মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব-১০+১১+১২

0
409

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১০
মন মেজাজ ভালো না অথৈর।একটু আগে ওর মা এসে বলে গেছেন ওকে নাকি দেখতে আসবে।ওকে আর ইহানকে তাই আজ ভার্সিটি যেতে দেয়নি।ইহানও বেশ রাগারাগি করেছে এই নিয়ে।কিন্তু ওর মা বলছে ছেলের পরিবার নাকি অনেক ভালো।আর তাছাড়া দেখতে এসে তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাহ।অথৈ আর ইহানের রাগারাগিতেও কাজ হয়নি।অসহ্য লাগছে অথৈর।মাত্র ভার্সিটিতে উঠেছে ও।আর এখনই কিসের দেখাদেখি শুরু করে দিয়েছেন।অথৈ মন খারাপ করে ছাদে দোলনায় বসে আছে। না চাইতেও চোখে জল চলে আসছে অথৈর।হঠাৎ দোলনায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে তাকায় অথৈ।দেখে ওর বাবা আজিজুর সাহেব এসে বসেছেন ওর পাশে।অথৈর মন খারাপ সেটা দেখে ওর বাবা মুঁচকি হাসলেন।আদুরে হাতে স্পর্শ করলেন মেয়ের মাথায়।বাবার স্নেহে যেন অথৈর চোখের বাধ ভেঙে গেল।চোখের জল গড়িয়ে পরল গাল বেয়ে।আজিজুর সাহেব যত্ন করে মেয়ের চোখের জল মুছে দিলেন।অথৈ ভেজা কণ্ঠে ওর বাবাকে বলে উঠল,
‘ বাবা?আমি কি তোমাদের কাছে বেশি হয়ে গিয়েছি?যে আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইছ?’

আজিজুর সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।আদুরে কণ্ঠে বললেন,
‘ কে বলেছে আমার মেয়ে আমাদের কাছে বেশি হয়ে গিয়েছে?’
‘ তাহলে বিয়ে কেন দিতে চাইছ?’

আজিজুর সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘ দেখ মা।বিয়ে আজ হোক কাল করতেই হবে। আর তাছাড়া দেখতে এলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না তাই নাহ?’

অথৈ কাঁপা গলায় বলল,
‘ কিন্তু আমি শুনলাম ছেলের নাকি আমাকে পছন্দ হলেই মা আমাকে এখানেই বিয়ে দিবে।’
‘ তুই ভুল শুনেছিস।দেখ মা পরিবারটা অনেক ভালো।এতো ভালো পরিবার সচরাচর দেখা যায় না।নিজেকে নিজে ভালো বললে হয় না মা।দশজন লোক যাকে ভালো বলে তারাই আসলে ভালো মানুষ।খোজখবর নিয়ে দেখেছি।আসলেই তারা অনেক ভালো।তুই সুখি হবি মা।আমরা কি কখনও তোর খারাপ চাইবো আমার সোনা মা?তুই তো জানিস আমরা তোকে কতোটা ভালোবাসি।মা আমার আমাদের ভুল বুঝিস নাহ।ইহানটাও রাগ করে আছে।তবে একদিন দেখিস এই আমাদের কথা শুনে এখানে বিয়ে করলে তুই নিজেই এসে আমাদের বলবি। বাবা আমার থেকে সুখি বোধহয় কেউ হবে না।আমার কথাটা মিলিয়ে নিস। আর তাছাড়া পছন্দ হলেও। আমরা শুধু বাগদানটা করিয়ে রাখব।এতো তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের মেয়েকে বিদায় দিবো না।এখন কান্না বন্ধ করে দে মা।তোর চোখের জল আমি সহ্য করতে পারি নাহ।এভাবে কাঁদলে আমি অপরাধবোধে ভুগব মা। ‘

অথৈ বাবার বুক থেকে উঠে সোজা হয়ে বসল।তারপর চোখের জলগুলো মুছে নিল।ওর বাবার প্রতিটা কথা ওর উপর খুব প্রভাব ফেলল।যেহেতু ওর বাবা আর মা বলছে ছেলেরা অনেক ভালো।তাহলে নিশ্চয়ই ভালো হবে।মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে আজিজুর সাহেব গলা খাকারি দিলেন।অথৈ উনার দিকে তাকাতেই তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলে উঠলেন,
‘ তুই কি একেবারেই রাজি না?মানে তোর কি কোনো পছন্দ আছে মা?আমাদের বলতে পারিস। তাহলে আমি উনাদের মানা করে দেই।’

অথৈ বাবার কথায় আঁতকে উঠল।ওর বাবা উউল্টাপাল্টা ভাবছে।অথৈ দ্রুত নাবোধক মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ না বাবা। এমন কিছুই না।তুই ভুল ভাবছ আমাকে।’
‘ ভুল ভাবছি না রে মা।শুধু জিজ্ঞেস করলাম।আমি জানি আমার মেয়ে এমন কিছুই করবেন না।’

অথৈ সস্তির নিশ্বাস ফেলল।আজিজু র সাহেব ফের বলেন,
‘ তাহলে কি তুই রাজি? ‘

অথৈ লম্বা শ্বাস ফেলল।মাথা দুলিয়ে বলে,
‘ হ্যা আসতে বলো।’
‘ মন থেকে বলছিস?নাকি আমাদের উপর রেগে আছিস এখনও?’

অথৈ ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তাকাল ওর বাবার দিকে।ওর বাবার কাধে মাথা রেখে উনার বামহাতটা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ উহু! একদম রাগ করে নেই আমি।আমি জানি আমার বাবা মা আমার জন্যে বেস্টটাই করবেন।’
‘ যাক মনে শান্তি দিলি মা।’
—————
অথৈ অস্থির হয়ে ঘরের এপাশ ওপাশ করে চক্কর কাটছে।গায়ে ওর নীল রঙের শাড়ি জড়ানো।তার উপর হালকা একটু সেজেছে।রিধিকে ফোন করেছিল। ও বলল রিধি নাকি ওর পরিবারের সাথে ওর মামার বাড়ি গিয়েছে।আর পিহুটা ফোনই ধরছে না।তাই আহিদকে ফোন করেছিল।ওইটা আর প্রিয়ান নাকি দূরে কোথায় ট্রিপে চলে গিয়েছে।আর এইজন্যেই পিহু রাগ করে কারো সাথে কথা বলছে নাহ।মাত্র একদিন ভার্সিটি ছুটিয়ে পেয়ে এদের তিড়িংতিড়িং শুরু।ওদের একটু মন খারাপও হলো।হঠাৎ করে এমন অথৈকে দেখতে আসবে ওর পাশে নেই।অথৈ ওদের মন খারাপ হয়েছে বুঝতে পেরে আর বেশি ঘাটলো না।ওরা অথৈর কথায় একটু শান্ত হয়।পরে ওরা ফোনে শুধু অথৈকে শান্তনা দিয়েছে।হঠাৎ ওর ঘরে আসলেন।উনাকে দেখেই অথৈ বুঝল তারা এসে পরেছে।অথৈর কেমন যেন ভয় লাগছে।গলা শুকিয়ে আসছে।মেয়ের শুকনো মুখ দেখে মিনহা বেগম বলে উঠলেন,
‘ ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।তোর বাবা আর আমারও এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল।আমাদেরই দেখ আমরা কতো সুখি।অভিভাবকদের দোয়ায় সবটা ভালই হয় মা।আমার কথা মিলিয়ে নিস।এখন একটু শান্ত হো।আমরা আছি তো।’

অথৈ মাথা দুলালো।ওর মা ওকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন।অথৈর চোখ নিচের দিকে।ভয়,অস্থিরতায় চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না মেয়েটা।অথৈ দৃষ্টি নত রেখেই সালাম জানালো।কয়েকজনের কণ্ঠে একত্রে সালামের জবাব শোনা গেল।এর মাঝে শুধু একজন মেয়ে সেটা ও বুঝতে পেরেছে।এদিকে ইহানের চটরচটর কথা ওর কানে আসতেই ওর ভ্রু-কুচকে আসে।একটু আগেই না ওকে দেখতে আসবে সেজন্যে কি রাগারাগি করল।এখন এমন ফটফট করে কথা বলছে।ওর কণ্ঠে যেন আনন্দের ঝিলিক।আর এমনভাবে কথা বলছে যেন তারা ওর কতো আগের চেনা।অথৈর রাগ লাগছে ইহানের প্রতি।হঠাৎ পাশ থেকে সেই চিকন মেয়েলি কণ্ঠের আওয়াজ ওর কানে আসল,
‘ দাদু আপনি ঠিক বলেছেন।মেয়েটা ভারি মিষ্টি।দেখি আন্টি ওকে আমার পাশে এসে বসান।’

