#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪২(নিস্তার)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘প্রাহী! আমার প্রাহী!’
সকালের মিষ্টি রোদ চোখেমুখে ঝাপটা দিতেই চোখ মুখ কুঁচকে প্রাহী পিটপিট করে তাকালো। রোদের ঝলকায় চোখ আবার বন্ধ করে কিছুক্ষণ পর খুললো। খানিক বাদে টেওর পেলো ওর মাথার নিচে শক্ত কিছু একটা বারবার উঠানামা করছে। প্রাহী আলতো ভাবে মাথা তুলেই দেখতে পেলো কারো নগ্ন বুকের উপর ও শুয়ে। শুধু শুয়ে না! এ বুকের উপরই এক ভালোবাসাময় রাত পার করার পর ও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো! দু’টো অনাবৃত দেহ একসাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ছিলো সারারাত! ভাবতেই প্রাহীর গাল দুটো অসম্ভব ভাবে গরম হয়ে গেলো৷ জলদি মুখ লুকালো সেই শক্তপোক্ত বুকে! থুতনিতে ভর দিয়ে মুখটা বুকের উপর রেখে এবার গভীরভাবে সেই চওড়া বুকের মালিকানার দিক তাকালো প্রাহী! যে কিনা এখন গভীর ঘুমে মগ্ন! প্রাহী একদৃষ্টিতে আকসাদের ঘুমন্ত মুখের দিক তাকিয়ে আছে! টানা ভ্রু, সরু নাক, তীক্ষ্ণ চোয়ালের এই পুরুষটি সারাটা রাত ওর সংলগ্নে ঘেষে পাগলের মতো নিজ ভালোবাসার জানান দিয়েছে! আকসাদের মসৃণ গালে আলতো চুমু দিয়ে ওর নগ্ন পিঠের উপর হাতের বাঁধনজোড়া আস্তে করে ছাড়িয়ে প্রাহী ধীরভাবে উঠে বসলো। বিছানার ফুলগুলো নিংড়ে আছে! গতরাতের পরনের শাড়িটা আলমারির এক কোণায় যে আকসাদ ছুড়ে ফেলেছিলো সেটা সেখানেই পড়ে আছে। প্রাহী লজ্জায় একবার আকসাদের দিক তাকিয়ে নিজের দিক তাকালো। গায়ে মখমলের কম্বলটা ছাড়া কোনো সুতোর ছিটেফোঁটাও নেই। কম্বলটা গায়ে আরেকটু জড়িয়েই প্রাহী এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলো বিছানার নিচে একপাশে আকসাদের সাদা টি-শার্টটা পড়ে আছে। প্রাহী নিচু হয়ে টি-শার্ট টা হাতে নিয়ে কোনোরকম গায়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই শরীরের ব্যথায় ও আবার বিছানায় বসে পড়লো। পেটে হাত দিয়ে বেড সাইডের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেলো। কিছুক্ষণ বসে আস্তেধীরে উঠে আলমারি থেকে জামা-কাপড় আর টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
আয়নায় নিজেকে দেখতেই প্রাহী নিজের মুখ ঢাকলো। সারা শরীরে আকসাদের দেওয়া চিহ্ন! গলায়, ঘাড়ে আকসাদের দ্বারা খচিত লালচে দাগগুলোয় হাত বুলাতেই প্রাহী আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিক তাকিয়ে হাসলো। যেটা ছিলো তৃপ্তির হাসি!
,
,
,
অনেকক্ষণ পর শাওয়ার নিয়ে প্রাহী মাথা মুছতে মুছতে বের হলো। পরনে ওর হালকা গোলাপী পাজামা সেট। বিছানার দিক তাকাতেই ও ভ্রু কুঁচকালো। আকসাদ নেই! রুমে নেই দেখে বারান্দার দিক এগোতে যাবে তার আগেই একজোড়া হাত ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। চমকে প্রাহী লাফিয়ে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো। ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে গভীর শ্বাস নিয়ে কানের চুলগুলো সরিয়ে সেখানে মুখ লাগিয়ে আকসাদ ফিসফিস করে বললো,
– ‘আমাকে ছাড়াই শাওয়ার নিয়ে নিলে! সো ব্যাড!’
কানে তপ্ত নিশ্বাস পড়তেই প্রাহী শিউরে উঠলো। কোনোরকম নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
– ‘আপ…আপনি কখন উঠলেন?’
আকসাদ প্রাহীর ঘাড়ে ছোটো ছোটো চুমু ফেলে বলতে লাগলো,
– ‘যখন আমায় ছেড়ে গেছো তখন।’
আকসাদ প্রাহীর ঘাড়ে হালকা কামড় দিতেই প্রাহী কেঁপে উঠলো। ঘাড়ের নরম মাংসের উপর হাত বুলিয়ে আকসাদ বললো,
– ‘বাহ্!!! আমার দেওয়া চিহ্নগুলো তো্মার গায়ে তো বেশ মানায়! এই লাইকড ইট!’
প্রাহী দ্রুত পিছন ফেরে আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘যান যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।’
আকসাদ প্রাহীর দিক এগিয়ে বললো,
– ‘নো! আই নিড সাম সুইট নাও?’
আকসাদের এগোনো দেখে প্রাহী কিছুপা পিছিয়ে বললো,
– ‘মিষ্টি! এতো সকালে? আচ্ছা আমি নিচ থেকে নিয়ে আসছি আপনি ফ্রেশ হোন!’
আকসাদ এবার প্রাহীর কোমড় জড়িয়ে ওকে কাবার্ডের সাথে দাড় করালো।
– ‘নিচে যাওয়া লাগবেনা। মিষ্টি আমার সামনেই আছে আগে আপাতত ওটার টেস্ট দরকার।’
প্রাহী কাঁপানো আওয়াজে বললো,
– ‘আক…আকসাদ আপ..আপনি…।’
কথা ফুরানোর আগেই আকসাদ প্রাহীর নরম ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডোবালো। প্রাহীর হাত থেকে ঠাস করে তাওয়ালটা পড়ে গেলো। ছোটো হাতজোড়া ঠায় নিলো আকসাদের খোলা বুকে। ঠোঁটে দাঁতের খোচা লাগতেই প্রাহী চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো। সারা শরীরে আকসাদের অবাধ্য স্পর্শে প্রাহী নেতিয়ে গেলেও আকসাদ ওকে শক্ত করে ধরে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো!
,
,
,
দীর্ঘসময় ধরে নিজের প্রিয়তমাকে নিজ মতন করে আদর করার এক পর্যায়ে কর্কশ আওয়াজে দু’জনের ধ্যান ভাঙলো। আকসাদ পাত্তা না দিলেও প্রাহী নিজের দখলজোড়া ঠোঁটগুলো দিয়ে কোনোরকম ‘উম’ শব্দ করলো। তাতেও আকসাদের ছাড়ার কোনো নামগন্ধ নেই! প্রাহী এবার জোড়ে আকসাদের থেকে নিজেকে ছাড়ালো। আকসাদ প্রাহীর দিক তাকাতেই প্রাহী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে হাপানো আওয়াজে বললো,
– ‘ফোন বাজছে আপনার!’
আকসাদ ওর দিক এগোতে এগোতে বললো, ‘বাজুক।’
প্রাহী আবারও পিছিয়ে করুনস্বরে বললো,
– ‘জরুরী ফোনও তো হতে পারে! দেখুন না!’
আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে শ্বাস ফেলে বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরতে গেলেই প্রাহী সেই সুযোগে একদৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো৷ আকসাদ ধরতে যেয়েও পারলোনা। বিরসমুখে সেদিক তাকিয়ে আকসাদ ফোনের দিক তাকালো। কল কেটে যেতেই ও আপাতত সেদিক পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
,
,
,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আকসাদ শার্টের হাতার বোতাম লাগাচ্ছে৷ ফোনটা আবার বেজে উঠতেই স্ক্রিনে ‘ভিঞ্চি’ নাম দেখতেই সাথে সাথে ফোনটা পিক আপ করে কানে নিতেই ওপাশ ভিঞ্চির আওয়াজ শোনা গেলো,
– ‘আকসাদ! জেনি নামের একটা মেয়ে তোর ল্যাবেই কাজ করতোনা?’
আকসাদ ভ্রু কুঁচকালো। জেনির কথা হঠাৎ ভিঞ্চি জিজ্ঞেস করছে কেন? কিছু একটা ভাবতেই আকসাদ সিরিয়াস কন্ঠে শুধালো,
– ‘হ্যাঁ! ও জুনিয়র স্টুডেন্ট। কেন কি হয়েছে?’
ভিঞ্চি গম্ভীর আওয়াজে বললো,
– ‘শী ইজ ডেড।’
আকসাদ চিল্লিয়ে বললো,
– ‘হোয়াট!’
ভিঞ্চি ফের বললো,
– ‘হুম। তোর ল্যাবের সামনে পার্কেই ওর লাশ পাওয়া গেছে। জলদি আয়।’
ভিঞ্চি ফোন কাটতেই আকসাদ ধপ করে আয়নার সামনের টুলে বসে পড়লো। ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা ওর জেনি মারা গেছে! মেয়েটা অনেক ব্রিলিয়ান্ট একটা স্টুডেন্ট ছিলো। সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা ওকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলো! ও শুনেনি!
মাথার চুলগুলো জোড়ে টেনে মাথার দু’পাশে হাত রেখে ও বসে রইলো। ওর মাথা কাজ করছেনা। চোখ বন্ধ করতেই জেনি মেয়েটার ওই তামাটে চেহারাটা ভেসে উঠছে। দু’দিন আগেও মেয়েটা ওর ল্যাবে প্রজেক্ট করেছে, টাস্ক কম্পলিট করেছে আর আজ মেয়েটা নাকি আর নেই!
প্রাহী কফি হাতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ যাবত। আকসাদের ফোনে কথা বলার পর পরই এভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া, হতাশ হওয়া সবটাই ও দেখেছে। নিরবে পা ফেলে ও এবার আকসাদের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। কফির মগটা আয়নার সামনে সেন্টার টেবিলে রেখে ও আকসাদের কাঁধে হাত রাখলো। আকসাদ ধীরে মাথা তুলে তাকালো। অগোছালো চুল আর লাল হয়ে যাওয়া চোখজোড়ার দিক তাকিয়েই ও জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কি হয়েছে?’
