#মন_একে_একে_দুই
#পর্ব_০১
#লেখনীতেঃ–#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘এইযে মিস! আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করবেন আমায়?’
গায়ের হলুদের অনুষ্ঠানে ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে স্টেজে বসা কনেকে দেখার চেষ্টা করছিল। তার মধ্যে আচমকা কারো গলার আওয়াজ শুনে প্রাহী পিছন ফিরে তাকালো। দেখলো অনুষ্ঠানের হালকা হলদে আলোয় ওর থেকে একটু দূরে সাদা টিশার্ট আর ওফ হোয়াইট খাকি প্যান্ট পরিহিত বেশ লম্বা গড়নের একজন দাড়িয়ে আছে। প্রাহী সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে একটু অবাক হলো। গায়ের হলুদের অনুষ্ঠানে যেখানে সব ছেলেরা পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে এই লোক টিশার্ট আর প্যান্ট পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন! আপাতত ও এইসব চিন্তা বাদ দিয়ে সামনে দাঁড়ানো লোকটার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
– ‘জ্বী? আমাকে বলছেন?’
লোকটা শান্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
– ‘আপনি ছাড়া আমার সামনে আর কেউ আছে?’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝালো। লোকটা গমগমে আওয়াজে বললো, ‘মুখে বলুন।’
প্রাহী সাথে সাথেই বললো, ‘না নেই।’
– ‘তাহলে কথাটা আপনাকেই বলেছি নিশ্চয়ই?’
প্রাহী চোখ পিটপিট করে বলে উঠলো, ‘জ্বী!’
এবার লোকটা ওর দিকে আবারও ঝুঁকে বলে উঠলো,
– ‘তাহলে আমার উত্তরটা দিন ঘামপরী?’
ঘামপরী! লোকটা ওকে এই কথাটা কেন বললো? প্রিয়ন্তী ভ্রু কুঁচকে লোকটার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ঘামপরী?’
লোকটা ওর সরু নাকের দিক তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো, ‘হু।’
প্রাহী কিছুটা বিস্মিত হলো। লোকটা ওকে এই নামে ডাকছে কেন? ও ঘামাচ্ছে এজন্য! অনুষ্ঠানে কারেন্ট নেই বিধায় জেনারেটর চালু হলেও সেটা দিয়ে কোনো রকম বিয়ে বাড়িতে আলোটা জ্বলছে শুধু। ফ্যানের বাতাস তেমনভাবে গায়ে লাগছে না। তাই কম বেশি সবাইই গরমে অস্থির হয়ে আছে।
তার মধ্যে প্রাহী পরিচিত কাউকেই আশেপাশে দেখছে না বিধায় ওর একটু অস্বস্তি হচ্ছে। টেনশন আর অস্বস্তিজনক পরিবেশে ও বেশ ঘামায়। যেমন এখন এই অচেনা একটা লোকের এমন অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন আর কথাবার্তায় ও আরও অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছে। যার দরুন ওর মুখ, নাকের ডোগা, ঠোঁটের উপরিভাগ থেকে থেকে ঘেমে উঠছে।
প্রাহী লোকটার দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘আপনি আমায় এই নামে ডাকছেন কেন?’
– ‘কোন নামে?’
– ‘ঘামপরী! এই নামে?’
লোকটা ওর দিকে ঝুঁকে এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন নামটা পছন্দ হয়নি? পছন্দ না হলেও কিছু করার নেই। আমি আপনায় এই নামেই ডাকবো।’
প্রাহী আবারও ঠোঁটটা হালকা ভিজিয়ে বললো,
– ‘কিন্তু কেন?’
লোকটা ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ওর দিকে গভীর দৃষ্টিত তাকিয়ে রয়েছে। প্রিয়ন্তী আবারও শাড়ির আঁচল দিয়ে নাকের ডগার ঘাম মুছতে যাবে তার আগেই লোকটা রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘মুছবেন না।’
প্রাহী ভড়কে উঠলো। দেখলো সামনে তাকানো লোকটা ওর দিক গভীর দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রয়েছে। লোকটা যে ওর মুখের প্রত্যেকটা অঙ্গ খুঁটে খুঁটে দেখছে এটা ও বেশ বুঝতে পারছে। ও হালকা ঢোক গিলে আলতো কন্ঠে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কে?’
লোকটা ওর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললো,
– ‘গায়ে হলুদের দাওয়াতে এসেছি মেহমান বলতে পারেন।’
– ‘আপনি মেয়েপক্ষের না ছেলেপক্ষের?’
