#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৫০_অন্তিম_পর্ব(আবেশিত)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘আপনি তো এই পর্যন্ত কিছু বললেন না!’
নক্ষত্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
– ‘কি বলতাম!’
শিমলা ওড়নায় ডগায় আঙুল পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,
– ‘এইযে আমায় পছন্দ করেন কিংবা ভালো…বাসেন কি না!’
নক্ষত্র স্বাভাবিককন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘তা এগুলো আবার বলা লাগবে নাকি!’
শিমলার আঙুলের ডগা হতে ওড়নাটা পড়ে গেলো। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
– ‘মানে?’
নক্ষত্র এবার শিমলার কোমড় ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বললো,
– শোন আমি এতো প্রেম, ইন্দ্রিয় অনূভুতির ব্যখা লুতুপুতু ভাবে দিতে পারবো না। আমার ব্যবহার, আদর, সোহাগে কিছু বুঝলে বুঝবি না বুঝলে নেই। আর অবশ্য কাল রাতের পর থেকে না বোঝার তো কিছু নেই! তুই তো আর কচিখুকি নশ তাইনা! এখন কাছে আয়। দূরে না থেকে আমার সাথে বেশি বেশি ঘেষবি বুঝলি!
শিমলাকে আরও কাছে নিজের সাথে চেঁপে ধরলে শিমলা এবার চট করে নক্ষত্রের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে দূরে সরিয়ে দাঁড়ালো। আবার ওর মেজাজ টা গরম হচ্ছে। কই একটু আদর আহ্লাদ করে নিজের মনের কথাগুলো প্রকাশ করবে! তা না করে এই লোক খটখট করে কতগুলো কথা ওকে ছুড়ে মারলো! সবসময় এই লোকের ত্যাড়ামো! নক্ষত্রের দিক কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শিমলা হালকা চিল্লিয়ে বললো,
– ‘এত ঘেষে থাকতে পারব না বুঝলেন! খালি ছুয়ার ধান্দা তাইনা! ফালতু লোক একটা।’
বলেই শিমলা গটগট পায়ে নিজের চুলগুলো এলিয়ে দুলিয়ে চলে গেলো। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে নক্ষত্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শিমলার ঝলমলে দুলায়মান চুলগুলোর দিক তাকিয়ে রইলো। কাপটা হাতে নিয়েই নক্ষত্র আকাশের দিক তাকালো। রোদ দেখা যাচ্ছে না বিকেলের পর থেকে। হয়তো আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। হালকা ঠান্ডা বাতাসে নক্ষত্র আড়াআড়িভাবে বুকে হাত গুজে রোদহীন আকাশের দিক তাকাতেই দেখলো অনেক রঙ বেরঙের ঘুড়ি সেথায় উড়ছে! মনে পড়লো, ও আর প্রাহী তো অনেক এভাবে রোদ কম পড়লেই ঘুড়ি উড়াতো! অনেকদিন প্রাহীটার সাথে কথা হয়না! ভাবতেই পকেট থেকে ফোন বের করে বোনের নাম্বারে কল দিলো নক্ষত্র।
,
,
,
সালটা ২০২৭ এর শেষের দিক, ডিসেম্বরের মাস। তাপমাত্রা ৭-৮ ডিগ্রীর কাছাকাছি! তবুও আজকের সকালের দিকে রৌদ্রের প্রভাবটা পড়েছে বেশ ভালোই। হিমশীতল বাতাসে গাছের শুকনো পাতা নড়েচড়ে রাস্তায় পড়ছে। অতিরিক্ত শীত থাকলেও এখনও অবধি তেমন তুষারপাত হয়নি। কনকনে ঠান্ডার তান্ডবেও মানুষ ঘরে বসে নেই! অবশ্য এখানেই সবাই কর্মমুখী। হাত,পা সহ দরকার হলে চোখে কাপড় বেঁধে হলেও সবাই সড়কে নেমে যে যার কাজে মত্ত থাকবেই! হাজারো কাজের মাঝে যেন শীত তাদের কাছে ঠূনকো বস্তু মাত্র!
– ‘এই প্রাহী!’