আকসাদ প্রাহীর স্নিগ্ধখানা মুখটার দিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। আয়নার সামনের ফুলদানির দিক এক নজরে তাকিয়ে বললো,
– ‘কিছুনা।’
আকসাদ দাঁড়িয়ে অফিসের ব্যাগটা নিতে নিতে বললো,
– ‘কফিটা আপাতত খাব না! আর আমি ব্রেকফাস্ট বাইরেই করবো। তুমি খেয়ে নিও কেমন!’
আকসাদ বেরোতে নিলেই প্রাহী খপ করে আকসাদের ডান হাতের কব্জি টেনে ধরলো৷ আকসাদ পিছু ফিরতেই প্রাহী বললো,
– ‘আমার সাথে আসুন।’
আকসাদের হাত টেনে ধরে প্রাহী ওকে বারান্দায় নিয়ে গেলো। কাউচে বসে আকসাদকে বসতে ইশারা করতেই আকসাদও প্রাহীর পাশে বসলো৷ প্রাহী আকসাদের হাতদুটো নিজের হাতের সাথে নিবিরভাবে জড়িয়ে বললো,
– ‘আকসাদ! আমি আপনার কে হই বলুন তো?’
আকসাদ মলিন মুখে কপালের ভাঁজ ফেলে বললো,
– ‘মানে!’
প্রাহী নিরব কন্ঠে বললো,
– ‘আপনার জীবনে আমার পরিচয়টা কি?’
আকসাদ হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘কি প্রশ্ন করছো প্রাহী! তুমি আমার ওয়াইফ! আমার জীবনসঙ্গী! আমার জীবনে তোমার পরিচয় শুধু স্ত্রী হিসেবেই নয়! আমার জীবনের অর্ধেকাংশের সাথে তুমি মিশে আছো!’
প্রাহী মুখ তুলে বললো,
– ‘যদি তাই হয় তাহলে আমাকে আপনার জীবনের বিষয়গুলো থেকে এতটা আড়ালে রাখছেন কেন?’
আকসাদ প্রাহীর দিক চট করে তাকাতেই প্রাহী আবারও বললো,
– ‘আকসাদ শুধু স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেলেই হয়না! সম্পর্ক জোড়ালো তখন হয় যখন একে অন্যের জীবনের সকল জটিলতা,বিপত্তি গুলোর গভীরতার ব্যপারে অজ্ঞাত থাকবে! যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না কেন একজন আরেকজনের পাশে সবসময় থাকবে!
আমি আপনার চেয়ে বয়সে ছোটো হলেও আমার বোঝার ক্ষমতা কিন্তু ক্ষুদ্র নয়! এখানে এসে থেকে আপনার আর বাবার কিছু কথোপকথন, আপনার ভাবভঙ্গি সবকিছুই কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি! তখন কিছু বলিনি। ভেবেছি সমস্যা না ঝামেলা মানুষের থাকতেই পারে। কিন্তু আজ আপনার এই অবস্থা দেখে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো সাধারণ ঝামেলায় আপনি পড়েনি নি!’
প্রাহী দম ছেড়ে ফের বললো,
– ‘আকসাদ আপনিই কিন্তু আমায় বলেছেন আপনার সামনে যেন নিজেকে আস্তে আস্তে আমি মেলে ধরি যাতে আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব না থাকে! সেখানে আপনি নিজেই কিন্তু আপনার লাইফের প্রব্লেমগুলো থেকে আমাকে দূরে রাখছেন! অথচ আমি যতবার সমস্যায় পড়েছি আপনি আমার পাশে থেকে আমায় সাহায্য করেছেন! তাহলে আপনার ক্ষেত্রে আমাকে অজানায় কেন রাখছেন বলুন তো!’
প্রাহী কাতরস্বরে বললো,
– ‘আপনার মতো আমি না হয় আপনার সমস্যাগুলোর সমাধান করতে না পারি অন্তত আমাকে আপনার পাশে থাকতে দিন! আমি আপনার স্ত্রী ঠিক আছে কিন্তু তার আগে আমি আপনার বন্ধু হতে চাই! কাল রাতের পরে আমাদের মাঝে যা দূরত্ব ছিলো তা তো অনেকটাই মিটে গেছে! তাহলে আমায় বলতে এত কিসের বাঁধা!’
আকসাদ প্রাহীর দিক একবার তাকিয়ে বাইরে বিশাল রাস্তার ছোটো বাচ্চাগুলোর সাইকেল চালানোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– ‘বাবা যখন প্রথম এদেশে আসে তখন থেকেই বাবা বিজনেস শুরু করে। বাবার বিজনেসটা ছিলো মূলতো মেডিসিনের। তখন বাবা শুধু বিভিন্ন কান্ট্রি থেকে সব ধরনের মেডিসিন ইম্পোর্ট করে এখানকার বড় বড় ল্যাবগুলো, ফার্মাতে, রিসার্চ সেন্টারেও সাপ্লাই করতো। বছর বাড়লো বাবার বিজনেসটাও অনেক বড় হলো। এদিকে আমি নিজেও ফার্মাসি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কম্পলিট করে ট্রেনিং নিতে থাকলাম৷ ততদিনে বাবার অনেক নামডাকও হয়েছে। অন্যান্য বিজনেসেরদের মতো বাবাও উনার আন্ডারে অনেক ল্যাব,রিসার্চ সেন্টারগুলোর নিয়ে প্ল্যান এবং স্ট্র্যাকচার অনুযায়ী মেডিসিন তৈরি করে বাইরে এক্সপোর্ট করতো। আমিও ট্রেনিং কম্পলিট এর পর বাবার আন্ডারে থাকা একটা ল্যাবে জয়েন হই। মেডিসিন নিয়ে কাজ করতে থাকি। দু’বছর বাদে আমার নিজেরই দু’টো ল্যাব হয়। আমার আন্ডারে সেখানে অনেক ট্রেনিং করে আমার সাথে মেডিসিন নিয়ে গবেষণা, রিসার্চ, টেস্ট করে আমার সাথে আবার জিপি প্র্যাকটিসও করে। এতগুলো বছর ধরে সব স্বাভাবিকই ছিলো। সমস্যা দেখা দিয়েছে গত মার্চ মাস থেকে। বাবার আন্ডারে থাকা ল্যাবগুলো থেকে যখন মেডিসিন যখন বাইরে এক্সপোর্ট হয় তখন প্রথম আমেরিকা আর নেদারল্যান্ডের মেডিসিন আআর্থ্রাইটিস আর বিজনেসম্যান গুলোও প্রথম অভিযোগ জানায় আমাদের মেডিসিনে নাকি ড্রাগ পাওয়া গেছে! প্রথম প্রথম এমন হওয়াতে আমরা ভেবেছি কেমিক্যালের ব্যাপার স্যাপার ড্রাগ হয়তো একটু বেশি পড়ে গেছে৷ কারণ সব মেডিসিনেই তো ড্রাগ পাওয়া যায়ই! বাবা তখন ল্যাবগুলোতে এই কথা জানাতে উনারা সাবধানতার সাথে পরবর্তী থেকে হ্যান্ডেল করবে বলে জানায়। কিন্তু না এরপরেও প্রত্যেকটা মেডিসিনে কম-বেশি ড্রাগ পাওয়া যেতোই। তাও সেটা খুব হাই পাওয়ারের ড্রাগ, মেথামফেটামাইন, ফেনটানিল যেগুলো অতি ছোটো মাত্রার মেডিসিনেও পাওয়া যেতো! বিভিন্ন কান্ট্রি থেকে তখন অভিযোগ আসতে থাকলো। কারণ মেডিসিনগুলো ব্যবহার করে অনেকেরই হারপারএক্টেভিটি ডিসঅর্ডার, আরও অনেক জটিক রোগ দেখা দিতেই ব্যপারটা তখন ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে চলে গেলো। বাবার উপর থেকে তখন বিভিন্ন ভাবে প্রেশার আসতে থাকলো। বাবার চব্বিশ বছরের বিজসেন। সবাই এখানে বাবাকে একনামেই চিনে। দেখা যায় অনেকে বাবার চেহারা দেখেনি কিন্তু নাম শুনলেই চিনে। কারণ বাবা বিজনেস করলেও উনি কখনও ন্যায়, বা বিশ্বস্ততার দিক থেকে কাউকে কখনও ঠকায়নি। এ কারণে বাবার উপর বলতে গেলে এখানকার সবারই আলাদা একটা আস্থা আছে। এজন্য ইন্টারন্যাশনাল সেক্টর হতে বাবাকে ওয়ার্নিং দিলেও এখানকার সবাই আর পার্শ্ববর্তী কান্ট্রিগুলো বাবাকে সময় দেয় একদম পিউর মেডিসিন ডেলিভারির জন্য। বাবাও বিভিন্নি ল্যাব আর রিসার্চগুলোতে স্ট্রিক্টলি ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেয়।’
আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে বলে,
– ‘ভিঞ্চি কে তো চিনোই?’
প্রাহী মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আপনার বন্ধু!’
