মন বলেছে পর্ব-০১

0
58

#মন_বলেছে
#তাহিরাহ্_ইরাজ [ ছদ্মনাম ]

[১]

” এই যে মিস ফণা তোলা সাপ! তোমার সাহস তো কম নয়। ফণা তুলতে তুলতে আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় চলে এসেছো?! কি করছো এখানে? হুঁ? লুকিয়ে লুকিয়ে দিনদুপুরে চুরি? ”

ভ্রু যুগল অবিরাম নৃত্যরত। রৌদ্রে চিকচিকে গৌরবর্ণ মুখশ্রী। ঠোঁটের কোলে ঝুলে দুষ্টুমি মিশ্রিত হাসি। সে হাসিতে অত্যন্ত তেতে উঠলো অষ্টাদশী ইফানা। তর্জনী তাক করে অভব্য স্বরে বলে উঠলো,

” একদম ফালতু কথা বলবেন না শয়ন ভাই। আমাকে দেখে কি চোর মনে হয়? আর আপনাদের ওই গোপন অন্দরমহলে আছেটাই বা কি? যেটা চুরি করে আমি রাতারাতি মুকেশ আম্বানি হয়ে যাবো? ”

শয়ন ত্যাছড়া হাসলো,

” আরে বাহ্! তুমি মনে মনে, শয়নে স্বপনে মুকেশ আম্বানি হতে চাও? জানতাম না তো। তা অমন হাজার কোটি খরচা করে কি করবে? ছেলের বিবাহ দেবে বুঝি? বিয়েতে দাওয়াত দিতে ভুলো না যেন। ”

সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কথায় তাজ্জব বনে গেল ইফানা। এই ছেলেটার মাথায় স্ক্রু কি ঢিলা হয়ে গেছে? নাকি খুলে রাস্তার এখানে সেখানে পড়েই গেছে? কোন কথার পৃষ্ঠে কি বলছে এসব? আজিব পাবলিক তো! আব্বু যে কোন ভাবনায় এ পাড়ায় বসত গড়লো, আল্লাহ্ মালুম।

” কি গো? কোথায় হারালে? আমাদের ইয়ে মানে আম্বানির ছেলের বিয়েতে? ”

ভাবনায় মগ্ন মেয়েটির মুখের সামনে তুড়ি বাজালো শয়ন। এতে ধ্যানমগ্ন অবস্থা হতে ছিটকে বেরিয়ে এলো ইফানা। অধর প্রসার করে কৃত্রিম হাসি সহকারে বললো,

” জ্বি, জনাব। আম্বানির ছেলের বিয়েতেই ছিলাম। আর ইয়া বড় এক দামড়া’র মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছিলাম। সে-ই টেস্ট! একদম জিভে পানি আনার মতো। ”

শয়ন শার্টের ডান স্লিভ গুটানোর ফাঁকে স্বল্প ঝুঁকে গেল ইফানা পানে। ইফানা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে। শয়ন সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে, কেমন অভিযোগের সুরে বললো,

” একা একাই অতবড় দামড়া’র মাথা চিবিয়ে খেলে? আমাকে একটু ভাগ দিলে না? ”

ইফানা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো,

” যার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছি তাকেই কি করে ভাগ দিই, বলুন তো ভা-ই-য়া? ”

ভাইয়া শব্দে হাজার টন ওজনের জোর দিয়ে বললো মেয়েটা। শয়ন আহত স্বরে বুকের বাঁ পাশে হাত স্থাপন করে বললো,

” এভাবে ভাইয়া ডেকো না গো কন্যা! ফিলিং লাইক অ্যা সাইয়্যা…! ”

ইফানা তৎক্ষণাৎ অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো,

” আপনি না আস্ত একটা ফালতু লোক। পল্টিবাজ, ফ্লার্টার, মিথ্যুক, গিড়িঙ্গিবাজ। ”

শয়ন নবজাতক শিশুর ন্যায় অবুঝতম রূপে শুধালো,

” হ্যাঁ গো! গিড়িঙ্গিবাজ কাহারে কয়? ”