ফরমাল লেডিস প্যান্ট সাথে ফুলহাতা উলের সোয়েটার, উপরে লম্বা ভারী কোটিওয়ালা শীতমানানসই কোট, মাথা সহ কান ঢেকে কানটুপি পরিহিত প্রাহী সুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ওর ফ্রেন্ড ডিসুজার ডাকে পিছন ফিরলো। তামাটে বর্ণের মেয়েটা ওর দিকে এক গাল হাসি দিয়ে চেয়ে আছে। প্রাহী নিজেও ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে সেদিক এগিয়ে গেলো।
– ‘আজ এতো আগে আগে চলে যাচ্ছ যে! ক্লাস তো সবে শেষ হলো!’
প্রাহী হাতে থাকা গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
– ‘আজ তাড়া আছে। এছাড়া আজ তো অনার্সের স্টুডেন্ট দের কনভোকেশন। থেকেই বা কি হবে!’
ডিসুজা প্রাহীর কথায় তাল মিলিয়ে বললো,
– ‘তা ঠিক। তবে কি কাজ আজ তোমার?’
প্রাহী গালভর্তি হাসলো। মাথার টুপিটা টেনে বললো,
– ‘আমার হাজবেন্ডের আজ এওয়ার্ড ফাংশন রয়েছে। সেদিকে যেতে হবে।’
ডিসুজা উৎফুল্লতার সাথে বললো,
– ‘ওহ্ হ্যাঁ! কাল টিভিতে দেখেছি তোমার হাজবেন্ডের সহ আরও অনেক সাইন্টিস্টদের ছবি! আজ এওয়ার্ড পাবে বুঝি!’
প্রাহী হেসে মাথা দুলালো। ডিসুজা প্রাহীর কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘কংগ্রাচুলেশনস টু ইউর হাজবেন্ড!’
প্রাহী হেসে বললো,
– ‘থ্যাংকস্!’
– ‘তাহলে যাও! ট্রেন দিয়ে যাবে তো নাকি?’
প্রাহী ডিসুজার দিক চেয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ না হয় পরে দেরী হয়ে যাবে। সবাই অলরেডি চলে গেছে।’
ডিসুজা প্রাহীর হাতে হাত রেখে ওকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো,
– ‘তাহলে পা চালাও তোমাকে তো পৌঁছাতে হবে নাকি!’
প্রাহী মাথে নেড়ে ডিসুজার সাথে কথা বলতে বলতে এগোলো।
প্রাহীরা দেড় বছরের মতো হয়েছে লন্ডন এসেছে। কানাডা থেকে অনার্স কমপ্লিটের পর এখানকার সিটি ওফ লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাহী মাস্টার্সটা কমপ্লিট করছে। তাও প্রায় শেষের দিকেই। পাশাপাশি আকসাদ অক্সফোর্ড থেকে পি.এইচ.ডি করছে! মূলত আকসাদের এই পি.এইচ.ডি এর জন্যই প্রাহীরা লন্ডনে শিফট হয়েছে। যদিও লন্ডন থেকে অক্সফোর্ডের দূরত্ব রয়েছে কিছুটা। তাও আকসাদ পুরো পরিবার নিয়েই এখানে এসেছে। কারণ কানাডা থেকে অক্সফোর্ডে পি.এইচ.ডি করা সম্ভব নয়। আর ও পরিবার থেকে কখনোই আলাদা থাকবেনা। তাই সবাইই এক সময় না পেরে এখানে এসেছে।
অক্সফোর্ড এ পি.এইচ.ডি এর পাশাপাশিও আকসাদ সহ আরও কয়েকজন ক্যান্সার রোগের মেডিসিন নিয়ে রিসার্চের কাজ করছিল। যেটা ইন্টারন্যাশনাল ভাবে দারূণ সফলতা বয়ে এনেছে! সেই উপলক্ষে আকসাদ সহ অনেককেই এরূপ পহেলা শ্রেষ্ঠ রিসার্চের জন্য ওদের আজ পুরষ্কারসহিত সম্মানিত করা হবে! আর আকসাদরা সেই সম্মানের যোগ্য! কারণ প্রাহী দেখেছে আকসাদ ও তার সহকর্মীরা রাতদিন এই রিসার্চটা নিয়ে পড়ে থাকতো! কম পরিশ্রম কেউ করেনি! অগাধ পরিশ্রম,চেষ্টা আর অধ্যবসায়ের উপহার আজ সবাই পাবে! প্রাহী আপাতত অনুষ্ঠানের দিকই রওনা হচ্ছে।
ঝিলিমিলি আলোয় সজ্জিত রাজকীয় ফাংশনের দর্শক এর জন্য বরাদ্দকৃত আসনে আকসাদের বাবা-মা, আয়সুন সবাই বসে। প্রাহী ঢুকতেই আয়সুন ইশারায় প্রাহীকে ডেকে ওদের কাছে ডাকলো। প্রাহী হেসে সেদিক এগিয়ে গেলো। আয়সুনের পাশে বসতেই পাশ থেকে নক্ষত্র বলে উঠলো,
– ‘এতো দেরী হয়ে গেলো যে তোর!’
