মন একে একে দুই পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
4

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৫(অনুভূতির জালে)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

– ‘এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে এদিকে তাকিয়ে আছে কেন?’

মনে মনে কথাটা আওড়িয়ে প্রাহী আশেপাশে তাকালো। এত এত হাজারো শ্বেতাঙ্গদের মাঝে মাথার সম্মুখ অংশের অর্ধেক চুলবিহীন এই লোক ওদের দিকে কেমন শকুনের নজরে চেয়ে আছে! প্রাহী কিছুক্ষন ওর মন অন্যদিকে নিবেশ করলো। কিছুক্ষণ পর তাকাতেই আবার দেখলো লোকটার দৃষ্টি ঘুরেফিরে ওদের দিকেই! এবার তিরিক্ষি নজর দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাহীর কেন যেন ভালো ঠেকছে না বিষয়টা। লোকটাকে ওরা চিনে না! একজন অচেনা মানুষ কখনও কোনো কারণ ছাড়া এভাবে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে তাকিয়ে থাকবে না নিশ্চয়ই! প্রাহী পাশ ফিরে দেখলো আয়সুনের খাওয়া হয়েছে কি না! আয়সুন আইস্ক্রিমের লাঠিটা পাশের ডাস্টবিনের ঝুড়িতে ফেলতেই প্রাহী ওর হাত ধরে বললো,

– ‘সামনের ওই ভেনসি শপিং মলে যাবে!’

আয়সুন সেদিক তাকিয়ে দ্রুত মাথা নাড়লো,
– ‘হ্যাঁ চলো! আমার একটা পার্স কিনা লাগবে সামনের ফ্রাইডে তে ফ্রেন্ড এর বার্থডে পার্টির জন্য।’

– ‘চলো তাহলে! তোমার ভাইয়া আসতে আসতে আমরা একটু ঘুরে আসি!’

আয়সুন মাথা নাডিয়ে প্রাহীর সাথে চঞ্চল পায়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকলো। প্রাহী পিছন ফিরে পুনরাহ শ্বেতাঙ্গের ওই কঠোর চাহনী পরখ করতেই দ্রুত আয়সুনের হাত ধরে ভিড়ের মাঝে নিজেদের হারিয়ে ফেললো।

,

,

,

আকসাদ আজ একটু ব্যস্ত। মেডিসিনগুলো মাইক্রোবায়োলজিষ্ট দের দ্বারা চেক করিয়ে বার বার নিজেও লিকুইডগুলোর লেবেল, একটিভ ইনগ্রিডেন্ট, লেয়ারগুলো চেক করে স্টুডেন্ট দের দিয়েও চেক করাচ্ছে। এত এত মেডিসিন এক দিনে চেক করা সম্ভব নয় নিশ্চয়ই। তাও যতদূর সম্ভব চেক করে জলদি সব কাজ মিটানো যায় সেটারই চেষ্টা করছে ওরা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করে ওর মাথা একটু ব্যথা করছে। চোখ থেকে গোগলস খুলে একটা চেয়ারে যেয়ে বসলো। হাতে থাকা ড্রপার টা টেবিলে রাখতে যাবে তার আগেই ওর চোখ পড়লো। জেনি যেখানটায় দাঁড়িয়ে কাজ করতো সেই জায়গা টায়। কপালে দু’আঙুল ঠেকিয়ে আকসাদ সেদিকটায় তাকিয়ে রইলো। ওর জায়গার পাশে আরও তিনজন দাঁড়িয়ে নিজেদের মতো কাজ করছে। আকসাদ কি মনে বলে উঠলো,

– ‘স্যাম, টিনা এবং এইজেল তোমাদের টেস্ট করা কি কমপ্লিট!’

টিনা মাথে নেড়ে বললো,

– ‘ আরও একটু বাকি আছে স্যার!’

– ‘তাহলে তোমরা এককাজ করো কর্ণারে রাখা মেডিসিন গুলোর লেয়ারগুলো আরেকবার চেক করে টেস্টেড শেলফে রেখে দাও। পরে এখানে এসে বাকি কাজগুলো করো।’

এইজেল লিকুইডগুলো রেখে বললো, ‘ওকে স্যার।’

বলেই ওরা তিনজন আকসাদের কথামতো মেডিসিনগুলো টেস্টার মেশিনে এ দিলো। ওরা যেতেই আকসাদ সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। জেনি যেখানে কাজ করতো তার পাশে টিনা ওরা এতক্ষণ এককাজ করছিলো। আর আরেকপাশে একদম কোনায় আরেকজন কাজ করে৷ সেখানে কিছু টেস্টার, টাফনেস টেস্টার রাখা,কিছু লিকুইড রাখা। জেনি সাধারণত মেডিসিনগুলো টেস্টই করতো। লিকুইড নিয়ে কোনো কাজ সাধারণত এইবার ও করেনি। কারণ অর্ধেক স্টুডেন্ট মেডিসিন বা কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করলে বাকিরা সেগুলোর টেস্ট বা পিএইচ চেক করতো। জেনির পাশের টেবিলে কিছু ক্যামিকেল রাখা। বেশিরভাগ ক্যামিকাল হচ্ছে জেনোপসিন, ইটরিয়াম, জিরকোমিয়াম এর। আকসাদ সেদিক তাকিয়ে জেনি যেখানে কাজ করতো সেখানে আসতেই ওর টেবিলে রাখা থার্মোসাইক্লার মেশিনের একপাশে কলম দিয়ে কিছু লেখা। আকসাদ ভ্রু কুঁচকালো। মেশিন বা ল্যাবের কোনোকিছুর উপর কলম বা পেনসিল দিয়ে আঁকাআঁকি করা নিষিদ্ধ। যা কিছু লেখার খাতায় লিখতে হবে! এটা আকসাদ অনেক আগেই ওদের ডিক্লেয়ার করে দিয়েছিলো। তারপরও জেনি এভাবে মেশিনের উপর লেখালিখি করলো কেন! আকসাদ লেখাগুলোর উপর ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই থমকালো। কলম দিয়ে স্পষ্ট ভাবে একপাশে লিখে রাখা ‘X Y Z’। লেখাটা জেনি ক্লু হিসেবে রেখে গিয়েছিলো। যেটা এখানেও লিখে রেখেছে! গ্লাভস পরিহিতি হাত দ্বারা লেখার উপর হাত বুলিয়ে পাশের টেবিলে রাখা লিকুইড গুলোর দিক আকসাদের ওর নজর গেলো। লিকুইডগুলো হাতে নিয়ে কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করতেই আকসাদ দ্রুত লিকুইডগুলোর নাম আরেকবার চেক করলো। কিছু একটা ভাবতেই আকসাদ আর সময় ব্যয় না করে দ্রুত এক সাইডে যেয়ে ভিঞ্চি কে কল করলো। ওপাশ থেকে ভিঞ্চি কলটা রিসিভ করতেই ও সাথে সাথে বলে উঠলো,

– ‘ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই ওয়েলস্ বোর্ডে আয়। কাম ফার্স্ট।’

বলেই আকসাদ ফোন রেখে স্টুডেন্ট এর উদ্দেশ্য বললো,

– ‘বাকি কাজগুলো নেক্সট ল্যাবে করা হবে। যে যেই মেডিসিন চেক করছিলে সেগুলো অবশ্যই প্রপার চেক করে লকারে রেখে যাবে।’

স্টুডেন্টরা মাথা নাড়াতেই আকসাদ দ্রুত ব্যাগ হাতে বেড়িয়ে গেলো। তার আগে প্রাহীদের নিয়ে বাসায় দিয়ে আসতে হবে। তারপর যা করার করতে হবে।

,

,

,

ফুলসজ্জিত খাটে শিমলা বসে আছে। পরনে ওর বাদামী রঙের একটা সাদা থ্রি-পীস। ওড়নার এক প্রান্ত ধরে ও বারবার তা হাতে পেঁচাচ্ছে। সারাটা জীবন বান্ধবীর ভাইকে ভাইয়ের নজরে দেখে এসে আজ হুট করে তাকে বর হিসেবে মেনে নেওয়াটা ওর জন্য আসলেই খুব পীরাদায়ক! তার মধ্যে এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলের সাথে এক ছাদের নিচে এখন থেকে থাকতে হবে ভাবতেই ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। খট করে দরজা খোলার আওয়াজে ও জড়োসড়ো হয়ে বসলো৷ নক্ষত্র ঘুরে ঢুকেই আগে ওয়াশরুমে গেলো। শিমলা বিছানার গোলাপের পাপড়িগুলো তাকাতেই ওর এক অজানা ভয়ে মন ঝেকে উঠলো। এমনেই এই লোক জোর করে ওকে বিয়ে করেছে। এখন তো ওর উপর নক্ষত্রের পূর্ণ অধিকার আছে। যদি এই অধিকারের জোড়ে ওর সাথে আজ নক্ষত্র…। ওর চিন্তার মাঝেই নক্ষত্র ওয়াশরুম হতে বেড়িয়ে এলো। টেবিল থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে পানি খেতেই ওর নজর গেলো একদম চিপে বসে শিমলার দিকে। অর্ধেক পানি খেয়ে ও শিমলার দিক আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘তোর শাড়ি কই?’

