মন বাড়িয়ে ছুঁই ২ পর্ব-১০+১১

0
637

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_১০.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

মিথ্যে বলেনি। মিথ্যে লাগেনি। মিথ্যে ছিলো না কিছুই। দুহাতে গলাটা জড়িয়ে কোলে বসলো মেহনূর। প্রাণচঞ্চল্যকর কিশোরীর ন্যায় মায়া-মায়া চোখে তাকালো। অন্ধকার থাকা সত্ত্বেও শান্ত-ধীর মুখটা দেখতে পেলো। ওই মুখে কোনো ক্রোধ নেই, গাম্ভীর্যের আভাস নেই, কাঠিন্যের ছাপ নেই। শ্রাবণের শান্ত বৃষ্টির মতো ঠান্ডা, সন্ধ্যার ডুবো-ডুবো সূর্যের মতো নিস্তেজ, পূর্ণিমার রাত্রির মতো নিরব। একটু আগে অস্থির-উৎকণ্ঠায় বিহ্বল ছিলো মাহতিম। সাগরে ডুবন্ত ব্যক্তি যখন সামান্য খড়কুঁটো পেয়ে বাঁচতে চায়, একটুখানি আশা পেয়ে যেমনরূপে অস্থির হয়, মাহতিমও যেন ওইরূপে ব্যকুল হয়ে মেহনূরকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে। পুষ্পকূটতুল্য নরম অধরযুগলে নিজের ওষ্ঠাধর গুঁজে দেয়। শুষ্ক মাটি যেমন একটুখানি পানি পেয়ে সবটুকু আর্দ্রতা টেনে নেয়, তেমনি মাহতিম আকুলভাবে ঠোঁটদুটোকে ছিন্নভিন্ন করে শুষে নিলো। পূর্বের তুলনায় সবটুকু আদুরে ছোঁয়া বহুগুনে বাড়িয়ে দিলো। যে উৎকণ্ঠিত অবস্থা কোনোদিন প্রকাশ করেনি, যেই চিত্রটা মেহনূরের কাছে খুলে ধরেনি, আজ প্রাণপণে তা মেলে দিলো। যেই দুটো বছর দিশেহারা পথিকের মতো নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগতো, আজ বহুদিন পর সঙ্গিনীর বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলো। এক কাল্পনিক স্বপ্নের মতো লাগলেও স্বপ্নচারিনীর কাছে সপে নিজেকে হালকা লাগছিলো। প্রায় বহুক্ষণ পর হৃদয়ের প্রাণদায়িনীকে ছেড়ে দিলো মাহতিম। অন্ধকারে তার শান্ত চোখদুটো কেবল কাতরের ভাষায় তাকিয়ে রইলো। সে জানে না, কি বলে প্রিয়তমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাবে। তাকে ছাড়া কতটা নাজেহাল, কতটা দুঃখ-পীড়ায় জর্জরিত ছিলো, সেকথা বলতে পারেনি মাহতিম। চুপ করে বসে রইলো, তাকিয়ে রইলো, শেষে মেহনূরের দেহ থেকে দু’হাত নামিয়ে নিলো। সে ভাবতেও পারেনি মেহনূর তার কোলের মধ্যেই চলে আসবে। অম্লানবদনে তাকিয়ে-তাকিয়ে চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করবে। মেহনূর চোখে-চোখ মিলিয়ে নরম সুরে বললো,

– হয়তো শাড়ি পুড়িয়ে দিতাম। কিন্তু স্মৃতিচিহ্ন পুড়ানো সম্ভব? আমার মধ্যে যেই দাগকাটা স্মৃতি আপনি গেঁড়ে দিয়েছেন, সেগুলো কি ভুলতে পারবো? আপনাকে জড়িয়ে আমার সবকিছু কেটেছে, আমি কি মুছতে পারবো? যদি পারতাম, যদি আমার ক্ষমতা বেড়ে যেতো, তাহলে নিষ্ঠুরভাবে সব পুড়িয়ে দিতাম। আপনাকে ছাড়ার পর সব জিনিস ছাই করে ফেলতাম। আমি পারিনি। আপনাকে দুঃখ দিলে আমার গায়েই লাগে। আপনাকে জড়িয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। সেখানে বিষ দিলে আমার গলাই জ্বলে। কেন আপনি এতো মায়া বাড়িয়ে দিলেন? কেন আপনার প্রতি দূর্বলতা শিখালেন? আমার মধ্যে ভালোবাসার সর্বনাশী বুননটা কেন গেঁথে দিলেন বলুন?

মেহনূর একটু থামলো। মূলত থামিয়ে দিলো মাহতিম। মেহনূরের হাতদুটো ঘাড়ের পেছন থেকে আলগা করতেই রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বেজে উঠলো। বাইরে বৃষ্টি না থাকলেও বাতাসের হুল্লোড় চলছে। কানে সেই শব্দ স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। অকস্মাৎ বুকের ধুকপুকনি বেড়ে গেলো মেহনূরের। মাহতিম কি করতে চাইছে? হাতদুটো সরিয়ে দিলো কেন? কেন সে চুপ করে আছে? মেহনূর একটু নিজের মনে প্রশ্ন কষে চললো। মাহতিমের নিশ্চুপ অবস্থা বড্ড এলোমেলো করে দিলো। মেহনূর ঢোক গিলে যেই প্রশ্ন করবে, ঠোঁট খুলে যেই বলতে নিবে, ঠিক তখনই মাহতিম আস্তে করে মেহনূরের বাহুদুটো ধরলো। বাহু ছুঁয়ে-ছুঁয়ে কোমরের দুপাশ ধরে শীতল কন্ঠে বললো,