নক্ষত্ররা লন্ডনে এসেছে আজ প্রায় এক মাস! এর আগে একবার নক্ষত্র মাস্টার্স শেষে বিয়ের প্রায় এক বছরের মাথায় শিমলাকে নিয়ে হানিমুনে এসেছিলো কানাডায়। এখন আবার ঘুরতে এসেছে লন্ডনে। বাবা-মাকে সাথে নিয়ে আসার কথা ছিলো। কিন্তু প্রাহীর বাবার হার্টের সমস্যার জন্য এবার আর আসতে পারেনি।
প্রাহী পাশ ফিরে নক্ষত্র আর শিমলার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ট্রেনের জন্য দেরী হয়ে গেলো!’
শিমলা সামনে ইশারা করে বললো,
– ‘দেখ! তোর জামাই বসে আছে!’
প্রাহী ইশারামতো তাকিয়ে দেখলো সাদা শার্ট, ডার্ক ব্লু প্যান্ট পরিহিত ফরমাল লুকে আকসাদ স্টেজের মাঝে কয়েকজনের সাথে বসে আছে। ওদের সাথে কথা বলার ফাঁকে প্রাহীর দিক তাকিয়ে আকসাদ মুচকি হাসলো। প্রাহীও হাসলো। এতগুলো বছরেও আকসাদের ভালোবাসা কিংবা ওকে ঘিরে অনুভূতি বা চাওয়া পাওয়াগুলো যেন কিছুই কমেনি! যেনো তা সময়ের পাল্লার সাথে বেড়েই চলেছে! প্রাহীর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই! যেন দুজনের এই প্রবল প্রণয় সহিত অনুরাগ মিশ্রিত ভালোবাসা উর্ধ্বগতিতে বাড়বেই!
এনাউন্সমেন্টে আকসাদের গ্রুপদের ডাকতেই সবাই উঠে এলো। একে একে সবার হাতে প্রাইজ এবং বক্তব্য শুনার পর এবার আকসাদের সময় এলো। আকসাদ মাইক হাতে স্থির দৃষ্টিতে নিজের পরিবারের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আজকের এই এওয়ার্ড আসলে আমার না। এই এওয়ার্ড আমার পরিবারের প্রাপ্য। কারণ আমার বাবা-মা,বোন আমার জীবনের ভালো কিংবা খারাপ সময়ে সবসময়ই আমার পাশে থেকেছে। আমার স্ত্রীও আমার কঠোর পরিস্থিতিগুলোতে আমার পাশে থেকে আমাকে সাপোর্ট দিয়ে গেছে। আমার এই রিসার্চ এর জন্য আমার পুরোটা পরিবার নিজেদের স্থান,শহর ছেড়ে আমার সাথে এসে থেকেছে। আমার কখনোই মনে হয়নি আমি একলা। বরং আমার পরিবারের দিক তাকালে আমি সবসময় মনোবল এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি! ধন্যবাদ বললেও তা নিতান্তই গন্য নয়! তবুও, থ্যাংকস টু মাই ফ্যামিলি এন্ড মাই ওল টিম!’
করতালিতে চারপাশ ভরে উঠেছে। প্রাহী নিদারুণ দৃষ্টিতে আকসাদের দিক তাকিয়ে আছে। আকসাদ স্টেজ থেকে নেমে এসে গলার মেডেলটা মায়ের গলায়, এওয়ার্ড টা বাবার হাতে আর মাথার হ্যাটটা প্রাহীর মাথায় পড়িয়ে দিলো। আকসাদের মা গালভর্তি হেসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। একে একে নক্ষত্র,শিমলা সহ সবাই ওকে কংগ্রাচুলেট করলো। আকসাদ প্রাহীর দিক তাকাতেই ও নীরবে ঠোঁট নাড়িয়ে আকসাদকে পিটপিট করে বললো,
– ‘কংগ্র্যাটস্!!!’