মিনহা বেগম হেসে অথৈকে তার পাশে বসালো।মেয়েটি ফের বলে,
‘ এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন?চোখ তুলে দেখবে না আমাদের?না দেখলে হবে?দেখি তাকাও আমাদের সবার দিকে।সবাইকে দেখে নেও।’

মেয়েটির জোড়াজুড়িতে অথৈ তাকাতে বাধ্য হলো।কিন্তু সামনে তাকাতেই ওর চোখ কপালে উঠে গেল।কারন ওর সামনে বসে আছে সেদিনের সেই লোকটা।যিনি মাঝরাস্তায় তার নাতির জন্যে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল ওকে।আতিক মাহাবুব অথৈর রিয়েকশন দেখে হেসে দিলেন।অথৈদের পরিবার উনার হাসি দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।মূলত তারা কিছুই বুঝতে পারছেন না।আতিক মাহাবুব অথৈর অবাক হওয়া মুখশ্রী দেখে ভ্রু নাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
‘ কি অবাক হলে মেয়ে?তুমিই তো বলেছিলে তোমার বাড়িতে যেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই।’

আজিজুর সাহেব উনার কথা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করেই ফেললেন,
‘ মানে বুঝলাম না।আপনি কি একটু বুঝিয়ে বলবেন?’

আতিক মাহাবুব হেসে উঠলেন।তারপর একে একে সেদিনের ঘটনা সব খুলে বললেন।কাহিনি শুনে বাকিরাও অবাক হলেন।পরক্ষনে সবাই হাসল। আতিক মাহাবুব এইবার হাসি থামালেন।তারপর অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘ এইদিকে তাকাও।সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’

তিনি তার ছেলেকে দেখিয়ে বলেন,
‘ এই হলো আমার ছেলে আরহাম মাহাবুব মির্জা।’

আরিয়ানকে দেখিয়ে বলে,
‘ এই হলো আমার বড় নাতি আরিয়ান তাশরিফ মির্জা।’

রোজাকে দেখিয়ে বলল,
‘ এই হলো আমার বড় নাতবউ আফরোজা উর্মি। আমরা ছোটো করে রোজা ডাকি।’

অথৈ একে একে সবাইকেই সালাম জানাল।

এরপর রুদ্রিককে দেখিয়ে বলে,
‘ এই হলো আমার ছোটো নাতি আরিহান রুদ্রিক মির্জা। যার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব এনেছি আমি।’

রুদ্রিকের দিকে তাকাতেই অথৈ যেন চারশো চল্লিশ বোল্টের ঝটকা খেল।চোখগুলো বেড়িয়ে আসার উপক্রম।ওর মুখটা হা হয়ে গিয়েছে।রুদ্রিক ওর দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে।আর অথৈ ভাবছে।রুদ্রিক?তার মানে রুদ্রিকের জন্যে ওকে বউ করে নিতে চাইছেন আতিক মাহাবুব।এদিকে অথৈয়ের রুদ্রিককে দেখে এমন ভয়ানক রিয়েকশন দিতে দেখে সবাই বেশ অবাক হলেন।রোজা ওর কানে ফিসফিস করে বলল,
‘ কি হলো অথৈ?তুমি রুদ্রিকের দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছ কেন?’

রোজার কথায় অথৈ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল।এইজন্যেই ও ভাবছিল ভাই হঠাৎ এইভাবে কেন নিজের মুড পরিবর্তন করে নিল।অথৈ দুহাতে মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিল।রুদ্রিকের সাথে ওর বিয়ে? ভাবলেই তো কেমন একটা লাগছে।না এটা হতে পারে না।এটা সম্ভব না।রোজা অথৈকে এমন করতে দেখে প্রশ্ন করল,
‘ কোনো সমস্যা অথৈ?’
‘ ন…না।আমি ঠিক আছি।’

মুখে এটা বললেও ওর মন জানে ও ঠিক নেই।এর মধ্যে আতিক মাহাবুব বলেন,
‘ মেয়ে আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে আজিজুর সাহেব।এইবার নাহয় ছেলেমেয়েদের আলাদা করে কথা বলতে পাঠানো হোক।তাদেরও তো মতামতের গুরুত্ব আছে।’

আজিজুর সাহেব হেসে মাথা নাড়ালেন।তারপর অথৈকে বলেন,
‘ অথৈ আম্মু যাও রদ্রিককে নিয়ে তোমার রুমে যাও।’

না চাইতেও অথৈকে উঠতে হলো।তারপর সামনের দিকে পা বাড়ালো।রুদ্রিক অথৈর পিছনে পিছনে চলল।
__________

অথৈ আর রুদ্রিক অথৈয়ের রুমে আসলে।অথৈ নিজে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।তারপর রাগি চোখে তাকায় রুদ্রিকের দিকে।ওকে এইভাবে রেগে তাকাতে দেখে রুদ্রিক বাঁকা হাসল।রসিকতার স্বরে বলে,
‘ আরে কি করছ?এখনি দরজা আটকাচ্ছ কেন?আমাদের বিয়ে এখনও হয়নি।’

অথৈ যেন রুদ্রিকের এমন রসিকতায় আরোও রেগে গেল।দাঁত কিরমির করে বলে,
‘ এটা কেমন ফাইজলামি?আর কিসের বিয়ের কথা বলছেন?আমি আপনাকে বিয়ে কোনোদিন করব নাহ।’
‘ কেন করবে নাহ?’

বেশ ঠান্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন করল রুদ্রিক।অথৈ জবাবে বলে,
‘ এমনি আপনাকে আমার ভালোলাগে নাহ।’

রুদ্রিক গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ কেন ভালো লাগে নাহ?কি করেছি আমি?আমার চেহারা খারাপ?নাকি আমি কোনোদিক দিয়ে প্রতিবন্ধি?মেয়েবাজি করি?না জুয়া খেলি?না তোমার সাথে কোনোদিন অসভ্যতামো করেছি?বা অন্য মেয়েদের সাথে করেছি?কোনটা?’

রুদ্রিকের একের পর এক প্রশ্নে অথৈ দমে গেল।ঠিক কি উত্তর দিবে জানা নেই অথৈর।রুদ্রিক দেখতে কেন সুন্দর।শ্যামবর্ণের গায়ের রঙ,লম্বাচওড়া, পেটানো, শক্তপোক্ত,সুঠামদেহির রুদ্রিককে যে কোনো মেয়ে এক দেখায় পছন্দ করে ফেলবে।আর রুদ্রিকের মাঝে কোনো বাজে স্বভাব দেখেনি অথৈ।শুধু সিগারেট খাওয়া ছাড়া।অথৈকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্রিক নিজেই বলল,
‘ কি হলো? চুপ করে আছ কেন?উত্তর দেও।যদি আমার কোনো একটা দোষ তুমি দিতে পারো তবে আমি নিজে বিয়ে ভেঙে দিব।’
‘ না এর কোনোটাই নাহ।’
‘ তাহলে?’
‘ জানি না।শুধু আপনাকে বিয়ে করতে পারব নাহ।’

রুদ্রিক কদম বাড়িয়ে অথৈর সামনে চলে আসল।অথৈ ওর থেকে অনেকখানি খাটো।তাই রুদ্রিক ওর দিকে ঝুকে ওর চোখে চোখ রেখে বলে,
‘ আমাকে রিজেক্ট করছ।ফলাফল কিন্তু ভালো হবে নাহ।আর জানো তো যেটা কেউ রুদ্রিককে করতে বারন করে।সেটা রুদ্রিক আরও আগ্রহ নিয়ে করে।আমি নিচে গেলাম।উত্তরটা যেন হ্যা হয়।নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে নাহ।’

রুদ্রিক ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।অথৈ রুদ্রিকের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রাগে বিরবির করে ওকে কয়েকটা গা’লি দিল।লোকটা এমন ত্যাড়া।তবে ও নিজেও কারো থেকে কম না।ও রুদ্রিককে বিয়ে করবে না।

