মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
581

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩৪

মীরা প্রচণ্ড বেগে দৌড়াচ্ছে। সে যত জোরেই দৌড়াতে চাচ্ছে ততই যেন পিছিয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে এক জায়গায় থেমে আছে। একটুও এগোতে পারছে না। তার পেছনে কুচকুচে কালো কয়েকটি কুকুর তাড়া করেছে। মীরা কুকুরের হাত থেকে বাঁচতেই জানপ্রাণ দিয়ে ছুটছে। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। পা মাটির সাথে আঠার মতো লেগে আছে। কুকুর গুলো কাছাকাছি চলে এসেছে। মীরা ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু গলা দিয়ে টু শব্দও বের হচ্ছে না। মীরা সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে চাচ্ছে। তাতেও কাজ হচ্ছে না। কুকুর গুলো মীরাকে কাটতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশ কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বাজ পড়ছে। বৃষ্টি শুরু হলে মুহূর্তেই মীরার চারপাশে পানি জমে গেল। মীরার হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। কুকুর গুলো ভিজে চুপচুপে হয়েও তাকে কামড়াতে চাচ্ছে। গলা দিয়ে শব্দ না বের হলেও মীরা চিৎকার করে গলা ভেঙে ফেলেছে। মীরার মনে হচ্ছে আজই তার শেষ দিন। কুকুর গুলো তাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। মীরার এই ভাবনার মাঝেই জায়িন ভাই এসে হাজির হলো। কুকুর তাড়ানোর জন্য জায়িন ভাইয়ের হাতে কফির মগ! জায়িন ভাই হিরোর মতো মীরার সামনে এসে বলল,

“আমি থাকতে তোমার কোন ভয় নেই, জানপাখি!”

বলেই জায়িন ভাই কুকুর গুলো দিকে হাতে থাকা মগটা ছুড়ে মারলো। কুকুর গুলো ভয় পেয়ে ঘেউঘেউ করতে করতে পালিয়ে গেল। মীরা জায়িন ভাইকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বলল,

“তুমি এসেছ কলিজা? আমি জানতাম তুমি আসবে।”

ঠিক তখনই ঠাস করে ওদের উপর বজ্রপাত হলো। মীরা লাফিয়ে উঠে বসলো। এই শীতল আবহাওয়ায়ও ঘামছে বেচারি। আতঙ্কিত চোখে আশেপাশে দেখতে লাগল। নিজের ঘরে আছে বুঝতে পেরে ফোঁস করে দম ফেলল।

“আল্লাহ! মাবুদ, এটা কী দেখেছি আমি? কী দেখালে তুমি আমাকে?”

দরজা জানালা বন্ধ বলেই রুমে বাতাস আসছে না। বৃষ্টি থেমেছে মনে হয়। মীরা কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছলো। কয়টা বাজে এখন? রুম অন্ধকার থাকায় ঘড়িতে সময় দেখতে পারল না। ফোন খুঁজে বের করে সময় দেখল। মাত্র আটটা বাজে। এই সন্ধ্যা রাতে ঘুমিয়ে এরকম একটা স্বপ্ন দেখল!

“আল্লাহ। এখন থেকে আমি দিনের বেলা শোয়ার আগেও আয়াতুল কুরসি, তিনকুল পড়ে বুকে ফু দিয়ে শোব। ঠা’ডা পড়ে মরে গেছি! তাও জায়িন ভাইকে নিয়ে! নাউজুবিল্লাহ, স্বপ্নে উনাকে আমি… উনি আমার হিরো ক্যারেক্টারে ছিল? আস্তাগফিরুল্লাহ।”

সন্ধ্যাবেলা ঘুমিয়ে এরকম একটা স্বপ্ন দেখার জন্য মীরার নিজের গালেই ঠাসঠুস চড় দিতে ইচ্ছে করছে। আসলে সব দোষ জায়িন ভাইয়ের। আজকের ওই ঘটনা ধরেই এই স্বপ্নটা এসেছে।

“জায়িন ভাই আপনি আমার স্বপ্নে এসেও জ্বালাতে শুরু করে দিয়েছেন! ছাতা ছিল না, আপনি আমাকে ভিজেই চলে আসতে দিতেন। বন্ধুর কথা শুনতে গিয়ে কী ঘটালেন দেখেন তো।”

বাইরে থেকে দরজা ধাক্কিয়ে কেউ ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। মীরা বিরক্ত হয়ে তাকাল। এই বাড়িতে কোন প্রাইভেসি নেই? ভালো মতো স্বপ্নের শোকটাও কাটিয়ে উঠতে পারল না। তার আগেই ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। তনি আপুর কি খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই?

“কিরে সাড়াশব্দ দিচ্ছিস না কেন? মরে টরে গেলি নাকি? মীরা! এই খবিশ, দরজা খোল।”

মীরা বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দিলে তনি মীরাকে ঠেলে ভেতরে চলে এলো। পুরো ঘর অন্ধকার দেখে বলল,

“দরজা জানালা লাগিয়ে ঘর অন্ধকার করে ধ্যান করছিলি নাকি? কার আত্মাকে ডাকছিলি?”

“নিজের আত্মাই দেহ ত্যাগ করতে করতে বেঁচেছে, অন্যের আত্মা ডেকে এনে নুন মরিচ দিয়ে আচার দেব?”

