মন পলাশ পর্ব-০৫

0
64

#মন_পলাশ ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
বাড়ি ফেরার পথে সেদিন সারা রাস্তা জুড়ে সৌমী ভেবে যাচ্ছিল যদি এই চাকরিটা ও ছেড়ে দিতে পারতো! একটা অন্য কোন চাকরি যদি পেয়ে যেত হাতে, তাহলে এতটা অপমানের পর আবার ওই অফিসে ফিরে যেতে হতো না। মাঝে মাঝে নিজেকে এতটা অসহায় লাগে! এই সংসারের চাপ, টাকার চিন্তা এইসবের ভিড়ে নিজের আত্মসম্মান, খারাপ লাগা, কষ্টগুলোকে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে গিলে ফেলতে হয়। যাকে মানুষ হিসেবেই পছন্দ না, তার অধীনেই কাজ করে যেতে হবে চিরকাল। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আপনাআপনি একটা দীর্ঘশ্বাস চলে আসছিল! সেদিন তবে বাড়ি ফিরে এসে মোবাইলে নিজের মেল বক্সটা আনমনে চেক করে চমকে উঠেছিল সৌমী! মুখার্জি গ্রুপস অফ কোম্পানি থেকে একটা অফার লেটার এসেছে। কদিন আগে এখানেই চাকরির জন্য এপ্লাই করেছিল সৌমী। তার মানে সত্যিই একটা নতুন চাকরি পেল অবশেষে! মেলটা দেখে যেন বুক থেকে একটা পাথর নামলো। অফার লেটারে লেখা আছে সাতদিনের মধ্যে জয়েন করতে হবে। ওদের আর্জেন্ট এমপ্লই দরকার। লাইনটা পড়েই সৌমী সঙ্গে সঙ্গে নিজের রেজিগ্নেশন লেটারটা টাইপ করে ফেললো। এবার শুধু কাল অফিসে গিয়ে এটা জমা দিতে পারলেই গল্প শেষ। আর অর্জুন স্যার তো এমনিতেও ওকে পছন্দ করে না। চাকরিটাও তো শুধু মায়ের কথাতেই দিয়েছিল। তাই সৌমী অফিস ছেড়ে গেলে উনিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন।
পরেরদিন এই ভাবনার ভিড়েই বেশ নিশ্চিন্ত মনে সৌমী অফিসে এসেছিল নিজের রেজিগ্নেশন লেটার সমেত। তবে আজ সৌমীকে নিজের কেবিনে দেখে অর্জুন কিছুটা থমকে গেছিল। কাল ওইভাবে সৌমী নন্দিনী কাকিমাকে নিয়ে পার্টি থেকে চলে আসায় মা ভীষণ রেগে গেছে ওর ওপর। কাল থেকে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে অর্জুনের সাথে। আসলে অর্জুনও জানে দোষটা আসলে কার ছিল! তিলোত্তমা যে কতটা অহংকারী আর বদমেজাজী মেয়ে সেটা অর্জুন খুব ভালোভাবেই জানে, আর তিলোত্তমার স্বভাবই হচ্ছে তিলকে তাল করা। শুধু এই বিজনেসের কথা ভেবেই অর্জুন কাল চুপ ছিল। তিলোত্তমার বাবা বিজনেস পার্টনার না হলে অর্জুন মেয়েটার এই অসভ্যতা কখনোই সহ্য করতো না। কথাগুলো আনমনে ভাবছিল অর্জুন। তখনই সৌমী ব্যাগ থেকে নিজের রেজিগ্নেশন লেটারটা বার করে টেবিলে রেখে বলেছিল,
——–” স্যার আমি রিজাইন করছি। আমি এই চাকরিটা ছাড়তে চাই। এই যে আমার রেজিগ্নেশন লেটার..”