নক্ষত্রের প্রশ্নে শিমলা একটু নড়েচড়ে বসলো। মিনমিনে গলায় উত্তর দিলো,

– ‘গর…গরম লাগছিলো। তাই চেঞ্জ করেছি।’

নক্ষত্র বাকি অর্ধেক পানিটা খেয়ে জবাব দিলো,

– ‘একটু পর তো আরও গরম লাগবে তখন কি করবি?’

নক্ষত্রের কথায় শিমলার হৃদয় টা যেনো এবার থেমে গেছে! ও ফ্যালফ্যাল চোখে নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে আছে। এ…এই ছেলে কি সত্যিই আজ ওর সাথে…। ভাবার আগেই নক্ষত্র ওর গা ঘেষে বসলো। শিমলা সাথে সাথে দূরে সরে বসলো। নক্ষত্র স্থির দৃষ্টি দিয়ে শিমলার দিক তাকিয়ে আছে। মেয়েটার মাথায় ওড়না জড়ানো, ফোলাফোলা চোখমুখ জুড়ে এক স্নিগ্ধতা কাজ করছে, ভয়ে মুখটা এটুকুন হয়ে আছে! নক্ষত্র আবার ঘেষে শিমলার পাশে বসতেই শিমলা আবার সরবে তার আগেই নক্ষত্র ওর হাত চেঁপে ধরে ওর সাথে বসালো। শিমলা এবার ভয়ে ভয়ে নক্ষত্রের দিক তাকাতেই দেখলো নক্ষত্রের শান্ত দৃষ্টি ওর দিকেই! শিমলা চোখ নামিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এই লোকের শক্তি এর সাথে ও পেরে উঠছেনা। শিমলা ভয়চকিত চোখে নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘হাত ছাড়ুন।’

নক্ষত্র যেনো ওর হাত আরও জোড়ে চেপে ধরলো। শিমলা এবার কাঁপা গলায় বললো,

– ‘দে…দেখুন…।’

নক্ষত্র ওর দিকে ঝুঁকে বললো,
– ‘হু দেখছি তো!’

শিমলা এবার মুখ পিছিয়ে তড়িত কন্ঠে বললো,

– ‘আপনি এভাবে আমার সাথে জোড় করতে পারেন না। একেই আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে বিয়ে করেছেন । তার উপর এভাবে এখন জোরাজুরি করছেন! কোনো বিবেক নেই আপনার মাঝে? আমি যেখানে সারাটা জীবন আপনাকে ভাই বলে ডেকে এসেছি সেখানে কিভাবে আপনি আমাকে…।’

আর কিছু শব্দ ছোড়ার আগেই নক্ষত্র এবার শিমলার গাল জোড়ে চেপে ধরলো। শিমলা ব্যাথায় চোখমুখ খিচে নিলো। নক্ষত্র ওর মুখের উপর ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,

– ‘বেশি বলে ফেলেছিস! আর না! বিবেক নেই মানে! বিবেক থাকলে সসম্মানে বিয়ে করতাম না। ওই বদ্ধ ঘরে আটকে রাখতাম নিজের সাথে! পরে মুখে চুনকালি লাগিয়ে বিয়ে করলে ভালো হতো তাইনা! আর কি কি ভাই ভাই করছিস!’

শিমলার গাল আরও জোড়ে চেপে ধরে নক্ষত্র বললো,
– ‘তোর আপন ভাই লাগিনা বুঝেছিস! আর একবার ভাই ভাবতাম, ভাই বলে ডেকে এসেছি এই ধরনের কথা বলবি তোর একটা একটা করে দাঁত ভাঙবো! আমাকে তো চিনিসই! যা বলি তাই করে ফেলি! দেখলিই তো আজকে তাইনা?’

শিমলা কোনো কথা বলছে না৷ ব্যথায় ওর চোখে পানি জমে গেছে। নক্ষত্র দ্রুত ওকে ছেড়ে দিয়ে টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে শুতেই শিমলা এবার লাফিয়ে উঠলো। ভাঙ্গা গলায় অনুরোধের সুরে বললো,

– ‘শুনুন আমায় একটু সময় দিন! এভাবে জোরজবরদস্তি করবেন না দয়া করে! আমি এখন এসবের জন্য প্রস্তুত নই…।’

নক্ষত্র ওকে আবার নিজের সাথে জড়িয়ে শুইয়ে গম্ভীর গলায় বললো,

– ‘প্রস্তুত নোস নিজেকে কালকের মধ্যে প্রস্তুত করে নিবি! আমার এতো সময় দেয়ার ধৈর্য নেই। আপাতত ঘুমা নইলে জোরজবরদস্তি করতে একসেকেন্ডও সময় নিবনা।’

শিমলা ভয়ে চোখ বুঝে নক্ষত্রের বুকে পড়ে রইলো। আজ ছাড় পেলেও কাল তো ঠিকই নক্ষত্র ওকে ধরবে! তখন কি হবে! এ কথা ভাবতেই শিমলা এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। নক্ষত্র সাথে সাথে ওর কামিজের ভিতর হাত গলিয়ে ওর পাতলা কোমড় চেঁপে ধরলো। শিমলা শিউরে উঠতেই নক্ষত্র বললো,

– ‘বলেছিলাম ঘুমাতে। তুই এক কথা শুনার মানুষ না বুঝলাম।’

শিমলা মাথা নেড়ে কেঁপে বললো,

– ‘ন…না। ঘুমাচ্ছি তো, এইযে চোখ বুঝলাম!’

নক্ষত্র আর কিছু বললো না। শিমলা অনেক কষ্টে ফুঁপানো বন্ধ করে চোখ বুঝে রইলো। নক্ষত্র এখনও ওর কোমড় থেকে হাত সরাচ্ছেনা। শিমলা বিড়বিড়িয়ে বললো,

– ‘হাতটা সরান প্লিজ! এভাবে আমার ঘুম আসবে না।’

শিমলার মিনতির সুড়ে নক্ষত্র এবার হাত জামার ভিতর থেকে বের করে বললো,

– ‘আজকের মতো ছাড়ছি। কাল থেকে এর অভ্যাস করে নিতে হবে।’

বলে নক্ষত্র কোমড় জড়িয়েই শুয়ে থাকলো। শিমলা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে চোখ বুঝলো। দিনের এত ঝড়ঝাপটা, কান্না, আর চিন্তায় ডুবে থাকার দরুন ঘুম এসে ওর চোখে মিনিটেই ধরা দিলো। বুকে গরম নিশ্বাস পড়তেই নক্ষত্র মাথা নিচু করে দেখলো শিমলা গুটিশুটি মেরে ওর বুকে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটার চেহারার দিক ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কেউ কি ভেবেছিলো এই পুঁচকি মেয়ের জন্য আজ ও এমন জোড়তোড় করে বিয়ে করবে!

নক্ষত্র তখন ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। প্রাহী ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে! নক্ষত্র একদিন দুপুর বেলায় বারান্দায় বসে ফোন টিপছিলো তখনই একটা মেয়ের চিকন কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই ও চোখ মেলে চাইলো। দেখলো দু’বেনী দুলিয়ে উজ্জ্বল শ্যামরাঙা এক মেয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে। কাজল কালো চোখ, পাতলা শরীরের গড়ন, ওড়নায় আঙুল পেঁচিয়ে মিষ্টি সুরে ওকে বলছে,

– ‘আসসালামু আলাইকুম। প্রাহী আছে?’

