মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-১৭+১৮

0
626

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৭
🌸

পড়া শেষ করে মীরা আর মুবিন একসাথেই রুম থেকে বের হলো। মুবিন কোথাও যাবে। সে দরজার কাছে গিয়ে মা’কে ডেকে বলল,

“আম্মু আমি একটু বেরুচ্ছি।”

সুমনা রান্নাঘর থেকেই বলল,

“এখন কোথায় যাচ্ছিস?”

“বেরুচ্ছি একটু। চলে আসব।”

মীরা এসে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসল। টিভির রিমোট হাতে নিয়ে সামনের টেবিলের উপর পা তুলে দিল। এই বাড়ি এত পরিপাটি থাকে, এরকম পরিপাটি বাড়ি দেখলে তার ভালো লাগে না। একটু অগোছালো থাকলে বাড়ি বাড়ি ফিল আসে। এটা তো আর হোটেল না। টিভি চালু করে দিয়ে মীরা ডাকল,

“আন্টি তোমাদের বাড়ি এমন টিপটপ পরিপাটি থাকে কেন? একটু অগোছালো করার মানুষ নেই।”

সুমনা হেসে জবাব দিল,

“তুই করে দিয়ে যা।”

“যাচ্ছিই তো। তারপরও আমি তো আর চব্বিশ ঘণ্টা এখানে থাকি না। শোনো আন্টি ছেলেদের এবার বিয়ে করাও। বাড়িতে বউ আসুক। দু’চারটা নাতি নাতনি হোক। তুমি আমি মিলে বউটাকে নির্যাতন করবো। বউ তোমার ছেলেদের কাছে বিচার দিলে তুমি ডায়লগ মারবে, এটা আমার বাড়ি। আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথা মতো থাকতে হবে। নইলে তোরা তোদের বউদের নিয়ে এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা।”

সুমনা ওর ছেলেমানুষী কথা শুনে হাসছে। মীরা থেমে নেই। সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে গলাটা আরেকটু উঁচু করে বলল,

“মুবিন ভাইয়েরও বিয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু জায়িন ভাইয়ের তো বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। উনাকে কবে বিয়ে করাবে? বুড়ো হয়ে গেলে তো মেয়ে পাবে না।”

” তুই-ই একটা মেয়ে খোঁজে দে।”

“আমি খুঁজে দিব? তোমার ওই গোমড়ামুখো পেঁচা ছেলের সাথে কোন মেয়েই দুই দিনের বেশি থাকতে পারবে না।”

“তারপরও ছেলেকে বিয়ে তো করাতে হবে। তোর জানাশোনা ভালো কোন মেয়ে নেই?”

“আমি জেনেশুনে কেন আমার বান্ধবীদের কপাল পোড়াবো আন্টি? তোমার ছেলে তো হাসতেই জানে না। কথা বলতে তার কত কৃপণতা! এমন একটা মানুষের সাথে মনখোলা কোন মেয়েই সংসার করবে না।”

সুমনা হাতের কাজ সারতে সারতে মুখ টিপে হাসছে। মীরা ডাকল,

“ও আন্টি, ঘটককে কি এক কাপ চা দেবে না? শুকনো মুখে বিয়ের কথা বললে তো বিয়ে টিকবে না।”

সুমনা এসে মীরাকে চা দিয়ে গেল। আস্তে করে বলে গেল কথা কম বলতে। মীরা সুমনা আন্টির ইশারা বুঝলো না। সে মনের সুখে চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তি করে “আহ” শব্দ করল।

“তোমার হাতে জাদু আছে বুঝলে। এত সুন্দর একটা চা খাওয়ানোর জন্য তোমার কাজটা করাই যায়।”

“মীরা তুই বাড়ি যা।”

“পরে যাব।”

“চুপ করে চা শেষ কর তাহলে।”

“চা খেতে খেতে বিয়ের কথা বলি। আচ্ছা ঠিক আছে। আগে জায়িন ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে যাক। পরে মুবিন ভাইয়ার কথা ভাববো। দায়িত্ব যখন দিয়েছ। এখন বলো তো কেমন মেয়ে চাও?”

