মন পলাশ পর্ব-১৩

0
65

#মন_পলাশ ( ত্রয়োদশ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২৫>
এরপরের দিনগুলো অর্জুনের কেটেছিল ঝাপসা কুয়াশার অন্ধকারে। অফিসে কাজে মন বসছিল না। কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। রাতে চাইলেও ঘুম আসছিল না। সারাক্ষণ মনের মধ্যে যেন একটা কাঁচ বেঁধানো যন্ত্রণা হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই মাঝে মাঝে নিজেকে আটকাতে না পেরে মোবাইলে সৌমীর নাম্বারে কল করে ফেলছিল অর্জুন। তবে প্রত্যেকবারই ফোনটা রিং হয়ে হয়ে কেটে যাচ্ছিল। সেই চেনা গলার স্বর আর ধরা দিচ্ছিল না অর্জুনের কাছে। ছেলেটার যেন নিজেকে কিরকম ছন্নছাড়া মনে হচ্ছিল এই সময়ে। তবে এর মধ্যেই তিলোত্তমা এনগেজমেন্টের শপিং প্রায় শেষ করে ফেলেছিল। ভেনু ডিসাইড, গেস্টদের নিমন্ত্রণ সব হয়ে গিয়েছিল ওদের তরফে। যদিও রুক্মিণী অর্জুনকে খুব পরিষ্কার ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিল এই এনগেজমেন্ট এ ও কোনভাবেই থাকবে না। অর্জুনের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ও ভীষণ একা হয়ে গেছে হঠাৎ। নিজের ভুলেই নিজের কাছের মানুষ গুলোকে হারিয়ে ফেলেছে এক এক করে। শুধুমাত্র বিজনেসের কথা ভাবতে গিয়ে কি ও জীবনের লাভ ক্ষতির হিসেবটা ভুল করে ফেললো! এই এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই দিনগুলো পেরিয়ে এনগেজমেন্ট এর দিনটা চলেই এলো ক্যালেন্ডারের পাতায়। অর্জুন আজ সারাদিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছিল। শুধু মনে হচ্ছিল কিছু একটা শেষ করে ফেলছে ও, যেটা ভীষণ নিজের ছিল! সেদিন এই বেহিসেবী ভাবনার ভিড়েই সন্ধ্যেবেলা এনগেজমেন্ট এর জন্য রেডি হয়েছিল। আসলে এই মুহূর্তে বার বার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যা করছে বাবার জন্য করছে। বাবার এই বিজনেসটার কোন রকম ক্ষতি অর্জুন হতে দেবে না। অনেক পরিশ্রম করে দাঁড় করিয়েছিল ব্যবসাটাকে। তাই যতই নিজের জীবনের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হোক,অর্জুনকে এই এনগেজমেন্টটা করতেই হবে। এই ভাবনার ভিড়েই গিয়েছিল মায়ের কাছে, প্রণাম করতে। কিন্তু সেদিন রুক্মিণী ছেলের মাথায় হাত রেখে একটা অন্য কথা বলেছিল। খুব স্থির স্বরে বলেছিল ও,
——–” ভালো থাকিস, এটাই চাই। আর একটা খবর তোকে বলার ছিল। সৌমীরও আশীর্বাদের দিন ঠিক হয়ে গেছে পার্থর সাথে। এই রবিবার। তোর মতন সৌমীও একটা নতুন জীবন শুরু করবে। ”
কথাগুলো কিরকম শান্ত স্বরে বলেছিল রুক্মিণী। তবে অর্জুনের মনে ধাক্কা লেগেছিল একটা। সত্যি সৌমী অন্য একজনকে বিয়ে করবে! কথাটা যেন বুকে বাজছিল ওর। অর্জুন এরপর সারা রাস্তা জুড়ে এই চিন্তাই করেছে। সেদিন ক্যাফেতে পার্থর সঙ্গে সৌমীর দেখা, ওদের একসাথে সময় কাটানো, সৌমীর সেই কথাটা যে ও পার্থকেই বিয়ে করবে, সবই যেন ভাসছিল চোখের সামনে। অর্জুন কিছুতেই নিজের মনকে আর সামলে রাখতে পারছিল না। ভীষণ অস্থির লাগছে ওর। শুধু মনে হচ্ছিল সৌমীর জীবনে অন্য একজনকে কিছুতেই থাকতে পারে না। সৌমীর জীবনে শুধুমাত্র ওর থাকার কথা ছিল। সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়ে এনগেজমেন্ট এর জন্য তিলোত্তমার সামনে এসে দাঁড়িয়েও অর্জুন স্থির হয়ে গিয়েছিল। তিলোত্তমাকে আংটি পড়াতে পারেনি কোনভাবেই। নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———-” এই এনগেজমেন্টটা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আই কান্ট ম্যারি ইউ..”
