মনের কোণে পর্ব-২৮+২৯

0
260

#মনের_কোণে🥀
#আফনান_লারা
#পর্ব_২৮
.
ঘরভরা আসবাব দেখে নাবিলের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
আর যে এই কান্ড ঘটিয়েছে সে নিশ্চিন্তে এক কোণায় বসে পানি গিলছে ঢকঢক করে বোতল থেকে।
তার পানি খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই নাবিল হুমড়ি খেয়ে জানতে চাইলো এই অসাধ্য সাধন কি করে করেছে ও।
লিখি বললো নিউমার্কেটে ঢুকে গেছে সোজা।ঢুুকলেই হয়না।দামাদামি করতে হয়,জানতে হয়।নাবিল তাই ভাবছে,দামাদামি জানলে এসব সম্ভব।

লিখি উঠে এবার সব গুছিয়ে ফেলছে এক এক করে।সবার আগে তার রুমে তোষক পেতে তাতে চাদর বিছিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে এখন।
নাবিল ওখানে একটু জায়গা করে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।শক্ত ফ্লোরে বসে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছিল।
লিখির চোখে ঘুম এসে গেলো।তারপর যখন চোখ খুললো তখন রাতের দশটা বাজে।রান্না করা হলোনা মনে করে লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়েছে সে।
নাবিল ওর পাশেই বসে শর্মা খাচ্ছিল,অর্ডার করে এনেছে।সেটা ওকেও খেতে বলে আবার কাজে মন দিলো।
লিখি চোখ ডলতে ডলতে ওয়াশরুমের দিকে চললো।ঘুম থেকে উঠলে পাঁচ মিনিট এ জগতের কারোর হুশ থাকেনা।মনে হয় অন্য জগৎয়ে উঠে চলে এসেছি।
মুখ ধুয়ে বের হয়ে সে চড়াও হয়ে গেলো নাবিলের ওপর।সে নাকি তরকারি কিনে এনেছে তাহলে নাবিল শর্মা অর্ডার করে টাকা নষ্ট করলো কেন।

‘রাতের দশটার সময় তুমি ভাত রাঁধবে?’

‘কেন?কি সমস্যা তাতে?’

‘লাগবেনা’

বিড়বিড় করতে করতে লিখি বাইরে গেলো দেখতে।যা যা আগোছালো ছিল সেসব কিছু পরিপাটি করে গোছানো।কাজটা নাবিলের বুঝে লিখি খুশি হলো।সদাই করে এসে প্রচণ্ড টায়ার্ড হয়ে পড়েছিল সে।আজ আর কোনো কাজ তাকে দিয়ে হতোনা।
—–
শর্মা খেতে খেতে লিখি নিজের রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দূরের একটা ফ্ল্যাট দেখছিল।নাবিল তখন ল্যাপটপের কাজ শেষ হওয়ায় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসেছে।লিখিকে মনযোগ দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখে তার মাথায় আবারও দুষ্টু বুদ্ধি এসে গেলো।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,’বউ??’

বউ ডাক শুনে লিখির গলায় খাবার বিঁধে গেছে।অনেক কষ্টে গিলে পেছনে তাকালো।তার বড় করে রাখা চোখ বলে দিচ্ছে সে ভীষণ ভয় পেয়ে আছে।নাবিল তার চোখে ভয় দেখে ভয়টাকে আরেকটু নাড়াচাড়া দিতে বললো,’আসো পাশে বোসো।প্রেমালাপ করি’

‘আপনার কি শরীর খারাপ?’

‘না তা হবে কেন?হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?’

‘বেশি রোমান্টিক হয়ে গেছেন তাই জানতে চাইছি’

‘তুমি হলে আমার ওয়াইফ।তোমার জন্য রোমান্টিক হবোনা তো কার জন্য হবো?আসো পাশে বোসো বলছি’