নক্ষত্র কিছুক্ষণ মেয়েটাকে পরখ করে ঘরের ভিতর প্রাহী আছে জানালে বিনিময়ে মেয়েটা ওকে মুচকি হাসি দিয়ে চঞ্চল পায়ে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। মেয়েটাকে সেদিন সারাদিন চোখের সামনে দেখেই ওর দিনটা পেরিয়েছে। সেদিনই নক্ষত্র জানতে পারে মেয়েটা ওর বাবার বন্ধু শামিম কাকার মেয়ে শিমলা। নক্ষত্র তখনই চিনতে পারে ওকে। আগে ছোটোবেলায় রোজ ওকে দেখতো। বড় হওয়ার পর আর সেভাবে ওকে দেখা হয়ে উঠেনি। কারণ নক্ষত্র কলেজ লাইফ থেকেই ঢাকায় পড়াশোনা করেছে তাই ও বেশিরভাগ শহরের বাইরেই থাকতো। সেদিনের পর থেকেই যেকোনো কারণেই নক্ষত্র এর সামনে শিমলা আসলেই ও আড়চোখে শুধু মেয়েটার দিক তাকিয়ে থাকতো। কেন তাকিয়ে থাকতো ও জানে না! শুধু জানতো মেয়েটার ওই উজ্জ্বল শ্যামলার মায়ায় ভরা মুখটা আর চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলা, চঞ্চল ব্যবহার ওকে বেশ টানতো ওর দিক! মেয়েটা ওর সাথে নিজ থেকেই সালাম দিয়ে কেমন আছে না আছে জিজ্ঞেস করতো। ও স্বাভাবিকভাবেই ওর সাথে কথা বলতো।

ভার্সিটির ছুটি শেষে নক্ষত্র ঢাকায় চলে গেলো। গিয়েই পরলো আরেক সমস্যায়। উঠতে, বসতে, চোখ বন্ধ করতেই শিমলার শ্যামলা গোলগাল মুখখানা ওর চোখে ফুটে উঠতো। প্রথম প্রথম ভেবেছে এতদিন মেয়েটার মায়াভরা মুখটা সবসময় সামনে দেখতো। এজন্য হয়তো এভাবে ওর কথা মনে পড়ছে! এইসব ভেবে নিজেকে বুঝ দিলেও কিছুতেই ওর শান্তি মিলছিলো না। বন্ধুমহলকে এক পর্যায়ে এই কথা জানালেই সবাই ওকে ঘিরে জোড়ে বলে উঠেছিলো, ‘মামা তুমি তো প্রেমে ফেঁসে গেছো!’

নক্ষত্র তখন সেইসব কথায় পাত্তায় দেয়নি। এর মধ্যে দু’দিনের ছুটিতে কি মনে করে খুলনায় আবার গেলো। একদিন প্রাহীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বোনকে কলেজ থেকে আনতে যেতেই ওদিন ওর হৃদয় এর ধুকপুকানি ওর সমস্ত মিছে স্বান্তনাগুলোকে ধাক্কা মেরে ওর মন থেকে সরিয়ে দিলো। নিজের বোনের পাশে হলুদ শাড়ি পড়া, খোলা চুল, কানে গুজানো দু’টো লাল গোলাপ, কাজল লেপ্টানো চোখ, আর ঠোঁটে চওড়া হাসি সহিত মেয়েটাকে দেখে ওর মনমস্তিষ্ক সেদিন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।সেদিনই ও বুঝে গিয়েছিলো প্রেম ভালোবাসা কি ও বোঝেনা বা জানেনা, কিন্তু এই মেয়েকে ওর লাগবে। লাগবে মানে লাগবেই! এরপর থেকেই ওর পাড়ার বন্ধুদের দ্বারা শিমলার উপর নজর রাখাতো। ফলে খবরাখবর নক্ষত্রকে ওর বন্ধুরা দিতো। আর যদি কোনো ছেলেকে শিমলার সাথে কথা বলতে শুনেছে সেদিনই শিমলার সাথে ও খেঁকিয়ে কথা বলতো। এরকম দু’দিন পর পর মেজাজ দেখিয়ে কথা বলতো বিধায় এক পর্যায়ে শিমলাও পালটা কথার জবাব দিতো। যার দরুন দু’জনের সম্পর্কটা সাপে নেউলের মতো হয়ে গিয়েছিলো। নক্ষত্র ভেবেছিলো মাস্টার্স শেষেই শিমলাদের বাড়িয়ে প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু সেদিন ওর বন্ধু নয়ন যখন ওকে বলেছে শিমলাকে দেখতে আসছে। তাও পাত্র নাকি ওর বড় মামীর ছেলে! তখনই নক্ষত্র আর রিস্ক নেয়নি। কারণ ও জানে শিমলার বড় মামী মানুষটা একদমই সুবিধার নন। চটজলদি ঢাকায় এসে প্ল্যান করে মেয়েটাকে বিয়েটা করেই নিয়েছে ও।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নক্ষত্র শিমলার ঘুমন্ত মুখটার দিক তাকিয়ে ও মনে মনে ভাবলো, মেয়েটা এখন ওর বউ! ভাবতেই শান্তি লাগছে ওর। শুধু এখন ওর রপ্ত অনুভূতির জালে মেয়েটাকে ফাঁসাতে পারলেই হয়েছে! যেমনটা ও ফেঁসেছিলো! শিমলার ফোলা ফোলা গালে নক্ষত্র নিজের পুরো ঠোঁট ডুবিয়ে ওর মাথার চুলের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ও ঘুমিয়ে পড়লো।

,

,

,

আকসাদ আর ভিঞ্চি আপাতত দশতালার একটা এপার্টমেন্টের সামনে এসে লিফটে করে আটতালায় পৌঁছালো। কাঙ্ক্ষিত ফ্ল্যাটের সামনে যেয়ে কলিং বেল প্রেস করতেই ওপাশ থেকে কেউ দরজা খুলে দিতেই আকসাদ মুখে চওড়া হাসি দিয়ে বলে উঠলো,

– ‘হ্যালো জেড!’

চলবে,,,

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৬(ট্রেপ!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

হঠাৎ নিজের বাসার সামনে আকসাদকে দেখে জেড বেশ অনেকটাই চমকে গিয়েছে। বিস্মিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আকসাদ এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভিঞ্চির দিক বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজেকে সামলে ও উত্তর দিলো

– ‘স্যার! আপনি…এখানে?’

আকসাদ হাসলো,
– ‘হ্যাঁ! তোমাকে দেখতে হঠাৎ কেন জানি ইচ্ছে করছিলো। তাই চলে এলাম! যাই হোক, ভিতরে ঢুকতে বলবে না!’

জেড মাথা নেড়ে বললো,

– ‘জ্বি নিশ্চয়ই! আসুন না স্যার।’

ও সরে যেতেই আকসাদ আর ভিঞ্চি ধীর পায়ে বাসার ভিতর ঢুকলো। বাসাটা নিরিবিলি গুছানো। ভিঞ্চি ঘুরে ঘুরে বসার ঘরের আসবাবপত্র সহ প্রত্যেকটা কোনা কোনা দেখছে। আকসাদ একটা সিংগেল সোফায় বসে জেডের দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘তা তোমার শরীর কেমন?’

জেদ ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

– ‘এইতো স্যার, আ’ম ওয়েল।’

আকসাদ মাথা নেড়ে আশেপাশে তাকিয়ে বললো,

– ‘তাহলে গত দু’তিনদিন ধরে তুমি ল্যাবে আসছো না যে! এনি প্রব্লেম?’

জেড হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
– ‘নো…নো স্যার, আসলে শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই…।’

আকসাদ সাথে সাথে ওর দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘কিন্তু তুমি তো বললে তোমার নাকি শরীর ভালো!’

জেড আমতাআমতা করতেই ভিঞ্চি সোফায় রাখা ব্যাগের দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘কোথাও যাচ্ছ নাকি তুমি?’

জেড থতমত খেয়ে বললো,

– ‘না…না আসলে এমনেই একটু বেরোচ্ছিলাম।’

ভিঞ্চি ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

– ‘একটু বেরোনোর জন্য এভাবে ট্রলি ব্যাগ গুছিয়ে বেরোনো লাগে! কোথায় যাচ্ছ! ফার ফ্রম হোম?’

জেড এবার ঘামছে। ও বুঝে গেছে এরা এমনি এমনি এখানে আসেনি! ওর উচিত ছিলো আরও আগেই এখানে থেকেই চলে যাওয়া! এখন তো মনে হচ্ছে ভালোই ফেঁসেছে ও। আচ্ছা উনারা কি ওকে এখন সন্দেহ…। না না কিছুতেই কিছু বুঝতে দেওয়া যাবেনা। কিছুতেই না। আকসাদ এদিকে জেডের টেবিলের উপর কিছু বোতলে মেথাডন, কেনাবিসের মতো একদম হাই পাওয়ারের কিছু বিপর্যস্ত ড্রাগ রাখা। আকসাদ ড্রাগগুলো দেখে জেডের দিক মুখ করে বললো,

– ‘ তোমার কাছে এই ড্রাগগুলো কি করছে জেড?’

