#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫৬
মীরার মনে প্রথম প্রেমের রঙ লেগেছে। প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি লিখতে বসলে গোটা একটা ডায়েরি শেষ হয়ে যাবে তবুও তার লেখা শেষ হবে না। প্রথম প্রথম জায়িনের সাথে কথা বলতে গেলে বেচারি ফোনের এপাশে লজ্জায় লাল নীল হতো। আচ্ছা তার এই লজ্জা কি জায়িন ভাই বুঝতে পারতো? হয়তো পারতো। কিন্তু মীরার মন বলে এই লোক না বলে দিলে কিছুই বুঝে না। অবুঝ কচি খোকার সাথে প্রেম করছে সে। শুরুর দিকে কেমন আছেন, কী করছেন জিজ্ঞেস করে ফেলার পর মীরা আর কথা খুঁজে পেতো না। এর থেকে বেশি আর কী বলা যায়? সে চুপ থাকত এই ভেবে যে, জায়িন ভাই হয়তো কিছু বলবে। কিন্তু এই লোক চিনির রসে ডুবানো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে তো দূর, তাকে পড়াশোনা বিষয়ক জ্ঞান দিতে থাকে। মীরা মনে মনে ভাবে,
“পড়াশোনা নিয়ে জ্ঞান চাইলে আমি তো আপনার ভাইয়ের সাথেই প্রেম করতে পারতাম। আমার প্রাইভেট খরচ দিয়ে উনার কাছে পড়তে হতো না। আপনিও যদি পড়াশোনা নিয়েই জ্ঞান দিবেন তাহলে শুধু শুধু আপনার সাথে প্রেম করতে গেলাম কেন? আমার তো কোন লাভ হলো না।”
জায়িনের একটা কাজ মীরার ভীষণ ভালো লাগে। মীরাকে দেখা করার কথা বলতে হয় না। জায়িন নিজেই অপ্রত্যাশিত ভাবে এখানে সেখানে উপস্থিত হয়ে মীরাকে চমকে দেয়। মানুষটার চরিত্রের এই একটা দিকই মীরার পছন্দ। তাছাড়া আর কোনকিছুই ঠিক নেই উনার। প্রেম কীভাবে করতে হয় এটাই এখনও বুঝে না। এই আন রোমান্টিক মানুষটার সাথে প্রেম করে মীরার ডিপ্রেশন কি কম ছিল? তার ডিপ্রেশনে কয়েক গুন বাড়িয়ে দিতে মুবিন ভাই-ই যথেষ্ট। মাহিমাটারও আদিখ্যেতার শেষ নেই। সেদিন নাচতে নাচতে এসে সালোয়ার উপরে তুলে পা দেখাতে লাগল। মীরা প্রথমে মাহিমার ইশারা বুঝেনি। না বুঝে বলেছে,
“চোখ দিয়ে এরাম এরাম করে মাটির দিকে কী দেখাচ্ছিস?”
“দূর! মাটির দিকে না। আমার পায়ের দিকে দেখ।”
“কেন তোর পায়ে কি পাঁচ আঙ্গুলের জায়গায় ছয় আঙ্গুল চলে এসেছে?”
