মনের কোণে পর্ব-৩০+৩১

0
256

#মনের_কোণে🥀
#আফনান_লারা
#পর্ব_৩০
.
নাবিল নাছোড়বান্দা, সে কিছুতেই লিখিকে ছাড়া ঐ বাসায় পা রাখবেনা।
এদিকে জনাব অনাবিল আরও বড় নাছোড় বান্দা।তিনি লিখিকে ধমকে ওর বাবা,ভাইয়ার ঠিকানা নিয়ে নিছেন।তারপর তার লোকদের লাগিয়ে দিয়েছেন কাজে।আজ নাবিলকে না নিয়ে তিনি কোথাও যাবেননা।
লিখির মন ভীষণ খারাপ,ভাইয়া একবার এখানে আসলে ওকে না নিয়ে যাবেননা,এদিকে নাবিলের বাবা তো নিলে ওকে একাই নিবেন। হাঁপিয়ে গিয়ে তিনি একটু বাইরে মামার বাসার দিকে গেছেন পানি আর কিছু খাবার খেতে আর তার লোকদের পাহারা দিতে রেখে গেছেন এখানে।নাবিল আর লিখি দুজনেই ফ্লোরে বসে ছিল।

‘লিখি?’

‘হুম’

‘ কান্না পাচ্ছে তোমার?’

‘হুম’

‘বাবা আজ আলাদা করেই ছাড়বে।ফোন নাম্বারটা দাও তো’

‘কেনো?’

‘যাতে কল করতে পারি’

‘আমাকে ফেলে চলে যাবেন?’

‘আমি বাবার সাথে শেষ অবধি লড়াই করবো তোমাকে নিয়ে যাওয়ার।কিন্তু তোমার পরিবারোর কেউ এসে গেলে আমার হাতে আর কিছু থাকবেনা’

নাবিলের কথা শুনে লিখির মনে হলো সব শেষ।মুখটা ছোট করে সে নাবিলের হাত শক্ত করে ধরলো।
আধঘণ্টা পর অনাবিল ফিরে আসলেন আবার তবে সাথে নিয়ে এসেছেন ওসমানকেও।ওকে কোথায় পেলেন তাই ভেবে লিখি অবাক হলো।
ওসমান বিয়ের কথা জেনে গিয়ে এসেই এক থাপ্পড় মে/রে দিয়েছে লিখির গালে।তারপর শুধু বলেছে ডিভোর্স লেটার এক মাস পর পাঠাবে।
লিখি হাত ছাড়িয়ে নাবিলকে ধরে বললো,’আমি যাব না।কিছু তো করুন’

নাবিলের সামনে বাবার ভাড়া করা লোকের অভাব নেই।সে মুখটা ছোট করে লিখির হাত ছেড়ে বললো,’আমি তোমায় নিয়ে যেতে আসবো লিখি।ততকাল তুমি…..’!