– ‘তুমি ঘামছো কেন এভাবে?’

জেদ কোনো শব্দ করছেনা। আকসাদ এবার ঠোঁটের কোনে ছোটো হাসি টেনে বললো,

– ‘আচ্ছা জেড, তোমার পুরো নাম কি?’

একথা শুনতেই জেড এবার মেইন দরজার লকের দিকে তাকালো। কোনোদিক না তাকিয়ে এবার ও এক দৌড়ে দরজার কাছাকাছি এসে পৌঁছাতেই পিছন থেকে কেউ ওর কলার টেনে ধরলো। জেড হুরমুরিয়ে পড়তে গেলেই ভিঞ্চি ওর কলার সমিত হাতের বাহু ধরে টেনে এনে রুমের মাঝ বরাবর একটা চেয়ারে বসালো। ভিঞ্চি ওর কলারটা ঠিকঠাক করে দিতে দিতে বললো,

– ‘পালিয়ে লাভ নেই! অযথা সময় অপচয় না করে যা যা জিজ্ঞেস করছি তার উওর দাও, হু?’

আকসাদ জেডের দিক ঝুঁকে বললো,
– ‘তোমার ফুল নেইম বলো?’

জেড ভয়ে আকসাদের দিক তাকিয়ে হাত দিয়ে মুখ, চুল চেঁপে ধরে মাথা নিচু করে ফেললো। আকসাদ ফের ওকে বললো,

– ‘জেদ! কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে আমি!’

জেদ আগের ন্যায় মাথা নিচু করে আছে। এবারও এভাবে চুপ করে থাকায় ভিঞ্চি এবার জেডের কাঁধ ঝাঁকিয়ে শক্ত করে ধরে বললো,

– ‘লিসেন জেড! ভালোভাবে কথার উত্তরগুলো দাও।’

জেড মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝাতেই ভিঞ্চি এবার শ্বাস ফেলে বললো,

– ‘ওকে! তাহলে এক কাজ করা যাক! তোমাকে থানায় নিয়ে বলি ঘরে এভাবে ইলিগ্যাল ভাবে ঘরে ড্রাগ রাখার জন্য জেলের ভিতর ঢুকানো টা আমার জন্য খুব একটা কঠিন ব্যপার নয়। তবে লস একটাই। এই ড্রাগের অপরাধের দরুন তোমার ব্রাইট ফিউচার বা ক্যারিয়ারটা সারাটা জীবন বা জীবনের অর্ধেক সময় চারদেয়ালের মধ্যেই আটকা পড়ে যাবে! চলো উঠো।’

ভিঞ্চি জেডের কাঁধে ধরে উঠাতেই জেড এবার জোড়ে বলে উঠলো,

– ‘বল…বলছি বলছি।’

ভিঞ্চি ওকে ছেড়ে দিতেই জেড খপ করে চেয়ারে বসে বললো,

– ‘আমা…র পুরো নাম জেইরেন ইয়াং জেড।’

আকসাদ ওকে বললো,

– ‘তোমার বাবা বা মা কেউ কি চাইনিজ?’

জেড মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ, আমার বাবা চীন এর।’

আকসাদ এবার জেডের সামনে এসে দাঁড়ালো,

– ‘ জেনি মারা গেছে তা জানো নিশ্চয়ই!’

জেদ মাথা তুলে আকসাদের দিক তাকাতেই ও বললো,

– ‘আর ও মারা যাওয়ার আগে তোমার নামের প্রথম তিনটা অক্ষরগুলো লিখে গেছে। ইন্টারেস্টিং তাইনা!’

জেড এবার ঢোক গিলে বললো,
– ‘মা…মানে!’

ভিঞ্চি এবার ওর দিক ঝুঁকে বললো,
– ‘মানে এই যে জেনির মৃত্যুর কারণ তুমি বা এর পিছনে তোমার হাত আছে নিশ্চয়ই!’

জেড এবার স্বজোড়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘না না আমি…আমি জেনি কে মারিনি। বিশ্বাস…বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কাউকে মারিনি।’

আকসাদ এবার ওকে ঝাঁকিয়ে বললো,

– ‘তাহলে ও তোমার নাম এর অক্ষরগুলো এভাবে লিখে গেলো কেন? কিছু তো একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে তাইনা! নইলে একজন মৃত্যু পথযাত্রী কেন তোমার নাম এভাবে লিখে যাবে!’

জেড কাঁপা গলায় বললো,
– ‘আমি জানি না।’

আকসাদ শান্ত গলায় বললো,

– ‘জানো কি না জানোনা সেটা তো এখন আমি বুঝবো!’

আকসাদ এবার ভিঞ্চির দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘ওকে লক আপে ঢুকানোর আর্জেন্ট ব্যবস্থা কর। ওখানে যেয়ে যা কথা হবার হবে।’

জেড এবার আঁতকে উঠে আকসাদের হাত ধরে অনুরোধের স্বরে বললো,

– ‘স্যার…স্যার প্লিজ এমনটা করবেন না। আমি… আমি বলছি স্যার। কি জানতে চান বলুন আমি সব বলছি।’

আকসাদ জেডের দিক তাকালো। ছেলেটার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। ভিঞ্চি এবার জেডের সামনে এসে ওকে বললো,

– ‘তোমার টেবিলে এই হাই পাওয়ারের একদম রো ড্রাগগুলো কি করছে! এতদিন ধরে যে বিভিন্ন ল্যাবের যে মেডিসিনগুলো বাইরে ইম্পোর্ট করা হতো সেখানে যে ড্রাগ পাওয়া যেতো সেখানে কি তাহলে তোমার হাত আছে! তুমি কি জড়িত এগুলোর সাথে?’

জেড মাথা তুলে ভিঞ্চির দিক তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বললো,
– ‘না স্যার। আমি এসবের সাথে জড়িত নই। আর না তো আমি জেনিকে মেরেছি।’

আকসাদ এবার হালকা চেঁচিয়ে উঠলো,
– ‘তাহলে কে মেরেছে ওকে! আর এই ড্রাগ তাহলে তোমার কাছে কেন! কিছু যদি করে নাই থাকো তাহলে যাই জানো তুমি বলছো না কেন?’

আকসাদের ধমকের আওয়াজে জেড কিছুটা কেঁপে উঠলো।

– ‘আজ থেকে তিনমাস আগে ল্যাব শেষে যখন বাসায় আসি তখন আমার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজটা ছিল অনেকটা এরকম যে ‘যদি আপনজনদের প্রতি মায়া থাকে তাহলে ডু এজ উই সে!’ আমি তখন এতোটাও পাত্তা দেইনি কারণ এধরনের স্প্যাম ম্যাসেজ প্রায়ই আমার ফোনে আসতো। এর দু’সপ্তাহ পর আবারও একই ধরনের ম্যাসেজ আসলে আমি বরাবরের মতো এড়িয়ে যায়। কিন্তু একদিন যখন ছোটো বোনের একটা ছবি দিয়ে বলে, ‘একে মারতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না!’ তখনই আমার বুকটা কেঁপে উঠে। কারণ আমার বোন ওবধি যারা পৌঁছে গিয়ে এমন ম্যাসেজ আমাকে দিচ্ছে তাহলে নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে! কিন্তু আমাকে এমনভাবে হুমকিস্বরূপ ম্যাসেজ বা প্রাণঘাতীর ভয় দেখানোর কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার কোনো শত্রু নেই। তাও একমাত্র বোনটার কথা চিন্তাভাবনা করে আমি বলে উঠি যে ওরা কি চায়। ম্যাসেজে ওরা শুধু বলে, আপাতত আমি যেই ল্যাবে কাজ করছি তার প্রত্যেকটা খবরাখবর আমায় ওদের দিতে হবে। না চাওয়া স্বত্তেও আমি ল্যাবের খবরগুলো ওদের দিতাম। মাঝখান দিয়ে আকসাদ স্যার কয়দিন ল্যাব ওফ রাখায় আমি আর তেমন কোনো খবর ওদের দিতে পারিনি। আর ওরাও আমায় তেমন বিরক্ত করেনি। কিন্তু এর মাঝে আকসাদ স্যার ফিরে এলে ওরা আবার আমায় ল্যাবের খবরাখবরগুলো ওদের দিতে বলে। এর মধ্যে আকসাদ স্যার যখন বলে যে এবার আমাদের ল্যাব হতে মেডিসিন ইম্পোর্ট হবে, এ খবর ওদের দিতেই ওরা আমাকে এবার ওদের সাথে দেখা করতে বলে।’

ভিঞ্চি এবার সিরিয়াস হয়ে বলে,

– ‘তুমি ওদের সাথে দেখা করেছো!’