“দিলে দিতেও পারিস। তোর সাথে তো কোন ভরসা নেই। হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়। খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা হয়েছে।”

খিচুড়ি, ইলিশ ভাজার কথা শুনেই মীরার জিভে পানি এসে গেল।

….

মুবিন ভাইয়ের উপর মীরা ভীষণ রাগ করেছে। আজকের পর থেকে সে আর মুবিন ভাইকে সাহায্য করবে না। একা একাই এবার মাহিমার মন জয় করুক। দেখুক কত ধানে কত চাল। নানির বাড়ি যাওয়ার আগে তাকে জানিয়ে যেতে পারলো না? তাহলে তো মীরা ঝড়তুফান মাথায় নিয়ে কষ্ট করে এতদূর যায় না। মুবিন ভাইয়ের মেসেজ দেখেও মীরা দেখছে না।

“আপনি গুরুতর একটা অপরাধের কাজ করেছেন মুবিন ভাই। জিরাফ ভাইটাকে বাড়িতে রেখে নিজে চলে গেছেন। উনাকেও কেন সাথে নিয়ে গেলেন না!”

অনেকগুলো মেসেজ জমা হলেও মীরা সিন করছে না। সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে এখন ঘুমও আসছে না। সময় কাটাতে মীরা ইভার কাছে চলে গেল। প্রতিদিন রাতেই ওরা লুডু খেলে। মীরা ইভান ভাইয়ের ঘরের সামনে এসেও ভাবল, এখন এগারোটা বাজে। এসময় কাউকে বিরক্ত করা কি ঠিক? মীরা আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল। মুবিন ভাই কি কানা? দেখতে পারছে না কয়টা বাজে এখন। এসময় মেসেজ দিচ্ছে। মীরা রিপ্লাই করল,

“মুবিন ভাই প্রথমত আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। দ্বিতীয়ত, কয়টা বাজে দেখেছেন?”

“সরি মীরা। এত রাতে মেসেজ দেওয়ার জন্য দুঃখিত। কিন্তু তুমি আমার সাথে কথা বলবে না কেন?”

“কারণ কাজটাই আপনি এমন করেছেন। আপনার জন্য আমার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন আসছে। ঘুমোতে যেতে ভয় করছে।”

“মানে! আমি কী করেছি মীরা?”

“আপনিই তো সব করেছেন।”

“আমি সব করেছি মানে কী? খুলে বলবে একটু?”

মীরা কিছুই মুবিন ভাইকে খুলে বলতে পারল না। পায়ে গরম চা পড়েছিল। সে জায়গা এখন ফোস্কা পড়ে গেছে। পায়ের ছোট আঙুলটা সোফায় ঠুসা খেয়েছিল। সেটাও ব্যথা করছে। মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সর্দি লেগেছে। টিস্যু হাতে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। হাঁচি শুরু হলে একসাথে দশ বারোটা। ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা নতুন করে না-ই বললো। এসব কার জন্য হয়েছে? মুবিন ভাই বাড়িতে নেই এই কথাটা তাকে জানালে এসব কিছুই হতো না।

“আমি ঠিক করেছি, আমি আর আপনাকে সাহায্য করব না। এতদিনে যতটুকু করেছি ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে সেটাও ফিরিয়ে নিতাম।”

জায়িন তার মা’র সাথে ফোনে কথা বলছে। সুমনা ছেলেকে একা বাড়ি রেখে গিয়ে থাকতে চাচ্ছিল না। তবুও চাচা চাচীর জোড়াজুড়িতে থাকতে হলো। সুমনারা দুই বোন। কোন ভাই নেই। বাবা মা-ও বেঁচে নেই। এখন বাপের বাড়ি বলতে এক চাচা আছে তাকে দেখতেই মাঝে মাঝে আসে। চাচা তাদের নিজের মেয়ের থেকে কম দেখে না। আজ অনেকদিন পর দুই বোন এলে যেতে দিলো না।

“রাতে খেয়েছিস কিছু?”

জায়িন যদি এখন মা’কে বলে সে রাতে খায়নি তাহলেই মা’র প্রেসার বেড়ে যাবে। মিথ্যা না বলে সে কোনরকমে কথা কাটিয়ে নিতে চাইল,

“আজ বিকেল থেকে প্রচুর ঝড়তুফান হয়েছে। রাস্তাঘাটে পানি জমে গেছে। রাতে না ফিরে ভালোই করেছ।”

“সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু তুই আমার কথা কাটাচ্ছিয় কেন? খাসনি কিছু?”

“দুই মগ কফি খাওয়ার পর আর খিদে হয়নি।”

“তুই খিদে হয়নি বললেই আমি বিশ্বাস করে নিব! সকালে রান্না করে ফ্রিজে রেখে এসেছি। এক্ষুনি ফ্রিজ থেকে ভাত তরকারি বের করে গরম করে খাবি। ওসব খেতে না পারলে আমি লাইনে থাকতে থাকতেই তুই রান্না করে খাবি।”

“মা এক রাত না খেলে কিছু হবে না। তুমি তো কাল চলেই আসবে।”

“কিছু হবে না কিছু হবে না বলেই তো শরীরের এই হাল করেছিস। নিজে রান্না করতে পারলি না। বাইরে থেকে কিছু আনিয়ে খেয়ে নিতি।”

“ওদিকে আবহাওয়া ভালো দেখে বুঝতে পারছ না এদিকে কী পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে গেছে। খাবারের অর্ডার দিলেও মনে হয় না ডেলিভারি ম্যান আজ খাবার পৌঁছে দিয়ে যেতে পারতো।”

“আজ মীরা এসেছিল?”

