মন পলাশ পর্ব-১০

0
69

#মন_পলাশ ( দশম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৯>
সেদিন গাড়িতে যেতে যেতে সৌমী নিস্পলক দৃষ্টিতে দেখছিল রাতের কলকাতাকে। এখন জায়গায় জায়গায় প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে। চারিদিকে একটা হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। সৌমীর এইসব দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। এই সময়েই গাড়িটা একটা সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল। সৌমী এই মুহূর্তে আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, তখনই গাড়ির জানলার কাঁচের ওপাশে হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ে কিছু গোলাপ হাতে এসে বললো,
————” দিদি,একটা গোলাপ নাও না গো। আজ একটাও ফুল বিক্রি হয়নি। কিচ্ছু খাইনি সকাল থেকে। একটা গোলাপ দশ টাকা মাত্র। ”
কথাগুলো শুনে সৌমীর মনটা ভিজে গেল। আহা, বাচ্চা মেয়ে! মুখটা শুকিয়ে গেছে পুরো। কথাটা ভেবেই নিজের পার্স থেকে টাকা বার করতে যাবে গোলাপ কেনার জন্য, তখনই অর্জুন বাচ্চা মেয়েটার হাতে দুশো টাকা দিয়ে বললো,
———–” একটা না, সব গুলো গোলাপ দিয়ে দাও। ”
কথাটা শুনে বাচ্চাটার সাথে সাথে সৌমীও ভীষণ অবাক হয়েছিল। বাচ্চাটা তো খুশিতে উজ্জ্বল মুখে বলেছিল,
———” সব কটা গোলাপ! তুমি সব কিনে নেবে? সত্যি! ”
এই কথায় অর্জুন আলতো হেসেছিল। তারপর গোলাপ গুলো নিয়ে সৌমীর হাতে দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সৌমী এই সময় মনে মনে বুঝেছিল, মানুষটার বাইরের খোলসটা হয়তো খুব কঠিন, কিন্তু ভিতরে একটা নরম মন আছে, যে অন্যের কথা ভাবে।
যাইহোক, সেদিন এরপর সৌমী অর্জুনের বাড়ি এসেছিল। রুক্মিণী নিজে হাত ধরে ওকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। এই ঘরটাকে রুক্মিণীই রেডি করে রেখেছিল সৌমীর থাকার জন্য। যদিও এত বড় বাড়িতে থাকতে সৌমীর বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। নিজেকে ভীষণ বেমানান লাগছিল এখানে। সেদিন রাতে তো ঘুমই আসতে চাইছিল না সৌমীর।

যাইহোক, পরেরদিন সকাল ছিল রবিবার। সৌমী ঘুম থেকে উঠে নিচে ড্রইং রুমে গিয়ে দেখে রুক্মিণী কাকিমা রান্নাঘরে। সবজি কাটছে। সৌমী এই মুহুর্তে রান্নাঘরে যেতে রুক্মিণী ওকে জিজ্ঞেস করে উঠলো হাসি মুখে,
———- ” কি খাবি বল? কি তোর পছন্দ? ”
এই কথায় সৌমী বেশ চিন্তা নিয়ে বললো,
———–” তুমি রান্না করবে না কি! তোমার তো শ্বাস কষ্টের প্রব্লেম আছে। রান্নাঘরে কাজ করা বারণ। মায়ের মুখে শুনেছি। ”
এই কথায় রুক্মিণী আলতো হেসে বললো,
———–” ধুর। একদিন রান্না করলে কিছু হবে না। আজ আসলে আমার রান্নার মাসী কাবেরী আসেনি। তাই আমিই চলে এলাম রান্না করতে। ”
