মন বলেছে পর্ব-০৪

0
47

#মন_বলেছে
#তাহিরাহ্_ইরাজ

[৪]

‘ ফণা তোলা সাপ খুব কষ্ট পেয়েছে কি? এবার বোধহয় অতিরিক্ত করে ফেলেছি। ধ্যাৎ তেরেক্কি। কেন যে করতে গেলাম! ‘

গোধূলি নেমেছে বসূধার কোলে। আঁধার হয়ে আসছে চারিপাশ। অন্তরীক্ষে দেখা মিলছে ঘরগামী অসংখ্য পক্ষি দলবলের। বিছানায় ম্লান বদনে বসে শয়ন। কেন? কি হয়েছে তার? জানতে হলে যে ঘুরে আসতে হবে একবার গতরাত হতে।

টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর না’ন (none)। সময় গড়িয়ে যায় তার আপন মহিমায়। ইফানার হাতে মা’র খেয়েছে শয়ন ও তার গুড়ি শিষ্য ইতিমধ্যে তিনদিন তিন রাত পেরিয়েছে। এই তিনটা দিন ও রাত নাওয়াখাওয়া একপ্রকার ভুলে, দিবারাত্রি ভেবেচিন্তে অবশেষে বুদ্ধি ওপস্ কুবুদ্ধি খুঁজে পেয়েছে শয়ন সাহেব। উদয়কৃত বুদ্ধি নিয়ে কোনো প্রকার সংশয় নেই। একদম ফুল প্রুফ আইডিয়া। ওই ফণা তোলা বিচ্ছু সাপটা এবার বুঝবে ঠ্যালা। হু। পরিকল্পনা মোতাবেক একটা সঙ্গী দরকার। পরিকল্পনা মূলত যে বাস্তবায়িত করবে। কাকে নেয়া যায়, কাকে নেয়া যায়! ইয়েস। পেয়ে গিয়েছি। তার পরানের টুকরো থাকতে চিন্তা কিসের? ও তো এক চুটকিতে সব করতে ওস্তাদ। আই মিন ‘ আ-কা-ম ‘। যেই ভাবা সেই কাজ। পরিকল্পনা তৈরি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী তৈরি। দিনক্ষণও তৈরি। নাউ লেটস্ ডিস্ট্রয় দ্য শত্রু। হা হা হা। পৈ’শাচিকতা ফুটে উঠলো শয়নের অধরকোণে।
_

চন্দ্রালোকিত রাত ছিল গতরাত। মোহনীয় নিস্তব্ধ পরিবেশ। বেলকনিতে আরামপ্রদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ইফানা। দু’পা ভাঁজ করে চেয়ারে তোলা। কানে গুঁজে ইয়ারফোন। এফএম রেডিওতে পছন্দের শো শুনছিল সে। বন্ধ চক্ষু পল্লব। ঠোঁটের কোণে ভাসছে মিষ্টি হাসি। পেরিয়ে গেল কিছু মূহূর্ত। আস্তে ধীরে ওর বেলকনির ঠিক পাশেই শোনা যাচ্ছিল কোনো অদ্ভুতুড়ে শব্দের। ইফানার কানে তো ইয়ারফোন গুঁজে রাখা। তাই সে শুনতে পাচ্ছিল না। আস্তে ধীরে শব্দের নির্যাতন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইয়ারফোনের বাইরে অন্য কোনো শব্দের আভাস পেয়ে বিরক্ত হলো মেয়েটা। এক কান হতে ইয়ারফোন খুলে তাকালো বেলকনির বাইরে। কিছুই নজরে এলো না। তবে গা ছমছমে এক শব্দ লোমকূপ দাঁড় করিয়ে দিতে লাগলো। মেয়েটার ভ্রু কুঁচকে এলো। কৌতুহলবশত আরেক কান হতেও ইয়ারফোন খুলে ফেললো। মাথা বাড়িয়ে বাড়ির বাইরেটা ভালোমতো অবলোকন করে নিলো। শব্দ আসছে। কাছেপিঠেই শব্দটার উৎপত্তিস্থল। কে ওখানে? ইফানা শুধিয়ে উঠলো,

” কে? কে ওখানে? ”

সাড়া নেই। শুধু পায়েল পায়ে কারোর হাঁটাচলার তালে সৃষ্ট ছমছম ধ্বনি।

” কে ওখানে? কি করছেন? ”