এই কথায় তিলোত্তমার ধাক্কা লেগেছিল একটা। ও হিংস্র গলায় বলে উঠেছিল,
———-” এনগেজমেন্ট করতে পারবে না মানে! মজা করছো না কি আমার সাথে? ”
কথাটা শেষ হতেই তিলোত্তমার বাবাও বলে উঠলো,
———” তুমি আমার মেয়ের সাথে এটা করতে পারো না। তুমি ভুলে গেলে আমাদের বিজনেস রিলেশনের ব্যাপারে? আমি পার্টনারশিপ ভেঙে দিলে তোমার বিজনেসের লসটা একবার ভেবে দেখেছো! ”
এই কথায় অর্জুন নিজের সমস্ত ধৈর্য্য হারিয়ে বলেছিল,
———–” ইনাফ ইজ ইনাফ.. ব্ল্যাকমেল করছেন আপনি আমাকে! আপনি কি ভাবছেন আমি ভয় পাই আপনাকে? এইভাবে জোর করে বিয়ে দেবেন আপনি আপনার মেয়ের সাথে! ”
কথাটা বলে আংটিটা তিলোত্তমার হাতে ধরিয়ে বলেছিল,
———-” এই নাও তোমার আংটি। অনেক হয়েছে। আর সম্ভব না। আমি এইভাবে একটা জোরের বিয়ে কখনোই করতে পারবো না। আর এতে শুধু আমার না, তোমারও জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। এই কথাটা যদি তোমার বাবা বোঝেন তো ভালো, আর না বুঝলে যা ইচ্ছে তাই করে নিক। আই ডোন্ট কেয়ার এনিমোর. ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই অর্জুন আর অপেক্ষা করেনি। সবার সামনে বেরিয়ে এসেছিল জোরে পা চালিয়ে। একটা খুব বড় ভুল করতে যাচ্ছিল ও। নিজের জীবনটাকে নিজের হাতে তছনছ করে ফেলছিল আজ। এটা বুঝতে পারেনি যে সৌমীকে ছাড়া পুরো জীবনটাই অসম্পূর্ণ, অর্থহীন! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের গাড়িতে উঠে বসলো। এখন সবার প্রথমে ওই মেয়েটার কাছেই যেতে হবে। যেই ভুলটা করে ফেলেছে নিজে, সেটাকে ঠিক করতেই হবে। সৌমীকে গিয়ে বলতে হবে ‘ ভালোবাসি ‘। মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে আবার নিজের জীবনে, যেভাবেই হোক। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কিছু সময়ের ভিড়ে পৌঁছে গেছিল অর্জুন সৌমীর দরজায়। তারপর অনেক কথা মনে মনে সাজিয়ে কলিং বেলটা বাজিয়েছিল সৌমীদের বাড়ির। এরপর কিছুক্ষণ এর মধ্যে সৌমী এসেই দরজা খুলেছিল অর্জুনকে, আর থমকে গেছিল হঠাৎ। নিজের মনেই প্রশ্ন করে উঠেছিল,
———-” আপনি! এখানে? আজ তো আপনার এনগেজমেন্ট ছিল। ”
এই কথায় অর্জুন আলতো স্বরে বলেছিল,