মা হুট করে সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রসঙ্গে চলে গেল। জায়িন সন্ধ্যা থেকে মীরাকে নিয়েই ভেবে কাটিয়েছে। এই মেয়ের ভাবনা তার মস্তিষ্কে জোঁকের মতো এঁটে বসেছে। আজকাল অনুভূতি গুলো বড্ড অবাধ্য হচ্ছে। মন লাগামছাড়া হতে চাচ্ছে। এখন আর অনেকদিন পর এক পলকের একটু দেখায় মন ভরছে না। এখন পুরোটা সময় মীরাকে দেখতে ইচ্ছে করে। যখন তখন নানান আজুহাতে ওর কপালে পড়া অবাধ্য চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মীরার সাথে মনের সব অব্যক্ত কথা বলে ফেলতে ইচ্ছে করে। তার এত এত অনুচিত ইচ্ছে, এদিকে জায়িন জানেই না মীরা তার জন্য কী ফিল করে। মীরার মনেও তাকে নিয়ে আদোও কোন অনুভূতি আছে কি-না। জায়িন কল কেটে অলস ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়লো। এইতো আরও চার/পাঁচ ঘন্টা আগে মীরা ঠিক এই জায়গাটায় বসে ছিল।
জায়িন মীরার পায়ে মলম লাগিয়ে দেওয়ার পর দু’জনেরই আর কোন কাজ ছিল না। গুমোট বাঁধা অদৃশ্য এক অস্বস্তিতে নিজেরাও কথা বলতে পারছিল না। ওদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই। আবির ভাই তাকে কখন নিতে আসবে? মীরা নখ কামড়াতে কামড়াতে সোফায় বসে আবিরের আসার অপেক্ষা করে করে এক একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
জায়িন কিছুটা দূরে বসে মীরাকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে ঘুমাতে দেখছিল। সেই ঘুমন্ত মুখটার মায়া জায়িন এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কত স্নিগ্ধ! কত পবিত্র সেই মুখখানা। বাজ পড়ার শব্দ হলে ঘুমের মধ্যেই মীরা ভয় পাচ্ছিল। জায়িন লক্ষ করেছে মীরা যতবার বজ্রপাতের শব্দে ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়েছে ততবারই ওর ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কেঁপেছে। জায়িন নিজের মনের সাথেই লড়াই করে পেরে উঠছে না। অনিশ্চয়তা, সংকোচ, দ্বিধা তাকে মীরার কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতেও দিচ্ছে না।

“অজান্তে তোমাকে আমি চেয়েছি। যখন বুঝেছি, তখন আর ফিরে আসার উপায় ছিল না। দেখলাম, ততদিনে সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি তোমার মায়ার পুরোপুরি আটকা পড়েছি।”

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩৫

মাহিমা কলেজে যাওয়ার আগে মীরাকে নিতে এসেছে। গতরাতের ঝড়তুফানের পর আজ সকাল সকাল উঠে কলেজে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। এই লেখাপড়া জীবনের অর্ধেক শান্তি, আরাম, ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আজকে আবার দজ্জাল ম্যাম ক্লাস টেস্ট নিবে। না গেলে কালকে সবার সামনে অপমান করবে। মহিমা এখানে এসে দেখে মীরা জ্বর বাঁধিয়ে কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে। মাহিমা মীরার পাশে ধপ করে বসে পড়ে ঠোঁট উলটে বলল,

“ইচ্ছে করে জ্বর বাঁধিয়েছিস না? আমি জানি। ক্লাস টেস্ট দেওয়ার ভয়ে তোর এই জ্বর।”

মীরা কম্বল গলা পর্যন্ত টেনে বসে যাওয়া গলায় চিউচিউ করে বলল,

“তুমি গা গরম হওয়ার আগেই ও বাবা গো, ও মা গো বলে নাটক করো দেখে সবাই কি তোমার মতো নাটক করে মনে হয়? হারামি, হাঁচি দিতে দিতে আমি মরে যাচ্ছি।”

মাহিমা অবহেলাভরে মীরার কপালে হাত রেখে বলল,

“বিলাইয়ের জ্বর। তেমন কিছু না। উঠে রেডি হ। আমি একা কলেজে যেতে পারব না।”

“না গেলে না যাবি। আমার জ্বর এক সপ্তাহ থাকবে। ঔষধ তো দূর, ডাক্তার গুলিয়ে খাওয়ালেও সারবে না।”

ডাক্তারের কথা উঠতে মনে পড়লো, জায়িন ভাইকে নিয়ে ভোর রাতেও একটা স্বপ্ন দেখেছে। এই লোক এক রাতে দুইবার তার স্বপ্নে হানা দিয়েছে। মীরা কারো কাছে শুনেছিল। সঠিক জানে না তাই মাহিমার কাছে জিজ্ঞেস করে শিওর হতে চাইল।

“ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় এই কথাটা কতটুকু সত্য রে মাহি?”

“কেন? তুই আবার ভোরে কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিস? মুবিন ভাইকে নিয়ে?”

“মুবিন ভাইকে নিয়ে তুই স্বপ্ন দেখ। আমি কেন অন্য বেডির বয়..