লিখির বড্ড অভিমান হলো।চোখের কোণা মুছে ভাইয়ার সাথে চলে গেলো সে।
ওর পরিারের কেউই বিয়েটা মানেনি, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিল ডিভোর্সের কথা।
নাবিলের তো শুধু বাবা মানেননা।
যেতে যেতে নাবিলের দিকে একবারও তাকায়নি লিখি।তার বিশ্বাস ছিল নাবিল ওকে যেতে দেবেনা কিন্তু নাবিল হঠাৎ মত বদলে নেবে এটা কে জানতো।
নাবিল মন খারাপ করে বসে আছে নিচে।বাবা জয়ের হাসি দিয়ে বললেন গিয়ে গাড়ীতে বসতে,বাসায় মেহমানরা অপেক্ষা করছে।
—–
লিখি গিয়ে তাদের গাড়ীতে বসলো।বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে।খুব কষ্ট হচ্ছে নাবিলের জন্য।সে বাসায় ফিরে যাচ্ছে ওখানে তার সাথে কি হবে সেটা না ভেবে সে ভাবছে নাবিলের কথা।নাবিলকে আর একটিবার দেখার,আর একটা দিন ওর সাথে একই ছাদের নিচে কাটানোর ইচ্ছা তার ভেতরটা জ্বালিয়ে খাচ্ছিলো।
ভাইয়া ড্রাইভারের সাথে বসে বাবাকে কল করে জানিয়ে দিলেন লিখিকে নিয়ে আসছে তারা সবাই।
লিখি জানালায় হাত রেখে চেয়ে আছে ডান পাশে।বাইরে নাবিলকে এক ঝলক দেখা গেলো।মাথা নিচু করে কারে উঠছিল সে।
ওকে শেষবার দেখে লিখির চেখে পানির বাঁধ মানলোনা আর।কেঁদেই ফেললো।ভাইয়া শুনতে পেয়ে তাচ্ছিল্য করে বললেন,’ওসব দুদিনের প্রেম মিটে যাবে’
—-
লিখিদের বাড়ি বরিশালের পশ্চিম কাউনিয়াতে।
পথ শেষ হচ্ছিলোনা।ক্লান্ত হয়ে শেষে লিখি ঘুমিয়ে পড়েছিল গাড়ীতেই।স্বপ্নে সে দেখলো নাবিলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে।অথচ যখন চোখ মেললো চোখের সামনে ফাঁকা সিট আর সামনে ভাইয়াকে দেখে তার স্বপ্নের আর কোনো অস্তিত্ব রইলোনা।ফোনটা খুঁজে চেয়ে রইলো কেবল।নাবিলের নাম্বার তার নেওয়া হয়নি।কল লগ থেকে সেভ করেও লাভ নেই,কারণ ঐ সিমটা নাবিল ফেলে দিয়েছিল,বাবুর থেকে যে সিম নতুন নিয়েছিল সেটার নাম্বার লিখির কাছে নেই।
রাগ হলো ভীষণ।কেনোই বা সে নাবিলের কলের অপেক্ষা করছে??নাবিল কিই বা করবে!যদি করতেই পারতো তবে আজই করে ফেলতে পারতো।সকালটা এত সুন্দর হয়ে শেষটা এত বিদঘুটে হবে তা যদি জানতো সে!!!
পথ শেষই হয়না,লিখির চোখে বিরক্তির ছাপ,দুইটা বছর পরিবার থেকে দূরে থেকে একা বেঁচে থাকা শিখে গিয়েছিল সে।
আর কয়েকটাদিন ভালবাসার কিছু মূহুর্তে ডুব দিয়ে এখন আবারও সেই বিচ্ছিরি জীবনে প্রবেশ।
——
নাবিল বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ফেলেছে।মেহমানদের কারোর সাথে কোনো কথা বললোনা।মা বারবার দরজার দিকে ফিরে লিখির অপেক্ষা করলেন।জনাব অনাবিল লিখিকে মেনে নেবেননা এটা তিনি জানতেন কিন্তু মেনে না নেওয়া এভাবে ফলাবেন তা তাঁর জানা ছিলনা।খুব জানতে ইচ্ছে হলো মেয়েটা কোথায়।
ফোন ও নেই যে বাবুকে কল করে বৃত্তান্ত জানবেন।
তাই কৌতূহল মেটাতে নাবিলের রুমের কাছে এসে দরজার কড়া নেড়ে জানতে চাইলেন লিখি কোথায়।
নাবিল কিছু বললোনা।অনাবিল পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,’তুমি চেনো তাহলে?
তুমিও জানতে সব অথচ বলোনি,তা কি হলো লুকিয়ে?আমি একদিনে সব জেনেই গেলাম’

‘একটা বিয়ের সম্পর্ককে মুখের কথায় ভাঙ্গা যায়না।’

‘যে কাজ মুখের কথায় হয়না,সে কাজ টাকায় হবে।
ওরা যদি াবিলকে মেনেও নেয় তারপরেও আমি তাদের মেনে নিবনা।তার জন্য যত টাকা ঢালতে হয় ঢালবো’