– ‘দুটোই।’
প্রাহী ভ্রু কুঁচকালো। মনে মনে বললো, এই লোক উভয় পক্ষের লোক? কিন্তু কিভাবে! প্রিয়ন্তী আশ্চার্যজনিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘তাহলে বাড়ির ভিতর বা অনুষ্ঠানে না যেয়ে এখানে কি করছেন?’
– ‘আপাতত বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি আপনাকে।’
প্রিয়ন্তী এবার বেশ বিরক্ত হলো, কে এভাবে প্রথম সাক্ষাতেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়! তাও আবার সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা মেয়েকে! অদ্ভুত তো! মজা করছে নাকি ওর সাথে এই লোক! না এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবেনা। ও ভাবলো ভিতরে চলে যাবে। যেয়ে ওর বান্ধবীকে খুঁজে বের করে ওর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে। এমনিতেই রাত হয়ে গিয়েছে তার মধ্যে আবার এই অদ্ভুত লোকের অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথাবার্তা ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে বরং ও ওর বান্ধবী শিমলার সাথে দেখা করে বাসায় চলে যাক তাও ভালো।
যেই ভাবা সেই কাজ। প্রিয়ন্তী যেই না পা চালালো ভিতরের দিক যাওয়ার জন্য তার আগেই খপ করে কেউ ওর হাতটা চেপে ধরলো।প্রিয়ন্তী এবার বেশ ভয়ে হালকা কেঁপে উঠলো। আস্তে করে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো লোকটা ওর বাম হাতের কব্জি চেপে ধরেছে। ও বেশ অবাক হলো। লোকটা ওর হাত ধরেছে কেন?প্রিয়ন্তী কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘হা…হাত ধরেছেন কেন?’
লোকটা ওর দিকে আবারও ঝুঁকে বললো, ‘উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন?’
প্রাহী এবার বিরক্তিভরা কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আরে মশাই কিসের উত্তর দিব? হাতটা ছাড়ুন আমার।’
– ‘ছাড়ব না’।
ও এবার অসহায় কন্ঠে লোকটার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
– ‘আমার একটু ভিতরে যেতে হবে প্লিজ আমার হাতটা ছাড়ুন।’
লোকটা ওর দিক আবারও হালকা ঝুঁকে বলে উঠলো, ‘ছেড়ে দিব! ছেড়ে দিলে যদি আর খুজে না পাই?’
আকস্মিক এমন কথায় প্রাহী খানিকটা কেঁপে উঠলো। লোকটার এই কথার মাঝে কি ছিল ও জানেনা। কিন্তু কথাটা শুনে ও কিছুটা স্তব্ধ হয়ে গেলো। হালকা আবছা আলোয় ও এবার ঘাড় হালকা উঁচু করে লোকটার চোখে চোখ রাখলো। ঠিক তখনই হালকা ঝাপসা আলোকে দূরে সরিয়ে গাঢ় সোনালি রঙ সহ আরও রঙ বেরঙের আলোয় পুরোটা অনুষ্ঠান আবার আগের মত ঝলমলিয়ে উঠেছে। তার মানে কারেন্ট চলে এসেছে!
বিয়ে বাড়ির পূর্ণ আলোয় প্রাহী এবার ওর সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। লোকটা ওর চেয়ে অনেক লম্বা প্রায় ছয় ফিটের কাছাকাছি তো হবেই! মুখে তেমন দাড়ি নেই তীক্ষ্ণ চোয়াল, চওড়া কাঁধ, পেটানো শরীর, মাসেল আছে যা টিশার্টের উপর দিয়েও বোঝা যাচ্ছে, সিল্কি চুল যার কিছু অংশ কপালে এসে ঠেকেছে, সরু নাক,কালচে মেরুন রঙের ঠোঁট যার বামপাশে ছোটো একটা তিল, আর একজোড়া টানা টানা চোখ।
প্রাহী বেশ অবাক হলো ছেলেদের চোখ বুঝি এত সুন্দর হয়!এই লোকের চোখ একদম হরিণের চোখের মতো! মায়াভরা বড় টানা টানা চোখ। যেন সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে বেশ নিপুণভাবে চোখজোড়ার কারুকার্য করে মানুষটার অক্ষিকোটরে বসিয়েছেন। গভীর চোখজোড়ার উপরে একজোড়া কালো মোটা ভ্রু। বাম পাশের ভ্রুর নিচে একটা কুচকুচে কালো তিল, আর ডান চোখের পাশে একটা কালো তিল যা লোকটার চেহারার সৌন্দর্যটাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
হুট করে একটা জিনিস লক্ষ্য করে প্রাহী নাক মুখ কুঁচকালো।লোকটা ফর্সা। ফর্সা বলতে একটু বেশিই ফর্সা। একদম ধবধবে ফর্সা যেটাকে বলে। এই লোক মনে হয় বিদেশী। প্রাহী এবার লোকটা যেই হাত দিয়ে ওর হাত ধরে রেখেছে সেদিকে তাকালো। দেখলো লোকটার হাত ওর হাত থেকে দ্বিগুণ সাদা। প্রাহী নাক মুখ কুঁচকালো। ছেলে মানুষের এত ফর্সা হতে হবে কেন! ও তো এই ছেলের ধারে কাছেও নেই। বরং এই ছেলের পাশে দাঁড়ালে ওকে মনে হবে পাতিলের কালি। কারণ প্রাহীর গায়ের রঙ মিষ্টি ফর্সা আর উজ্জ্বল শ্যামলার মাঝামাঝি বলা চলে। সেখানে এই ছেলের কাছে ও কিছুই না!
