ। আবরাহামের ধৈর্য্য হারানোর আগেই ওপাশ থেকে নরম কণ্ঠে একটি শব্দ ভেসে এলো।

“আবরাহাম…”

মহিলার কণ্ঠ শুনে আবরাহামের মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো। কণ্ঠটা সে খুব ভালো করেই চিনেছে। এই কণ্ঠ তাকে বহুবার দোটানায় ফেলেছে, তীব্র কষ্ট দিয়েছে।

“আপনি আবার ফোন করছেন কেন?” আবরাহামের কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ।

“তুমি কি একটু কথা বলতে পারবে? প্লিজ?” ওপাশ থেকে নীলিমার ভাঙা গলা।

“কথা বলার কিছু নেই। আপনি যা করেছেন, তার পর আর কিছু বলার থাকে না। আপনি আমার আর আনিশার জীবন থেকে মুছে গেছেন,” আবরাহাম প্রায় চাপা গলায় বলল।

“আবরাহাম, আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করো। কিন্তু আমিও তো তোমাদের মা…”

আবরাহাম ধমক দিয়ে বলল,
“মা! এই শব্দের মানে জানেন আপনি? জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না, সেটা প্রমাণ করে দেখাতে হয়!”

ফোনের ওপাশে নীলিমা আর কিছু বলতে পারলো না। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। অবশেষে, ভাঙা গলায় সে বলল,
“আমি শুধু তোমাদের ভালো থাকতে দেখতে চাই।”

আবরাহাম একরকম চিৎকার করেই বলল, “তাহলে দূরে থাকেন। আমাদের জীবন থেকে চিরতরের জন্য দূরে চলে যান!”

ফোনটা ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে দিল আবরাহাম। কপালের রগগুলো দপদপ করছে, সে আবারও বুঝতে পারছে রাগের তীব্রতা তাকে গিলে খাচ্ছে। কিন্তু এবার সে নিজেকে একটু সামলাতে পারলো। কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থেকে সে ভাবতে লাগলো—মা হিসেবে কি কখনো মাফ পাওয়া যায়?

আবরাহাম বিছানায় বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবতে লাগল। তার ভেতরে এক ধরনের ক্লান্তি চলে এসেছে। রাগ, হতাশা, এবং দুঃখ—সব মিলে যেন তাকে নিঃশেষ করে ফেলেছে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, নীলিমা কি সত্যিই তাদের জীবনে ফেরার যোগ্য? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর এত সহজ নয়।

হঠাৎ দরজায় নক হলো।

“ভাইয়া?”

আনিশার কণ্ঠ শুনে আবরাহাম ধীর গতিতে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলল। আনিশা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে কাঁটার মতো তীক্ষ্ণ কষ্টের ছাপ স্পষ্ট।

“ভাইয়া, প্লিজ রাগ কোরো না। মা… উনি শুধু আমাদের ভালো চায়।”

আবরাহাম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আনিশার দিকে। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি বুঝতে পারছো না, আনিশা। তিনি আমাদের মা নন, কেবল নামেই মা।”

“কিন্তু আমাদের কি একবারও উনার কথা ভাবা উচিত নয়? তিনি তো আমাদের ছেড়ে যাননি ইচ্ছে করে,” আনিশার কণ্ঠে আকুতি।

আবরাহাম ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
“সবকিছুর পরও তুমি কীভাবে তাকে মেনে নিতে পারো? আমি পারি না।”

আনিশা একদম নীরব হয়ে গেল। কিছু বলার সাহস হারিয়ে ফেলে ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে চলে গেল নিজের রুমের দিকে। আবরাহাম দরজাটা বন্ধ করে আবার বিছানায় বসে পড়ল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে, চিন্তা যেন স্পষ্ট হচ্ছে না। নিজেকে বেশ অসহায় মনে হচ্ছে তার কাছে। জীবনটা তো এতো জটিল না হলেও পারতো।

আনিশা নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লো দরজার সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে। একদিকে তার মা আর অন্যদিকে তার ভাইয়া। বাস্তবতার চাপে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তার। আনিশা দুহাতে মাথার সামনের চুল গুলো মুঠি করে পিছনে ঠেলে চোখ বুজে রইলো।

আবরাহাম ঠাস করে বেডে শুয়ে পরলো। দৃষ্টি তার সিলিংএ ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে। সে বেড সাইড টেবিল হাতরে সিগারেট আর লাইটার হাতে নিলো। দুঠোঁটের মাঝে সিগারেট নিয়ে টানতে লাগল।