,
,
,
বাড়ি ফিরে সবাই কাজে মেতে উঠলো। আকসাদের সাফল্যের জন্য আজ ছোটোখাটো একটা পার্টি নিজেদের মধ্যেই আয়োজন করেছে ওরা। প্রাহী রান্নাঘরে কুকিজ বানাতে ব্যস্ত। কুকিজগুলো ওভেনে দিতেই শিমলা রান্নাঘরে এসে ওকে বললো,
– ‘কোনো হেল্প লাগবে! দে আমি ভেজিটেবলস গুলো কেঁটে দেই?’
প্রাহী শিমলাদ দিক তাকালো। মেয়েটা দু’মাসের প্রেগন্যান্ট! এখানে এসেই জানতে পেরেছে যে ও কনসিভ করেছে। এজন্য নক্ষত্র বেশ তাড়াহুড়ো করছে দেশে ফেরার। নইলে পরে যেয়ে প্লেন জার্নি ওর জন্য রিস্ক হয়ে যাবে।
প্রাহী ব্যস্ত ভঙ্গিতে শিমলাকে বললো,
– ‘কোনো হেল্প লাগবে না। তুই ড্রয়িং রুমে যেয়ে বস!’
শিমলা কিচেনের কাউন্টারে হেলান দিয়ে বললো,
– ‘আর কতো রেস্ট নিবো! অন্তত পায়েশটা আমায় করতে দে!’
প্রাহী এক কথায় মানা করে শিমলাকে ঠেলেঠুলে কিচেন থেকে বের করে দেয়। পায়েশটা চুলায় বসিয়ে ঘরের কাছাকাছি আসতেই দরজা হতে হাত টেনে আকসাদ ওকে ভিতরে নিয়ে গেলো। প্রাহী হুমড়ে আকসাদের বুকে পড়তেই আকসাদ ওকে আগলে নিলো। মিটমিট চোখে আকসাদের দিক তাকাতেই আকসাদ ওর ঘাড়ে মুখ গুজে সেথায় স্বজোড়ে কামড় বসিয়ে দিলো। মুহুর্তেই রক্তজমাট কালচে দাগ প্রাহীর নরম তুলতুলে ঘাড়ে জায়গা করে নিলো। ব্যথায় চোখমুখ খিচে প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে শুধালো,
– ‘আপনি কি মানুষ!’
আকসাদ প্রাহীর ব্যথা জড়িত চোখের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘উহু! আমি ক্ষুধার্ত মানুষ! বউয়ের আদর আর এটেনশন না পেতে পেতে শুকিয়ে যাচ্ছি!’
প্রাহী আকসাদের মাসেলওয়ালা বাহুতে হাত রেখে বললো,
– ‘খুউউউব না!’
আকসাদ প্রাহীর দিক ঝুঁকে ওর নাকে কামড় দিয়ে বললো,
– ‘হু! খুউউব!’
প্রাহী আকসাদের বুকে হাত রেখে ওকে সরাতেই আকসাদ ওকে কাছে এনে বললো,
– ‘ফাংশন হতে ফিরার পর থেকে একবারও রুমে আসোনি কেন!’
প্রাহী আকসাদের বুকে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
– ‘আপনার জন্যই তো ব্যস্ত ছিলাম!’
– ‘আমার জন্য!’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘আপনার দারূণ এচিভমেন্টের জন্য বাসায় ছোটোখাটো সেলিব্রেশনের আয়োজন করা হয়েছে! তো সেখানে আমার সময় দিতে হচ্ছেনা!’
আকসাদ প্রাহীর দিক ঝুঁকতে ঝুকতে বললো,
– ‘অনেক সময় দিয়েছো। এখন আমায় সময় দাও!’
প্রাহী আকসাদকে ধাক্কা দিতে দিতে বললো,
– ‘না এখন না! পরে। দেখি সরুউ…।’
বলতে না বলতেই আকসাদ প্রাহীর ঘাড়ে হাত রেখে ওর মুখটা সামনে এনে ওর উষ্ণঠোঁট জোড়ায় নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। ছোটফট করতেই ওর নরমদেহখানায় আকসাদের বেসামাল হাতের স্পর্শ পেতেই একদম নেতিয়ে পড়লো।
,
,
,
– ‘সবগুলো ফল খাবি।’
নক্ষত্রের গম্ভীর কন্ঠশুনে শিমলা মুখে এক টুকরো আপেল পুরে বললো,
– ‘আর না। পেট ভরে গেছে।’
নক্ষত্র শিমলার দিক তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘আমার আদরই তো এখনও খেলিনা! পেট ভরলো কি করে!’