কথাটা শুনে অর্জুন কেমন আকাশ থেকে পড়েছিল। ও বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেছিল,
———” রিজাইন করবে! জানতে পারি কেন? ”
এই প্রশ্নটায় সৌমী নিজে বেশ অবাক হয়েছিল। ও তো ভেবেছিল অর্জুন স্যার এই লেটারটা দেখে বেশ খুশি মনে একসেপ্ট করে নেবে। কিন্তু সেসব না হয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করছে কেন! কথাটা ভাবতে ভাবতেই সৌমী অল্প চিন্তা করে বললো,
———” স্যার কারণটা পার্সোনাল। ”
অর্জুন এই উত্তরে বুঝেছিল সৌমী প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছে। আসলে কালকের ঘটনার জন্যই কি মেয়েটা রিজাইন করছে! তবে কি জানি কেন অর্জুন কিছুতেই এটা মানতে পারলো না। তাই সাথে সাথেই বলে উঠলো,
———-” এইভাবে তো তুমি রিজাইন করতে পারবে না। রিজাইন করার মিনিমাম ছ মাস আগে তোমাকে একটা নোটিশ দিতে হবে। এর মধ্যে যদি কোম্পানি তোমার অল্টারনেটিভ কাউকে খুঁজে পায় তাহলেই এই রেজিগ্নিশন লেটারটা একসেপ্ট করা হবে। এই কন্ডিশনটা তোমার জয়েন করার সময় কনট্র্যাক্ট পেপারে লেখা ছিল। ”
কথাগুলো বেশ স্থির গলায় বললো অর্জুন। কিন্তু সৌমী এইসব শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। আসলে জয়েন করার সময় এই চাকরিটার এত দরকার ছিল যে কোন কিছু না পড়েই সাইন করে দিয়েছিল কনট্র্যাক্ট পেপার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সৌমী ভীষণ অস্থির গলায় বললো,
——–” কিন্তু স্যার আপনি তো আমাকে এই অফিসে কখনো রাখতেই চাননি। শুধু আপনার মায়ের কথা রাখার জন্য চাকরিটা দিয়েছিলেন। আর আমি এই অফিস ছেড়ে চলে গেলে তো সব সমস্যাই মিটে যাবে। ”
কথাগুলো কেমন কাতর স্বরে বললো সৌমী। কিন্তু অর্জুন এর উত্তরে মনে মনে বলে উঠেছিল ” আমার আর কোন সমস্যা নেই তোমাকে নিয়ে। বরং আমি তো চাই তুমি এই অফিসেই থেকে যাও। তোমার মতন হার্ড ওয়ার্কিং এমপ্লইর দরকার আছে এই অফিসে। ”
কিন্তু কথাগুলো সাজিয়ে আর বলতে পারেনি অর্জুন। ছোটবেলা থেকে ইন্ট্রোভার্ট নেচারের জন্য অর্ধেক কথা যাকে বলার ইচ্ছে হয় তাকে কোনভাবে বলাই হয় না! ভাবনাগুলো কেমন মনের আড়ালেই থেকে যায়। কথাটা ভাবতে ভাবতেই অর্জুন বললো সেই স্থির স্বরে,
———” আমি কোম্পানির রুলস এন্ড রেগুলেশন এর এগেনস্ট এ যাবো না, তাই কোনভাবেই এই রেজিগ্নেশন লেটারটা আমি একসেপ্ট করতে পারবো না। এর থেকে বেশী আর আমার কিছুই বলার নেই। ইউ ক্যান লিভ নাও.. ”
কথাটায় সৌমীও এবার চুপ করে গেল। এই অফিস থেকে এত সহজে মুক্তি নেই ওর! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাগে কিরকম দিশেহারা হয়ে নিজের ডেস্কে এসে বসেছিল সৌমী। কেমন নিজের মনেই গজগজ করে বলছিল,