রেগে গিয়ে কথাটা বলতে গিয়েও মীরা বলল না। দুনিয়ায় যদি গাধার থেকেও নির্বোধ, বোকা কোন প্রাণী থাকে সেটা এই মাহি। এতদিনেও বুঝতে পারছে না মুবিন ভাই কাকে পছন্দ করে। মীরা ইশারা ইঙ্গিতে কতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। এই হাদার বাচ্চা মুবিন ভাইকে দুলাভাই বানাতে জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে।

গতরাতের ঝড়বৃষ্টির পর আজ কলেজে খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়েরাই এসেছে। যারা এসেছে সেসব ব্রিলিয়ান্টদের মধ্যে মাহিমাও একজন। ছুটির পর একা বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। ভালো লাগছে না। মীরা সাথে থাকলে বকবক করতে করতে পথ ফুরিয়ে যায়। মাহিমা কিছুদূর এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুবিন মাহিমাকে দেখে এগিয়ে আসছে। গতরাতে মীরার মেসেজ পড়ে পুরো রাত বেচারা দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। টেনশনে অস্থির হয়ে রাতটা কোনরকমে পার করে সকালেই রওনা দিয়েছে। মীরা কেন তাকে সাহায্য করবে না? সাহায্য ফিরিয়ে নিবে মানে কি? মীরা কি মাহিমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে! এই মেয়ের সাথে বিশ্বাস নেই। মাহিমা মুবিনকে আসতে দেখে বিড়বিড় করে বলল,

” আপনার পাখি তো আজ আসেনি মুবিন ভাই। আপনাকে আজ নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে।”

মুবিন মাহিমার কাছাকাছি চলে এলে মাহিমা ঠোঁটে হাসি টানলো। মাহিমাকে হাসতে দেখে মুবিন স্বস্তি পেলো। যাক মীরা উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি।

“মুবিন ভাই, কেমন আছেন?”

“ভালো।” মাহিমাকে পাল্টা, ‘তুমি কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করতে মুবিনের লজ্জা লাগল। তাই বলল, তোমাদের খবর কী?”

“আমার খবর ফার্স্ট ক্লাস। কিন্তু আপনার ছাত্রী জ্বরে পড়েছে।”

“ওহ।”

মাহিমা মুবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলো না। মীরার জ্বর শুনেও মুবিন ভাইয়ের চেহারায় তেমন কোন উদ্বেগ বা অস্থিরতা প্রকাশ পেলো না। পছন্দের মানুষের গা গরম হলে নিজে প্যারাসিটামল খাওয়া পাবলিক মনে হয় মুবিন ভাই না।

“কাল আপনার কাছে পড়তে গিয়েই বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছে।”

“আমি তো কাল বাড়িতে ছিলাম না।”

“আপনি বাড়ি নেই এই কথা মীরা জানতো না?”

“মনে হয় না। ওকে বলার সুযোগ হয়নি।”

মাহিমার সন্দেহ এবার গাঢ় হচ্ছে। মুবিন ব্যাটা কি সত্যি সত্যি মীরাকে পছন্দ করে? পছন্দ না করলে শুধু শুধু টাইম পাস করার ছেলে তো মুবিন ভাই না। মাহিমা কিছু বলছে না। কিন্তু মুবিন কথা চালিয়ে নিতে চাচ্ছে। কী বললে আলাপ দীর্ঘ করা যায় ভাবছে মুবিন।

“তোমাদের পরীক্ষা কবে হবে?”

“শুনেছিলাম দুই মাস পর।”

“কেমন প্রিপ্রারেশন নিচ্ছ?”

মাহিমা তীক্ষ্ণ চোখে মুবিনকে দেখছে। তার এখন মনে হচ্ছে মুবিন ভাই মীরাকে পছন্দ করে না। করলেও প্রেম ভালোবাসা টাইপ না। কারণ উনি আসার পর থেকে মীরার সম্পর্কে কোন কথাই জিজ্ঞেস করেনি। মীরার জ্বর শুনেও ওর জন্য টেনশন না দেখি পরীক্ষা নিয়ে আজাইরা পেঁচাল পারছে। ওরা কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছিল। মুবিন রাস্তার পাশে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। মাহিমা রাস্তায়। এই রোডে খুব বেশি গাড়ি বাস চলাচল করে না। তবে পেছন থেকে হঠাৎ করে মোটরবাইক এলে মুবিন মাহিমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওকে রাস্তা থেকে নামিয়ে নিয়েছিল। বাইকটা একটুর জন্য মাহিমার গা ঘেঁষে যাচ্ছিল। মুবিন ঠিক সময়ে মাহিমাকে টেনে না নিলে হয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যেত। মুবিন উত্তেজিত গলায় মাহিমাকে জিজ্ঞেস করছে,

“কোথাও লাগেনি তো? ব্যথা পেয়েছ?”

