মনের কোণে পর্ব-১২+১৩

0
281

মনের কোণে🥀
#পর্ব_১২
আফনান লারা
.
‘ছোকরা কিছু বলবে?ওমন চেয়ে আছো কি জন্যি?’

নাবিল চুপ করে শুধু দেখছে লোকটাকে।অফার চেয়ে বসবে নাকি বসবেনা সেটার অংক কষাকষি করছিল মনে মনে।লোকটা ঠিক বুঝে গেলো।বাম পাশের খালি সিটটাতে পা তুলে বসে বললো,’বুঝলাম সবই।চোখের ভাষা একটু আকটু জানা আছে,আদিমকালে আমার বাপ দাদা জৌতিষী করতেন।আমি তাদের থেকে কিঞ্চিত ক্ষমতা লাভ করে এই যুগে এসে প্রকাশ করতে পারি।
তবে চোখের ভাষা বলছে তোমাদের নকল রেজিস্ট্রি লাগবে কিন্তু তার কারণ যে আমায় খোলসা করে বলতে হবে,তা নাহলে আমি বাপু এইসবে নামবোনা’

নাবিল লিখির দিকে ফিরে বললো,’কি বলো?’

লিখি চটে গেলো।রেগে মেগে বললো,’নকল নাহয় বাহিরের মানুষ জানবেনা,কিন্তু আমরা তো জানি।এভাবে অবিবাহিত হয়ে দিনের পর দিন একই ঘরে থাকা খাটে??আপনি নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন’

‘দেখ মা!দা বটি সবার ঘরেই আছে,তাই বলে কি সবাই ডাকাত?তুমি যদি শুদ্ধ হও,তোমার মন যদি শুদ্ধ হয় এই ছেলে যদি ভাল হয় তবে এক ঘরে থেকেও তোমরা একে অপরকে স্পর্শ ও করবেনা।আমি যতদূর জানি আর কি।এই জামানাতে তো একজন আরেকজনের পাশে বসলেও আকর্ষণ সৃষ্টি হয় একে অপরের প্রতি।তোমাদের জীবন,তোমাদের সিদ্ধান্ত আমি শুধু আগাই দিব ব্যস”

লিখি চোখ কঠিন করে নাবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।
এই নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি দুজনের মাঝে।ঐ লোকটা উঠে একটা স্টেশনে নেমেও গেছিল।ঢাকা আসতে আসতে রাত বারোটা বেজে গেছে।
যেন রাত বারোটার সাথে তাদের ভাল সম্পর্ক।বেছে বেছে এই সময়টাতেই তাদের পথে উপস্থিত হতে হবে।
লিখি একাই হোস্টেলে ফিরে এসেছে।গেট দিয়ে ঢুকবে এমন সময় দারোয়ানের ডাক শুনে পিছু হটলো।

‘মা তুমি যাইওনা,তোমারে সবাই মিলে খুঁজতেছে।মনে হয় তোমার পরিবারের কেউ এসেছে দলবল নিয়ে, তোমাকে পেলে নিয়ে যাবে’