নাবিলের জোর দেওয়া দেখে লিখি দু কদম আরও পিঁছিয়ে দাঁড়ালো।গেলো না ওর কাছে। শর্মা শেষ করে কিণারা দিয়ে হেঁটে হাত ধুয়ে এসেছে।নাবিল তখনও বিছানাতে ছিল।শুতে হলে তো ঘুরেফিরে তাকে এই জায়গাতেই আসতে হবে,তাই সে পড়েছে মহাবিপদে।নাবিলকে সুবিধার মনে হয়না।
দুষ্টামি মাথায় চলছে, আবার কি করে বসে তাই ভাবছিল কতক্ষণ। ওকে জানালার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে থাকতে দেখে লিখি রুমের আলো নিভিয়ে চো/রের মতন বসে গেলো নিচে পাতানো তোষকের ওপর।
নাবিলের হাতের ঘড়ি ডাক দিয়েছে।এগারোটা বাজে।লিখি চোখ বুজতে গিয়েও পারেনা,নাবিল কখন কি করে বসে তা নিয়ে চিন্তায় ঘুম নেই চোখে।ঘুম না হবার আরও একটা কারণ হলো কিছুসময় আগেও সে ঘুমিয়েছে।এখন আড্ডা দিলে মন্দ হতোনা।কিন্তু নাবিল যে রোমান্টিক ভাব দেখাচ্ছে তাতে মনে হয় আড্ডা দেওয়ার নাম ও নেয়া যাবেনা।
নাবিল ঠিক সেসময়ে লিখির হাতটা টেনে ধরলো আঁধারের মাঝে।
লিখি তো ভয়ে শেষ।চিৎকার করে বললো ‘হাত ধরলেন কেন?কি করবেন?’

‘প্রেম’

লিখি উঠে বসে বললো,’মজা পায় আপনার?আমরা কিসের মধ্যে আছি, ভুলে গেছেন?এই সিচুয়েশনে আপনার মজা পায় কি করে আমি তাই বুঝিনা।আমার হাত এত শক্ত করে ধরেছেন কেন?ছাড়ুন নাহয় কামড়ে দেবো’

‘নাহিদের বহুত কামড় খেয়েছি।হেবিট আছে।কামড়াও’

লিখি হাত নাড়তে নাড়তে বললো,’হাত ধরেছেন মানলাম,কিন্তু কিসের জন্য হাত ধরলেন?’

‘সামনে খোলা জানালা,আকাশ কালো,তাতে জ্বলে আছে কোটি কোটি তারা।আকাশের নিচে খালি।থেমে থেমে বাতাসের রাশি,রুম অন্ধকার।
এই মূহুর্তে হাত ধরবোনা তো কবে ধরবো?’

‘ধরে কি হচ্ছে?’

‘চোখ বন্ধ করে ভাবো কি হচ্ছে’

লিখি নাবিলের কথা মতন চোখ বন্ধ করলো।জানালা দিয়ে বাইরের বাতাসে তার চুল নড়ে উঠলো।ঠাণ্ডা আবহাওয়া,আর নাবিলের হাতের ছোঁয়া তাকে এক অন্যরকম দুনিয়ায় নিয়ে চলে গেছে।সেই অনুভূতিটা শিহরণ জাগালো মনে।কেঁপে উঠলো সে।নাবিল তখন হেসে বললো,’বলেছিলাম না?’

‘আপনি অদ্ভুত ‘

‘আর তুমিও’
——-
‘এই রাত কি শেষ হবেনা লিখি?গান পারো?হয়ত পারোনা।বেশি ঝগড়াটে মেয়েদের গলা ভাল হয়না তাই গাইতে বলবোনা।আচ্ছা গল্প জানো?’

নাবিলের কথা শুনে লিখি কিছু বললোনা।দু মিনিট চুপ থেকে খালি দু লাইন গাইলো।
“””মনের কোণে””””
“””গহীন ঘরে,,,থাকবি রে শুধু তুই””
“””কল্পনাতে,ভেলায় ভেসে”””
“””” ঘুরবো আমি, তুই……””””

গানটা এত ভাল যে লিখির চিকন স্বরে দারুণ শোনা গেলো।নাবিল অবাক চোখে ওর দিকে ফিরে চেয়ে রইলো এতক্ষণ কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিলনা।গানটা শুনে সে বললো,’জানো আমাদের সাথে গানটা মিলে গেছে।’

‘কিভাবে?’

‘একদিন বুঝবে’
—-
নাবিল এবার বসা থেকে শুয়ে পড়েছে।লিখির চোখে ঘুম নেই,হয়ত নাবিলও জেগে আছে।তাই সে বললো,’আচ্ছা আপনার বাবা যেদিন জানবে আপনি বিবাহিত, সেদিন তিনি কি করবেন?’