এতক্ষণে বাইকটা অনেকদূর চলে গেছে। মুবিন ওদিকে তাকিয়ে চাপা ক্রোধে বলল,

“আজকাল ছেলেগুলো বাইক নিয়ে রাস্তায় নামলে ভুলে যায় ওরা পাবলিক প্লেসে বাইল চালাচ্ছে। তোমার কোথাও লেগেছে? তুমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটো।”

মাহিমা হতবাক হয়ে মুবিনকে দেখছে। মানুষটার চোখে তার জন্য স্পষ্ট উদ্বেগ, চিন্তা, কেয়ার দেখতে পারছে। মুবিন ভাই মীরার জন্য তার সাথে এত ভালো আচরণ করছে না। মাহিমা এবার বুঝতে পারছে। তবে এটা বুঝতে পেরেই সে লজ্জা, অপরাধবোধে কুঁকড়ে গেল। মুবিন ভাই মীরাকে না তাকে পছন্দ করে। এটা জানলে মীরা কতটা কষ্ট পাবে ভেবেই মাহিমার বুক কেঁপে উঠল। মাহিমা জীবনে কোনদিন এমন কোনো কাজ করতে পারবে না যাতে মীরা সামান্যতম কষ্ট পায়। তাই সে মুবিনকে এড়ানোর জন্য জোরে পা চালালো। হঠাৎ কী হলো মুবিন বুঝতে পারল না। কথা বলতে বলতে মাহিমা এমন স্বাভাবিক ভাবে ছুটছে কেন? সে কি ভুল কিছু করে ফেলেছে? মাহিমা পেছন ফিরে মুবিনকে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না।

“আপনি কাজটা ঠিক করেননি মুবিন ভাই। মীরা আপনাকে পছন্দ করে। আপনি কেন আমাকে পছন্দ করতে গেলেন?”

মাহিমার হঠাৎ এরকম চলে যাওয়ার মুবিন কিছুই বুঝতে পারছে না। এ নিয়ে বেচারা সারাটা দিন মনমরা হয়ে থেকেছে। ভালোবাসা জিনিসটা তো কঠিন কেন? তার বন্ধুরা একসাথে দুই তিনটা গার্লফ্রেন্ড চালাতে পারতো। সে একটাও বানাতে পারছে না। ভালোবাসা শুধু কি তার জন্যই কঠিন? আগে জানলে ভালোবাসা নামক এই ফাঁদে জীবনেও পা দিতো না। কিন্তু এখন তো দিয়ে ফেলেছে। ফিরে আসার কি কোন পথ আছে? হয়তো আছে। কিন্তু মুবিন ফিরে আসতে চায় না। এই অনুভূতিটা ভীষণ সুন্দর।
বিকেলে মুবিন মায়ের সাথে বসে টিভি দেখছে। টিভি দেখছেও বলা যায় না। মা সিরিয়াল দেখছে। সে শুধু শুধু বসে আছে। মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করলেও মা’র মনোযোগ এখন ইন্ডিয়ান সিরিয়াল থেকে সরছে না।
জায়িন ঘুম থেকে উঠে এলোমেলো চুলে মা ভাইয়ের কাছে এসে বসলো। মুবিন ভাইকে দেখলো। ট্রাউজারের এক পা উপরে উঠে আছে। চোখে মুখে এখনও ঘুম জড়ানো। ফোলা ফোলা চেহারায় ভাইয়াকে সুন্দর লাগছে। মুবিন ভাবল, তার ভাইটাই ভালো। যখন খুশি তখন ঘুমানো এক বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে। বাড়িতে এলে সারাদিনই ঘুমায়। মুবিন বুঝে না, দিনের বেলা এত ঘুমানোর পর ভাইয়া রাতের বেলা কী করে? আর ঘুম থেকে উঠেও ভাইয়ার মেজাজ এত ভালো থাকে কীভাবে? মুবিন দিনের বেলা ঘুমালে তার সাথে যে সমস্যা গুলো হয়। তার মধ্যে এক নম্বর, ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারে না দিন না রাত। বিকেলে উঠলেও মনে হয় রাত হয়ে গেছে। বা একটা রাত পুরো ঘুমিয়ে সকালে উঠেছে। দুই নম্বর সমস্যা, মেজাজ খিটমিটে হয়ে থাকে৷ কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেউ কথা বললেও কলিজা কাঁপানো ধমক দিতে ইচ্ছে করে। তাই মুবিন দিনের বেলা ঘুমানোই বাদ দিয়েছে।

“কী দেখছিস?”

জায়িনের কথায় মুবিন লজ্জা পেলো। সে এতক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল বুঝতে পেরে দু’পাশে মাথা নাড়ল। জায়িন একনজর মা’র দিকে তাকিয়ে নিজেই উঠে কিচেনের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরই দুইটা মগ হাতে নিয়ে ফিরল। ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসে বাঁ হাতে ধরা মগটা মুবিনের দিকে এগিয়ে দিল। মুবিন মগটা নিলে জায়িন আরাম করে নিজের মগে ঠোঁট ছোঁয়াল।

“মা কফি খাবে?”

“না। তুই খাবি? করে দিব?”

জায়িন হাসলো। বলল,

“না থাক। তোমার ডিস্টার্ব হবে।”

মুবিন ভাইয়ের দিকে ফিরে গলা নিচু করে বলল,

“দেখলে ভাইয়া, মা পুরোপুরি সিরিয়ালে আসক্ত হয়ে গেছে।”

“বাবা ফিরলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

“বাবা কবে ফিরবে জানো?”

“বলেছিল তো এই সপ্তাহে আসবে।”

“হিসেব করলে দেখা যাবে, বারো মাস থেকে বাবা কিন্তু আমাদের সাথে তিন মাসও ভালো ভাবে থাকে না।”

“তুই চাস বাবা বারো মাসই বাড়িতে থাকুক?”