“তোর মতো লক্ষী একটা মেয়ে।”

“লক্ষী মেয়ে! খোঁজা একটু কঠিন হবে। তবে পাওয়া যাবে। দেখতে কেমন হতে হবে?”

“তোর মতোই ধর।”

“আমার মতো! উঁহু, তোমার জিরাফের মতো লম্বা ছেলের সাথে আমার মতো লিলিপুটকে মানাবে না। জায়িন ভাইয়ের বউ ওর সমান না হলেও কাঁধ পর্যন্ত হতেই হবে। নইলে ভালো লাগবে না। আমি তো উনার কাঁধের সমানও না।”

সুমনা কিছু বলল না। মীরা নখ কামড়ে কিছুক্ষণ ভেবে খুশি হয়ে বলল,

“আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে। অনেক লম্বা। সুন্দরীও। বাবার অনেক টাকা। প্রতিদিন গাড়ি করে কলেজে আসে। তোমার ছেলের সাথে বেশ মানাবে। মেয়েটার সাথে কথা বলে দেখি। আচ্ছা আন্টি জায়িন ভাইয়ের বয়স কত? মেয়েটা তো আমার বয়সী। অনেক ছোট হয়ে যাবে না?”

পা নাচাতে নাচাতে টিভিতে কাপিল শর্মা শো দেখছিল মীরা। সে গভীর চিন্তায় আছে বলে হাস্যকর সব জোকস শুনেও হাসি আসছে না।

“আন্টি শোনো না। উনার যদি কোন গার্লফ্রেন্ড থেকে থাকে। তুমি কি জানো উনার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে কি-না। দেখা গেল গার্লফ্রেন্ড থাকলে আমার সব খাটনি জলে যাবে। তুমি উনাকে জিজ্ঞেস করে আমাকে জানিও।”

“আচ্ছা জানাব।”

“আজকালকার কোন ছেলেই সিঙ্গেল হয় না। তোমার ছেলেরও নিশ্চয় গার্লফ্রেন্ড আছে। লজ্জা পেয়ে না-ও বলতে পারে। তবে তুমি জোর দিবে। টাইট করে ধরলেই সত্য কথা বলে দিবে।”

কথা বলতে বলতে ঘাড় ফিরিয়ে হঠাৎ মীরার চোখ জায়িনের রুমের দিকে গেল। এক হাত কোমরে রেখে দরজার সামনে মানুষটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মীরা ভূত দেখার মতো ভয় পেল। চোখের ভুল কিনা বোঝার জন্য বার কয়েক চোখ পিটপিট করল। তারপরও ভূতটা যাচ্ছে না দেখে চায়ের কাপ রেখে চোখ কচলে দেখল। এখনও আছে। তার মানে এটা কোন ভূত টুত না! এটা জায়িন ভাই-ই! মীরার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে সে যা যা বলছিল জায়িন ভাই সব শুনেছে! ইনি বাড়িতেই আছেন এই কথাটা তো তাকে কেউ জানায়নি। এবার এতদিন থাকছে কেন? কোন বারই তো চার দিনের বেশি থাকে না। মীরার কলিজার পানি তো উনাকে দেখেই শুকিয়ে গেছে। এখন গলাও শুকিয়ে আসছে। মীরা আড়চোখে টেবিলের উপর পড়ে থাকা নিজের ব্যাগটা ও দরজাটা দেখল। জায়িন কঠিন চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা ঢোঁক গিলে দাঁত বের করে বোকার মতো হাসল। কিন্তু তার এই হাসিতেও কোন কাজ হলো না। জায়িন ভাই তাকে খেয়ে ফেলবে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। মীরা ব্যাগটা হাতে নিল। ঝড়ের বেগে দরজার দিকে দৌড়ুতে দৌড়ুতে আন্টিকে বলল,

“আন্টি আমি আসছি।”

“কিরে, এই মীরা। শোন, আসছি বলেই চলে গেলি নাকি?”

