মনের কোণে পর্ব-১৮+১৯

0
291

মনের কোণে🥀
#পর্ব_১৮
আফনান লারা
.
পথে নাবিলের দেখা হয়ে গেলো বাবুর সাথে।বাবু তো ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে ছিল।নাবিল ভেবেছে সে হয়ত একাই মামা মামিকে বাঁচিয়ে উদ্ধার করে ফেলেছে।তাই জানাতে ছুটতে ছুটতে আসছিল।তার উত্তেজনা ছিল বিশাল।ছোটকালে আমরা যখন বড় খবর আগে শুনলে বাবা অথবা মাকে জানাতে আসতাম,তখন আমাদের যে উত্তেজনা কাজ করতো ঠিক সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল বাবুর সারা মুখ জুড়ে।
তার নাম বাবু রাখা তবে সার্থক হলো।হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললো ‘ভাইয়া জানো ঐ গুন্ডাগুলোকে আমি তাড়িয়েছি’

‘আচ্ছা তাই?তা কিভাবে?’

‘আমি বলেছি আমার বাবা আর্মি।ফটো ও দেখিয়েছি’

নাবিল ঠাস করে নিজের কপালে নিজে বাড়ি মে*রে বললো,’আর আমি তোর উত্তেজনা দেখে ভাবলাম হয়ত মা*রামা*রি করে এসেছিস’

‘ “””আকালমান কে লিয়ে ইশারাই কাফি হে”” বাবার পেশার কথা শুনে তারা যদি টাইটই হতো তবে আমি কেন খামোকা ঝগ*ড়া,মা*রামা*রি বাঁধাবো?’

‘খুব বুদ্ধির কাজ করেছিস’

‘আমি এদিকে এ কারণে আসছিলাম না তো।আম্মু এই টিফিন বক্সটা দিয়ে বললো ভাবীকে দিয়ে আসতে।ভাবী তো কিছুই খায়নি।আচ্ছা ভাবীর রাগ কমেছে তো?ভাবী হয়ত তার ভাই এসেছে ভেবে কিছু সময়ের জন্য রাগ- টাগ সব স্থগিত রেখে ছিল তাই না?’

‘বুঝলি,মেয়ে মানুষের রাগ হলো ধুমকেতুর মতন।কত কাল পর আসবে তা আমরা জানি,কিন্তু ঐদিন কোন সময়ে আসবে তা আমরা জানিনা।’

‘ভাল একটা পয়েন্ট বললে; আমার বিয়ের পর কাজে দেবে’

‘তোর আবার বিয়ে?জানিস তোর বিয়ে নিয়ে আমার কত কগ গবেষণা জমে আছে।’

‘কিরকম?’

‘ধর, তোর ঘরে তোর বিয়ের পর একটা ছেলে হলো।ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর বিয়েও দিলি’

‘হুম,তারপর?’

‘তারপর তোর পুত্রবধূকে কেউ শ্বশুরের নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলবে “বাবু”।হাহাহাহাহা’

বাবু ব্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো।নাবিল সবসময় তার নামটা নিয়ে রসিকতা করে।একদিন এক কৌতুক বানিয়ে আনে ওর নাম দিয়ে।
—-
বাবুর সাথে আরও কিছু সময় গল্প করে নাবিল যখন ফিরছিল ঠিক সেসময় লিখির ভাই তার দলবল নিয়ে ওদের দুজনের পথ আটকে দাঁড়ালো।
বাবু ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।ওসমান নাবিলের দিকে তাকিয়ে বললো ‘এই আর্মির ছেলেটার কি হও তুমি?ওর সাথে কিসের আলাপ জুড়েছো?’

নাবিল কিছু বলার আগে বাবু বললো,’আমার বাবা আর্মি, আর ও হলো আর্মির ভাগ্নে পুলিশ’

‘এই তুমি পুলিশ?’

‘হাইট দেখে কি মনে হয় তোমাদের?’