– ডান কাধের চুলগুলো সরাও।

এমন আদেশ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা হয় মেহনূর। কারণটা না বুঝলেও চুপচাপ মানলো। বাঁ-হাতটা উলটো করে ডানকাধের কাছ থেকে চুল সরালো। গোছা-গোছা চুলগুলো বাঁ-কাধে টেনে আনলো। মেহনূর প্রশ্ন বাড়িয়ে কিছু বলতে নিলো,

– আপনি কি —

ওমনেই চোখের কপাট বন্ধ করলো মেহনূর। কোমরের দুপাশ থেকে শক্ত বেড়িবাঁধ তাকে প্যাঁচিয়ে ধরলো। বুক ফুলিয়ে শ্বাসবায়ুটা উচ্চ তরঙ্গে আঁটকে গেলো ওর। হিম করা অনূভুতিতে সিক্ত হলো মেহনূর। রিনিঝিনি হাতদুটো বিছানার চাদর খামচে ধরলো। ক্লিভ শেভের খোঁচা-খোঁচা গালটা মেহনূরের গলায় ছুঁয়ে দিচ্ছে। মানুষটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলতেই নিবিড় কন্ঠে বললো,

– মেহনূর,

ডাক শুনে আমতা-আমতা করে উত্তর দিলো মেহনূর,

– জ-জ-জ্বী,

সাড়া পেয়ে মুচকি হাসলো মাহতিম। মেহনূরের কাধের হাড্ডিতে ঠোঁট রাখলো সে। আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই ঘোরলাগা কন্ঠে বললো,

– আমি যা বলবো, আমার সাথে-সাথে বলবে। একটুও এদিক-ওদিক যেন না হয়। যদি দেরি হয়, খুব অত্যাচা —

তাড়াতাড়ি কথাটা ছিনিয়ে নিলো মেহনূর। বেচইন কন্ঠে বললো,

– না, না; দেরি না। আপনি বলুন, আপনি বলুন।

সারা পিঠময় হাত বুলাচ্ছে মাহতিম। কোমরে একটা হাত তখনও রাখা। মেহনূরকে জব্দ করতে গলার ছোট্ট তিলতুল্য জায়গায় চুমু বসিয়ে দিলো। ধীরকন্ঠে সুক্ষ্ম দম্ভ নিয়ে বললো,

– আমি মেহনূর আফরিন…

মাহতিমের ফ্যাসাদে কাতর মেহনূর হালকা গলায় বললো,

– আমি মেহনূর আফ-আফরিন…

– আমার স্বামী মাহতিম আনসারীর…

– আমার স্বা-স্বামী মাহতিম আনসা-সারীর…

– সকল কথা মানিয়া চলিবো।

– সকল কথা মানিয়া চলিবো।

– তাহাকে ছাড়িয়া কখনো কোনোদিন যাওয়ার চিন্তাভাবনা আনিবো না।

– তা-তাহাকে ছাছা-ড়িয়া কখনো কোনোদিন যাওয়ার চিন্তাভাবনা আনিবো না।

– যদি এই ধরনের পরিকল্পনা করি,

– যদি এই ধরনের চিন্তা করি,

– একটা লাগাবো! ভুল বলা নিষেধ। বলো, যদি এই ধরনের পরিকল্পনা করি,

মেহনূর দম আঁটকানো সুরে বললো,

– যয-দি এই ধরনের পরিকল্পনা করি,

মাহতিম আশ্বস্ত হয়ে বললো,

– তাহলে আমার স্বামী যা শাস্তি দিবেন, তাই আমি মানিয়া চলিবো।

চোখ কুঁচকে ঠেলে-ঠেলে বললো মেহনূর,

– তাহলে আমার স্বামী যা শা-শাস্তি দিবেন, তাই আমি মানিয়া চলি-চলি-চলিবো।

শেষের কথাটা বলে চোখ খিঁচালো মেহনূর। গলায় প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে চোয়াল শক্ত করলো। চাদর থেকে হাত সরিয়ে গলার কাছে মাথাটা দু’হাতে ধরলো। মানুষটার চুলের অরণ্যে আঙ্গুল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে অনুরোধের সুরে বললো,

– এবার যে ব্যথা পাচ্ছি। মাফটা মন্ঞ্জুর করলে হয় না?

সভ্য ব্যক্তির মতো ছেড়ে দিলো মাহতিম। কোল থেকে নামিয়ে দিলো মেহনূরকে। বিছানা থেকে দু’পা ফেলে দাঁড়িয়ে পরতেই প্রসন্ন সুরে বললো,

– অনেক কিছু করার ইচ্ছে ছিলো। কিছু করলাম না। সামনে তোমার বোর্ড এক্সাম। স্পেশাল ডোজটা আপাতত তোলা থাক। জানালাটা খুলে দাও। আমি মোমবাতি জ্বালাচ্ছি।

গলায় হাত বুলাতে-বুলাতে জানালা খুললো মেহনূর। একঝাঁক বৃষ্টি মিশেল হাওয়া ওর চোখে-মুখে ছুঁয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলো মেহনূর। কি তরতাজা ঠান্ডা হাওয়া! একরত্নি ধূলো নেই, গন্ধ নেই, প্রাণবন্ত সজীব হাওয়া। চোখ খুলে বিছানার বালিশ সাজালো মেহনূর। টেবিলের উপর সাদা লকলকে মোমটা জ্বালালো মাহতিম। ম্যাচ বাক্সটা টেবিলে রাখতেই বিছানার দিকে তাকালো। পূর্ণদৃষ্টিতে দুটো নেত্রযুগল এক হয়ে আছে। একজনের ঠোঁটে মুচকি হাসির ছোঁয়া, অপরজনের ঠোঁটে বাঁকা হাসির টুকরো। মেহনূরের দিকে ভ্রুঁ নাচিয়ে মাহতিম জিজ্ঞেস করলো ,

– কি দেখছো?