শিমলা কটমট দৃষ্টি ওর দিক তাকাতেই নক্ষত্র ফলের বাটিটা ওর দিক দিয়ে বলে উঠলো,
– ‘পুরোটা শেষ কর।’
শিমলা কাচুমাচু মুখে বললো,
– ‘আর ভালো লাগছেনা!’
নক্ষত্র ওর দিক তাকাতেই শিমলা হেলে নক্ষত্রের বুকে মুখ গুজে সেখানে নাক ঘষলো। লোকটার শরীরের এই পুরুষালী গন্ধ শিমলাকে খুব কাছে টানে! নক্ষত্র ফলের বাটিটা রেখে দিলো। মেয়েটা ভালোই কায়দা জানে! এইযে বুকে মাথা রেখে বিড়ালের মতো খসখস করছে যাতে নক্ষত্র ওকে রাগ দেখাতে না পারে! নক্ষত্র শিমলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ করে ওর কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
– ‘এই শুন! ভালোবাসি!!!’
শিমলা চট করে মাথা তুলে নক্ষত্রের দিক তাকালো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নক্ষত্রের দিক তাকাতেই ও মাথা নাড়ালো। শিমলার চোখের কোণে অজান্তেই জল নেমে এলো। তবে তা প্রাপ্তির! তবে এই না বলা ভালোবাসি কথাটার প্রাপ্তি শিমলা অনেক আগেই পেয়েছে! নক্ষত্রের প্রতিটা কাজকর্মে, ব্যবহারে, ছোঁয়ায় শিমলা দিব্যি বুঝে যেতো নক্ষত্রকে ওকে ঠিক কতটা ভালোবাসে! আর শিমলাও এই নিরব ভালোবাসাগুলো সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে! কেনই বা নিবে না! এই মানুষটা গত বছরগুলোতে ছায়ার মতো ওর পাশে থেকে লোকটা নিবিড়ভাবে ওকে আগলে রেখেছে! এমন একটা মানুষকে শিমলা জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে এটা যেনো ওর ভাগ্য!
আবেগে জড়িতে শিমলা মুখ এগিয়ে নক্ষত্রের কানে ফিসিরফিসির করে বলে উঠলো,
– ‘আমিও’
বলে শিমলা সরে আসতেই নক্ষত্র ওর গাল চেপে ধরে ওর নরম অধরজোড়া নিজের অধীনে নিয়ে এলো। শিমলা চোখ বুজে ওর স্বামীর আদরগুলো উপভোগ করতে লাগলো।
,
,
,
ড্রয়িং রুমে সবাই নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মত্ত। প্রাহী কিচেন থেকে পায়েসের বাটিটা ট্রে তে রাখতেই আয়সুন সেখানে এসে চট করে বলে উঠলো,
– ‘ভাবি! তোমরা কবে বেবি নিবে বলোতো! আমার ফ্রেন্ডের বোনের বেবি হয়েছে। কি সুন্দর দেখো!’
আয়সুন নিজের ফোন প্রাহীর দিকে এগিয়ে দিয়ে দেখালো। প্রাহী সেদিকে তাকিয়ে দেখলো বেশ সুন্দর ফুটফুটে এক বাচ্চার ছবি! আয়সুন ফের বললো,
– ‘দেখেছো কি কিউট না! তোমরা জলদি একটা বেবী নাও না! কবে আমি পিপি ডাক শুনবো বলো তো!’
ঘরভর্তি মানুষের সামনে এভাবে বলায় প্রাহী বেশ লজ্জা পেল। আকসাদই মূলতো বলেচিলো ওর মাস্টার্সের পর একবারে বেবি নিবে। কারণ প্রাহীর পড়াশোনায় কোনোরকম ডিস্ট্রেক্ট ও চাচ্ছিলো না। প্রাহী অনেকবার চেষ্টা করেছে বেবি নিতে। কিন্তু এ বিষয়ে আকসাদ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় ও আর কিছু বলেনি।
আয়লিনা হোসেন মেয়েকে বললেন,
– ‘বেবি যখন হবে তখন দেখা যাবে। ওকে খুঁচিয়ে লাভ আছে! নিজের ভাইকে বল।’
আকসাদ ধীরকন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘প্যারা নিস না। খুব শীঘ্রই তুই ‘পিপি’ ডাক শুনতে পাবি!’