———–” আপনি না, তুমি। কারণ আমি এতটাও পর হয়ে যাইনি এখনো। আর এনগেজমেন্ট আমি ভেঙে দিয়েছি সৌমী। আমি পারিনি অন্যের সাথে নিজেকে জড়াতে! বিকজ আই লাভ ইউ.. আমি ভালোবাসি তোমায়। ভীষণ ভালোবাসি। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অর্জুন। কিন্তু সৌমী এবার ভীষণ স্থির গলায় বলেছিল,
———-” এসবের আর কোন মানে নেই। আপনি প্লিজ যান এখান থেকে। আর আমাদের মধ্যে অনেকদিন আগেই সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। ”
কথাগুলো বলেই সৌমী দড়জাটা দিতে যাচ্ছিল, তখনই অর্জুন ওকে আটকে বলে উঠলো,
———–” সব কিছু এত সহজে শেষ হয় না সৌমী। আর আমি শেষ হতে দেবোও না। আরেকবার আমাকে একটা সুযোগ দাও, সব কিছু নতুন করে শুরু করার, প্লিজ! ”
কথাগুলো ভীষণ কাতর স্বরে বলেছিল অর্জুন। কিন্তু সৌমী এবার ভীষণ কঠিন গলায়ই বলে উঠেছিল,
———–” কি মনে হয়? এত সস্তা আমি! আমাকে যখন খুশি ছেড়ে দেয়া যায়, আবার যখন ইচ্ছে আমার কাছে ফিরে আসা যায়? আমার কোন দাম নেই! ”
কথাটায় অর্জুন কিছুটা এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
———-” সৌমী প্লিজ, এইভাবে বোলো না। আমি জানি আমি একটা ভুল করে ফেলেছি! কিন্তু”
না, ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই সৌমী বললো,
———-” কিন্তু আর কোন গল্প নেই আমাদের। আপনার ইচ্ছা মতন সব কিছু হবে না স্যার। আমাকে ছেড়ে দেয়ার ডিসিশন আপনার ছিল। আমি মেনে নিয়েছি। আর আপনার কাছে ফিরে না যাওয়ার ডিসিশন আমার নিজের। এটা আপনাকে মানতে হবে। আর সামনেই আমার বিয়ে। তাই আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না প্লিজ। ”
কথাগুলো বলেই সৌমী আর অপেক্ষা করেনি। দরজাটা দিয়ে দিয়েছিল অর্জুনের মুখের ওপর। কিন্তু অর্জুন কিরকম নিঃস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক জায়গায়। আজ হয়তো ওর খালি হাতে ফেরার দিন! একদিন তো এইভাবেই সব শেষ করে চলে গিয়েছিল অর্জুন সৌমীর কাছ থেকে। আজ সৌমীর ফিরিয়ে দেয়ার পালা।
সেদিন এরপর বৃষ্টি নেমেছিল খুব শহরে। অর্জুন এই বৃষ্টিতে অনেকক্ষণ বসেছিল একা গঙ্গার ধারে। একটা সময় এই গঙ্গার ধারের বেঞ্চটায়ই সৌমীর সাথে ও বসে থাকতো কত সময়। কত হাসি কত গল্প কত মুহূর্ত কাটাতো একসাথে। অর্জুনের কথাগুলো ভেবে চোখটা ভিজে আসছিল বার বার। বুঝতে পারছিল না কিভাবে নিজের ভুলটাকে ঠিক করবে! কিভাবে আবার ফিরিয়ে আনবে সৌমীকে নিজের কাছে!