——–” শান্তি নেই জীবনে। এত সাধ্য সাধনার পর একটা নতুন চাকরি পেলাম! কিন্তু সেটাও এই লোকটার সহ্য হলো না। জোর করে আটকে রাখবে এই অফিসে। ”
কথাগুলো কেমন নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল সৌমী, তখনই পাশ থেকে একটা খুব চেনা গলার স্বর কানে এলো,
———-” এনি প্রব্লেম? কার ওপর এত রেগে আছো? ”
প্রশ্নটা শুনে সৌমী পাশে তাকাতেই অবাক। সেই ইউনিভার্সিটির চেনা রোহিতদা! ওর থেকে এক বছরের সিনিয়র ছিল। আর ইউনিভার্সিটি লাইফের ভীষণ ভালো বন্ধু। কিন্তু রোহিতদা এখানে কি করছে! কথাটা ভেবেই জিজ্ঞেস করে উঠলো,
———” রোহিতদা! তুমি এখানে? ”
এই প্রশ্নে রোহিত সাথে সাথেই বললো,
———-” আজই জয়েন করেছি। নতুন চাকরি, কাউকে চিনি না। তারপরই তোকে আসতে দেখলাম। তুই যদিও আমাকে খেয়াল করিসনি সেই সময়। যাইহোক, এবার বল এরকম আপসেট লাগছে কেন তোকে? ”
এই কথায় সৌমী একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বললো,
———-” আর আপসেট লাগছে কেন! এখানকার যে বস, সে আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না তাই। ওই মিস্টার অর্জুন, ভীষণ অহংকারী আর মেজাজি লোক। কারণে অকারণে কথা শোনানোটাই ওনার হবি। আর ওনার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই আমি এতদিন ধরে অন্য চাকরি খুঁজছিলাম। আর আমি অবশেষে জোগাড়ও করে ফেলেছিলাম একটা নতুন চাকরির। কিন্তু অর্জুন স্যার আজ আমার রেজিগনেশন লেটারটা অব্দি একসেপ্ট করলো না। বলে না কি চাকরি ছাড়ার আগে ছ মাসের নোটিশ দিতে হবে! এইসব ভেবেই আমার কান্না পাচ্ছে এখন। ”
কথাগুলো কেমন এক নিঃশ্বাসে বলে গেল সৌমী। তবে রোহিত এবার ওকে শান্ত করে বললো,
——–” কেঁদে কোন লাভ আছে! আর যা হয় ভালোর জন্যই হয় জানবি। তোর নতুন চাকরির বস যে একই রকম হবে না এর কোন গ্যারেন্টি আছে! যাইহোক, আরো কিছুদিন সময় দে এই অফিসটাকে। দেখবি, সব এডজাস্ট হয়ে গেছে। আর এখন তো আমিও আছি। তোর একা লাগবে না আর এখানে। ”
কথাগুলো হাসি মুখে বললো রোহিত। এইসব শুনে সৌমীর মুখেও আলতো হাসি। সত্যিই রোহিতদা আসার পর আর হয়তো একা লাগবে না এই অফিসে ওর। এমনিও ইউনিভার্সিটির দিনগুলোতে নোটস বোঝানো থেকে প্রজেক্ট জমা দেয়া, আর সেই ক্যান্টিনে আড্ডা, সব কিছুতে সঙ্গী ছিল এই রোহিতদা। কথাগুলো সৌমীর মনে পড়ে গেল হঠাৎ। মনে পড়ে গেল অনেকের ভিড়ে সৌমী সব থেকে বেশি ভরসা করতো এই রোহিতের ওপরই। তারপর কিছুদিনের জন্য যোগাযোগ না থাকলেও আবার এই অফিসে দেখা হয়ে নতুন একটা গল্প শুরু হলো হয়তো! এবার এই অফিসটাকে এই মানুষটার জন্য নতুন করে ভালো লাগলেও লাগতে পারে!