মিসেস সামিয়া বেশি কথা বললেন না।অনাবিলের সাথে মাঝে মাঝে তার কথা বলতে বিরক্ত লাগে।একটা বদমেজাজি লোক তিনি,নিজে যা সঠিক মনে করেন সেটাই পূরণ করেন।নিজেকে তিনি অনেককিছু ভাবেন।আজ লিখির জন্য তার খুব মায়া হলো।মেয়েটার এই পরিণতি তিনি আশা করেননি।

নাবিল রুমে এসে তার আলমারি তে রাখা টাকা গুলো সব পকেটে পুরলো তারপর ড্রয়ার খুলে একটা সিম নিয়ে ফোনে ঢোকালো।বাবুর কাছে যে সিমের নাম্বার আছে ওটা খুলে ফেলেছে,বাবা নাহলে সেটাও ধরে ফেলবে।তারপর নিজের কটা টিশার্ট ব্যাগে পুরে জানালার দিকে তাকালো।থাই গ্লাস,ভাঙলেই গ্রিল।গ্রিল কাটতে হবে তারপর। ঐ ঝামেলা পোহানো যাবেনা। আচ্ছা,বাবা কখন ঘুমাবে?ঘুমালেও তার লোকেরা তো ঘুমাবেনা।রীতিমত বন্দি করে রাখবে সেটা ওর জানা আছে।
——
বাসায় ফেরার পর মা বাবা খুব খুশি হলেন লিখিকে পেয়ে।এতই খুশি যে তারা ওর বিয়ের ব্যাপারটা মুখেই আনেননি।যেন সে অবিবাহিত। লিখিকে পেয়ে বাসায় যেন অনুষ্ঠান চালু হয়ে গেছে।লিখির মন পড়ে আছে ঢাকাশহরে।নাবিল কি করছে সেটা ভাবছে শুধু।মন খারাপ করে নিজের রুমে এসে ফোনে চার্জ লাগালো সবার আগে।বারবার করে চেক করলো কল এসেছে কিনা কোনো।কল তো আসেইনি,তাই ওর খুব করে রাগ হলো নাবিলের ওপর। ফোন রেখে বালিশে মাথা রেখে শুতেই তখন মা আসলো হাতে খাবার নিয়ে।

‘মা আমার খিধে নেই’

‘এতদিন পর আমার কাছে ফিরলি,কোথায় কোলে ঢুকে বসে থাকবি,তা না করে দূরে দূরে থাকছিস!’

‘মা আমার কিছু ভাল লাগছেনা,আমাকে একা থাকতে দাও’

মা কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,’ছেলেটা দেখতে কেমন?’

লিখি মাথা তুলে বললো,’তোমায় কে জানালো?’

‘সবাই জানে।ছেলেরা তো মনে হয় আমাদের মতন বড়লোক’

‘তাতে আর কি হলো?দু পক্ষ রাজিনা’

‘আরে সেটা কদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।ছেলে দেখতে কেমন ওটা বল।ছবি আছে তোর কাছে?’

‘নেই’

‘তো দেখতে কেমন সেটা তো বলবি’

‘সুন্দর আছে,আমার চেয়ে একটু বেশি। আর লম্বাও ঠিকঠাক।’

‘তাহলে আর কি চাই!!!সুন্দর জামাই পেয়ে গোছি।তোর বাবা,ভাইয়া মেনে নিলেই হলো’

লিখি মন খারাপ করে ফোনের দিকে তাকালো।নাবিলের তো কল আর আসলোই না।
‘বুদ্ধি করে যদি বাবুর নাম্বারটা নিতাম তাহলে ওনার নাম্বারটা পেয়ে যেতাম অনায়াসেই।
আচ্ছা আমি কেন ওনার কলের অপেক্ষা করছি?উনি তো ভাল না।উনি আমায় একা চলে আসতে দিলেন।একবার আটকালেন ও না,
নিজের বাবার কাছে হার মানলেন,উনি একটা স্বার্থপর!!’

‘কিরে বিড়বিড় করে কাকে বকিস?’

‘ওনাকে’

‘কেন?সে কি করলো?’

‘কিছুনা,বাদ দাও।বাবা কোথায়?’