আকসাদ শান্ত কন্ঠে বলে,
– ‘হু! ও এখানকার আর্মি অফিসার। ওর কাজিন এখানকার চিফ অফিসার হওয়ার ওর হাতে কেসটা আসার সাথে সাথেই ও ভিঞ্চিকে জানায়। ভিঞ্চি আগাগোড়া সবটাই জানতো। এর মধ্যে মে এর দিকে একটা শিপমেন্ট যখন বাইরের কান্ট্রিগুলোতে যায় তখন খবর আসে, কিছু কিছু মেডিসিনে হাই পাওয়ারের ড্রাগের রেট বেশি, আবার কিছু কিছু মেডিসিনে হাই পাওয়ারের ড্রাগের রেট কম আবার কিছু মেডিসিনে নাকি ড্রাগই নেই! ভিঞ্চি এটার শুনার পর ফ্রানকো কে দিয়ে প্রত্যেকটা ল্যাবের সিকিউরিটি গার্ড বাড়িয়ে দেয় কারণ এটা অন্তত বোঝা যাচ্ছিলো ল্যাবের কেউই হয়তো এসবের সাথে জড়িত! হুট করে একদিন শুনি ল্যাবগুলোর মধ্যে দু’টো স্টুডেন্ট নিঁখোজ আর একজনের মৃতদেহ ল্যাবের ভিতরেই নাকি পাওয়া গেছে। এরপর থেকে বাবার উপর এরেস্ট এর অর্ডার আসলেও ভিঞ্চি গভার্মেন্ট এর মাধ্যমে নূন্যতম সময় নেয় যাতে কেসটা তাড়াতাড়ি সলভ করতে পারে আর বাবাকে যাতে এরেস্ট না করা হয় কোনোমতেই। ফ্রানকো দায়িত্বে থাকলেও ভিঞ্চি এখন পুরো কেসটাই বলতে গেলে নিজ হাতে নিয়েছে। ফ্রানকো শুধু খনে খনে আমাদের যা ইনফরমেশন দেয়ার দেয়। আমি আর ভিঞ্চি এখন যথাসম্ভব চেষ্টা করছি কেসটার একটা সুরাহা করার।’
এটুকু বলে থেমে আকসাদ প্রাহীর দিক তাকালো। মেয়েটার মুখখানা হতবাক, ভয়,শঙ্কায় আটসাট হয়ে আছে। এজন্যই ও মেয়েটাকে এখনই কিছু বলতে চায়নি। এমন একটা ঘটনা শুনে যে কেউই অবাক বা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়বে এটা খুবই স্বাভাবিক! আকসাদ প্রাহীর হাতদুটো ধরে বললো,
– ‘প্রাহী,আমি তোমাকে সবটাই বলতাম। ভেবেছিলাম এসব মিটে গেলে ধীরেসুস্থে তোমায় সব বলবো। কিন্তু সিচুয়েশন যে এতোটা বিগড়ে যাবে আমি ভাবিনি। আর আমাদের বিয়ে হয়েছে এক মাস হয়েছে সবে। এর মধ্যেই এইসব বলে তোমাকে পেইন দিতে আমার ইচ্ছে করছিলো না।’
প্রাহী সাথে সাথে আকসাদকে জড়িয়ে বললো,
– ‘মানুষের জীবন সবসময় একই রকম থাকেনা আকসাদ। ভালো খারাপ মিলিয়েই সময়গুলো যায় সবার। ভালোর পরে অনেকে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায় আবার খারাপ সময় পারি দিয়ে মানুষ ভালো সময়ের মুখখানা উপলব্ধি করে! আর এখন আপনার সমস্যা মানেই আমার সমস্যা! তাই এখানে আমার পেইন লাগবে এসব ভাবার কিছুই নেই! দেখবেন আকসাদ সবটা খুব শিগগিরই মিটে যাবে!’
আকসাদ এবার প্রাহীর দিক তাকাতেই ও বললো,
– ‘এবার বলুন তো আজ কি হয়েছে? ফোনে কিছু একটা বলছিলেন আপনি!’
আকসাদ বিষন্ন স্বরে বললো,
– ‘আমার ল্যাবের জুনিয়র স্টুডেন্ট জেনি মেয়েটার লাশ পাওয়া গেছে আমার ল্যাবের বিল্ডিং এর সামনেই। মেয়েটা দু’দিন আগেও কাজ করেছে সবার সাথে ল্যাবে। আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি শুনেও শুনিনি। আমি যাস্ট মানতে পারছিনা প্রাহী যে মেয়েটা আর নেই! মেয়েটাকে কোনোভাবে আমার ল্যাবে কাজের জন্যই মেরেছে কি না জানিনা কিন্তু ওর এই মৃত্যু পাওনা ছিলোনা প্রাহী! সি ওয়াজ এ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট!’
আকসাদের করুন গলায় প্রাহীর নিজেরও এবার খারাপ লাগছে। মেয়েটা যেই হোক এভাবে কারো মৃত্যু কেউই মেনে নিবে না! না জানি মেয়েটার বাবা-মার কি অবস্থা হবে আজ! প্রাহী নরমভাবে আকসাদের পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
– ‘জেনির মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী নন আকসাদ। এটা তো বোঝাই যাচ্ছে এই পরিস্থিতির জন্য যারা দ্বায়ী তারাই মেয়েটার মার্ডারেরন পিছনে রয়েছে। আপনি আর আপনার ফ্রেন্ড মিলে খুব শীঘ্রই এই সমস্যার থেকে নিস্তার পাবেন! দেখে নিয়েন!’
আকসাদ মলিন কন্ঠে বললো,
– ‘তাই যেনো হয় প্রাহী!’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘ইনশাআল্লাহ হবে! এবার উঠুন তো ব্রেকফাস্ট করবেন।’
আকসাদ দাঁড়িয়ে বললো,
– ‘আজ আর খেতে ইচ্ছে করছেনা প্রাহী। একবারে বাইরে যেয়ে লাঞ্চ করে নিব।’
প্রাহী আকসাদের হাত ধরে টেনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
– ‘খেতে হবে। এইযে কেসটা কিভাবে সলভ করবেন তার জন্য বুদ্ধিও লাগবে শক্তিও লাগবে। আসুন।’
অগত্যা আকসাদ প্রাহীর সাথে চললো।
,
,
,
বিকেলের দিক প্রাহীর বাবা সোফায় বসে পেপার পড়ছেন। প্রাহীর মা চুলোয় চা বানাতে ব্যস্ত। এখন ঘরে ছেলে নেই, মেয়েও নেই। দুজনেই অবসর। কলিংবেলের আওয়াজে প্রাহীর বাবা পেপারখানা টেবিলে রেখে দরজার দিক এগোলেন। এ সময় তো আবার কে এলো! দরজার খুলতেই প্রাহীর বাবা চোখজোড়া কপালে তুলে দ্বিগুণ বড় করে হালকা চেঁচিয়ে অবিশ্বাসনীয় কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আরে হারামজাদা! এ তুই কি করলি!’
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৩(এসপার নয় ওসপার)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
-‘ আরে হারামজাদা! এ তুই কি করলি!’
সাদা শার্ট পড়ে নক্ষত্র দাঁড়িয়ে। পাশেই শাড়ি পরিহিত শিমলা। গলায় দু’জনেরই মালা জড়ানো। কোনোরকম একটা ঘোমটা মাথায় শিমলা একদম কুনো হয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার একদম নাজেহাল অবস্থা। নক্ষত্র আড়চোখে শিমলার দিক তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
– ‘বিয়ে করেছি।’
প্রাহীর বাবা এবার চিল্লিয়ে বলে উঠলেন,
– ‘বিয়ে করেছিস মানে! কি বলছিস না বলছিস কিছু জানিস আদৌও!’
এত জোড়ে কথা বলার শব্দে প্রাহীর মা রান্নাঘর থেকে হাতে চায়ের ছাকনি নিয়েই বেড়িয়ে এলেন। দরজার কাছে এগোতেই উনার হাত থেকে চায়ের ছাকনি পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে উনি দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। অবিশ্বাস্য নজরে ছেলে আর পাশে দাঁড়ানো শিমলার দিক তাকিয়ে রইলো!
নক্ষত্র সহজভাবে বাবার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘বিয়ে করেছি মানে বিয়ে করেছি! এখানে জানার কি আছে!’
বলে পাশে দাঁড়ানো শিমলাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
– ‘এই সালাম কর। তোর শ্বশুর হয়।’
শিমলা একটু হেলে প্রাহীর বাবা আর এসব নিতে পারছেন না। ছেলের গালে কষে এক চড় মারার জন্য উদ্যত হলেই টের পেলেন মাথা উনার প্রচন্ড ঘুরছে। দরজার রাখা হাতদুটো ঢিলে হয়ে পড়ে যেতে নিলেই নক্ষত্র আর পিছন থেকে ওর বন্ধু বোরহান আর সুমন এসে উনাকে ধরে নিয়ে ধীরেসুস্থে সোফায় বসালেন। প্রাহীর বাবা বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে টেবিলে রাখা হাফ গ্লাস পানি কোনোরকম গিললো। অতঃপর হাঁপানো গলায় বোরহান আর সুমনের দিক তাকিয়ে নক্ষত্রকে ইশারা করে বললো,
– ‘ওর না হয় মাথার তাড়গুলো সব ছিড়ে গেছে। তোদেরও কি মাথার তাড় ছিড়েছে! ওর না হয় বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে! তোদেরও কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে! এমন একটা কাজ করার আগে তোরা ওকে আটকালি না কেন? বিয়েটাতো কোনো ছেলেখেলা না! যে হুট করে বিয়ে করে নিয়ে চলে এলাম! আরে তোরা ওকে সাহায্য না করে আমাকে একটা ফোন তো দিতে পারতি! তাহলে তাই এই অনর্থক কান্ডটা আর ঘটতো না!’
