মন পলাশ পর্ব-১১

0
103

#মন_পলাশ ( একাদশ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২১>
তবে নন্দিনীকে এইসব কথা বলার আগের দিন রুক্মিণী অর্জুনের কাছে এসেছিল সন্ধ্যেবেলা। তারপর ছেলেকে কথার ছলে বলে উঠেছিল,
———” তোর জন্য আমি একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। ভাবছি কালই যাবো বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করতে মেয়েটাদের বাড়ি। ”
কথাটায় অর্জুন যেন আকাশ থেকে পড়েছিল। ও চমকে উঠে বলেছিল,
———” মেয়ে পছন্দ করেছ মানে! কি বলছো এইসব! ”
এই কথায় রুক্মিণী শান্ত গলায়ই বলেছিল,
———-” ঠিকই বলেছি। তুই তো নিজে এতদিনেও কাউকে জোটাতে পারলি না! সেই একাই রয়ে গেলি। তাই আমিই পছন্দ করলাম তোর জন্য মেয়ে। নইলে সারা জীবন তো ব্রহ্মচারী হয়ে ঘুরে বেড়াবি ! ”
কথাটা শুনে অর্জুন ভীষণ উসখুস করে বলে উঠলো,
———-” এটা কোন কথা! আমাকে না জিজ্ঞেস করে তুমি এইসব ভাবলে কি করে! আর বিয়ের মতন একটা বড় ডিসিশন নিলেই বা কি করে! আমার বিয়ে, আমার মতামতের তো একটা দাম আছে না কি? ”
এই কথায় রুক্মিণী অর্জুনকে পাত্তা না দিয়েই বলে উঠলো,
———-” সেসব আমি শুনতে চাই না। আমার একটা বৌমা চাই, ব্যাস। আর তোর আপত্তিটা কিসের জন্য আমি তো বুঝতে পারছি না। তোর তো নিজস্ব কোন পছন্দও নেই। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল রুক্মিণী। কিন্তু অর্জুনও এই কথার উত্তরে নিজের মনেই বলে উঠেছিল ,
———–” কে বললো পছন্দ নেই! আমার তো! ”
কথাটা বলতে বলতেও আটকে গেল অর্জুন। আসলে নিজের মনের কথা বলার একদম অভ্যাস নেই যে। এইসবই ভাবছিল আনমনে, তখনই রুক্মিণী আলতো হেসে বললো,
———” তোর তো কি? পছন্দ কাউকে? ঠিক আছে, তাহলে আমি নন্দিনীদের বাড়ি আর যাবো না কাল। সৌমী যদিও খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু কি আর করা যাবে! ”
এই কথায় অর্জুনের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ও ভাবতে পারেনি মা এতক্ষণ ধরে সৌমীর কথা বলছে! তাই সঙ্গে সঙ্গে নিজের কথাকে ঘুরিয়ে বলেছিল,
———” না না। আমার কাকে পছন্দ হবে আবার! আমার কাউকে পছন্দ না। আর তুমি যখন আমার হয়ে বিয়ের ডিশিশনটা নিয়েই নিয়েছ সৌমীর সাথে, তাহলে আমার আর আপত্তির কি আছে! তোমার যেটা ঠিক মনে হয় তুমি করো। সেরকম হলে আমি কাল যেতে পারি তোমার সাথে। ”
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে গেছিল অর্জুন। তবে ও বোঝেনি ও এইসব কথা বলে যতই ম্যানেজ করার চেষ্টা করুক, মা সব জানে। ও যে সৌমীকে পছন্দ করে, সেটা তো আজ স্পষ্ট। এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রুক্মিণী অর্জুনের গাল দুটো টিপে দিয়ে বলেছিল,
———-” ঠিক আছে, তাই হবে। শান্তি? কাল বিকেলে তাহলে নন্দিনীদের বাড়িতে যাচ্ছি। তুই চলে আসিস অফিস থেকে ঠিক সময়ে। ”
কথাগুলো বলে রুক্মিণী আর কোন কথা না এগিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছিল। তবে অর্জুনের মুখে এবার চওড়া হাসি। মা হয়তো না বুঝেই ওর মনের ইচ্ছেটা পূরণ করে ফেলেছে। সৌমী যে কবে ওর জীবনে এতটা দামী হয়ে গেল, ও নিজেই জানে না!