কেউ সাড়া দিলো না। ইফানা মোবাইল ও ইয়ারফোন হাতে উঠে দাঁড়ালো। ভূতপ্রেতে মেয়েটার তেমন বিশ্বাস নেই। তবে ভয়ডর আছে বেশ। তাকে অল্পতেই ভয়ে কাবু করা সম্ভব। জমিনে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর কারোর পদধ্বনি। খসখসে সে শব্দবাণে ইফানার কলিজাটা শুকিয়ে আসছে। ঘনঘন ঢোক গিলছে। শীতল স্নিগ্ধ হাওয়া শরীর ছুঁয়ে রয়েছে, তবুও ঘামছে সে। চোখ দু’টো অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অস্ফুট স্বরে ডাকছে কে রয়েছে ওখানে। কেউ সাড়া দিলো না। বরং ক্ষীণ ধ্বনিতে ওর আশপাশে খুব কাছেই ভয়াবহ কতগুলো শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে ভৌতিক সিনেমার আবহসঙ্গীত। পায়েলের রিনিঝিনি, বাতাসের তীব্রতর শব্দ, বেড়ালের ক্রন্দনরত ডাক, কোনো মেয়ের গুনগুনিয়ে কান্না। সব মিলিয়ে পরিবেশ একদম ভূতুড়ে। ইফানা টের পাচ্ছিল ওর বিপি লো হয়ে যাচ্ছে। দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে স্নায়ু। আর কিছু মূহূর্ত সেথায় দাঁড়ালেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে। তাই তো ভয়ার্ত অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ইফানা সোজা অবস্থাতেই পিছে হাঁটছিল। দৃষ্টি সামনে। তবে ভয়ে কাতর পা দু’টো পেছাচ্ছে পেছনে। পেছাতে পেছাতে ইফানা বেলকনির দরজায় পোঁছে গেল। ওদিকে ভয়ঙ্কর শব্দগুলোর নি’ষ্ঠুরতা বেড়েই চলেছে। এতটুকু সময়ের মধ্যেই ইফানা ঘেমেনেয়ে অস্থির। আশপাশে বহু গাছপালা, ঝোপঝাড়। একেকটি গাছকে ওর কাছে দানবাকার পিচাশ লাগছিল। ঘাসে ঢাকা বাগান লাগছিল ডাইনির লম্বা আঁচল। বাতাসের বেগে কানে তালা লেগে আসছিল। আকাশের চাঁদটাও ঠেকছিল ভ্যাম্পায়ারের ঠিকানা। দু হাতে কোনোমতে এলোমেলোভাবে কান চেপে ধরে ভীতসন্ত্রস্ত ইফানা ত্বরান্বিত ঘুরে দাঁড়ালো। ঘরেই ঢুকতে যাচ্ছিল। সহসা কানে পৌঁছালো বৃদ্ধা কণ্ঠে হিসহিসিয়ে ডাক,

‘ ই ফা না ‘

ডাকটা কানে প্রবেশ করতেই ইফানা অজানা মোহে ঘুরে দাঁড়ালো। তাতেই হলো চূড়ান্ত সর্বনাশ। ধর থেকে বিচ্ছিন্ন এক মুণ্ডু চোখের পলকে একদম বেলকনির গ্ৰিল ঘেঁষে ওকেই কাছে ডাকলো যেন। র”ক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, বী’ভৎস সে-ই মুণ্ডু দেখে চিৎকার করে উঠলো ইফানা। লহমায় ওর ছিপছিপে গড়নের শরীর লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। মোবাইল ও ইয়ারফোন পড়ে কোলে। বেহুঁশ ইফানা।

রাতের শেষে আগমন নতুন এক দিনের। তবে আজকের সকালটা বলাকা’য় আনন্দ ও ঝগড়ুটে পরিবেশ বয়ে আনেনি। এনেছে চিন্তার সুবিশাল পাহাড়। বসার ঘরে উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। অনুপস্থিত শুধুমাত্র ইফানা ও রনি। ইফানার বড় ভাই ইনজাম একটি চেয়ারে বসে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলছে,

” তোমরা কেউ কিছুই টের পাওনি এ কি করে সম্ভব? ”

স্ত্রী তনিমা বললো,

” আমরা সত্যি বলছি গো। ইফু তো ডিনার সেরে ঘরে গিয়েছিল সাড়ে দশটার দিকে। এরপর আমরাও যে যার ঘরে। ”