বোরহান আর সুমন নক্ষত্রের বাবার দিক করুন নজর ফেললো। উনি কি ভাবছেন! ওরা নক্ষত্রকে বুঝায়নি, আটকায়নি! বুঝাতে বুঝাতে মুখের ফেনাটা মনে হয় উঠে গিয়েছিলো ওদের! কিন্তু এই ত্যাড়া পোলা শুনলে তো! বোরহান দাঁত চিবিয়ে নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো, ‘ঘাড়ত্যাড়া শালা একটা।’
নক্ষত্র এবার বাবার সামনে এসে শান্ত গলায় বললো,
– ‘প্রথমত আমার মাথার তাড়গুলো ছিড়ে যায়নি। বিয়ে করা মানেই মাথার তাড় ছিড়ে যাওয়া নয়! আর দ্বিতীয়তো অনেক দিন থেকেই আমি বিয়ের জন্য তোমাদের বলে আসছি। তোমরা কথা কানে নাওনি! আমারও আর ঘ্যান ঘ্যান করতে ভালো লাগছিলো না। এজন্য ডিরেক্ট বিয়ে করে নিয়ে এসেছি। আর তৃতীয়তো আমার বিয়েটা কোনো অনর্থক নয়! প্রত্যেকটা বিয়ের যেমন একটা মানে বা অর্থ আছে ঠিক তেমনি আমার বিয়েটারও আছে! তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছি। তাও স্বজ্ঞানেই! সুতরাং, কোনো ছেলেখেলা বা বোধহীন করাজ আমি করিনি।’
বলেই নক্ষত্র নিজ রুমের দিক এগোতে নিয়ে আবার পিছু ফিরে টেবিলে রাখা গ্লাসে পানি ঢেলে বাবার সামনে রেখে বললো,
– ‘বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি মেনে নিবে তোমাদের জন্য বিষয়টা সহজাত হয়ে যাবে৷ শরীর বেশি খারাপ লাগলে রুমে যেয়ে একটা ঘুম দাও।’
নক্ষত্রের বাবা ছেলের যাওয়ার দিক তাকিয়ে সোফার কাঠে মাথা এলিয়ে দিলেন। ছেলে উনার কি সুন্দর অনায়াসে বলে গেলো, সবটা মেনে নিতে! মেনে নেওয়ার কথা তো দূর এখন এই ঘটনা নতুন করে কি ঝামেলা নিয়ে আসে আর তা কতদূর গড়ায় আল্লাহ্ই ভালো জানে!’
নক্ষত্রের মার এখনও সবটা অবাস্তব মনে হচ্ছে। কস্মিনকালেও ভাবেনি ছেলে এমন একটা কাজ করে বসবে! নক্ষত্রকে এদিকে আসতে দেখে উনি ওকে থামালো। নক্ষত্র মা’য়ের দিক তাকাতেই উনি বলে উঠলেন,
– ‘আসলেই কি বিয়ে করেছিস?’
নক্ষত্র গলার মালা খুলতে খুলতে বলে উঠলো,
– ‘হু, মা শোনো ওকে ঘরে নিয়ে এসে একটু ফ্যানের নিচে বসাও। আর ঘরে যা খাবার আছে আমার রুমে একটু নিয়ে এসো। খুব ক্ষুধা পেয়েছে আমার।’
শিমলার দিক ইশারা করে কথাগুলো বলেই ও ঘরে চলে গেলো। নক্ষত্রের মার এবার নজর গেলো শিমলার দিকে! মেয়েটা এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। ধীরপায়ে উনি সেদিক এগিয়ে গেলেন। শিমলার হাত ধরে ওকে ভিতরে নিয়ে আসলেন। এতক্ষণে শিমলা একটু মুখ তুলে নক্ষত্রের মায়ের দিক তাকালো। নক্ষত্রের মা এবার ভালোভাবে মেয়েটাকে পরখ করলেন। মাথায় ঘোমটা টানা, চোখের কাজলগুলো ছড়িয়ে আছে, চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মেয়েটা চোখগুলো ফুলিয়ে ফেলেছে। পুরো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে!নক্ষত্রের মা এবার স্নেহের সহিত শিমলার কাঁধে হাত রাখতেই শিমলা সাথে সাথে নক্ষত্রের মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলো। নক্ষত্রের মা শিমলার মাথার ঘোমটা টা খুলে ওর চুলে হাত বুলাতে লাগলেন। ফুঁপানো অবস্থাতেই শিমলা ভাঙ্গা গলায় কোনোমতে বললো,
– ‘আ…আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করো! তোমার…তোমার ছেলে জোড় করে এইসব করেছে।’
নক্ষত্রের মা শিমলার পিঠে হাত বুলাতে লাগলো। উনি জানেন, এইরকম কার্যের জন্য উনার ছেলেই দ্বায়ী! এখন শুধু সামনে কি হয় কে জানে! ভাবতেই উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আকসাদ এবং ভিঞ্চি পার্কের একদম ভিতরের দিকে জেনির লাশের সামনে দাঁড়িয়ে। মেয়েটার লাশটা বামপাশে কাঁত হয়ে পড়ে আছে। একদম কপাল বরাবর একটা গুলি ওর মাথার সামনে থেকে পিছন দিয়ে বের হয়েছে। আকসাদ হাঁটু গেড়ে বক্সে গভীরভাবে ওর লাশটা পর্যবেক্ষণ করলো। মেয়েটার হাতের কব্জিতে অনেকগুলো আঁচড়ের দাগ। তার মানে কারো সাথে ওর হাতাহাতি হয়েছিলো নিশ্চয়ই! পাশে তাকাতেই আকসাদের চোখগুলো কুঁচকে এলো। জেনির মাথার একটু পাশেই কালচে লাল কালি দিয়ে কিছু একটা লেখা! আকসাদ লেখাটার উপর হাত বুলাতেই ওর হাত কালচে কালিতে একটু ভরে গেলো। আকসাদ হাতটা নাকের কাছে আনতেই টের পেলো এটা রক্তের গন্ধ!
– ‘ও মনেহয় আমাদের জন্য কোনো ক্লু রেখে গেছে!’
ভিঞ্চির কথায় আকসাদ জেনির মাথার পাশে রক্ত দিয়ে আকাঁবাকাভাবে লেখা টা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। বেশ অস্পষ্টভাবে কিছু একটা লেখা। এম্বুলেন্স আসতেই ভিঞ্চি আর ও উঠে দাঁড়ালো। জেনির লাশটা গাড়িতে তুলতেই আকসাদ ভিঞ্চিকে বলে উঠলো,
– ‘লাশটা পোস্টমর্টেম না করালে হয়না! এমনেই ও অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেছে।’
ভিঞ্চি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘অর্ডার যেহেতু এসেছে সেখানে পোস্টমর্টেম টা করতে হবেই। তাও আমি দেখি একবার ফ্রানকো কে বলে। কিছু করা যায় কি না।’
আকসাদ একদৃষ্টিতে জেনির কোমল প্রাণহীন মুখটার দিক তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কাল পরশু এই সময় কি সুন্দর ওদের সাথে হাসিমুখে ল্যাবে, কাজ করছিলো। আর এখন কিভাবে শুয়ে আছে! পীড়াজনক ভারী শ্বাস ফেলতেই ভিঞ্চি পাশ হতে আকসাদের কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘ক্লাবে চল। আজকে আর বোর্ডে যাব না।’
আকসাদ প্রতিউওরে মাথা নাড়ালো।
.
শিমলা আপাতত প্রাহীর ঘরে বসা। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ও একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাতারাতি ওর জীবন টা একটা সময়ের ব্যবধানে কি থেকে কি হয়ে গেলো! পরনের শাড়িটা দিয়ে চোখ মুছতে গেলে শাড়িটার দিক তাকিয়ে দুপুরবেলার ঘটনায় ও ডুব দিলো।
।
।
।
ভার্সিটি থেকে আসতেই শিমলা বসার ঘরে বড় মামীকে দেখতেই চোখমুখ কুঁচকে নিজ ঘরের দিক গেলো। ব্যাগটা রেখে মায়ের ঘরে যেতেই দেখলো ওর মা মনমরা হয়ে আলমারিতে কাপড় রাখছে৷ শিমলা ওর মাকে শান্ত গলায় বলে উঠলো,
– ‘ওই মহিলা এখানে কি করছে?’
শিমলার মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘ওই মহিলা আবার কি! তোর মামী হয়।’
শিমলা মুখ কুঁচকে বললো,
– ‘উনার মতো সয়তান মহিলা কারো কিছুই হতে পারেনা। উনাকে যেতে বলো! নাহলে আমি এবার ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাব।’
শিমলার মা অসহায়ভাবে মেয়ের দিক তাকিয়ে আছেন। শিমলার মাও ভালোই ফ্যাসাদে পড়েছন,
– ‘শিমলা কাউকে কিন্তু ঘর থেকে এভাবে বের করে দেয়া যায়না!’
শিমলা দাঁতে দাঁত চেপে ফুসে উঠছে। এই বড় মামী নতুন ঢঙ ধরেছে। আকসাদের সাথে তো আর নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে পারেনি! এখন শিমলার পিছে পড়েছে। নিজের হাবাত্বে ছেলের সাথে ওর বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। শিমলা উনার চাল ঠিকই ধরতে পেরেছে। আকসাদের মতো বড়লোক ছেলে হাতছাড়া হয়েছে। এই নিয়ে তার আফসোসের একদম শেষ ছিলোনা। মাটিতে গড়াগড়ির মতো আফসোস যাকে বলে। এখন শিমলার দিক উনার নজর পড়েছে! শিমলা বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। ওর বাবার এই দোতালা বাড়ি, আরও কিছু জমিজায়গা যা আছে তা তো শিমলাই পাবে! কাজেই ওর সাথে যদি নিজের ছেলের বিয়ে দেয়া যায় তাহলে তো ষোলো আনায় লাভ!