যাইহোক, এরপরের দিনই রুক্মিণী অর্জুনকে নিয়ে হাজির হয়েছিল নন্দিনীদের বাড়ি। তবে সৌমী নন্দিনী কিছু বোঝার আগেই রুক্মিণী নন্দিনীর হাত দুটো ধরে বলে উঠেছিল,
———” তোর মেয়েটাকে আমার বড্ড পছন্দ রে। ওকে আমি নিজের মেয়ে করতে চাই। অর্জুনের জন্য সৌমীকে চাই আমি। তুই কোন আপত্তি করিস না প্লিজ! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল রুক্মিণী। কিন্তু নন্দিনী আর সৌমী যেন আকাশ থেকে পড়েছিল। নন্দিনী সেই মুহূর্তে ভীষণ চমকে উঠেই বলেছিল,
——–” এইসব কি বলছিস তুই! কোথায় তোরা, কোথায় আমরা! আমাদের অবস্থার আকাশ পাতাল তফাৎ। আমার মেয়ের সাথে তোর ছেলের বিয়ে কিভাবে সম্ভব! এটা হয় না। ”
কথাটায় রুক্মিণী বুঝিয়ে বলে উঠেছিল,
———” টাকা পয়সা দিয়ে আমি কোনদিন কাউকে বিচার করিনি, আর করবোও না। আমি শুধু জানি যে সৌমীর থেকে ভালো মেয়ে আমি হাজার খুঁজলেও পাবো না আমার অর্জুনের জন্য। আমি আজ অনেক আশা নিয়ে এখানে এসেছি। তুই আমাকে খালি হাতে ফেরাতে পারবি না নন্দিনী। ”
কথাগুলো শুনে নন্দিনীর চোখে জল চলে এসেছিল। হ্যাঁ না কোন কিছু বলার অবস্থাতেই ছিল না ও। সেই মুহূর্তে রুক্মিণী ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। কিছু না বলে বোঝাতে চেয়েছিল ‘সাথে আছি’।

তবে সেদিন ছাদে সৌমী আর অর্জুন যখন আলাদা এসেছিল কথা বলার জন্য, সেই মুহূর্তে সৌমী নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———- ” আপনি কি রুক্মিণী কাকিকার জন্য আজ এখানে এসেছেন? দেখুন, আপনি প্লিজ জোর করে এই বিয়েতে হ্যাঁ বলবেন না। আমি জানি, আমাদের স্ট্যান্ডার্ড, স্ট্যাটাস এইসবের কোন মিল নেই। আর আমার মতন সাধারণ একটা মেয়ের সাথে আপনাকে মানায় না। যাইহোক, যদি আপনি এই বিয়েতে না বলতে না পারেন, তাহলে আমি বলে দেব। কোন সমস্যা নেই। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল সৌমী। কিন্তু অর্জুন এবার একটা লম্বা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বলেছিল,
———-” তুমি নিজেই বলে যাবে না কি আমার কথাও শুনবে একটু? আমি এখানে কারোর কথায় আসিনি, নিজের জন্য এসেছি। আর যথেষ্ট ভেবে চিন্তেই এসেছি। আমি বিয়ে করতে চাই তোমাকে। ”
কথাগুলো শুনে সৌমী নিজের মনেই বলে উঠেছিল ,
———-” আমাকে! কিন্তু আমাকে কি করে! ”
এই কথায় অর্জুন অবাক হয়েই বলেছিল ,
———–” কেন? তোমাকে না কেন! না কি তোমার আমাকে পছন্দ না? আচ্ছা, তুমি কি অফিসের সেই প্রথম দিনের কথাগুলোই মনে রেখেছো? খুব খারাপ মানুষ মনে হয় কি আমাকে? ”
এই কথায় সৌমী সাথে সাথেই বলে উঠেছিল,
———–” না না। খারাপ কেন মনে হবে! আপনাকে তো আমার! ”
না,কথাটাকে আর শেষ করতে পারেনি সৌমী। লজ্জায় কেমন সব আটকে গেছিল ঠোঁটে। সেই মুহূর্তে অর্জুনই ওর কথাটাকে শেষ করে বলে উঠেছিল,