ঝড় বৃষ্টি তুফান চলে এলেও মীরা দাঁড়াবে না। জায়িন ভাই যতদিন না যাচ্ছে ততদিন পড়তেও আসবে না। আল্লাহ, একেই মনে হয় বলে বাঘের গুহায় পা দেওয়া। যেভাবে দেখছিল! ভয়ঙ্কর এই চোখ দু’টো আজকের পরে স্বপ্নেও মীরাকে তাড়া করবে।

রাস্তায় বেরিয়ে মীরা নিজের গালেই দুইটা করে চারটা চড় দিল। ফিরে একবার মুবিন ভাইদের বাড়িটা দেখল।

“অন্যের বিয়ে নিয়ে তোর এত মাথা ব্যথা কেন? ওই জিরাফের জন্য বউ খুঁজবি তুই? তার আগে জিরাফটা তার চোখ দিয়েই তোকে দুনিয়া থেকে গায়েব করে দিবে। তওবা কাট মীরা। আর জীবনে ওই জিরাফের বিয়ের কথা মুখে আনবি না।”

🌸

মীরাদের বাড়িতে আজ সকাল থেকেই বিশাল তোরজোর চলছে। কারণ আজ ইভা আপুদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়িতে মানুষ আসবে। ইভা আপুর বাবা এক সপ্তাহ আগেই দেশে এসেছে। বড় ফুপু, ছোট ফুপু সবাই এসেছে। মীরা মাহাকে কোলে করে পুরো বাড়ি জুড়ে টইটই করে ঘুরছে। মাহিমা ফাউ পেঁচাল পারছে।

“ইভা আপুর বাবা মা’র সাথে জায়িন ভাইরাও আসবে, না মীরা?”

জায়িন ভাইয়ের নাম শুনেই মীরার গলা শুকিয়ে গেল। ওই দিনের পর প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখেছে জায়িন ভাই হাতে এতো বড় একটা রাম দা নিয়ে তাকে তাড়া করছে। মীরা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে জান বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে। জায়িন ভাই আলিফ লায়লার মোটা পেট ওয়ালা, টাক মাথার দৈত্যদের মতো হু হা হা করে হাসতে হাসতে তার পেছনে ছুটছে। উফ বাবা! কী ভয়ংকর স্বপ্ন।

“দুই ভাই-ই দেখতে সুন্দর। হ্যান্ডসাম। পড়াশোনাতেও ফার্স্ট বয়। একটাকে পটিয়ে ফেলতে পারলে কাজ হতো। তুই তো প্রথম থেকেই মুবিন ভাইয়ের উপর ক্রাশিত।”

মীরা রাগী চোখে মাহিমাকে দেখল। কলেজে উঠার পর থেকে এই মেয়ের জীবনের একটাই উদ্দেশ্য প্রেম করা। এর মুখ থেকে সারাক্ষণ প্রেমের কথাই বেরোয়।

“মুখ ভোতা মেরে রেখেছিস কেন? কথা বলতে কষ্ট লাগে নাকি?”

“তোর ফাউ পেঁচালে নিজের মূল্যবান কথাগুলো ব্যয় করতে চাচ্ছি না।”

“ফাউ পেঁচাল! এভাবে অপমান করলি তুই আমাকে? কেন, মুবিন ভাইয়ের উপর তুই ক্রাশ খাসনি?”

“ছোটবেলায় খেয়েছিলাম। এখন উনারে দেখলে আমার ভাই ভাই ফিল আসে।”

“সারাক্ষণ ভাই ডেকে মুখ দিয়ে ফেনা বের করে ফেলিস। তাহলে ভাই ভাই ফিলিংস না এসে জামাই জামাই ফিলিংস আসবে নাকি?”

“তুই তো জায়িন ভাইকে জামাই ডাকিস তাই জামাই জামাই ফিল আসে তোর! হারামি তুইও তো ভাইয়াই ডাকিস।”

“ওরে পাগলা ভাইয়া থেকেই তো ছাইয়া হয়।”

ওদের কথাবার্তা ছোট্ট মাহা কী বুঝলো কে জানে। সে খিলখিল করে হাসতে লাগল। মাহিমা জিভ কামড়ে বলল,

“নাউজুবিল্লা। মাসুম বাচ্চা ফেরেশতার সামনে পাপ মার্কা কথাবার্তা বলেছি এতক্ষণ। ওর কানে কানে কয়েকবার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়।”