জেড মাথা নেড়ে বলে,

– ‘হ্যাঁ না করে উপায় নেই। কারণ আমার বোনটার সব ইনফরমেশন ওদের হাতে। আমার বোনের জন্য হলেও আমায় দেখা করতে হতোই।’

– ‘ওদের চেহারা দেখেছো কারোরও?’

জেড মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
– ‘না স্যার। ওরা দু’জন এসেছিলো আমার সাথে দেখা করতো। তাও চোখে সানগ্লাস আর মুখে ওদের মাস্ক ছিলো।’

ভিঞ্চি ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘দেখা করতে বলেছিলো কেন?’

জেদ একটা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘কোনো কথা তেমন বলেনি। শুধু আমাকে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলেছে বাকি কথা ফোনে হবে।’

– ‘তারপর?’

আকসাদের প্রশ্নে জেদ এবার মুখ নিচু করে বললো,

– ‘এরপর আমি বাসায় এসে ব্যাগটা খুলতেই দেখলাম সেখান হাই পাওয়ার আর হার্মফুল কিছু ড্রাগে ভরা। সেদিন রাতেই আমার ফোনে ম্যাসেজ আসলো, যেই মেডিসিনগুলো ল্যাব থেকে ইম্পোর্ট করা হবে সেখানে এই ড্রাগগুলো মিক্স করতে হবে। আমি এককথায় মানা করে দেই৷ কারণ এভাবে আমার আর ভালো লাগছিলোনা। ক্রমাগত মনে হচ্ছিলো আমার সহকর্মীদের বিশেষত আকসাদ স্যারকে আমি ঠকাচ্ছি। কারণ এভাবে গুপ্তচরের মতো নিজের ল্যাবের গোপন খবর বাইরের কাউকে দিয়ে আমার নিজের কাছে নিজেকে বেশ ছোটো মনে হচ্ছিলো। দু’দিন আর কোনো ম্যাসেজ আমার ফোনে আসেনি। ভেবেছি এই কাহিনী এখানেই শেষ। কিন্তু না একদিন বিকেলে একটা ছবি আমাকে পাঠানো হয়। সেখানে দেখা যাচ্ছিলো আমার বোনকে ঘিরে দুটো লোক বসে আছে। আর ওর হাতে স্কুল ব্যাগ। আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই করতেই ওরা রাফলি আমাকে জানায়, কথামতো কাজ না করলে আমার বোনের লাশ আমার দরজার সামনেই ফেলে যাবে ওরা। দিক বেদিক ভুলে আমি ওদের কথায় রাজি হয়ে যাই। একদিন ল্যাবশেষে প্ল্যানমতো আমি ভেবে রাখি সবাই চলে গেলে যখন চারপাশ নীরব হয়ে যাবে তখন গ্রাউন্ডে যেখানে মেডিসিনগুলো রাখা আছে সেখানে যেয়ে আমি ড্রাগগুলো আস্তেধীরে মিশিয়ে বেড়িয়ে আসব। প্ল্যানমতো স্যার সেইদিন আমাদের সবাইকে কাজ শেষে বাসায় চলে যেতে বললে সবাই তখন চলে যাচ্ছিলো। আমি কিছুক্ষণ ক্যান্টিনে থেকে গ্রাউন্ডে তৈরীকৃত মেডিসিনগুলো যেখানে রাখা সেখানে যেয়ে ড্রাগের শিষিগুলো বের করে মেডিসিনে ঢালতেই সেখানে জেনি কোথাথেকে যেনো চলে আসে। আমায় দেখে ও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তার মধ্যে আমার হাতে ড্রাগের বোতল দেখে ও আমাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, মেডিসিনে আমি ড্রাগ মিশাতে এসেছিলাম কি না! আর এতদিন ধরে আশেপাশে যে কাহিনী হচ্ছে তার জন্য আমিই দায়ী কি না। আমি মানা করে বলি ও যেটা ভাবছে তেমনটা নয়! ওকে কোনো রকম বুঝ দিয়ে আমি সেদিন চলে এলেও জেনি বুঝে গিয়েছিলো একটা না একটা ঝামেলা এর মধ্যে আছেই! একদিন দেখলাম জেনি আকসাদ স্যারের রুমে গিয়েছে, আমি বুঝে গিয়েছিলাম ও আমায় নিয়ে কিছু বলার জন্যই স্যারের কাছে গিয়েছে। কিন্তু স্যার সেদিন ব্যস্ত থাকায় ওর কথা শুনতে পারেনি। এদিকে আমি স্যার যাতে কিছু না টের পায় এজন্য পরের দিন জেনিকে পার্কের এক সাইডে ডেকে ওকে বুঝাই যে এই সব কিছুর পিছনে আমার হাত নেই। আমি সিচুয়েশনের জন্য ফেঁসে গেছি। কিন্তু জেনি বুঝতে চাইছিলো না, বার বার বলছিলো স্যারকে ঠকিয়ে আমি ঠিক করিনি। এর জন্য আমায় স্যারের কাছে জবাব দিতেই হবে। ও স্যারকে সব জানাবেই। এ কথা বলে এগোতেই ওর মাথায় কোথা থেকে এক বুলেট এসে লাগতেই ও ঠাস করে নিচে পড়ে গেলো। আমি দ্রুত ওর মাথা কোলে নিয়ে অনেকবার ডাকলেও ও যখন সারা দিচ্ছিলো না তখন বুঝে গেছি যে জেনি আর নেই। আর ওর মৃত্যুর পিছনে ওই লোকগুলোই দায়ী! আমি এদিক ওদিক তাকাতেই দূর হতে কালোগাড়ির ভিতর দু’জনকে দেখেই বুঝে যাই যে এরাই জেনিকে গুলিটা করেছে। কারণ ওরাই আমাকে ড্রাগগুলো দিয়েছিলো। আমি কোনো রকম ওখান থেকে দৌঁড়ে চলে আসি। ভাবিনি যে মৃত্যুর আগে জেনি আমার নাম এভাবে লিখে যাবে।’

আকসাদ সবটা শুনে জেডের দিক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জেড মাথা আকসাদের দিক তাকিয়েই মাথা নিচু করে ফেললো। অপরাধবোধ ওকে কুঁড়ে খাচ্ছে৷ জেড এবার নিচু হয়ে আকসাদের পা জড়িয়ে কেঁদে উঠলো,

– ‘স্যার…স্যার আমি এইসব করতে চাইনি স্যার। আমি ভুক্তভোগী স্যার। আমার বোন ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমরা ছোটোবেলায় অরফানেজে বড় হয়েছি। আমি অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করে এই পর্যন্ত এসেছি। আমার বোনটা মাত্র সিক্সে পড়ে। ওকে নিয়ে এভাবে হুমকি দেয়ায় আমি আর নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারিনি স্যার। নইলে আপনাকে কেন কাউকেই ঠকানোর কোনো ইচ্ছা আমার ছিলোনা স্যার। আমি কখনও কারোর কোনো ক্ষতি করিনি স্যার। কিন্তু এই প্রথম আমি বাধ্য হয়ে এমন করেছি স্যার। আমায় ক্ষমা করুন স্যার। প্লিজ আমায়… আমায় আপনি…।’

আকসাদ ওকে মাটি থেকে তুলে চেয়ারে বসালো। ওর কাঁধে হাতে রেখে বললো,

– ‘আমাকে যদি আগে জানাতে তাহলে হতো জেনির আজ এই অবস্থা হতোনা!’

জেড ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,

– ‘আ’ম…আ’ম সরি স্যার। স…সরি।’

আকসাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– ‘মেডিসিনে ড্রাগ মিশিয়েছো তুমি?’

জেড সাথে সাথে বললো,
– ‘না স্যার। সেদিন জেনি চলে আসায় আমি আর মেশাতে পারিনি।’

ভিঞ্চি এবার বললো,
– ‘যারা তোমার সাথে কথা বলেছে ওদের নাম্বার আছে!’