কাজেই আকসাদরা যাবার কিছুদিন পরেই ওর বড় মামী নতুন সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে শিমলার সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দেওয়ার। শিমলার মা সাথে সাথেই মানা করে দেয়ার পরেও এই মহিলা বারবার এসে ঘেনিয়ে যাচ্ছিলো। উনার একটাই কথা ‘আমার ছেলে ঢাকা থেকে এসে ওকে দেখে পছন্দ করলেই না বিয়ে হবে। আগে একটু ওকে দেখার সুযোগটাতো দাও!’ ওই দেখাদেখি তো একটা বাহানা মাত্র! দেখা যাবে দেখাদেখির উছিলায় উনি বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়ে নিবে পুরো ব্যাপার টা। এই নিয়ে শিমলা ওর বড় মামীর সাথে সামনাসামনি কথা কাটাকাটি পর্যন্ত করে বসেছে। এক পর্যায়ে বলেও দিয়েছিলো, ‘আপনার মতো লোভী মহিলা আমি একটাও দেখিনি।’ এটা শুনার পর ওর বড় মামী একদম বিলাপ আলাপ শুরু করে দিয়েছে! যে মেয়ের নাকি শিক্ষা দিক্ষা নেই। ওর মা আবার ওকে এই নিয়ে দু’টো কথা শুনালে শিমলা রাগে দুঃখে তুলির বাড়িতে গিয়ে দু’দিন ছিলোও। তাও যদি ওর মা ওর মনের কথাটা বুঝতো! ওর মায়ের বড় মামার দিক তাকিয়ে সবসময় উনার বউয়ের সবকিছুতে স্বায় দেয়াটা শিমলার পছন্দ না।
শিমলা ফুসে বললো,
– ‘তুমি না পারলে আমাকে বলো আমি বের করে দিচ্ছি।’
শিমলার ছোটো মামী এবার ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে বললো,
– ‘শোন মাথা খারাপ করিস না। তোকে আজ ভাবীর ছেলে দেখতে আসবে শাড়িটা পড়িয়ে দিচ্ছি আমি আয়।’
শিমলা ঝাড়া মেরে বললো,
– ‘একদমই না। আমি ওই ছেলের সামনে যাবোনা।’
রাগে শিমলার চোখমুখ লাল হয়ে চোখে পানি জমে গেছে। শিমলার ছোটো মামী ওর চেহারার দিক তাকিয়ে ওর হাত চেপে বললো,
– ‘শোন শান্ত হো! তোর মেজো মামা আর ছোটো মামা আজ এ বাসায় আসবে। তোকে যখন দেখতে আসবে তখনই উনারা কথা তুলবে যে তুই বা তোর বাবা-মা এই সম্বন্ধে রাজি নস। তোর বাবা-মা এখন কিছু বলতে পারছেনা। কারণ তোর বাবার এই জায়গজমির কেনার পিছনে তোর বড় মামার অনেক সাহায্য উনারা পেয়েছিলো। তোর মামা তখন তোর বাবাকে অনেক টাকার লোন দিয়েছিলো জমি কেনার জন্য। যদি ওই সময়ে ওই লোনটা তোর মামা না দিতো তাহলে আজ তোর বাবা এই বাড়ি,এত জমিজায়গা করতে পারতো না। এজন্য কৃতজ্ঞতার খাতিরে তোর মা বা বাবা কিছুই আপাতত বলতে পারছে না। কিন্ত তোর বড় মামা বেশ বিচক্ষণ মনের মানুষ। সব শুনার পর উনি নিজেই সরে আসবে এই প্রস্তাব থেকে সাথে উনার বউকেও মানা করে দিবে যাতে এই নিয়ে আর ঘাটাঘাটি উনি না করে। সবাই মিলে জোর গলায় বললে তোর বড় মামী আর ওতো সুবিধা করে উঠতে পারবে না। তুই শুধু শাড়িটা কোনোরকম পেঁচিয়ে সামনে বসবি তাতেই হবে। বাকিটা আমরা দেখে নেব।’
শিমলা না চাইতেও ওর ছোটো মামীর কথায় মায়ের বেগুনি শাড়িটা পড়ে পড়ে বসে আছে। ভরদুপুর মা রান্নার কাজে ব্যাস্ত। ছোটো মামী ঘরে নামাজ পড়ছে। আর ওর বড় মামী আপাতত ঘুম। কলিংবেল বাজতেই শিমলা গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দেখলো বাইরে নক্ষত্র দাঁড়িয়ে। শিমলা ভ্রু কুঁচকালো। এই ছেলে এখন এখানে! এর তো এখন ঢাকায় থাকার কথা!
– ‘আপনি এখানে!’
শিমলার প্রশ্নে নক্ষত্র স্বাভাবিকগলায় বললো,
– ‘হুম! একটু আমার সাথে আয় তো।’
– ‘কোথায়!’
শিমলার প্রশ্নে নক্ষত্র এবার মুখে একটু সিরিয়াসভাব এনে বললো,
– ‘মায়ের শরীরটা কেমন যেনো করছে। তুই একটু এলে ভালো হতো। প্রাহীটাও এখন নেই।’
শিমলা ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
– ‘বলেন কি! দাঁডান আমি মাকে এখনই বলছি।’
শিমলা ভিতরে যেতে নিলেই নক্ষত্র ওর হাত চেঁপে বললো,
– ‘এখনই তোর মাকে জানানোর কিছুনেই। আগে তুই চল পথে যেতে যেতে জানিয়ে দিস।’
– ‘কিন্তু…।’
নক্ষত্র ওর হাত ধরে নিয়ে গেলো। বাইকের উপর বসে বললো,
– ‘গাড়িতে উঠ সময় নেই। বাবা বাসায় নেই। মাকে নিয়ে একা হাসপাতালে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
শিমলা আর কথা না বাড়িয়ে বাইকের পিছন বসলো। কিছুক্ষণ পর ও টের পেলো এটা নক্ষত্রদের বাড়ির রাস্তা নয়! কোথায় যাচ্ছে এই ছেলে! আকাশ কুসুম ভাবতেই দেখলো নক্ষত্র একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়েছে। শিমলা নামতেই দেখলো ওরা একটা একতালা বাড়ির সামনে দাঁড়ানো। উপরে বড় বড় করে লেখা ‘মিতুন কাজী অফিস’। শিমলা কপাল কুঁচকে নক্ষত্রকে শুধালো,
– ‘এখানে কেন এসেছেন?’
নক্ষত্র হেলমেট খুলতে খুলতে বললো,
– ‘বিয়ে করব বলে।’
শিমলা অবাক গলায় বললো,
– ‘মানে?’
নক্ষত্র ওর সামনে এসে বললো,
– ‘মানে আমি বিয়ে করবো তাই এখানে এসেছি।’
শিমলা সাথে সাথেই বললো,
– ‘আপনি বিয়ে করবেন ভালো কথা তাহলে আমায় কেন এনেছেন!’
নক্ষত্র হাফ ছেড়ে বললো,
– ‘তোকে বিয়ে করবো! আর তোকেই আনবো না?’
শিমলা এক লাফে পিছন সরে বললো,
– ‘কি? কিসব বলছেন! মাথা ঠিক আছে আপনার!’
নক্ষত্র ওর কাছে যেয়ে বললো,
– ‘মাথা আমার ঠিক আছে। এবার ভিতরে চল হাতে বেশি সময় নেই। বিয়ে করেই বাড়ি যাব।’
শিমলা মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘অসম্ভব! আমি কখনোই আপনাকে বিয়ে করবো না!’
নক্ষত্র ওর দিক এগিয়ে বললো,
– ‘কেন?’
শিমলা পিছালো,
– ‘আমি আপনাকে কখনও ওই চোখে দেখিনি। ভাইয়ের নজরে দেখে এসেছি। আপনায় আমি বিয়ে করব না। আমায় বাড়ি দিয়ে আসুন।’
নক্ষত্র শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– ‘বাংলা সিনেমার ডায়লগ দেওয়া শেষ! এখন ভিতরে চল।’
শিমলার এবার রাগ লাগছে। এই ছেলে এমন ছেলেমানুষী কেন করছে!
– ‘দেখুন নক্ষত্র ভাই সবকিছুর একটা লিমিট আছে! আপনি কি পাগল হয়েছেন নাকি! আমার আপনায় বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই! আমাকে বাড়ি দিয়ে আসুন বা একটা টমটম ধরিয়ে দিন আমি বাড়ি চলে যাই।’
নক্ষত্র এবার শিমলার হাত ধরে কাজী অফিসের দিক এগোতে এগোতে বললো,
– ‘দেরী হচ্ছে এখন চল।’
শিমলা এবার হাত ঝারা মেরে সরিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
– ‘আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন না! আপনায় আমি বিয়ে করব না। আমার বিয়ে করার লোকের অভাব হয়েছে যে আমি আপনায় বিয়ে করবো! অসভ্য লোক একটা।’
নক্ষত্র এবার দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
– ‘ভালো ভালোয় বলছিলাম! শুনলিনাতো! এবার শুনবি?’
বলেই শিমলাকে নিয়ে বাইকে উঠিয়ে ওদের গ্রাম থেকে একদম দূরে খালি একটা জায়গার পুরানো বাড়ির সামনে এনে বাইক থামিয়ে শিমলাকে নিয়ে ওই বাড়ির ভিতর চললো। শিমলার হাত নক্ষত্রের হাতে বন্দি। মোচড়ামুচড়ি করেও ও ছাড়াতে পারছেনা হাতটা। নক্ষত্র এবার ওকে নিয়ে গেইট পেরিয়ে বাডির ভেতরের একটা রুমে এনে দরজা বন্ধ করে দিলো। শিমলার এবার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এটা ওকে কোথায় এনেছে এই লোক! শুনশান জায়গা, আশেপাশে কাউকেই ও দেখেনি!
– ‘দরজা বন্ধ করলেন কেন! আর আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন আপনি?’
নক্ষত্র এবার রুমের একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে পা নাচিয়ে বললো,
– ‘তুই তোর বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে তাইনা! কেমন হবে যখন ওরা শুনবে যে তাদের একমাত্র মেয়ে সারারাত একটা ছেলের সাথে একঘরে বন্দি ছিলো! আর এ কথা সারা গ্রাম ছড়ালে তোর বাবা-মায়ের অবস্থা কেমন হবে?’
শিমলা ছলছলানো চোখে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘মানে…আমি এখানে বন্দি কেন থাকবো?’
নক্ষত্র ঘাড় কাত করে বললো,
– ‘কথা শুনিসসি তাই! ভালোয় ভালোয় বিয়ে করতে বলেছি করিস নি। এখন সারা দিন রাত আমার সাথে এই ঘরে থেকে সকালে বের হবি। এই ঘটনা পুরো গ্রাম রটানোর পর এমনেই তোর আমাকে বিয়ে করতে হবে ওমনে হলেও আমাকেই বিয়ে করতে হবে! ত্যাড়ামি যেহেতু করছিস। তাহলে একটু ত্যাড়াভাবেই নাহয় বিয়েটা তোকে করলাম। তফাৎ একটাই আমার কথা শুনলে তোর বাপ-মার মুখে চুনকালি পড়তো না! তোর এই ত্যাড়ামির জন্য এখন চুনকালি পড়বে উনাদের মুখে এই যা!’