———- ” ভালো লাগে! তাই তো? আমারও। কবে কিভাবে জানি না! কিন্তু আই লাইক ইউ.. আই ফিল ফর ইউ.. ”
কথাগুলো খুব ধীর স্বরে সৌমীর চোখে চোখ রেখে বলেছিল অর্জুন। সৌমী এর উত্তরে কিছু বলতে পারেনি। লজ্জায় চোখটা নামিয়ে নিয়েছিল নিজের। কিন্তু ঠোঁটের কোণে একটা আলতো হাসি এসে জড়ো হয়েছিল হঠাৎ। মনে হচ্ছিল একটা স্বপ্ন দেখছে। কোন রূপকথার স্বপ্ন। সেই সময় অর্জুন আলতো করে হাতটা ধরেছিল সৌমীর এই প্রথম। একটা অনেকদিনের পুরনো গল্পকে যেন নতুন করে লিখতে চেয়েছিল এই গোধূলি বিকেলে, একান্ত নিজের করে।

<২২>
এই কথাবার্তার পরেরদিনই রুক্মিণী পুরোহিত ডেকেছিল, বিয়ের ডেট ফাইনাল করার জন্য। সৌমীর তো এখনও সব কিছু স্বপ্নের মতনই লাগছিল। অর্জুন যেন এই দিনগুলোতে নিজের আড়াল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। সৌমীর সাথে ফোনে এলোমেলো কথা, রাতে মেসেজ, কখনো একসাথে কফি খেতে বেরনো, তো কখনো গঙ্গার ধারে ঘুরতে যাওয়া, সব মিলিয়ে দিনগুলো ভীষণ রঙিন হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ। সৌমী এই সময় নতুন করে চিনছিল অর্জুনকে। ওর ভালো লাগা, খারাপ লাগা, রাগ অভিমান কষ্টগুলোকে বুঝতে পারছিল নিজে থেকে। আর অর্জুনও যেন একটা নতুন বন্ধু খুঁজে পেয়েছিল ওর নিঃসঙ্গ জীবনে। সৌমীকে আসলে খুব নিজের মনে হতে শুরু করেছিল এখন, যার সাথে বেহিসেবী ভাবে কথা বলা যায়, নিজেকে এক্সপ্রেস করা যায়। এইভাবেই এগোচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু হঠাৎই তাল কাটলো। তিলোত্তমা একদিন কফি শপে দেখে ফেলেছিল অর্জুন আর সৌমীকে। যদিও ওরা তিলোত্তমাকে খেয়াল করেনি। নিজেদের মধ্যে গল্পে হারিয়েছিল। কিন্তু তিলোত্তমা থমকে গেছিল যেন ওদের দুজনকে একসাথে দেখে! অর্জুন এই মেয়েটার সাথে কি করছে! এইভাবে কোন মেয়ের সাথে এত গল্প করতে আগে কখনো দেখেনি তো! তিলোত্তমা নিজে কতবার বলেছিল অর্জুনকে একসাথে বেরোনোর কথা, কোন কফি শপে আসার কথা, কিন্তু অর্জুন কোনদিন ওর এইসব কথায় সাড়া দেয়নি। আর সেই ছেলে আজ এই মিডল ক্লাস মেয়েটার সাথে এত ক্লোজ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তিলোত্তমা আর দাঁড়ায়নি। বেরিয়ে এসেছিল ওখান থেকে। কিন্তু এরপরই তিলোত্তমা অর্জুনের অফিসের একজন এম্প্লই খেয়ালীকে কল করেছিল। খেয়ালী অনেক সময়ই তিলোত্তমাকে অর্জুনের ব্যাপারে খবর দেয়। যাইহোক, সেদিন তিলোত্তমা খেয়ালীকে ফোন করে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করেছিল,
———-” তোমাদের অর্জুন স্যার আর অফিসের ওই মেয়েটা, সৌমী, দুজনের মধ্যে কি চলছে জানো? ”
এই প্রশ্নে খেয়ালী সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিল,
