মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-১৭

0
558

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব ১৭
.
অভ্র উঠে বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। পৃথুলা অভ্রর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ভাবছে, সেদিন যদি এই অভ্র তার পাশে থাকত তাহলে কি তার জীবনটা এমন হতো? তার আকাশটা এমন ঘোলাটে, মেঘাচ্ছন্ন থাকতো? নাকি জীবন আকাশে উঁকি দিত এক রক্তিম সূর্য?

অভ্র রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে গেল৷ আঞ্জুমান কিচেনে রাতের রান্না করছেন। অভ্র বলল,
“হেল্প লাগবে আম্মু?”
আঞ্জুমান হেসে বললেন,
“তুই কি হেল্প করবি! পৃথুলা কোথায়?”
“রুমে।”
“ভালোই হইছে তখন ওকে ডেকে নিয়ে গেছিস। উফ্ মহিলাগুলো মেয়েটাকে প্রশ্ন করে করে পাগল বানিয়ে দিচ্ছিল।”
অভ্র কিছু না বলে কফিমেকারে কফি বানাতে নিল। আঞ্জুমান বললেন,
“কফি খাবি? দে আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
অভ্র বাধা দিয়ে বলল,
“তুমি তো এমনিতেই কাজ করছো। সমস্যা নেই৷ কফিটা আমিই বানাই। তুমি খাবে কফি?”
“নাহ।”

অভ্র দু মগ কফি বানিয়ে বারান্দায় এলো। পৃথুলা গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
“পৃথা…”
“হু?”
“কফি নাও।”
“খাব না।”
“আমি বানিয়েছি। খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?”

পৃথুলা মগটা নিল। ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
“দারুন কফি বানান তো আপনি।”
অভ্র পৃথুলার পাশে বসতে বসতে আহ্লাদি গলায় বলল,
“আহ্ জীবনটাই ধন্য আমার।”
বলেই হাসলো অভ্র। পৃথুলাও হালকা হাসল। অভ্র বলল,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“হুম।”
“বিভোর কে?”

পৃৃথুলা চমকে তাকাল অভ্রর দিকে। অভ্র বলল,
“আরে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আসলে কাল রাতে জ্বরের ঘোরে তুমি বিভোরের নাম নিয়েছিলে। তাই জানতে চাইছি।”
পৃথুলা কিছু বলল না। অভ্র বলল,
“স্যরি! ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করে ফেললাম বোধহয়।”
“স্যরি বলার কিছু নেই। আপনাকে বিভোরের কথা জানানো উচিত ছিল।”
একটু থেমে বলল,
“বিভোর আমার এক্স বয়ফ্রেণ্ড। আমি বিভোরকে ভালবাসতাম। বাসতাম বললে ভুল হবে। এখনো বাসি। চার বছরের রিলেশন ছিল আমাদের।”

পৃথুলা কাউকে ভালবাসে শুনে মনে মনে খানিকটা আহত হলো অভ্র। ছোট্ট করে বলল,
“ওহ।”
তারপর কৌতুহল নিয় জানতে চাইল,
“আচ্ছা বিভোর এখন কোথায়? তোমার সাথে ঘটা ঘটনার কথা সে জানে না?”
“জানবে না কেন? জানে বলেই তো সে আজ আমার সাথে নেই৷ আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে।”
“মানে?”
“আমার রেপ হওয়ার পর আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়। ধর্ষিতা মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে যাবেই বা কেন!”

অভ্র হতবাক, বিষ্মিত। তার মুখ দিয়ে কেবল একটা কথাই বের হলো,
“এ কেমন ভালবাসা!”
“অবশ্য সে আমার কাছে সময় চেয়েছিল। প্রথমে একেবারেই না করে দিয়েছিল। পরে আবার কি যেন ভেবে সময় চেয়েছে। সময় নিয়ে সে তার ডিসিশান জানাবে, আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে কি রাখবে না সেটা ভেবে জানাবে।”
“তুমি সময় দিয়েছো?”
“বিভোরকে আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম। আমার বিশ্বাস ছিল, সারা দুনিয়া আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বিভোর নেবে না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। সে জানালো, সময় নিয়ে ভেবে আমাকে তার ডিসিশন জানাবে। আমি কি করে তার জন্য অপেক্ষা করতাম বলুন তো? সে আমাকে ‘হ্যাঁ’ বলবে এই আশায়?”