আয়লিনা হোসেন হেসে প্রাহীকে জড়িয়ে বললেন,
– ‘তাই নাকি প্রাহী! আকসাদ যা বলছে তা সত্যি?’
প্রাহী এবার মাথা তুলে তাকাতে পারছেনা। আয়লিনা হোসেন প্রাহীর এ অবস্থা দেখে হেসে ওর মাথায় হাত বুলালেন। মাঝে শিমলা এসে ওর হাত ধরে ‘এদিকে আয়’ বলে ওকে নিয়ে ওর রুমের দিক এগিয়ে গেলো।
ভিডিও কলে রাতুল,তুলি, তন্নি আর শোয়াইব প্রাহীকে দেখতেই জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– ‘কি রে বিদেশী মহিলা কেমন আছিস!’
প্রাহী মিছে চোখ পাকিয়ে বললো
– ‘কিসের বিদেশী মহিলা! আমি দেশী বুঝেছিস! আমার আছি ভালোই! তোদের কি অবস্থা?’
রাতুল বলে উঠলো,
– ‘ওদেশে এতো বছর থাকছিস। আবার নাগরিকও হয়ে গেছিস! হলি না তুই বিদেশী মহিলা! আমরা আছি ভালোই!’
– ‘তোর বউয়ের কি অবস্থা!’
প্রাহীর প্রশ্নে রাতুল বললো,
– ‘আছে ভালোই! বাচ্চা সামলাচ্ছে আপাতত!’
মুহুর্তেই তুলি তার কোলে ছয় মাসের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে হাজির! রাতুল আর তুলির বিয়ে হয়েছে দু’বছর হলো। এই দুটো এতোদিন নিরবে প্রেম করে গেছে! যদিও শিমলা সন্দেহ করেছিলো একবার। কিন্তু প্রাহী ওরা বিশ্বাস করেনি! বিয়ের কার্ড বিলানোর সময় সবাই টের পেলো শিমলার সন্দেহই ঠিক ছিলো তাহলে!
তুলি ওর বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কি রে প্রাহী কেমন আছিস! তোর ঘাড়ে ওটা কিসের দাগ!’
প্রাহী তৎক্ষণাৎ ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো,
– ‘এল…এলার্জি। তোর কি অবস্থা কেমন আছিস!’
তুলি প্রাহীর দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হেসে বললো,
– ‘এলার্জি হুম! আকসাদ ভাইকে বলিস মলম লাগিয়ে দিতে! আমি আছি ভালোই। বাচ্চা নিয়ে প্যারা খাচ্ছি এই যা। সিংগেলই ভালো ছিলাম! বিয়ের পর জীবন তছনছ হয়ে গেলো!
তুলির কথায় প্রাহী হেসে তন্নি আর শোয়াইব এর দিক তাকালো। ওদের বিয়ে হয়েছে আজ এক বছর! তন্নির বাবা মেয়ের পছন্দসই শোয়াইবের বাবাকে উনার ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা বলতেই শোয়াইবের বাবা আর না করে উঠেননি। কারণ তন্নির বাবা উচ্চপর্যায়ের মানুষ হলেও তিনি বেশ বড়মনের মানুষ! তাছাড়া তন্নিও বেশ ভদ্র একটা মেয়ে! ছেলের বউ হিসেবে একদম পার্ফেক্ট যাকে বলে!
প্রাহী তন্নিকে ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
– ‘কি তন্নি তোমার জীবনটাও কি তছনছ হয়ে গেছে বিয়ে করে?’
তন্নি আড়চোখে শোয়াইবের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘এখন পর্যন্ত তো সব ঠিকই আছে!’
প্রাহী হেসে বললো,
– ‘যাক তাহলে তো ভালোই! তোমাদের বিয়েতে আমি থাকতে পারলাম না! অথচ কত ইচ্ছে ছিলো তোমার আর তুলির বিয়েতে কত এঞ্জয় করবো! কিছুই হলোনা! দূর দেশের মানুষকে বিয়ে করে কত কিছু মিস করে গেলাম!’