‘তুমি যত ভালই হও না কেন ডিভোর্স দিতে বলবে’

‘তখন?’

‘আমি কি তার কথা শুনি? ‘

লিখি হালকা নিশ্চিন্ত হলো।প্রথমদিন মন চাইছিল ডিভোর্স দিয়ে দিতে আর আজ ডিভোর্সের ভয় জাগে মনে।একটা সম্পর্কের ভিত্তি কতটা মজবুত হতে পারে।
নাবিলের নড়চড় না দেখে বোঝা গেলো সে ঘুমিয়েছে।সন্ধ্যাবেলার ঘুমটা রাতের ঘুম কেড়ে চলে গেছে।
তাই উঠে বসে নাবিলের কথা মতন খোলা জানালা দিয়ে আকাশের তারা দেখছিল সে।মন চাইলো ছাদে গিয়ে দেখতে।ভাবনার ছায়াতলে দরজা খুলে ছাদে চলে আসলো লিখি।
ছাদ ছিল ফাঁকা।সেখানে গোল হয়ে বসে আকাশের দিকে তাকাতেই মনে হলো তারার মেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সে।
কি সুন্দর আকাশটা।ইচ্ছে করে এক ছুটে গ্যালাক্সিতে চলে যেতে।
পরিষ্কার ছাদ দেখে মনে স্বাদ জাগলো একবার শুয়ে দেখার।সব পূরণ হয়ে একটা বাদ যাবে কেন?শুয়ে পড়েছে লিখি।এবার আকাশটা যেন কোলে চলে আসবে।মুচকি হেসে তখন পাশে মুখ ফেরাতেই পাশে নবিলের মুখের ঝলক দেখে চমকে গেলো লিখি। নাবিল কখন যে আসলো আর ওর পাশে শুয়েও গেলো সে টেরই পায়নি।নাবিলের মুখে ছিল অসীম হাসি।ছাদের মাঝে জ্বলে থাকা লাল বাতির আলোয় ওর মুখের সাদা রঙটা যেন আরও গাঢ় হয়ে গেছে।নাবিলের ঠোঁটের কোণায় জমে থাকা হাসি লিখিকেও হাসতে বাধ্য করলো।সে হেসে বললো,’আপনি ঘুমাননি?’

‘দেখছিলাম তুমি আমার অজান্তে কি করে,আর এটাও জানতাম তুমি এত জলদি ঘুমাবেনা’

‘কখনও এমন শুয়েছিলেন?’

‘বহুবার’

‘কোনো মেয়ের সাথে?’

‘উহু।’

‘আচ্ছা আপনি প্রেম করেছিলেন?’

‘হ্যাঁ’

লিখি মাথা উঠিয়ে কুনুই ছাদে রেখে বললো,’সত্যি?’

‘হ্যাঁ’

‘সে মেয়ের সাথে বিয়ে হলোনা কেন?’

‘বাবা তাকে পছন্দ করেনি’

‘তো তাই বলে ভালবাসার মানুষটাকে যেতে দিলেন? ‘

‘তখন আমি ইন্টারে পড়তাম।আমার হাত খরচ বাবা দিতো।বাইরের জগৎ সম্পর্কে দু আনাও জানতাম না।তাকে নিয়ে পালিয়ে উল্টে তাকে বিপদে ফেলতাম।তখন এত আত্নবিশ্বাস ছিলনা’

‘ঐ মেয়ে কাঁদেনি?’

‘কেঁদেছে,হয়ত আমি দেখিনি।আমাকে দেখিয়ে কাঁদেনি।বাবার প্রতি তার ঘৃনা সৃষ্টি হয়েছিল যার কারণে শেষ পর্যন্ত সেও আমায় ঘৃনা করেছে।অবশ্য ঘৃনা করারই কথা’

লিখি উঠে বসে তারপর বললো,’যদি আমার বেলায় ও এমন করে?’

‘তুমি হলে আমার বিয়ে করা বউ,
চাইলেই কি আলাদা করা সম্ভব? ‘

‘আপনার বাবা সব পারবেন’

‘আমার বাবাকে দোষ দিচ্ছো কেন?তোমার ফ্যামিলি কি কম সাংগা/তিক??? ওরা জানলেও একই কাজ করার চেষ্টা করবে’

‘আপনি কি চান আলাদা হতে?’