ওসমান দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে চলে গেলো চুপচাপ।পেছনে ফিরে আর তাকায়নি।
নাবিল বাবুর কাঁধে হাত রেখে বললো,’তোর তো ভালই উপস্থিত জ্ঞান হয়েছে।বিয়ে করিয়ে দিব ভাবছি।’
—-
লিখি নাবিলের একটা টিশার্ট নিয়ে রুমে এসে দরজা লক করে ওটাকে ব্লাউজ বানিয়ে শাড়ী পরার শেষ চেষ্টা করছে।
ফোন অন করে ইউটিউব দেখে মোটামুটি ভাল ভাবেই শাড়ীটা সে পরে নিলো অবশেষো।যখন পরা শেষ হলো ঠিক তখন কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে কুচি ধরে দৌড় দিয়ে এসে দরজা খুললো সে।
নাবিল ভেতরে ঢোকার আগে লিখিকে দেখে থমকে গেছে।প্রথমে খেয়ালই করেনি শাড়ীর সাথে এটা তারই টিশার্ট। লিখি আঁচল ঘুরিয়ে বললো,’শাড়ী পরা কেমন হয়েছে আমার?’

‘বাহ!নাহ!’

‘বাহ আবার নাহ?কেন?’

‘ব্লাউজের জায়গায় ওটা কি আমার টিশার্ট? ভুল দেখছি নাকি এটাই সত্যি?’

‘ঠিক দেখলেন’

নাবিল হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগালো।লিখি ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।ওর হাতে খাবার ধরিয়ে দিয়ে নাবিল কিছুদূর চলে যাবার পর থেমে পেছনে ফিরে বললো ‘তোমার না হাত অনেকটা পুড়ে গেছিল?তবে শাড়ী পরলে কি ভাবে?’

নাবিল ফেরত এসে ওর হাতটা উপরে ধরে দেখলো হাত থেকে বেশ রক্ত ঝরছে।তার যে হাত পুড়ে গেছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই।ডেং ডেং করে দুনিয়ার সব কাজ করে যাচ্ছিল।ফলস্বরুপ এত এত রক্ত ঝরছে এখন।

‘তুমি এত বেখেয়ালি কেন?’

‘আপনার কি তাতে?’

‘হ্যাঁ আমার অবশ্য কিছুইনা।তবে তোমার এই মূহুর্তে থেকে কিছু হলে নারী নির্যাতনের কেসে ফাঁসবো’

‘কেস তো আমি করবোনা’

‘তোমার যে গুষ্টি!বলবে স্ত্রীকে মে*রে স্বামীর আ*ত্নহ*ত্যার চেষ্টা,।স্বামী হাসপাতালে ভর্তি’

লিখি অনেক হাসলো।নাবিল তখন ওকে নিচে বসিয়ে বললো,’ঘরে তো ফার্স্ট এইড বক্সের একটা অক্ষর ও নেই।তোমায় বাহিরেও নেওয়া যাবেনা, তোমার ভাই আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।কি করি বলোতো?
আচ্ছা আগে খেয়ে নাও।’

নাবিল ওর পাশে বসে টিফিন বক্সটা খুলে চামচ দিয়ে খাবার তুলে ওর মুখের সামনে ধরলো।লিখির খেতে ইচ্ছে করছিলনা,তাও এক চামচ খাবার গিলেছে।নাবিলকে না করলে এক দফা লেকচার শুনিয়ে দেবে তাই চুপ হয়ে রইলো।টু শব্দ ও করলোনা।
নাবিল বুঝতে পারলো সে কিছু একটা বলতে চায়।জোর করে খেতে বসালে খাদকের এক কথা-“”আমার খেতে ইচ্ছে করেনা।””
এটা নাবিল জানে তাই সেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি।
—-
বেলা বারোটার সময় নাবিল বেলকনির রেলিংয়ে হাত রেখে নিচে দেখছিল,নিচে কলোনির বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে,নাহিদ থাকলে ছুটে যেতো ওখানে।লিখি দূর থেকে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল এক দৃষ্টিতে।কিছুক্ষণ পর চোখের পলক ফেলে বললো,’আপনার ভাই নাহিদ ফোন করেছিল’

‘হাসলে?’

‘অনেক,তবে মনে হলে আপনার বাবা ওকে দিয়ে কল করিয়েছে।’

কথাটা শুনে নাবিল নিজের ফোন খুলে সিম বের করে দাঁত দিয়ে দু টুকরা করে ফেললো।লিখি হা করে চেয়ে আছে।

‘বাবা এই সিম ধরে এখানে চলে আসতে পারবে জানো?’

‘আপনার বাবা এত চালু?? ‘

‘চালুর আর কি দেখলে।বিয়ের কথা জানলে দাঁড়িয়ে থেকে ডিভোর্স করাবে’

লিখি লাফ দিয়ে উঠে বললো,’তাহলে তো অনেক ভাল হয়।আমি আমার মতন থাকবো আগের মতন।আর আপনিও আপনার মতন’

নাবিলের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো ওর কথা শুনে।হয়ত লিখির থেকে এ কথা সে আশা করেনি।বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল সে,তারপর কি যেন ভেবে চাহনি সরিয়ে নিলো।
লিখি হয়তবা বুঝলো।ধীরে জিজ্ঞেস করেছে,’আপনার বাবা দাঁড়িয়ে থেকে ডিভোর্স করাতে চাইলে আপনি কি করতেন তখন?’