অকপটে বললো মেহনূর,

– আপনাকে।

মৃদ্যু হাসলো মাহতিম। বিছানার দিকে পা ঘুরালো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে এগুতে-এগুতে বললো,

– আমাকে দেখার কিছু নেই। তোমাদের ভাষায় আমি একজন ‘ রসকসহীন ‘ মানুষ। যার মধ্যে শুধু ভোঁতা অনুভূতি আছে। সেখানে খুঁজাখুঁজি করলে কিছু মৃত স্মৃতি পাবে। মেবি আর কিছুই না।

বিছানায় শুয়ে পরেছে মেহনূর। খাটের বাঁ-দিকে মাহতিমের জন্য জায়গা ছেড়েছে। কাছাকাছি আসতেই বিছানায় হাঁটু ফেলে উঠে পরলো মাহতিম। খালি জায়গায় শোয়ার জন্য গা ছাড়বে, তখনই মেহনূর ব্যস্ত গলায় বলে উঠলো,

– ওখানে ঘুমোচ্ছেন কেন?

মাহতিম আশ্চর্য হয়ে শোয়া থামিয়ে ফেললো। কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে বললো,

– কোথায় ঘুমাবো? তুমি কি নিচে শুতে বলছো?

‘ না ‘ করলো মেহনূর। এক প্রস্থ মিষ্টি হাসি দিলো। মাহতিমকে বক্ষস্থলে রাখার জন্য, তাঁকে কাছে আসার জন্য, তাঁকে আবদ্ধ করার জন্য দু’হাত মেলে দিলো। শূন্য দুটি হাতে আঙুল নাড়িয়ে আসতে ইশারা করলো। মাথাটা একবার উঁচু-নিচু করে শেষ আহবানটা জানিয়ে দিলো। আকুল মাখানো প্রীতিপূর্ণ আবদারে ঝাঁপিয়ে পরলো মাহতিম। একমাত্র শয্যাসঙ্গিনীর বুকে মাথা রেখে দিলো। চোখের পাতা দৃঢ়ভাবে বন্ধ করতেই অজানা কারণে চোখ ভিজে এলো। হাতের পাঁচ আঙ্গুলে পিঠের ব্লাউজটা মুঠো করলো সে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে আর্দ্র গলায় বললো,

– আমাকে ছেড়ে যেও না মেহনূর। তোমাকে খুব ভালোবাসি। একটু আগে চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছিলো। এমন ব্যথা পাচ্ছিলাম, আমার কলিজাটা বুঝি দু’টুকরো হয়ে ছিঁড়ে গেছে।

মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরলো মেহনূর। চুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে গভীরভাবে চুমু খেলো। পিঠে হাত বুলাতে-বুলাতে বললো,

– ছেঁড়া কাপড় পুড়িয়েছি গো। ওটা কিচ্ছু ছিলো না। আপনার কিছুই আমি পুড়াইনি। শুধু ঝাঁজালো গন্ধ আনার পর দুটো শুকনো মরিচ পুড়িয়েছিলাম। আর কথা না। আর কিচ্ছু বলবেন না। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। চোখদুটোকে ঠান্ডা করুন। বুকে একটু ঘুম দিন। আর কথা বলবেন না। ঘুমিয়ে পড়ুন। ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়ুন।

.

বৃষ্টিস্নাত সকাল। শেষ রাত্রিরে বৃষ্টি হয়েছে। বড়-বড় কচুপাতায় শিশির জমেছে। রৌদ্রের আলোতে মুক্তোর মতো জ্বলছে। ভোরের আলোটা বাড়তে-বাড়তে সকাল হয়ে গেছে। চারিদিকের নিরবতা ভেঙ্গে পাখির কলরব উঠলো। বাতাসে-বাতাসে এক পশলা হাওয়া মর্মর শব্দ করছে। গেরস্থ বাড়ির উঠোনে হাস-মুরগী ছেড়েছে। ধীরে-ধীরে প্রাতঃকাজ সেরে গ্রামবাসীরা জাগছে। দূর-দূরান্তে চাপকল চাপার ধ্বনি। কলপাড়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মুখ ধুচ্ছে কেউ। কেউ আবার বাঁহাতের তেলোয় কয়লা নিয়ে সন্তর্পণে দাঁত ঘষছে। গরুর হাম্বা-হাম্বা ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো মেহনূরের। গোয়ালের কালো গরুটা প্রাতঃকালে খুব ডাকে। একটা মোরগের চেয়ে বেশি ডাক ছাড়ে। দু’চোখের পাতা খুলে হাই তুললো মেহনূর। ঘুমের রেশ নিয়ে শরীর টানা দিতেই হঠাৎ বুকের কাছটায় খেয়াল হলো। ওমনেই তড়িঘড়ি করে থেমে গেলো। ভাগ্যিস ঘুমটা গভীর। নাহলে ঠিকই জেগে যেতো। বুকের মধ্যে ছোট্ট অবুঝ বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে আছে মাহতিম। কেউ যেনো একরাশ স্নিগ্ধতা ঘুমন্ত মুখে লাগিয়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে লম্বালম্বি এক টুকরো রোদ মুখের উপর পরেছে। মেহনূর সেটাকে আড়াল করার জন্য ডানহাতে বাধা দিলো। মুখ ঝুঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে সকালের স্পর্শটা কপালে বসিয়ে দিলো। চোখ খুলে হাসি-হাসি মুখে বললো,