জ্বলন্ত সিগারেটের দহনটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তার মনের গহীনের দহন কেউ দেখবেনা কেউ বুঝবেনা। আবরাহান নিজ মনে বিরবিরালো,
“নারী তুমি ছলনাময়ী। কি সুন্দর সুখ কেড়ে নিয়ে হাসো। সম্পদের লোভে সেই সুখ কেড়ে নেওয়া মানুষের কাছেই আসো।”

বেশ কান্ত লাগছে সারাদিন কাজ শেষে রাতেও শান্তি নেই। ক্লান্তিতে চোখ জোড়া বুজে এলো আবরাহামের। তলিয়ে গেল ঘুমের অতল গহ্বরে।

———————

সামিয়া ডায়েরির পাতার শেষ অংশে কলমটা নামিয়ে রেখে বাইরে তাকালো। বৃষ্টি এখনও পড়ছে, তবে মৃদু হাওয়ায় একটু ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। চারপাশে নিরবতা, শুধু বৃষ্টির টিপটিপ শব্দ।

মনের গভীরে জমে থাকা কথাগুলো লিখে ফেলার পর, যেন সামিয়ার বুকের ভেতর এক ধরনের হালকা ভাব এসেছে। নিজের মনকে আরও একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো সে। এরপর ডায়েরির পাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। ইয়ানা তখনও ঘুমোচ্ছে। বারান্দায় গিয়ে সামিয়া বাতাসে চোখ মুদলো, যেন প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।

হয়তো এই নীরবতার মধ্যেই উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে।

সামিয়া বেশকিছুক্ষণপর রুমে চলে এলো। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো। চোখের চশমা বেড সাইড টেবিলে রেখে চোখ বুজলো। কাল শুক্রবার বলে নিশ্চিন্তে ঘুম দিলো সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে।

#চলবে

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ৫

সকালের তীক্ষ্ম রোদের ঝলক চোখে পড়তেই আবরাহামের মুখ কুচকে এলো। ঘুমটা তখনও ভাঙেনি পুরোপুরি, তাই সে মুখের উপর কম্বলটা টেনে দিয়ে জোর করে চোখ বুজে রাখলো। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রেদোয়ানের তীক্ষ্ম কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“স্যার, অফিসে কখন আসবেন?”

আবরাহাম খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, বেশ দেরি হয়ে গেছে।

আবরাহাম গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে মাথার নিচ থেকে বালিশটা সরিয়ে একপাশে ছুঁড়ে ফেলল। বিরক্তি নিয়ে বলল,
“রেদোয়ান, এত সকালে ফোন করার প্রয়োজন কি ছিল? আর স্যার বলা লাগবেনা কয় বার বলবো তোকে।”

ওপাশ থেকে রেদোয়ান কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। জরুরি একটা মিটিং ছিল, তুই তো তো জানিসই। সবাই অপেক্ষা করছে।”

আবরাহাম চোখ বন্ধ করেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকের সকালটা শান্তিতে কাটানোর পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু কি আর করার।

“ঠিক আছে, আমি আসছি,”

বলে ফোনটা রেখে বিছানা থেকে উঠতে গেল, কিন্তু তার মাথায় আবারও সেই অদ্ভুত বেদনা এসে হানা দিল। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে, মাথায় হাত দিয়ে।

“এভাবে আর কতদিন চলবে?”

নিজের মনেই বিড়বিড় করল আবরাহাম, যেন নিজের সাথে নিজেই কথোপকথন করছে।

আবরাহাম কিছুক্ষণ মাথা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথার যন্ত্রণা এখন প্রায় নিয়মিত সঙ্গী হয়ে উঠেছে, যা তাকে অস্থির করে তুলছে। ক্লান্ত চোখে সে একবার জানালার দিকে তাকালো। বাইরে তীব্র রোদ, শহর যেন ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা।

নিজের চিন্তাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে সে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো। মৃদু পানির ঝাপটায় মুখ ধুয়ে একটুখানি সতেজ বোধ করল, কিন্তু ভেতরের ভারী অনুভূতিটা তেমন কমল না।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ক্লান্ত মুখটা একবার দেখল আবরাহাম। সেই একই প্রতিচ্ছবি—ঘুমহীন চোখ, চিন্তিত মুখভঙ্গি। নিজেকে সামলে দ্রুত পোশাক পরতে শুরু করল।

মিটিংয়ের চিন্তা মাথায় ঢুকে গেলেও আবরাহাম জানে, এই চাপ শুধু বাইরের নয়। কিছু একটা গভীরভাবে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, যেটা সে এখনো স্পষ্ট করে ধরতে পারছে না।

অফিসে পৌঁছানোর পর রেদোয়ান আবরাহামের কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“তোর নামে চিঠি এসেছে।”

আবরাহাম একটা ক্ষীণ শ্বাস ফেলে ধীর কন্ঠে বলল,
“এই নিয়ে মোট কয়টা হলো!”