লিখির ভয় হলো।মনে পড়ে গেলো দেড় বছর আগের ঘটনাটার কথা।
সদ্য অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছিল সে।বাবার সবসময় লোভ থাকতো টাকাপয়সার প্রতি,তিনি চাইতেন তার একমাত্র মেয়ের জন্য কোটিপতি এক ছেলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসবে।কিন্তু ছেলে সুন্দর হলে ঐ ছেলের ইনকাম সুন্দর হয়না।
একদিন এমন একটা ছেলে পেলেন যে সুন্দর আছে,টাকা পয়সা আছে কিন্তু বয়স কিঞ্চিত বেশি।ছেলেকে দেখার পর লিখি মানা করে দিয়েছে সাথে সাথে।কিন্তু বাবা তার কথার তোয়াক্কা না করে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিলেন।শুধু তাই নয়!পরেরদিন কাবিন করার ঘোষণাও দিলেন।পুরো বাড়ির মানুষ ব্যস্ত হয়ে গেলো আয়োজনে।
লিখির হাতে বারো ঘন্টা ছিল।একা থাকার অভ্যাস তার কখনও ছিলনা কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার,নিজের জীবন বাঁচাতে হলে তাকে এই জায়গা ছাড়তে হতো।
নিজের জামাকাপড় ব্যাগ ভর্তি করে নিজের গলার স্বর্নের চেইনটা নিয়ে সে বেরিয়ে এসেছিল “মহসিন ভিলা” থেকে।আর পেছনে ফিরে তাকায়নি।রাতের অন্ধকারে ঢাকার বাসে উঠে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।ভেবেছে এটাই শেষ দুঃখের।কিন্তু নাহ!
কয়েকটা মাস গেলেই এই দূর্গম অতীত হানা দেয়।কেড়ে নিতে চায় সকল সুখকে।যেমনটা আজ হলো।আজ বেশি হচ্ছে।কেমন করে যেন তারা যেন গেলো এই গার্লস হোস্টেলের কথা!
দারোয়ানের কথায় পিছিয়ে গেলো সে।যতদূর পেছানে যায় ততদূর।কোথায় যাবে!অন্য হোস্টেলে ঢুকতে হলে তো আবারও কাগজপত্র লাগবে।এই হোস্টেলে নাহয় হেনার বাবা -মা সাহায্য করেছিলেন।কিন্তু অন্য হোস্টেলে কে সাহায্য করবে?


নাবিলের ও এলই পরিণতি।ছাত্রাবাসের ধারের কাছেও যেতে পারেনি।সয়ং বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন গেটের বাহিরে।তিনি আজ ওকে নিয়েই ছাড়বেন।
নাবিল ও সরে আসলো।চন্দ্রাহাট দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলো লিখিকে আর ঐ মহিলাকে।লিখি তার কাছে মিনতি করছিল থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার।

‘দেখো মেয়ে!আমি নিজেই থাকি কুঁড়েঘরে।আমার আবার পাঁচটা পোলাপান।তোমায় কি করে রাখবো ওদের মাঝে?সবগুলো জোয়ান পোলা আমার।চেয়েও তো রাখতে পারবোনা।কি করি?’

লিখি চুপ করে আছে।নাবিল পাশে এসে দাঁড়ালো তখন।ওকে দেখে লিখি নিজের চোখের পানি লুকাতে অন্যদিকে ফিরে মুছে ফেললো।
নাবিল বুঝতে পেরেছে ও কাঁদছে।

ফোন বের করে একটু দূরে সরে এসে মাকে কল করলো সে।

‘কিরে নাবিল?ঠিক আছিস বাবু??তোর বাবা তো নাকি আজ ছাত্রাবাস থেকে ফিরবেইনা,খেয়েছিস কিছু?’

‘মা একটা ঘটনা বলছি তোমায়।আমায় শুধু সমাধান দেবে?’

‘কিসের ঘটনা?’

‘ধরো,একটা ছেলে যে পরিস্থিতিতে পড়েছে একই স্থানে একটা মেয়ে ও একই পরিস্থিতিতে পড়েছে।ছেলেটার সাথে মেয়েটার কদিনের পরিচয় হয়।তারপর দুজনে আবার আলাদা।এখন এমন একটা পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ালো যে তাদের দম ফেলাও দায়ের।এই সময়ে তাদের একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন নিজেকে সমাজের থেকে আলাদা রাখতে।লুকিয়ে রাখতে।
জানোই তো অবিবাহিত ছেলে মেয়ে একসাথে থাকা অন্যায়।তবে কি করা উচিত তাদের?’

‘এটা কার কাহিনী?’

‘আমার চেনা একজনের।তুমি শুধু বুদ্ধি দাও’

‘কদিনের পরিচয়ে কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ত ঠিকনা।যদি আশ্রয়ের একান্তই দরকার পড়ে তবে আমি প্রিপার করবো ওদের বিয়ে করে নেওয়া উচিত,লিগালি।
এরপর তারা একসাথে থাকলেও সেটা অন্যায় হবেনা যেহেতু তারা পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতিতে পড়ে অন্যায় কাজ না করে যদি হালালটা করে হবে আই থিংক সেটাই বেটার।’