মোতালেব সাহেব চিন্তায় পড়ে বললেন,

” দিদিভাই যখন খাবার খেতে এসেছিল তখন তো সব ঠিকই ছিল। ফুরফুরে মেজাজে ছিল। এরপর হঠাৎ কি হলো যে.. ”

ইফানার বাবা ইকবাল হোসেন বললেন,

” বাবা সেটাই তো কথা। খেয়েদেয়ে ভালো মানুষের মতো ঘরে গেল আমার মেয়েটা। এরমধ্যে মাত্র এক ঘন্টায় কি অমন হলো যে ওভাবে.. সেন্সলেস হয়ে গেল? ”

মনিরা বেগম সোফায় বসে। নীরব কান্নায় লিপ্ত। আদরের মেয়েটার অমন ভগ্ন দশায় পুড়ছে ওনার মাতৃ হৃদয়। হঠাৎ কি হলো ওনার বাচ্চাটার? সব তো ঠিকই ছিল।

তনিমা বললো,

” ভাগ্যিস কাল ওসময় আমি ইফুর ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম। তাই তো ওর চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম। গিয়েই দেখি… ”

থেমে গেল তনিমা। ননদের জন্য কাতর হয়ে পড়েছে মনটা। দাদি মমতা বেগম চোখের পানি মুছে বললেন,

” আমি নিশ্চিত ওই বাড়ির কেউই আমার দিদিভাইয়ের সাথে কিছু করছে। ”

ইনজাম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে,

” কে কি করবে? ”

” করার লোকের অভাব আছে? ওই শয়ন, রুহান ছোকড়া দুইটা তো বদের হাড্ডি। ওরাই হয়তো.. ”

দাদির মুখে এতটুকু শুনেই ক্ষ্যাপাটে ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো ইনজাম। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

” ওদের একটাকেও ছাড়বো না আমি। জমিনে পুঁতে ফেলবো একদম। ”

ইনজাম বের হতে উদ্যত হলো শেষের কবিতা’র উদ্দেশ্যে। তখুনি বাবা ইকবাল হোসেন বাঁধা দিলেন,

” থামো। ”

ইনজাম দাঁড়িয়ে গেল। পিছু ঘুরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো বাবার দিকে। বাবা বলে উঠলেন,

” কিসের ভিত্তিতে যাচ্ছো তুমি? কোনো প্রমাণ আছে কি? নেই। গিয়ে শুধু শুধু বেইজ্জতি হবে। ওরা ঠিক পল্টি খাবে। এরচেয়ে ইফু মা একটু ঠিক হোক। ওর মুখেই শোনা যাক কি হয়েছিল। কে ওর সঙ্গে কি করেছে। এরপর নাহয়… ”

মাঝবয়সী লোকটির মুখভঙ্গি আস্তে ধীরে বদলে গেল। ঠোঁটে এক দুর্বোধ্য হাসি। ইনজাম সে হাসিতে সংক্রমিত হয়ে সরু হাসলো। বসলো পুনরায় চেয়ারে। মাথা তখনো দপদপ করে চলেছে। বোনের সঙ্গে কে করলো এমন শ’য়তানি? হাতের মুঠোয় একবার পেলে ছাড়বে না ওটাকে।

শয়নের আজকের দিনটা বেশ কাটলো। কাটবে না? গতরাতে দুর্দান্ত এক প্রতিশোধ নিতে পেরেছে যে। ওই না-গিন গিন গিন গিন এর বি`ষদাঁতটা ছেটে দিয়েছে। আচ্ছা হয়েছে। উচিত শিক্ষা হয়েছে। বেশ ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছে ছেলেটা। মাঝেমধ্যে আবার কি যেন ভাবছেও। ওর এই ফুরফুরে মেজাজের চৌদ্দটা বাজলো ঠিক শেষ বিকেলের দিকে। পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়েছিল বসার ঘরে। নাস্তা পানি খেতে খেতে একথা সেকথা বলছিল। শয়ন চনমনে মেজাজে গিলছিল ডালের বড়া। সসে মেখে খাচ্ছিল। আর তৃপ্তিকর অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিল। কানে যাচ্ছিল পরিবারের খোশগল্প। কথার এক ফাঁকে বজ্রপাত সরাসরি এসে পড়লো যেন শয়ন বাবুর মাথার ঠিক মধ্যিখানে। হতভম্ব নজরে বড় বোনের দিকে তাকিয়ে সে! গলায় আঁটকে সসে মাখামাখি ডালের বড়া। এসব কি করে হলো? কখন হলো? সে তো কিছুই জানে না। অবশ্য জানবে কি করে? আজ ব্যস্ত দিন ছিল যে। ভার্সিটি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা এসবেই দিন ফুরিয়েছে। এদিকে এমন কাণ্ড ঘটে গিয়েছে অজানা তার। তবে। তবে এসব হলো কি করে? ভাবতে ভাবতে আঁধার নামলো দুনিয়ায়।
..