লিখির কথা শুনে নাবিল ওর চোখের দিকে তাকালো।প্রশ্নটা সে সিরিয়াসলি করেছে। তাও নাবিল উত্তর দিলোনা। সোজা আকাশের দিকে চেয়ে থাকলো।লিখি উঠে ছাদের বাতিটা নিভিয়ে দিলো হঠাৎ।নেভানোর ওরেও আকাশে আলাদা একটা ভাসমান আলো ছিল।একেবারে আঁধার টাইপের।মেঘলা বলে হয়ত!!চাঁদ কি উঠছিল?নাকি মেঘে ঢাকা??এরকম আকাশের দিকে তাকালে কেমন একা একা মনে হয় নিজেকে।
লিখিকে ওভাবে উঠে যেতে দেখে নাবিল বললো,’আমি আলাদা হতে চাইনা লিখি’

‘কেনো?কারণ জানতে পারি?কদিনে মায়া ধরে গেছে?’

‘মায়া ধরুক বা না ধরুক,বন্ধনে তো আটকা পড়ে গেলাম।এটা কি চাইলেই অস্বীকার করা যায়?’

লিখি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বললো,’আমাকে আপনার কেমন লাগে?’

‘কেমন লাগে, পাশে আসতে বলেছি বুঝোনা?’

লিখির গাল লাল হয়ে গেছে কথাটা শুনে।রেলিং থেকে হাত সরিয়ে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়েও নিয়েছে।নাবিল আবারও দুষ্টুমি শুরু করবে মনে হয়।
পরিস্থিতি সুবিধার না বলে লিখি পালিয়েই যাচ্ছিলো।নাবিল ছাদের বাতিটা জ্বালিয়ে দরজার সামনে বাধা দিয়ে দাঁড়ালো তখন।ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসি আর চোখে দুষ্টুমি ভাসছে তার।লিখি অসহায়ের মতন তাকিয়ে ছিল,নাবিল বললো,’তোমায় ভয় দেখাতে এত ভাল লাগে কেন বলোতো?’

‘আপনি জানেন,কারণটা জানলে আমি শুধরে নিতাম’

‘কারণ হলো তুমি ভয় পাও তাই।
ভয় পাওয়া বন্ধ করে দাও,দেখবে আর ভয় দেখাবো না’

লিখি বুক ফুলিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে, দম আটকে বললো,’আমি স্ট্রং,আপনাকে ভয় পাইনা হুহহহহ’

নাবিল হঠাউ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরতেই তার সব সাহস আর দম ছেড়ে গেলো।কোমড় থেকে নাবিলের হাত সরিয়ে দূরে সরে বললো,’আপনি খুব খারাপ’

‘ঐ যে বললাম ভয় পাইলে আরও ভয় দেখাবো’

‘আমি ভয় লাঘব করার জন্য টাইটলি দাঁড়িয়েছিলাম,কি দরকার ছিল কোমড়ে হাত রাখার?’

‘ছুঁয়ে দেখছিলাম ভয় গেলো কিনা’

‘এমন গেম খেলবোনা,আপনি কি আগে বলেছিলেন যে কোমড়ে হাত রেখে চেক করবেন?’

‘গেমসের সব রুলস বলে দিলে এই গেমস আমি নিজেই খেলবোনা।সরো’

‘ঠিক আছে,এবার আবার ট্রাই করবেন’

লিখি আবারও বুক ফুলিয়ে দম আটকে এবার কোমড়ে নিজের হাত রেখে দাঁড়িয়েছে যাতে নাবিল কোমড় ছুঁলেও ওর কাতুকুতু না লাগে।
নাবিল মুখে হাসি ফুটিয়ে কাছের দিকে আসলো।লিখি ভাবছে কোমড়ে হাত রাখলে ভয় পাবেনা,মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছিল ওসব।
তার ভাবনায় আরও একবার ছেদ ঘটালো নাবিল।ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কাছে এসে।
কোমড়ে হাত রাখেনি অথচ আরও একবার লিখিকে ভয় দেখিয়ে ফেললো।
লিখির হাত সরে গেছে কোমড় থেকে।নাবিল ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’আমি আবারও জিতে গেলাম’