‘তোর বাবার স্বভাব তো জানিস!!তোর জন্য ছেলে দেখতেছে’

‘আবার???’
——
গভীর রাত।নাবিল বসে আছে বরিশাল যাবার অপেক্ষাতে।এদিকে একটা কল যে করবে ফোনে ব্যালেন্স ও নেই।বাবা চোখে চোখে রাখছে।
ইমারজেন্সি ব্যালেন্স ও নিয়ে রাখা।একেবারে বা/জে যে সিম ছিল ওটাই পুরেছে সে।
রাত দশটা বাজার পর মা দরজায় কড়া নেড়ে বললেন খাবার খেয়ে নিতে।নাবিল বললো সে খাবেনা।
দরজা খোলার ভয়ে পেটে খিধে থাকার পরেও সে কিছু খায়নি।
বাইরে বাবার লোকেরা সব পাহারা দিচ্ছে।বের হতে হলে ঐ মেহমান থাকতে থাকতে বের হতে হবে।একা বের হতে গেলেই ধরা খাবে।বাবা এগারোটার সময় গোসল করতে যান।ঐসময়টা কাজে লাগাতে হবে।মায়ের সামনে পড়লেও সমস্যা নেই কিন্তু বাবার সামনে পড়া যাবেনা কিছুতেই।
——-
লিখি না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।নাবিলকে জ্বালানো,তার দুষ্টুমিতে ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো, সব কিছুর স্মৃতি তাকে এই রাতে এসে ধরেছে।এই ব্যাথা থেকে সে তখনই মুক্তি পাবে যখন নাবিলের একটা কল আসবে।কিন্তু এসব তার কেবলই ভুল ধারণা।নাবিলের কল আসেনি।তবে কি নাবিল ভুলে গেলো সব?
—-
ভোরবেলা অনেক সময় দুঃসংবাদ নিয়ে আসে,, কখনও বা সুসংবাদ নিয়ে আসে।
লিখি সারারাত ভাবনাতে কাটিয়ে সেই ভোরের দিকে এসে একটু ঘুমোলো।ফোনে চার্জ হয়ে আছে ১০০%।
কতবার যে চেক করেছিল কল আসে কিনা।
৫টা বাজার দশ মিনিট পর তার ফোন অবশেষে বাজলো।তখন আবার সে গভীর ঘুমে ছিল।ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেলো তবে তার ঘুম ভাঙ্গলো তাও চোখ মেলে একবার চেয়ে আবার শুয়ে পড়েছে।ফোন আবার বাজলো এরপর তার হুশ এসেছে যে এটা নাবিলের কল হতে পারে।চট করে লাফিয়ে উঠে বসে রিসিভ করলো জলদি।

‘কল ধরতে এতক্ষণ লাগে?মেইন স্টেশনে আছি।তোমার বাসা কোন জায়গায়?’

‘আমি তো বরিশালের’

‘ওটাই!আমি বরিশালের স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি তোমার বাসা কোন জায়গায় সেটা বলো’

‘কাউনিয়া,পশ্চিম কাউনিয়া ‘

নাবিল কল কেটে সিনএজি থামালো।

লিখি ফোনের দিকে চেয়ে হা করে তাকিয়ে বসে বসে ভাবছে এসব সত্যি নাকি মিথ্যা??সত্যি কি নাবিল আসছে?
চোখ ডলে ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখ- মুখে পানি দিয়ে নিজের হুশ ফিরিয়ে এনে ফোন চেক করে দেখলো সত্যি তাই।পাক্কা এক মিনিট সে নাবিলের সাথেই কথা বলেছে,সত্যি কল এসেছিল।
চোখ মুখ মুছে ছুটে সে রুম থেকে বের হলো।
বাবা -মা নিজের রুমে,ভাইয়া তার রুমে।সে ধীরে ধীরে গেটের দিকে গেলো।দারোয়ান ওকে থামিয়ে বললো,’ম্যাডাম আপনাকে বের হতে দিতে মানা আছে।বাইরে যেতে পারবেননা ‘
—–
‘এ্যা?কোন বাড়ি?রুহুল্যার বাড়ি?’