🌸

রাতে মেহমান আসবে। কিন্তু দুপুর থেকেই চাচী, ফুপুদের আশেপাশে যাওয়া যাচ্ছে না। সবাই কাজে এত ব্যস্ত। সামনে দেখলেই ধমকে দিচ্ছে। আবির ভাই তনি আপুর সাথে সবার সামনে বিন্দাস প্রেম করছে। কেউ সন্দেহ করছে না। কিছু বলছেও না। মীরা মাহিমা ড্রয়িংরুমে সোফায় একপাশে বসে কান পেতে ওদের কথা শুনছে। কিছুক্ষণ শোনার পর মীরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড এসব কথা বলে নাকি? এরা তো তুই তাই করে ঝগড়া করছে।”

“এজন্যই কাজিন মহলে প্রেম করা ঠিক না। এদের তুই তাই দিয়েই জীবন কাটবে।”

“বিন্দু ওর বয়ফ্রেন্ডকে কী ডাকে জানিস?”

“বাবুর আব্বু। অথচ ওর বয়ফ্রেন্ডেরই এখনও মা’র কোলে শুয়ে ফিডার খাওয়ার বয়স।”

মীরা হো হো করে হেসে উঠল। সাথে মাহিমাও যোগ দিল। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ের উপর ঢলে পড়ছে। আবির, তনি চোখ ছোট ছোট করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা হাসতে হাসতেই বলল,

“ওইডার মা এখনও ছেলেকে ডায়াপার পরিয়ে বাড়ি থেকে পাঠায়। মহিলা কী আর জানে তার বাবু আরেক বাবুর বাবা হয়ে গেছে।”

দু’জনকে এমনভাবে হাসতে দেখে আবির, তনি বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ওরা পাগলের মতো হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে কী বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ইভান এসে ওদের এরকমভাবে হাসতে দেখে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। আবির উঠে এসে ইভানের পাশে দাঁড়িয়ে সন্দেহের চোখে দু’জনকে দেখে বলল,

“পাগল টাগল হয়ে গেছে নাকি!”

ইভান আবিরের দিকে ফিরল।

“হাসছে কেন এভাবে? তুই কোন জোকস বলেছিস নাকি? কিন্তু তোর ফালতু জোকস শুনে ত এভাবে হাসার কথা না।”

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৮
🌸

মীরা মাহিমা সন্ধ্যার আগেই তৈরি হয়ে বসে আছে। নিচে এসে টেবিল সাজাতে সাহায্য করছে। মাহিমা মামীর হাত থেকে শোকেস থেকে বের করা নতুন কাচের প্লেট নিতে নিতে বলল,

“আমাকে দাও মামী। আমি হেল্প করে দিচ্ছি।”

বড় মামী হেসে বলল,

“লক্ষী মেয়ে আমার। সাবধানে করিস কেমন?”

“হু।”

মীরা রান্নাঘরে গিয়ে ছোট চাচীর পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে বলল,

“কী করো ছোট চাচী? ”

“মেহমানের জন্য ফল কাটি। ওরা এসেই পড়েছে। আবির কল দিয়েছিল।”

“ওহ। আমাকে দাও তাহলে। আমি কেটে দিচ্ছি। মাহা দুধ খাওয়ার জন্য কাঁদছে। তুমি যাও।”

“না না। তুই পারবি না। হাত কেটে ফেলবি।”

মীরা জেদ করলো।

“কাটব না, সত্যি। তুমি দিয়েই দেখো।”

“পারবি না রে তুই। শুধু শুধু কাজ বাড়াস না।”

“পারব তো। আমি কি আগে কোনোদিন ফল কাটিনি? কত কেটেছি।”

এই মেয়ে নাছোড়বান্দা। একবার যা বলবে হাজার বার না করলেও শুনবে না। ওদিকে মাহার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তনি চাচীকে ডাকছে।

“আচ্ছা তুই সুন্দর করে ফল কেটে ওই প্লেটে সাজিয়ে রাখ। হাত কাটিস না। তাহলে মার খাবি কিন্তু। ”

“হু।”