প্রাহীর আফসোসের সুরের কথায় তন্নি মুচকি হেসে বললো,
– ‘এভাবে বলছো কেন প্রাহী! দূর দেশে থেকে তুমি অনেক কিছু মিস করলেও কাঙ্ক্ষিত একটা জিনিস কিন্তু পেয়ে গেছো! তা কি জানো! ‘সুখ’। দূর দেশে চলে গেলেও তুমি তো মাশাল্লাহ বেশ সুখে আছো, হাসিখুশি,ভালো আছো! আর কি চাই বলো!’
তন্নির কথায় প্রাহী নীরবে হাসলো। সুখে! হ্যাঁ ও বেশ সুখেই আছে! আকসাদ নামক মানুষটা ওর জীবনে আসার পর থেকে ওর জীবনটা দুঃখ কম বরং সুখ দিয়ে তা কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে!
,
,
,
হাসিঠাট্টা শেষে রাতের ডিনার শেষে হাতের কাজ সেরে প্রাহী ঘরে ঢুকতেই বেশ অবাক হয়ে গেলো। সারা ঘর মোমবাতির আলো দিয়ে আলোকিত হয়ে আছে। বিছানায় গোলাপের পাপড়ির ছড়াছড়ি। রুমের এরূপ সাজগোজ দেখে প্রাহীর ওদের প্রথম কাছে আসার মুহুর্তের দিনটার কথা মনে পড়ে গেলো। সেদিনও এভাবেই আকসাদ ওদের ঘরটা সাজিয়েছিলো। তার মানে কি আজও আকসাদ! ভাবনার মাঝেই একজোড়া শক্ত হাত ওকে জড়িয়ে ধরলো। প্রাহী একটা ঢোক গিললো,
– ‘এ…এসব হঠাৎ!’
আকসাদ পিছন হতে প্রাহীর কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বললো,
– ‘আয়সুনকে বলেছি খুব শীঘ্রই তাকে পিপি ডাক শুনাবো!’
প্রাহী কাঁপা কন্ঠে বললো,
– ‘ত…তো!’
সঙ্গে সঙ্গে আকসাদ প্রাহীকে ঘুড়িয়ে কোলে নিতেই প্রাহী জমে গেলো। আকসাদের পড়নে সাদা শার্ট তাও সব বোতাম খুলা! উদাম বুকে প্রাহী হাত রাখতেই আকসাদ বিছানার দিক এগোতে এগোতে বললো,
– ‘তো এখন বেবি নেয়ার মিশন শুরু! যার চোখ হবে তোমার মতো, নাক হবে আমার মতো, কান হবে তোমার মতো, আর…।’
প্রাহীর শুইয়ে ওর ঠোঁটের কোণে ঠোঁট বুলাতে বুলাতে বললো,
– ‘আর ঠোঁট হবে তোমার মতো! নরম আর তুলতুলে!’
প্রাহী লাজুকলতার ন্যায় আকসাদের বুকে মুখ গুজতেই আকসাদ ওকে নিমিষেই নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।
,
,
,
মধ্যরাত আকাশভরা তারার দিক প্রাহী একমনে তাকিয়ে আছে! জীবনের মুহুর্তগুলোর কথা ভাবছে প্রাহী। আকসাদের সাথে ওর পরিচয়, এ শহরে আসা, দু’জনের সংসার! কিভাবে কিভাবে যে সময়গুলো নাকের ডগা দিয়ে পেরিয়ে গেলো ও টেরই পেলোনা! অবশ্য আকসাদ ওকে যেভাবে নিজের ছায়ায় হেসেখেলে আগলে রেখেছে এতে কোনোকিছু টের না পাওয়াও স্বাভাবিক! হাজারো ভাবনার মাঝে একজোড়া উষ্ণ হাতের বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ হতে দেখেই প্রাহী মুচকি হাসলো।
– ‘এভাবে আমার শার্ট পড়ে এসে দাঁড়িয়ে আছো! কেউ দেখে ফেললে! তাছাড়া তোমার শীত করছেনা!’
প্রাহী আকসাদের উপর নিজের হাত রেখে বললো,
– ‘এত রাতে কে দেখবে! আর আপনি জড়িয়ে ধরেছেন না! এখন আর শীত করছেনা!’