কথাগুলো শুনে সৌমী এবার কাছে গিয়ে রুক্মিণীর ওপর বেশ জোর খাটিয়ে বললো,
———–” রাখো এইসব। একদম তোমার রান্না করার দরকার নেই। আমি আছি কি করতে! আমি আজ রান্না করবো। তুমি ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। ”
কথাগুলো শুনে রুক্মিণী না না করে উঠে বললো,
————” পাগল তুই! কদিনের জন্য আমার বাড়িতে এসেছিস। আর আমি তোকে দিয়ে রান্না করাবো! ”
এই কথায় সৌমী আরো জোর খাটিয়ে বললো,
———-” আমি কি কোন অচেনা কেউ না কি! আর তুমি কষ্ট করে রান্না করবে, আর আমি বসে বসে খাবো, এটাও সম্ভব না। যাইহোক, আমি কিছু শুনতে চাই না আর। তুমি ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। এদিকে আমি সব সামলে নিচ্ছি। ”
কথাগুলো সৌমী এমন অর্ডারের সুরে বললো যে রুক্মিণী আর না করতে পারলো না। সত্যি, মেয়েটা বড্ড চিন্তা করে ওকে নিয়ে। যাইহোক সেদিন এরপর রুক্মিণী বাধ্য মেয়ের মতন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সৌমী এরপর নিজের মতন করে রান্না শুরু করেছিল।

কিন্তু সেদিন ডাইনিং টেবিলে খাবার সার্ভ করে সৌমী বেশ চিন্তার মধ্যেই ছিল। আসলে রুক্মিণী কাকিমা তো নিজের। খারাপ হলেও হাসি মুখে খেয়ে নেবে। কিন্তু অর্জুন স্যার! ওই মানুষটাকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছিল। যাইহোক, সেদিন অর্জুন খেতে এসে চিকেন মুখে দিয়ে বেশ অবাক হয়ে বললো মা কে,
———-” কাবেরী মাসীর রান্নার হাত কবে থেকে এত ভালো হলো মা! এরকম টেস্ট তো আগে কখনো করেনি! ”
এই কথায় সৌমীর মুখে হাসি। একটু যেন নিশ্চিন্ত হয়েছিল এটা শুনে। তবে রুক্মিণী এই মুহূর্তে বলে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে,
———-” আজকের রান্না তো কাবেরী করেনি। সৌমী করেছে। কাবেরী তো আজ কাজেই আসেনি। আর সেটা শুনে সৌমী আমাকে কিছুতেই রান্না করতে দিল না। নিজে হাতেই করলো সব। ”
এই কথায় অর্জুন যেন থমকে গেল কয়েক সেকেন্ড। তারপর নিজের মনেই বলে উঠলো,
———-” রান্নাটা সত্যি খুব ভালো হয়েছে। ”

যাইহোক, সেদিন সন্ধ্যেবেলা অর্জুন স্টাডিতে কাজ করে করে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। ওর এই মুহূর্তে কফির দরকার খুব। অন্যদিন হলে কাবেরী মাসীকে বলে দেয়। কিন্তু আজ তো সেই সুযোগ নেই। তাই নিজেই গেল রান্নাঘরে। এরপর ইলেকট্রিক ক্যাটেলটা চোখে পড়তে শান্তি হলো মনে। আসলে অর্জুন গ্যাস জ্বালাতে পারে না। যাইহোক, ইলেকট্রিক ক্যাটেলে জল গরম করে নেবে। আর কোন চাপ নেই। ভেবেই জল বসালো ক্যাটেলে। কিন্তু সুইচ অন করতেই কেস। ইলেকট্রিক ক্যাটেল আর চলে না! অর্জুন এদিক ওদিক করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেষ্টা করলো। কিন্তু কোন