‘ ফণা তোলা সাপ খুব কষ্ট পেয়েছে কি? এবার বোধহয় অতিরিক্ত করে ফেলেছি। ধ্যাৎ তেরেক্কি। কেন যে করতে গেলাম! ‘

গোধূলি নেমেছে বসূধার কোলে। আঁধার হয়ে আসছে চারিপাশ। অন্তরীক্ষে দেখা মিলছে ঘরগামী অসংখ্য পক্ষি দলবলের। বিছানায় ম্লান বদনে বসে শয়ন। এবার কি করা উচিত? সে আসলেই একটা ফাউল পোলা। কামের জায়গায় খালি আকাম করে বসে। অসহ্যকর। এবার কি করে সবটা ঠিকঠাক করবে? ইফানা কিছু বলে দেয়নি তো? ওর নাম? ধ্যাৎ! ইফানা নাম বলবে কি করে? সে কি ওকে দেখেছে? দেখেনি তো। কাকপক্ষী অবধি টের পায়নি কিছু। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে গিয়েও ব্যর্থ হলো শয়ন। ইফানা না জানুক। আল্লাহ্ জানেন, ওর মন জানে, পরানের টুকরো জানে ‘ সে দোষী ‘। বিষয়টি মস্তিষ্কে আসতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ধপ করে বিছানায় দুই হাত দু’দিকে ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো শয়ন। মলিন চোখ দু’টো স্থির সিলিংয়ে।

আঁধারিয়া তিমির। মৃদু হাওয়ায় উৎফুল্ল বৃক্ষপল্লব। জানালা থেকে একটুখানি দূরত্বে বিছানা। সেথায় শায়িত ঘুমন্ত কন্যার দেহ ছুঁয়ে রয়েছে চাঁদের কিরণ। দেখতে মোহনীয় লাগছে! কমনীয়তা বিরাজমান সে অসাধারণ সৌন্দর্যে! ইফানা ঘুমে আচ্ছন্ন। চোখমুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়েছে। ঠোঁট ফ্যাকাশে। র’ক্তশূন্য লাগছে। শুকনো শরীরটা আরো চিকন, রুগ্ন দেখাচ্ছে। যেন কতকাল ধরে রোগে শোকে ভুগছে সে। মেয়ের শিয়রে বসে মা মনিরা বেগম। জ্বরাক্রান্ত মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে চলেছেন। ওনার চোখ দু’টো নোনাজলে টয়টম্বুর। অন্তরটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। সে-ই গতরাত থেকে মেয়েটার জ্বর। তীব্র জ্বরে প্রায় অচেতন। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই। মেয়ের এমন দুরবস্থায় কোন মা ঠিক থাকতে পারে? উনি তো পারছেন না। শুধু আল্লাহ্’কে ডাকছেন আর চোখের পানি ফেলছেন। এভাবেই মেয়ের কাছে অনেকটা সময় ধরে বসে রইলেন মনিরা বেগম। ওদিকে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে এক ভূতুড়ে ছোকড়া। মশার কা’মড় খেয়েদেয়ে র’ক্ত বিলিয়ে দিচ্ছে অকাতরে। অপেক্ষায় রয়েছে সে। মনিরা বেগমের প্রস্থানের অপেক্ষায়। আরে আন্টি আর কতকাল সেবাযত্ন করবেন? অন্যদেরও তো একটু আধটু সুযোগ দেন। যান না এবার। মনে মনে বকবক করছে সেই আগন্তুক। আর মশা বাহিনীকে নিরস্ত্র অবস্থায় যথাসম্ভব হ-ত্যা করছে। এই মশাগুলো হাড়মাংস জ্বালিয়ে খেল একদম। বা*। কিছুটা সময় আরো পার হলো।

‘ মনিরা! এদিকে আসো তো। ‘

ইকবাল হোসেন ডাকছেন স্ত্রীকে। আহা! সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে চক্ষু জ্বলজ্বল করে উঠলো বহিরাগতের।

‘ হ্যাঁ আসছি। ‘

মেয়ের কপালে চুমু এঁকে অনিচ্ছুক মনে উঠে দাঁড়ালেন মনিরা বেগম। ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে প্রস্থান করলেন।

‘ ইয়াহু। চাল বেটা জলদি ছাদের রুট ধর। ‘

অজ্ঞাত আগন্তুক দাঁত কেলিয়ে সেথা হতে চলে গেল। উদ্দেশ্য ছাদের মাধ্যমে এই বাড়ির ঠিক এই নির্দিষ্ট কামরায় আগমন।
.

ঘুমে বিভোর ইফানা। ঘড়ির কাঁটা তখন বারোর কাছাকাছি। ঘুমে লিপ্ত পরিবারের সদস্যরা। আস্তে করে মেয়েটার ঘরের ভিড়িয়ে রাখা দরজা খুলতে লাগলো। বাহির থেকে ভেতরে এলো এক পুরুষালী অবয়ব। আলতো করে দরজা ভেতর থেকে চাপিয়ে দিলো সে। ঘুরে দাঁড়ালো। নজর আটকালো ইফানাতে। ধীরে ধীরে তার চাহনি পরিবর্তিত হলো। চোখেমুখে দুর্বোধ্য প্রতিক্রিয়া। অন্তরে কিসের যেন সুপ্ত এক পীড়ন। ধীরপায়ে বিছানার ধারে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। দৃষ্টি নিবদ্ধ মায়াবী ইফানায়। চাঁদের আলো আদর মেখে রয়েছে শ্যামরূপে। মাশাআল্লাহ্! কি অপূর্ব লাগছে দেখতে! কোনো পৌরুষ হৃদয়ে ঝড় তোলার জন্য এই শ্যামস্নিগ্ধা মুখখানিই যথেষ্ট। তোলপাড় উঠবে তনু মনে। সে টের পাচ্ছে। বুকের ভেতরে অনুচ্চ কম্পন উঠেছে। আঁখি পল্লব ঝাপটানো বন্ধ করে নিয়েছে। শ্বাস প্রশ্বাস অস্থির। শয়ন গেল। বিছানার খুব কাছে গেল। বসার জায়গা করে নিলো মেঝেতে। কুমারী, রূপবতী এক মেয়ের অচেতন অবস্থায় তার বিছানায় জায়গা করার ধৃষ্টতা দেখালো না। ভদ্রতার পরিচয় দিলো। বিছানা ঘেঁষে মেঝেতে বসলো। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো ফণা তোলা বি`ষহীন নাগিনের দিকে। এই বলেই তো ডাকে মেয়েটাকে। আর মেয়েটা? ত্বরান্বিত ক্ষেপে ওঠে। পাল্টা জবাব দেয়। তাদের এই শত্রু শত্রু খেলা, ঝগড়াবিবাদ আজকের নয়তো। সে-ই বহুকাল হতে। জন্মের পর থেকেই তারা একে অপরকে চিনেছে শত্রু হিসেবে। নেইবার দ্য এনিমি হিসেবে। কখনো মিত্রতার সুযোগ মেলেনি। দু দণ্ড মিষ্টি আলাপ করার সুযোগ মেলেই নি। সবসময় খালি ঝগড়া। ঠোকাঠুকি। বিচার আচার। আর অনুকরণ। এভাবেই তো বছরের পর বছর গড়িয়ে গেল। ভবিষ্যতেও যাবে। কিচ্ছু বদলাবে না তাদের। আসলেই কি তাই? কে জানে হয়তো ভিন্নতা আসতেও পারে। শয়ন করুণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে। বিড়বিড় করে বলছে,

‘ ইফানা! খুব কষ্ট হচ্ছে? ‘

ইফানা! আহা! সজ্ঞানে ইফানা বোধহয় কখনোই এই বল্লা’টার মুখে নিজের নামটা ঠিকঠাক শোনেনি। সবসময় ব্যঙ্গ করে ডাকবে শয়ন। এটা ওটা বলবে। ইচ্ছাকৃতভাবে ন্যাকামি করবে। ঠিকমতো ডাকেই না ওকে। আর আজ? নিদ্রাচ্ছন্ন মেয়েটিকে পূর্ণাঙ্গ নামে ডাকলো। কণ্ঠে করুণ ধ্বনি। তবে যাকে ডাকলো সে শুনতেই পেল না। হয়তো জানবেও না কখনো তার এমন দুর্দশায় পরিবারের পাশাপাশি ব্যথিত হয়েছিল…. আরো একটি বেয়াড়া হৃদয়।