আকসাদ হাসলো৷ প্রাহীর কানে ঠোঁট এনে বললো,
– ‘ভালোবাসি মিসেস প্রাহী!’
প্রাহী চোখ বুঝলো!
– ‘কতদিন পর ‘মিসেস প্রাহী’ ডাকলেন! মিস করেছি এতোদিন এই ডাকটা! যদিও আগে শুধু ‘মিস প্রাহী’ বলে ডাকতেন!’
আকসাদ প্রাহীকে আরও জড়িয়ে বললো,
– ‘তাই বুঝি! তবে অনেকদিন পর মুখে ভালোবাসি বললাম বোধহয় তাইনা!’
প্রাহী চোখ খুললো। আকসাদের দিক ফিরে ওর চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,
– ‘ – ‘মুখে ঠোঁট নাড়িয়ে ভালোবাসা প্রকাশের চেয়ে তা বুঝিয়ে দেয়াই বা বুঝে নেয়াই শ্রেয়! তবে এক্ষেত্রে হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের সঙ্গম থাকাটা অত্যাবশ্যক। না হলে অনুভূতির সুরের কথাগুলো বুঝবো কিভাবে! তবে আমি বুঝেছি! আপনার আর আমার ওই রক্তাক্ত মাংসল হৃদয়টা গভীরতার দিক থেকে এক অপরকে ছুঁয়ে ফেলেছে অনেক আগেই তবে তা কতখানি ছুঁয়েছে তা জানিনা। জানতেও চাইনা! কারণ এই যেমন বাইরে অসীম আকাশ হতে গড়িয়ে পড়া তুষারপাতগুলো যেমন ঝপঝপিয়ে গাছের ডাল, পাতা গড়িয়ে মাটিকে স্পর্শ করছে। আপনার মনটাও আমার মনটাকে ঠিক এভাবেই স্পর্শ করে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে অনেক আগেই!’
আকসাদ প্রাহীর কথায় ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে ঠোঁটের গাঢ় স্পর্শ আঁকতেই প্রাহী আলগোছে আকসাদকে জড়িয়ে ধরলো। গভীর রাতের স্তব্ধ আকাশের নিচে একজোড়া কপত কপতী নিজেদের প্রবল একাকার ভালোবাসার আদলে মত্ত। আকসাদের বুকে মাথা রেখে প্রাহী গুণগুণিয়ে গেয়ে উঠলো,
‘মন একে একে দুই
একাকার আমি তুই
আর না চোখ ফিরিয়ে, একটু হাস!’
আকসাদ মিষ্টি হেসে সুর মেলালো,
নেই মনে কি কিছুই?
তোর ঠোঁটের ডানা ছুঁই
মিলবে সব জীবনের ক্যালকুলাস!’
প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে হাসলো! কি স্নিগ্ধ সেই হাসি! আকসাদ নিবিড়ে নিঝুম রাতে সেই হাসির দিক চেয়ে রইলো! সারাটা জীবন আকসাদের এভাবেই কাঁটুক! এর থেকে বেশি কিছু চাইনা ওর! এই সুখের সুরে আকসাদ সারাজীবন তাল মিলিয়ে যেতে চায়! তবুও এই রোদনধারার ন্যায় মুহুর্তগুলো যাতে ও আজীবন অনুভব করতে পারে।
দূর আকাশের তারাগুলো এঁকে এঁকে একে অন্যের সাথে মিশে হারিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি অদূরে শহরাঞ্চলের এক কোণে থাকা সরল প্রাহীর মনটা পৃথিবীর অপরপ্রান্তে থাকা আকসাদের মনের সাথে অচিরেই মিশে গেছে। দুজনের একক মন জোড়ায় পরিণত হওয়ার সাথে সাথে ওরাও একে অপরের সাথে অচিরেই মিশে গেছে! এই যেমন এখন একে অন্যের সাথে মিশে দূর ওই বিশাল আসমানের দিক চেয়ে আছে একসাথে সূর্য উঠা দেখবে বলে! দূরের ওই আকাশের সূর্য যেমন পুরোটা আকাশ আলোয় ছড়িয়ে দেয় ঠিক তেমন স্বরূপ ওদের জীবনেও যেন প্রতিটা মুহুর্ত আনন্দ, আহ্লাদ, ভালোবাসার দিপ্তীতে যেন আবেশিত হয়ে ওঠে!
সমাপ্ত।