‘রুহুল্যা কে আবার?আপনি রুহুল আমিনকে চেনেন?’

‘রুহুল্যা কে হয় তোমার?’

‘শ্বশুর’

‘হৌর??’

‘হৌর কি আবার!!আপনি যাবেন নাকি যাবেননা?’

‘১০০টাহা দিবেন তাহলে হ্যার বাড়িত যামু’

‘কিসব বলতেছে কিছু বুঝতেছিনা,
লিখিকে আবার ফোন দিতে হবে মনে হয়’

‘হরমু আনে কি?’

‘এটা মানে কি?হ্যালো লিখি!!হরমু আনে কি মানে কি???’

লিখি কানে ফোন ধরে দারোয়ানের দিকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে ছিল।নাবিলের প্রশ্ন শুনে বললো,’হরমু আনে কি মানে হলো তারপর কি করবো’

‘ওহ।তারপর আমাকে রুহুল আমিনের বাসায় নিয়ে যাবেন।১০০টাকাই দিবো’
—-
লিখি ফোন রেখে বললো,’এই বাড়ির জামাই আসতেছে,গেট খোলেন মামা’

‘আপনার বিয়ে হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ,গেট খোলেন।তাকে বলবেন উপরের তলায় আসতে। আপনার যেহেতু আমাকে বিশ্বাস হচ্ছেনা আমি বাসায় চলে যাচ্ছি’

লিখি চলে গেলো।ওর কথামতন দারোয়ান গেট খুলে অপেক্ষা করতে লাগছে নাবিলের আসার।সিএনজি আলা মনমত বরিশালের ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে।আর নাবিল গালে হাত দিয়ে ভাবছে ঐ বাসায় ঢুকতে দিবে কিনা

বাসাটা বেশি দূরে ছিলনা।অল্প সময় লেগেছে আসতে।কাউনিয়াতে নেমে রুহুল আমিনের বাসা দেখে ও ইয়া বড় হা করে তাকালো।এত বড় বাড়ির মেয়ে লিখি!!!বাবা এই বাড়ি দেখলে লিখির সাথে জীবনেও ডিভোর্স করাতোনা।’

নাবিল সিএনজিআলাকে টাকা দিয়ে দেখলো দারোয়ান ওকে সালাম দিয়ে ভেতরে যেতে বলতেছে।সে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে পা রাখলো ভেতরে।দু পা এগোতেই দোতলা থেকে লিখি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।পরশু রাতের নাবিলের ধরার চেয়েও শক্ত করে ধরেছে সে।নাবিলের চোখ বন্ধ হয়ে গেছে।লিখির গায়ের উষ্ণতা ওর এত বড় জার্নি লাঘব করে দিলো।

চলবে♥

#মনের_কোণে🥀
#আফনান_লারা
#পর্ব_৩১
.
দারোয়ান নজির লজ্জা পেয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলো সবাইকে নাবিলের আসার খবর দিতে।
লিখি মুখ গুজে চুপ করে আছে,তার কোনো নড়চড় নাই।নাবিল ওর মাথায় হাত রেখে ধীরে বললো,’বাবার লোকদের সামনে, তোমার ভাইয়ার সামনে আমি তোমায় নিয়ে যেতে পারতাম না।যার কারণে মানুষ কমানোর জন্য আমি তোমায় যেতে দিয়েছি।দেখো আমি বাসায় থাকিনি।তোমার খোঁজে ঠিক চলে এলাম।আমাকে ভুল বুঝেছো হয়ত’

‘অনেক’

‘এখন ছাড়ো,কেউ দেখলে কি ভাববে?’