– আপনার কপাল থেকে সব চিন্তা দূর হয়ে যাক।

জানালা দিয়ে ক্ষণিকের জন্য ঠান্ডা হাওয়া ঢুকলো। ঘুমন্ত মুখের কপালে কয়েকটা চুল উড়ে এসে থামলো। মেহনূর ডানহাতের তর্জনীতে চুল সরাতেই হঠাৎ কানে অদ্ভুত কিছু ঠেকলো। ব্যাপারটায় গুরুত্ব দেওয়ার জন্য তর্জনীটা থামালো মেহনূর। কয়েক সেকেন্ড শুধু কান খাড়া রাখলো। নিচ থেকে একটা হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। গলাটা বোধহয় বড়মার। বড়মা সাতসকালে কখনো চেঁচায় না। এ বাড়ির একটা নিয়ম আছে। সকাল-সকাল বাড়ির মহিলাদের কন্ঠ উচ্চস্বরে উঠলে সেদিনটা নাকি ভালো যায় না। যদিও এটা কুসংস্কার। কিন্তু ব্যাপারটা মেহনূরের দাদী মেনে চলতো। মেহনূর উঠবে-কি-উঠবেনা এমন একটা দোটানায় পরলো। একদিকে ক্লান্ত মাহতিমের ঘুম, অন্যদিকে বড়মার উচ্চস্বর। মেহনূরের কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগলো। বড়মা কিছুতেই অপ্রতিভ আচরণ করে না। বিনা কারণে তো কখনোই না। আজ সকাল-সকাল নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। নিচে একবার যাওয়া দরকার। কিন্তু কিভাবে যাবে? মাহতিমকে সরালেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে। এখন উপায় কি? নিচ থেকে শব্দ আরো বেড়েছে। এবার বড়মার সাথে শেফালির কন্ঠও যুক্ত হয়েছে। হৈচৈয়ের মাত্রাটা অতিমাত্রায় ঠেকেছে। রুমের দরজাটা বেশ দূরে। সেই সঙ্গে দরজাটা কাঠের হবার ফলে শব্দ কম। মেহনূর গা থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ঘুমন্ত মাহতিম ঘুমন্ত বাঘের মতো ধরেছে। থাবার মধ্যে শিকারি ধরার মতো শক্ত। মেহনূর হাল ছেড়ে ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ফেললো। ঘুমন্ত মুখে তাকিয়ে উপায়হীন সুরে বললো,

– আমাকে এভাবে ধরেছেন কেন? আমি কি পালিয়ে যাব? নিচে কতক্ষণ ধরে হাউকাউ করছে, অথচ আপনাকে উঠাতে —

হঠাৎ বাকি কথার মাঝখানে চমকে উঠলো মেহনূর। আপনাআপনি ওর কথায় দাড়ি বসে গেলো। নিচ থেকে হুঙ্কারের গলা ঝরছে। দফায়-দফায় গলা উঁচাচ্ছে বড়মা! মেহনূর অপ্রস্তুত ভয় নিয়ে অবাক হলো। মাহতিমের ঘুমও ইতিমধ্যে ভেঙ্গে গেলো। মেহনূরকে একবার জিজ্ঞেস করলো মাহতিম,

– নিচে কিছু হয়েছে? গলাটা বড়মার না? উনি কেন চেঁচাচ্ছে?

মেহনূর অবুঝ ভঙ্গিতে মাহতিমের দিকে তাকালো। ‘ না ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে বললো,

– আমিও তো জানি না। আপনি ঘুমাচ্ছেন দেখে উঠতে পারিনি। বড়মা অনেকক্ষণ ধরে হৈচৈ করছেন।

মাহতিম একলাফে বিছানা থেকে উঠলো। তাড়াতাড়ি গায়ে টিশার্ট গলাতেই বললো,

– তুমি আস্ত একটা বো:কা। নিচে গণ্ডগোল হয়েছে তুমি আমাকে তুলবে না? বো:কার মতো আমার ঘুম দেখার মানে আছে? আল্লাহ্-ই জানেন নিচে কি হয়েছে! তুমি চটপট নামো। আমি আগে দেখে আসি।

মাহতিম তাড়াহুড়ো করে দরজার কাছে গেলো। জং ধরা ছিটকিনিটা জোর খাটিয়ে খুলতেই আরেকদফা চিৎকার শুনলো! চকিত হলো মাহতিম। এবারের কন্ঠটা শেফালির! মাহতিম ছিটকিনিতে হাত রেখে মাথা পিছু ঘুরালো। সোজাসুজি মেহনূরের দিকে তাকালে একসাথে দুজন অবাকের কন্ঠে বললো,

– মেজো মা!

শেফালি আলাদা তেজে ঔদ্ধত্যের সুরে বললো,

– আমি তোরে ত্যা:ইজ্য ভাইব্বা ফালাইছি। তু:ই আমার চক্ষের সা:মনেরতে দূর হ! আমারে তুই বা:ন্দি পাইছোস? যখন মন চায় আইবি? যখন মন চায় আবদার করবি? এতোই সুজা লাগে?