ছোট চাচী চলে গেল। মীরা খুশি মনে ফল কাটছে। আজ বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে তারপর থেকেই বিয়ের কেনাকাটা, ঘরবাড়ি সাজানো, হলুদ, বিয়ে কত মজা। অনেকদিন পড়া বন্ধ।
মাহিমা ডাইনিংয়ে প্লেট সাজিয়ে রাখছিল। হঠাৎ করে হাত ফসকে একটা প্লেট পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙে এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেল। মাহিমা চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে এমন বিকট শব্দ শুনে বেখেয়ালে মীরা ফলের বদলে হাতে ছুরির পোঁচ বসিয়ে দিয়েছে। কলকল করে রক্ত ছুটেছে। মীরা যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। এক চোখ সামান্য একটু ফাঁক করে হাতে তাজা লাল রক্ত দেখে এক চিৎকার দিয়ে তব্দা খেয়ে গেল। মীরার চিৎকার শুনে মাহিমা কেন চিৎকার দিল সে-ও জানে না। প্লেট ভেঙে ফেলার ভয় নাকি মীরার চিৎকারে ভয় পেয়ে কে জানে। দুই মেয়ের চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেল। সামান্য একটু সাহায্য করতে এসে অকাজের কাজ সবই করে দিল। মাহিমার মা মাহিমাকে বকছে। বড় মামী মাহিমাকে বাচাঁনোর চেষ্টা করছে।

“থাক ওকে বকো না। ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। ইচ্ছে করে কি আর ভেঙেছে? হাত থেকে পড়ে গেছে। এখন বকাঝকা করে মেয়েটার মন খারাপ করে দিও না।”

বড় মামী ফ্লোর থেকে কাঁচ তুলে নিচ্ছে। মাহিমা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। সে তো কাজ এগিয়ে দিতে চেয়েছিল। এখন উল্টো কাজ বাড়িয়ে দিল। মাহিমা অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। মীরাকে মাহিমার মতো কেউ বকছে না। কিন্তু বড় ফুপু শাসন করছে।

“তুই কি এখনও রুশমির মতো ছোট মানুষ! হাত কাটে কীভাবে? আর তোর জোর করে ফল কাটতে হবে কেন? এখন হাত কেটে শান্তি হয়েছে?”

ছোট চাচী মীরাকে বকা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে বলল,

“আমিই ওকে কাটতে বলেছিলাম আপা। ওর কোন দোষ নেই।”

“থাক, আমাকে আর বোঝাতে হবে না। তুমি ওকে কাজ করতে বলবে! কাকে টুপি পরাও শুনি? যে মেয়েকে এক গ্লাস পানি নিজে থেকে নিয়ে খেতে দাও না তাকে দিয়ে কাজ করাবে!”

বড় ফুপু মীরার হাতে ঔষধ লাগিয়ে দিয়ে হাত ব্যান্ডেজ করে দিল। মীরা মুখ লটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসেছিল সাহায্য করতে। এখন নিজের পেছনেই দুই তিনজনের সাহায্য লাগছে।

“চুপচাপ সোজা ঘরে গিয়ে বসে থাক। মেহমান এলে তোদের ডেকে আনব। তার আগে যেন তোদের দুইটাকে ঘরের বাইরে পা দিতে না দেখি।”

মাহিমা মীরার ঘরের বেডে মুখ ফুলিয়ে শুয়ে আছে। মীরা হাতের ব্যান্ডেজে টানাটানি করছে। মাহিমা বলল,

“আমি কোন কাজ সোজা ভাবে কেন করতে পারি না? একটা না একটা ঝামেলা বাঁধাবোই।”

“দোষ আসলে আমাদের না। দোষ ঝামেলার। ঝামেলা আমাদের পছন্দ করে। তাই পিছু ছাড়ে না।”

“ঠিক বলেছিস। সব দোষ হতচ্ছাড়া ঝামেলার। আচ্ছা দেখি তোর হাত কতটা কেটেছে।”

“বেশি কাটেনি। একটু কেটেছে। কিন্তু অনেকগুলো রক্ত বেরিয়ে গেছে।”