‘ গেট ওয়েল স্যুন। ঝগড়া করার জন্য মুখিয়ে আছি মেয়ে। ঠিক হয়ে যাও। ‘

তখুনি ইফানা ঘুমের ঘোরে কি যেন বলে উঠলো। বিড়বিড়িয়ে। শয়ন উদ্বেলিত চিত্তে তৎক্ষণাৎ কাছে গেল।

” ইফানা! কি বলছো? কষ্ট হচ্ছে? ”

‘ প্.. ন্.. ‘

” হা! কি? আরেকবার বলো। ”

ইফানা আরেকবার বিড়বিড় করে উঠলো। শয়ন ঠিক বুঝলো না। ডেকেও সাড়া পেল না। ইফানা আবার ঘুমে তলিয়ে। ছেলেটা বসে পড়লো মেঝেতে হতাশ হয়ে। কিছুটা সময় সেভাবেই অতিবাহিত হলো। শয়ন তাকালো এ ঘরের দেয়ালঘড়িতে। রাত বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। এবার ফেরা উচিত তার। কেউ দেখে নিলে মন্দ ভাববে। তপ্ত শ্বাস ফেলে শয়ন উঠতেই যাচ্ছিল। তৎক্ষণাৎ কিছু দেখে চক্ষু ইয়া বড় হয়ে গেল। চোখের পলকে ছেলেটার ঠাঁই হলো খাটের নিচে। লম্বা ছেলেটা কোনোমতে গুটিসুটি হয়ে খাটের নিচে শুয়ে রইলো। ঘরে প্রবেশ করলেন বৃদ্ধা মমতা বেগম। ধীরপায়ে এসে বসলেন নাতনির পাশে। ঘুম আসছে না ওনার। কি করে আসবে? শান্ত নদীর মতো ওনার নাতনি। কখনোবা প্রয়োজনবোধে উত্তাল সমুদ্র। নাতি নাতনিদের মধ্যে ওনার বেশি স্নেহের এই ইফু। ছোট থেকেই দাদীর নেওটা বাচ্চাটা। দাদী দাদী বলে যখন ডাকে কলিজাটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ওর সামান্য কিছু হলেও ওনার ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়। সেখানে আজ! জ্বরাক্রান্ত নাতনিকে এভাবে দেখতে চান না তো উনি। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক বাচ্চাটা।

‘ ইয়া আল্লাহ্! ‘

বিড়বিড় করে রবের নিকট প্রার্থনা করলেন মমতা বেগম। এদিকে শয়ন পড়েছে মহা বিপদে। খাটের নিচে এভাবে আর কতকাল থাকবে সে? বুড়িটার এখুনি আসার ছিল? সে যাওয়ার পর আসলে হতো না? উফ্! শয়ন চোখ মুখ কুঁচকে গালমন্দ করতে লাগলো মনে মনে। খাটের নিচে ছটফটানি হচ্ছে। ডান হাতটি কোনোমতে একটু প্রসারিত করলো খাটের বাইরে দিকে। অমনি.. ওরে আল্লাহ্ রে! বেদনাদায়ক আর্তনাদ জোরপূর্বক মুখে হাত চাপা দিয়ে গিলে নিলো শয়ন। বুড়িটা**। ওর হাতের ওপর পারা দিয়েছে। আল্লাহ্ গো! হাতটা মনে হয় ভেঙেই গেল। বুড়ির গায়ে এত বল এলো কোথা থেকে? খায় কি এ? বৃদ্ধদের হরলিক্স? র’ক্তিম মুখে খাটের নিচে পড়ে রইলো শয়ন। মমতা বেগম কতক্ষণ বসে রইলেন। এরপর শুলেন নাতনির ঠিক পাশেই। শয়ন তো বেখবর সে সম্পর্কে। ঘুমও পাচ্ছে বেশ। অন্যদিন দুটোর আগে ঘুম ধরে না। আজ এখুনি ঘুম পাচ্ছে?

‘ আআআ ‘

হাই তুলছে ছেলেটা। নিভু নিভু করছে চোখ। মমতা বেগম নাতনির পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ওদিকে শয়ন…

চলবে।