শিমলা কাঁদতে কাঁদতে এবার নিচে বসে পড়লো। ভেজাকন্ঠে বললো,
– ‘আমার সাথে এমনটা কেন করছেন বলুন তো! আমি কি করেছি!’
নক্ষত্র এবার দাঁডিয়ে ওর দিকে ঝুকলো,
– ‘সোজাভাবে বলেছি বিয়ে করার জন্য,করিসনি! তাই এই পথ বেছে নিলাম!’
শিমলা ক্রন্দনরত গলায় বললো,
– ‘আপনার কেন বিয়ে করব! আপনায় আমি ভা…।’
নক্ষত্র ওর স্বজোড়ে শিমলার মুখে নিজের শক্ত পাঁচ আঙ্গুল দাবিয়ে চিবিয়ে বললো,
– ‘আর একবার ভাই বলবি চড়ে তোর দাঁত সব ফেলে দিব!’
বলে থেমে শিমলার গায়ের শাড়িটার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘শাড়ি কার জন্য পড়েছিস হুম! ওই হ্যাবলা মামাতো ভাইয়ের জন্য!’
শিমলা চমকে নক্ষত্রের দিক তাকালো। বড় মামীর ছেলে ওকে দেখতে আসবে দেখে এই শাড়ি ওকে পড়ানো হয়েছে উনি কিভাবে জানে! নক্ষত্র শিমলার মুখের কাছে ঝুঁকে বললো,
– ‘আজ থেকে অন্য কারো জন্য শাড়ি পড়বি তো তোর অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়ব। এখন এই শাড়ি খোল এই শাড়িতে তোকে একদম মানাচ্ছে না।’
বলেই শিমলার শাড়ির আঁচলে হাত দিতেই শিমলা সাথে সাথে নক্ষত্রের হাত ধরে কেঁদে উঠে বললো,
– ‘এমনটা করবেন না প্লিজ। প্লিজ আমি…।’
কান্নার জন্য ওর কথা বের হচ্ছেনা। নক্ষত্র শিমলার দিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ওকে জোড় করে দাঁড় করিয়ে কোলে তুলে নিলো,
-‘চুপচাপ এখন আমার সাথে কাজী অফিসে যেয়ে বিয়ে করবি। আর একবার সিনক্রিয়েট করবি আবার তোকে এখানে নিয়ে আসব। আর এবার এখানে নিয়ে আসলে বাসর ছাড়া তোকে বের হতে দিব না! বিয়ের আগে বাসর! আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু!’
বলেই নক্ষত্র শিমলার দিক তাকিয়ে বাঁকা হাসা দিলো। শিমলা মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলো। নক্ষত্র ওকে বাইকে বসিয়ে কাজী অফিসে নিয়ে এলো। বোরহান আর সুমন শিমলার অবস্থা দেখে নক্ষত্রকে বুঝাতে গেলেও কোনো লাভ হয়নি। বিয়ের মাঝে দেনমোহরের কথা উঠতেই নক্ষত্র শিমলাকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘তোর কত লাগবে দেনমোহর?’
শিমলা ফুঁপিয়েই যাচ্ছে। নক্ষত্র কাজীকে পরে বললো,
– ‘পঞ্চাশ লাখ লিখুন।’
অতঃপর তিনকবুল বলে ওদের বিয়েটা হতেই বোরহান আর সুমন সাক্ষী হিসেবে নিজেদের স্বাক্ষর দিয়েছে। বিয়ে শেষে নক্ষত্র শিমলাকে নিয়ে বাইকে উঠাতেই ওর নজর গেলো শিমলার গালের দিক। পাঁচ আঙ্গুলের শ্যামলা গালে পড়ে আছে! নক্ষত্র ওর গালে হাত বুলিয়ে ঠোঁট বসিয়ে গভীর চু’মু এঁকে দিতেই শিমলা নড়ে পিছু সরে আসতেই নক্ষত্র ওকে টেনে কাছে এনে মাথায় ঘোমটা জড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো।
(বর্তমান)
শেষে ওকে জোর করে বিয়ে করেই নিলো নক্ষত্র! কথাটা ভাবতেই শিমলার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ও কোনোদিনো এই লোককে ক্ষমা করবেনা! কোনোদিনও না! শিমলার চোখের পাতাজোড়া ভারী হয়ে আসছে। কাঁদতে কাঁদতে ওর এখন বেশ ঘুম পাচ্ছে। জানালার গ্রিলেই ও মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেই আলগোছে কেউ ওকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কপাল বরাবর ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।
,
,
,
আকসাদ আর ভিঞ্চি ক্লাবের গোল টেবিলে বসে। আকসাদের হাতে চায়ের কাপ আর ভিঞ্চি কোল্ড ড্রিংকস খাচ্ছে।
– “তার মানে মেয়েটা তোকে কিছু বলতে চাচ্ছিলো!’
আকসাদ চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে বললো,
– ‘হুম।’
ভিঞ্চি কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
– ‘কেন যেন মনে হয়ে আশেপাশের বা আপন মানুষই এসব করছে!’
আকসাদ ওর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘তা তো অবশ্যই!’
ভিঞ্চি ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘শিপমেন্ট কি এবারও পাঠাবি!’
আকসাদ মাথা নাড়ালো,
– ‘হুম! তবে সেটা অন্যান্য ল্যাব থেকে নয়।’
– ‘তাহলে?’
আকসাদ চায়ের কাপ রেখে বললো,
– ‘এবার শিপমেন্ট যাবে আমার ল্যাব থেকে। আমার দায়িত্ব যাবে।’
ভিঞ্চি মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘গুড! দেখা যাক এখন কাহিনী কোথায় যেয়ে গড়ায়। তবে আমার মনে হয় ব্যপারটা শুধু মেডিসিন ঘিরেই আবদ্ধ নয়!’
আকসাদ বাইরে তাকালো। বিষয়টা আরও জটিল এটা ও জানে। তবে এবার এর একটা এসপার নয় ওসপার ও করেই ছাড়বে। আর না হলে…..
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৪( আরও একটি)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘কাজটা কি ঠিক করলি?’
কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নক্ষত্র মায়ের দিক তাকালো। জবাবে বললো,
– ‘কি করলাম?’
নক্ষত্রের কথায় এবার ওর মা বেশ ক্ষেপলেন। ছেলের পাশে এসে বললেন,
– ‘কি করলাম মানে! নক্ষত্র হেয়ালি করবি না একদম। হুট করে এভাবে বিয়েটা করা কি খুব দরকার ছিলো! আমাদের বললেও তো হতো! বাবা-মা হিসেবে আমরা অবশ্যই তোর বিয়ে, পছন্দ, অপছন্দ নিয়ে ভাবতাম! তা না করে ফট করে বিয়ে করে ফেললি! সবে একটা মাস হয়েছে প্রাহীটার বিয়ে হয়েছে! তার মধ্যে তুই আবার এ কান্ড ঘটালি। তোর বাবা সেই যে বিকেলে ঘরে ঢুকে শুয়েছে তার উঠার আর নামগন্ধ নেই! এমনটা করে কি লাভ হলো বলতো?’
নক্ষত্র কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘লাভ তো হয়েছেই ছেলের বউ পেয়েছো! এখানে তো খুশি হওয়ার কথা!’
নক্ষত্রের মা বিরক্তি মাখা দৃষ্টিতে ছেলের দিক তাকিয়ে রইলেন! নক্ষত্র কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিক ঘুরে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– ‘আমার এক না এক সময় বিয়ে হতো নিশ্চয়ই তাইনা! তখন দেখা গেলো আমার জন্য মেয়ে দেখাদেখি করতে, ঘটকালি করতে আরও কত কি। তার চেয়ে বরং আমি ডিরেক্ট বিয়ে করে নিয়ে চলে এসেছি এটাতে খারাপ কিছু তো আমি দেখছি না! ধরে নাও আমার বিয়েটা না হয় এভাবেই লেখা ছিলো!’
নক্ষত্রের মা এবার ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– ‘খারাপ যে সেটা আমি বলিনি! আমরা বাবা-মা কয়দিন তোদের বকে না হয় চুপ হয়ে গেলাম! আশপাশের মানুষ তো আর চুপ থাকবেনা! সমালোচনা তো হবেই এ নিয়ে। যে বাড়ির ছেলে না বলে কয়ে বিয়ে করে এসেছে! আরও কত কি!’
নক্ষত্র কম্পিউটার ওফ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো,
– ‘মানুষ কি বললো না বললো তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা কোনো কালেই ছিলোনা। এত দিন ধরে খেয়াল যত্নে রাখা নিজের পাখিকে অন্য কেউ এসে টানাটানি করে নিয়ে যাবে সেটা নিবিড়ে দেখার মতো ধৈর্য্য আমার নেই। আর ও যা মেয়ে ওকে বিয়ে করতে গেলে অনেক ঝামেলাকে আমার অতিক্রম করে তারপর যা করার করতে হতো। আপাতত সেই সময়টা নেই। এতো ফাউল ঝামেলা সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। হ্যাঁ তোমাদের খারাপ লাগতে পারে ছেলের বিয়ে একটু আয়োজন করে দেয়ার ইচ্ছা সব বাবা-মায়েদেরই থাকে। চিন্তা করোনা, কিছুদিন যাক গায়ের হলুদ,অনুষ্ঠান,বউভাত সব হবে।’
নক্ষত্রের মার বুঝি এবার বোধ এলো। অনেক আগে থেকেই তাহলে উনার ছেলের শিমলাকে মনে ধরেছিলো! উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘এজন্য জোড় করে মেয়েটাকে বিয়ে করেছিস তাইতো!’