#চলবে_________

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১১
নাহ,এই বিয়ে অথৈ করতে পারবে না।রুদ্রিককে ও কোনোভাবেই বিয়ে করবে না ও।কিন্তু,কিভাবে আটকাবে ও এই বিয়ে?বাবা,মা ওর ভাই সবার যে এই বিয়েতে মত আছে।তা তাদের মুখশ্রী দেখেই বুঝতে পেরেছে অথৈ।তবে এটা মানতে হবে রুদ্রিক যেমনই হোক।রুদ্রিকের পরিবারটা অনেক ভালো।সবার ব্যবহার অমায়িক।ওর গো সব থেকে বেশি ভালো লেগেছে রোজাকে।মেয়েটা অনেক মিশুক।অল্প পরিচয়েই যেভাবে ওর সাথে কথা বলেছে।মনে হয়েছে যেন রোজা ওকে কতোদিন দিন ধরে চিনে।অথৈ মাথা নাড়ালো।না এসব ভাবলে হবে না।যার সাথে সারাটাজীবন কাটাবে তাকেই যদি মনে না ধরে?তাহলে কিভাবে হবে? এখন উপায় একটাই ইহানকে সবটা জানানো।যেই ভাবা সেই কাজ। অথৈ ওর ভাইকে মেসেজ করে দিল।সে যেন দ্রুত অথৈর রুমে আসে।ঠিক মিনিট দশেক পর অথৈয়ের রুমে আসে ইহান।ও আসতেই অথৈ রাগি চোখে তাকালো ইহানের দিকে।বলল,
‘ এতোক্ষণ লাগে আসতে?সেই কখন মেসেজ দিয়েছি।’

ইহান বলে,
‘ আরে রাগ করছিস কেন?নিচে মেহমান আছে।চাইলেই তো আর সাথে সাথে আসা যায় না।এখন বল কি জন্যে ডেকেছিস।’

ইহানের কাছে কিছু বলতে অথৈয়ের কোনোকালেই কোন রূপ জড়তা কাজ করে না।ও অকপটে ওর মনের সব কথা ইহানকে বলে দিতে পারে।ইহান ওর কাছে ওর বেষ্টফ্রেন্ড।তাই কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই অথৈ বলে,
‘ ভাই, আমি তোর ফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে পারব নাহ।’

ইহান বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না।ও আগেই বুঝতে পেরেছিল অথৈ এমন কিছুই বলবে।তাই খুব শান্ত কণ্ঠে বলে,
‘ আচ্ছা ঠিক আছে সে নাহয় বুঝলাম।কিন্তু ঠিক কি কারনে আমার ফ্রেন্ডকে তুই বিয়ে করবি না।তা তো বলবি?এভাবে হুট করে তো আর বিয়েতে না করে দেওয়া যায় না।কারন প্রয়োজন হয়।’

ইহানের এমন প্রশ্নে অথৈ কি বলবে ভেবে পেল নাহ।এটা ঠিক রুদ্রিককে সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কোনো বাজে কিছু করতে ও দেখেনি।যতোদিন ভার্সিটিতে দেখা হয়েছে।দেখতেও অনেক সুন্দর রুদ্রিক।যেকোনো মেয়েই এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করতে এক পায়ে রাজি হয়ে যাবে।অথৈকে চুপ থাকতে দেখে ইহান ফোস করে শ্বাস ফেললো।তারপর অথৈয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওকে ধরে বিছানায় বসালো।নিজেও ওর পাশে বসে অথৈকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিল।অথৈ ভাইয়ের স্নেহ পেয়ে ভাইয়ের বুকের সাথে মিশে রইল।ইহান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল,
‘ দেখ অথৈ আমি জানি। তুই সেদিন রুদ্রিকের সাথে যেই ব্যবহার করেছিস।আর সেদিন যাই ঘটেছে।সেই রেশ ধরেই তোর অকারনেই রুদ্রিককে ভালো লাগে না।তবে একটা কথা কি জানিস বোন?দুনিয়াটা না বড্ড কঠিন।এই ধর আজ রুদ্রিকদের আমরা মানা করে দিলাম।কয়েকবছরেও আর তোর বিয়ের কথা ভাবব নাহ।কিন্তু একদিন না একদিন তো তোকে বিয়ে করতেই হবে।এটাই যে নিয়ম।যা আজীবন ধরে হয়ে আসছে।আমরা তো আর জেনেশুনে তোকে খারাপ জায়গায় বিয়ে দিতে চাইবো না।কিন্তু মানুষের মনে কি থাকে তা তো আর আমরা জানি না।তখন যদি তারা খারাপ হয়ে যায়? তোর সাথে যদি খারাপ ব্যবহার করে?কি করবি তুই?হয়তো আমরা কষ্ট পাবো সেইজন্যে আমাদের কাছে তোর কষ্টের কথা বলবি না।নিজে ধুকে ধুকে মর’বি।কিন্তু একদিন না একদিন তো আমরা সব জানবই।আমরাও ভেঙে পরব।এখন তুই বলতে পারিস তুই আগে থেকেই নেগেটিভ ভাবছিস কেন?পজিটিভও তো হতে পারে।কিন্তু বোন ভবিষ্যতের কথা তো আর কেউ বলতে পারে না।তাই বর্তমানে আমাদের কাছে যা আছে তা নিয়েই খুশি থাকা উচিত।রুদ্রিককে আমি ভালো বলব তা এই কারনে না যে ও আমার বেষ্টফ্রেন্ড।তুই নিজেও জানিস।আমি আমার বোনের জন্যে বেষ্টটাই খুঁজে আনবো।রুদ্রিক অনেক ভালো ছেলে অথৈ।ওকে বিয়ে করলে তুই সুখে থাকবি।ছেলেটা একটু রাগি,গম্ভীর।কিন্তু ওর মনটা অনেক ভালো।আর ওর পরিবারকে তো আমি আগে থেকেই চিনি।রুদ্রিকের পরিবারের প্রতিটা মানুষই খুব ভালো।তারা তোকে রানি বানিয়ে রাখবে।বিশ্বাস না হলে রোজা ভাবির থেকেই জিজ্ঞেস করিস।জানিস রোজা ভাবি এতিম ছিল।সে থাকতো এতিমখানায়।আরিয়ান ভাইয়া নাকি সেই এতিমখানায় কিছু টাকা ডোনেট করতে গিয়েছিল।আর সেখানেই নাকি ভাবিকে দেখে পছন্দ করেছিল।ব্যস আরিয়ান ভাইয়া বাসায় গিয়ে এই কথা জানাতেই।আংকেল আর দাদু কোনোরূপ তর্ক না করে।আরিয়ান ভাইয়ার পছন্দ করা মেয়েকেই মেনে নেন।তারপর রোজা ভাবিকেই আরিয়ান ভাইয়ের বউ করে নিয়ে আসে।তাহলে বুঝ তারা কতোটা ভালো মনের মানুষ।রোজা ভাবিকে আজ পর্যন্ত তারা কেউ এই নিয়ে কটু কথা বলেনি।তাদের বৌভাতের দিন তাদের এক আত্মীয় এটা নিয়ে ভাবিকে কটু কথা শোনালে।রুদ্রিক সবার আগে প্রতিবাদ করে।আর তাদের পরিবারের সবাই ওই আত্মীয়ের সাথে সব সম্পর্ক ভেঙে দেন।সেদিন ওই ঘটনার পর থেকে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আমার আরও বহুগুন বেড়ে গিয়েছিল।তাহলে তুই নিজেই চিন্তা করে দেখ তারা কতোটা ভালো মনের মানুষ।তুই সুখে থাকবি বোন।মিলিয়ে নিস আমার কথাটা।’

অথৈ ইহানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল।ইহান বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে হালকা হেসে বলে,
‘ তবে ভাবিস না।তোকে জোড় করব।তোর মন যা বলে তুই তাই করবি।’

অথৈ ইহানের দু হাত শক্ত করে ধরে ভেজা কণ্ঠে বলে,
‘ আমার নিজের কোনো পছন্দ নেই ভাইয়া।সেটা তুমি জানো।আর আমি এটাও বিশ্বাস করি।আমার মা,বাবা আর ভাই আমার জন্যে যা করবে আমার ভালোর জন্যেই করবে।তারা কখনই আমার খারাপ চাইবে না।তাই তোমরা যেহেতু বলছ সবাই চাইছ রুদ্রিকের সাথেই আমার বিয়েটা হোক।তাহলে আমি রাজি ভাইয়া।’

ইহান বোনের কথা শুনে খুশি হলেও।অনেকটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে,
‘ কিন্তু তুই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব বলিস না অথৈ।আমি আগেও বলেছি।তোর মন যা চায় তুই তাই করবি।আমরা কেউ তোকে জোড় করছি নাহ।’

অথৈ মুঁচকি হেসে বলে,
‘ আমি মন থেকেই রাজি ভাইয়া।আমার এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই।’
‘ তাহলে বলছিস?আমি নিচে গিয়ে তোর উত্তরটা হ্যা জানিয়ে দেই?’