এত নাটক আর নেয়া যাচ্ছিল না। ইফানা বি°ষহীন সরল সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করে উঠছিল। সে রূপে দুষ্টু হাসি ফুটছিল শয়ন সাহেবের অধর কোলে। রঙধনু রঙের লং কুর্তি, কৃষ্ণবর্ণ লেগিংস পড়নে ইফানার। হিজাবে মুড়ে মস্তক, কেশরাশি। ডান কাঁধে ব্যাগ। বাঁ কাঁধে পিন বিদ্ধ হয়ে ঝুলছে রঙিন ওড়না। হাতে বাদামী রঙের চিকন বেল্টের লেডিস ওয়াচ। কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি হতে বেড়িয়েছে সে। শয়ন বাঁ হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোনের যান্ত্রিক পর্দায় নিজেকে অবলোকন করে চলেছে। ইফানা তখন নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পদযুগল এগিয়েছে। অকস্মাৎ শয়ন স্বীয় চুল হালকা ঠিক করে বললো,

” এই শেষ দুপুরে কাঁধে ব্যাগপ্যাক নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? কোচিংয়ে? ”

” সেটা আপনাকে বলবো কেন? ” পিছু না ঘুরেই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ইফানা।

শয়ন এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। একদম পাশেই।

” এ বাবা! বলবে না কেন গো? আফটার অল আমরা নেইবার ( neighbor). যাকে বলে একদম ক্লোজ নেইবার। কলিজা লাগালাগি করে কাছাকাছি পাশাপাশি থাকি। এত কাছের একজন হয়ে এতটুকু জানতে পারি না? ”

ইফানা ঈষৎ বিদ্রুপাত্মক হেসে বললো,

” না। জানতে পারেন না। আপনাদের চক্করে আমাদের শান্তি বিনষ্ট হয়ে চলেছে দিনরাত। সে-ই আপনারা নাকি আমাদের ক্লোজ নেইবার! হাসালেন শয়ন ভাই। ”

শয়ন বেশ গর্বিত কণ্ঠে বললো,

” হাসো কন্যা হাসো। আরো বেশি করে হাসো। হাসি স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। তোমাকে হাসাতে পেরে ধন্য এই আমি।”

ইফানা হতাশায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। তাকালো হাতঘড়িতে। আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। এরচেয়ে বেশি দেরি হলে স্যার রেগে যাবেন। তাই তো চুপচাপ কোচিংয়ের পথে পায়ে হাঁটা ধরলো মেয়েটি। পেছন হতে জিজ্ঞেস করে উঠলো শয়ন,

” ওহে হৃদয়হীনা কন্যা! একা ফেলে যাচ্ছো কোথায়? ”

কোনোরূপ জবাব মিললো না। রৌদ্র সয়ে একাকী পথ চলেছে ইফানা। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে শ্যামবরণ ত্বকে। পেছন হতে ভেসে আসছে বেসুরো এক পুরুষালী কণ্ঠে গান,

‘ চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে? ‘

” আচ্চা, আমি যুদি তোমাকে একতা চককেত দিই তুমি আমাকে কি দেবে? ”

মেয়েটির গভীরতর প্রশ্নে ভাবনায় ডুবে গেল ছেলেটি। আসলেই তো। মেয়েটি নাহয় ওকে ভালোবেসে চকলেট দিচ্ছে। বিনিময়ে সে কি দেবে? কিছু না দিলে ভালো দেখায়? লোকে মন্দ বলবে যে। কেমন বপ্পেন সে? যে কিনা গাপ্পেন’কে কিছুই দিতে পারে না। পাশাপাশি দুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা। বামের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা সহসা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলো,

” পেয়েছি পেয়েছি। তুমি আমাকে চকলেট দিয়ো। আমি তোমাকে একটা ছোটো হামি দেবো নে। আম্মু যেমন বাপি’কে দেয়। ঠিক তেমন। ”

হামি! ক্ষুদ্র সে শব্দটি শ্রবণ হতেই লাজে রাঙা বধূর ন্যায় টকটকে লাল হলো রিনি। আলতো করে মাথা নাড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,

” ছোতো দেবা কিন্তু। বড় না। ”

রনি চওড়া এক হাসি উপহার দিলো। দ্রুত ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো,

” আচ্ছা। তোমার নরম গালে দেবো নে। কাউকে বলো না কিন্তু। ”

বছর পাঁচের রিনি সতর্ক হয়ে উঠলো। লহু স্বরে বললো,

” ঠিক আচে। তুমিও বলবা না। ”