নাবিলের কথা শুনে লিখির হুশ ফিরলো।ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে।
নাবিলের মুখে ওকে ফিরে পাবার হাসি ভাসছিল কেবল।নজিরের ডাকে লিখির বাবা আর মা অবাক হয়ে কৌতূহল নিয়ে ছুটে আসলেন দেখতে।সে বলতেছে লিখির নাকি বর এসেছে।এটা কি আদৌ সত্যি??
সত্যি নাকি মিথ্যা তা যাচাই করতে তারা ছুটে এসেছিলেন বাসার বাইরে।এসে দেখলেন সত্যি তাই।লিখির পাশে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
লিখি বাবাকে দেখে ভয় পেয়ে নাবিলের হাতটা ধরে ফেললো।বাবা কাছে আসতেই নাবিল সালাম দিলো তাকে।তিনি সালাম নিলেননা নাকি মনে মনে নিলেন,বোঝা গেলোনা।শুধু দেখে যাচ্ছেন নাবিলকে।নাবিল লিখির মাকেও সালাম দিলো।তিনি অবশ্য সালাম নিয়েছেন এবং মুচকি মুচকি হাসছেন নাবিলকে দেখে।লিখি মাথা নিচু করে ছিল।বাবা নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাগানে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে গেছেন।মা ইশারা করলো নাবিলকে।নাবিল ও গিয়ে চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালো।রুহুল আমিন এখনও দেখছিলেন ওকে।লিখি মায়ের পাশে গিয়ে জানতে চাইলো এবার কি হবে।মা চুপ থাকতে বলেছে।
——–
‘তোমার বাবা কি করে?’

‘ব্যবসা’

‘আমাদের মতন ব্রান্ডেড নাকি অখ্যাত’

‘বিখ্যাত ‘

‘তোমার পরিবার নাকি আমার মেয়েকে মানে নাই?’

‘হুম,এটা সত্যি।কিন্তু আমার মা মেনে নিয়েছে’

‘বাড়ির কর্তা না মানলে বাড়ির পেয়াদা মেনে কি হবে?’

‘বাবাও মেনে যাবে’

‘কবে?’

‘সময় লাগবে, আমার মনে হয় আপনাদের দু পক্ষের দেখা সাক্ষাৎ হয়ে গেলে….. ‘

‘এসব ব্যাপারে ছেলেরা আগায়।আমি মেয়ের বাপ হয়ে কেনো তোমার বাবার জন্য লাইনে দাঁড়াবো?তোমার বাবা কি পারেননা এখানে এসে দেখা করতে?আমাদের কি কিছুর অভাব আছে যে উনি ভাব দেখাচ্ছেন?আমার তো মনে হয় না আমাদের মতন তোমার বাবার ব্যবসা।যদি খবর পেয়ে দেখি মাসে আমি যত ইনকাম করি তার চেয়ে তোমার বাবা একটু কম ইনকাম করে তবে এই বিয়ে আমি মানবোই না।আমি আমার মেয়ের জন্য কোটিপতি ছেলের পরিবার খুঁজছি সেটা জানতে?তোমায় যে মেনে নেবো তার কারণ তো দেখাতে হবে তবে’

নাবিল লিখির দিকে তাকালো।দুজনে মনে মনে বললো তাদের দুই পরিবার একই ম্যাটেরিয়ালের।
দুজনেই নিশ্বাস ফেললো তারপর।
—–
রুহুল আমিন নাবিলকে বসতে দিলেননা।বললেন বাবাকে কল করে এখানে আসতে বলতে।

‘বাবা এখন মানছেনা।আমার মনে হয় আপনারা দুজনে কথা বললে ভাল হবে।কল ধরিয়ে দিবো?’

‘ঠিক আছে।তবে সময় দেখছো?ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে।আমি জীবনে এ সময়ে উঠিনা।নজিরের ডাকে উঠেছি। তোমার বাবা বুঝি এত সকালে ওঠে?’

‘তাও ঠিক।বাবা ছয় টার পর ওঠেন।তাহলে ততক্ষণ এখানে একটু বসি?’

রুহুল আমিন ব্রু কুঁচকালেন।তারপর লিখির দিকে তাকিয়ে বললেন,’দাঁড়িয়ে দেখছো কি?আমি বসে বসে এই ছেলের মুখ দেখবো?ওকে ঘরে নিয়ে যাও’

লিখি ভীষণ খুশি হলো।মন চাইছিল বাবাকে ধরে চুমু খেতে।নাবিলের হাত ধরে সঙ্গে সঙ্গে সে নিয়ে গেলো বাসার ভেতর।মা ওনার পাশে বসে বললেন,’তুমি কি মেনে নিয়েছো?’