“আচ্ছা নে কমলা খা। ফল খেয়ে রক্ত হয়ে যাবে।”

মাহিমা কমলার খোসা ছাড়িয়ে ঘর জুড়ে ছিটিয়ে ফেলছে। নিজে একটা খাচ্ছে। মীরাকে একটা দিচ্ছে।

🌸

ইভা আপুর বাবা মা, মুবিন ভাই সহ তার বাবা মা-ও এসেছে। জায়িন আসেনি। কারণ সে বাড়িতে নেই। মীরাদের বাড়িতেও আজ সবাই উপস্থিত। বাড়ির বড় ছেলের বিয়ের কথা হবে। মীরাদের আয়োজন দেখে যে কেউই বিস্মিত হবে। মেহমানরা আসার পর মীরা মাহিমাকে ডাকা হয়েছে। দু’জন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। মুবিনের চোখ ওদিকেই আটকে রইল। ওরা নিচে এসে বড়দের সবাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। মুবিনের কাছে এসে দাঁড়ালে মুবিন ওর হাতে ব্যান্ডেজ দেখে বলল,

“হাতে কী হয়েছে?”

মীরা মুখ গোমড়া করে বলল,

“ফল কাটতে গিয়ে কেটে গেছে।”

“তুমি ফল কাটতে গিয়েছিলে কেন?”

“আপনাদের জন্যই তো।”

মীরার বলার ধরন দেখে মুবিন সামান্য হাসলো। মাহিমারও মন ভালো নেই। তাই সে আজ নিজে থেকে মুবিনের সাথে কোন কথা বলেনি। মুবিন মাহিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছো মাহিমা?”

মাহিমা ফোঁস করে দম ছেড়ে বলল,

“ভালো খারাপের মাঝামাঝি আছি মুবিন ভাই।”

মুবিন ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকিয়ে আগ্রহ নিয়ে বলল,

“কেন?”

“হাত থেকে পড়ে প্লেট ভেঙে ফেলেছি। ইচ্ছে করে ভাঙিনি। তবুও মা বকেছে।”

এরকম ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ওদের মন খারাপ করা দেখে মুবিনের সত্যিই হাসি পাচ্ছে।
ইভানকে আগে থেকেই সবার পছন্দ। ধরতে গেলে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। আজ শুধু বিয়ের তারিখ পাকা করবে। কিন্তু এখানে এসে একটা সমস্যা হলো। মুবিনের বাবার কাবিনের টাকা দিয়ে দরকষাকষি কারোরই ভালো লাগলো না। কিন্তু কেউ কিছু বললোও না। মীরার বাবা বলল,

“আমরা বউমা না, ঘরে মেয়ে আনতে চাই। আপনারা যা বলবেন আমরা সেটাই মেনে নিব।”

ইভার বাবা মনে মনে খুশি হলো। এই মানুষ গুলোর কাছে তার মেয়ে ভালো থাকবে। সুমনা স্বামীর এমন আচরণে অসন্তুষ্ট হলেন। মাহিমা মীরার কানে কানে বলল,

“মুবিন ভাইয়ের বাপ তো আস্ত একটা খাটাশ! ইভা আপুকে বেচে দিচ্ছে নাকি যে টাকা নিয়ে দরদাম করছে।”

“পড়তে গিয়ে কোনদিন এই লোককে বাড়িতে দেখিনি। আজ কোথায় থেকে এসে টপকালো।”

“মুবিন ভাইয়ের সাথে তোর কিছু-মিছু থাকলেও ভুলে যা মীরা। এমন শ্বশুর স্বপ্নেও কল্পনা করিস না।”

“দূর মুবিন ভাইকে জাস্ট ভালো লাগতো। আমি কি উনাকে কোনদিন বিয়ে করতে চেয়েছি। তুই বরং জায়িন ভাইয়ের আশা ছেড়ে দে। কারণ উনিও তার বাপের মতোই হয়েছে।”

খেতে বসে সুমনা মীরা মাহিমাকেও ওদের সাথে বসে যেতে বলল। মীরার হাত কেটে গেছে। সে একা খেতে পারবে না। মাহিমা মীরাকে ছাড়া বসতে চাইল না। তবুও সুমনার জোড়াজুড়িতে বসতে হলো। আবির জায়িনকে না দেখে বলল,

“জায়িন আসেনি মুবিন?”