সুরাহা হলো না। ইলেকট্রিক ক্যাটেলটা খারাপই হয়ে গেছে তার মানে। এদিকে মা ও তো বেরিয়েছে পুজোর কেনাকাটা করতে। তাহলে এখন কাকে কফি করতে বলবে! ভাবতে ভাবতে একজনের কথাই মাথায় এলো। সৌমী বাড়িতে আছে। ওকে গিয়েই তাহলে! আসলে মাথাটাও খুব ধরেছে। এখন এক কাপ কফির ভীষণ দরকার অর্জুনের। এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই অর্জুন সৌমীর ঘরে গিয়ে নক করলো। সৌমী সেই মুহূর্তে একটা গল্পের বই পড়ছিল মন দিয়ে। হঠাৎ অর্জুনকে দেখে ও হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। অর্জুন এই সময় বলে উঠলো,
——–” ভিতরে আসতে পারি? ”
এই প্রশ্নে সৌমী সাথে সাথেই বলে উঠলো,
———” স্যার, আপনারই তো বাড়ি। প্লিজ ভিতরে আসুন। জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। ”
এই কথায় অর্জুন ভিতরে এসে কিছুটা ইতঃস্তত স্বরে বলে উঠলো,
———-” আসলে একটা কথা ছিল। মানে তুমি যদি ব্যস্ত থাকো, তাহলে ইটস ওকে.. নইলে! ”
অর্জুনের এই কথায় সৌমী কিছু না বুঝতে পেরেই বললো,
———-” স্যার কি কথা? প্লিজ বলুন। কি হয়েছে? ”
এই প্রশ্নে অর্জুন সেই ইতঃস্তত স্বরেই বললো,
———–” আসলে আমার মাথাটা খুব ধরেছে। আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে দেবে প্লিজ. আমি আসলে নিজেই করে নিতাম, কিন্তু ইলেকট্রিক ক্যাটেলটা খারাপ হয়ে গেছে। আর আমি গ্যাস জ্বালাতে পারি না। ”
শেষ কথাটা বেশ লাজুক মুখে থেমে থেমে বললো অর্জুন। কিন্তু এইসব শুনে সৌমী সাথে সাথেই বলে উঠলো,
———–” স্যার আপনি এইভাবে কেন বলছেন! আমি নিশ্চয়ই করে দেব। আমি এক্ষুনি বানিয়ে আনছি। ”
কথাটা বলেই সৌমী রান্নাঘরের দিকে এগোলো। অর্জুনও সেই মুহূর্তে সৌমীর সাথেই রান্নাঘরে এলো। তারপর আস্তে গলায় বলে উঠলো,
———” আমাকে একটু শিখিয়ে দেবে গ্যাস কি করে অন করে! আসলে এটা জেনে রাখা দরকার। আজ মনে হচ্ছে। তবে প্লিজ এই কথাটা অফিসে কাউকে বলবে না। মানে এত বড় একটা কোম্পানি চালাই কিন্তু গ্যাস জ্বালাতে পারি না, এটা শুনে লোকে যে কি ভাববে! ”
কথাগুলো আপন মনেই বলে গেল অর্জুন। কিন্তু এইসব শুনে সৌমী খুব সহজভাবেই বললো,
———” সবাই সব পারবে এর তো কোন মানে নেই। আবার আপনি যেটা পারেন, সেটা হয়তো অনেকে পারে না! যাইহোক, ডোন্ট ওরি স্যার,আমি কাউকে কিছু বলবো না। ”
কথাটা বলে সেদিন সৌমী অর্জুন কে গ্যাস অন করতে শিখিয়ে দিয়েছিল। এরপর অর্জুনের জন্য কফি বানিয়ে ওর হাতে দিয়ে সৌমী চলে যাচ্ছিল নিজের ঘরে, তখনই অর্জুন বলে উঠলো নিজে থেকে,
———” থ্যাঙ্ক ইউ.. আর কফিটা সত্যিই খুব ভালো হয়েছে। ইভেন আজকের চিকেনটাও । খুব সুন্দর হয়েছিল। ”
এই কথায় সৌমী ভীষণ খুশি হয়ে বলে উঠেছিল,
———” আপনার ভালো লেগেছে! থ্যাঙ্ক ইউ স্যার..”