“তুই এত গাধা কেন? আমি কি তোকে আমার আঙ্গুল গুনতে বলেছি? আমার পায়ে নূপুর গুলো দেখ। বল তো কে দিয়েছে? ঠিকই ধরেছিস। মুবিন ভাই নিজে পরিয়ে দিয়েছে। সিনেমায় দেখিস না। হিরো হিরোইনের পা হাঁটুর উপর রেখে নূপুর পরিয়ে দেয়। সেরকম ভাবে। আমার যে কী ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। একটু একটু লজ্জাও লাগছিল।”
মাহিমার আনন্দের কথা শুনে এই প্রথম মীরা আনন্দিত হতে পারল না। কারণ তলে তলে তারও তো একটা বয়ফ্রেন্ড আছে। সে কেন মীরাকে এরকম ভাবে নূপুর পরিয়ে দিল না? উল্টো তার নূপুর কুড়িয়ে পেয়ে নিজের কাছে রেখে দিল।
মীরা মনে মনে হিংসেয় জ্বলছে। তোর বয়ফ্রেন্ড তোকে নূপুর দিয়েছে ভালো কথা। তুই এটা ঢোল পিটিয়ে না জানালে পারতি না। মীরা একা কেন জ্বলবে? কইতরি শয়তানীর জ্বলন ধরাতে বলল,
“নূপুর দিয়েই কাজ কী? আর নেকলেস দিলেই বা তুই করবি কী? সম্পর্কের এতগুলো দিন হয়ে গেল এখনও বয়ফ্রেন্ডকে ভাই বলাই ছাড়তে পারলি না। এই মুবিন ভাই তোকে কিছু বলে না? তোকে ভাই ডাকতে নিষেধ করে না? রক্তের সম্পর্ক দূরদূরান্ত পর্যন্ত নেই। লতায় পাতায়ও ভাই হয় না। তবুও ভাই ডেকে ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলিস। কোন বয়ফ্রেন্ডটা এই জিনিস এতদিন সহ্য করবে? তোরটা কেন করছে কে জানে। আমি তো বুঝি না।”
কথাগুলো বলতে বলতে মীরা আড়চোখে মাহিমার রিয়াকশন দেখে মনে মনে শয়তানি হাসি দিচ্ছে। আরও ড্যাঙড্যাঙ করে নূপুর দেখিয়ে মীরাকে জ্বালাতে আয়।
“মুবিন ভাই কী চায় কে জানে। কিন্তু আমি ছেলে হলে কোনদিনও এটা মেনে নিতাম না। গার্লফ্রেন্ড ভালোবেসে জানু, বাবু, সোনা, কলিজা ডাকবে। কিন্তু ভাই কেন ডাকবে?”
মাহিমার মাথায় তো এতদিন এই কথাটা আসেনি। সত্যিই তো এটা নিয়ে মুবিন ভাই কখনও তাকে কিছু বলেনি। একদিন নিষেধও করেনি। মাহিমা ভাবনায় পড়ে গেল। মীরা আগুনে আরও ঘি ঢালতে গিয়েও ভাবল,
“না। আর বেশি ঘি ঢালা উচিত হবে না। যতই হোক আমার দেবর তো। ভাবী হয়ে কীভাবে দেবরের সংসারে আগুন লাগাই! দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র দেবর। এটুকু টাইট দেওয়া দরকার ছিল কারণ, গার্লফ্রেন্ডকে এতকিছু কেন গিফট করবে? যেখানে বড়ো ভাই কিছুই করে না। সেখানে সে ছোট হয়ে কেন এত রোমান্টিক হবে? কেন, কেন, কেন?”
…..
আবির, তনির ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। বাড়ির পরিবেশ এখন রমরমা। সারাদিনই হৈচৈ চলছে। আরিব মানেই হৈচৈ আর আনন্দ। ছোট্ট মাহা আর রুমশি সর্বক্ষণ আবিরের কাঁধে চড়ে আছে। মাহা এখনও অনেক ছোট। তবুও কীভাবে বুঝে গেছে আরিব ভাই মানেই হৈ-হুল্লোড়। তাই আরিব যাওয়ার সময় মাহা চিৎকারের উপর থাকে। আরিব নিজেও এই কাণ্ড দেখে অবাক। সে মাহাকে কাঁধে নিয়ে মামীর উদ্দেশ্যে বলে,
“একে কী খাইয়ে এমন চালাক বানিয়েছ বলো তো! আমার যাওয়ার সময় হলেই কীভাবে বুঝে যায়? ফাঁকি দিয়েও বেরুতে পারি না।”
মামী হেসে জবাব দেয়।
“এটাই তো ভাই বোনের ভালোবাসা। বোনও ভাইয়ের মতোই হয়েছে। এখন থেকেই বুঝে গেছে কে বাড়িতে থাকলে না ঘুরিয়ে, না খেয়ে চব্বিশ ঘণ্টা খেলা করা যায়।”
“এই চালাকনি, তুই এত চালাক কেন হয়েছিস রে? আমার কি বাড়ি যেতে হবে না?”