<১০>
এই এলোমেলো চিন্তার মাঝেই কয়েকটা দিন কেটে গেল। সৌমীর অফিস আসতে এখন সত্যি ভালো লাগে আসলে, কারণ এই অফিসে কথা বলার মত একটা নতুন লোক খুঁজে পেয়েছে হঠাৎ। রোহিতের সাথে কাজ করা, কাজের ফাঁকে গল্প করা, একসাথে টিফিন শেয়ার করা, তারপর অফিস শেষে একই বাসে গল্প করতে করতে ফেরা, এইভাবে দিনটা যে কিভাবে চোখের পলকে কেটে যায়, সৌমী বুঝতেই পারে না! তাই অফিস আসতেও খারাপ লাগে না এখন। আসলে একজন পজিটিভ মানুষের সাথে থাকলে আশেপাশের সব নেগেটিভিটি ভুলে যাওয়া যায়। এই কথাগুলোই মনে হয় আজকাল খুব, তাই মনটাও ভালো থাকে বেশ।
কিন্তু এই ভালোর মাঝেও একটা ঘটনা ঘটলো সেদিন। লাঞ্চ টাইমে সৌমী আজ বাড়ি থেকে পরোটা আর আলুর দম এনেছিল। এটা আবার রোহিতের খুব পছন্দ। তাই বেশ আনন্দ করেই ক্যান্টিনে বসে খাচ্ছিল দুজন, আর হারিয়ে যাচ্ছিল সেই ইউনিভার্সিটি লাইফের সময়টায়। তখনও সৌমী মাঝে মাঝে টিফিনে এই পরোটা আলুর দম আনতো, আর রোহিতের এর থেকে ভাগ চাইই প্রত্যেকবার। এর জন্য মাঝে মাঝে ক্লাসও মিস করতো ছেলেটা। এই কথাগুলো বলতে বলতেই বেশ হাসাহাসি করছিল দুজনে। কিন্তু ওরা খেয়াল করেনি এই মুহূর্তে অর্জুন দরজার কাঁচের ওপার থেকে হঠাৎ থমকে দেখছে ওদের। আসলে অর্জুন সেই মুহূর্তে নিজের কেবিনে যাচ্ছিল কিছু ফাইল হাতে, তবে হঠাৎ স্থির হয়ে গেছিল কাঁচের দরজার ওপাশে থাকা ক্যান্টিনের দিকে তাকিয়ে। সৌমী এই নতুন আসা ছেলেটার সাথে টিফিন খাচ্ছে! তার ওপরে এত হেসে হেসে কথা বলছে, গল্প করছে! হঠাৎ কি হলো মেয়েটার! এতদিন তো অফিসে বেশ চুপচাপ থাকতো। অর্জুন খেয়াল করেছে দরকার ছাড়া খুব বেশি কারোর সাথে কথা বলতো না মেয়েটা। তাহলে আজ কি হলো! এই কদিনের আসা ছেলেটার সাথে এত কিসের বন্ধুত্ব! সেদিন জানে না কেন অর্জুনের এই এলোমেলো চিন্তাগুলোই হঠাৎ এসে ভিড় করেছিল মাথায়, আর আস্তে আস্তে কিরকম হালকা রাগ আর বিরক্তি এসে জমা হয়েছিল যেন। কে এই ছেলেটা! আর সৌমীর সাথে এত বন্ধুত্ত্ব এত কথাই বা কিসের! এটাই মনে হচ্ছিল বেহিসেবী ভাবে, আর রাগ হচ্ছিল কেমন।
সেদিন কেবিনে এসেই অর্জুন সৌমীকে ডেকে পাঠিয়েছিল। তারপর ভীষণ রুক্ষ ভাবেই বলেছিল হঠাৎ,
——–” তোমাকে যে মন্থলি বাজেটটা বানাতে বলেছিলাম সেটা হয়েছে? ”
এই কথায় সৌমী বেশ অবাক হয়ে বলেছিল,
——–” স্যার, ওটা তো আপনি আজ সকালেই বানাতে বলেছিলেন! এত তাড়াতাড়ি কি করে! ”
ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই অর্জুন এবার বলে উঠলো বেশ ঝাঁঝালো স্বরে,
——–” সেই। সেটা রেডি হবে কেন! অফিসে এসে যদি হাসি ঠাট্টা গল্প ইয়ার্কিতেই সব টাইম চলে যায়, তাহলে বাকি কাজ আর হবে কি করে! তুমি মনে হয় ভুলে গেছ, এটা একটা অফিস। বন্ধুর সাথে আড্ডা দেয়ার জায়গা নয়। ”