নাবিল ফোন রেখে দিলো।মা হয়ত সত্যি ধরে নিয়েছে কাহিনীটা ওর না।যদি ওর হতো এবং মা সেটা বিশ্বাস করত তবে কখনওই এই উপদেশ দিতেননা।
‘লিখিকে লিগালি বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।আমি কোনো জব করিনা,আমার ক্যারিয়ার গড়িনি।ইভেন ওকে আমার স্ত্রী হিসেবে পছন্দ ও না।কিন্তু এভাবে ওকে রেখে আমি নিজের ব্যবস্থা করতে যাব সেই মনমানসিকতাটুকু ও তো আমার নেই।আসছেনা’

মন খারাপ করে নাবিল পকেটে ফোনটা ঢুকাতে গিয়ে দেখলো সেই লোকটার কার্ড।এই মানুষটা ছাড়া আর কেউ সাহায্য করতে পারবেনা যা বোঝা যাচ্ছে।লিখি মন খারাপ করে হাঁটা শুরু করেছিল,নাবিল পেছনে তাকিয়ে ওকে অনেকদূরে দেখলো।দেরি না করে ফোন কানে ধরে ছুটে গেলো ওর কাছে।

‘লিখি ওয়েট’

‘কি?’

‘হ্যালো আঙ্কেল।আমি নাবিল’

‘কেঠা তুমি?কোন বিল?’

‘আমি ঐ যে বাসে কথা বলেছিলাম,কার্ড দিয়েছিলেন।আমাকে রেজিস্ট্রি করার কথা বলেছিলেন,পরে পাশের জন মানা করলো’

‘ওহ হ্যাঁ।মনে পড়েছে।হঠাৎ এত রাতে?’

‘লাগবে’

‘ঐ মেয়ের মত আছে তো?’

‘ওর মতকে ওর বাবা গুরত্ব দেয়নি বলে পালিয়ে এতদূর এসেছে। আমওপ ওর মতকে গুরুত্ব দিব না, কিন্তু আমার থেকে পালাতে পারবেনা এটা সিওর।আপনি কাল একবার দেখা করতে পারবেন?আপনার অফিসের লোকেশান বলেন।আমরা আসবো’

‘ওরকম অফিস থাকলে আমি এতদিনে জেলে থাকতাম।আমি তোমাদের একটা জায়গার নাম বলবো, ওখানে আসবে।কাজটা আমি করবোনা, আমার কর্মচারী করবে।নিজেদের জন্মনিবন্ধন কার্ড,আইডি কার্ড এসব নিয়ে আসবে।আর বাবা মায়ের গুলা সব ফেক বসিয়ে দেবো সমস্যা নাই।এখন রাখছি, আমি বেশিক্ষণ কারোর সাথে কথা বলিনা’

নাবিল ফোন রাখতেই দেখলো লিখি রেগে মেগে গাল ফুলিয়ে রেখেছে।

‘কি করতেছেন কি আপনি?আপনাকে বলছিনা, আমি মিথ্যে সম্পর্কে জড়াবো না?’

‘তবে থাকো এই পথে।আমি যাচ্ছি’

নাবিল সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে।লিখি অনেকক্ষণ ধরে ওর চলে যাওয়া দেখলো,এরপর হঠাৎ কি মনে করে ছুটে গেলো ওর কাছে।তারপর বললো,’ঠিক আছে আমি রাজি’

নাবিল নিচের ঠোঁট উল্টে বললো,’তাও আজকের রাতটা সএই ফুটপাতেই কাটাতে হবে।থাকার জায়গা থেকেও নেই,পাহারাদারে ভর্তি।
রাতটা কোনোমতে দুজনে কাটিয়ে নিলো।সকাল হতেই কিছুটা তড়িগড়ি করেই দুজনে পৌঁছে গেলো সেই জায়গায় যে জায়গাতে ঐ লোক আসতে বলেছিল।
একটা পরিত্যাক্ত কারখানাতে।অথচ ভেতরে একটা অফিসের মতন করে রাখা।বাহিরে থেকে বোঝা যাবেনা ভেতরে কি তৈরি হয়ে আছে।ভেতরে সাজানো অফিস,কম্পিউটার, দলিল দস্তাবেজ। লোকজনে ভর্তি।কিন্তু ঐ লোকটা তো বলেছিল তার কোনো অফিস নেই।তবে কি যেখানে- সেখানে এমন অফিস করে তুলতে পারে?আজব একটা লোক।দেখে মনে হয় অফিসিয়াল’