অথৈ হ্যাবোধক মাথা নাড়ালো।ইহানের ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসি ফুটে উঠল।বোনের কপালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালো।বলল,
‘ তুই অনেক সুখে থাকবি অথৈ। অনেক সুখি হবি তুই।’

ইহান চলে গেল নিচে সবাইকে অথৈর উত্তরটা জানানোর জন্যে।এইদিকে ইহানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে অথৈ মনে মনে বলল,
‘ তুমি যা বলেছ তাই যেন হয় ভাই।আর দোয়া করো।আমি যেন তোমার বন্ধুকে ভালোবাসতে পারি।আর সেও যেন আমাকে ভালোবাসে।দোয়া করো তোমরা।তোমাদের খুশিতেই আমি খুশি।’
____________
ইহান এসে রুদ্রিকের পাশে বসল।এদিকে রুদ্রিক অস্থির হয়েছিল ইহান আসছেনা কেন?ইহান আসতেই রুদ্রিক ওর কানে ফিসফিস করে বলে,
‘ কিরে?তোর বোন কি বলল?’

ইহান মুখটাকে এমন একটা মুখোভঙি করল।যা দেখে রুদ্রিক দুশ্চিন্তায় পরে গেল।তবে কি অথৈ মানা করে দিয়েছে?রুদ্রিক আবারও বলল,
‘ কিরে কিছু বলছিস না কেন?কি বলেছে ও?আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে এতো সহজে মানবে না।তুই-ই বললি তুই নাকি সামলে নিবি।এখন চুপ করেই থাকবি?নাকি উত্তর দিবি?’

ইহান রুদ্রিককে এমন অস্থির আর চিন্তিত দেখে ফিক করে হেসে দিল।ইহানকে হাসতে দেখে ভ্রু-কুচকে ফেলল রুদ্রিক।পরক্ষণে ইহানের হাসির মানে বুঝে গেল অথৈ রাজি হয়ে গিয়েছে।আর ইহান ওর সাথে ফাইজলামি করছে।রুদ্রিক দাঁতেদাঁত চিপে বলে,
‘ আমার সাথে ফাইজলামি করছিস?তোকে তো আমি পরে দেখে নেব।এখন বল আমি যা ভাবছি সেটাই কি ঠিক?’

ইহান হেসে জবাব দেয়,
‘ হ্যা, অথৈ রাজি হয়ে গিয়েছে।আমি বললাম না আমি গিয়ে বুঝালেই ও বুঝবে।’
‘ যাক রাজি হলো।’

হঠাৎ ইহান রুদ্রিককে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ দেখ তুই যেদিন প্রথম অথৈকে দেখেছিস।সেদিনই আমাকে জানিয়েছিস তুই প্রথম দেখাতে আমার বোনকে পছন্দ করে ফেলেছিস।ওকে তোর ভালোলাগে।আমিও কিছু বলিনি।কারন তুই ভালো ছেলে আর তোর ফ্যামিলিও ভালো।কিন্তু ভবিষ্যতের কথা তো আর কেউ বলতে পারে না।কিন্তু মনে রাখিস।আমার বোন আমার কলিজা। ওকে কোনোদিন কষ্ট দিবি না।যদি তোর কারনে আমার বোনের চোখ থেকে একফোটা অশ্র ঝরে।তবে আমি ভুলে যাবো তুই আমার বেষ্টফ্রেন্ড।’
‘ রিলেক্স! হাইপার হচ্ছিস কেন?আমি বললাম তো।তোর বোনকে কোনোদিন আমি কষ্ট দিবো নাহ।রুদ্রিক বেঁচে থাকতে অথৈ কোনোদিন কষ্ট পাবে না।’

রুদ্রিকের ভরসা পেয়ে সস্থির নিশ্বাস ফেলল ইহান।এদিকে রুদ্রিক ইহানের সাথে কথা শেষ করে।ওর দাদুর দিকে তাকালো।পর পর বাঁকা হাসল।ওর বোকা দাদু।সে ভেবেছে রুদ্রিক এতো সহজেই এখানে এসেছে?উহু! তার দাদু তো আর জানে না।তার পছন্দ করা মেয়েকে রুদ্রিক আরও দুবছর আগে থেকেই ভালোবাসে।সিয়ামকে ওর পিছনে লাগিয়েছে স্পাই গিরি করার জন্যে।অথচ এটা জানে না।রুদ্রিক এতোটা কাঁচা প্লেয়ার নাহ।অথৈকে দেখে তো তার ঘুম নিদ্রা সব বিসর্জনে গিয়েছিল আরও দুবছর আগেই।সেদিন ছিল বসন্তকাল।বন্ধুদের সাথে বসন্তবরণ উৎসবে সামিল হয়েছিল রুদ্রিক।ওরা নিজেদের মতো আনন্দ করছিল।হঠাৎ ইহানের ফোনে কল আসে। ও ফোন রিসিব করে কথা বলে নেয়।ইহানের কথা শেষ হওয়ার পর রুদ্রিক জিজ্ঞেস করেছিল কি হয়েছে।ইহান জানায় ওর বোন নাকি তার ফ্রেন্ডের ফোন থেকে ওকে কল করেছে।আর সে নাকি ভার্সিটিতে এসেছে।আর ইহানকে নিতে এসেছে।কারন আজ সে নাকি ইহানের সাথে ঘুরতে যাবে।বোনের আবদার ফেলতে পারবে না ইহান।তাই তৎক্ষনাত চলে যাবে।সবাইকে বলে বিদায় নেয় ইহান।যেহেতু ইহান নেই তাই রুদ্রিকেরও থাকতে ইচ্ছে করছিলো না।তাই নিজেও চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।ওর বন্ধুদের বলে দুজনেই রওনা হয়েছিল।দুজন একসাথে গেটের কাছে আসতেই।ইহান ওকে ইশারা করে দেখায় রাস্তার ওইপারে একটা ছেলের সাথে দাঁড়ানো মেয়েকে।সেদিকে তাকাতেই রুদ্রিকের হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল।বাসন্তী রঙা শাড়িতে এক অপরূপ সুন্দরী দাঁড়িয়ে।ডাগর ডাগর আঁখিজোড়ার গভীর সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল ও।পাশেই দাঁড়ানো বন্ধুর দু একটা কথায় যখন ওই চিকন লিপস্টিক রাঙানো ঠোঁটজোড়া দিয়ে হেসে উঠছিল।তখন মনে হয়েছিল ওই হাসিতেই রুদ্রিক খু’ন হয়ে গিয়েছে।ফর্সা ছোটো-ছোটো চেহারাটায় যেন তার রাজ্যের মায়া।এলোমেলো চুলগুলো ক্ষণেক্ষণেই কানের পিছে গুজে দিচ্ছিল।হাতে তার শুভ্র সিন্ধ বেলি ফুলের মালা। সেদিনই মন হারিয়ে ফেলেছিল রুদ্রিক ওই মেয়ের কাছে।বুকের তীব্র স্পন্দন থামাতে না পেরে ইহানের থেকে দ্রুত বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল।সেদিন রাতে একফোটা ঘুম হয়নি।সারাটারাত ছটফট করেছিল।বারবার মেয়েটার চেহারা ভেসে উঠছিল ও চোখের সামনে।মনের অনুভূতিকে সামলে রাখতে পারিনি।সেদিনই বুঝে গিয়েছিল সে প্রেমে পরেছে।যাকে বলে ভয়া’নক প্রেম।যার থেকে বিন্দুমাত্র নিস্তার রুদ্রিক কোনোদিন পাবে নাহ।
তাই পরেরদিনই ছুটে গিয়েছিল ইহানের কাছে।মনের কথা বলেছিল প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে।তার বিশ্বাস ছিলো ইহান কখনও ওকে ফিরিয়ে দিবে না।আর হলোও তাই।তবে ইহান ওকে বলেছিল অথৈকে বিয়ে না করা পর্যন্ত ও অথৈয়ের ধার পাশেও যেতে পারবে না।রুদ্রিক মেনে নিয়েছিল বন্ধুর কথা।আর আজ তা পূরণ হতে চলেছে।অথৈ ওর বউ হবে।তবে এতো তাড়াতাড়ি ও নিজেও অথৈকে বিয়ে করতে চায়নি।ওর স্টাডি এখনও শেষ হয়নি।কিন্তু ওর দাদু ওকে বিয়ে করানোর জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিল।প্রথমে এই কথা শুনে রাগ হয়েছিল।কিন্তু যেদিন জানতে পারে ওর ভালোবাসার মানুষটিকেই ওর দাদু পছন্দ করে ওর বউ করে আনতে চায়।তখন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল।মন চাচ্ছিল দাদুকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু রুদ্রিক তো রুদ্রিকই নিজের এটিটিউট ধরে রাখতে হবে নাহ?তাই একটু অভিনয় করেছিল বটে।
অতিতের কথা ভেবে হালকা হাসল রুদ্রিক।তারপর ওর দাদুর কাছে গিয়ে বসল।এরপর ওর দাদুকে বলে,
‘ দাদু শোনো না।’