চলবে♥

#মনের_কোণে🥀
#আফনান_লারা
#পর্ব_২৯
.
মধ্য রাতের আকাশে ভাসা গুঞ্জন,মেঘে লুকানো চাঁদের কিঞ্চিত আলোর সাথে মিশে আছে নতুন প্রেম।বিবাহের পরের প্রেম।
দু শরীরের স্পর্শে কাতর হয়ে যাওয়া এক যুগল সৃষ্টি করে ফেললো তাদের দুজনের প্রথম ভাল লাগা।
খেলার ছল থেকে তারা অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে তাও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে যে ভীষণ ভাললাগে।এই অনুভূতি এত মধুর কেন মনে হয়?কেন সারাক্ষণ এভাবে থাকার প্রতিজ্ঞা করতে ইচ্ছে হচ্ছে?
চোখ বন্ধ করে ভাল লাগার শেষ সীমানা পেরিয়ে গেছে দুজন।সময় কেটে যাচ্ছে।পেঁচার ডাক শোনা গেলো তখন।সে যেন তাদের সতর্ক করে দিলো।তার ডাকে দুজনে আলাদা হয়ে দুদিকে ফিরে গেছে।
কি সুন্দর ছিল মূহুর্তটা।যদি আবারও জড়িয়ে ধরা যেতো।কিন্তু সামনের মানুষটা কি ভাববে ভেবে আর তাদের দুজনের জড়িয়ে ধরা হলোনা।
নাবিল পা চালিয়ে বললো,’চলো ফিরে যাই’

লিখিও দেরি না করে ওর পিছু চললো।বাসায় ফিরেও দুজনে দুদিকে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।আর একটি কথাও তাদের মাঝে হয়নি।
মজা করতে করতে তারা আজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে যার কারণে সেটা হজম করতে অনেককাল নিরবতা বয়ে যাচ্ছে সম্পর্কের মাঝে।
পরেরদিন খুব ভোরে নাবিল উঠে গেছে,আজান শোনা যায়।লিখি ওর বালিশে মুখ গুজে ঘুমাচ্ছে,তাকে জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছে হলোনা তাও নামাজ পড়ার জন্য ডাকলো দুবার।তারপর সে নিজেই পড়তে গেলো।নাবিলের ডাকে লিখি জেগেছে ঠিক কিন্তু উঠতে পারছিলনা আলসেমির কারণে।বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে দশ মিনিট নষ্ট করেছে।নাবিলের পড়া শেষ।সামনের রুমে পড়ে এসে দেখলো লিখি হাত পা নাড়াচ্ছে এখনও।

‘জাগছো যখন,নামাজটা পড়ে নাও’

‘হুম’

নাবিলের কথায় জোর পেলো উঠার।মাথায় হাত দিয়ে চললো ওয়াশরুমের দিকে।চোখে ছিল ঘুমের রেশ, সামনে ঝাপসা দেখছিল বলে ঠাস করে নাবিলের গায়ের সঙ্গে লেগে গেছে এক ধাক্কা।নাবিল ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,’এত ঘুমালে হয়?’

এবার পুরোপুরি হুশ ফিরে এসেছে ওর।চোখ বড় করে সে সত্যি সত্যি ওয়াশরুমে ঢুকেছে এবার।
নাবিল আর ঘুমাবেনা ঠিক করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো।হাজারটা কাজ এসে জমে আছে।এই সব কাজ কমপ্লিট করতে করতে দুপুর বারোটা বাজবে।
লিখি নামাজ পড়ে এবার পুরো বাসায় ঘুরঘুর করছে।নাবিল ঘুমাবেনা বলে সেও ঘুমাবেনা ঠিক করেছে।
কাজ নেই তো খৈ বাজতে হবে।খৈ নেই তো নাবিলকে জ্বালানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
নাবিলকে ইদানিং জ্বালানোর ইচ্ছা করেনা।সে কেমন দুষ্টু হয়ে গেছে।এ কথা ওর মনে পড়লো এক মগ পানি নিয়ে নাবিলের মুখে ঢালার পর।
হুশ আসলো নাবিল এখন আর ঐ নাবিল নেই যে বালিশের মা/র খেয়ে আবার বালিশ দিয়ে মা/রবে।সে এখন বালিশের সাথে চেপে ধরবে, তার মাথায় যে পরিমাণ দুষ্টু বুদ্ধি ঢুকেছে।
পানি ঢালার পর নাবিল হাত দিয়ে ল্যাপটপ টাকে শান্তভাবে সরিয়ে রাখলো,এরপর হাত দিয়ে আবার মাথার চুল থেকে পানি চিপে ফেললো নিচে।তারপর সে মাথা তুলে লিখির দিকে তাকালো।লিখি সরি বলে এক দৌড়ে অন্য রুমে ঢুকে ভেতর দিয়ে দরজা লাগিয়ে ফেলেছে।
নাবিল ওকে ধরতে পিছু পিছু এসেছিল,দরজা বন্ধ দেখে তাতে হাত রেখে বললো,’বের হবেনা ভাবছো?আমি সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবো তোমার,দেখি কতক্ষণ না বেরিয়ে থাকতে পারো।আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন’

লিখি ভয়ে নিচে বসে দরজার নিচ দিয়ে দেখছে নাবিলের পা দেখা যায় কিনা।নাবিল গোল হয়ে দরজার সামনে বসে আছে দেখে লিখির আরও ভয় হলো।গলাটা নামিয়ে বললো,’আপনি এক মগ ঢেলে দিয়েন।ইকুয়েল হবে তাহলে’

‘সকাল সকাল পানি দিয়ে ভেজানো কত বিরক্তিকর তার পরেও সবসময় তুমি সকালেই আমাকে ভেজাবে, এর শাস্তি তোমায় এক মগ দিয়ে দেওয়া যাবেনা।তোমাকে কোলে তুলে বাথটাবে চুবালে শাস্তি পূর্ণ হবে’

লিখির গলা শুকিয়ে গেছে ভয়ে।ঢোক গিলে সেও নিচে বসলো।নাবিলকে বোঝানোর জন্য কত কি সান্ত্বনা দেওয়া শুরু করলো, একটার পর একটা।
একটা সময়ে নাবিল মিষ্টি করে বললো ছুঁয়েও দেখবেনা।লিখি যেন দরজাটা খোলে।লিখির কাছে কথাটা একবার সত্যি মনে হলো তো আরেকবার মিথ্যে।
তাও মনকে বুঝিয়ে সে দরজা আলতো করে খুললো।ওপারে নাবিল নেই বলে দম ফেলে বাইরে পা রাখলো সে।
সেই মানুষটার গায়ের গন্ধ তীব্র আকারে বাতাসে বইছে।লিখি সামনে দেখে যেইনা পেছনে তাকালো ওমনি নাবিল দুহাত খপ করে ধরে ফেললো ওর।সে তো ভয় পেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলছে যেন এক মগেই কাজ সারে।
নাবিল হলো নাছোড়বান্দা,টেনে হিঁচড়ে ওকে নিয়ে গেছে ওয়াশরুমে।সেখানে বালতি থেকে যত মন চাইছিল তত পানি নিয়ে নিয়ে লিখির মাথায় ঢেলেছে।মনমত পানি দিয়ে নাকানিচোবানি খাইয়ে তারপর ক্ষান্ত হলো সে।
লিখি ভেজা বেড়ালের মতন সে আছে নিচে।
নাবিল খিলখিল করে হেসে বললো,’তোমার এই দুষ্টামিতে তালা মে/রে দিলাম।আর জীবনে আমার গায়ে পানি ঢালার আগে হয়ত দশবার ভাববে।’
—–
সকাল সকাল ভিজলে সর্দিটা জলদি ধরে ফেলে।নাবিল দিচ্ছে একটা হাঁচি আর লিখি দুইটা করে।নাবিলের হয়ত সর্দি লাগেনি তবে লিখির লেগে গেলো।নাক মুছতে মুছতে ঘুরেফিরে সেই নাবিলের পাশেই এসে শুয়েছে।নাক টানছে আর বিড়বিড় করে বকা দিচ্ছে ওকে।নাবিল টাকা ঠেলে দিয়ে বললো গিয়ে হিসটাসিন কিনে আনতে।লিখি রাগ করে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে ফেলেছে।এখন ঔষুধ না খেলে তো এই সর্দি আরও বেড়ে যাবে।বাধ্য হয়ে ল্যাপটপ সরিয়ে নাবিল বের হলো ঔষুধ কিনতে।রাগের চোটে লিখি একটা কথাও বলেনি ওর সাথে।
ঔষুধের দোকান একেবারে মামার বাসার ওপারে।বাবার রাখা লোকগুলো তাকে না চিনলেই হয়।ভয়ে ভয়ে সে পথ এগোলো,আসার সময় মাস্কটাও আনতে ভুলে গেছে। মামার বাসার সামনের দোকানটায় বসা ছিল নীল শার্ট পরা সেই গার্ড।বসে বসে চা খাচ্ছিল বিসকুট চুবিয়ে।তিনি নাবিলকে পেছন থেকে দেখেই চিনে ফেলেছেন।নাবিল যখন এসএসসি পরীক্ষা দেয় তখন থেকে তিনি জনাব অনাবিলের হয়ে কাজ করে আসছেন।নাবিলকে কতবার কলেজে নামিয়ে দিয়েছেন গাড়ী করে।ওকে না চিনলে কাকে চিনবেন?
ফোন বের করে সোজা অনাবিলকে কল করলেন তিনি।
অনাবিল মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলেন বলে ফোনটা রুমেই ফেলে রেখে গেছেন।কলটা ধরলো সামিয়া।
কিন্তু ঐ লোকটা সামিয়াকে কিছু বললোনা।শুধু বললো স্যার আসলে যেন জানায়।
সামিয়াও কিছু বুঝতে পারেনি।অনাবিল ফেরার পর তার হাতে ফোন দিয়ে বললেন একজন কল করেছিল।অনাবিল নাম্বার দেখে বুঝতে ওেরেছে কোনো ইনফরমেশন আছে।তাই তিনি দেরি না করে কলব্যাক করলেন।সঙ্গে সঙ্গে লোকটা জানিয়ে দিলো নাবিল এই এলাকাতেই আছে,এবং কোন বাসাতে আছে সেটাও তিনি ধরে ফেলেছেন।
লিখির শরীর মোটামুটি যা ছিল এখন আরও খারাপ।নাবিল আসার পথে নাস্তাও কিনে এনেছে।সর্দির ঔষুধ খেতে খেতে নাবিলকে আবারও বকলো সে।
নাবিল চুপ করে বকা শুনে গেছে।কলিং বেল বাজলো সেসময়ে।
সে তাই লিখিকে রেখে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খোলার পর দেখলো অনাবিলের পাঠানো দুজন লোক এসে হাজির।নাবিলকে না জিজ্ঞেস করেই তারা দুজন ভেতরে ঢুকে গেছে।লিখি লুকিয়ে দেখছিল সব।লোকগুলোর মধ্যে একজন লিখিকে দেখে ফেলেছে এবং চিনেও ফেললো।তারপর সব তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে,লিখি নাবিলের কিছু তো হয়।
নাবিল তাদের বের হয়ে যেতে বললো ঠিক সেসময়ে জনাব অনাবিল আসলেন।তাকে দেখে নাবিল আশ্চর্য হয়ে গেছে,তার মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেছে সব।তিনি বাসায় ঢুকলেন হনহনিয়ে।এরপর নাবিলের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলেন।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার।ইচ্ছে করছিল চড় মে/রে দিতে।কিন্তু নিজেকে সংযত করলেন।
হঠাৎ লিখিকে রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,’বাসায় একা এই মেয়েটার সাথে থাকো নাকি তুমি?’

‘হুম’

‘এই শিক্ষা দিয়েছিলাম?’

‘না’

‘তাহলে কেন করতেছো?’

‘ও আমার স্ত্রী ‘

‘কি বললে? স্ত্রী? বললেই মেনে নিতে হবে?’

নাবিল রুম থেকে খুঁজে এনে রেজিস্টারি কাগজপত্র দেখালো।অনাবিল তো অবাক।এতবড় ঘটনা কিনা তার অজানা রয়ে গেলো এতদিন।কাগজটা চেক করে দেখলেন আসল কাগজ।মাথা তুলে তিনি লিখিকে ধমকে বললেন সামনে আসতে।লিখি ভয়ে ভয়ে নাবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘তোমার বাবা কি চাকরি করে?’