চলমান .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_১১ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

প্রচণ্ড শোরগোল হচ্ছে। কোনোক্রমেই সেটা থামছে না। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে এখন। হৈচৈ যেন কমছে না। দ্রুত দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে গেলো মাহতিম। লম্বা বারান্দা পেরুতেই নিচের দিকে তাকালো। চোখে বিষ্ময় নিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো। মনে-মনে উচ্চারণ করলো, ‘ এটা এখানে কেন? এই বদমাইশ কি করতে এসেছে? ‘। নিচ থেকে চোখ সরিয়ে সিঁড়ি ধরলো মাহতিম। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে নিচে নামলো সে। যতটুকু বুঝতে পারলো শেফালি এখন চটে আছে। চোখে-মুখে রাগীভাব। দাঁত কিড়মিড় করছে। আগত ছেলেটার গায়ে কালো স্যূট-প্যান্ট, ডানহাতে একটা ব্রিফকেস। বেশভূষায় বিদেশি-বিদেশি ছাপ থাকলেও চোখে একটা কটা ভাব আছে। সুজলা তিরিক্ষি মেজাজে কিছু বলার জন্য অগ্রসর হবেন, তখনই ছেলেটা বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,

– আমি আপনাদের চেহারা দেখতে আসিনাই। আই নিড্ মানি। আমার টাকা লাগবো। পাঁচ লাখ টাকা দেন, নাইলে আমিও এখান থেকে যাইতেছি না। দাদার টাকা-পয়সা ক্যামনে গিলেন আমিও দেখবো।

কথা শুনে গর্জে উঠলো শেফালি। রাগ সামলাতে না-পেরে উঠোন পরিষ্কারের ঝাঁটাটা হাতে নিলো। এক চোট মারতে নিলে শেফালির রণমূর্তি দেখে তাড়াতাড়ি চোখমুখ খিঁচে পিছিয়ে গেলো সিফাত। পরিস্থিতিটা দ্রুত সামলানোর জন্য শেফালির ডানহাতটা ধরলো মাহতিম, একচান্সে ঝাঁটাটা নিজের হাতে নিয়ে শেফালিকে আঁটকে দিলো। শেফালি আরো ক্ষেপে গিয়ে চেঁচাতে লাগলো। সিফাতের দিকে যতো প্রাণপণে এগুতে চাইলো, ততবার পেছন থেকে দু’হাতে আঁটকাতে থাকলো মাহতিম। অনবরত সে বলতে লাগলো,

– থামুন মেজো মা। মাথা ঠান্ডা করুন। প্লিজ আমাকে ব্যাপারটা দেখতে দিন। এই বদমাইশের সামনে সিন-ক্রিয়েট করার প্রয়োজন নেই।

অপরদিকে শেফালি বাঘিনীর মতো হামলা করার বাসনায় উচ্চকন্ঠে বললো,

– মাহতিম থামাইও না বাবা, থামাইও না। আমারে আইজকা ছাইড়া দেও। এই কুত্তার বাচ্চারে আগে শিক্কা দিয়া লই! এই জানোয়ার আমারে কতো বড় পিত্তি দেখায় দেখছো? ওয় আমার সামনে ভাবীরে কিরম চোখ রাঙানি দেয়! শয়তান, চা:মার! ওই জানোয়ার! তুই আমারে পেটে ধরছোস? আমারে পালছোস তুই? পালনের যহন বয়স আইলো, তুই টেহা চাইতে আইছোস! তোরে তো ঝাঁটি দিয়া বাইড়ায়া-বাইড়ায়া খেদান দরকার। ছাড়ো মাহতিম, আমারে ছাইড়া দেও। এই কুলাঙ্গারের বাচ্চারে সোজা করুম। ওরে আমি ছাড়ুম না।

অনেক কষ্টে শেফালিকে থামালো মাহতিম। শান্ত করে একসাইডে দাঁড়াতে বললো। সুজলার দিকে তাকালো মাহতিম। সম্পূর্ণ ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– বড়মা আপনি কি একে রাখতে চান?

ডানহাতের তর্জনী তুলে সিফাতের দিকে ইশারা করলো মাহতিম। উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো সুজলার দিকে। একমাত্র সুজলার কথায় সবকিছু স্থির করবে। সুজলা দুই মিনিটের মতো নিরব থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,

– আমি একে চিনি না। মেজো বউও একে চায় না। বাড়িটা আপদমুক্ত করো মাহতিম। আমার কোনো আপত্তি নেই। নাস্তা বানানোর সময় হয়েছে। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।

একটু-একটু করে বাঁকা হাসিটা ফুটে উঠলো ঠোঁটে। ঠিক এমন উত্তরটাই মাহতিম চেয়েছে। সুজলার কাছ থেকে যোগ্য জবাব পেয়ে মাথাটা সামনে ঘুরালো সে। সরাসরি তাকালো সিফাতের দিকে। তর্জনী নামাতে-নামাতে বাঁকা হাসিটা মিলিয়ে দিলো। একদম হাসিহীন ঠোঁটে পাষাণের মতো তাকালো। সিফাত যতই ভয় পাক, হাবভাবে বুঝতে দিলো না। কিন্তু বেচারা সিফাত পরের র্কীতি সম্বন্ধে অবগত না। মাহতিম ওর দিকে একপা-একপা করে এগুতেই কাট-কাট সুরে বললো,

– দ্যা ইউনাইটেড আরব আমিরাত। সেখান থেকে ইউনাইটেড স্টেটস। নিউইয়র্কের মতো বড়লোকি জায়গায় জুয়াখেলা শুরু। ক্যাসিনোতে লাখ-লাখ টাকা হার। গাম্বলিং করতে-করতে সব অর্থ শেষ। দেশে ফেরার টাকা ছিলো না। এক আমেরিকান নারীকে প্রেমের জালে ফাঁসানো। কিছু টাকা উদ্ধার। তারপর —

সিফাতের মুখ ভয়াবহ কালো। গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে। ভীতিপ্রবণ অবস্থা সারা মুখে ছড়িয়ে আছে। মাহতিম একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। ঠোঁট গোল করে ছোট্ট একটা শিষ বাজাতে-বাজাতে ডানহাতে প্লেনের উড়ার ইঙ্গিত দিলো। ভ্রুঁদুটো দু’বার নাচিয়ে সিফাতের উদ্দেশ্যে বললো,

– তারপর বিদেশ-টু-বিডি। তাই না মিস্টার স্টিফেন?