মাহা আরিবের কথা কী বুঝে কে জানে। আবির কথা বললে সে মুখ দিয়ে ফেনা বের করে হেসে হেসে মাথা নাড়ে। রুশমি ছোট বোনের হয়ে আবিরকে বুঝিয়ে দেয়।
“মাহা তুমাকে যেতে দিবে না। তুমি গেলে কানবে।”
আবির রুশমিকেও কাঁধে তুলে নেয়।
“মাহা এই কথা বলেছে? পাকনা বুড়ী। তুমি তো আরও বেশি পাকনা।”
পড়াশোনা করতে হয় বলেই মীরা মাহিমার কলেজ যাওয়া। এই জিনিসটা বাধ্যতামূলক না হলে তাদের ঠেকা পড়েছিল এত কষ্ট করে পড়াশোনা করতে। কবেই পড়াশোনার সাথে ব্রেকআপ ঘোষণা করে দিত। কলেজ থেকে ফেরার পথে ভেবেছিল জায়িনের সাথে হয়তো দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু হলো না। বাড়ি ফিরে বাড়ির পরিবেশ দেখে মীরার এই দুঃখ বেশিক্ষণ মনে থাকল না। সে হলরুমে ব্যাগ ছুঁড়ে ওদের সাথে যোগ দিল।
“ও আবির ভাই, তুমি বলেছিলে তোমাদের পরীক্ষার পর ঘুরতে নিয়ে যাবে। বলেছিলে কি-না বলো? এখন কিন্তু বলতে পারবে না তোমার মনে নেই। আমি জানি তোমার মনে আছে। কবে নিয়ে যাবে বলো। বলো না। বলো বলো।”
“আরে বাবা, শ্বাসটা নেওয়ার সময় তো দিবি। আমি কি একবারও না করেছি?”
মীরা সোফার উপর উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল,
“ইয়াহু! তার মানে তুমি নিয়ে যাবে!”
“একশো বার। বোনেরা কোন আবদার করেছে। আমি সেটা ফেলে দেব! নো নেভার। কাভিবি নেহি।”
“ইয়ে, ইয়ে। এবার আমরা ঘুরতে যাব।”
বড়মা এসে মীরাকে কলেজ ড্রেসে সোফার উপর উঠে লাফাতে দেখে তেড়ে মারতে এলো।
“দাঁড়া তুই। দাঁড়া, পালাস না। তুইও বাচ্চা হয়েছিস না! কলেজ থেকে ফিরে রুমে যাওয়া নেই। কাপড় ছাড়াও নেই। ব্যাগ নিচে ফেলে তুমিও বাচ্চা সাজছো। আজ তোকে কে বাঁচায় দেখি।”
মীরা বড়মার ভয়ে চিৎকার করে আবিরের পেছনে এসে লুকাল।
“ও বাবাগো মেরে ফেলল। মরে যাব। আবির ভাই গো আমাকে বাঁচাও।”
“আজ ভাই বোনকে একসাথেই লাঠি মারব।”
বড়মা মীরার দু-হাত দূরে থাকতেই মীরা চিৎকার করে যাচ্ছে।
“আহ লাগছে। মেরো না। মরে যাব। লাগছে, লাগছে। মেরো না।”
এই মেয়ের নাটক দেখে বড়মা কঠিন থাকতে পারল না। দাঁড়িয়ে পড়ে হেসে দিল।
“লাগছে তোর? আমি তোকে মেরেছি কখন যে লাগবে তোর? না মারার আগেই এমনভাবে চিৎকার শুরু করিস যেন মেরে টেরে শেষ করে ফেলেছি। সত্যি সত্যি মারলে তখন কী করবি?”