‘আমি একটু ভাব নিয়ে থাকবো।আগে দেখি ছেলে আসলেই আমাদের মতন বড়লোক কিনা।তারপর যা দেখার দেখা যাবে’

লিখির রুমে এসেই ব্যাগটা টেবিলে রেখে দুম করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে নাবিল।চোখে ঘুমের আলমারি পুরে আছে।
সারারাত বাসের জার্নিতে ঠিকভাবে ঘুমটাই হয়নি।লিখি তো নাবিলকে পেয়ে কত খুশি হয়েছে।ইচ্ছে করছে আরও একবার জড়িয়ে ধরতে ওকে।দেরি করা ঠিক হবেনা ভেবে সে বিছানায় উঠে নিচু হয়ে নাবিলের পিঠ জড়িয়ে ধরলো।নাবিল তো অবাক।মাথা না তুলেই বললো,’একদিনে একেবারে দিওয়ানা হয়ে গেলে?’

‘অনেক মিস করেছি”

‘সরো।হাঁড় ভাঙবে এবার,মুটকি!’

লিখি উঠে ওর পিঠে ঠাস করে একটা চড় মে /রে বললো,’আমি মুটকি?আর ঐ বাড়িওয়ালার মেয়ে চিকনি চামেলী?’

‘হ্যাঁ’

লিখি কটা চিমটি কেটে উঠে চলে গেলো।নাবিল মিটমিট করে হাসছে।এত ক্লান্ত যে চোখ মেলে কিছু দেখার সাধ্য কুলিয়ে পারছেনা।

লিখি মায়ের কাছে গিয়ে জানতে চাইলো নাবিলকে কি খেতে দেবে।

‘তোর বাবা তো জানিস মনের দিক দিয়ে বিশাল মনের মানুষ।নজির আর মনিরকে কাঁচা বাজারে পাঠিয়েছে বড় বড় রুই কাতল,মুরগী -খাসি কিনে আনতে।বলেছে সকালের খাবার যেন ফাটাফাটি হয়’

‘কি বলছো!!বাবা কি ওনাকে মেনে নিয়েছে?’

‘শোন মেনে নেবার কথানা।তিনি নাবিলের ব্যাপারে খবর নিতে কাল ঢাকার এক লোককে ধরিয়েছিল।ঐ লোক নাকি জানিয়েছে নাবিল আসলে কার ছেলে।নাম শুনে সে শুরুতেই বলে দিয়েছে বিশাল বড়লোক।তাও আরও খবর জেনে আজ জানাবে বলেছে।এসব দেখে যা খবর তোর বাবার কানে এসেছে মনে হয় মানতে বাধ্য।যেমন ছেলে চাইছিল তেমন পেয়ে যাওয়ার আবাস পেয়েছে বলেই খাতির বাড়িয়ে দিছে।

লিখি আবারও ছুট লাগালো।নাবিল তখন গভীর ঘুমে।কিন্তু এই সুখবর তাকে তো জানাতেই হবে।হাতে কর্ণফ্ল্যাক্সের প্যাকেট নিয়ে নাবিলের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’বাবা মনে হয় রাজি’

নাবিল শুনলোনা কিন্তু ঘুমের ঘোরে লিখির চুল শক্ত করে ধরে ফেললো।লিখি মাথাটা এনে এখন আর নিতে পারছেনা।টানতে টানতে ব্যর্থ হয়ে শেষে চেঁচিয়ে বললো,’ছাড়ুন’

নাবিল চোখ মেলে আস্তে করে বললো,’আজ একটু শান্তি দাও।সবসময় ভোরেই কেন তোমায় এসে আমায় জ্বালাতে হবে?’

‘আরে আমার চুল!!’

‘বকা দিচ্ছো?’