রেদোয়ান কিছুসময় ভেবে বলল,
“আজকেরটা নিয়ে বিশটা।”

আবরাহাম ব্যস্ত ভঙ্গিতে মিটিং রুমের দিকে যেতে বলল,
“আমার গাড়িতে রেখে দিস।”

———————

সামিয়ার ঘুম ভাঙলো সকাল নটায়। বিছানা হাতরে দেখলো ইয়ানা নেই। স্কুল চলে গেছে হয়তো। সামিয়া বেড সাইড থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে পড়ে নিলো। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো কড়া রোদ উঠছে। সামিয়া উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রুমটা ঝটমট গুছিয়ে নিলো। জানালার পর্দা সরাতেই রোদের আলোগুলো হুড়মূ্ড়িয়ে রুমে প্রবেশ করলো। সামিয়া আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখমুখে এখনো ঘুমের ছাপ স্পষ্ট। সামিয়া সযত্নে নিজের চুলগুলো ঠিকঠাক করে রুম থেকে বেড়িয়ে পরলো। আয়েশা বেগম সোফায় বসে চা খাচ্ছিলেন। একটু আগেই ইকবাল সাহেব আর দুই বাচ্চাকে খাইয়ে তাদের নিজ নিজ স্থানে পাঠিয়েছেন। ইয়ানা আর ইহসান দুইজন একসঙ্গেই স্কুলে যায়।

সামিয়াকে রুম থেকে বের হতে দেখে আয়েশা বেগম মুচকি হেসে বললেন,
“ঘুম হয়েছে তোর!”

সামিয়া মায়ের হাসির জবাবে হালকা হাসল। ঘুমটা পুরোপুরি হয়নি, তবে কিছুটা বিশ্রাম পেয়েছে। সে মা’র পাশে বসে বলল,
“হ্যাঁ মা, একটু বড্ড বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছি আজ। ইয়ানা আর ইহসান ঠিকঠাক স্কুলে গেল তো?”

আয়েশা বেগম এক চুমুক চা খেয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ওরা ঠিকঠাক গেছে। ইকবালও অফিসে চলে গেলো। তা আজ কি কি করবি?”

সামিয়া কিছুটা উদাসীন ভাবে বলল,
“দেখি মা, কাজ আছে কিছু। প্রথমেই তো বাংলা পরীক্ষা তাই ভাবছি আজ থেকে পড়া শুরু করবো।”

আয়েশা বেগম মাথা নাড়লেন। “খুব চাপ নিচ্ছিস মনে হচ্ছে। আর টেনশন নিস না তুই পারবি সব।”

সামিয়র দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালেন আয়লা বেগম, যেন কিছু একটা বুঝতে চাইছেন।

সামিয়া হেসে কথাটা এড়িয়ে গেল। নরম সুরে বলল,
“চা নিয়ে আসি তোমার সাথে বসে খাব,”

বলেই কিচেনের দিকে পা বাড়াল।

কিচেনে ঢুকে সামিয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আয়েশা বেগম উঁচু গলায় বলে উঠলেন,
“টেবিলে তোর নাস্তা রেখেছি ওটাও নিয়ে আয়।”

সামিয়া মায়ের কথামতো সব কিছু নিয়ে মায়ের কাছে এসে বসলো।

আয়েশা বেগম টিভিতে খবর দেখছিলেন। ঘড়িতে দশটা ছুঁই ছুঁই। খবরের শুরুতেই আবারাহামকে দেখাচ্ছে। আবরাহামের কন্ঠ শুনে মাথা তুলে তাকালো সামিয়া।

আবরাহামের সংবাদ কক্ষে কথা বলার ধরন, তার গম্ভীর মুখাবয়ব—সবই সামিয়ার মনে একটি অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করল। সে সেদিকে তাকিয়ে রইলো, যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলছে তাকে। আবরাহাম কি বলছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। হুট করেই সামিয়া খেয়াল করলো আবরাহামের মলিন হওয়া মুখটা। চোখগুলোও কেমন লাল হয়ে আছে।

সামিয়ার হৃদয়ে এক অজানা উদ্বেগ নাড়া দিতে লাগলো। আবরাহামের মুখে যে উদ্বেগের ছাপ দেখা যাচ্ছে, সেটি তার চোখের সামনে যেন অদৃশ্য একটি বন্ধন তৈরি করছে। মনে মনে সে ভাবতে লাগলো,
“কী এমন ঘটছে তার জীবনে?”