“পুরোপুরি মরে যাব।”
“হয়েছে। বাজে কথা রেখে ঘরে গিয়ে কাপড় পালটে আয়। আর আবির, তোকেও কি আমার শাসন করতে হবে? বাঁদর গুলোকে এত লাই দিচ্ছিস। শেষে কিন্তু তুই-ই সামলাতে পারবি না। তুই বড়ো। কোথায় একটু শাসন করবি।”
আবির ভবিষ্যত শাশুড়িকে পটাতে আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল,
“শাসন করার জন্য তুমি তো আছো। আমি সহ সবাইকে শাসন করবে।”
“তোরা যে কবে বড়ো হবি। আমি বুঝি না।”
“আমরা তো বড়ো হতে চাই না মামী। সারাজীবন তোমার ছোট্ট আবির হয়েই থাকতে চাই।”
তনি এসব ঢঙ দেখে মুখ মোচড়ায়। মনে মনে বলে,
“উহহ ঢঙ! মামীর সাথে যতোই খাতির লাগাও, মামীর মেয়ের সাথে সম্পর্কের কথা বলতে গেলেই সেই-ই হাঁটু কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায়। এখনও সাহস করে আসল কথাটাই বলতে পারল না। আবার ঢঙ করতে আসে।”
তনির মুখ মুচড়ানো দেখে আবির চোখ টিপ দেয়। তা দেখে তনি আরও রেগে যায়। মেয়ে হয়ে তার সাহস আছে সবাইকে বলে দেওয়ার তারা যে রিলেশনে আছে। কিন্তু ছেলে হয়ে তার হাঁটু কাঁপে। চোখের সামনে দিয়ে যেদিন অন্যের ঘরে বউ হয়ে যাবে সেদিন বুঝবে মজা। তখন কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে কান্না করা ছাড়া উপায় নেই।
সারাদিন নিজেরা যতই প্ল্যান করুক। কিন্তু আসল প্ল্যান ইভান ভাইকে ছাড়া হবে না। ইভারও তো ছুটি চায়। ইভার স্কুল দুইটা তিনটার মধ্যেই শেষ হয়ে গেলেও ইভান ফিরতে রাত হয়। ইভান ফিরলেই আসল প্ল্যানিং শুরু হয়। ভাই এখানে থাকে। মাহিমা নিজে কি বাড়ি বসে থাকবে? কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে আবির মামার বাড়ি আছে জেনেই সে-ও চলে এসেছে। এখন সবাই ইভানের ঘরে বসে আছে। ইভান মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। এখনও শার্ট চেঞ্জ করেছে। গ্যাঞ্জাম গ্রুপের সব সদস্যকে এখানে দেখেই বুঝে নিল ওদের উদ্দেশ্য এবার বড়সড় কোন অঘটন ঘটানোর। কেউ কথা শুরু করছে না। মীরা ইভান ভাইয়ের সাথে খাতির লাগাতে বলল,
“ইভান ভাই, আমি তোমার জন্য পানি নিয়ে আসি?”
ইভান ইশারা করে দেখাল, পানি তোর ভাবীই নিয়ে এসেছে। তবুও মীরা দমে গেল না। তাৎক্ষণাৎ বলল,
“এটা তো শুধু পানি। আমি তোমার জন্য চিনি লেবুর শরবত বানিয়ে আনি। আমি অনেক ভালো শরবত বানাতে পারি। তুমি একবার খেলে খেতেই চাইবে শুধু।”
চলবে
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫৭
এই মেয়ের হাতে শরবত খেলেও ফেঁসে যাবে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বলবে,
“আমি তোমাকে কত কষ্ট করে শরবত বানিয়ে খাইয়েছি। আর তুমি আমার কথা শুনছো না! তুমি এমন করতে পারবে ইভান ভাই!”