এই কথায় অর্জুন হঠাৎ অন্য একটা কথা বলে উঠলো সৌমীকে।
———-” এটা বাড়ি। অফিস না। এখানে সব কথায় এত স্যার স্যার বলার দরকার নেই আমাকে। কল মি অর্জুন। ”
এই কথায় সৌমী তো যেন আকাশ থেকে পড়েছিল! কি বলবে ঠিক বুঝতেই পারেনি প্রথমে, তাই কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ঘাড় নেড়ে বলেছিল
———” ঠিক আছে স্যার। সরি, মানে অর্জুন। আসছি আমি। ”
কথাটা বলেই জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে এসেছিল অর্জুনের সামনে থেকে। আর কথা বাড়ানোর সুযোগই দেয়নি আসলে।
<২০>
যাইহোক, সেদিনের পর আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। অর্জুন একটা শাড়ির প্যাকেট নিয়ে হঠাৎ এসেছিল সৌমীর ঘরে। সৌমী সেই মুহূর্তে অফিস থেকে ফিরে কিছুটা ক্লান্ত শরীরে বসেছিল। তবে অর্জুনকে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গে। সেই মুহূর্তে অর্জুন আবার বলে উঠলো শান্ত স্বরে,
——–” সৌমী এটা অফিস না। তোমার আমাকে দেখলেই উঠে দাঁড়ানোর দরকার নেই। ”
এই কথায় সৌমী সাথে সাথেই বলে উঠলো,
——–” না না, সেরকম কিছু না। আপনি বলুন। কিছু দরকার ছিল? ,”
এই কথায় অর্জুন একটু অগোছালো হয়ে বললো,
———-” না। দরকার ঠিক না। আসলে একটা জিনিস দেয়ার ছিল। ”
কথাটা বলেই শাড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে দিল সৌমীর দিকে। তারপর সেই কিন্তু কিন্তু করেই বললো,
———” এটা তোমার জন্য। তুমি পড়লে আমার ভালো লাগবে। ”
কথাটা বলেই আর কিছু শোনার অপেক্ষা না করে অর্জুন ঘরটা খালি করে চলে গেছিল সেই মুহূর্তে। কিন্তু সৌমী সত্যিই কিছু বুঝতে পারেনি এই সময়। ও বেশ অবাক হয়েই প্যাকেটটা খুলে দেখেছিল এরপর, আর থমকে গেছিল হঠাৎ। সেই সেদিন রুক্মিণী কাকিমার জন্য শাড়ি পছন্দ করতে গিয়ে যেই শো কেসে রাখা শাড়িটা ওর খুব পছন্দ হয়েছিল, সেটা এই বাক্সতে কি করছে! তার মানে কি অর্জুন এই শাড়িটা ওর জন্য কিনেছে! কিন্তু কেন! এত দামী শাড়ি অর্জুন কেন দিল ওকে! আর জানলোই বা কি করে এই শাড়িটা সৌমীর পছন্দ ছিল! সব যেন কিরকম হিসেবের বাইরে লাগছিল আজ।
যাইহোক, এরপরের দিন অফিস শেষে ফেরার পথে অর্জুন নিজে থেকে এসে বলেছিল সৌমীকে,
———-” বাসে যাওয়ার দরকার নেই আর। একই বাড়িতে তো ফিরবো। একসাথেই যাই। ”
এই কথায় সৌমী আর না বলতে পারেনি। অর্জুনের সাথেই এগিয়ে গিয়েছিল গাড়ির দিকে। তবে সেদিন ড্রাইভ করতে করতে অর্জুন নিজের মনেই বলে উঠলো,
———” মাথাটা খুব ধরেছে। ডু ইউ মাইন্ড, যদি আমি এক কাপ কফি খাই?”