টিভির পর্দায় আবরাহাম বলছিলো,
“আমরা একটি নতুন প্রকল্পের দিকে এগোচ্ছি, তবে কিছু সমস্যা সামনে এসেছে। আমাদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।”

সামিয়া বুঝতে পারলো, আবরাহাম তার কাজে ব্যস্ত, কিন্তু তার উদ্বেগ তার মধ্যে নতুন কিছু প্রতিফলিত করছে। সে খুব গভীরভাবে অনুভব করছিল, যে কিছু একটা তাকে টানছে, তাকে আবার আবরাহামের কাছাকাছি নিয়ে আসছে।

—————-

আনিসা ভার্সিটি থেকে আসার পর থেকে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলো। বারবার সদর দরজা দিয়ে দেখলো। শেষে আবরাহাম ফিরেছে রাতে। টুকিটাকি কথা বলে খাওয়া শেষ করলো তারা। আনিশার আগের রাতে ঘুম না হওয়ায় সে দ্রুত ঘুমাতে গেল।

আবরাহাম ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ঢুকল। দিনের সমস্ত ঘটনাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। রুমের ভিতর ঢুকেই সে জানালার দিকে তাকালো। বাইরে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে, আবরাহাম চুপচাপ বিছানায় বসে পড়ল। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু চুপচাপ লাগছিল, কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন এক অদ্ভুত অশান্তি বিরাজ করছে।

রাতের নীরবতায় আবরাহামের মাথার যন্ত্রণা আবারও ফিরে এলো। তার চারপাশের পরিবেশ শান্ত হলেও, মনে হচ্ছিল তার নিজের ভেতর একটা যুদ্ধ চলছে। আনিসার দিকে তাকিয়ে আবরাহাম নিজের ভেতরের যন্ত্রণা লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু তার ক্লান্ত চোখ যেন সেই লুকানো অস্থিরতা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হলো।

রাত গভীর হচ্ছে, কিন্তু আবরাহাম জানে, আজও তার ঘুম আসবে না। হুট করেই আবরাহামের চিঠির কথা মনে হলো। চিঠিগুলো গাড়িতেই রেখে এসেছে। মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটে উঠলো তার। ধীর পায়ে রুম ছেড়ে করিডোর পেড়িয়ে পাকিং এড়িয়াতে গিয়ে গাড়ি থেকে সবগুলো চিঠি নিয়ে আবারো রুমে ফিরে এলো সে।

ভ্রুকুচকে চিঠিগুলো বিছানায় ছড়িয়ে বিছানায় পা উঠিয়ে বসে সে দেখছে চিঠিগুলো। বেছে বেছে কালকের চিঠিটা হাতে তুলে নিলো। চিঠি খুলে পড়তে লাগল,

**প্রিয় নেতামশাই,

আপনি কি হ্যাঁ! আজকেরটা নিয়ে বিশটা টিঠি আপনাকে লেখছি আমি। একটারো কি উত্তর দিতে মন চায় না আপনার। দেখুন আপনার এমন আচরণ জনগণ মেনে নিবে না। আপনাকে কষ্ট করে ভোট দিয়েছি। যদিও আমি ভোটার না। তাতে কি আমার বাপ মা চৌদ্দগুষ্টি আপনাকে ভোট দিয়েছে। তাই তো আপনি পদ পেয়েছেন। এখন আমার মতো নান্নামুন্না মেয়েটার চিঠি আপনি এভাবে ইগনোর করছেন। এটা কিন্তু মটেও ঠিক হচ্ছেনা।

যাইহোক তা বলেন তো আপনি কি ! এতো রাগী রাগী মুখ করে রাখেন সবসময়। একি মুডে থাকতে আপনার মুখ ব্যথা হয়ে যায় না। যদি আপনাকে এমন রূপে খারাপ লাগেনা। তবুও একটু হাসবেন। হাসলে হৃদপিন্ড ভালো থাকে।

আর আপনি আমার চিঠির উত্তর দিবেন বলে দিলাম। একটা চিঠি দিলে কি হয়! আপনার চিঠির জন্য আমি কত অপেক্ষা করি আপনি জানেন।

আপনি যদি সত্যিই আমার চিঠির উত্তর দেন, তাহলে আমি বুঝব যে আপনি শুধু নেতা না, একজন মানুষও। বুঝলেন আমার কুচুপু নেতামশাই।

ইতি,
তোমার গোপন ভক্ত,
ছায়াবীথির পথিক**

#চলবে