<২৬>
সেদিন এই অগোছালো ভাবনার ভিড়েই অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। অর্জুন এরপর ক্লান্ত শরীরে ফিরেছিল বাড়িতে। তবে আজ বাড়ি ফিরে ওর মাকে আঁকড়ে ধরতেই ইচ্ছে করছিল ভীষণ। তাই কিছু না ভেবেই গিয়েছিল মায়ের ঘরে। তারপর ঘুমন্ত মা কে জড়িয়ে ধরেছিল পিছন থেকে। অর্জুনের স্পর্শে রুক্মিণীর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ও অর্জুনকে এইভাবে ভেজা চোখে এলোমেলো অবস্থায় দেখে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
———” কি হলো! কি হয়েছে তোর? সব ঠিক আছে তো? ”
এই প্রশ্নে অর্জুন ভাঙ্গা গলায় বলেছিল,
———–” সব শেষ হয়ে গেছে মা। আমি আমার নিজের ভুলে সব শেষ করে ফেলেছি। আমি আজ তিলোত্তমার সাথে এনগেজমেন্ট করতে পারিনি কিছুতেই। আমি পারিনি একটা বিজনেস ডিলের সাথে নিজের জীবনটাকে জড়িয়ে ফেলতে। আমি ভালোবাসি সৌমীকে মা। ওকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অর্জুন। তবে রুক্মিণী এই সময় নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———–” কি! তুই এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়েছিস তিলোত্তমার সাথে! ”
এই কথায় অর্জুন কিছুটা থমকে থাকা গলায় বলেছিল,
———-” হ্যাঁ। ভেঙে দিয়েছি। মা, তুমি প্লিজ বোঝাবে সৌমীকে যে আমি ওকে কতটা ভালোবাসি! আমি তারপর গিয়েছিলাম সৌমীর কাছে। কিন্তু সৌমী আমার কোন কথাই শুনতে চাইছে না। ও আর আমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। ও আর আমাকে বিশ্বাস করে না! কিন্তু আমি জানি তুমি বোঝালে ও ঠিক রাজি হয়ে যাবে। একবার ওকে গিয়ে বলবে মা প্লিজ!”
কথাগুলো কিরকম এলোমেলো অবস্থায় বলেছিল অর্জুন। তবে রুক্মিণী এই মুহূর্তে অর্জুনকে কোনভাবে সামলে বসিয়েছিল নিজের কাছে। তারপর খুব শান্ত স্বরে বলেছিল,
———-” এটা হয় না অর্জুন। সৌমীর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। চাইলেই কাউকে মর্জি মতন ছেড়ে দিলাম, আবার চাইলেই সে তোর কাছে ফিরে আসবে, এটা হয় না। আমি তো তোকে আগেই বলেছিলাম যে তুই ভুল করছিস। কিন্তু সেদিন তুই আমার কথা শুনিসনি। আর এতদিনে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ”
কথাগুলো খুব স্থির গলায় বলেছিল রুক্মিণী। কিন্তু অর্জুনের সবটা শেষ মনে হচ্ছিল। তাহলে কি ও সত্যি হারিয়ে ফেললো সৌমীকে সারা জীবনের জন্য! এতটা নিঃস্ব হয়ে গেল আজ! কথাগুলো আনমনে মনে হলো হঠাৎ।

আজকের পর অর্জুন আর নিজের মধ্যে ছিল না। দিন রাত শুধু কাউকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা এসে বুকে দানা বাঁধছিল। নিজের ভুলগুলোর মধ্যে জর্জরিত মনে হচ্ছিল নিজেকে। সৌমী আর ওর না, অন্য একজনের, এই কথাটা অর্জুন কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছিল খুব। রাগ হচ্ছিল ভীষণ নিজের ওপর। তাই এই দিনগুলোতে অর্জুন কাজকর্ম সব ফেলে নেশার মধ্যে ডুবে ছিল। এখন এলকোহলই পারে ওকে শান্তি দিতে। সেদিন এইভাবেই নেশার মধ্যে অর্জুন সৌমীর বাড়ি চলে এসেছিল নিজেকে আর সামলাতে না পেরে। জোরে জোরে কলিং বেল বাজাতে শুরু করেছিল নেশার ঘোরে। সেদিন নন্দিনীও বাড়িতে ছিল না। একটা নেমন্তন্ন বাড়ি গিয়েছিল। সৌমী একাই ছিল বাড়িতে। ও তবে দরজা খুলেই থমকে গেছিল অর্জুনকে দেখে। এলোমেলো চেহারা, ছন্নছাড়া অবস্থা, এটা কি করেছে অর্জুন নিজের সাথে! এটাই ভাবছিল, সেই মুহূর্তে অর্জুন টলতে টলতে সৌমীর কাছে এসে বলেছিল,