প্রশ্নটা করে জায়িন কফিতে চুমুক দিয়েছে। মুবিন এই প্রশ্নটার উত্তর দিলে মিথ্যা বলতে হবে। সত্যটা ভাইয়ার কাছে বলা যাবে না। বাড়িতে সে আর মা একা একা থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন বাবা বাড়ি এলে তার স্বাধীনতা বিগ্ন হয়। মনে মনে চায়, বাবা কবে যাবে। ভাইয়া বাড়ি এলে ভালো লাগে। কারণ ভাইয়া তো তাকে বাবার মতো শাসন করে না। জায়িন ভাইকে চুপ থাকতে দেখে মুচকি হাসলো।
মুবিন রুমে গিয়ে বাইকের চাবি নিয়ে এলো। বেরুবার আগে মা’কে বলল,

“আম্মু আমি একটু বেরুচ্ছি।”

সুমনা ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“এখন কোথায় যাচ্ছিস? মীরা পড়তে আসবে না?”

“আজ মনে হয় আসবে না। মীরার জ্বর।”

“সে কি! জ্বর কীভাবে বাঁধাল? এই সিজনের জ্বর তো ভালো না। ইভাকে কল করে জান তো অনেক জ্বর নাকি।”

মীরার জ্বর এসেছে শুনে জায়িন পিঠ সোজা করে বলল। নিশ্চয় বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পড়ায় এই জ্বর এসেছে। মীরা এসময় পড়তে আসে ভেবেই জায়িন ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল। যাতে মীরার সাথে দেখা হয়। গতরাতের পর মীরাকে দেখার যে তীব্র ইচ্ছাটা দমন করে রেখেছিল তা এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মেয়েটা তাকে এত জ্বালায় কেন?

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩৬

মীরা মাহিমাকে বলে দিয়েছিল কলেজ থেকে যেন এখানে ফিরে। গাধীটা এখানে না এসে বাড়ি চলে গেছে। মীরা জ্বর নিয়ে কষ্ট করে কতবার কল করছে। কইতরি কলও তুলছে না। এই মেয়ের সাথে সে এক সপ্তাহ কথা বলবে না।
মীরাকে দেখার জন্য আবির ওবাড়ি যাচ্ছে। বেরুবার আগে সে বোনের ঘরে এলো। মাহিমা চিত হয়ে শুয়ে দু’হাতে ফোন ধরে উপরের দিকে তুলে রেখেছে।

“ফোন আকাশে তুলে সিগনাল খুঁজছিস নাকি?”

ভাইয়ের কথা শুনে মাহিমা উঠে বসলো। আজ তার মন ভালো নেই। মুবিন ভাইয়ের ব্যাপারটা জানার পর থেকেই মীরার কল তুলছে না। মীরা জেনে গেলে কষ্ট পাবে।

“মামার বাড়ি যাচ্ছি। গেলে এক মিনিটে রেডি হয়ে আয়। এক মিনিটের বেশি এক সেকেন্ডও দাঁড়াব না।”

মাহিমার যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বলল,

“আমি যাব না। তুমি চলে যাও।”

বোনের কথা শুনে আবির চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। এগিয়ে এসে মাহিমার কপালে হাত রেখে বলল,

“দেখি তোরও জ্বর এসেছে নাকি। নিশ্চয় জ্বরের ঘোরে যাবি না বলছিস। নইলে সুস্থ থাকলে তুই তোর দ্বিতীয় আস্তানায় যেতে না করতি!”

মাহিমা কপাল থেকে ভাইয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ ভোঁতা করে বসে রইল। আবির ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“সত্যিই যাবি না?”

“না।”

“আজ রাতে গ্রিল নানের আড্ডা হবে। তবুও যাবি না!”

মাহিমা নাকি কেঁদে বলল,

“ভাইয়া তুমি আমাকে লোভ দেখাচ্ছ!”

“না। সত্যিটা বলছি। মীরার জ্বর কিছু খেতে পারছে না। তাই ইভান ভাইয়ের কাছে গ্রিল খাওয়ার আবদার করেছে। তুই তো জানিস ইভান ভাই দয়ার সাগর। আমাদের রেখে সে কি মীরাকে একা খাওয়াবে? কী আর করার? তুই যেতে না চাইলে আমি তো আর জোর করতে পারব না। বাড়িতে থাক। মা পুঁটি মাছের তরকারি রান্না করেছে ওটাই মজা করে খাস।”

আবির দরজা পর্যন্ত চলে গেলে মাহিমা লাফিয়ে বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। চেঁচিয়ে বলল,

“তুমি এক সেকেন্ড দাঁড়াও ভাইয়া। আমি শুধু চুলটা বাঁধব।”

“কেন, তুই তো যাবি না।”

“না না যাব। কে বলেছে যাব না? আমি তো রেডি। সন্ধ্যা থেকে বসে ছিলাম তুমি এসে কখন যাওয়ার কথা বলবে।”

….

মাহিমা এলেও মীরা মাহিমার সাথে কথা বলছে না। মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসে আছে। মাহিমা এটা ভেবে ভয় পাচ্ছে মীরা কি কোন ভাবে মুবিন ভাইয়ের কথা জেনে গেছে? নইলে তার সাথে রাগ করে আছে কেন?