বিদ্যূৎপৃষ্টের মতো চমকে গেলো সিফাত। চোখদুটো গোল-গোল করে আস্তে করে ঢোক গিললো। এই লোকটা কে? কিভাবে এতোকিছু জেনেছে? চুটিয়ে ঘামছে সিফাত। প্যান্টের লেফট্ পকেট থেকে রুমাল বের করতেই ভীতিপ্রদ কন্ঠে বললো,

– হু আর ইউ?

একগাল হাসি দিলো মাহতিম। গলা খাঁকাড়ি দিয়ে হাতদুটো প্যান্টের পকেটে গুঁজলো। মাথাটা বামে ফিরিয়ে চোখদুটো ঠিক দোতলার দিকে রাখলো। ওরকম চাহনি দেখে সিফাত খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। অন্যদিকে তাকালো কেন? সেও মাহতিমের দৃষ্টি লক্ষ করে দোতলার দিকে চাইলো। কপালের বাঁদিকটা রুমালে মুছছিলো সে, তৎক্ষণাৎ কিছু দেখতে পেয়ে বাঁ-হাতটা থেমে গেছে। ভূত দেখার মতো ঠোঁট ফাঁক করলো সিফাত। উজবুকের মতো একবার দোতলার দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো মাহতিমের দিকে। দোতলায় তখন মেহনূর দাঁড়িয়ে আছে। সেই ছোট্ট-শৈশব-বাচ্চামো চিত্র আর নেই। বদলে গেছে মেহনূর। যৌবনে পদার্পণ করা টগবগে যুবতী এখন। যেন সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো মায়াবী। চোখের চাহনি, মুখের শ্রী, দেহের গড়ন সব মিলিয়ে সুরসুন্দরী। সিফাতের অবাক চাহনি দেখে মেহনূর অস্বস্তি বোধ করলো। এক দৌঁড়ে বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকে পরলো। সিফাত চোখ নামিয়ে মাহতিমের দিকে চাইলো। মনটা প্রচুর খচখচ করছে। অনেক কিছু জানার জন্য অস্থির লাগছে। মাহতিম ওর প্রশ্নাতুর অবস্থাটা বুঝতে পেরে বলিষ্ঠ কন্ঠে বললো,

– মোল্লাবাড়ির ছোট নাতজামাই। মাহতিম আনসারী। পেশায় বাংলাদেশ নেভির সদস্য। বয়সে আপনার চেয়ে সিনিয়র আছি। সম্পর্কের দিক থেকে কিছুটা ছোট। এতোসব তথ্য কিভাবে জোগাড় করলাম, নিশ্চয়ই সেটা ব্যাখ্যা দিতে হবে না।

সিফাত নিজেকে সামলে নিলো। কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হবে। একটুও বাজে আচরণ করা যাবে না। নেভালের লোকজন ভালো না। এদের মেজাজ খুব চড়া থাকে। কখন কি করে বসে, কিচ্ছু বলা যায় না। একটু আগে যেই লোকটা হাসতে-হাসতে কথা বললো, এখন তার মুখের অবস্থা অবর্ণনীয়। একেবারে চেন্ঞ্জ অবস্থা। সিফাত খুব মাপযোগ করে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি কিভাবে জানলেন? আমার পেছনে লোক লাগিয়েছেন? আমিতো আপনাকে চিনি না। আপনি কি করে আমার পরিচয় পেলেন?

মাহতিম কোনো জবাব দিলো না। দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। এই বদমাইশের সাথে কথা বলতে অসহ্যবোধ হচ্ছে। এর চেহারা দেখলে তরুণের কথা মনে পড়ছে। এই বদমাইশটা ওই শয়তানকে বন্ধু পাতিয়েছিলো। মাহতিম কোনো ভণিতা না-করে মোদ্দাকথায় ফিরলো,

– আপনি কি মাল নিবেন, না বিদায় হবেন?

কথাটা ধরতে পারলো না সিফাত। ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকতেই বোকা গলায় বললো,

– জ্বী?

কিছুক্ষণ নিরব থাকলো মাহতিম। পকেটে এখনো হাতদুটো গোঁজা। সিফাতের দিকে তাকিয়ে থাকতেই দ্বিতীয়বার শুধালো। কিছুটা গাম্ভীর্যের সাথে প্রতিটা শব্দ থেমে-থেমে বললো,

– আপনি কি মাল নিবেন, নাকি বিদায় হবেন?

‘ মাল ‘ শব্দটা শুনে সিফাত টাকার কথা ভাবলো। মাহতিম বোধহয় টাকার ব্যাপারটা অন্যভাবে বোঝাচ্ছে। একপ্রকার মুগ্ধ হলো সিফাত। এরকম বোনজামাই পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। কি সুন্দর করে মালের কথাটা তুললো। সিফাত মিষ্টিমধুর হাসিতে সায় জানিয়ে বললো,

– আমি মাল নেবো ভাইজান। তখন তো পাঁচ চেয়েছি। এখন আপনাকে দেখে দশ বলতে চাচ্ছি। এক কাজ করুন, আপনি খুশি হয়ে দশই দিন। জিনিপত্রের যা দাম। বুঝেনই তো সমস্যা?