কথাটা ভীষণ কানে লাগলো সৌমীর। ও এই মুহূর্তে সত্যিই বুঝতে পারলো না যে কি এমন অপরাধ করেছে যার জন্য এতগুলো কথা শুনতে হচ্ছে হঠাৎ! না কি এই অফিসে চাকরি করাটাই ওর সব থেকে বড় অপরাধ! এই লোকটা মাস গেলে কটা টাকা মাইনে দিচ্ছে বলে যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অর্জুন আবার বলে উঠলো, ———-” মন্থলি বাজেটটা আমার আজই চাই। ইউ মে লিভ নাও..”
কথাটায় সৌমী আর কোন কথা না বাড়িয়ে খুব জোড়ে পা চালিয়ে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। রাগে অপমানে সারা শরীর কাঁপছে এখন। মনে হচ্ছে এক্ষুনি এই অফিসটা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে কোথাও। কিন্তু হাত পা যে বাঁধা। এখনো তিন মাস বাকি কনট্র্যাক্ট অনুযায়ী। তার আগে এই লোকটার থেকে মুক্তি নেই। কথাগুলো ভেবেই নিজের ডেস্কে বসে মাথাটা ঠান্ডা করে কাজে মন দিল। যেভাবেই হোক পুরো বাজেট শেষ করতে হবে আজকে। মনে হয় সারা রাত অফিসেই থেকে যেতে হবে আজ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ফাইলের পাতায় চোখ দিল।
কিন্তু অর্জুনের কিছুক্ষণ বাদে মাথাটা ঠান্ডা হতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল নিজের ব্যবহারের কথা সৌমীর সাথে। হঠাৎ এতটা রুড হয়ে গেল কি করে ও মেয়েটার সাথে! কথাটা যেন ভীষণ ভাবে মনে হতে শুরু করলো এই মুহূর্তে। সৌমী তো লাঞ্চ টাইমেই ক্যান্টিনে বসে ওই অফিসের নতুন ছেলেটার সাথে কথা বলছিল, ওয়ার্কিং আওয়ার্স এ তো না। আর সৌমী নিজের কাজের ব্যাপারে খুবই এফিশিয়েন্ট, এটা অন্তত অর্জুন এতদিনে হাজারবার বুঝেছে। তাহলে কেন এতটা রিয়্যাক্ট করলো আজ! না কি ওই ছেলেটার সাথে সৌমীর কথা বলাটা অর্জুনের পছন্দ হয়নি একদম! কিন্তু অদ্ভুত তো। সেটা কেন হবে! সৌমী যার সাথে খুশি কথা বলতে পারে। গল্প করতে পারে। তাতে অর্জুনের কি! কথাগুলো যেন জোর করেই ভাবার চেষ্টা করছিল অর্জুন। যাইহোক, তারপর ধীরে ধীরে নিজের কাজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা। এরপর বেশ কয়েক ঘন্টা বাদে ঘড়িতে যখন রাত সাড়ে নটা, তখন কাজ শেষ হয়েছিল অবশেষে অর্জুনের। বেশ ক্লান্ত লাগছিল আজ। তাই বাড়ি যাবার জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেই থমকে গেছিল হঠাৎ। উল্টো দিকের ফাঁকা অফিসের এক কোণে নিজের ডেস্কে বসে এক মনে কাজ করে যাচ্ছে সৌমী। দৃশ্যটা দেখেই অর্জুনের মনে পড়ে গেছিল আজ সকালের কথাগুলো। ইশ, ও রাগের মাথায় সারা মাসের বাজেট একদিনে রেডি করে জমা দিতে বলেছে সৌমীকে! তাই মেয়েটা এতক্ষণ অব্দি অফিসে বসে কাজ করে যাচ্ছে একা! কথাটা মনে হতেই নিজের ওপরই রাগ হয়েছিল অর্জুনের। ও মনে হয় আজ অনেক বেশি কথা শুনিয়ে ফেলেছে মেয়েটাকে। কথাটা ভেবেই অর্জুন নিজে গেছিল সৌমীর কাছে। তবে সৌমী অর্জুনকে খেয়াল করতেই ওর কিছু বলার আগে নিজেই বলে উঠেছিল,