মীরা চলে যাওয়ার পরপরই মাহিমাও ইভানকে হাত করার জন্য বলল,
“অনেকদিন তুমি চুল টেনে দিতে বলো না। আমার তো পড়াশোনার চাপ ছিল। তাই আমিও তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি। এখন কি তোমার চুল টেনে দেব ইভান ভাই?”
এই মেয়েগুলোর গাধামি দেখে তনি মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে। এখন ইভান ভাইয়ের বউ আছে। বোনেরা খেয়াল না রাখলেও হবে। আগে না পারতে বোনদের দিয়ে কাজ করাত। এখন তো সে কাজগুলো করার মানুষ আছে।
ইভান ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে এদের চাওয়া এবার অনেক বড়ো। নয়তো এত তেল লাগাতো না। তাই ইভান এদের মিষ্টি কথায় ফাঁসল না।
“না থাক। দরকার নেই।”
“কেন? আগে তো চুল টেনে দেওয়ার জন্য টাকা দিতে। এখন ফ্রি-তে দিতে চাচ্ছি। তবুও তুমি না করছো!”
আবির ইভার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। মনে মনে বলছে, োওরে আমার অবুঝ বোন। তোর ভাইয়ের এখন চুল টেনে দেওয়ার, হাতপা টিপে দেওয়ার পার্সোনাল মানুষ আছে।
তনি ধমক দিয়ে মাহিমা চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
“ইভান ভাই, তুমি আগে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নাও। আমাদের সবার একটা কথা আছে।”
ইভান ডান ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“সবার একটাই কথা?”
“হ্যাঁ।”
“কথাটা নিশ্চয় কোথাও ঘুরতে যাওয়া নিয়ে।”
“তুমি তো জানোই। তবুও কেন না জানার ভাব ধরে আছো।”
“তোদের উদ্দেশ্য জানা থাকলেই বিপদ।”
“বড়ো ভাই হয়েছ। বিপদ তো একটু আধটু তোমার ঘাড়েই থাকবে।”
“একটু আধটু না। তোরা একেকটা বিপদের নানা নানী। তাই তোদের সাথে নিয়ে কোথাও যেতে এত ভয় পাই।”
আবির এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার বলল,
“আমরা কেউই বাচ্চা না। তুই খালি মামা মামীদের রাজি করাবি ব্যস। তারপর আমরা নিজেরা নিজেরাই দেখে নিতে পারব।”
“তাহলে তো আমি আরও আগে তোদের সাথে নেই। আমাকে ক্ষমা কর। তোরা কোথাও যাবি আর অঘটন ঘটাবি না! এমনটা না হওয়াই আশ্চর্যজনক হবে। শেষে বাবা চাচাদের কাছে জবাবদিহি আমাকেই করতে হবে।”
কোনভাবেই কাজ হবে না বুঝতে পেরে আবির ইভার সাহায্য নিল। বউয়ের কথা কোন বরই ফেলতে পারবে না।
“ভাবী দেখছেন আপনার জামাই কেমন দাম দেখাচ্ছে! ভাইবোনদের কথা না-ই ভাবলো। আপনার কথাটা তো ভাবা উচিত। বিয়ের পর কি আপনাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেছে? যায়নি। এটাকে ফ্যামিলি ট্রিপ না ভেবে হালকা করে হানিমুন ট্রিপই ভেবে নিতে বলুন না।”
মীরা শরবত নিয়ে হাজির। সে যাওয়ার পরে কী কী কথা হয়েছে জানার জন্য মনে মনে ব্যাকুল হচ্ছে।
“নাও ইভান ভাই। শরবত খাও।”
“টেবিলে রাখ।”
“না। তুমি এখন খাও।”
ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরবত খেলো। মীরা আবিরের পাশে গিয়ে বসলো। চোখে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল কথা কতদূর এগিয়েছে। আবির মুখ বাঁকিয়ে না সূচক মাথা নাড়ল।
ইভান এদের মাথা থেকে ঘুরতে যাওয়ার ভূত নামাতে বলল,
“কাছাকাছি কোথাও হলে আমার আপত্তি নেই। দিনের মধ্যে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব। কিন্তু তোদের নিয়ে বাস ট্রেনে লম্বা জার্নি অসম্ভব। একেকটাকে মরা আনতে হবে।”
সবাই এত করে বলার পরেও ইভান রাজি হচ্ছে না দেখে এবার ইভা বলল,
“ওরা এত করে বলছে..
” না ইভা, তুমি এদের কথা জানো না। বাঁদর তিনটা যে লাফাচ্ছে তুমি ওদের জিজ্ঞেস করো তো বাসে ওঠে ঠিক কতক্ষণ বমি না করে থাকতে পারে? বিশ মিনিট। এর বেশি একটা সেকেন্ডও না। যেখানে আধঘন্টা একঘন্টার মধ্যেই অবস্থা কাহিল হয়ে যায়, সেখানে ওরা সাজেক, কক্সবাজার যাওয়ার কথা মুখে আনে কীভাবে?”
ইভান ইভার কথাও শুনলো না। আবির, তনিকে কোনকিছু বলার সুযোগই দিলো না। ওদেরকে দূরে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান বাদ দিয়ে কাছেই ঘুরে আসার উপদেশ দিলো। ওদের মন খারাপ হতে দেখেও ইভার কিছু করার নেই। ইভান ওদের ভালোর জন্যই না করছে। কিন্তু মীরা তো এটা বোঝার মানুষ না। সে কান্না চেপে রুদ্ধ গলায় বলল,
“তুমি আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে না তো? না যাও। আমরাও তোমার সাথে যাব না। কিন্তু ভাবীকেও তোমার সাথে থাকতে দেব না। আজই ভাবীকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিব। তোমার বিয়ের ঘটকালি আমি করেছি..” মীরার কথার মাঝেই মাহিমা বলে উঠল,
“আমিও।”
মীরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। আবার বলতে থাকল,
“তোমার বিয়ের ঘটকালি আমরা করেছি। এখন আমরাই ভাবীকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিব। তুমি আমাদের কথা শুনো না। আমরাও তোমার কথা ভাববো না। ভুল করে তোমার বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন ভাবীকে এখানে থাকতে দিব না।”
মীরার সাথে মাহিমাও যোগ হলো।
“হ্যাঁ ঠিক। যে ভাই বোনদের খুশির কথা ভাবে না। বোনদের কথা রাখে না। আমরাও এমন ভাইয়ের জন্য কিছুই করব না। ভুল করে যা করে ফেলেছি সেটাও ফিরিয়ে নেব।”
এদের দু’জনের মুখে এমন কথা শুনে আবির, তনি বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ইভানের অবস্থাও কিছুটা শক পাওয়ার মতোই। কিন্তু ইভা ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগল। ওর এমন হাসিতে মীরা মাহিমাও ভড়কে গেল।
…
কাল চাঁদপুরে একটা কনসার্ট আছে। ওদের ছোট্ট দলটা একটু একটু করে পরিচিত কুড়চ্ছে। এখন অনেকেই তাদের ডাকে। ছোট থেকেই তো মানুষ বড়ো হয়। মুবিনও হাল ছাড়বে না। একদিন তারা ঠিকই নামডাক কামাবে। আজ রাতে বেরুতে হবে। কাল দুপুরে স্টেজ পারফর্ম করবে। মুবিন এক্সাইটেড হওয়ার সাথে সাথে কিছুটা নার্ভাসও। বড়ো পরিসরে এটাই তাদের প্রথম কনসার্ট। দর্শন কেমন হবে? তাদের গানকে কীভাবে নেবে সেটাও ভাবার বিষয়। মুবিনের হাবভাব লক্ষ করে জায়িন বলল,
“তুই কি ভয় পাচ্ছিস?”
“কিছুটা।”
“ভয় পেলে তো আগেই শেষ। কনফিডেন্স লেভেল বাড়া।”
“চেষ্টা করছি। কিন্তু এটা ভেবেই কিছুটা চিন্তিত মানুষ আমাদের শো’য়ে রেসপন্স করবে তো?”
“তোদের নিজেদেরই যদি ডাউট থাকে তাহলে পাবলিক কীভাবে তোদের উপর বিশ্বাস করবে?”
মুবিন ফোঁস করে ফুসফুসের সব বাতাস বের করে দিল। কনফিডেন্স বাড়াতে হবে। মানুষ তাদের ভালোবাসা দিবে এই বিশ্বাস নিয়েই স্টেজে উঠতে হবে।
মুবিন প্যাকিং করছে। জায়িন এখন মাঝে মাঝেই মুবিনের কাছে চলে আসে। দুই ভাই অনেকটা সময় একসাথে কাটায়। আগে এক ছাঁদের নিচে থাকার পরেও যেটা সম্ভব হতো না। প্রয়োজন ছাড়া তখন দুই ভাইয়ের তেমন বিশেষ কোন কথাই হতো না। কিন্তু এখন দূরত্ব বাড়ার পর মুবিন বুঝেছে মনের দিক থেকে দুই ভাই কতটা কাছে ছিল। জায়িন পরোক্ষ ভাবে সবসময়ই মুবিনের সাহায্য করেছে। সত্যিই একটা বড় ভাই বাবার ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এখানে তার বাবাই ভিলেন সেজে বসে আছে।
“মা কি এখনও বাবার সাথে রাগারাগি করে?”
“তুই বাড়িই ছেড়েছিস এজন্যে। খুব ভালো করেই জানতি তুই বাড়ি ছাড়লে মা বাবাকেই দায়ী করবে।”
মুবিন হাসতে লাগল। জায়িন উঠতে নিলে বলল,
“চলে যাচ্ছ?”
“অনেকক্ষণ তো হলো।”
“আরেকটু থাকো।”
“তুই বেরুবি কখন?”
“এখনও সময় আছে।”
জায়িন মাহিমার ব্যাপারটা জেনে গেলে মুবিন আর লুকায়নি। ভাইয়ের থেকে এত লুকোচুরি কিসের? প্রেমই তো করছে। চুরি তো করছে না। মুবিন আমতা আমতা করে বলল,
“তোমার যদি হাতে কোন কাজ না থাকে তাহলে আমার সাথে এক জায়গায় যাবে?”
“কোথায়?”
“আগে বলো যাবে কি-না।”
“সেটা তো জানার পরই বলা যাবে।”
একটু একটু লজ্জা লাগলেও মুবিন বলে ফেলল,
“ইভা আপুর শ্বশুরবাড়ি।”
“ইভা আপু কি যেতে বলেছে?”
জায়িন প্রথমে বুঝতে পারেনি। আসলে তার মনে ছিল না। কিন্তু মুবিনকে লজ্জা পেতে দেখে মনে পড়ল।
“কিন্তু ওটা তো তোর মামা শ্বশুরবাড়ি। ওখানে গেলেও তোর লাভ হবে না। নিজের শ্বশুরবাড়ি যেতে মন চাইলে আমি আবিরকে..
” মাহিমারা ওখানেই আছে।”
জায়িন মনে মনে হাসলো। মুবিন যে কথাটা বলে ফেলতে পেরেছে তা হয়তো সে কোনদিন পারত না। মীরা চায় না এখন কেউ জানুক এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ তার বাবা। বাবা হয়তো চাইবে না ইভা আপুর শ্বশুরবাড়ি ছাড়া ওবাড়ির সাথে নতুন কোন সম্পর্ক তৈরি হোক। ইভার বিয়েতে সবাই রাজি থাকলেও একমাত্র বাবারই আপত্তি ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস। আজ তার নিজের দুই ছেলেই ওই বাড়ির মেয়েদের পছন্দ করে বসে আছে। মুবিনের বিষয়টা যদিও বাবা মানে, কিন্তু তার বিষয়টা এত সহজে মানবে না।
….
আজ মীরার বাবা বাড়িতেই আছেন। মীরা ইভানের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাবার কাছে গেল। মেয়েকে মুখ ফুলিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বায়েজিদ সাহেব হাত বাড়িয়ে ডাকলেন।
“ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন মা? এদিকে আয়।”
মীরা থমথম মুখে বাবার কাছে এলো। বায়েজিদ সাহেব ঠিক বুঝতে পারছেন মেয়ের কোন কারণে মন খারাপ।
“কী হয়েছে আমার লক্ষী মা’টার? কেউ বকেছে?”
মীরা এদিকওদিক মাথা নাড়িয়ে জানাল, কেউ বকেনি।
“তাহলে কেন মন খারাপ? আবির, ইভানের কাছে কিছু চেয়েছিলে ওরা এনে দেয়নি? কী লাগবে মা? আমাকে বলো।”
“ইভান ভাই একটুও ভালো না বাবা। কোন কথাই শুনে না।”
“আমার মা’র কোন কথাটা শুনেনি ইভান? উহু, ইভান তো খুব খারাপ কাজ করেছে। ওকে এক্ষুনি ডেকে বকে দিই?”
“আবির ভাই, তনি আপুর পরীক্ষা শেষ। আমরা সবাই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু ইভান ভাই নিয়ে যেতে মানা করে দিয়েছে। তুমিই বলো বাবা, ইভান ভাই কি এটা ঠিক কাজ করেছে? একটু নিয়ে গেলে কী হয়?”
বায়েজিদ সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা ভীষণ অভিমানী। ছোট থেকে মা’র ভালোবাসা পায়নি বলেই হয়তো এমন হয়েছে। তিনি নিজেও তো মেয়েকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি। টাকার পেছনে এত ছুটেছেন, এমনকি এখনও ছুটছেন। মেয়ে কবে বড়ো হয়ে গেছে খেয়ালই করেননি। ওর চাচীরা না থাকলে মীরার কী হতো ভাবতে পারেন না বায়েজিদ সাহেব।
“আমার মা তো একটু ঘুরতে যেতেই চেয়েছে। ইভান এতেও না করে দিয়েছে! আমি এক্ষুনি ওকে শাসন করে দিচ্ছি। কোথায় যেতে চাও মা?”
মীরা মাথা তুলে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে খুশিতে ঝলমল করে উঠে বলল,
“কক্সবাজার। তুমি ইভান ভাইকে নিয়ে যেতে বলবে?”
মীরা কক্সবাজার যেতে চায় শুনে বায়েজিদ সাহেবও হাওয়া ফুস হয়ে গেল। কারণ লম্বা জার্নি করলে মীরার কী অবস্থা হয় তা তো উনার অজানা না। তবুও মেয়েটা কেন এমন বায়না করে?
“বলো না বাবা। তুমি ইভান ভাইকে বলবে তো?”
“হুম। কিন্তু মা…
বাবা পুরো কথা শেষ করার আগেই মীরা লাফিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,
” আমি জানতাম। তুমি না করবে না। ঠিক ইভান ভাইকে নিয়ে যেতে বলবে। আমি জানি তো। তুমি আমার কোন কথাই ফেলতে পারো না। আমার সব চাওয়া পূর্ণ করো। তুমি যে কী ভীষণ ভালো বাবা। আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।”
চলবে…