” না না। বলবো না। এটা সিক্রেট। হুশশ! ”

” আরেপ্পাস! এ কি দেখছি আমি? ”

আকস্মিক পুরুষালী এক কণ্ঠস্বরে ঘাবড়ে গেল রনি, রিনি উভয়েই। ছোট্ট রিনি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে তার বপ্পেন এর দিকে। রনি তো অবিরাম শুকনো ঢোক গিলে চলেছে। এই রে! এই পেয়ার কা মৌসুমে গাব্বার সিং উদয় হলো কোথা থে? এবার যে সাড়ে সর্বনাশ হতে চলেছে। দানবীয় দাঁতগুলো কেলিয়ে হাসছে শয়ন। হাসিমুখে এসে দাঁড়ালো ভাগ্নি রিনি’র পাশে। ভ্রু নাচিয়ে বললো রনিকে,

” কিব্বে? এদিকে কি করছিস? দিনদুপুরে হামি বিনিময় হচ্ছে? ”

রনির অবস্থা খারাপ। এক নম্বর বেগ পাচ্ছে। জোরসে বেগ পাচ্ছে। ভয়ের ঠ্যালায় হাফ প্যান্ট ভিজে না যায়! নাহলে যে একমাত্র গাপ্পেন আর হবু মামা শ্বশুরের সামনে ইজ্জতের লে হালুয়া!

” শা°লা তোরাই আপডেট মাল রে। জীবনের তেইশটা বসন্ত চোখের পলকে উড়তে উড়তে চলে গেল। এখন অবধি পারমানেন্ট একটা গফ জোটাতে পারলাম না। আর তুই কিনা নাক টিপলে দুধ বের হওয়া বয়সে হামি দিচ্ছিস? ”

শয়নের এমনতর কণ্ঠস্বরে রনির অবস্থা বেগতিক। ওরে রে! এই হিসু’টা এখুনি আসার ছিল! না যাচ্ছে সওয়া, না যাচ্ছে করা। রনি চোখমুখ কুঁচকে কোনোরকম বললো,

” আ-ঙ্কে-ল। আমি যাই? ”

” হপ! চুপচাপ দাঁড়া। পড়ালেখা বাদ দিয়ে এসব যে করছিস মা, বাবা জানে? ”

রনি বিধ্বস্ত কণ্ঠে টেনে টেনে বললো,

” নাহ্! আমি.. আমি যাই? ”

শয়ন চোখ রাঙানি দিয়ে বললো,

” আমি যেতে বলেছি? ”

” যাই না আঙ্কেল? ”

রনি কেঁদেই দেবে এবার। এত হিসু পেয়েছে না! মামাই এবং রনির এমন গম্ভীর কথাবার্তায় খুদে রিনি ভয় পাচ্ছে। কান্না পাচ্ছে তার। সে মিহি স্বরে অনুমতি সূচক ভঙ্গিতে বললো,

” মামাই? আমি যাই? ”

শয়ন এবার সমস্ত ডাটভাট ছেড়ে স্নেহশীল ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হলো। আদরের ভাগ্নিকে কোলে তুলে নিলো। চুমু খেল নরম তুলতুলে গালে। মুচকি হেসে বললো,

” যাও মা। এই ছোকড়া থেকে দূরে দূরে থাকবে কিন্তু। ঠিক আছে? ”

রিনি কিছু বললো না। সুরসুরিয়ে মামাই’য়ের কোল বেয়ে নেমে গেল। অতঃপর রনি’র দিকে একবার তাকিয়ে ছোট ছোট পায়ে লাগালো ম্যারাথন দৌড়। এক দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে গিয়েছে সে। রনি হতাশ। বাচ্চা গাপ্পেনের এমন স্বার্থপরতায় সে চূড়ান্ত হতাশ। তার এদিকে অদমনীয় হিসু পেয়েছে। আর রিনি কিনা সিংহের ডেরায় একাকী ছেড়ে পালিয়ে গেল?

‘ বেওয়াফা এ দিল! ‘

কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে রনি তাকালো শয়নের দিকে। শয়ন চোখ গরম করে যেই না দিলো এক ধমক। অমনি উসাইন বোল্টের গতিতে ঘরের ভেতর পালিয়ে গেল রনি। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে ছেলেটা। শয়ন এ দেখে দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়লো। পেট চেপে একাকী হাসছে সে। ওরে আমার বাচ্চা আশিক রে! বুকে নাই একবিন্দু সাহস, এসেছে তার আদরের ভাগ্নিকে হামি দিতে। ঠোঁট কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হয়। আহাম্মক এক পিস।

.