নক্ষত্র বিছানায় শুতে শুতে বললো,
– ‘জোড় করে করিনি। হামকি ধমকি মারতে হয়েছে আর কি বিয়ের সময়।’
এত কান্ড করেও ছেলে কি সুন্দর নিশ্চিন্তে কাথা মুড়ি দিয়ে শুতে যাচ্ছে! আছে এর কোনো চিন্তা ভাবনা! নক্ষত্রের মা রুম থেকে বের হতে যাবেন তার আগেই কি মনে করে একবার ছেলের দিক তাকালেন। ছেলে যে মনে মনে শিমলাকে পছন্দ করতেন তা উনি কখনও টের পায়নি। একটা সময় সন্তানদের মনোভাব বা চিন্তাধারা সম্পর্কে বাবা-মায়েরা পুরোপুরি সেভাবে বুঝতে সক্ষম হয়না। তখন উনারা নিজেদের শরীরের অবস্থা নিয়ে ক্লান্ত থাকে আবার সন্তানদের ভবিষ্যত কিভাবে গুছানো যায় এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে যায়। ছেলের রুম থেকে বের হয়ে নক্ষত্রের মা একবার শিমলার রুমের দিক এগালেন। মেয়েটাকে ঘুমাচ্ছে ওকে এখন তুলা দরকার। দুপুরে নাকি কিছু খায়নি। খিদে পেটে এভাবে থাকাটা ঠিক না।
মা রুম থেকে বেরোতেই নক্ষত্র মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে বসলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফোন লাগালো কাউকে।
,
,
,
সন্ধ্যার দিক বসার ঘরে নক্ষত্রের বাবা, চাচা,মামারা, শিমলার বাবা-মা আর মেজোমামা সহ সবাই উপস্থিত হয়েছে। কারো মুখে কোনো কথানেই। নক্ষত্র নির্বিকারভাবে সোফায় বসে ফোন দেখছে। শিমলার বাবা এক পর্যায়ে নিরবতা কাটিয়ে নক্ষত্রের বাবার দিক তাকিয়ে বললেন,
– ‘ভাইজান, আমাদের মেয়ে যদি পছন্দ হয়েই থাকে তাহলে প্রস্তাব দিলেই তো হতো তাইনা! একটাবার বলেই দেখতেন! ঘরের কাছের ছেলে আমরা নাকোচ তো কোনোকালেই করতাম না।’
নক্ষত্রের বাবা হতাশার সুরে বললো,
– ‘ছেলের এমন কাজে আমি নিজেই বাকশুন্য। তোমাদের আর কি বলবো! এমন কাজ ও করবে কে জানতো?’
শিমলাকে নিয়ে নক্ষত্রের মা বসার ঘরে আসতেই শিমলার মা উঠে জলদি মেয়ের কাছে গেলেন। মাকে দেখেই শিমলা হরহরিয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকলো। যার অর্থ ও এসবের কিছুই জানতো না! আর না ও নিজে থেকে এই বিয়ে করেছে!’ শিমলার মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। শিমলা মায়ের বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো। শিমলার মা মেয়েকে জড়িয়ে সোফায় নিয়ে বসালেন। এবার শিমলার মেজো মামা বলে উঠলেন,
– ‘বলছিলাম এখন মেয়ে না হয় আমরা নিয়ে যাই! পরে এটা নিয়ে একটা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না হয়!’
নক্ষত্র দাঁত চিবিয়ে শিমলার মেজো মামার দিক তাকিয়ে শিমলার দিক তাকালো। এই মেয়ের এতো কাঁদার কি আছে! যত্তসব। এরে নাকি নিয়ে যাবে! এটারে যেতে দিলে তো!
– ‘শিমলা আপাতত কোথাও যাবেনা।’
হঠাৎ রাশভারি কন্ঠে সবাই ঘুরে দেখলো শিমলার ছোটো মামা আর মামী এসেছে। সাথে হুজুর এর মতোন একটা লোক ও আছে। শিমলার ছোটো মামা সোফায় বসতেই শিমলার মেজো মামা বলে উঠলো,
– ‘কোথাও যাবেনা না মানে! মেয়েটাকে এখন বরং নিয়ে যাই! হুলুস্থুলভাবে বিয়েটা হয়েছে ওদের। মেয়েটা মানসিকভাবে পুরো দূর্বল হয়ে পড়েছে! দেখছিস না?’
শিমলার ছোট মামা হুজুরকে সোফায় বসতে বলে ঘুরে সবার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘বিয়েটা ওদের বেশ হুলস্থুলভাবেই হয়েছে মানলাম।’
এরপর নক্ষত্রের দিক ফিরে বললো,
– ‘এছাড়া আমি এটাও বলবো নক্ষত্র এরও এভাবে বিয়ে করাটা উচিত হয়নি! কারণ প্রত্যেকটা বাবা-মা অনেক কষ্ট করে নিজের সন্তানদের বড় করে। একটা আশা উনাদের থাকে যে, ছেলেমেয়ের বিয়ে নিজ হাতে দিবে বা দেখেশুনে দিবে। এক্ষেত্রে নক্ষত্র ভুল করেছে মানলাম। কিন্তু সবকথার বড় কথা যেভাবেই হোক ওদের বিয়েটা হয়েছে! এখন কেউ মানুক বা না মানুক ওরা ধর্মীয়বভাবে স্বামী স্ত্রী। এটা কেউ বদলাতে পারবে না। আর শিমলা, প্রাহী, নক্ষত্র এরা আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। সুতরাং, এ নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ বা টেনশন নেই যে ছেলে কেমন হবে বা মেয়ে কেমন হবে। আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েই এরা! কাজেই নক্ষত্রকে জামাই বা শিমলাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে কারো তো আপত্তি থাকার কথা নয় তাইনা!’
শিমলার বাবা-মা নিশব্দে মাথা নাড়লো। কথা তো ঠিকই। নক্ষত্র দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ সুন্দর। আচার, ব্যবহারও ভালো। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছে। আজ বাদে কাল চাকরিও করবে। শিমলার জন্য নক্ষত্র একদম পারফেক্টই বলা চলে! এখানে উনাদের মানা করার কিছুনেই। হুট করে বিয়েটা হয়েছে এতেই উনারা একটু আশ্চার্যনিত হয়েছেন। এই যা! শিমলার মেয়ের দিক তাকিয়ে ভাবলেন, যা হয়েছে হয়তো ভালোই হয়েছে! তা না হলে উনার বড় ভাইয়ের বউ যেভাবে উঠেপড়ে নিজের মেয়েটার পিছনে পড়েছিলেন যেনো নিজের ছেলের সাথে বিয়েটা বোধহয় এবার দিয়েই দিতেন। যেটা শিমলার বাবা বা মা কেউই মন থেকে চাননি। কারণ উনার বড় ভাইয়ের ছেলে তেমন একটা সুবিধারও নন! এক্ষেত্রে নক্ষত্রকে নিজেদের মেয়ে জামাই হিসেবে পেয়ে উনারা খুশিই বলা চলে!
নক্ষত্রের বাবা এবার বললো,
– ‘আপত্তি কারোরই নেই! মেয়ে হিসেবে আমাদের শিমলা এক কথায় মাশাল্লাহ। কিন্তু আমার ছেলে তো এখনও মাস্টার্স টাই শেষ করেনি। বিয়ে করেছে, বিয়ে করার আগে ভেবেছে! যে বউ এর দায়িত্ব এমতাবস্থায় কিভাবে নিবে!’
এ পর্যায়ে নক্ষত্র গম্বীর স্বরে বলে উঠলো,
– ‘আমার মাস্টার্স শেষ হতে আর মাত্র কয়েক মাস। আর আমি এই পর্যন্ত যা ইনকাম করেছি আর আমার যা সেভিংস আছে তা দিয়ে আমি আমার বউকে চাকরি পাওয়া অব্দি নির্দ্বিধায় চালাতে পারব। সুতরাং, ও এখন কোত্থাও যাবেনা।’
নক্ষত্রের মাও এবার স্বায় দিয়ে বললো,
– ‘তাছাড়া শিমলা আমার আরেক মেয়ে। প্রাহী আর ও আমার কাছে এক। ও বরং থাকুক!’
শিমলার ছোট মামা হালকা হেসে বললো,
– ‘থাকবে থাকবে! থাকার ব্যবস্থা করার জন্যই এইযে কাজী নিয়ে এসেছি!’
এবার নক্ষত্রের দিক ফিরে বললো,
– ‘নিজে তো আমার ভাগ্নীকে জোড় করে নিয়ে বিয়ে করে আসলি! এবার আমাদের সামনে আরেকবার কবুল পড়ে বিয়ে কর! আপত্তি আছে!’
নক্ষত্র মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘একদমই না!’
শিমলার মামারা এবার হেসে উঠলো।
,
শিমলা আর নক্ষত্র পাশাপাশি বসে। শিমলার পড়নে সেই দুপুরের শাড়িটাই। নক্ষত্র এবার একটা সাদা কালারের পাঞ্জাবী পড়েছে। বন্ধুরা মিলে ওকে পড়িয়ে দিয়েছে। কাজী সাহেব নক্ষত্রকে কবুল বলতেই ও ফুরফুর করে তিনবার কবুল বলে দিলো। শিমলা সহজে কবুল বলছে না। মাথা নিচু করে ফুঁপিয়েই যাচ্ছে। নক্ষত্র এবার ওকে ধমকে বলে উঠলো,
– ‘কবুল বলছিস না কেন! বলে পরে কাঁদতে থাক।’
নক্ষত্রের বাবা এবার রেগে ওকে ধমকে উঠে বললেন,
– ‘ওই তুই চুপ থাক।’.