“মীরা। মীরা আমার কোন দোষ নেই বিশ্বাস কর। আমি কিছুই জান…

মীরা মাহিমার দিকে ফিরে নাক ফুলিয়ে বলল,

” সব দোষ তোর। এহহ, কঁচি খুকী। তার নাকি কোন দোষ নেই।”

“আমার দোষ কীভাবে তুই বল। আমি কি বলেছিলাম মুব…

মীরা ঠাস করে মাহিমার পিঠে কিল মেরে বলল,

” বলেছিলাম কলেজ থেকে এখানে চলে আসিস। বলেছিলাম কি-না বল?”

“হ্যাঁ বলেছিলি।”

“তাহলে আসিসনি কেন? ফোনও তুলিসনি।”

মাহিমা অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

“তুই এজন্য রেগে আছিস?”

“না। তোর কাছে এটা রাগার কারণ না হলেও, আমি একারণেই রেগে আছি।”

মাহিমা খুশি হয়ে মীরাকে জড়িয়ে ধরলো। গদগদ গলায় বলল,

“ওলে আমাল মীরাবাঈরে! রেগে আছো আমার উপর? কী করলে তোমার রাগ কমবে শুনি?”

ইভান এখনও বাড়ি ফিরেনি। আবিরও মাহিমাকে দিয়ে বেরিয়েছে। মীরা হলরুমে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে নাক বন্ধ হয়ে আছে। শ্বাস টানতে পারছে না। তাই ছোট চাচী আদা চা করে দিয়েছে। মাহিমা মাহাকে কোলে নিয়ে খেলছে। রুশমি হল জুড়ে ছোটাছুটি করছে। মীরা চায়ের কাপের কাছে নাক নিয়ে বড়ো করে দম টেনে বলল,

“না। কোন গন্ধই পাচ্ছি না। এই নাক সবসময় আমার সাথে বেইমানি করে।”

“নাক কেটে ফেলে দে।”

“নাক ছাড়া আমাকে কেমন লাগবে ভাব একবার।”

মাহিমা হেসে ফেলে বলল,

“ভালোই লাগবে।”

“তাহলে আয় তোর নাকটাও কেটে দিই।”

“আমার নাক তোর নাকের মতো দুই নাম্বার না।”

“এহহ আসছে আমার এক নাম্বার। সর চোখের সামনে থেকে।”

মাহিমা ইভাকে ডেকে বলল,

“ও ভাবী, কল করে দেখো না তোমার বরটা কোথায় রয়ে গেল। ভাইয়া এমন লোভ দেখিয়েছে, না খেয়ে এসেছি আমি। এখন পেটের ভেতর এক হাতি খেয়ে ফেলার মতো খিদে পেয়েছে।”

মাহিমার কথা শেষ হওয়ার আগেই কলিংবেল বাজলো। মাহিমা লাফিয়ে উঠে বলল,

“ইভান ভাই এসেছে।”

মাহা কোলে থাকায় মাহিমা সাথে সাথে উঠতে পারলো না। কিন্তু মীরা চায়ের কাপ নিয়েই দরজা খুলতে ছুটলো। ছোটার কারণে তার পরনের শাল বেহুলার শাড়ির আঁচলের মতো মাটিতে গড়াচ্ছে। মীরা দরজা খুলেই সামনে যে মানুষটাকে দেখলো তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। আবির ভাইয়ার সাথে জায়িন ভাইও দাঁড়িয়ে আছে। নাক দিয়ে দম নিতে না পাড়ায় মুখ হাঁ করে দিম নিলো। যে লোকের জন্য মীরার এই অবস্থা তাকে সামনে দেখে হাতের ধরা চা-টা গায়ের উপর ঢেলে দিতে ইচ্ছে করছে। ব্যাটা তোর জন্য আমার জ্বর এসে নাক বন্ধ হয়ে আছে। এবার তুই মজা বোঝ।

“কিরে হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে আমাদের ভেতরে যেতে দে। খাম্বার মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস। সর।”

মীরা আবিরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে সরে দাঁড়াল।

“আয় জায়িন।”

ওরা ভেতরে চলে গেলে মীরা মনে মনে বলল,

“বন্ধুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাও না। আমাদের মাথার উপর কেন নিয়ে এসেছ? অসহ্য।”

মীরা দরজা লাগিয়ে এগিয়ে এলো। আবির মীরাকে দেখে বলল,

“ও বেহুলা, আপনার শাড়ি মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।”

মীরা আবিরকে কিছু না বলে শাল ঠিক করে নিলো। জায়িন আসার পর থেকে মীরাকেই লক্ষ করছে। মীরা যে তাকে দেখে অখুশি তা ছোট্ট মাহাও বুঝতে পারবে।
ইভা জায়িনকে এখানে দেখে বিশ্বাসই করতে পারল না। এই ছেলেকে জোর করেও কোথাও নেওয়া যায় না। অথচ আজ সে না বলাতেও চলে এসেছে! জায়িন যখন বোনকে জানাল,

“তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই চলে এসেছি।”

এই কথা শুনে তো ইভা খুশিতে আত্মহারা। জায়িনটা তাকে কতো ভালোবাসে!