‘না।সত্যি আমার চুল আটকেছে।ছাড়ুন।’

নাবিল আরও টান দিয়ে মুখটা বালিশের দিকে গুজে ফেললো।শেষে লিখি নাবিলের নাক টিপে ধরে বললো,’সরি’

নাবিলের তো দম গেছে আটকে।লাফ দিয়ে উঠে বসে বললো,’কি হয়েছে?কার হয়েছে?কেন হয়েছে?’

‘কারো কিছু হয়নি, আমার চুল ধরে ঘুমাচ্ছিলেন সেটা ছাড়াতে এমনটা করলাম’

‘তোমার চুল আমার হাতে আসলো কি করে? নিশ্চয় পানি ঢালতে এসেছিলে?’

‘একদম না।এই ভুল করতাম না।আপনাকে চিনি।পরে বাবার সামনে আমায় নিয়ে পানিতে চুবাতেন।আমি এসেছি খবর জানাতে’

‘কিসের খবর?’

‘এতবার বলতে পারবোনা’

লিখি ভেংচি কেটে চলে গেলো।
——-
বিশাল আয়োজন করা হয়েছে নাবিলের জন্য।নাবিল নিজের নাম্বার থেকে বাবার নাম্বারে কল করলো সময় নিয়ে।এই নাম্বার বাবার কাছে সেভ করা ছিল বলে তিনি দেখেই রিসিভ করলেন।

গম্ভীর সুরে বললেন,’কোথায় তুমি?’

‘বরিশাল’

‘এতদূর চলে গেছো?’

‘বাবা এখন এসব বলার সময় না।এখন তুুমি লিখির বাবার সাথে কথা বলবে?’

‘আমি কেন বলবো?বিয়ের ব্যাপারে আগে মেয়ের বাবারা কথা বলে।তাছাড়া ওরা কেমন স্টেটাসের সেটা তো জানা হয়নি আমার।কিছু বড়লোক ব্যবসায়ী আছে সারাদিন পেত পেত করে পান চিবোয়।ঐ টাইপের না তো?’

কথাটা শুনে নাবিল মাথা বাঁকিয়ে বাগানের দিকে তাকালো।সত্যি তাই,লিখির বাবা পান চিবোচ্ছেন।ঢোক গিলে সে বললো,’পান খাওয়া তো ভাল বাবা।মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়,ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী,দাঁত ব্যাথা লাঘব হয়’

‘শাট আপ!আমাকে পান পাতার উপকারীতা জানাতে হবেনা তোমায়।এরকম বেয়াই আমার লাগবেনা’

‘বাবা, পান খাওয়া যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার ‘

‘তাছাড়া তার চালচলন যদি আমাদের মতন না হয়?লুঙ্গি পরে থাকে নাকি সারাক্ষণ? ‘

নাবিল লিখির বাবার দিকে আবারও তাকালো।তাকিয়ে যা দেখলো তাতে ওর মাথায় হাত চলে গেছে।দম ফেলে বললো,’বাবা ড্রেস আপে কি সমস্যা তোমার?একটা মানুষের ব্যাক্তিত্ব হলো আসল’

‘আমি তার বেয়াই হবো আমাকে তো আমার মতন বেয়াই পেতে হবে’

‘আমি ছেলে তাই বলে কি আমি ছেলেকে বিয়ে করবো??’

‘এটা কেমন উদাহরণ? ‘

‘ঠিকই বলেছি।সব কিছুতে সমান সমান খুঁজতে হয়না।তোমার জন্য জরুরি ছিল লিখিদের সম্পদ।এখন সেটা বরাবর পেয়েছো তাহলে খুঁত কেন খুঁজছো বাবা?বাদ দাও এবার,অনেক তো হলো”

কথাটা বলে নাবিল রাগ করে কল কেটে দিয়েছে।লিখি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর জন্য তৈরি করা খাবার গুলোর লবণ ঠিক আছে কিনা টেস্ট করছিল।নাবিলকে মন খারাপ করে কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে জানতে চাইলো কি হয়েছে আবার।নাবিল তাকে কিছু না বলেই চলে গেছে রুমের ভেতর।
চলবে♥