নানারকম ভাবনা চিন্তা মাথায় নিয়ে ভেতরে ঢুকে দুজনে চেয়ার টেনে বসলো।যে কাজ করবে সে আসতে দেরি করছিল।আধ ঘন্টা পর অবশেষে তারও দেখা মিললো।সাদা পোশাক পরা ছেলেটি দ্রুত হেঁটে এসে চেয়ারে বসেই ওদের হাত থেকে কাগজ গুলা কেড়ে নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ে নিলো।এরপর কম্পিউটারে টাইপ করে ওদের সামনে মোটা পৃষ্ঠার একটা বই এগিয়ে দিয়ে বললো সই করতে।
এরপর আবার ওদের দুজনের জন্মনিবন্ধনের কাগজ দেখে ছেলেটা টপাটপ আবারও টাইপ করে নিলো।বাহিরে থেকে দুই জোড়া কাপল এসে হাজির ওদের পাশে।এরাও বিয়ে করতে এসেছে।কিন্তু তাদের এখন আসার কারণ হলো তারা স্বাক্ষী হিসেবে সই দিবে।
লিখির মনে সংশয় বাসা বেঁধে ছিল তাও সেই সংশয়কে দূরে ঠেলে সই করলো সে।নাবিল ও সই করলো।একে একে সেই কাপলরাও স্বাক্ষী হিসেবে সই করলো।
পেছন থেকে হঠাৎ শোনা গেলো ঐ লোকটার গলার আওয়াজ।তিনি হাতে ফুলের মালা নিয়ে এসে ওদের দুজনের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন,’বিবাহের জন্য শুভকামনা’

‘আপনি এমন ভাব করছেন যেন সত্যি সত্যি’

লিখির কথা শুনে লোকটা খিলখিল করে হেসে দিলো।হাসতে হাসতে চেয়ার টেনে বসে ইশারা করলো বাকি কাপলদের।তারা বাহিরে চলে গেছে তার ইশারা দেখে।

‘আমি একজন সমাজসেবক।এছাড়াও আমার পরিচয় হলো আমি একজন উকিল।আমি সমাজের একটা বিশেষ উন্নয়নের অংশীদার হতে চাই বলে একটা পরিকল্পনা করে ফান্ড তৈরি করেছি।এতে কাজ করে আমার পঞ্চাশ জন কর্মচারী। আমরা শুরুতে বলি নকল রেজিস্ট্রি। আসলে কিন্তু সেটা নয়।তোমাদের মতন কিছু যুবক- যুবতীরা সমাজে অন্যায় ফলানোর জন্য নকল রেজিস্ট্রি করে সংসার করে,একসাথে বসবাস করে।তোমাদের পাপ থেকে দূরে রাখতে আমার এই পরিকল্পনা।তোমরা ভাবলে নকল বিয়ে অথচ তোমরা কি জানো আজ তোমাদের রেজিস্টার করে লিগালি বিয়ে হয়ে গেছে??
আজ থেকে তোমরা নকল না,সত্যিকারের স্বামী -স্ত্রী। এই জন্য প্রবাদ আছে—
সই করার আগে ভেবো
সই করার পর কেঁদোনা।
তোমাদের হাল হলো সেরকম।তবে আমার সৎ কাজের বোঝা বাড়লো।তোমাদের ইল-লিগাল থেকে লিগালে নিয়ে আসলাম’

লিখির মাথায় যেন বা*জ পড়েছে।মাথয় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে গেছে সে।
চলবে♥

মনের কোণে🥀
#পর্ব_১৩
আফনান লারা
.
নাবিল লোকটার জামার কলার টেনে ধরে বললো,’কি বললেন?আপনি কি আমাদের সাথে মশকরা করছেন?যদি তাই হয় তবে আগেই স্বীকার করে নেন নাহলে আমার রাগ ঝাড়তে বেশি সময় নষ্ট করবোনা ‘

লোকটা হেসে নিজের কলার থেকে নাবিলের হাত সরিয়ে বললেন,’মশকরা তো তোমরা করো,বিয়ে নিয়ে।বিয়ের মতন একটা পবিত্র বন্ধনকে তোমরা নকল রেজিস্ট্রি পেপার দ্বারা আটকে রাখতে চাও।আমি তো তোমাদের সম্পর্কটাকে বৈধ করে দিয়েছি মাত্র’

নাবিলের প্রচণ্ড রাগ হলো।এই মূহুর্তে নিজের উপর বেশি রাগ হচ্ছে তার।এখানে লিখির দোষ নেই।তার নিজের জোরাজুরিতেই তো সে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে।লোকটা যে এমন ঘোল খাওয়াবে এটা কে বা জানতো!