আতিক মাহাবুবের ভ্রু-কুচকে আসে।নাতির হঠাৎ এমন ডাকে কিছু একটা সন্দেহ হচ্ছে।তিনি বলেন,
‘ কি হয়েছে?আমাকে তো এইভাবে কোনোদিন ডাকিস না।’

রুদ্রিক গলা খাকারি দিল।নিজের স্বভাবমতো চরিত্রে ফিরে এসে গম্ভীর গলায় বলে,
‘ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।’
‘ হ্যা বল শুনছি।’

রুদ্রিক ঠান্ডা গলায় বলে,
‘ বিয়ে তুমি যেহেতু আমাকে করাবেই।আর এই মেয়েকেই যে আমার বিয়ে করতে হবে তা আমি ভালোভাবে জানি।তাই চাচ্ছিলাম তুমি যেইভাবেই হোক আজকেই আমাদের আকদ করিয়ে রাখো।মেয়ে নাহয় আমরা পরে ধুমধাম অনুষ্ঠান করে বাড়িতে তুলব আমার স্টাডি শেষ হওয়ার পর।ততোদিন পর্যন্ত সে এই বাড়িতেই থাকবে।কিন্তু আমি চাইনা আমরা কোনো নাম বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে।সেই বন্ধন ভেঙে যাওয়ার সম্ভবনা আছে।আমি চাইছি আমাদের বন্ধনটা যেন মজবুত থাকে।আর সম্পর্কটাও যেন হালাল থাকে।এইজন্যে আমি চাইছি আজই আকদ করে রাখতে।’

আতিক মাহাবুব হা করে তাকিয়ে আছেন নাতির দিকে।তিনি এতোটাই আশ্চর্য হয়েছেন যে রিয়েকশন দিতে ভুলে গিয়েছেন।এইটা কি আদৌ তার নাতি রুদ্রিক?যে বিয়ে করবে না বলে।তাকে জোড় করে এখানে এনেছিলেন তিনি?কিন্তু এখন নাতির মুখে এমন কথা শুনে তার চারশ চল্লিশ বোল্টের ঝটকা লেগেছে।সে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।তার এমন রিয়েকশনে আরহাম সাহেব,আরিয়ান আর রোজাও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।আরাবীর বাবা আর মা আপাততো রান্না ঘরে গিয়েছেন।উনাদের জন্যে আরোও কয়েকপদ নাস্তা আনতে।এইজন্যে উনারা এখানে নেই।এদিকে সবার এমন মুখভঙি দেখে রুদ্রিকের কোনো হেলদোল হলো না।সে বেশ আয়েশ করে সোফায় বসে। একগ্লাস জুস হাতে নিল।আর রিলেক্সে তা পাণ করতে লাগল।সবাইকে এমন ঝটকা দিতে পেরে তার বেশ ভালোই লাগছে।

#চলবে________________

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১২
রুদ্রিকের মুখে আকদ করিয়ে রাখার কথা শুনে মির্জা বাড়ির সকলেই বেশ অবাক হয়েছিলেন।পরক্ষণে সবাই অবাকের রেশ কাটিয়ে উঠতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান।যাক রুদ্রিক রাজি হয়ে গিয়েছে।আর আকদ করিয়ে রাখার কথা নিজেই বলছে।আতিক মাহাবুব কথাটা আজিজুর সাহেবের কাছে প্রস্তাব সরূপ রাখতেই তারাও রাজি হয়ে যান।পবিত্র একটা বন্ধনে তারা আবদ্ধ থাকবে এর থেকে ভালো আর কি হবে? আরিয়ান,রোজা,ইহান,রুদ্রিক তারা চলে যায় বিয়ের সকল ব্যবস্থা করতে।এদিকে মিনহা মেয়ের কাছে যান ব্যাপারটা জানানোর জন্যে।তিনি অথৈয়ের রুমে গিয়ে দেখেন।মেয়ে তার পরনের শাড়ি টারি খুলে গোসল দিয়ে বিছানায় সুয়ে সুয়ে ফোন স্ক্রোল করছে।তিনি অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘ এ কি করেছিস?শাড়ি খুলেছিস কেন?আর একটু পরে থাকতি।তারা না যাওয়া পর্যন্ত।’

অথৈ উঠে বসল।মায়ের কথায় বিরক্ত হয়ে বলে,
‘ উফফো মা।আর ভালো লাগছিল না এইসব শাড়ি টারি পরে থাকতে।সেই কখন থেকে পরে আছি।’

মিনহা বেগম কথা বাড়ালেন নাহ।অথৈয়ের কাছে গিয়ে অথৈয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
‘ বিয়েতে যেহেতু তুই মত দিয়েই ফেলেছিস।তাই উনাদের পরিবার চাচ্ছেন আজকেই তোর আর রুদ্রিকের আকদ করিয়ে রাখতে।যেহেতু তুই রাজি।এইজন্যে আমরাও আর মানা করিনি।কি বলিস তুই?’

অথৈ বিষ্ময়ে হা করে রইল।সে সবে মাত্র হ্যা বলেছে।আর এরা ফোরজি স্পীডে এগিয়ে গিয়ে বিয়েও করিয়ে ফেলবে।এটার পিছনে যে রুদ্রিকের হাত তা বুঝতে বিন্দু মাত্র অনুবিধে হলো না অথৈয়ের।কিন্তু এই লোক এমন হাত ধুয়ে পরেছে কেন ওর পিছনে?ভালো তো ওকে বাসে না সেটা নিশ্চিত।তবে কি সেদিনের ওর করা ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতে চায়?না এমনটা রুদ্রিক করতে পারবে না।রুদ্রিক এমন না।তা এই কয়েকদিনে সেটা বুঝতে পেরেছে অথৈ।তবে কেন করছে সে এমন?অথৈয়ের ভাবনায় ছেদে হয় ওর মায়ের কণ্ঠে,
‘ কিরে? কি বলিস?আকদটা করিয়ে রাখলেই ভালো।তাই নাহ?’