” অ্যা অ্যা অ্যা… ”

অশ্রু বিহীন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে ড্রয়িং রুমে এলো রনি। প্রাণ হাতে তখনো দৌড়াচ্ছে বাচ্চাটা। দৌড়াতে দৌড়াতে ঠাস। এক মানবদেহের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়ে আরো জোরে কেঁদে দিলো রনি। তনিমা তো অবাক! কি হয়েছে তার ছেলের? এভাবে কাঁদছে কেন?

” রনি! কি হয়েছে বাবু? কাঁদছিস কেন? ”

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো তনিমা। ছেলের পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল সে। দেখছিল কোথায় ব্যথা পেয়েছে বাচ্চাটা। ও মা! এ কি?! ছেলের নিম্নাঙ্গ বেয়ে হলদেটে জলধারা বইছে যে! সঙ্গে বিশ্রী গন্ধ। হাফ প্যান্ট ভেজা। চট করে বাংলার ক্ষ্যাপাটে মা জননী রূপ ধারণ করলো তনিমা। ছেলেকে কাট কাট কণ্ঠে বললো,

” এসব কি রনি? তুই আবারো প্যান্টে প্রসাব করে দিয়েছিস?”

” ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ…! ”

আগত বিপদ সংকেত টের পেয়ে রনি আরো জোরে কাঁদতে লাগলো। এক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে আরেক বিপদ হাজির যে! তনিমা কটমট করে তাকিয়ে। বলে চলেছে,

” বিচ্ছু ছেলে। তোকে না কতবার বলেছি প্রসাব এলে বাথরুমে গিয়ে প্রসাব করবি। তা না করে তুই আবারো প্যান্ট ভিজিয়েছিস? ”

” আম্মু। আমি.. আমি.. ”

আহ্লাদ করে মা’কে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছিল রনি। তবে তা আর হলো কোথায়? মা জননী চোখ রাঙানি দিতেই বাবু চুপ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এরমধ্যে হারে রে রে রে করে ছুটে এলেন বছর সত্তরের মমতা বেগম। শাড়ি পরিহিতা বয়স্কা নারীটি আদরের পুতির কাছে ছুটে এলেন। উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন,

” দাদুভাই। ও দাদুভাই। কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন? মা বকেছে? ”

তনিমাকে উদ্দেশ্য করে,

” নাতবউ, তুমি আবার আমার দাদুভাইকে বকেছো? তোমাকে না কতবার নিষেধ করেছি আমার দাদুভাইকে কখনো বকবে না। ”

তনিমা অসহায় কণ্ঠে বললো,

” দাদি। বকবো না তো আর কি করবো বলো? দেখো তোমার আহ্লাদে পুতির কাণ্ড। আবারো প্যান্ট ভিজিয়েছে। ”

রনি হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

” বড়মা! আমি। আমি ভিজাইনি। ওই.. ওই শয়ন আঙ্কেল.. ”

তনিমা ছেলেকে ধমক দিয়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিল। তৎক্ষণাৎ বদলে গেল পরিবেশ। বদলালো পরিস্থিতি। কেননা নাম উঠেছে যে ‘ শয়ন সাহেব ‘ এর।

পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন এক রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে অবস্থিত সারি সারি বাড়ি। রাস্তার ঠিক ডান পাশেই পাশাপাশি একদম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে শুভ্র রঙা দুটো দৃষ্টিনন্দন একতলা বাড়ি। বাড়ি দুটোর বয়স কম নয় কিন্তু। সে-ই পনেরো বছর পূর্বে এদের জন্ম। শুভ্র রঙা দু’জন। দেখতে হুবহু একই রকম। বাড়ির অবয়ব হতে শুরু করে বাহ্যিক সৌন্দর্য পুরোটাই অবিকল এক। বাড়ি দুটোর নামেও মিল। ‘ বলাকা ‘ এবং ‘ শেষের কবিতা ‘. যে কেউ এখানে এসে প্রথম দফায় অবাক হতে বাধ্য। দেখেই মনে হয় জিগার কা টুকরো দুই বন্ধু কিংবা দুই জমজ ভাই এই বাড়ি দু’টো মনের মতো করে একই রকম দেখতে বানিয়েছে। এমনকি দু’জনেই রবীন্দ্রনাথ প্রেমী। তাই তো বাড়ির নামেও রবীন্দ্রনাথ এর সৃষ্ট রচনার নাম। বাম পাশের বাড়িটি হলো ‘ বলাকা ‘। ডান পাশেরটি ‘শেষের কবিতা। ‘

পড়ন্ত বিকেল তখন। লালচে কমলা রঙে ছেয়ে যাচ্ছে আসমান। দলবেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখপাখালি। মাশাআল্লাহ্! সে এক অপূর্ব দৃশ্য! এমনই মূহুর্তে হন্তদন্ত হয়ে ‘বলাকা’ হতে বেরিয়ে এলেন মমতা বেগম, তনিমা এবং রনি। মমতা বেগম হাঁক ছেড়ে ডাকছেন ও বাড়ির লোকেদের,

” জোহরা খাতুন। অ্যাই জোহরা খাতুন। কোথায় তুমি? এখুনি বেরিয়ে আসো। মুখ লুকিয়ে আছো কেন? বেড়িয়ে আসো বলছি। ”

দুইবার ডাকতেই শেষের কবিতাবাসী হাজির। বয়স্কা জোহরা খাতুন তার ছোট নাতনি সাফা’র হাত ধরে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললেন,

” এই এত চেঁচামেচি কিসের রে? বাড়িতে কি ডাকাত পড়েছে? অবশ্য পড়লেও বা কি? নেবে কি ওরা? ওই গুদামঘরে আছেটাই বা কি? ”

বলে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলেন জোহরা খাতুন। নাতনি সাফাও সশব্দে হেসে উঠলো। মমতা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,

” এই জোহরা খাতুন। একদম বাজে বকবে না কিন্তু। আমাদেরটা গুদামঘর হলে তোমাদের কি? ওটা তো আস্ত এক গোডাউন। ”

তনিমা ফিসফিসিয়ে দাদী শাশুড়ির কানে কানে বললো,

” দাদি। গোডাউন আর গুদামঘর কিন্তু সেইম সেইম টাইপ। ”

শুধরে দিলো তনিমা। মমতা বেগম সেসব আমলে না নিয়ে বললেন,

” ওই একটা হলেই হলো। সেম সেম। ”

জোহরা খাতুন মধ্যখানে বাঁধা দিয়ে বললেন,

” এই যে মমতা বেগম। বিকেলবেলা মানুষজন না একটু বিশ্রাম নেয়। কিন্তু তোমাদের চক্করে সে-ই বিশ্রাম তো কবেই পালিয়েছে। এবার বলো তো দেখি এমন হাভাতের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করছিলে কেন? ”

মমতা বেগম রাগত স্বরে বলে উঠলেন,

” কি বললে তুমি? আমি.. আমি হাভাতে? হাভাতে তো তোমার চৌদ্দ চৌদ্দ আটাশ গুষ্টি। ”

” তোমার আটাশ গুষ্টি। ”

” তোমার। ”

” না তোমার। ”

প্যান্ট ভেজা অবস্থায় এখনো অবুঝ খোকার ন্যায় দাঁড়িয়ে রনি। এখানে আসা হয়েছিল তার পক্ষে ন্যায়বিচার চাইতে। সে আর হলো কোথায়? বরাবরেই মতোই বাকবিতন্ডা অফট্র্যাকে পা দিয়েছে। বেচারা সে। এই দুই গুষ্টিতে ন্যায়বিচার বলে কিচ্ছু নেই। সব ম`রেছে যেন। রনির চোখেমুখের এমন করুণ হাল। বিচারের আশায় এই বুঝি কেঁদেই দেবে।

নিশিরাত। আসমানে ঝলমলে চাঁদ। নিজ ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শয়ন। বালিশে ঠেকিয়ে রাখা দামী স্মার্টফোন। ভিডিও কলে তার একমাত্র পরানের টুকরোর সঙ্গে খোশগল্পে লিপ্ত। সহসা শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো অভব্য কণ্ঠস্বর,

” শোয়াইন্না। অ্যাই শোয়াইন্না। ”

চলবে।