“না। ভাইয়া বিয়ের সময় আসবে। এখন এলে বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকতে পারত না।”

“ওহ।”

ইভানের ফোন বাজছে। সে ফোন বের করে দেখল। আবিরও উঁকি দিয়ে দেখেছে। সে ভাইয়ের পেটে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল,

“ওহহো! শবে তো বিয়ে ঠিক হয়েছে। এখন থেকেই? ভালো ভালো।”

ইভান চোখ পাকিয়ে তাকিয়েও হেসে ফেলল। ফোন তুলতে আড়ালে চলে গেল। খেতে খেতে মুবিনের চোখ বারবার ওইদিকে চলে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে তার সাথে কী হচ্ছে। তবুও মনকে আটকাতে পারছে না। হয়তো আটকাতে চায়ও না। মেয়েটার হাসি, কথা বলা, মন খারাপ করা, চঞ্চলতা সব কিছুতেই এত বেশি ভালোলাগা জড়িয়ে আছে কেন?

🌸

ইভান ভাইয়ার বিয়ে আজ থেকে ঠিক বাইশ দিন পর ঠিক হয়েছে। বাইশ দিনে বিয়ের এত আয়োজন কীভাবে হবে সেটাই বাবা চাচারা আলাপ করছে। কিন্তু আলাপ আলোচনা করেও কোন উপায় নেই। ইভা আপুর বাবা মাত্র দু-মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে। যা করার এই অল্প সময়ের মাঝেই করতে হবে। আবির ভাই, ইভান ভাই মেহমানদের এগিয়ে দিতে গেছে। চাচী, ফুপুরা সব ডাইনিং, প্লেট পরিষ্কারে লেগে গেছে। মাহা ঘরে ঘুমোচ্ছে বলে তনি আপুও তার কাছে বসে আছে। প্রিয়া আপু চেঞ্জ করতে গেছে। মীরা, মাহিমা চেঞ্জ না করেই ফোন চাপতে চাপতে চাচা, মামাদের সাথে বসে বিয়ের আলাপ আলোচনা শুনছে। ছোট চাচা বললেন,

“চিন্তা করো না তো ভাইজান। সব হয়ে যাবে। বাড়িতে কি কাজের মানুষের অভাব আছে? আবির একাই সব সামলে নিবে। নিজের বিয়ে বলে যে ইভানও কিছু করবে না এমন তো না। সময়ের আগেই সব হয়ে যাবে।”

মীরার বাবাও বড় ভাইকে ভরসা দিলেন।

“হ্যাঁ ভাইজান। টাকা ছেটালে কোন কাজই আটকে থাকবে না। তাছাড়া ওদেরও তো তেমন কোন চাওয়া নেই।”

মাহিমার উসকানিতে মীরা ভীষণ সাহসী একটা কাজ করলো। তার ভোরের পাখি ফেইক আইডি দিয়ে জায়িনকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। সাথে মেসেজ রিকোয়েস্টও দিল।

‘আপনার প্রোফাইলের ওই ছবিটার উপর আমি দিনে চব্বিশ বার ক্রাশ খাই। প্লিইইজ আমার রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করুন।’

মীরা মেসেজ সেন্ড করেও রিমুভ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মাহিমা তা করতে দেয়নি।

“সমস্যা কী তোর? আমিও তো মেসেজ দিয়েছি। তোর, আমার যার টা-ই রিপ্লাই দেয় আমি কথা বলবো। তোকে তো কথা বলতে বলছি না।”

“কিন্তু ওই গোমড়ামুখো জিরাফের উপর আমি দিনে চব্বিশ বার ক্রাশ খাই এটা কেন লিখতে গেলি?”

“আমিও তো লিখেছি, আপনার ছবি দেখেই এমনভাবে আপনার প্রেমে পিছলেছি যে, পড়ে গিয়ে আমার কোমর ভেঙে গেছে। অনুগ্রহ করে রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করে আমাকে তুলতে সাহায্য করবেন।”

চলবে_