অথৈ মাথা দুলালো।যেহেতু ও রুদ্রিককে বিয়ে কর‍তে রাজি হয়েছে।সেখানে আজ আকদ করিয়ে রাখবে।এখানে দ্বিমত প্রকাশ করে লাভ নেই।তাছাড়া ওর বাবা মা মত দিয়ে দিয়েছেন।তাই আর কথা বাড়ালো না অথৈ।তবে মন খারাপ হচ্ছে বেশ।ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন আজকে।আর আজকের এই দিনেই ওর বন্ধুরা ওর পাশে নেই। বন্ধুদের শূন্যতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে অথৈকে।আজ ওর বন্ধুরা ওর সাথে থাকলে ওর এতো দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে হতো না। ভীষণ মিস করছে তাদের।
————–
ঘন্টাখানিকের মধ্যে বিয়ের সকল ব্যবস্থা করে ফেলা হলো।কাজি আনা হলো,হুজুর আনা হলো।রুদ্রিক অথৈর জন্যে শোপিং ও করে এনেছে।একটা মেয়ের বউ সাঁজতে যা যা লাগে সব এনেছে।এবং তা রোজার হাতে দিয়ে বলেছে।অথৈকে এইগুলো দিয়ে তৈরি করে আনতে।রোজা ক্ষণে ক্ষণে দেবরের পাগলামি দেখে অবাক হচ্ছে।তবে বেশি কথা বাড়ালো না।রুদ্রিকের দেওয়া সবকিছু নিয়ে অথৈয়ের কাছে চলে গেল।
এদিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। মন খারাপ করে আকাশপাণে তাকিয়ে আছে।এইতো আর কিছুক্ষণ এরপরেই ওর জীবনের মোড় পাল্টে যাবে।বদলে যাবে ওর পরিচয়।ওর জীবনটা এমন কি গোটা ও পুরোটাই আজ অন্যকারো নামে দলিল হয়ে যাবে।আচ্ছা?বিয়ের পর ও এইভাবেই জীবনটা কাটাতে পারবে?যেমনটা গত কয়েকবছর যাবত কাটিয়ে আসছে।নাকি সম্পর্কের মারপ্যাচে ওকে বন্ধি হতে হবে অন্যকারো খাঁচায়?ভবিষ্যতটা ওর কেমন হবে?ও কি আজীবন চঞ্চল আর সাহসী আর স্বাধিন অথৈ হয়েই কাটাতে পারবে?নাকি রুদ্রিক তাকে সম্পর্কের জোড়ে ওকে আজীবনের জন্যে অন্ধকারে ঠেলে দিবে?কিন্তু অথৈ তো এমন সম্পর্ক চায় না।ও তো মুক্ত পাখির মতো বাঁচতে চায়।নাহলে যে দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাবে।ওর ভাবনার মাঝে দরজায় টোকা পরে।অথৈ নিজেকে সামলে নিয়ে দরজা খুলতে চলে যায়।দরজা খুলে দেখে রোজা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।অথৈকে দেখে হেসেই বলে,
‘ ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?’

অথৈয়ের মন অল্প হলেও ভালো হয়ে গেল রোজাকে দেখে।মেয়েটার মায়াভরা মুখটা দেখলে যে কারোরই মন ভালো হয়ে যাবে।অথৈ হাসিমুখে বলে,
‘ আরে আসুন না আপু।ভীতরে আসুন।’

রোজা অথৈয়ের রুমে প্রবেশ করে হাতের জিনিসপত্রগুলো বিছানার উপর রাখল।তারপর বলল,
‘ দেখি যাও হাত মুখটা ধুঁয়ে আস।রুদ্রিক তোমার জন্যে বিয়ের সব শোপিং করে নিয়ে এসেছে।এইগুলো দিয়ে তোমাকে তৈরি করে নিচে নিয়ে যেতে। তার আগে এসো।দেখে যাও তোমার বিয়ের শাড়িটা।দেবরের আমার পছন্দ আছে বলতে হবে।’

অথৈ কথাটা শুনে অবাক হলো।তারপর রোজার কথামতো শাড়িটা দেখার জন্যে এগিয়ে যায়।রোজা শাড়িটা খুলে মেলে ধরতেই অথৈয়ের চোখ জুড়িয়ে যায়।টকটকে সিঁদূর লাল রঙের স্টোন ওয়ার্ক করা কাতান শাড়ি।অসম্ভব সুন্দর শাড়িটা।অথৈয়ের চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে।আনমনে অথৈ শাড়িটায় হাত স্পর্শ করে। সাথে সাথে ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।এই শাড়িটা ও গায়ে জড়াবে।আজ বউ সাঁজবে ও রুদ্রিকের জন্যে।কেমন যেন অস্থির লাগছে অথৈর দ্রুত হাত সরিয়ে নিল শাড়ি থেকে। অথৈয়ের এমন হাশফাশ অবস্থা দেখে রোজা বুঝল অথৈ নার্ভাস।তাই অথৈয়ের কাধে রাখল।কাধে স্পর্শ পেয়ে অথৈ রোজা দিকে তাকায়।রোজা অথৈকে বলে,
‘ এতো অস্থির হবার কিছু নেই।নিজেকে হালকা রাখো।কোনো চিন্তার বিষয় নেই।জানো আমার বিয়ের সময়েও আমি এমন নার্ভাস ছিলাম।বলতে গেলে তোমার থেকেও বেশি।তোমার তো মা, বাবা, ভাই আছে।তোমার ভরসার যোগ্য কতোগুলো মানুষ আছে।কিন্তু আমার তো কেউ-ই ছিলো না।দুদন্ড মনের কথা কাউকে বলব সেরকম কেউ আমার ছিলো না।আরিয়ান আমাকে পছন্দ করেছে তাই ওর পরিবার যখন আমার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।বিশ্বাস করো কিযে ভয় লাগছিলো।কেমন হবে পরিবার?আমাকে কিভাবে রাখবে?এখন তো রূপের মোহে পরে হয়তো আমাকে ছেলে আমাকে বিয়ে করবে।যখন মোহ কেটে যাবে। বাস্তবতা বুঝবে।আমি অনাত এটার কারনে তারা যখন সবার কাছ থেকে কটুক্তি শুনবে।তখন আমার প্রতি যদি তারা বিরক্ত হয়ে পরে?পরে যদি আমাকে বের করে দেয় তাদের জীবন থেকে?আরও নানান চিন্তায় আমি অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম।ঠিক মতো খেতাম না ঘুমোতাম নাহ।কিন্তু বিশ্বাস করো বিয়ের পর আমার সব ধারনা পালটে যায়।আমাদের বৌভাতের দিন আমি অনাত এটা নিয়ে তাদের এক সুসম্পর্কের ফুপু আমায় কটু কথা শোনায়।এটা শোনার সাথে সাথে রুদ্রিক রেগেমেগে অস্থির। চিল্লাপাল্লা করে বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলেছিল।সে কি রাগ তার।সাথে বাকিরাও তো আছেই।সেই ফুপুর সাথে সব সম্পর্ক তারা ভেঙে দেয়।আমি যে তাদের কাছে এতোটা স্পেশাল তা বুঝতে পারেনি আমি।যেদিন বুঝলাম বাধ ভাঙা কান্নায় ঢলে পরলাম।আমার সব ভয় নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল।আমিও পরিবার পেলাম।যারা আমাকে এতোটা ভালোবাসে।জানো যেদিন বিয়ে করে আরিয়ান আমায় প্রথম সেই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।দাদু সবার আগে আমায় বাড়ির চাবিকাঠি আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন।ঘরের লক্ষী ঘরে এসেছে।আজ থেকে তার ঘর সে নিজেই দেখে শুনে রাখুক।সেদিনের পর বাড়ির সব দ্বায়িত্ব আমায় দিয়ে দেন।আমাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন।জব করার জন্যেও বলেছিলেন।কিন্তু আমিই করিনি।কারন জব করে যেই সময়টুকু আমি ব্যয় করব।সেই সময়টুকু আমি আমার পরিবারকে দিব।আমি তো অনাত ছিলাম বলো?পরিবার আসলে আমার কাছে কতোটা মূল্যবান তা বলে বোঝানো যাবে না।তাই আমার জীবনে যেই কয়দিনই বাঁচব। পরিবারেত সাথে হাসিখুশি থেকে উপভোগ করে বাঁচব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।আজ আমি এতোটা সুখি যে।আজ নিজের সুখ দেখে নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।ভাবি এতো সুখ আমার মতো অনাতের কপালে উপরওয়ালা লিখে রেখেছেন কল্পনাও করেনি।এখন তারাই আমার সব।তাদের ছাড়া আমার একটা মুহুর্তও চলে নাহ।’

রোজার চোখজোড়া ছলছল করছে।কিন্তু ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি।অথৈ মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখে।তবে ও নিজেও কি রোজার মতো অহেতুক চিন্তা করছে?এতো ভালো একটা পরিবার পাচ্ছে সে। অথৈ মাথা ঝাড়া দিয়ে চিন্তাটুক ঝেড়ে ফেলে দিল।তা হবে তা পরে দেখা যাবে।উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।তাই সবটা তার হাতেই ছেড়ে দিল।অথৈ মুঁচকি হেসে বলে,
‘ ধন্যবাদ আপু।আপনার থেকে এতোটা সাপোর্টিভ কথা শুনে আমার চিন্তাগুলো নিমিষেই গায়েব হয়ে গিয়েছে।’
‘ যাক শুনে খুশি হলাম।এখন যাও ফ্রেস হয়ে আসো।তোমাকে তৈরি করতে হবে।নিচে কাজি আর হুজুর বসে আছেন।’