লিখি মাথায় হাত রেখে চুপ করে আছে তখন থেকে।বাস্তবের এই কড়া সত্যটাকে তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
সে এটা চায়নি।যাকে চেনে না, জানেনা তাকে বিয়ে করার ভয়ে বাসা থেকে পালিয়েছিল অথচ আজ এমন একজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো যাকে সে ভালমতন চেনেই না এখনও।নিয়তিতে তবে এটাই লেখা ছিল?

নাবিল ওকে চুপ থাকতে দেখে নিজেও পাশে চেয়ার টেনে বসে গেছে।ঐ লোকটা দু কাপ চা পাঠিয়েছে তাদের দুজনের জন্য।নাবিল রেগেমেগে চায়ের কাপ উল্টে ফেলে দিয়েছে।কিন্তু লিখি ফালায়নি,সে কাপ নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়েছে বরং।এত বেশি প্রেশারের কারণে তার মাথা ব্যাথা বেড়ে গিয়েছিল,আসলেই এখন চায়ের প্রয়োজন ছিল ভীষণ।

দুজনে ঐ অফিস থেকে বেরিয়ে শূন্য রাস্তায় মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে ।নাবিল অসহায়ের মতন চেয়ে রইলো লিখির দিকে।ও তখন থেকে কোনো সাড়া দিচ্ছেনা বলে নাবিল বললো,’লিখি আই এম সরি।এটার জন্য আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না, তুমি আমায় অন্তত বোঝো।আমি জানলে কখনওই এটা হতে দিতাম না।সম্পূর্ণ আমাদের অজান্তে ঘটে গেলো বিষয়টা। আমায় ক্ষমা করে দাও লিখি।আমার জন্য তোমার লাইফটা….’

লিখি গাল ফুলিয়ে চিৎকার করে বললো,’হয়েছে এবার শান্তি?চলুন এখন।এবার তো বাড়িওয়ালা নেচে নেচে আপনাকে ভাঁড়া দিয়ে দিবে।সামান্য বাসা ভাড়ার জন্য দুইজনের লাইফ চেঞ্জ করে দিয়েছেন।এই বিয়ের ভয়ে আমি এতদূর অবধি আসলাম অথচ এখানেই আমার বিয়েটা হয়ে গেলো তাও কাগজে-কাগজে। অস্বীকার যে করবো তারও উপায় নেই কোথাও।একেই বলে-“আকাশ থেকে পড়ে খেজুর গাছে আটকানো”

‘লিখি তুমি তো সব নিজের চোখেই দেখেছো।আমি কি আগে থেকে জানতাম?তোমার কি ধারণা আমি ওদের সাথে যুক্ত?’

‘এখন এসব বলে কি লাভ?তাতে বিয়েটা বাতিল হয়ে যাবে?যাবে না তো!তবে সাফাই দিয়ে কি লাভ হচ্ছে?’

নাবিল চুপ করে গেলো।লিখিকে এখন কোনো কথা ছোঁয়ানো যাচ্ছেনা।প্রচণ্ড রেগে আছে তা বোঝা যাচ্ছে।আপাতত চুপ থাকাই শ্রেয়।
স্টেশন থেকে চুপচাপ বাসে উঠলো দুজন।এখান থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।নরসিংদীর কাছাকাছি জায়গা।নাবিল ঠিক করেছে অন্য এরিয়াতে বাসা ভাঁড়া নেবে।
এত বড় কথা মাকে জানানো জরুরি বলে ফোন নিলো নাবিল।তখনই লিখি আঙ্গুল তুলে বললো,’খবরদার যদি কাউকে বিয়ের কথা জানিয়েছেন তো!কাউকে জানাবেননা,এই বিয়ে মানার মতন না।আমি মানিনা এবং আমি চাইনা এটা তৃতীয় কেউ জানুক।আগে আমার ক্যারিয়ার তারপর সব যা হবার হবে’

‘রেজিস্ট্রি করা বিয়ে তোমার কাছে না মানার মতন??’