‘তুমি যেহেতু মুক্তি চাও আমি আর কি করতাম?কিছুই করতাম না’

“ওহ”
—–
সারাটা দিন কেটে গেলো দুজনের দু-রুমে বসে।এত চিন্তায় বিভোর ছিল দুজনে যে দুপুরের খাবার বলে একটা কথা আছে তা ভুলে গেছে তারা।মাথা থেকে সরে গেছে একেবারে।লিখি তার বাছাই করা সেই ফাঁকা রুমটার ফ্লোরে বসে মাথা পিলারের সঙ্গে হেলান দিয়ে রেখে জানালার দিকে চেয়ে বসেছিল সারাটা সময়।
নাবিল ছিল তার রুমে।

“বিয়ে কেমন না??কদিন আগেও দুটো মানুষ একজন আরেকজনকে চিনতো না,পরিচয় হয়েছিল অন্যরকমভাবে। এরপর হয় অপছন্দের খেলা,প্রতিযোগিতা।
এর মাঝে বিয়ের বন্ধন জুড়ে সম্পর্কটাকে এমন জায়গায় জুড়ে দিয়েছে,এখন ছেড়ে যাওয়ার কথা উঠলে বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগে।এই তো কাল সকালেই বিয়ে হয়েছে।মনের ভেতর শত শত ক্রোধ,রাগ,অভিমানের জড়তা প্রকাশ পেয়েছিল নকল নামের বিয়েটা আসল নাম পাবায়।মন চাইছিল মূহুর্তেই ডিভোর্স পেপারে সই করে দিতে।অথচ আজ সেই পেপারের নাম ওঠায় বুকের ভেতর খালি লাগছে।বিয়ের বন্ধন বুঝি এত গাঢ় হয়??
তবে কি অপছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকা মানুষটাকে নিজের সবটা বানানোর জন্যই বিয়েটা হুট করে হয়ে গেলো?
তবে পরিবার যদি মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়, এই বন্ধনের কি সেই শক্তি আছে দেয়াল ভাঙ্গার?

দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মন যদি হয় ডিভোর্সের জন্য ইচ্ছুক তবে দেয়াল আরো মজবুত হবে,ভাঙ্গবে না।”

দুপুর শেষ,বিকাল শেষ।দুজনের কথা নেই,খাওয়া নেই।
রুমের আলো জ্বলে উঠতেই লিখি মাথা ঘুরে তাকালো।নাবিল হাই তুলতে তুলতে বললো,’জানো এমন ঘুম দিয়েছি নাওয়া- খাওয়া সব ভুলে বসে আছি’

লিখি এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,’হাই তুললেই ঘুমের ভান হয়না’

নাবিলের চেহারার ভাব বদলে গেলো লিখির কথা শুনে।ও কেমন করে যেন বুঝে গেলো তার মিথ্যে হাই তুলার দৃশটা।লজ্জা পেলো সে।মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললো ‘হাই নিয়ে কেউ মজা করে নাকি?’

‘আমি জানতাম কেউ করেনা,তবে আপনাকে দেখে বুঝলাম কেউ অন্তত করে’

‘চলে হাঁটতে বেরুবে’

‘আমার ইচ্ছে নেই’

‘আজও মামার বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে।ফাঁকা ফ্ল্যাটে চাইলেও এখন থাকা যাবেনা’

‘তা নাহয় রাতে ঘুমানোর সময় হলে যাওয়া যাবে’

নাবিল চলে আসলো ওখান থেকে।লিখির ইচ্ছে নেই তো জোর করে কি লাভ?দরজা খুলে যেতে যেতে বলে গেলো সে একাই হাঁটতে যাচ্ছে।লিখি শুনলো।কিন্তু উঠে দরজা লাগাতে আসলোনা।নাবিল ভেবেছে সে হয়ত দরজা লাগাতে আসবে।তার এমন চুপ হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছেনা সে।
মেয়েটা বড় উদ্ভুত প্রকৃতির।তার মন কি চায় তা শুধু সে জানে।
চলবে♥

মনের কোণে🥀
#পর্ব_১৯
আফনান লারা
.
একলা ফাঁকা পথে হাঁটছে নাবিল।আবাসিক এলাকা গুলোর পথে পথে মানুষ খুব কম থাকে।বেশিরভাগ সময় গৃহযাপন করাই তাদের ধর্ম।অফিস থেকে বাসা,বাসা থেকে অফিস।কেউবা সকালে একটু সময় বের করে জগিংয়ে বের হয়।তাও হাঁপাহাঁপিতে অফিসে ছোটা।
তবে এক দল মানুষ দেখতে পাওয়া যায় যাদের অফিস নেই,সংসারের চাপ নেই।বার্ধক্য পাড়ি জমিয়েছে তাদের জীবনে।তারা এই ফাঁকা পথটাকে একলা রাখতে দেয়না।
নাবিল তাদের মতন কজনের দেখা পেয়েছে ইতিমধ্যে।তবে সন্ধ্যার এই সময়টায় সেই বয়স্ক মানুষগুলো মোটেও একা না,সাথে তাদের সঙ্গীর ও দেখা মেলে।
কেউ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বেরুচ্ছে,আর কেউ নিজেট প্রাণপ্রিয় পুরনো বন্ধুদের নিয়ে।
বয়স হয়ে গেলে বুঝি মানুষ জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে।তবে বয়স থাকতে কেন নয়?
বেশ বিরক্ত হলো নাবিল।বয়স্ক কাপল দেখে তার রাগ হলো কিঞ্চিত। একজন আরেকজনকে আইস্ক্রিম খাইয়ে দিচ্ছিলো।মিনিট পাঁচেক ধরে সেই কাপলকে লক্ষ করে নাবিলের এখন হিংসা লাগে।মাথা বাঁকিয়ে তাদের দালানের চতুর্থ তলার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।লিখির সাথে তার হয়ত প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক নেই,কিন্তু কাগজে কলমে তো তারা স্বামী-স্ত্রী;পাশাপাশি হাঁটা তো নিষিদ্ধ না।বিয়ে না করেও কতজন কত কি করে ফেলে আর তারা বিবাহিত হয়েও দোক্কা খাচ্ছে।
মুখটা কালো করে নাবিল আরও সামনের দিকে চললো।
সন্ধ্যা সাতটা তিন মিনিট।এসময়ে পথে বাবুর দেখা মিলবেনা।সন্ধ্যার এই সময়টাতে তার একবার প্রচুর নেশা ছিল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার।পরে মামা বুদ্ধি করে এসময়ে ওর জন্য প্রাইভেট টিউটর রেখে দিলেন।গুনে গুনে দু ঘন্টা পড়াবে সেই স্যার।বাবুর আড্ডার বারোটা বেজে গেলো।স্যার চলে যায় নয়টার সময়।তখন ওকে মামি চেপে ধরে ডিনার করিয়ে নেওয়ান,তারপর ঘুম।রাতের আড্ডা দেওয়া আর কোনোদিন বুঝি হবেনা তার।স্যার সপ্তাহের সাতটা দিনই পড়ান।ঝড়-তুফান-বৃষ্টি-হিমে ঘেরা শীতের সন্ধ্যা কিংবা চামড়া সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতন গরমকাল, কোনো কিছু তার কাছে সমস্যা না।
কি মুশকিল!
মামার বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় এক নজর তাকালো নাবিল।প্রয়োজন ছাড়া মামার বাসায় আসা পছন্দ করত না সে।আর এখন রীতিমত বাধ্য।
এক চক্কর কেটে আবারও ব্যাক করছে বাসার দিকে।দূর থেকে শোনা যায় কারোর ডাক।নাম নাবিল শুনতে পেলো বলে চোখ বড় করে দেখার চেষ্টা করলো কে আসে এত ডেকে ডেকে।কলোনীর ল্যাম্পপোস্ট এখনও জ্বলেনি বলে নাবিল চোখের সামনে ছুটে আসা মানুষটাকে দেখতে পেলোনা স্পষ্ট।অনেক কাছে আসার পর চিনতে পারলো ওটা লিখি।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো,’ ভাল্লাগছেনা একা’

‘আমি তো খুব করে সাধলাম,তুমিই তো এলেনা’

‘এখন আসলান তো,চলুন আইস্ক্রিম খাব’

নাবিল অবাক চোখে লিখির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।তখন এই ইচ্ছেটা তার হয়েছিল,অদ্ভুত!লিখি কেমন করে জানলো?’

নাবিলকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিখি বললো,’আমি তখন বারান্দায় নিচে বসে ছিলাম,আমাকে হয়ত দেখেননি।আপনি যে হা করে আইস্ক্রিম খাইতে থাকা কাপল দেখছিলেন আর বারবার করে আমাদের বারান্দা দেখছিলেন তার কারণ আগাগোড়া বেশ বুঝেছি আমি।’

নাবিল মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেলো।মনে হলো লিখির সামনে একেবারে ছোট হয়ে গেছে।লজ্জার চোটে মাথা তুলে ২য় বার তাকায়নি।কালো কঙ্করের পথটাকে দেখতে দেখতেই পথ চলা শুরু করেছে।
লিখিকে দেখে মনে হয় উদ্যমে আছে।লাফালাফি করছে,পথের পাশে হেলে থাকা ফুল গাছ থেকে লাফ দিয়ে ফুল ছিঁড়ছে।ফুলটাকে ভালভাবে দেখে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে আবার নাবিলের মুখে ছুঁড়ে মারছে।
‘মেয়েটার হলো টা কি?সন্ধ্যায় অন্ধকারে একা বাসায় থেকে জ্বীনে ধরলো নাকি!
লিখি?’

লিখি থেমে পেছনে ফিরে বললো,’কি?’

‘তুমি ঠিক আছো?’

‘আমার হবে কি?’

‘না কিছুনা। এরকম ছটফট আগে করতেনা তো তাই একটু অবাক হচ্ছি’

লিখি ভ্রু দুটোকে কুঁচকে বললো,’আগেও চুরি করতাম,এখনও চুরি করলাম।তফাৎ কি দেখলেন?’

‘ফুল ছিঁড়ে মাথায় দেওয়াকে আমি চুরি হিসেবে ধরিনা কখনও।ফুল সুন্দর, দেখলেই ধরতে ইচ্ছা করে।হাতে নিতে ইচ্ছা করে।কিন্তু ছিঁড়ে পাশের জনের মুখে ছুঁড়ে মা*রাকে আমি স্বাভাবিক নিতে পারলাম না’

‘মনে করেন আমার মনে রাগ ও আছে,উড়াউড়ি ও আছে।দুটো একসাথ হয়ে গেলে চুরির জিনিস ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়।বুঝলেন?’

নাবিল বুঝলো লিখি বুঝি রেগে আছে।তবে রেগে থাকার কারণ কি?
কারণ বের করতে চায়নি নাবিল।কারণ সামনে এসে পড়েছে সংখ্যায় সংখ্যায় আইস্ক্রিম ঝুলানো আইস্ক্রিমওয়ালা।লিখি বললো প্রথমে সে শুকনো কোণ খাবে অনেকগুলো।তারপর কোণে আইস্ক্রিম দিয়ে খাবে।
যেমন হুকুম তেমন কাজ।নাবিল বারতি টাকা দিয়ে শুকনো আইস্ক্রিম কতকগুলো কিনে দিয়েছে।মচমচে কোণগুলো লিখি বেশ তৃপ্তি সহকারে খেলো,এরপর আইস্ক্রিমের পুর নিয়ে সামনের দিকে চললো।আরও সামনে।অথচ তারা এখন তাদেরই বাসার সামনে।লিখি কি আরও হাঁটতে চায় নাক?নাবিল নিজেও একটা আইস্ক্রিম নিয়েছে।মিষ্টি খাবার তেমন একটা পছন্দ না ওর।তাও নিলো।সামনে একজন খাবে আর সে চেয়ে থাকবে,এটা সে হজম করলেও তার পেট হজম করবেনা,রাগ করে গুড়গুড় করবে।লিখির তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দেখে ওর মনে হচ্ছিল খাওয়া হয়ে গেছে, অথচ ওর হাতে দিব্যি আইস্ক্রিম রয়ে গেছিল।লিখি সামনের একটা দালানের সামনে করলা গাছ দেখে দুটো ছিঁড়ে দৌড় মে*রেছে।নাবিলের মনে হলো ওর চুরি করার স্বভাব এবার তুলতে হবে।এখন আর সেই লিখি না যে চুরি করে পেট চালাবে।মা যে টাকা দেয় তাতে করে নেক্সট চৌদ্দ জেনারেশন অনায়াসে বসে খেয়ে যেতে পারবে।

করলা হাতে লিখি বললো মামির হাতে দেবে।করলা ভাজি খেতে ইচ্ছে করছে অনেক।

‘শোন লিখি, আর কোনোদিন চুরি করবেনা।আজ থেকে চুরি করা ছেড়ে দেবে তুমি’

লিখি যেন শুনলোই না।করলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে আর বলছে মনে হয় বাড়িওয়ালা ঠিকমতন সার দেয়নি।করলার সাইজ ছোট একেবারে।
নাবিল শেষে ওর হাত ধরে থামিয়ে চোখ রাঙিয়ে নিজের কথাটা আবার বললো।লিখি চুপচাপ কথাটা শুনে বললো,’শুনেছি।কিন্তু আমি তো আপনার কথায় চলবোনা।আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।সামনে যা দেখি তাই নিয়ে নিতে ইচ্ছা করে’

‘অভ্যাস কি করে ছুটাতে হয় তা আমার জানা আছে।হাত -পা বেঁধে বসিয়ে রাখবো।তোমার চুরি করা কি করে বাপ বাপ করে না পালায় তা শুধু দেখবো’

‘ওটার ইচ্ছে তো মনের।হাত পা বেঁধে কি হবে?
“আমার হাত বান্ধিবি,পা বান্ধিবি
মন বান্ধিবি কেমনে?
আমার চোখ বান্ধিবি,মুখ বান্ধিবি
পরাণ বান্ধিবি কেমনে?”

গানটা গাইতে গাইতে লিখি আরও সামনের দিকে চললো।নাবিল ভূত দেখার মতন মুখ করে ওর পিছু পিছু চলেছে।লিখির কিছু একটা তো হয়েছে।কেমন পাগলা লালনের মতন শুরু করেছে।হাবভাব কেমন যেন!!’

লিখি থেমে গিয়ে বললো,’চলুন ফিরে যাই,সোজা মামার বাসায়,করলা ভাজি করতে সময় লাগবে তো’

নাবিল ওর কথামতন চললো।মামার বাসায় এসে মামির হাতে করলা দিয়ে লিখি বললো আলু কুচি করে ভাজি করে নিতে।মামি হাসছেন খিলখিলিয়ে।নতুন বউ নাকি করলা ভাজি খাবে,তাও স্বাদ করে গাছ থেকে ছিঁড়ে এনেছে।
এই খবর বাবুর কানে যাবার পর সে এসে নাবিলকে বললো,’ভাবীর কি গাছের তরতাজা সবজি ছিঁড়ার অভ্যাস আছে?আমাদের গাছের সব বেগুন ছিঁড়ে রান্নাঘরে রেখে গেলো কাল,ভাজি করার জন্য।এখন আবার কাদের না কাদের গাছের করলা নিয়ে আসলো।তুমি এক কাজ করো,তোমাদের বাসার সামনে সবজি বাগান করো,ভাবীর তাহলে আর কষ্ট হবেনা’

নাবিল গালে হাত রেখে লিখির মুখের দিকে চেয়ে আছে।এরা তো কেউ জানেনা লিখি কয় নাম্বারের চোর।
লিখি বাবুর হাতের সোনালী ঘড়িটা দেখছে।ভীষণ দামী ব্রান্ডের মনে হয়।নাবিল বিষয়টা বুঝতে পেরে বাবুকে বললো,’বাবাই তোর ঘড়িটা খুলে আলমারিতে রাখ তো।ভাল লাগছেনা দেখতে,সিলভার একটা আছেনা?ওটা পর’

‘কেন?আম্মু আব্বু বললো সুন্দর লাগে,আর তুমি বলছো সুন্দর না?’

‘বললাম তো খুলে আলমারিতে রাখ যা’

লিখি ভেংচি কেটে রুমে চলে গেছে।নাবিল কিছুক্ষণ পর রুমে আসতেই লিখি গাল ফুলিয়ে বললো,’আমি কি ঐ ঘড়িটা নিতাম?মুখের উপর ঐ কথা কেন বললেন?’

‘তোমার স্বভাব জানা আছে’

লিখি আঙ্গুল তুলে বললো,’আমার শুধু আপনার হাতের ঘড়িটার দিকে নজর। অন্য ঘড়ি এই লিখি নেবেনা!’

নাবিল তাচ্ছিল্য করে হেসে নিজের হাতের দিকে চেয়ে দেখলো তার হাতে ঘড়ি নেই।অমনি খচখচ আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে দেখলো লিখি ওর ঘড়িটা উপরে তুলে নাড়ছে আর হাসছে।

‘কেমনে নিয়ে নাও? টেরই পাইনা।’

চলবে♥