মাহতিমও তাল মিলিয়ে হাসলো। সিফাতের কথায় হাস্যমুখে সায় দিলো। পকেট থেকে ডানহাত বের করে কপালের ডানদিকটা চুলকাতে লাগলো। সিফাত বেজায় খুশি। পুরো দশ লাখ টাকা দিচ্ছে! খুশিতে গদগদ হয়ে যেই ‘ হিহি ‘ টাইপ হাসি দিবে, প্রচণ্ড শব্দে বাঁ-গালে চড় পরলো। গালের চামড়াটা বুঝি ধাঁইধাঁই করে জ্বলছে। কানটা তব্দা লেগে ‘ ভোঁ ‘ জাতীয় শব্দ হচ্ছে। কঠিন এক চড় খেয়ে মাথা ঝাঁকানি দিলো সিফাত। চোখে এখন ঝাপসা দেখছে। দোতলা থেকে সম্পূর্ণ দৃশ্য দেখছে দু’বোন। সাবা রোষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাজটার প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁত চিবিয়ে বললো,

– একদম ঠিক আছে। খুশি হয়েছি। মাহতিম ভাইয়া আরো মারো। আরো মারো। পিটিয়ে এটাকে বিদায় করো। জোচ্চোরটা যেনো জীবনেও না-আসে।

পাশেই অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সুরাইয়া। সিফাতের করুণ দশা দেখে কিছুতেই ভালো লাগছে না। যত কিছু হোক, ওর তো ভাই। ওকে তো একসময় দেখে-দেখে রেখেছে। কোনোদিন অন্যায় করেনি ওর সাথে। ছোটবেলার কথাগুলো ভাবলে আজও খারাপ লাগে। সিফাতকে ‘ দাদা ‘ ডাকতো সে। সেই দাদা কতবছর পর ফিরেছে। কিন্তু দাদা আজ এমন কেন? সেই দাদাটা কোথায় হারিয়ে গেলো? যেই দাদাটা সুরাইয়ার জন্য চকলেট এনে দিতো, মাথার তুলি কিনে আনতো, মায়ের খুব ভক্ত ছিলো, সে আজ কোথায়? কেন সিফাত দাদা কুসঙ্গে ফাঁসলো? ওই তরুণের মতো নেশাখোরকে কেন পছন্দ করলো? পুরোনো কথা ভাবতে গিয়ে চোখদুটো ভিজে এলো। খুব সাবধানে আঁচল টেনে চোখ মুছে নিলো। সাবা আড়চোখে ব্যাপারটা লক্ষ করে সুরাইয়ার দিকে তাকালো। নিচু সুরে বললো,

– তোর খুব খারাপ লাগছে, না?

সুরাইয়া চোখ মুছা থামিয়ে সাবার দিকে তাকালো। ঠোঁটে অপ্রস্তুত হাসি টেনে এড়ানোর জন্য বললো,

– রাত জেগে পড়তে-পড়তে চোখটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বুবু। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। খুব পানি পরে।

সাজানো মিথ্যা শুনে মিচকি হাসলো সাবা। বাঁদিকে কনুই গুঁতা মেরে ফাজলামি করে বললো,

– এইতো আর ক’টা দিন। তারপর তুইও মেহনূরের মতো আকাম করবি। সারা রাত জাগবি। জামাই পালবি। ব্যাপারটা ঠিক আছেনা সুরাইয়া?

লজ্জায় অবাক হলো সুরাইয়া। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

– কি খারাপ! তুমি দিনদিন খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো বুবু। এটা কিন্তু ঠিক না। আমি কিন্তু বড়মার কাছে বিচার দেবো।

সুরাইয়ার রাগ দেখে পাত্তাই দিলো না সাবা। উলটো মুখ ভেংচিয়ে বললো,

– যা যা বল গা। তোকে আমি ভয় পাই নাকি? তুই একদিক দিয়ে আম্মার কাছে যাবি, আমিও তোর ফেল্টুস খাতা মেজোমার হাতে গুঁজে দেব।

সুরাইয়া কিছু বলার সুযোগ পেলো না। আর কথা এগুলো না। পরিবেশটা ইতিমধ্যে গরম হয়ে গেছে। দু’বোনের দৃষ্টি নিচের দিকে থেমেছে। সিফাতের অবস্থা দেখে সুরাইয়া খপ করে সাবার হাত ধরলো ধরলো। ভয়কাতুরে দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে থাকলো। সিফাতের মুখ বরাবর চরম একটা ঘুষি পরেছে। সেই ঘুষিতেই নাকের ছিদ্রপথে টলটল করে রক্ত বেরুচ্ছে। এটুকুতে থামেনি মাহতিম। আরেকচোট আঘাত কান বরাবর মারলো। ওই দৃশ্য দেখে চোখ খিঁচালো ওরা। দ্রুত সুরাইয়ার হাত ধরে রুমে ঢুকলো সাবা। ওই নৃশংস মারগুলো দেখার মতো না।

.