———-” স্যার আর এক ঘন্টা টাইম দিন। আমার ততক্ষণে কাজটা কমপ্লিট হয়ে যাবে। আমি আজকের মধ্যেই জমা দিয়ে দেব বাজেট। ”
এই কথায় অর্জুন সাথে সাথেই বলেছিল বেশ নরম গলায়,
———” কোন দরকার নেই আর কাজ করার। অনেক রাত হয়েছে। তুমি রাখো এইসব। যা পেন্ডিং আছে, কাল করবে। প্লিজ.. ”
সৌমী অর্জুনের মুখে এই প্লিজ কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়েছিল যেন। আসলে এরকম অহংকারী লোকের মুখে এইসব শব্দ ঠিক মানায় না। যাইহোক, তবে এই লোকটার সাথে দরকারের বেশি একটা শব্দও বলতে ইচ্ছে করে না, তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে বলেছিল,
——–” ঠিক আছে স্যার। ”
তারপর ফাইলগুলো বন্ধ করে নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ডেস্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিল যাওয়ার জন্য। তবে এই মুহূর্তে অর্জুন হঠাৎ নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———” আজ আমি আসলে একটু ডিস্টার্বড ছিলাম। সেই জন্য অনেক রুডলি কথা বলে ফেলেছি তোমার সাথে। আমার ওইভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। আর বাজেট এক সপ্তাহের মধ্যে জমা দিলেই হবে। টেক ইওর টাইম.. ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অর্জুন। কিন্তু সৌমী বুঝতে পারছিল না, হঠাৎ নিজের খারাপ ব্যবহারের জন্য এক্সপ্লিনেশন কেন দিচ্ছে লোকটা! কে জানে! বড়লোকরা হয়তো এরকমই হয়। নিজের খেয়াল আর মর্জিতে চলে। যখন যা মনে হবে তাই ব্যবহার করবে। কথাটা ভেবেই সৌমী বলে উঠলো এই মুহূর্তে ভীষণ ধীর স্বরে,
———-” ঠিক আছে স্যার। আপনি আমাকে মাইনে দিয়ে রেখেছেন। যখন যা ইচ্ছে তাই বলতেই পারেন। আর তো তিন মাস। তারপর আর আমার মতন ইনএফিশিয়েন্ট এম্প্লইকে রাখতে হবে না এই অফিসে। আসছি। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে সৌমী আর দাঁড়ালো না। জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে এলো অর্জুনের সামনে থেকে। কিন্তু অর্জুন কেমন চুপ হয়ে রইলো হঠাৎ। মেয়েটাকে কি এতদিনে রাগের মাথায় কারণে অকারণে অনেক বেশি কিছু বলে ফেলেছে! তাই সৌমী কি খুব খারাপ মানুষ ভাবে অর্জুনকে! কথাটা যেন আচমকা মনে হলো হঠাৎ আর কেমন অস্থির লাগলো মনটা।
চলবে।