নক্ষত্রের ধমকে শিমলার কান্না যেনো আরও বেড়ে গেলো। তখনও এভাবে ধমকে ধামকে বিয়ে করেছে৷ আর এখনও সবার সামনে ওকে ধমকে কবুল বলতে বলছে! কান্না চাপিয়ে কোনোমতে শিমলা এবার ভাঙ্গা গলায় বললো,
– ‘কবুল।’
,
,
,
প্রাহী আপাতত করিডোর দিয়ে হাঁটছে। কিছুক্ষণ আগে ওর মা ওকে ফোন দিয়ে নক্ষত্র আর শিমলার বিয়ের ব্যাপারে সবকিছু জানিয়েছে। মন ওর বেজায় খারাপ। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে ও ভেবেছিলো বেশ নাচ গান এঞ্জয় করবে। তা আর হলো কই? অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, নিজের ছোটো বেলার বান্ধবীই নিজের ভাইয়ের বউ ভাবতেই একটা ভালো লাগা কাজ করছে। ওর ভাই যে এভাবে ওদের সবাইকে চমক দিবে এটা ও ভাবেনি! রসকষহীন নক্ষত্রের মনে যে এতো আবেগ, প্রীতি,ভালোলাগার ভাবাবেশ রয়েছে তা ওর জানা ছিলোনা! আকসাদ তো সবকিছু শুনে হেসে হেসে বলেছে, ‘ভালো কাজই তো করেছে! এর আগেই এই পদক্ষেপ নিলে হয়তো আমাদের সাথে ওদের বিয়েটাও বেশ ধুমধাম করে হয়ে যেতো!’
প্রাহী প্রতিউত্তরে কিছু বলেনি, মনে মনে ভাবলো ‘আরও একটি বিয়ে কিভাবে ফুট করে হয়ে গেলো!’
করিডোরের শেষ প্রান্তে এসে একটা রুমের ভিতর থেকে ঠাস করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে প্রাহী দাঁডিয়ে গেলো। রুমের দরজার দিক তাকাতেই দেখলো এটাতো সেই রুমটা! সেদিন ও এই রুমটায় ঢুকেও ঢুকেনি! প্রাহী দরজার লকটায় হাত দিয়ে ঘুরাতেই লকটা খুলে গেলো। ধীরপায়ে ভিতরে যেতেই দেখলো সাদা লাইটের হালকা আলোয় রুমটার সবকিছু পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে। রুমটা একদম সাধারণ। একটা ড্রেসিং টেবিল, ওয়াড্রপ, আর একটা টেবিল রয়েছে। রুমের মাঝ বরাবর খেয়াল হতেই প্রাহী বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। রুমের মাঝে পেতে রাখা একটা বড় খাটের উপর একজন শুয়ে আছে। প্রাহী একটু এগোতেই দেখলো আকসাদের মায়ের মতো বয়সীই এক মহিলা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হাতে ক্যাথেটার, নাকে পাইপসহ অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। পাশেই স্যালাইনের স্টান্ড, দেয়ালে টাঙানো থার্মোকেয়ার মনিটর থেকে হার্টবিট এর রেখাগুলো বাঁকাভাবে চলতে দেখা যাচ্ছে। প্রাহী অবাকভাবে কিছুক্ষণ মহিলার দিক তাকিয়ে থাকলো। মানুষটা দেখতে বাঙালীদের মতোই। মিষ্টি ফর্সা, কাঁচাপাকা চুলগুলো অগোছালোভাবে খোপা অবস্থায় পড়ে আছে, খাড়া নাক, ফ্যাকাশে মুখ আর ঠোঁট। চোখের নিচে কালি পড়ে আছে! মহিলার অসুস্থের ভার উনার মুখেই প্রকাশ পাচ্ছে। প্রাহীর ভাবনার মাঝেই আকসাদ ওকে ডেকে উঠলো। প্রাহী এগিয়ে এসে নিচে পড়ে থাকা গ্লাসটা সাইড টেবিলে রেখে মহিলার গায়ের চাদর ভালোভাবে দিয়ে রুম থেকে ও বেড়িয়ে এলো।
– ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’
হাতে রাখা পানির জগটা টেবিলে রেখে প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম। আপনার কাজ শেষ!’
আকসাদ ল্যাপটপ টা বন্ধ করে বললো,
– ‘হু ফাইনালি।’
প্রাহী মাথা নেড়ে আয়নার সামনে বসলো। চুলগুলো খুলে জট ছাড়িয়ে ঢিলেঢালা একটা খোপা করলো। আয়নার দিক তাকাতেই দেখলো আকসাদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাহী লাজুক হেসে আকসাদের দিক ফিরলো।
– ‘ঘুমাবেন না!’
আকসাদ হাতের ইশারায় ওকে বললো,
– ‘এদিকে এসো!’
প্রাহী আলতোপায়ে আকসাদের একটু কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। আকসাদ ওকে হাতের ইশারায় আরেকটু কাছে ডাকতেই প্রাহী আরও কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। আকসাদ আবার ডাকলে প্রাহী এগোতেই আকসাদ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কোলে বসালো। খোলা ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে জড়ানো গলায় বললো,
– ‘ঘুমাতে হলে তো তোমাকে লাগবে। জানোনা!’
প্রাহী আকসাদের বাহু খামচে ধরলো। ধীরে ধীরে আকসাদের স্পর্শ আরও গাঢ় হলো। ঘাড়ের ডানপাশে ভেজা ঠোঁটের স্পর্শ আর দাঁতের খোঁচায় প্রাহী শিউরে উঠলো। অনেকক্ষণ পর প্রিয়তমার ঘাড়ে নিজ আদরের চিহ্ন এঁকে আকসাদ প্রাহীর দিক তাকালো। প্রাহী লাজুক চোখে আকসাদের দিক তাকিয়ে চোখ নিচে নামালো। আকসাদ মুচকি হেসে প্রাহীর চুলগুলো কানে গুজে দিলো। কি মরে প্রাহী এবার মাথা তুলে আকসাদকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘ উম…আকসাদ!’
আকসাদ প্রাহীকে বুকে জড়িয়ে বললো,
– ‘হু বলো জান।’
প্রাহী একটু হাসলো। এরপর ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘করিডোরের শেষের দিকের রুমটায় একজন মহিলাকে দেখলাম আজ। উনি কে?’
আকসাদ ঝট করে প্রাহীকে বুক থেকে তুলে বললো,
– ‘তুমি ওই রুমে গিয়েছিলে!’
প্রাহী চোখের পলক ফেলে একটু অনুতাপের সুরে বললো,
– ‘হ্যাঁ আসলে ওঘর থেকে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজে গিয়েছিলাম। যেয়ে দেখি একজন মধ্যবয়সী মহিলা শুয়ে আছে। আ’ম সরি আসলে আমি…।’
আকসাদ প্রাহীকে ফের বুকে জড়িয়ে বললো,
– ‘ইটস ওকে প্রাহী! এখানে সরির কিছুনেই। একদিন না একদিন তুমি উনার ব্যাপারে জানতেই।’
প্রাহী মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আচ্ছা উনি কে?’
আকসাদ হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘উনি আমার ফুপি হয় প্রাহী।’
প্রাহী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘ফুপি! আপনার না একটাই ফুপি তাও তো উনি ঢাকায় থাকে! তাহলে ইনি!!!’
আকসাদ মাথা নেড়ে বললো,
– ‘আমার বাবারা আসলে দু’ভাই দু’বোন। যাকে একটু আজকে দেখেছো উনি আমার ছোটো ফুপি হয়। আসলে ফুপি পড়াশোনার খাতিরে আমেরিকায় এসে এক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে উনারা বিয়েও করে ফেলে। বিধর্মী এক ছেলেকে বিয়ে করায় আমার দাদু,দিদা এই সম্পর্ক কোনোভাবেই মেনে নেননি। সাথে আমার বাবা,চাচা,ফুপিদেরও মানা করে দেয় ছোটো ফুপির সাথে কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ না রাখার জন্য। কিন্তু আমার বাবা ছোটো ফুপিকে অনেক ভালোবাসতেন। শুধু বাবা না চাচ্চু,বড় ফুপিও অনেক ভালোবাসতেন নিজের বোনকে। এজন্য অগোচরে হলেও ছোটো ফুপির সাথে উনারা কথাবার্তা বলতেন।’
প্রাহী সবশুনে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘উনি কি অসুস্থ!’
আকসাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– ‘হুম ছোটো ফুপি কমায় আছেন। আজ আটমাস যাবৎ।’
প্রাহী বিস্ময়কর কন্ঠে বললো, ‘কি?’
আকসাদ মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ, আজ থেকে আটমাস আগে ফুপি আর উনার হাজবেন্ড কানাডায় উনাদের নতুন এপার্টমেন্ট দেখতে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে কার এক্সিডেন্টে ফুপা আর ফুপি গুরুতর ভাবে আহত হয়। আশেপাশের মানুষজন কাছের হাসপাতালে নিয়ে এডমিট করায়। ফুপা সেখানেই মারা যায়। আর ফুপির ব্রেইনে সিরিয়াস ইঞ্জুরির জন্য কোমায় চলে যায়। তারপর বাবা ফুপিকে এখানে নিয়ে এসে বাড়িতেই ফুপির যাবতীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়।’
– ‘উনার দেখাশোনা কি নার্স করে?’
– ‘নার্স করে,মাঝেমধ্যে মাও করে, আবার আমি যেয়ে রোজ হেলথ চেক করে মেডিসিন দিয়ে আসি।’
প্রাহী জিজ্ঞেস করলো,
– ‘উনার কোনো বাচ্চা নেই!’
আকসাদ শ্বাস ফেলে বললো, ‘ছিলো, ও মারা গেছে দেড় বছর আগেই।’
প্রাহী আহত সুরে বললো, ‘একটা মানুষ নিজের স্বামী সন্তান হারিয়ে নিজেও একদম নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে আছে! কি কঠিন নিয়তি! আল্লাহ্ উনাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দিক! আমিন্।
আকসাদ প্রাহীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওকে জড়িয়ে বললো,
– ‘হুম। এখন ঘুমাও আগামীকাল থেকে তোমার ক্লাস শুরু না!’
প্রাহী মাথা নাড়ালো। আকসাদ ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
– ‘বেশ! তাহলে ঘুমাও আমি তোমাকে আর আয়সুনকে দিয়েই ল্যাবে যাব।’
,
সকালে ক্লাস সেরে আয়সুন আর প্রাহী পার্কের এক বেঞ্চিতে বসে দু’জন আইসক্রিম খাচ্ছে। আকসাদ বলেছে নিতে আসবে। তাই ওরা এখানে বসে গল্প করতে করতে সময় পার করছে। সামনে তাকাতেই প্রাহী…
চলবে….