জেদ মাথা নেড়ে বললো,
– ‘না স্যার ওদের সাথে আমার ই-মেইলেই কথা হতো।’

– ‘ই-মেইলগুলো দেখাও।’

জেদ ভিঞ্চির কথামতো নিজের ল্যাপটপ টা ভিঞ্চিকে এনে দিতেই ভিঞ্চি তা ওপেন করে ই-মেইলগুলো দেখতে থাকলো। ভ্রু কুঁচকে ও জেডের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘প্রত্যেকটা মেইলের প্রথমে বা শেষে ch-420, ch-139, rh-890 এগুলো লেখা কেন?’

জেড বললো,
– ‘ইটস এ কোড। ওরা কোডের মাধ্যমে একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করে।’

আকসাদ ভিঞ্চির কাছ থেকে ল্যাপটপ টা নিয়ে দেখতে থাকলো। ভিঞ্চি জেদকে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘তার মানে প্রত্যেকটা ল্যাবে তোমার মতো স্টুডেন্ট রাই এভাবে মেডিসিনে ড্রাগ মিশিয়েছে এতোদিন?’

জেড নাক টেনে বললো,
– ‘শুধু স্টুডেন্ট রা না স্যার। ল্যাব এসিস্ট্যান্ট, কিছু স্যাররাও এ কাজ করেছে। কিন্তু স্যার ওরা সবাই আমার মতোই ভুক্তভোগী ছিলো। নিজ জীবনের মায়া,পরিবারের মায়ায় না পারতে ট্রেপে পড়ে এই কাজ সবাই করেছে।’

আকসাদ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
– ‘মেডিসিনে ড্রাগ মিশানোই কি ওদের মেইন উদ্দেশ্য?’

জেড আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘মেডিসিনে ড্রাগ মিশিয়ে আপনার বা আপনার বাবার নাম ডোবানোই হয়তো ওদের মেইন উদ্দেশ্য নয়। আমার যতটুকু মনে হয় এটা ‘ড্রাগ র‍্যাকে…।’

– ‘ড্রাগ র‍্যাকেটিং রাইট!’

জেড ‘হ্যাঁ’ বোঝাতেই ভিঞ্চি আকসাদের দিক চেয়ে বললো,
– ‘তার মানে আমরা ঠিক গেসই করেছিলাম! মেডিসিনে ড্রাগ মিশিয়ে এক পর্যায়ে দেশের বাইরে যেয়ে সেখান থেকে ড্রাগ আলাদা করে বিজনেস করে! তার মানে এখানে বাইরের দেশের মানুষও জড়িত!’

জেড এবার বলে,

– ‘আর এসবের পিছনে যে হেড। উনিই মেইন কালপ্রিট।’

আকসাদ জেডের দিক তাকাতেই ও বললো,
– ‘উনার কথাতেই সব হয়। আড়ালে এই কালকাঠিগুলো উনিই নাড়ে। বাকি সবাই উনার কথামতো কাজ করে। আমাকে যখন এই ড্রাগগুলো দিতে এসেছিলো তখন ওরা ‘বস’ নামের কাউকে সম্বোধন করে কথা বলছিলো। তখনই বুঝেছিলাম যে সবকিছুর পিছনে হয়তো এই দায়ী।’

ভিঞ্চি খানিকটা চিন্তিত সুরে বললো,

– ‘আন্ডারগ্রাউন্ডের কোনো মাফিয়া…।’

আকসাদ মাঝে বললো,
– ‘এর চেয়েও হয়তো বড় কিছু। কারণ বিভিন্ন দেশ জুডে যে এইভাবে ড্রাগ র‍্যাকেটিং করে বেড়াচ্ছে তার হাত এত ছোট নয়।’

জেড এইবার ভয়গলায় বললো,
– ‘আমিতো আপনাদের সব বলে দিয়েছি স্যার। এখন আমার বোন, স্যার আমার বোনটাকে যদি এবার ওরা…।’

ভিঞ্চি জেডের কাঁধে হাত রেখে বললো,

– ‘কিচ্ছু হবে না তোমার বোনের। আমরা সেই বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখব!’

ভিঞ্চি আকসাদের দিক ফিরলো,

– ‘সমস্যা তো ভালোই জটিল?’

– ‘আর সেটা দ্রুত সমাধান করতে হবে। খুব দ্রুত।’
বলেই আকসাদ বাইরে তাকালো।

,

,

,

আঁধার রাতের পরিবেশে শিমলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় একঘন্টা যাবত ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ যাবত ও অনেক কিছুই ভেবেছে। এই যেমন ওর এভাবে বিয়ে হওয়া, একরাতের মাঝেই জীবনে এত পরিবর্তন সবকিছু নিয়ে ভেবে ভেবে সময় পেরিয়ে গেছে। শিমলা মনে মনে আওড়ালো, বিয়েটা যেহেতু একবার হয়েই গেছে সেক্ষেত্রে এটাকে মেনে নিয়েই সামনে আগাতে হবে। কিন্তু তার আগে নক্ষত্রের সাথে ওর কথা বলার দরকার। ওর অতীতের কিছু কথা নক্ষত্রকে বলবে বলে ও ঠিক করেছে। কারণ একসাথে যেহেতু সংসার ওরা করবেই একজন আরেকজনের ব্যপারে জেনেশুনেই আগানোটা উত্তম। সেক্ষেত্রে শিমলা আগেভাগে সবকিছু নক্ষত্রকে বলে দিবে বলে ঠিক করেছে। যাতে পরে নক্ষত্র ওকে এ নিয়ে যাতে কোনো কথা শুনাতে না পারে। ভাবনা-চিন্তার মাঝেই একজোড়া হাত যখন শিমলার পেট পেঁচিয়ে ধরলো তখন শিমলা কিছুটা লাফিয়ে উঠতেই ওর কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বললো,

– ‘হুশ!!! আমি?’

নক্ষত্রের আওয়াজ পেয়েই শিমলা কিছুটা শান্ত হলো। তবে নক্ষত্রের ঘন শ্বাস ওর ঘাড়ে পড়তেই শিমলা কিছুটা নড়ে উঠলো। নক্ষত্রের হাত ওর কোমড় জড়িয়ে ধরতেই শিমলা শিউরে উঠলেও নিজেকে ধাতস্থ করে আস্তে করে বললো,

– ‘আমার…আমার আপনাকে কিছু বলার ছিলো।’

নক্ষত্র শিমলার ঘাড়ে মুখ রেখেই বললো,

– ‘বল।’

নক্ষত্রের ঠোঁট শিমলার নরম ঘাড়ে আছড়াতেই শিমলা চোখ বুঝে ধীর গলায় বললো,

– ‘দেখুন…আমাদের বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে। এখন আপনি আমায় জোর করে বিয়ে করেছেন, আমার অমতে বিয়ে করেছেন, আমাকে শ্বাসিয়ে বিয়ে করেছেন এই নিয়ে পড়ে থাকলে কেউই হয়তো সেভাবে আগাতে পারবো না। তাই বিয়েটা উপেক্ষা করে বসে থাকলে লাভের লাভ হয়তো কিছুই হবেনা।’

– ‘মাথায় ঘিলু ঢুকেছে তাহলে! যাক আমার আর এই বয়ানগুলো তোকে দিতে হলোনা। ভেবেছিলাম তোর প্যান প্যান কান্নার জন্য এগুলো আমায় বলে তোকে বুঝ দিতে হবে।

শিমলার এবার মেজাজটা চটলো। ইচ্ছা হচ্ছে লোকটাকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিতে। ফালতু একটা! এত কিছু করেও এর কোনো অনুতাপ নেই! উল্টো আরোও চটাং চটাং কথা বলছে। তাও ও নিজেকে শান্ত রাখলো। কারণ কথাগুলো বলা জরুরি। শিমলা ধীরে বললো,

– ‘আমায় বুঝ দিতে হবেনা। আমি বুঝি বলেই বিয়েটা মানার চেষ্টা করে এগোতে চাচ্ছি। আর তার জন্য আপনায় আমার কিছু বলার ছিলো। আমার অতীত নিয়েই। কারণ সবটা শুরুর আগে আমি চাই আমার দিক থেকে যা যা আপনাকে জানানোর দরকার সব বলে এরপর আগাতে। আর এখন আপনি আপনার ব্যাপারে কিছু বলবেন কি বলবেন না সেটা আপনার ব্যপার। কিন্তু আমি আমার দিক থেকে ক্লিয়ার থাকতে চাই।’

নক্ষত্র স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– ‘কি বলবি বল।’

শিমলা ঠোঁট ভিজিয়ে ফিচেল গলায় বলে উঠলো,

– ‘আমি…আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’

নক্ষত্র সাথে সাথে ওর হাত দ্বারা শিমলার কোমড় ঘুরিয়ে ওকে…

চলবে,,,

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৭(নিছোক বোধ!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

– ‘আমি…আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’

নক্ষত্র সাথে সাথে ওর হাত দ্বারা শিমলার কোমড় ঘুরিয়ে ওকে নিজের দিকে ফেরালো।

– ‘কি বললি আবার বল?’