অথৈও আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ ফ্রেস হতে চলে গেল।কিছুক্ষণ পর ফ্রেস হয়ে আসতেই।রোজা ওকে তৈরি করিয়ে দিতে লাগল।রুদ্রিকের দেওয়া শাড়ি,গহনা সব পরানো হলো অথৈকে।অথৈ রোজাকে বলে দিয়েছি।মেক-আপ যেন খুব হালকা হয়। একেবারেই ন্যাচারাল লাগে যেন ওকে।রোজা তাই করেছে।শুধু লিপস্টিকটা লাল টকটকে দিয়েছে।অথৈ দিতে চায়নি।রোজা জোড় করায়।আর রোজার কথা ফেলতে পারেনি।অথৈয়ের সাঁজ সসম্পূর্ণ হতেই।রোজা অথৈয়ের চিবুক স্পর্শ করে বলে,
‘ মাশা-আল্লাহ। একদম পুতুলের মতো লাগছে দেখতে।দাদুভাইয়ের পছন্দ একেবারে ফার্স্টক্লাস বলতে হবে।আমার দেবর তোমাকে দেখলেই একদম লাট্টু হয়ে যাবে।’

অথৈ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো।নিজেকে বউ সাঁজে দেখে অথৈ কি বলবে বুঝতে পারল না।কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করছে ওর মাঝে।যেই অনুভূতির ব্যাখ্যা ও কাউকে দিতে পারবে না।
হঠাৎ দরজায় টোকা পরল।মিনিহা বেগম ডাকছেন,
‘ কি হলো তোমাদের?সবাই অপেক্ষা করছে।’

রোজা বলল,
‘ এইতো আন্টি হয়ে গিয়েছে।আমি নিয়ে আসছি অথৈকে।’
‘জলদি এসো।’

মিনহা চলে গেলেন।তার অনেক কাজ বাকি।রান্না বান্না এখনও চুলায়।একা হাতে সব সামলানো কঠিন হয়ে পরেছে।কাজের মেয়েটাকেও এমন সময় ছুটি নিয়ে গ্রামে যেতে হলো।বিরবির করতে করতে মিনহা বেগম চলে গেলেন।
____________
অস্থির মন নিয়ে সোফায় টানটান হয়ে বসে আছে রুদ্রিক।বার বার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে সিড়ির দিকে।মেয়েটা আসছে না কেন?এতোক্ষণ লাগে না-কি তৈরি হতে?তার যে আর অপেক্ষা ভালো লাগছে না।পাশেই বসে ইহান বন্ধুর পাগলামি দেখছে।রুদ্রিকের বউ যদি ওর বোন না হতো।তাহলে রুদ্রিককে এতোক্ষণে কতো কথা বলে যে ক্ষ্যাপাতো তা আর বলতে?এখন বোনের বড় ভাই হয়ে সেসব হাতছাড়া করতে হচ্ছে।ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইহান।এদিকে অথৈয়ের দেরি দেখে রুদ্রিক ইহানের কানে ফিসফিস করে বলে,
‘ এতোক্ষণ লাগছে কেন আসতে?সেই কখন গিয়েছে ভাবি।তোর বোন কি সত্যিই বিয়েতে রাজি হয়েছে?বলবি?নাহলে আসছে না কেন?’

রুদ্রিকের একেরপর এক প্রশ্নে ইহানের হাসি পেলেও হাসলো না ও।মুখটা গম্ভীর করে বলল,
‘ লজ্জা রাখ কিছু।কাকে কি বলছিস?ভুলে যাস না সম্পর্কে এখন আমি তোর সম্বন্ধি হবো।’

ইহানের কথায় ভ্রু-কুচকে আসে রুদ্রিকের।বলল,
‘ ফাইজলামি করছিস আমার সাথে?কিসের সম্বন্ধি?হ্যা কি বলিস এগুলো?সব বাদ বুঝেছিস।তুই আমার বেষ্টফ্রেন্ড কম ভাই বেশি।এই সম্পর্কটাই থাকবে আমাদের। আর হ্যা উল্টাপাল্টা কথা বলে আমাকে রাগাবি না।এমনিতেই মেজাজ খা’রাপ হয়ে আছে।’

দুহাতে পিছনের চুল খামছে ধরে চোখ বুঝে নিল রুদ্রিক।

‘ ওইতো অথৈ এসে পরেছে।আয় মা বাবার কাছে এসে বোস।’

আজিজুর সাহেবের কথাটা কানে আসতেই তড়িৎ বেগে সামনের দিকে তাকায় রুদ্রিক। তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে যায় ও।হৃস্পন্দনের গতি হু হু করে বেড়ে যায়।হাত পা ক্রমশ শিথিল হয়ে আসল।লাল টুকটুকে কাতান শাড়ি গায়ে জড়িয়ে,মাথায় সোনালি রঙের ওড়না দেওয়া,গহনা পড়া,সেই সাথে হালকা সাঁজ পুরো পুতুল বউ সেঁজেছে অথৈ। যেমনটা ও স্বপ্ন দেখতো প্রতিরাত।মেয়েটার ওই কাজল কালো চোখদুটোর গভীর মায়ায় তলিয়ে গেল রুদ্রিক আরেকবার।এভাবে যে কতোবার নিজেকে হারিয়েছে হিসেব ছাড়া।যতোবার ওই চোখের দিকে তাকিয়েছে।নাকে নোসপিন পরেছে ওর দেওয়া ডায়মন্ডের।সেখানে একটা চুমু খাওয়ার ইচ্ছে জাগলো রুদ্রিকের মনে।দৃষ্টি গিয়ে আটকালো অথৈয়ের লাল টুকটুকে ঠোঁটের উপর।সাথে সাথে নিষিদ্ধ ইচ্ছে মনের কোঠায় উঁকি ঝুকি দিতে লাগল।একবার যদি ছুঁয়ে দিতে পারত ওই অধরজোড়া।শুকনো ঢোক গিলল রুদ্রিক।মাথা ঝাকিয়ে ভাবনাগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল।এসির মধ্যে বসেও সমানে ঘামছে রুদ্রিক।গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছে।জলদি টেবিল থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে পাণ করে নিলো।যতোই নজর সরাতে চাইছে। কিন্তু বেহায়া নজরজোড়া ঘুরেফিরে অথৈয়ের মাঝে গিয়েই আটকে যায়।চোখ সরাতে পারছে না ও।মেয়েটা এতো সুন্দর লাগছে।যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।রোজা দূর থেকে রুদ্রিকের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে।তার দেবর যে অথৈয়ের রূপে কুপোকাত হয়ে পরেছে তা বেশ বুঝতে পারছে।কিন্তু এগুলোর মাঝে রুদ্রিক যে কিছু লুকাচ্ছে সেটা আন্দাজ করতে পেরেছে ও।এখন সময় মতো রুদ্রিককে ধরে সব কথা পেটের থেকে বের করার অপেক্ষায় আছে ও।সব ভেবে রোজা অথৈ নিয়ে আজিজুর সাহেবের পাশে বসালো।তারপর নিজে গিয়ে আরিয়ানের পাশে বসে পরল। আতিক মাহাবুব বললেন,
‘ এইবার বিয়ের কার্যক্রম শুরু করা যাক?’
‘ জি!’