“মুবিনকেও নিয়ে আসতি।”

মুবিনের নামটা শুনেই মাহিমা চুপসে গেল। আজ সে জায়িন ভাইকে দেখেও খুশি হতে পারছে না। জায়িন ভাইকে নিয়ে মজা করে এতদিন কতকিছু বলেছে। ক্রাশ খেয়েছে। বয়ফ্রেন্ড বানানোর কথা বলেছে। এখন জানতে পারছে জায়িন ভাই তো না। তার ছোট ভাই তাকে পছন্দ করে! এটা কিছু হয়?

“তোর আবার কী হয়েছে? মুখ দেখে মনে হচ্ছে পেট খারাপের রোগী।”

মাহিমা উদাস নয়নে মীরার দিকে তাকালো। ইয়ারফোনের তারের মতো সবকিছু কেমন প্যাঁচ লেগে গেছে। ভেবেছিল, জায়িন ভাইয়ের সাথে সে। মুবিন ভাইয়ের সাথে মীরা। এখন মুবিন ভাই তাকে পছন্দ করে। মীরা আবার মুবিন ভাইকে পছন্দ করে। সে-ও আবার জায়িন ভাইকে একটু একটু পছন্দ করে। জায়িন ভাই কাকে পছন্দ করে এটা এখন প্রশ্ন। সবকিছু পুরাই হযবরল।

~~~

জায়িন যাওয়ার জন্য আসেনি। সে মূলত মীরাকে দেখতে ও মীরার সাথে কিছুটা সময় কাটাতেই এসেছে। তাই সে মুখে চলে যাব, চলে যাব বললেও মনে মনে জানতো ইভা আপু তাকে কিছুতেই যেতে দিবে না। জায়িন সকলের সামনে এমন দেখাল যে, সে ইভা আপুর জোড়াজুড়িতে থেকে গেছে।
জায়িনের উপস্থিতিতে মীরা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। প্রতিদিন রাতে জায়িন ভাইকে নিয়ে সে যে স্বপ্ন গুলো দেখে, সেই স্বপ্নের কথা জায়িন ভাই জানতে পারলে মীরার মুখ লুকানোর জায়গা থাকবে না। কত দোয়া, দুরুদ পড়ে শোয় তবুও ওসব স্বপ্ন দেখবেই। মীরা চোরা চোখে জায়িনকে দেখছে। জায়িনও হুট করে এদিকে তাকালে ওদের চোখাচোখি হয়ে গেল। মীরা ঝট করে উল্টো ফিরে বসলো। জায়িন মুচকি হাসলো। মীরা চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলছে,

“আমার স্বপ্নে বাসা বেঁধেও কি আপনার শান্তি হয়নি? আমাদের বাড়িতে কেন এসেছেন? আপনাকে সামনে দেখলে আমার সবকিছু কেমন উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। এরকম কেন হচ্ছে আমি জানি না। তবে আপনি আশেপাশে থাকলে কিছু একটা তো হচ্ছে।”

রাতের আড্ডায় জায়িনও ছিল। পুরোটা সময় সে মীরাকেই দেখেছে। কখনও আড়চোখে, কখনও সরাসরি। তবে মীরা ভুলেও জায়িনের দিকে তাকায়নি।
মাহিমার মনটাও আজ আড্ডায় লাগছে না। সে বারবার মুবিনের কথাই ভাবছে। প্রথম দিন থেকে মুবিন ভাই তাকে পছন্দ করতো। কিন্তু সে বিশ্ব গাধী, মীরাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মুবিন ভাই সম্পর্কে ওর মনে অনুভূতি জাগিয়েছে। তনি মীরা মাহিমাকে ঠেলা দিলে বলল,

“হলো কি আজ তোদের? কেউ মরেছে? শোক পালন করছিস কেন?”

মীরা নাক টেনে বলল,

“এক বক্স টিস্যু শেষ করে ফেলেছি। এখনও নাক পিটপিট করছে। মনে হচ্ছে একটু নুলেই কিছু একটা বেরিয়ে আসবে। বারবার নাক মুছায় জ্বলছে জানো। আমি রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি। মনে হচ্ছে বজ্জাত জ্বর আবার আসছে।”

তনি মীরার কপালে হাত দিয়ে দেখল কপাল এখনও যথেষ্ট গরম। নাকের ডগাটাও লাল হয়ে গেছে।

“আচ্ছা। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।”

মীরা জায়িনের সামনে থেকে চলে যাওয়ার অজুহাতই খুঁজছিল এতক্ষণ। এখন যেতে পেরে স্বস্তি পেলো। মীরার সাথে মাহিমাও চলে যাচ্ছে। আবির ওদেরকে চলে যেতে দেখে বলল,

“কোথায় যাচ্ছে ওরা? যাচ্ছিস কেন তোরা? মীরাবাঈ, কইতরি কই যাস?”

তনি আবিরের পাশে বসতে বসতে বলল,

“যেতে দাও। মীরার জ্বর আসছে। মীরাকে ছাড়া মাহিমাও থাকবে না।”

“হতচ্ছাড়া জ্বর যাচ্ছে না কেন এখনও? বাচ্চাটাকে কষ্ট দিচ্ছে।”

“দোষ তো ওরই। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়লেই জ্বর আসে জেনেও বৃষ্টিতে ভিজে কেন?”

জায়িন পাশ থেকে ওদের কথা শুনে ভাবল, বৃষ্টি তোমার যতটা প্রিয়, মায়াবতী। তোমার কপালের উষ্ণতা আমার ততটাই অপ্রিয়। তাই আজকের পর থেকে তোমার জন্য বৃষ্টি বিলাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।

চলবে…