এই কথায় সৌমী সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো,
——-” এ বাবা! না না। মাইন্ড করবো কেন! ”
এই কথায় অর্জুন গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য একটা রাস্তা ধরেছিল। সৌমী তবে মনে মনে ভাবছিল নিশ্চয়ই কোন বড় ক্যাফেতে গিয়ে দাঁড়াবে অর্জুন। এক একটা চা কফির দামই হয়তো তিনশো চারশো হবে! সৌমীর তো ওরকম হাইফাই জায়গায় গেলে বেশ অস্বস্তি হয় যেন। এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই সৌমীর ভাবনাকে একেবারে মিথ্যে করে অর্জুন একটা ছোট্ট চা কফির দোকানে গাড়িটাকে দাঁড় করালো। তারপর হাসি মুখে বললো,
——–” অনন্তদার দোকান। সেই কলেজ লাইফ থেকে আসি এখানে। এখানকার চা কফির স্বাদই আলাদা। তুমিও খেয়ে দ্যাখো, ভালো লাগবে। ”
কথাটা বলেই ও গাড়ি থেকে নেমে গেছিল। তবে সৌমী যেন এই মুহূর্তে সত্যিই ঠিক মেলাতে পারছিল না কিছু। এত বড় বিজনেস ম্যান, আর এখানে আসে চা কফি খেতে! কোন রকম দেখনদারি নেই! ভেবেই কেমন অন্য রকম লাগছিল অর্জুনকে। যাইহোক, সেদিন এরপর দু কাপ কফি খেয়ে ওরা বেরিয়ে এসেছিল দোকান থেকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে হঠাৎ অর্জুনের ফোন বেজে উঠলো। সৌমী খেয়াল করলো ফোনটা ধরে কিছু একটা শুনে অর্জুন বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো,
———” কি! মিষ্টি দিদার বুকে ব্যাথা হচ্ছে! ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না? আমি এক্ষুনি আসছি। ”
কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দিল। তারপর সৌমীকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলে উঠলো,
———–” আমাকে এক্ষুনি একটা জায়গায় যেতে হবে। একটা ইমারজেন্সি সিচুয়েশন হয়েছে। বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। কিন্তু তুমি চাইলে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারো। ”
এই কথায় সৌমী স্থির গলায়ই বললো,
———” না, আমি আপনার সাথেই যাবো। আমি বুঝতে পারছি কারোর একটা শরীর খারাপ হয়েছে। ”
এই কথায় অর্জুন আর কথা বাড়ালো না। গাড়িটাকে মেন রাস্তার দিকে ঘুরিয়েই ডাক্তারকে কল করলো। এরপর সারা রাস্তা ধরে ড্রাইভ করতে করতে ফোনে হসপিটাল এম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করতে থাকলো বেশ চিন্তা নিয়ে। সৌমী এরপর খেয়াল করলো অর্জুন একটা একতলা বৃদ্ধাশ্রমের সামনে গাড়িটা দাঁড় করালো নিজের। তবে এরপর সৌমী আর চুপ করে থাকতে পারলো না। ও নিজের মনেই প্রশ্ন করে উঠলো,
———” এটা কোথায়? মানে এই বৃদ্ধাশ্রমটা কার? আর আপনি এখানে! ”
ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই অর্জুন বললো,
———” এই বৃদ্ধাশ্রমটা আমার। যাদের দেখার কেউ নেই, রাস্তায় পড়ে থাকতে হয় শেষ জীবনে, তাদের নিয়ে এসে এখানে রাখা হয়। আর এখানকার সবাই আমার খুব ক্লোজ। মিষ্টি দিদা এখানেই থাকে। কদিন আগেই নিয়ে আসা হয়েছে ওনাকে স্টেশন থেকে। খুব ভালো মানুষ। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে অর্জুন আর অপেক্ষা করেনি। চলে গিয়েছিল আশ্রমে। কিন্তু সৌমী কেমন থমকে ছিল এই মুহূর্তে। অর্জুন এত ভালো মানুষ! আর এই লোকটার সম্বন্ধে এত ভুল ভাবতো ও একটা সময়! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ভিতরে এসেছিল সৌমী আশ্রমের। ততক্ষণে ডাক্তারও চলে এসেছে। তবে এই আশ্রমে এসে সৌমী খেয়াল করলো অনেক বয়স্ক লোকেদের মাঝে একটা চেনা মুখ। ওদের অফিসের সামনে যেই ঠাকুমাটা বসে ভিক্ষা করতো, সেই ঠাকুমাটা এখানে! এমনিতেও বেশ অনেকদিন ওনাকে দেখেনি সৌমী অফিসের বাইরে। কথাগুলো ভেবেই সৌমী এগিয়ে গিয়েছিল ওই ঠাকুমার দিকে। তবে ওই বয়স্ক ভদ্রমহিলা সৌমীকে দেখে বেশ অবাক হয়ে বলেছিল,
———-” দিদিভাই, তুমি এখানে! ”
এই প্রশ্নে সৌমী নিজেও জিজ্ঞেস করে উঠেছিল,
———” ঠাকুমা, কতদিন দেখিনি তোমাকে! তুমি এখানে কি করছো? ”
এই কথায় উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো,
———” তোমাদের অফিসের মালিক, অর্জুন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। দিদা দিদা বলে আমাকে। খুব ভালো ছেলে। আমাকে অফিসের বাইরে ভিক্ষা করতে দেখে নিজেই এসেছিল আমার কাছে সাহায্য করবে বলে। আজ ওর জন্যই এখানে শান্তিতে দুটো খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারছি। ”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিলেন উনি। কিন্তু সৌমী যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল এইসব শুনে আর দেখে। অর্জুন আজ একেবারে অন্য রূপে ধরা দিয়েছিল ওর কাছে। যে মানুষের জন্য এত ভাবে, মন থেকে লোকের পাশে দাঁড়ায়, সে আসলে ভীষণ বেহিসেবী মনের একটা মানুষ। এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল বার বার। আর সৌমীর মনে একটা ভালো লাগার রেশ ছড়িয়ে যাচ্ছিল এই মুহূর্তে। অর্জুনের জন্য এই প্রথম ফিল করতে শুরু করেছিল ও।
সেদিন ডাক্তার চেক আপ করে চলে যাওয়ার পর ওদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল। এই সময় বার বার সৌমী আড় চোখে দেখছিল অর্জুনকে। ছেলেটার শান্ত চোখ, এক গাল হাল্কা দাড়ি, চোখে রিমলেস চশমা, সব কিছুকে খেয়াল করছিল নতুন করে। যাইহোক এরপর বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীরে ঘুমের মধ্যেও সৌমী অর্জুনকে দেখেছিল, স্বপ্নে।

এরপরের দিনের সকাল একটা নতুন গল্প নিয়ে এসেছিল জীবনে। আজ অর্জুনদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো। বেশ হইহই রৈ রৈ ব্যাপার চারিদিকে। তার মাঝেই সৌমী অর্জুনের দেয়া শাড়িটা বার করেছিল আলমারি থেকে। কাল পর্যন্তও এই শাড়িটা পড়বে কি পড়বে না এই নিয়ে একটা ভাবনা ছিল মনের মধ্যে। তবে আজ সব ভাবনা ভুলে ভীষণ ইচ্ছে করছে এই শাড়ীটাতে সেজে উঠতে। কথাটা ভেবেই সৌমী শাড়িটা পড়েছিল। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছিল অর্জুনের জন্য। কপালে একটা ছোট্ট টিপ পড়তে পড়তে বার বার মনে হচ্ছিল অর্জুনের ভালো লাগবে তো ওকে এই শাড়িতে দেখে! কি জানি কেন এলোমেলো ভাবনা এসে ভিড় করছিল মনে।
যাইহোক, সেদিন এরপর সৌমী যখন শাড়ি পরে ঠাকুর ঘরে এসেছিল তখন পুজো শুরু হয়ে গেছে। তবে এর মাঝেই সৌমী খেয়াল করেছিল অর্জুনকে। ছেলেটা কেমন থমকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিস্পলক দৃষ্টি, স্থির দুটো চোখ যেন সৌমীকেই চাইছিল এতক্ষণ ধরে। আর এই শাড়িতে মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে যে সত্যি চোখই ফেরানো যাচ্ছে না!
সেদিন এই অগোছালো ভাবনার ভিড়ে দুজনেই তাকিয়েছিল দুজনের দিকে অনেকক্ষণ। তবে এইসবই পুজোতে বসে খেয়াল করেছিল রুক্মিণী। মনে মনে ভীষণ খুশি হচ্ছিল যদিও এই দৃশ্য দেখে। ছেলের মন গলেছে তাহলে, নইলে এরকম মূর্তির মতন চেয়ে থাকতো না সৌমীর দিকে। আর এটাই তো চেয়েছিল রুক্মিণী। প্রথমদিন থেকেই সৌমীকে ভীষণ পছন্দ ছিল ওর। যাইহোক, এরপর পরবর্তী পদক্ষেপটা রুক্মিণীই নেবে ছেলের হয়ে। নন্দিনী ফিরলেই সম্বন্ধের কথা বলবে ছেলের জন্য। একটা সুন্দর গল্পের শুভ পরিণয় নিজের হাতেই লিখবে রুক্মিণী।
চলবে।