আজিজুর সাহেবের অনুমতি পেতেই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল।প্রথমে ধর্মীয় নীতিতে বিয়ে পরানো হলো।রুদ্রিক আর অথৈ তিন কবুল বলে একে-অপরের হয়ে গেল।রুদ্রিককে কবুল বলতে বললে ও ফটাফট বলে দিয়েছে। কিন্তু অথৈয়ের বেলায় ও একটু সময় নিয়েছে।মেয়ের মনের অবস্থা আজিজুর সাহেব হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন।তিনি আদুরে হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।মিনহা বেগম চোখের ইশারায় কবুল বলতে বলেন।আরাবী অশ্রুভেজা চোখে বাবা মাকে দেখে।তারপর ভাইয়ের দিকে তাকায়।ইহানও চোখের ইশারায় সম্মতি দেয়।সবার ভরসায় অথৈ ভেজা কণ্ঠে ধীরে ধীরে কবুল বলে দেয়।সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।এরপর আইনের নীতিতে ম্যারিজ রেজিস্ট্রি পেপারে দুজনে সই করে দেয়।ধর্মীয়ভাবে আর আইনতভাবে রুদ্রিক আর অথৈ স্বামি স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়।বিয়ের কার্যক্রম শেষ হলে তার কিছুক্ষণ পর মির্জা বাড়ির সকলে চলে যাওয়ার কথা বললে মিনহা বেগম,আজিজুর সাহেব আর ইহান নারাজ হয়ে যায়।তাদের এক কথা রাতে খাওয়া দাওয়া না করে কোথায় যাওয়া হবে না।মির্জা বাড়ির কেউ আর তাদের আবদার ফেলতে পারলেন নাহ।তাই রাতের ডিনার এখানেই করেন।খাবার সময় রুদ্রিক আর অথৈকে রোজা একসাথে বসিয়েছে।পাশে রুদ্রিক বসায় যেন অথৈয়ের গলা দিয়ে খাবার নামছিলোই নাহ।কোনোরকম পানি দিয়ে একটুখানি খাবার খেয়ে উঠে গিয়েছে।খাবার দাবার শেষে মির্জা বাড়ির সকলে বিদায় নেন চলে যাবার জন্যে। আতিক মাহাবুব অথৈয়ের কাছে গিয়ে অথৈয়ের হাতে দুজোড়া বালা পরিয়ে দেন। অথৈ অবাক হয়ে তাকালে তিনি বলেন,
‘ এগুলো রুদ্রিকের মা বানিয়ে রেখেছিল তার পুত্রবধুদের জন্যে।রোজারটা রোজাকে দিয়ে দিয়েছি।আর আজ তোমারটা তোমাকে দিলাম।রুদ্রিকের দাদি বা মা থাকলে তারা দিত।কিন্তু তারা তো নেই।তাই আমিই দিলাম।সামলে রেখো।’

অথৈ বালা দুটোয় হাত ছোঁয়ালো।ধীর আওয়াজে বলল,
‘ সামলে রাখব।’

আরহাম সাহেব অথৈয়ের সাহেব এগিয়ে আসলেন।পুত্রবধুর মাথায় হাত রেখে দোয়া দিলেন।তারপর অথৈয়ের হাতে দশ হাজার টাকা গুজে দিলেন।অথৈ তা দেখে দ্রুত বলে,
‘ আংকেল এসব লাগবে না।কি করছেন।’

আরহাম সাহেব হেসে বলেন,
‘ আংকেল না।আজ থেকে আমি তোবার বাবা।ঠিক বেয়াই সাহেবের মতো।আর এইগুলো আমার পক্ষ থেকে উপহার। মানা করো না।আসলে হুট করেই যে আজ তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাবে প্লান ছিলো না।তাই কিছু কিনে আনতে পারিনি।তাই এইগুলোই গ্রহণ করো মা।তুমি মন খারাপ করো না।’
‘ আরে না না আংকে…আব বাবা।আমি মন খারাপ করব কেন?আপনারা আমাকে খুশি হয়ে যা দেবেন। আমি তাতেই খুশি।’
‘ এইতো গুড গার্ল।’

আরিয়ান আর রোজা একসাথেই আসল।রোজা অথৈকে একটা স্বর্ণের লকেটসহ চেইন উপহার দিলো।আরিয়ান বলল,
‘ এটা আমার আর রোজার তরফ থেকে উপহার।’

এই চেইনটা তখন বিয়ের কেনাকাটা করার সময় কিনে এনেছে আরিয়ান।রোজা বলে দিয়েছিল।আরিয়ান উপহার অথৈয়ের হাতে দিয়ে বলে,
‘ ভালো থেকো।’
‘ আপনিও ভালো থাকবেন ভাইয়া।’

আরিয়ান হেসে মাথা দুলিয়ে সরে গিয়ে দাদু আর বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।রোজা মুচঁকি হেসে ফিসফিস করে অথৈকে বলে,
‘ কি সবার সাথে তো কথা বললে।এখন আমার দেবরটার সাথে একটু কথা বলবে নাহ?কবে না কবে আবার দেখা হয়।’

‘ তার সাথে তো আমার প্রতিদিনই দেখা হয় আপু।এ আর নতুন কি!’ বিরবির করে কথাটা বলল অথৈ।
বুঝতে না পেরে রোজা বলে,
‘ কিছু বললে?’
‘ আব.. না কি বলব।’

রোজা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর স্বাভাবিক স্বরে বলে,
‘ রুদ্রিক আমরা গাড়িতে গিয়ে বসছি।আর অথৈ রুদ্রিক নিয়ে তোমার রুমে যাও বোন।একটু একা কথা বলে নেও।যাও।’

সবার সামনে এভাবে বলায় লজ্জা পেলো অথৈ। রোজা চোখ টিপে দিল রুদ্রিককে।রুদ্রিক ঠোঁট কামড়ে হাসল ওর ভাবির কান্ডকারখানা দেখে।অথৈ আলগোছে রুমের দিকে চলে গেল।পেছন পেছন গেল রুদ্রিক।রুদ্রিক রুমের দরজা চাপিয়ে দিল।অথৈ উল্টোদিকে ঘুরে আছে।বুকটা ধ্বুকপুক করছে।অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছে।যা আগে কখনও হয়নি।ভাবতেই অবাক লাগছে।যাকে বিয়ে করবে না বলে বলে বলে হয়রান হয়ে গিয়েছিল।আর কিছুক্ষণের ব্যবধানেই সে এখন তার স্বামি।যে এই মুহুর্ত তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।মনের ভীতর যে একটা অজানা ক্ষোভ ছিলো তা যেন কবুল বলার সাথে সাথেই গায়েব হয়ে গিয়েছে।একেই বলে বুঝি পবিত্র সম্পর্কের জোড়? ভাবনার ছেদ ঘটে নিজের খুব নিকটে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে।আর লোকটা যে রুদ্রিক তা বেশ ভালোভাবে জানে অথৈ।ধীরে ধীরে রুদ্রিকের দিকে ফিরল অথৈ।পলক ঝাপ্টে তাকালো রুদ্রিকের দিকে।রুদ্রিক ঘোরলাগা দৃষ্টিতে অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।ওই চোখে চোখ রাখতে পারল না অথৈ।দ্রুত মাথা নিচু করে নিলো।রুদ্রিক বাঁকা হাসল।তারপর মাথা নিচু করে মুখটা অথৈয়ের কানের কাছে নিলো।ভয় পেয়ে অথৈ চোখ বন্ধ করে নিলো।রুদ্রিক ধীর কণ্ঠে বলল,
‘ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে অথৈ।অনেক সুন্দর। ‘

সরে আসল রুদ্রিক।চোখ বন্ধ করা থাকা অথৈয়ের দিকে দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি আটকালো ওই নোসপিনটার দিকে।মোলায়েম কণ্ঠে বলে,
‘ নোসপিনটায় পরায় একদম আমার বউ লাগছে।’

রুদ্রিকের মুখে ‘ আমার বউ ‘ কথা শুনে সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ বয়ে গেল অথৈয়ের।তড়িৎ গতিতে তাকালো রুদ্রিকের দিকে।চোখে মুখে তার অবাকের রেশ।রুদ্রিকের এই ব্যবহার যে হজম করতে পারছে না।অথৈকে আরও একশ ধাপ অবাকের চূড়ায় নিয়ে পৌছে দিতে।রুদ্রিক এক অবিশ্বাস্য কান্ড করে বসল। অথৈয়ের নাকে ঠিক নোসপিন পরা জায়গাটায় চট করে নিজের অধরের স্পর্শ দিয়ে দিলো।এরপর কোনো কথা না বলে।এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।আর রেখে গেল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অথৈকে।যে হা করে রুদ্রিকের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে।যার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছে।আর পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে।রুদ্রিকের দেওয়া সেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটুখানি অধর স্পর্শের জন্যে।

#চলবে_____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করেন।তাহলে আমিও এইরকম বড়ো বড়ো পর্ব দিব।