সকালটা বিশ্রীভাবে শুরু হলো। শুরু হলো একের-পর-এক ঘটনা। যেই ঘটনা সবকিছু বিগড়ে দিলো। কেউ বুঝতে পারেনি, ধরতে পারেনি এমন কিছু হবে। এক অদৃশ্য ঝড় দামামা বাজিয়ে আছড়ে পরবে। সিফাতের আগমন নিয়ে ক্ষুণ্ণ ছিলো সবাই। তাকে বিদায় করার পর স্বস্তি পায় তারা। মাহতিমের বেধড়ক পিটানো নিয়ে কোনো আপত্তি ছিলো না। সকালের নাস্তা খেতে টেবিলে বসে সবাই। গতকাল দুপুরে এসেছে মাহতিম। হুট করেই এসেছে। মেহনূর যখন অনুষ্ঠান ছেড়ে বাড়ি চলে আসে, তখনই সুজলা আসল ঘটনা বুঝতে পারে। রান্নার আয়োজন শুরু করতেই কালো জীপটা হাজির হয়। মাহতিম যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে, তখনই সুজলার চাপাচাপিতে পুরো ঘটনা বলে ফেলে। সবকিছু শোনার পর ছেড়ে দেয় সুজলা। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে মাহতিম। ঠিক তখনই জানতে পারে মেহনূর খায়নি। আসার পরপরই দরজা সেঁটে ঘুমিয়েছে। কারোর সাথে দেখা করেনি। মাহতিম সবটা শোনার পর সুজলার কাছে অনুরোধ করে। ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপারটা মিটাতে চায় সে। তবে, রাতের ঘটনা স্রেফ সাবা-সুরাইয়া জানে। পোড়া গন্ধের ইতিহাস তারাও চুপিচুপি দেখেছে। মেহনূর যখন মরিচের জন্য রান্নাঘরে যায়, তখনই তারা মরিচ আনার কাহিনি দেখতে পায়। মেহনূর নাক-মুখ চেপে মরিচ পুড়িয়ে দরজার পাশে রাখে। সেই দরজার নিচ দিয়ে মাহতিমের কাছে পৌঁছে।

.

কাঠের দরজা ঠেলে মেহনূর ঢুকে। চোরের মতো পা ফেলে বিছানার দিকে তাকায়। সর্বপ্রথম বুকের উঠা-নামাটা দেখে। কবে জানি বুকটা স্থির হয়ে যাবে। শরীর হবে ঠান্ডা। যেই মাতৃস্পর্শের কাছে সতেরটা জীবন কাটালো, সেটা ছুঁতে গেলে ঠান্ডা অনুভব হবে। এমন একটা অনুভূতি কি করে সহ্য হবে? জীবন্ত মানুষটা হুট করে চলে যাবে। কান্নার আবেগটুকু খুব দামালভাবে আঁটকায়। মায়ের সামনে কাঁদা যাবে না। একটুও কাঁদা যাবে না। যেই শারীরিক যন্ত্রণায় দিনের-পর-দিন ভুগছে, তার নরম মনটাতে কষ্ট দেওয়া ঠিক না। মেহনূর নিচের ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ধাতস্থ হয়। পা টিপে-টিপে মায়ের কাছে যায়। শিউরের কাছে বসে ঘুমন্ত মায়ের রোগা কপালে হাত রাখে। একটু-একটু করে চোখের পল্লব মেলে মাহমুদা। কয়েক মিনিট চেষ্টা পর স্পষ্ট দেখতে পায়। মেয়েকে শাড়ি বেশে দেখে খুশি হয়। ফ্যাকাশে ঠোঁট একটুখানি হাসে। ওই হাসিটুকু মেহনূরের বুকটায় তীরের মতো বিঁধে। ‘ মা আর থাকবে না ‘ এমন একটা সুর বাজে। মেহনূর খুব আলতো করে কপালে হাত বুলায়। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,

– তুমি হাসছো কেন আম্মা? আমাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে?

মেহনূর কথাটা ইচ্ছা করে বলে। মায়ের মুখ থেকে মূল্যবান প্রশংসাটা দু’কানে শুনতে চায়। মাহমুদা মলিন কন্ঠে দম ছেড়ে-ছেড়ে বলে,

– তোকে খুব সুন্দর লাগে রে মা। আল্লাহ্ পাক তোকে সব সৌন্দর্য দিয়ে আমার গর্ভে পাঠিয়েছেন। আমি ধন্য রে মা। এবার একটু শান্তিতে যেতে পারবো।

সাথে-সাথে সুন্দর আকাশে মেঘের বাজ পরলো। খুব কষ্ট করে ভেতরটা সামলালো মেহনূর। কোনোভাবেই মা’কে বুঝতে দিলো না। ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললো,

– তুমি আমাকে তাড়াতে চাচ্ছো তাইনা? চাচ্ছো যে আমি এখান থেকে বিদায় হই। এ বাড়ি থেকে চলে যাই। তুমি এটাই চাচ্ছো না বলো?

পাণ্ডুর মুখে হাসে মাহমুদা। মেয়ের কথা শুনে খুব হাসতে মন চাইছে। শরীরে সেই বলটুকু শূন্য। বারবার শ্বাসনালিতে দম ফুরিয়ে আসছে। খুব খারাপ লাগছে। তবুও মাহমুদা সবকিছুর অগোচর করলো। মেয়ের সান্নিধ্য পেয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,

– তোর ঘরে প্রথম সন্তান যেন একটা মেয়েই হোক। মাহতিমের জীবনে আরেক মায়ের আদর আসুক। আমিতো মা থাকবো না। তোর মেয়েটাকে মায়ের মতোই ভালোবাসিস। আমার শেষ সময়ে যেভাবে পাশে থাকলি, তোর মেয়েটাও দেখিস কতো আপন করে নেয়। কোনোদিন মাহতিমের সাথে দূর্ব্যবহার করবি না। যতো ঝগড়াঝাঁটি হোক, যতো কাটাকাটি হোক, কোনোদিন আলাদা থাকবি না। এখনকার যুগ বিষাক্ত যুগ রে মা। এই যুগের তালে-তালে নিজেরে শেষ করিস না। মনোমালিন্য হলে মাহতিমকে সময় দিবি। খবরদার স্বামীর মুখে-মুখে তর্ক করবি না। এইসব শয়তানের প্ররোচনা। তোর দাদী সবসময় তিন বউকে বুঝ্ দিতো। আমি জীবনেও তোর দাদা-দাদীকে আলাদা থাকতে দেখিনি। কথাগুলো মনে রাখিস মেহনূর। আজীবন তো চুপচাপ থাকলি। এখন একটু কথা বলা শিখিস।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .