মন পলাশ পর্ব-০৪

0
62

#মন_পলাশ ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>
যেমন ভাবা, সেরম কাজ। সৌমী পরেরদিন থেকেই কাগজ ঘাঁটতে শুরু করেছিল। যদি ভালো কোন চাকরির সন্ধান পাওয়া যায়! এই ভাবনার ভিড়েই সকাল থেকে হারিয়েছিল। তবে অফিস বেরোনোর আগে হঠাৎ খেয়াল হলো ওই ওদের অফিসের সামনে একজন বয়স্ক মহিলা বসে থাকে, ভিক্ষা চায়, কালকে ওনার সাথে কথা হয়েছিল অনেক। সৌমী বলেছিল ওনার জন্য একটা চাদর নিয়ে আসবে। কথাটা মনে পড়তেই মা কে বলে আলমারি থেকে একটা চাদর বার করেছিল। ওই বয়স্ক ঠাকুমাটা রাস্তায়ই থাকে। ছেলে মেয়ে কেউ দেখে না। তাই এই বয়সে এইভাবে ভিক্ষা করে খেতে হয়। সেদিন কথাগুলো মা কে বলেছিল আনমনে। মা আবার এইসব শুনে টিফিন কৌটো করে কিছু খাবার ভরে দিয়েছিল ওনার জন্য। সৌমী আজ সেইসব নিয়েই এসেছিল অফিস, আর গেটে ঢোকার আগেই দেখেছিল ওই বয়স্ক মহিলা কালকের মতন একই জায়গায় বসে থাকতে। সৌমী নিজেই গিয়েছিল এই মুহূর্তে ওনার কাছে। তারপর ব্যাগ থেকে চাদরটা বার করে ওনার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিল, আর ব্যাগ থেকে খাবারের কৌটো বার করে হাসি মুখে দিয়েছিল ওই ঠাকুমার হাতে। সেদিনও বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল দুজনের। ঠাকুমা গালে হাত দিয়ে আদর করে দিয়েছিল সৌমীকে। আসলে এই দুদিনেই খুব নিজের হয়ে গেছে মেয়েটা। তবে এই পুরো দৃশ্যটাই একজন দেখেছিল অগোচরে। অর্জুন সেদিন গাড়ি করে অফিসে আসছিল। সেই সময়ে গাড়ির জানলায় হঠাৎ চোখ পড়ে যায়। সৌমীকে আর ওই বয়স্ক মহিলা একসাথে কথা বলতে দেখে কেমন থমকে গেছিল ও। সেই মুহূর্তে খেয়াল করেছিল সৌমী ওই ঠাকুমার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে, ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটো বার করে দিচ্ছে! এইসব দেখে অর্জুনের সত্যিই খুব অবাক লাগছিল। এই ব্যাস্ত পৃথিবীতে যেখানে নিজের লোকের জন্যই কারোর সময় নেই, সেখানে একজন রাস্তার মহিলাকে নিয়ে সৌমীর এত চিন্তা! কথাটা ভেবেই খুব অন্যরকম লেগেছিল মেয়েটাকে। আজ যেন নতুন করে দেখেছিল ও প্রথম সৌমীকে।
সেদিন আনমনে বার বার অফিসে খেয়াল করছিল অর্জুন সৌমীকে। মেয়েটা কাজ ছাড়া বেশি কথা বলে না। কাল কি একটু বেশিই রুড ছিল ও সৌমীর সাথে! তাই এত চুপচাপ আজ! না কি রোজই এত চুপ করে থাকে। কথাগুলো কেমন আনমনে মনে হচ্ছিল অর্জুনের।
সেদিন তবে এক দুবার এসেছিল সৌমী অর্জুনের কেবিনে। অর্জুনই এটা ওটা কাজের জন্য ডাকছিল ওকে। কিন্তু আজ সৌমী প্রথম থেকেই ভীষণ গম্ভীর। অর্জুনের চোখের দিকেও তাকাচ্ছে না আজ। আসলে কাল মায়ের সাথে যেই ব্যবহারটা করেছে এই লোকটা, সেটা ভুলতে পারছে না সৌমী। সত্যি একটা অন্য চাকরি পেলে চলে যাবে এই অফিস ছেড়ে। এরকম রাগি অহংকারী লোকের সাথে কখনোই কাজ করবে না আর।
যাইহোক, এই ভাবনার ভিরেই দুদিন কেটেছিল। আজ তবে অফিস শেষে বৃষ্টি নেমেছিল খুব শহরে। চারিদিকে কালো মেঘের ভিড়। আকাশটাকে যেন ছাই রং দিয়ে কেউ রাঙিয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে সৌমীর অফিস থেকে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছু কাজ পেন্ডিং ছিল আসলে। তবে আজ আকাশের অবস্থা দেখে বেশ জোরেই পা চালাচ্ছিল সৌমী। আজ আবার অটো স্ট্যান্ডে একটাও অটো নেই। এমনকি ভাগ্যক্রমে আজ সঙ্গে ছাতাও নেই। তাই বেশ তাড়াহুড়ো করেই হাঁটছিল সৌমী। সেই সময়েই হলো একটা কেস। আচমকা জুতোর স্ট্র্যাবটা খুলে গেল রাস্তায় আর সৌমী হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো এক জায়গায়। এই মুহূর্তে ওর মাথায় হাত! জুতো ছিঁড়বি তো ছেঁর, তাও এই সময়ে যখন আকাশে ভর্তি কালো মেঘ। এই বৃষ্টি নামলো বলে! আজ মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভেজা ছাড়া কোন উপায় নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই জুতোর মধ্যে কোন রকমে একটা সেফটিপিন লাগানোর চেষ্টা করছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তখনই পিছন থেকে গাড়ির আওয়াজ। অর্জুন অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার সময় দূর থেকে সৌমীকে ফুটপাথের মাঝ মধ্যিখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেই গাড়ি থামিয়েছিল ওর সামনে। তারপর নিজে থেকেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিল,
———-” কি ব্যাপার? এনি প্রব্লেম? তুমি এইভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছো! ”
কথাটা বলতে বলতেই খেয়াল করেছিল সৌমী সেফটিপিন হাতে ছেঁড়া জুতো নিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখে অর্জুন নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———-” এ কি! জুতো ছিঁড়ে গেছে তোমার,! ”
এই কথায় সৌমী একটু ইতঃস্তত হয়ে বলেছিল,
———” না মানে একটু ছিঁড়ে গেছে জুতোটা। কিন্তু কোন প্রবলেম নেই স্যার। আমি ম্যানেজ করে নেব। আপনি প্লিজ আসুন। ”
এই কথায় অর্জুন সাথে সাথেই বলেছিল,
———” একে তো বেশ রাত হয়েছে। তার ওপরে যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। আর মনে আছে এই রাস্তায় কদিন আগে কি হয়েছিল! ওই ছেলেগুলো কিভাবে টিজ করছিল তোমাকে! না না, এইভাবে এখানে একা থাকা উচিত না। তুমি গাড়িতে ওঠো। ”
এই কথায় সৌমী যেন কেমন ফেঁসে গেল। মনে হচ্ছিল বৃষ্টিতে ভিজবে তাও ভালো, কিন্তু এই রাগি অহংকারী লোকটার গাড়িতে কোন মতেই উঠবে না। তাই কিছুটা জোর দিয়েই বলেছিল,
———” না স্যার। আমি ঠিক চলে যাবো। কোন অসুবিধা হবে না। আপনি প্লিজ আসুন। ”
এই কথায় অর্জুন এই মুহূর্তে দ্বিগুণ জোর দেখিয়ে বলেছিল,
———-” আমি তোমার বস। আর আমি তোমাকে বলছি না, অর্ডার দিচ্ছি। গাড়িতে গিয়ে বসো। আন্ডারস্ট্যান্ড .. ”
এই কথায় সৌমী যেন কেমন থমকে গেছিল। সত্যিই যদি চাকরিটার খুব দরকার না হতো তাহলে কথায় কথায় এই লোকটার বস হওয়ার রোয়াব সৌমী কখনোই সহ্য করতো না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অন্ধকার মুখে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। আর সেই মুহূর্তেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এলো শহরে।
সেদিন সৌমী রাগে বিরক্তিতে নিজের মনেই বলে উঠেছিল বিড়বিড় করে,
———” জুতো ছেঁড়া আর বৃষ্টি আসার আর সময় পেলো না! তবে এই লোকটার গাড়িতে চরার থেকে তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজাও ভালো ছিল। ”

কথাগুলো খুব আস্তে গলায় বললেও এই বিড়বিড় শব্দ কানে গিয়ে পৌঁছেছিল অর্জুনের। তাই সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিল,
———-” কি ব্যাপার? কিছু বলছো তুমি? ”
কথাটায় সৌমী একটু এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
———” না না স্যার। কিছু বলিনি আমি। ”
কথাটা বলেই সৌমী চুপ করে গেছিল। এরপর বাকি রাস্তা ও জানলার কাঁচের দিকে মুখ ঘুরিয়েই বসেছিল আর মনে মনে অপেক্ষা করে যাচ্ছিল কখন এই রাস্তা শেষ হবে! সেই সময়ে অর্জুন নিজে থেকেই বলে উঠলো,
——–” আমি আসলে আজ যেতাম তোমাদের বাড়ি। ইনভাইট করতে।”
এই কথায় সৌমী বেশ অবাক হয়ে বলেছিল,
———” আমাদের বাড়ি! আপনি আমাদের বাড়ি আসতেন! কেন? ”
প্রশ্নটা শুনে অর্জুন কিছুটা সাজিয়ে গুছিয়ে বলেছিল,
———” মায়ের জন্মদিন কাল। আমি ছোট করে একটা সেলিব্রেশন করছি। তাই কাল তোমাকে আর কাকিমাকে আসার জন্য বলতাম। মা নন্দিনী কাকিমাকে দেখলে খুব খুশি হবে কাল। ”
কথাটায় সৌমী প্রথমে কোন উত্তর দেয়নি। তবে অর্জুনের বাড়ি যাওয়ার যে ওর কোনোই ইচ্ছে নেই সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যেন। তবে কয়েক মিনিট ভেবে সৌমী কিছুটা বানিয়ে বানিয়ে বলে উঠলো,
———-” মা তো কাল যেতে পারবে না। আসলে মায়ের পায়ে খুব ব্যাথা।”
অর্জুন কথাটা শুনে সাথে সাথেই বলে উঠলো,
———-” ব্যাথা! কিসের জন্য ব্যাথা? আর্থারাইটিস এর প্রব্লেম? ”
এই কথায় সৌমী না না করে বলে উঠলো,
———” না মানে আসলে পা মচকে গেছে। তাই আসতে পারবে না। ”
আসলে এর থেকে ভালো অজুহাত ওর সামনে আর কিছু ছিল না। এবার লোকটা কনভেনশ হয়ে গেলেই শান্তি। কিন্তু অর্জুন এইসব শুনে অল্প ভেবে বললো,
———-” ঠিক আছে। কাল তাহলে আমি গাড়ি পাঠাবো তোমাদের। তাহলে তো যেতে কোন প্রবলেম হবে না! ”
কথাটায় সৌমী কি বলবে ভেবে পেল না। হঠাৎ এই লোকটা এত করে নিজের বাড়িতে ডাকছে কেন! সেদিন তো পুরো উল্টো ছিল। সামান্য ভদ্রতার হাসি টুকু হাসেনি দেখে। আর শেষমেষ তো অপমান করে বাড়ি থেকে বারই করে দিল! তাহলে আজ হঠাৎ এত ভদ্রতা কিসের!
এই এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই অবশেষে বাড়ি অব্দি পৌঁছে গেছিল সৌমী। এরপর অর্জুন নিজে নন্দিনীর সাথে দেখা করে ওদের ইনভাইট করেছিল। তবে প্রথমেই ও নন্দিনীকে দেখে জিজ্ঞেস করে উঠেছিল,
——–” কাকিমা, আপনার পা কেমন আছে? ”
এই প্রশ্নে নন্দিনী বেশ অবাক হয়ে বলেছিল,
———” পা! আমার পায়ে কি হবে! ”
এই কথায় অর্জুনও বেশ আশ্চর্য হয়ে বললো,
———-” এই তো সৌমী গাড়িতে আসতে আসতে বললো আপনার পায়ে ব্যাথা! পা মচকে গেছে! ”
কথাটায় নন্দিনী কিছু বুঝতে না পেরে আকাশ থেকে পড়ার মতন মুখ করে বললো,
———-” আমার পা মচকে গেছে! কখন! ”
এই কথাটাকে আর এগোতে না দিয়েই সৌমী বলে উঠলো চোখ টিপে ওর মার দিকে তাকিয়ে,
———–” কি যে বলো না মা! কালই তো মচকে গেল পা! কত ব্যাথা তোমার। ভুলে গেলে? ”
কথাটা শুনে আর সৌমীর এক্সপ্রেশন দেখে নন্দিনী এবার আন্দাজ করতে পারলো কিছুটা। নিশ্চয়ই মেয়েটা কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলেছে অর্জুনকে। তাই আর হাটে হাঁড়ি না ভেঙে চুপ করে গেল।
<৮>
সেদিন তবে অর্জুন চলে যাওয়ার পর সৌমী বেশ বিরক্ত হয়েই বলেছিল,
——-” মা আমি একেবারেই যেতে চাই না আর ওই অহংকারী লোকটার বাড়ি। যদি আমার বস না হতো তাহলে মুখের ওপরই না বলে দিতাম। আর সেদিন যেইভাবে তোমার সাথে ব্যবহার করেছিল এই অর্জুন স্যার, সেটা তো আমি কোনদিনই ভুলতে পারবো না! ”
এই কথায় নন্দিনী কিছুটা শান্ত গলায় বলেছিল,
——–” ছেলেটা তো এসে সরি বলেছে। আবার আজ বাড়ি বয়ে এসে নেমন্তন্নও করে গেল। আর সব থেকে বড় কথা আমাদের বিপদের দিনে ওরা আমাদের কত সাহায্য করেছে। তোর এই চাকরিটা না হলে আমাদের সংসারটা পুরো ভেসে যেত। তাই কৃতজ্ঞতার খাতিরেও রুক্মিণীর জন্মদিনে আমাদের যাওয়া উচিত। ”
এই কথায় সৌমী চুপ করে গেছিল। আসলে অফিসের অপমানগুলো তো মা জানে না! কতবার কত রকমভাবে এই অর্জুন কথা শুনিয়েছে ওকে এই চাকরি দেয়ার জন্য! যাইহোক, একটা নতুন চাকরি পেলেই এর সমাধান হবে। ওই অহংকারী লোকটার মুখোমুখি হতে হবে না আর।

সৌমী সেদিন এইসব ভাবলেও পরেরদিন ঠিক মায়ের কথায় ওকে যেতে হয়েছিল রুক্মিণীদের বাড়ি। তার মধ্যে মা আবার জোর করে একটা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে ওকে! সেই নিয়েই গোমড়া মুখে দাঁড়িয়েছিল পার্টিতে এক কোণায়। এদিকে রুক্মিণী কাকিমা তো নন্দিনীকে পেয়ে এত খুশি যে এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধুকে কাছছাড়া করছে না। সত্যি মা আর ছেলে মানুষ হিসেবে এত আলাদা কি করে হয়! ওই অর্জুন এত অহংকারী! আর উল্টোদিকে রুক্মিণী কাকিমা একেবারে মাটির মানুষ। এইসবই ভাবছিল সৌমী একা একা দাঁড়িয়ে। তবে ও খেয়াল করেনি অর্জুন আজ দূর থেকে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। লাল রঙের শাড়ি, খোলা চুল, কপালে ছোট্ট টিপ, সব মিলিয়ে কেমন অন্য রকম লাগছে মেয়েটাকে! অফিসে তো এরকম লাগে না। তাহলে কি আজ শাড়ি পরেছে বলে আলাদা লাগছে! কথাগুলো মনে মনেই ভেবে যাচ্ছিল ও। তবে কিছুক্ষণ বাদে নিজের ভাবনার ওপরই নিজে বেশ অবাক হয়েছিল। কোন মেয়েকে কেমন দেখতে লাগছে এইসব নিয়ে আগে কখনো ভেবে দেখেনি তো! তাহলে হঠাৎ সৌমীকে দেখে এইভাবে থমকে যাচ্ছে কেন! সৌমীকে কি আজকাল খুব আলাদা লাগতে শুরু করেছে ওর! আসলে ওর পজিশন, বিজনেসে এত নাম, এইসবের জন্য সবাই সব সময় খুব কাছে আসতে চায় অর্জুনের। মন রেখে কথা বলা, জোর করে কথা বাড়ানোর চেষ্টা, এইসব তো প্রায় সবাই করে। কিন্তু সেখানে সৌমী খুব চুপ। দরকার ছাড়া, কাজের কথা ছাড়া মেয়েটা কখনোই আসে না ওর কাছে। বরং একটু এড়িয়েই চলতে চায়। এইসবের জন্যই কি আরো বেশি করে সৌমীকে খেয়াল করছে অর্জুন! প্রশ্নগুলো নিজের মনেই করে ফেললো সেদিন।
যাইহোক, এর মধ্যেই সেদিন পার্টিতে এসে হাজির হয়েছিল তিলোত্তমা। অর্জুনের বিজনেস পার্টনার অমিত রায়চৌধুরির একমাত্র মেয়ে। অনেক গিফটস চকলেট নিয়ে হাজির হয়েছিল তিলোত্তমা। অর্জুন যদিও এই মুহূর্তে তিলোত্তমাকে এখানে দেখে একদমই খুশি হয়নি। আর ও তো ইনভাইটও করেনি মেয়েটাকে। তাও চলে এলো! আসলে ওকে দেখলেই তিলোত্তমা যেভাবে এসে গায়ে পড়ে, বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়, সেইসব একদমই পছন্দ না অর্জুনের। একটু যেন বেশিই ফ্রেন্ডলি হতে চায় ওর সাথে। তার মধ্যে মিস্টার চৌধুরী তো এক দুবার অর্জুনের সাথে তিলোত্তমার সম্বন্ধের কথাও বলেছে। এইসব শুনে তো অর্জুনের আরোও দূরে থাকতে ইচ্ছে করে এই মেয়েটার থেকে। একমাত্র মিস্টার চৌধুরীর সাথে বিজনেস রিলেশনের জন্য মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না। যাইহোক, সেদিন তিলোত্তমা অর্জুনের কাছে এসে বেশ অভিমানের সুরে বলেছিল,
———” কি ব্যাপার অর্জুন! আন্টির বার্থ ডে, আর তুমি আমাকেই ইনভাইট করতে ভুলে গেলে! এটা কি ঠিক হলো? ”
অর্জুন এই কথায় একটু ইতঃস্তত হয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
———” না আসলে এমন কিছু বড় পার্টি তো না! মায়ের কিছু বন্ধু এসেছে। ”
এই কথায় তিলোত্তমা বেশ বিগলিত স্বরে বললো,
———–” তো কি! আমি কি তোমাদের নিজের কেউ নই! এনিওয়েজ আমি জানি তুমি কত ব্যস্ত। তাই আমি কিছু মাইন্ড করিনি। চলো এবার আমাকে আন্টির কাছে নিয়ে চলো। সি, আমি কত গিফটস এনেছি আন্টির জন্য। ”
কথাটা বলেই তিলোত্তমা অর্জুনের হাতটা জড়িয়ে ধরলো। অর্জুনের এই মুহূর্ত থেকেই অস্বস্তি শুরু হলো। এই মেয়েটা নিজের লিমিট বোঝে না। কি অদ্ভুত! ইনভাইট না করা সত্ত্বেও চলে এসেছে! আবার সবার সামনে এইভাবে হাত জড়িয়ে ধরছে। কে কি ভাববে কে জানে! কথাটা ভেবেই অর্জুন আলতো করে ছাড়িয়ে নিল নিজের হাত। তারপর রুক্মিণীর কাছে নিয়ে এলো তিলোত্তমাকে। রুক্মিণীকে দেখেই তিলোত্তমা সব গিফ্টসগুলো রুক্মিণীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
———” আন্টি, হ্যাপি বার্থডে.. মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে.. দ্যাখো আমি তোমার জন্য শাড়ি, পারফিউম, পার্স আর একটা পার্ল সেট এনেছি। সব কটা টপ ব্র্যান্ডের। আমি পারসোনালি পছন্দ করেছি। আই হোপ তোমার ভালো লাগবে! আর যদি কিছু এক্সচেঞ্জ করতে হয়, দেন অলসো ইউ ক্যান টেল মি.. ”
এই কথায় রুক্মিণী দু সেকেন্ড চুপ ছিল। এই মেয়েটার এই একটা স্বভাব। কথায় কথায় নিজের ক্লাস, পয়সা না বোঝালে হয় না। কথাটা ভেবেই রুক্মিণী বললো,
———-” ও মা! এক্সচেঞ্জ কেন করতে যাবো! আর তুমি যদি আমাকে একটা দশ টাকার পেনও গিফ্ট করতে, সেটাও আমার কাছে অনেক দামি। কারণ তুমি সেটা ভালোবেসে আমাকে দিয়েছো। যাইহোক, খুব ভালো লাগলো তুমি এসেছ দেখে। ”

এই কথায় তিলোত্তমা আলতো হাসলো এই মুহূর্তে। আসলে অর্জুনকে এতটা পছন্দ না করলে এই মিডলক্লাস মেন্টালিটির মহিলার সাথে একটা শব্দও তিলোত্তমা বলতো না কখনো। শুধু অর্জুনের জন্য এইসব দেখনদারি। একবার অর্জুন বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিক। তারপর নিজের ক্লাস বুঝিয়ে দেবে এই মহিলাকে। কথাগুলো যেন নিজের মনেই বলে উঠলো তিলোত্তমা।
যাইহোক, সেদিন পার্টিতে এরপর একটা ঘটনা ঘটেছিল। সৌমী একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক এর গ্লাস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল মায়ের দিকে, তখনই আনমনে তিলোত্তমার সাথে ধাক্কা লাগে, আর ওর গ্লাস থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কটা ছলকে পড়ে তিলোত্তমার ড্রেসে। ব্যাস, কান্ডটা হতেই তিলোত্তমার মেজাজ সপ্তমে। ও পার্টি ভর্তি লোকের মাঝেই চেঁচিয়ে উঠলো,
———-” হাও ডেয়ার ইউ.. চোখে দেখতে পাও না? এইভাবে কেউ চলে! অন্ধ না কি! ”
কথাগুলো শুনে সৌমী একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠলো,
———” আই অ্যাম রিয়েলি সরি.. আমি আসলে বুঝতে পারিনি। ”
এই কথায় তিলোত্তমা আরো রেগে গিয়ে বললো,
————” সরি মাই ফুট.. ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া আমার এই ড্রেসটার দাম কত! ”
কথাটা শুনে সৌমীরও এবার পারদ চললো। অদ্ভুত মহিলা তো! একটা ছোট ব্যাপারের জন্য এত কথা শোনাচ্ছে! কথাগুলো ভেবেই সৌমী বললো,
———” আশ্চর্য! আপনি এইভাবে কথা বলছেন কেন! আর দোষ শুধু একা আমার না। আপনিও দেখে হাঁটতে পারতেন। ”
কথাটা তিলোত্তমার গায়ে লাগলো ভীষণ। ও এবার আরো রেগে গিয়ে বললো,
———-” মানে! তোমার সাহস কি করে হয় আমার সাথে এইভাবে কথা বলার! আনকালচারড স্টুপিড গার্ল.. দেখে তো মনে হচ্ছে কোনদিন এরকম পার্টিতে আসোনি। তাই এইরকম পার্টিতে কিভাবে বিহেভ করতে হয় জানো না। ”
সৌমী এই কথায় এবার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো ভীষণ তীক্ষ্ণ স্বরে,
———-” আর আপনি মানুষের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা জানেন না। ”
কথাটা শুনে তিলোত্তমা এবার তিন গুণ স্বরে অর্জুনকে ডেকে উঠলো। এই অপমান ওর কোনভাবেই সহ্য হচ্ছে না। একটা হেস্ত নেস্ত আজ করেই ছাড়বে। কথাটা ভেবেই অর্জুন আসতে বললো,
——–” এই মেয়েটার সাহস কি করে হয় আমার সাথে এইভাবে কথা বলার! একে তো কোল্ড ড্রিঙ্ক এর গ্লাস ফেলে আমার ড্রেস খারাপ করেছে। তারপর সরি বলার নাম নেই, উল্টে অপমান করছে! এত অভদ্র অসভ্য একটা মেয়ে। ”
কথাটা শুনে সৌমী এই মুহূর্তে দৃর গলায় বললো অর্জুনকে,
———-” অভদ্রতা প্রথমে উনি শুরু করেছেন স্যার, আমি না। একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে কেউ কিভাবে এত রিয়্যাক্ট করতে পারে আমি ভেবে পাচ্ছি না! ”
এই কথায় অর্জুন এই মুহূর্তে কি বলবে ভেবে পেল না। ও জানে তিলোত্তমার স্বভাব। তিল কে তাল করা। কিন্তু তিলোত্তমার বাবা ওদের বিজনেস পার্টনার। অনেক টাকার ইনভেস্টমেন্ট আছে ওনার কোম্পানিতে। তাই তিলোত্তমাকে একটু বুঝেই চলতে হয় অর্জুনের। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তিলোত্তমা বলে উঠলো,
——–” অনেক হয়েছে। ইনাফ ইজ ইনাফ.. আমি আর ইনসাল্ট সহ্য করতে পারছি না। হয় এই মেয়েটা আমাকে সরি বলবে, নইলে আমি এই পার্টিতেই থাকবো না। নট এনিমোর…”
কথাটা শুনে অর্জুন বুঝলো আসলে তিলোত্তমার ইগো ভীষণভাবে হার্ট হয়েছে। আর সৌমীর সরি না শুনে এই মেয়ে শান্ত হবে না। উল্টে সব গিয়ে নিজের বাবার কানে ঢালবে। আর মিস্টার চৌধুরী মেয়ের প্রেমে এমনই অন্ধ যে তিলোত্তমার ভুল তো দেখবেই না, উল্টে এর এফেক্ট বিজনেসে পড়বে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও সৌমীর কিছু বলার আগেই অর্জুন সৌমীর হাত ধরে আলাদা করে একটু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছিল,
———-” তুমি তো সেনসিটিভ.. একটা ব্যাপারকে এতটা বাড়তে দিও না। মিটিয়ে ফেল। ”
কথাটায় সৌমী বুঝেছিল অর্জুনের ঈশারাটা। সরি বলতে বলছে ওকে। আসলে সৌমী অবাক হয়নি। ওর তো মনে হয় এই তিলোত্তমা অর্জুন সব সমান। টাকার অহংকারে মত্ত। অর্জুনও যেমন লোককে অপমান করার আগে এক সেকেন্ড ভাবে না, ওনার বন্ধু তিলোত্তমাও তাই। তবে আজ সৌমীর কেমন সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। অনেক কথা সহ্য করেছে একটা চাকরির জন্য। তবে আজকের অপমানটা আর না। কথাটা ভেবেই সৌমী ভীষণ কঠিন গলায় বললো,
——-” সরি স্যার, কিন্তু আমি আপনার কথা মানতে পারবো না। আমি সরি বলবো না, কারণ আজ আমি কোন ভুল করিনি। যাইহোক, আমার জন্য আপনার গেস্টকে এই পার্টি ছেড়ে যেতে হবে না। বরং আমিই মা কে নিয়ে চলে যাচ্ছি। তাহলে আশা করি আর কোন সমস্যা থাকবে না। ”
কথাটা বলেই তিলোত্তমা অর্জুনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। তারপর ওর মায়ের হাত ধরে বলে উঠলো,
———” চলো এখান থেকে। আর এখানে থাকার কোন দরকার নেই। ”
কথাটা বলেই মায়ের হাত ধরে এগিয়ে গেল সৌমী দরজার দিকে। এটাই শেষ। আর এই বাড়িতে কখনো আসবে না জীবনে। যাওয়ার আগে কথাগুলো যেন মন থেকে বলে উঠলো সৌমী।
চলবে।