নক্ষত্রের শান্ত কন্ঠে শিমলা আতঙ্কিত চোখে একবার নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বললো

– ‘আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’

নক্ষত্র কিছুক্ষণ শিমলার দিক তাকিয়ে রইলো। অতঃপর ধীর কন্ঠে বললো,

– ‘ভুল। তুই যাকে ভালোবাসার কথা বললি না! তাকে তুই কখনো ভালোই বাসিস নি।’

শিমলা অবাক হয়ে নক্ষত্রের দিক তাকালো। কি বলে এই ছেলে? সেই কিশোরী বয়স থেকে যেই ছেলেটাকে ও মনে প্রাণে চেয়ে এসেছে তাকে নাকি কখনও ও ভালোইবাসেনি! ক্ষিপ্ত কন্ঠে ও শুধালো,

– ‘কি বললেন আপনি? এতদিন ধরে যাকে চেয়ে এসেছিলাম, যাকে নিয়ে একটা সময় ভাবনায় বিভোর ছিলাম তাকে আমি কখনও ভালোবাসিনি! আপনি ভালোবাসার মানেটা কি বোঝেন বলুন তো? যে হুট করে এমন একটা কথা আমায় বলে দিলেন! যে আমি নাকি কখনও ভালোইবাসিনি তাকে?’

নক্ষত্র শিমলাকে ছেড়ে ওর পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। ওর দিক তাকিয়ে স্মিত হেসে ভারী কন্ঠে বললো,

– ‘ভালোবাসা কি এর সঠিক ব্যখা হয়তো আমার কাছে নেই। কিন্তু যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসি তার সাথে নিজের বিচ্ছেদ তো দূর খানিকটা দূরুত্বও তো কারো সহ্য হওয়ার কথা না। যাকে ভালোবাসি সে অন্য কাউকে নিয়ে দিব্যি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখবে আর সেটা চোখের সামনে সয়ে যাওয়াও কারো কাম্য নয়! যাকে ভালোবাসি তার পাশে অন্য কেউ কিংবা সেই শখের পুরুষটা যদি কাউকে নিজের করে নেয় তাহলে সেটা অনায়াসে মেনে নিয়ে শুধু হালকা কষ্ট পাওয়াই কোনো ভালোবাসা নয়।’

শিমলা হতবিহ্বল হয়ে নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে রইলো। নক্ষত্র এর কথাগুলো শুনে খানিকটা স্তম্ভিত হলেও নক্ষত্র কি তাহলে জানে শিমলা কাকে পছন্দ করতো সেই মানুষটার কথা! এটা ওকে বেশি ভাবাচ্ছে। আর জানলেই তা কিভাবে জানে? শিমলা কম্পনরত ঠোঁটে কোনোরকম নক্ষত্রকে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘আপ…আপনি কিভাবে জানেন আমি আক…।’

নক্ষত্র শান্ত কন্ঠে শিমলাকে বললো,

– ‘তোর নিজের ভালোবাসার মানুষ হেসেখেলে বিয়ে করে দূর দেশ পাড়ি দিলো! আর তুই সেটা মাত্র জলচোখে চেয়ে দেখলি! যদি ভালোইবাসতি তাহলে আজ তুই এভাবে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতি না। হয়তো ঘরের কোণে বিধ্বস্ত অবস্থায় শোকে পড়ে থাকতি বা এতো সহজে সবকিছু মেনে নিতি না। যখন শুনেছিস তোর ভালোবাসার মানুষটার বিয়ে অন্তত নিজের মনের কথাটা তাকে জানানোর জন্য একবার হলেও উদগ্রীব হতি বা চেষ্টা করতি। ফলাফল শুন্য হলেও তুই তোর জায়গা থেকে একটা চেষ্টা বা পদক্ষেপ নিতি। তা না করে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থেকে ভালোবাসার মানুষটার বিয়ে তুই দেখে গেলি! ভালোবাসার মাঝে সেক্রিফাইস থাকবে ইটস ফাইন কিন্তু এতো স্টুপিডিটি কখনোই থাকবে না! এখন তুই হয়তো বলবি তাহলে কি আমি সেই মানুষটাকে ভালোবাসি না! বা আমার অনুভূতি গুলো কি তাহলে হেয়ালী ছিলো! না তোর অনুভূতি গুলো হেয়ালী ছিলো না। তোর আসলে তার প্রতি একটা তীব্র ভালোলাগা ছিলো। এক কথায় যাকে বলে তুই তাকে অনেক পছন্দ করতিস। যখন তখন তাকে দেখতিস তোর ভালো লাগতো, মন খুশি হতো আর এটাকে তুই একসময় ভালোবাসার সংজ্ঞায় ফেলে দিলি। যেটা একান্তই তোর ভ্রান্ত মনোভাব ছাড়া আর কিছুই না! এই যেমন ধর কাউকে আমাদের খুব ভালো লাগে হুট করে যদি শুনি সেই মানুষটা আমাদের থেকে দূরে চলে যাবে তা শুনলে আমাদের যেমন খুব করে মন খারাপ হয় তার রেশ ধরে চোখের কোণ বেয়ে বৃষ্টিও নামে! তোর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে! নয়তো তুইই দেখ যাকে ভালোবাসলি সে এতদূর পাড়ি জমালো সেখানে তোর অনুভূতি বা অবস্থা কিন্তু শোকে বা কষ্টে শোচনীয় নয়!’

শিমলা নক্ষত্রের কথায় এবার থমকালো। কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে কিছু বলেও বলে উঠতে পারছেনা। কিভাবে বলবে! ওর গলার শব্দগুলোকে যেনো নক্ষত্র তার বিশাল পাথর সমিত কথায় থামিয়ে দিয়েছে! নক্ষত্র শিমলাকে দেখে হাসলো। সেই হাসি ছিলো শিমলার কাছে দৃশ্যমান। নক্ষত্র টের পেয়েছিলো অনেক আগেই শিমলার আকসাদের প্রতি যে একটা অনুভূতি কাজ করতো! প্রায় সময় লাজুকভাবে আকসাদের দিক তাকানো, হেসে ওর সাথে কথা বলা, উৎসূচকভাবে আকসাদের আশেপাশে থাকা সবটাই ও খেয়াল করেছিলো। নক্ষত্রের এসব দেখে মেজাজ বিগড়ালেও শিমলার আকসাদের প্রতি অনুভব টা যে এত গভীর নয় সেটা টের পেতেই ও আর কিছু বলেনি। কারণ ভালোবাসার নজরে কোনটা আর ভালোলাগার নজরের চাহনী এটা নক্ষত্র বেশ ভালোই জানে! তাই ও এসব দেখা স্বত্তেও চুপ ছিলো। নইলে এতোগুলো বছর যাবৎ যাকে আগলে রেখেছে তার অন্য পুরুষের প্রতি এত উৎসাহ দেখা স্বতেও নীরব থাকার মতো ছেলে নক্ষত্র নয়! শিমলার অনুভূতি গুলো আকসাদের প্রতি এতোটাও প্রগাঢ় ছিলোনা। যা নক্ষত্রের বুঝতে বেশি সময় লাগেনি।

শিমলার ভ্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাদ ফেলে নক্ষত্র রুমে চলে গেলো। আজ না হয় শিমলা একটু ভাবুক ! অনুভুতির হিসেব নিকেষ কষে বের করুক ও এতদিন কোন ধরনের অনুভাবে মত্ত ছিলো!

শিমলা এদিকে নক্ষত্রের কথাগুলো মন থেকে ফেলতে পারছেনা। যখন আকসাদরা চলে গিয়েছিলো তারপর ওর খারাপ লাগলেও নিত্যদানকার জীবনের অভ্যাস আর ঝামেলার মাঝে ওর খারাপলাগাগুলো যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিলো। রাত হলে খারাপ লাগতো তবে সেটা ক্ষাণিকের জন্য! নয়তো এইযে ওর বিয়ে হয়ে গেলো দু’রাতের মাঝে ও নক্ষত্রকে একটা জীবন গুছানোর সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছে,বিয়েটাকে একটাকে সূযোগ দিবে বলেও ঠিক করেছে! কই এতো কিছুর মাঝে আকসাদের ভাবনা তো একবারও ওর মনে উঁকি দেয়নি! তবে কি ওর অনুভূতি, বোধ বা অনুভাবগুলো কি সব ফিচেল ছিলো!