‘ব্যবসা করে’

‘কেমন ব্যবসা?মাসিক আয় কত?’

‘তা তো জানিনা আমি’

‘গাড়ী আছে তোমাদের?জানো ও কার ছেলে?ওর বাড়িঘর দেখছো?জানো নিশ্চশ? নাহলে তো এত জলদি কেউ বিয়ের পিড়িতে বসেনা।আমার নাম শুনেই তো মনে হয় আমার ছেলেকে বিয়ে করে নিছো এক লাফে’

লিখি চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।নাবিল তখন বললো,’আমরা কেউই জানতাম না আমাদের বিয়েটা সত্যি সত্যি হচ্ছে।আমার ভেবেছিলাম নকল’

‘তুমি কোনো কথা বলবেনা,আমাকে অনেক ঘুরিয়েছো আর এখন যে বিয়ের নাটক শুরু করেছো সেই নাটক এখনই বন্ধ করবে।এই মেয়েটা কোনো মতেই আমার বাসায় পা রাখতে পারবেনা।আমি তোমার বিয়ে দিব একমাত্র আমার পছন্দে,আমাদের স্টেটাসের সাথে মিলিয়ে’

‘বাবা তুমি হয়ত জানোনা, ওর বাবা তোমার বরাবরি ‘

‘তা হলেও এই বিয়ে আমি মানিনা।আমার পছন্দ হয়নি ওকে।আমার বড় ছেলের বউ হবে চোখ ধাঁধালো সুন্দরী।তাছাড়া ওর আশে-পাশে চাকরবাকর ভর্তি থাকবে।কই কাউকেই তো দেখছিনা।আর তোমরা এটা কিসের ফ্ল্যাটে উঠেছো?মেয়ের পরিবারের দেওয়া নাকি?’

‘ওর পরিবারের কেউ জানেনা এখনও’

‘জানার দরকারও নেই।এই সম্পর্ক আমি মানিনা।তুমি এই মূহুর্তে আমার সাথে বাড়ি ফিরে যাবে তা নাহলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবো।বিয়ের ভূত কিভাবে নামাতে হয় তা আমার জানা আছে’

‘বাবা আমি গেলে ওকে নিয়ে যাবো’

‘তোমরা দাঁড়িয়ে দেখছো কি?ওকে ধরে নিয়ে আসো আমার সাথে। দরকার হলে বলো করিমকে কল করে ডাকতেছি।ওর বাড়াবাড়ি আজ শেষ দেখে ছাড়বো’

নাবিল হাত ছাড়িয়ে আঙ্গুল তুলে বললো,’যত যাই বলেননা কেন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।এটা অস্বীকার করলেই অস্বীকার হয়ে যাবেনা।কাগজে কলমে বিয়ে হয়েছে আমাদের।আমি নিজের খরচ নিজে চালাতে পারবো।আপনারা যেতে পারেন এখন’

‘তোমার পেছনে কোটি কেটি টাকা ব্যয় করে এতদূর এনেছি,এখন তো তুমি নিশ্চয় নিজের খরচ চালাতে পারবে কিন্তু আমার ও তো চাহিদা আছে।এতদূর কেন পড়িয়েছি তোমাকে?যাতে তুমি আমার মানসম্মান ধরে রাখতে পারো।আর আজ দেখলাম মানসম্মান এর কি ছিরি করেছো।আমি এই কথা জীবনেও পাঁচকান হতে দিব না।তোমাকে আমি ধুম-ধাম করে আমার পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিব।এই মেয়েটার সাথে তোমার ডিভোর্স করাতে আমার পাঁচ মিনিট সময় লাগবেনা।
তার জন্য যদি তার পরিবারকে খবর দিতেও হয় তাও করবো,তাদের যদি টাকা দিয়ে মুখ মা/রতে হয় তাও করবো কিন্তু তোমায় আমি অবিবাহিত রুপে ঘরে ঢোকাবো। বাসায় আজ আমার কিছু কলিগ আসবে।আমি কিছুতেই এই টপিক সামনে আনতে দিব না’
চলবে♥