———-” আমি পারছি না আর সৌমী। আমি জানি আমি ভুল করেছি। কিন্তু তার জন্য এত বড় শাস্তি আমাকে দিও না প্লিজ! আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেও না। ”
কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল অর্জুন। সৌমীর এই মুহুর্তে অর্জুনকে দেখে সত্যি খারাপ লাগছিল ভীষণ। এ কি অবস্থা করেছে ছেলেটা নিজের! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সৌমী অর্জুনের সাথে আর আপনি করে কথা বলতে পারেনি। ও অর্জুনকে শান্ত করার জন্য বলে উঠেছিল,
———-” প্লিজ এরকম কোরো না। তুমি প্লিজ বাড়ি যাও। অনেক রাত হয়েছে। আমি তোমার ড্রাইভারকে ফোন করছি। ”
কথাগুলো শুনে অর্জুন সেদিন জেদ দেখিয়ে বলেছিল,
———” না, আমি কোথাও যাবো না। আমি আজ আমার ভুলটাকে ঠিক করবোই। আচ্ছা, তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও তো? বেশ, আমি নিজেই নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি। চরম শাস্তি দিচ্ছি। ”
কথাগুলো বলেই অর্জুন নেশার ঘোরে সামনের ডায়নিং টেবিলে রাখা ছুরিটা তুলে নিয়েছিল। তারপর সৌমীর সামনেই নিজের হাতে একটা দাগ বসিয়েছিল ছুরি দিয়ে, আর সৌমীর চোখের সামনেই রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল অর্জুন। সৌমী এই মুহূর্তে দৌড়ে গিয়ে অর্জুনের হাত থেকে টান মেরে ছুরিটা নিয়ে ফেলে দিয়েছিল মাটিতে। তারপর চিৎকার করে বলেছিল,
———-” কি করছো কি এইসব! পাগল হয়ে গেছ না কি তুমি! ”
এই কথায় অর্জুন এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
———-” হ্যাঁ। পাগল হয়ে গিয়েছি আমি। আর পারছি না। সত্যি পারছি না। ”
কথাগুলো বলতে বলতেই অর্জুনের চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে এসেছিল, আর অর্জুন মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল সৌমীর ওপর। সৌমী এই মুহুর্তে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল অর্জুনকে। তারপর কোন রকমে ধরে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল। অর্জুনের এই সময় কোন জ্ঞান ছিল না। সৌমী চোখে মুখে জল দিয়েও জ্ঞান ফেরাতে পারেনি। এদিকে হাতটা থেকে রক্ত পড়ে যাচ্ছে! সৌমী এই সময় তাড়াতাড়ি ফাস্ট এড বক্সটা নিয়ে এসে অর্জুনের হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল। এই সময় ছেলেটার মুখটা ভীষণ করুণ লাগছিল। সৌমী এই মুহুর্তে অর্জুনের ড্রাইভারকে ফোন করেছিল। ছেলেটাকে যেভাবেই হোক, ঠিকভাবে বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে। সৌমী সত্যিই অর্জুনকে এই অবস্থায় কোনদিন দেখতে চায়নি। সৌমী তো ভালোবেসেছিল অর্জুনকে। সারাটা জীবন সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু অর্জুনই হঠাৎ সবটা ভেঙে দিল। এখন নতুন করে শুরু করা আর সম্ভব না। সৌমী বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিয়েছে। আশীর্বাদের ডেট ঠিক হয়ে গেছে। আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শী সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে। এই অবস্থায় সৌমী পিছিয়ে আসতে পারবে না। এইসবের সাথে মায়ের সম্মান জড়িয়ে। সৌমী এই কথাটা ভুলে যেতে পারে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন অর্জুনকে ধরে গাড়িতে তুলেছিল। তারপর বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে এসেছিল নিজে। রুক্মিণী তো ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে মেলাতে পারছিল না ঠিক। অর্জুন তো কোনদিন ড্রিংক করতো না! ছেলেটার এ কি অবস্থা হলো! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখে জল চলে এসেছিল রুক্মিণীর। ওরা কোনো মতে ধরে অর্জুনকে ঘরে শুইয়ে দিয়েছিল। সৌমী সেই মুহূর্তে রুক্মিণীর হাত দুটো ধরে বলেছিল থমকে থাকা গলায়,
———” আমি এইসব চাইনি রুক্মিণী কাকিমা। সত্যি চাইনি। আমি শুধু চাই অর্জুন ভালো থাকুক। ব্যাস। যাইহোক আমি আসছি। তুমি চিন্তা কোরো না। আর অর্জুনকে বলো নিজেকে যেন এরকম শাস্তি না দেয় আর। ”
কথাগুলো বলে সৌমী আর দাঁড়ায়নি। চলে গেছিল সেই মুহূর্তে। কিন্তু রুক্মিণীর আজ নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। ভয় হচ্ছিল ভীষণ ছেলের জন্য। অর্জুন সত্যি ভীষণ ভালোবাসে সৌমীকে। ছেলেটা কিভাবে সামলাবে নিজেকে এরপর! ভাবনাটা যেন মেলাতে পারছিল না ঠিক।

তবে অর্জুন এইদিনের পর থেকে ভীষণ চুপ করে গেছিল। অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সারাক্ষণ নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখতো। একটা নিঃস্তব্ধতার চাদরে মুড়ে ফেলেছিল নিজেকে। শুধু মনে হতো একটা কষ্ট বুকের ভিতর। কাউকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। যেখান থেকে অর্জুনের মুক্তি নেই। তবে এই দিনগুলো পেরিয়ে অবশেষে সৌমীর আশীর্বাদের দিনটাও চলে এসেছিল ক্যালেন্ডারের পাতায়। রুক্মিণী তো আজকের দিনে অর্জুনের মুখের দিকেই তাকাতে পারছিল না। ছেলেটা একদম থমকে আছে। তবে অর্জুন আজ সন্ধ্যেবেলা সৌমীর কাছে গিয়েছিল। হয়তো শেষবার দেখা করতে! একটা অনুষ্ঠান বাড়ি ভাড়া করে আশীর্বাদের আয়োজন করা হয়েছিল। সৌমী নিজেও ভীষণ স্তব্ধ ছিল আজ। ভিড়ের মধ্যে খুব একলা মনে হচ্ছিল নিজেকে। বার বার অর্জুনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। সেই সময়েই অর্জুন এসেছিল ওর দরজায়। এলোমেলো চেহারা, মুখে হালকা দাড়ি, ক্লান্ত দুটো চোখ। সৌমী সেই সময় ঘরে একাই ছিল। অর্জুনকে দেখে ও কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে গিয়েছিল। তারপর নিজে এগিয়ে গিয়েছিল ছেলেটার কাছে। নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———” কেমন আছো তুমি? শরীর ঠিক আছে তো? ”
এই কথায় অর্জুন আলতো হেসে বলেছিল,
———-” আজ আমাকে নিয়ে ভেবো না। আজকের দিনটা খুব সুন্দর। আজ নিজেকে নিয়ে ভাবো। ”
এই কথায় সৌমী ঠিক কি বলবে বুঝতে পারেনি। কষ্ট হচ্ছিল খুব! সেই মুহূর্তে অর্জুন আবার বলে উঠেছিল,
———-” আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি সত্যি তোমাকে ডিসার্ভ করি না। তুমি একদম ঠিক ডিসিশন নিয়েছ। এন্ড আই অ্যাম রিয়েলি হ্যাপি ফর ইও.. আর আজকের পর আমি আর কোনদিন আসবো না। ভালো থেকো। ”
কথাগুলো স্থির গলায় বলেছিল অর্জুন। তারপর সৌমীর কোন কথার অপেক্ষা না করেই চলে গিয়েছিল ঘরটা খালি করে।
সৌমীর সেই সময় চোখ দুটো ভিজে এসেছিল হঠাৎ। মন ভাঙার যন্ত্রণা এসে বিঁধছিল বুকে।
চলবে