এতক্ষনের মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চেহারাটা হঠাৎ নাক মুখ কুঁচকে ফেললো দেখে লোকটা ওকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘বিড়ালের মতো নাক মুখ কুঁচকে আছেন কেন মিস?’
প্রাহী হালকা গাল ফুলিয়ে বললো, ‘আমি বিড়াল নই।’
– ‘তাহলে নাক মুখ কুঁচকে রেখেছেন কেন? আমায় পছন্দ হয়নি?’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘তেমন কিছুনা।’
লোকটা এবার হালকা আওয়াজে বললো, ‘তাহলে ধরে নেব আপনার আমায় পছন্দ হয়েছে?’
প্রাহী আবারও লোকটার কথায় নড়ে উঠলো। এখনও লোকটা ওর হাত ছাড়েনি। প্রিয়ন্তী লোকটাকে এবার একটু সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কি আমায় চিনেন?’
লোকটা দায়সারা কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘হুম।’
প্রাহী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই লোক ওকে চিনে! কিন্তু কিভাবে! ও তো এই লোককে চিনে না! তাহলে? প্রাহী আবারও ঠোঁটে ভিজিয়ে লোকটাকে বললো,
– ‘কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনিনা জানিনা! কখনও দেখিও নি! আর আপনি আমায় চিনেনই বা কিভাবে!’
লোকটা মৃদু হেসে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, -‘কিভাবে চিনি তা না হয় আপাতত থাক। আর আমায় চিনেন না কোনো অসুবিধে নেই এখন থেকে প্রায়ই দেখা হবে সাথে অল্প অল্প করে চেনাজানাও হবে।’
প্রাহী আবারও অস্বস্তিতে পড়ে গেলো লোকটার কথায়। অসহায় ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকাতেই দেখলো শিমলা এক হাতে শাড়ির কুঁচি ধরে আরেক হাতে ফুলের ডালা হাতে নিয়ে কাউকে খুঁজছে। ওকে দেখে প্রাহী যেনো একটু স্বস্তি পেল।
প্রাহী শিমলাকে গলা উঁচিয়ে ডাকতে যাবে তার আগে খেয়াল করলো লোকটার হাতের ভাঁজে এখনও ওর হাত আটকে আছে। প্রাহী এবার লোকটার দিকে তাকিয়ে অনুরোধের স্বরে বললো, -‘দেখুন হাতটা ছাড়ুন প্লিজ!’
কিন্তু এই লোক হাত ছাড়বে কি? উনি এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাহী আবারও করুণস্বরে বললো, ‘দেখুন আশেপাশে অনেক লোকজন। এভাবে হাত ধরে থাকলে অনেকেই অনেক কথা বলতে পারে। তাছাড়া আমারও এখন ওদিকে যাওয়াটা জরুরি। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন! প্লিজ!’
লোকটা হয়তো এবার দয়া হলো ওর প্রতি। আস্তে করে প্রাহীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে আবারও ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে জোরে টান মারলো৷ যার দরুন প্রাহী লোকটার বুকে মুখ থুবড়ে পড়তে যেয়েও কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়েছে। হঠাৎ এমন একটা কান্ডে ও মাথা উঁচু করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ও টের পেলো লোকটা ওর কানের কাছে মাথা ঝুকে ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আপাতত ছেড়ে দিলেও পুরোপুরি ছাড়ছি না।’
এই বলেই লোকটা ওর থেকে কিছুটা দূরে যেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।প্রাহীর এখন শরীরটা মৃদু কাঁপছে। লোকটা কথা বলার সময় তার গভীর নিশ্বাস ওর ঘাড়ে আছড়ে পড়ছিল। বুকের ভিতরের নরম মাংসপিণ্ড টা যে বেশ জোড়ে স্বরে লাফাচ্ছে তা ও বেশ টের পাচ্ছে। না আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাবেনা। ও এবার তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ভীড় ঠেলে ভিতরের দিক যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় আরেকবার পিছে তাকিয়ে দেখলো লোকটা এখনও আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিক তাকিয়ে রয়েছে।
প্রাহী কিছুটা দৌড়ে আসার কারণে শিমলার গায়ে হালকা হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এদিকে আচমকা গায়ে ধাক্কা লাগার দরুন শিমলার হাতের ফোনটা পড়ে গেলো। শিমলা এবার কটমট দৃষ্টিতে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘এরকম দৌড়ে আসার কি দরকার ছিল? ভূত দেখেছিস নাকি?
প্রাহী শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে আলতো কন্ঠে বললো, ‘সরি রে। আচ্ছা শোন!’
– ‘হুম বল।’ শিমলা ফোন তুলতে তুলতে উত্তর দিলো।
– ‘ঐ লোকটাকে চিনিস?’
শিমলা সামনে তাকিয়ে বললো, ‘কোন লোকটা?’
প্রাহী এবার আঙুল তাক করে সামনে দেখিয়ে বললো, ‘ ঐ যে সাদা টিশার্ট পড়া! ফোনে কারো সাথে কথা বলছে!’
– ‘আকসাদ ভাই!’
প্রাহী মনে মনে বলে উঠলো, তার মানে এই বিদেশী লোকের নাম তাহলে ‘আকসাদ’? প্রাহী শিমলাকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘উনার নাম আকসাদ?’
শিমলা চঞ্চল কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘আরে হ্যাঁ উনি আকসাদ ভাই। ‘
– ‘তোদের পরিচিত?’
– ‘পরিচিত মানে! উনি তো আমাদের পরিবারেরই সদস্য! বড় কাকার ছেলে উনি। বড় কাকারা তো কানাডায় থাকেন। আপার বিয়ের সুবাদে কাকার পুরো পরিবার এখানে এসেছে।’
প্রাহী একটা ছোটো শ্বাস ফেলে ভাবলো, তাহলে ও ঠিকই ছিলো। এই বিদেশী হরিণ তাহলে এখানকার স্থানীয় নয়। কিন্তু এই ছেলে যদি কানাডায় থেকে থাকে তাহলে ওকে চিনে কিভাবে!
প্রাহী চুপ থাকতে দেখে শিমলা ওকে বললো,
– ‘কি ভাবছিস? আর তুই আকসাদ ভাই এর কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? কিছু হয়েছে?’
প্রাহী থতমত খেয়ে বললো, ‘না না কিছু হয়নি। এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম আরকি।’
কিন্তু শিমলার সন্দেহজনক দৃষ্টি দেখে প্রাহী আবারও বললো,
– ‘আসলে তোদের পরিবারের সদস্যদের মোটামুটি কম বেশি তো আমি চিনিই তাইনা? তাই হুট করে উনাকে দেখে মনে হলো উনি ছেলেপক্ষ বা তোদের আত্নীয় কি না এজন্যই জিজ্ঞেস করছিলাম আর কি!’
– ‘ওহ আচ্ছা আচ্ছা তাই বল’ এই বলে থেমে শিমলা আবারও লাজুক দৃষ্টিতে সামনে তাকালো।
শিমলার উত্তর শুনে প্রাহী হালকা করে দম ফেললো। আপাতত ও চাচ্ছে না একটু আগের ঘটনার ব্যপারে শিমলাকে কিছু জানাতে। পরে না হয় কোনো একসময় বলা যাবে! ওর ভাবনার মাঝেই কেউ একজন ওদের সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রাহী মাথা তুলে তাকালো। দেখলো শিমলার মা ওদের দু’জনের সামনে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ওদের জিজ্ঞেস করলো,
– ‘তোরা এখানে কেন! রুমিকে হলুদ লাগানো হয়েছে তোদের!’
শিমলা চঞ্চল কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘না এখনও দেয়নি। প্রিয়ন্তীর সাথে দিব। ওকে বাড়ির ভিতর ভিতরে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই এখানে আসলাম। হলুদ দিয়ে আমরা ভিতরে আসছি মা! তুমি যাও!’
– ‘তাড়াতাড়ি কর। খাওয়া দাওয়া তো মনে হয় এখনও হয়নি তোদের! হলুদটা দিয়ে এসে খেয়ে নে অনেক দেরী হয়ে গেছে। আর তাছাড়া…।’
শিমলার মার কথার মাঝেই প্রাহী উনাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
– ‘কাকিমা খাওয়া দাওয়া এখন হবে না। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমি আপাকে হলুদটা লাগিয়েই চলে যাব।’
শিমলার মা গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘হলুদ টা লাগিয়ে তোরা বাসার ভিতর এসে খাবি আয়। খাবার খেতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। আর শিমলা তোকে এগিয়ে দিয়ে আসবে একটু চিন্তা করিস না। এখন জলদি স্টেজে যেয়ে হলুদটা দিয়ে আয়।’ এই বলে শিমলার মা তাড়াহুড়ো করে ঘরের ভিতর চলে গেলেন।
প্রাহী অসহায় দৃষ্টিতে শিমলার দিকে তাকাতেই শিমলা ওকে নরম কন্ঠে বললো, ‘চিন্তা করিস না। মা তো বললোই আমি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসব। এখন চল যেয়ে আপাকে হলুদটা দিয়ে আসি’। বলে প্রাহীকে টেনে নিয়ে স্টেজের দিকে চলে গেল শিমলা।
স্টেজে যেয়ে প্রাহী আর শিমলা মিলে রুমিকে হলুদ লাগিয়ে,মিষ্টি খাইয়ে, ছবি তুললো। তিনজন বেশ কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা করে ওরা আপার থেকে বিদায় নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে আসলো। স্টেজ থেকে নামার সময় প্রাহী সামনে তাকাতেই দেখলো কিছুক্ষণ আগের সেই বিদেশী লোকটা ফুলসজ্জিত একটা পিলারে হেলান দিয়ে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। প্রাহী একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে ফেললো। লোকটার চাহনী এমন কেন! চোখের দৃষ্টি দিয়ে মানুষ ফেরে ফেলবে বোধহয়! তাড়াতাড়ি করে ও শিমলাকে নিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। এখানে আর এক মুহুর্তও থাকা যাবেনা নয়ত এই লোক উনার ধারালো দৃষ্টি দিয়েই ওকে ক্ষনে ক্ষনে অস্বস্তিতে ফেলবে।
গায়ের হলুদ উপলক্ষে কাচ্চি বিরিয়ানির আয়োজন করেছে শিমলারা। দুই বান্ধবী পেট পুড়ে সেই কাচ্চিবিরিয়ানি খেলো। ওদের কাচ্চি খুবই পছন্দ। খাওয়া দাওয়া শেষে প্রাহী শাড়ির আঁচল ঠিক করে ব্যাগ টা হাতে নিয়ে শিমলাকে তাড়াহুড়ো কন্ঠে বললো,
– ‘শিমলা আর দেরী করা যাবে না। রাত প্রায় দশটা বেজে যাচ্ছে। আর দেরী হলে পরে বাবা আর ভাইয়া কড়া কথা শুনাবে আমায়। চল।’
প্রাহীর কথায় শিমলা মাথা নাড়িয়ে ওকে এগিয়ে দিয়ে আসতে গেল।
প্রাহীদের বাড়ি এখানে থেকে বেশি দূর না। পায়ে হেঁটে গেলে ত্রিশ মিনিট লাগবে আর রিকশা দিয়ে গেলে দশ মিনিটের মতো লাগবে। ওরা বের হয়ে দেখলো রাস্তা সুনশান। রিকশা তেমন নেই। রাস্তা ভালোই নিরব। এই অবস্থা দেখে শিমলা প্রাহীকে বললো,
– ‘রাস্তা তো বেশ অন্ধকার তুই যাবি কিভাবে! তোকে কেউ দিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো। আপার বিয়ে উপলক্ষে আমার এখন বাড়িতে থাকাটা জরুরী। নয়ন ভাইওটাও ব্যস্ত। তাহলে তোকে দিয়ে আসবে কে!’
প্রিয়ন্তী শাড়ির আঁচল টা কাঁধে এনে হালকা হেসে বললো,
– ‘অসুবিধে নেই। হেডলাইটের আলোয় দিব্যি…।’
ওদের কথার মাঝেই ক্ষানিকটা দূর হতে কেউ হালকা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আমি দিয়ে আসছি।’
চলবে,,,