———–” সরি ম্যাম, আপনাকে তো খবরটা দেয়াই হয়নি। আসলে এ কদিন কাজের এত চাপ ছিল! আসলে অর্জুন স্যার আর সৌমীর তো মনে হয় বিয়ের ঠিক হয়েছে যত দূর শুনলাম। খুব তাড়াতাড়িই বিয়ের অনুষ্ঠান হবে দুজনের। ”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল খেয়ালী। কিন্তু এইসব শুনে তিলোত্তমা কিরকম পাথরের মতন স্থির হয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল মুখের ওপর। এটা কি করে সম্ভব! অর্জুন ওকে বাদ দিয়ে এরকম একটা মিডল ক্লাস মেয়েকে বিয়ে করার ডিসিশন নিল! ওরকম একটা সাধারণ মেয়ের কাছে শেষে হেরে গেল তিলোত্তমা! কখনোই না। এই বিয়েটা কিছুতেই হতে পারে না। তিলোত্তমা কোনভাবেই এই বিয়েটা হতে দেবে না অর্জুনের। কথাটা কিরকম জেদের মতন মাথায় চেপে বসলো ওর।

সেদিন তিলোত্তমা সোজা এরপর নিজের বাবার কাছে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত এই মানুষটা ও যা চেয়েছে, তাই এনে দিয়েছে। আর আজ ওর অর্জুনকে চাই। এই কথাগুলো সরাসরি বলেছিল তিলোত্তমা বাবাকে। বলেছিল অর্জুনকে ছাড়া আর কোনদিন কাউকে বিয়ে করবে না। যেভাবেই হোক অর্জুনকে বাধ্য করতে হবে তিলোত্তমার সাথে বিয়ে করার জন্য। কথাগুলো শুনে অমিত রায়চৌধুরী আর অপেক্ষা করেনি। মেয়ে মুখ ফুটে একটা জিনিস চেয়েছে, আর উনি সেটা দেবেন না এটা হয়! কথাগুলো ভেবেই মনে মনে একটা প্ল্যান সাজিয়েছিল।
পরেরদিন সকাল সকালই উনি এসে হাজির হয়েছিল অর্জুনের অফিসে। অর্জুন যদিও প্রথমে ভেবেছিল বিজনেসের কোন কারণের জন্যই অমিত রায়চৌধুরী এসেছেন। কিন্তু ভাবনাগুলো মিললো না যখন উনি সব হিসেব এলোমেলো করে দিয়ে বলে বসলেন তিলোত্তমাকে বিয়ে করার কথা! বললেন এই বিয়ে না হলে উনি অর্জুনের কোম্পানির সাথে সমস্ত রকম বিজনেস রিলেশন শেষ করে দেবেন। আর এর জন্য অর্জুনের কোম্পানির প্রচুর লস হবে। এতদিন এত পরিশ্রম করে অর্জুন বিজনেসটাকে যে পর্যায়ে এনেছে, সবটা নষ্ট হয়ে যাবে একদিনে। অর্জুনের কয়েক বছর লেগে যাবে এই লস থেকে কোম্পানিকে রিকোভার করতে। কথাগুলো কেমন হুমকির সুরে বলেছিলেন অমিত রায়চৌধুরী। আর সাথে চব্বিশ ঘন্টা সময় দিয়েছিলেন ডিসিশন নেয়ার জন্য।

সেদিন এইসব শুনে অর্জুনের পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠেছিল। একদিকে সৌমী , আর এক দিকে এই বিজনেস! বাবার কত স্বপ্ন জড়িয়ে এই ব্যবসাকে নিয়ে। সবটা শেষ হয়ে যাবে ওর একটা ডিসিশনে! কিন্তু সৌমীকে এই মুহূর্তে বিয়েতে না বলবে কিভাবে! মেয়েটাকে ভালোবাসে ও। সারা জীবন একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখেছে দুজনে মিলে। বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। মা, নন্দিনী কাকিমা সবাই কত খুশি এই বিয়েটা নিয়ে! সবার মন ভেঙে কিভাবে অর্জুন বিয়েটা ভেঙে দেবে! সেদিন সারাদিন এই এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই কেটে গেছিল সময়টা।
চলবে।