,

,

,

– ‘উম…এটা অনেক তেঁতো।’

আকসাদ হাসলো। প্রাহী মুখটা বিকৃত করে রেখেছে। আজ ও প্রাহীকে নিয়ে বেডিয়েছে। এখানে আসার এই ঝামেলা সেই ঝামেলায় মেয়েটাকে নিয়ে এই আর বের হয়ে একটু সময় দিতে পারেনি। তাই আজ তাড়াতাড়ি অফিস সেড়ে ওরা হিউরোন লেকে এসেছে। আপাতত হাতে দু’জনেরই কফি।

– ‘তোমাকে বলেছিলাম এক্সপ্রেসো তেঁতো হয়। তুমি লাটে বা ক্রিমি কফি নাও। শুনোনি তো তখন?’

প্রাহী মুখটা গোমড়া করে বললো,

– ‘আপনি এটা নিয়েছেন। ভেবেছি আমিও নেই।’

আকসাদ হেসে বললো,
– ‘আচ্ছা না ভালো লাগলে খেয়ো না।’

প্রাহী ঠোঁট উল্টে বাকি আকসাদের কফির মগের ঢাকনা খুলে তাতে ঢেলে দিলো। আকসাদ ভ্রু কুঁচকে প্রাহীর দিক তাকালে প্রাহী দাঁত কেলিয়ে বললো,

– ‘শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং! হি হি। ‘

আকসাদ প্রাহীর দিক এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

– ‘আজ্ঞে না! আপনি খেতে পারছেন না বিধায় আমায় দিয়েছেন! এটাকে শেয়ার করা বলেনা।’

প্রাহী আড়চোখে আকসাদের দিক তাকিয়ে ওর হাত ধরে বললো,

– ‘আচ্ছা চলুন চলুন। বোটে উঠবো। শেয়ার করা কাকে বলে বাসায় যেয়ে শুনবো নি।’

আকসাদ প্রাহীর কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
– ‘সত্যি! বাসায় যেয়ে আমি তোমায় যতোটা আদর দিব ততোটা আদর তুমি আমার সাথে শেয়ার করবে!’

প্রাহী আকসাদের হাত ছেড়ে এবার জোড়েসোড়ে হাঁটা শুরু করলো। আকসাদ হেসে দৌড়ে যেয়ে প্রাহীর হাত ধরে ওকে বোটের কাছে নিয়ে গেলো। বোটে করে ওরা একদম লেকের সাইডে আসলো। যেখান দিয়ে মেইন রোডে উঠা যায়। প্রাহী আর আকসাদ সেই মেইন রোড দিয়ে আপাতত হাঁটতে লাগলো। আকসাদের গাড়ি সামনেই পার্ক করা। হাঁটতে হাঁটতে প্রাহী একটা উঁচু বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে থেমে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকলো। প্রায় ৬০ তালা বিশাল ভবনটি দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে যার পুরোটাই চাকচিক্যে ঘেরা, হাইফাই স্বচ্ছ গ্লাসের ভিতর দেখা যাচ্ছে ডেস্কটপের সামনে মানুষরা যার যার মতোন কাজ করে যাচ্ছে, কোথাও আবার এটাচ ক্যাফেটেরিয়ায় দু’একজন হাত নেড়ে নেডে কথা বলছে। আকসাদ প্রাহী কে আসতে না দেখে পিছন ফিরলো। মুখ হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাহীর কাছে যেয়ে ওর মুখটা আস্তে করে ও বন্ধ করে দিলো। প্রাহী চমকে আকসাদের দিক তাকিয়ে সামনে তাকিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘এটা কিসের বিল্ডিং?’

আকসাদ সামনে তাকিয়ে বললো,
– ‘এটা কর্পোরেট অফিসের বিল্ডিং।’

প্রাহী মুগ্ধচোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘সুন্দর!’

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘তুমি বিবিএ নিয়ে পড়ছো না! কোনটা নিয়ে মেজর করার ইচ্ছা?’

প্রাহী উৎফুল্লভাবে বললো,
– ‘একাউন্টটিং!’

আকসাদ প্রাহীর কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘তাহলে তুমি এখানে একদিন জব করবে ইনশাল্লাহ!’

প্রাহী বিস্ময় নিয়ে আকসাদের দিক তাকাতেই ও বললো,
– ‘ইয়েস! পড়াশোনা করে ঘরে বসে থাকবে কেন! ইচ্ছে হলে নিজ পায়ে দাঁড়াবে। জব বা বিজনেস যেটা করার করবে! দরকার হলে আমি তোমাকে সাপোর্ট করবো পুরোভাবে!’

প্রাহী আবেগমাখা দৃষ্টিতে আকসাদের কাঁধে মাথা রেখে বললো,

– ‘ইনশাল্লাহ্!’

,

,

,

আকসাদ একটা হসপিটালের সামনে গাড়ি থামাতেই আকসাদ নেমে প্রাহীকে বললো,

– ‘আমার একটু কাজ আছে তুমি রিসিপশনে বসো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি!’

প্রাহী রিসিপশনে যেয়ে বসলো। আকসাদ দ্রুত তিনতালা যেয়ে সেখানকার রিসিপশনে যেয়ে বললো,

– ‘ড.পিটার আছেন?’

রিসিপশনিস্ট মাথা নেড়ে বললো,
– ‘আছেন! ২০৩ নম্বর রুমেই! কিন্তু এখন উনার ব্রেক টাইম।’

আকসাদ ব্যাস্ত গলায় বললো,
– ‘বলুন যে আকসাদ নামের একজন দেখা করতে এসেছে। তাহলেই হবে।’

রিসিপশনিস্ট কথামতো ফোন দিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর ‘আকসাদকে বললো,

– ‘আপনি যেতে পারেন!’

আকসাদ দ্রুত রুমের সামনে যেয়ে নক করতেই ভিতর থেকে আওয়াজ এলো ‘কাম ইন’। আকসাদ দরজা খুলে ঢুকতেই দেখলো সাদা চুলওয়ালা বৃদ্ধু একজন লোক চেয়ারে বসে ওর দিকে হাসিহাসি মুখে তাঁকিয়ে আছে। বয়সের ভারে উনার চামড়া প্রায় কুঁচকে এসেছে।

– ‘আরে আকসাদ আসো আসো। হাও আর ইউ?’

আকসাদ চেয়ারে বসতে বসতে বললো,

– ‘আ’ম ফাইন। আপনি কেমন আছেন?’

– ‘আ’ম গুড! কিন্তু তুমি হঠাৎ এখানে! কোনো কাজে এসেছো! তোমার বাবার কি অবস্থা এখন! সমস্যা মিটেছে!’

আকসাদ মাথা নেড়ে বললো,

– ‘এখনও মিটেনি। সেই কাজেই এসেছি।’

ড.পিটার ভ্রু কুঁচকে বললেন,

– ‘মানে???’

আকসাদ ফোনটা বের করে ডা.পিটারকে দেখিয়ে বললেন,

– ‘উনার প্রত্যেকটা ডিটেইলস আমার চাই।’

পিটার কিছুক্ষণ সেই ছবির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা আমি দেখছি।’

আকসাদ এবার বললো,
– ‘আরেকটা কথা?’

– ‘হ্যাঁ বলো!’

আকসাদ সিরিয়ার ভঙ্গিতে বললো,
– ‘আপনাদের এখানে এক বা দুইবছর আগের লাশ কি মর্গে রাখা হয়!’

পিটার মাথা নেড়ে বললেন,
– ‘না সব রাখা হয়না। স্পেসিফিক কিছু রিজন ছাড়া।’

আকসাদ কি মনে করে বললো,
– ‘আমি একবার মর্গে যেতে চাই!!!’

পিটার কিছুক্ষণ আকসাদের দিক তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে বললো,

– ‘ওকে এসো! কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবেনা।’

আকসাদ ‘হ্যাঁ’ বোধক ইশারা করে বললো,
– ‘থ্যাংক ইউ! আমার বেশিক্ষণ লাগবেও না।’

চলবে,,,