লিখি ঘুরে বসে বললো ‘তো কি চান বৌভাতের জন্য সেজে তৈরি হয়ে নিব?’

‘না,তা বলিনি’

‘সেটাই তো বুঝাচ্ছেন কথা দিয়ে।আপনার কি ধারণা?আপনার মাকে যখন বলবেন- মা আমি তো বিয়ে করে নিয়েছি তখন আপনার মা চুপচাপ বলবে- ও তাই!!বলবে এখন মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসো।আমরা অনুষ্ঠান করে আত্নীয় স্বজন খাওয়াবো’

‘সেটাও কথা,বাবা জানলে তো সর্বনাশের মাথায় বাড়ি পড়বে’

‘তো?এগুলা কমন সেন্স।আপনি কোন সাহসে এই খবর আপনার মাকে দিতে যাচ্ছিলেন?বিয়ে হয়েছে নাকি হয়নাই এখনও ঐ ঘোর থেকে বের হতে পারিনি আমি আর উনি মাঝ দিয়ে বিবিসির খবর জানাতে কল করতে যাচ্ছিলেন’

‘ওকে সরি’
—–
হাতিরঝিলে এসে নেমেছে তারা দুজন।এখানে বাসা ভাড়া করে থাকবে।নাবিল কল করে তার মামাকে ডেকে এনেছে।মামার বাসা হাতিরঝিলেই।মামাকে প্রথমে লিখির ব্যাপারে সবটা বলে শেষে বলে দিয়েছে কথাটা যেন গোপন রাখে।ইভেন মা ও যেন না জানে।মামা প্রথমে রাগারাগি করেছেন এভাবে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করায়,পরে মেনে নিয়েছেন।ওদের দুজনকে তিনি তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন কিন্তু নাবিল রাজি হয়নি।বাবা যদি আন্দাজ করে মামার বাড়িতে খুঁজতে এসে ওকে পেয়ে যান তবে মহাবিপদ। তাই মামাকে সাথে নিয়ে আশেপাশের একটা খালি ফ্ল্যাট আছে এমন বাসায় এসে উপস্থিত হলো তারা।
তবে ভাড়া বেশি।গুনে গুনে চৌদ্দ হাজার।বেড তিনটে,ডাইনিং,সোফার রুম, রান্নাঘর,বেলকনি ২টা।
আপাতত এটাই সোনায় সোহাগা মনে করে নাবিল রাজি হয়ে গেছে।মামা দস্তখত করে ওদের সব ওকে করে দিয়েছেন,শুধু তাই নয় আজকের রাতটা ওদের মামার বাসায় থাকার কথাও বলে গেছেন।কিন্তু নাবিল রাজি হলোনা।তার মতে বাবা যেকোনো সময় এসে যেতে পারে।
শেষমেষ অন্তত ডিনারটা খেয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করালেন তিনি।
—–
মামা চলে যাবার পর খালি বাসায় পা রেখেছে দুজনে।লিখির শুরু থেকেই মন খারাপ ছিল।এখনও মন খারাপের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে সে একটা রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।নাবিল জুনায়েদকে ফোন করে ছাত্রাবাসের অবস্থা জানতে চাইলো।জুনায়েদ বললো বাবা নাকি যাবার সময় লোক রেখে গেছেন।কড়া পাহারা দিচ্ছে তারা।ফোন রেখে নাবিল এবার ফ্রেশ হতে গেলো।
গায়ে ঝর্নার পানি ঝরে ভিজে একাকার হয়ে যাবার পর তার মনে পড়লো তোয়ালে,নতুন জামা কিছুই নেই সাথে।সঙ্গে সঙ্গে ঝর্না বন্ধ করে দূরে সরে গেছে সে।কি ঝামেলা!এখন কি হবে!
বাধ্য হয়ে ভেজা গায়ে বের হলো সে।লিখির কাছেও তো তোয়ালে থাকার কথানা।এই ভেজা শরীর নিয়ে কতকাল থাকতে হবে?
কলিংবেল বাজছে,শোনা গেলো।গায়ের শার্টটা খুলে ফ্লোরে রেখে নাবিল গেলো দরজা খুলতে।বাড়িওয়ালার মেয়ে ইমু এসেছে হাতে নাস্তা নিয়ে।নাবিলকে এমন হালে দেখে সে হাত থেকে ট্রে টাই ফেলে দিলো।আওয়াজ শুনে লিখি দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখলো নাবিল উদম গায়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ঐ মেয়েটা হা করে ওকে দেখছে শুধু।লিখি এগিয়ে এসে বললো,’কি হচ্ছে এখানে?’

‘আসলে আমার জামাকাপড় তো নেই,ভুলে শাওয়ারের নিচে চলে গেছি তাই এমন হাল হলো আমার’

লিখি যেন নাবিলের কথাই শোনেনি।মেয়েটার দিকে চেয়ে বললো,’আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি’

‘আমি তো নাস্তা দিতে এলাম।হঠাৎ ওনাকে এই অবস্থায় দেখে বেসামাল হয়ে ট্রে পড়ে গেছে হাত থেকে’

লিখি ঠাস করে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো।
নাবিল ব্রু গুটিয়ে বললো,’এটা কেমন ব্যবহার!মেয়েটা কি ভাববে?’

‘ ক্রাশ খেলে হাত থেকে ট্রে পড়ে,ভয় পেলে পড়েনা।আমি বাবুসোনা না যে সোজা কথা বুঝিনা’

নাবিল নিজের বুক থেকে পানি মুছে বললো,’তো তুমি কি জেলাস হচ্ছো?’

‘মোটেও না,আপনার ইচ্ছা জাগে তো ভেগে যান বাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে,আমি মানা করেছি নাকি?’

কথাটা বলে লিখি হনহনিয়ে চলে গেলো রুমের ভেতর।নাবিল দরজা ফাঁক করে বললো,’বইনা ট্রে-টা নিচেই রেখে যাও,আমি নিব পরে’

‘বইনা ডাকবেননা,আমি আপনার বোন না’

‘ওকে আপু”

‘আপু ডাকবেননা আমি আপনার আপু ও না’

‘ওকে খালা’

নাবিল এবার নিজেও দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।লিখি ঠিক বলেছিল।এই মেয়েটা তো দেখি দিবানা হয়ে গেছে আমার উপর।’
—-
‘লিখি আসো খাবে,চা ফ্লাক্সে পাঠিয়েছে ওরা।খাবে আসো,তুমি তো চা পছন্দ করো।
উফ কি জ্বালা!বিয়ে করে মনে হয় বিপদে পড়েছি আমি।সবাই আমাকে দোষ দিচ্ছে।’

‘আপনার চা আপনি খান।আমাকে একা থাকতে দিন প্লিজ’

নাবিল দরজায় হাত রেখে বললো,’তোমার এই রাগ কেন দেখাইতেছো?তুমি তো বললে বিয়েটা মানোনা,তবে রাগ দেখিয়ে কি লাভ হচ্ছে?’

‘ক্ষোভ বলতেও একটা জিনিস আছে,আমি কি রাগ ও করতে পারবোনা?এখন থেকে আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন?’

‘জাহা….’

‘হ্যাঁ!!আমাকে তো জাহান্নামেই যেতে বলবেন,জানতাম তো।বিয়ে করেছেন অধিকার ফলাতে’

‘তুমি ডিভোর্স পেপার আনো আমি সই করে দিই।তাও এমন বাচ্চাদের মতন বিহেভ করবানা।তোমার দেখি সংসার বলতে কোনো জ্ঞানই নাই,যেখানে আমিও তোমার মতন ডোজ খেয়েছি সই করে সেখানে তুমি রাগ দেখাচ্ছো কিসের ভিত্তিতে?রাগ তো এখন আমিও দেখাইতে পারি’

‘কারণ আপনি উড়া-উড়ি করছিলেন নকল রেজিস্ট্রি নিয়ে’

‘উড়া-উড়ি না করে তোমায় একা রাস্তায় এত রাতে ফেলে চলে গেলে ভাল হতো তবে?’

লিখি এবার চুপ করলো।আর কিছু বললোনা।তার উত্তর সে পেয়ে গেছে।
চলবে♥