অভ্র কিছু বলল না। পৃথুলা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আসলে বিভোর খুবই বুদ্ধিমান। তাই সুযোগ বুঝে সটকে গেছে। রেপড হওয়া একটা মেয়েকে নিজের জীবনের সাথে জড়ানোর বোকামি সে করতে যাবে কেন? সবাই তো আপনার মত বোকা না।”
“আমি বোকা?”
“সন্দেহ আছে? যাকে আমি এত ভালবাসতাম সেই বিভোরই আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। আর আপনি….”
অভ্র পৃথুলার হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“বিভোর ছেড়ে দিয়েছে। অভ্র ছাড়বে না কখনো। অন্তত প্রাণ থাকতে না।”

পৃথুলা চোখ তুলে তাকালো অভ্রর দিকে। অভ্র বলল,
“বিভোর এই চার বছরে তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি?”
“জানি না। হয়তো করেনি। আমিও চাই না ওর সাথে কখনো আমার দেখা হোক।”
অভ্র একটু ভেবে বলল,
“বিভোর যদি আবার তোমার জীবনে ফিরে আসে? তোমাকে তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, যাবে তার কাছে?”
পৃথুলার উত্তরটা যেন রেডিই ছিল। চট করে বলে ফেলল,
“নাহ।”

‘নাহ’ এই ছোট্ট একটা শব্দে কি মেশানো ছিল কে জানে! শব্দটা শুনে অভ্রর সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি ঢেউ খেলে গেল।
.
রিসেপশনের আয়োজন করা হয়েছে ‘বসুন্ধরা’ কমিউনিটি সেন্টারে। দুপুর বারোটা নাগাদ দুই পরিবারের প্রায় সব মেহমানই উপস্থিত হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে।
পৃথুলাকে সাদা স্টোনের কাজের সোনালী রঙের লেহাঙ্গা পরানো হয়েছে। লেহাঙ্গার ওড়নাটা গাঁঢ় খয়েরী। অভ্র পরেছে সাদা স্যুট। দুজনকে একসাথে মানিয়েছে বেশ। ফটোগ্রাফার বিভিন্ন এঙ্গেলে ওদের দুজনের কাপল ছবি তুলছে। অভ্র-পৃথুলাকে একসাথে দেখে অনেকের মুখেই একটা বাক্য শোনা গেল, ‘দে আর মেইড ফর ইচ আদার’।

উৎস ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছিল। হঠাৎই তার চোখ আটকে যায় এক সবুজ পরীর উপর। প্রত্যাশা সবুজ রঙের একটা গাউন পরেছে। হাতে সবুজ কাচের চুড়ি। খোলা চুলে অপূর্ব লাগছে প্রত্যাশাকে। প্রশ্বস্ত হাসি ফুটে ওঠে উৎস’র ঠোঁটের কোণে। মুখ দিয়ে আপনাতেই বের হয়, ‘বিউটিফুল’।

প্রত্যাশার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ ঘায়েল করে নিচ্ছে উৎসকে। উৎস নিজের দিকে তাকাল। তার পরনে সবুজ পাঞ্জাবি। কাকতালীয়ভাবে দুজনেই আজ সেইম কালারের ড্রেস পরেছে। উৎস ক্যামেরাটা তুষারের কাছে দিয়ে এগিয়ে গেল৷ দাঁড়াল প্রত্যাশার মুখোমুখি।

“হেই বিউটি গার্ল!”
প্রত্যাশা মুখে বড় একটা হাসি টেনে বলল,
“হাই জল্লাদ ভাইয়া।”
উৎস মুখটা পাংশুবর্ণ করে অনুনয়ের সুরে বলল,
“প্লিজ আজকে আমরা ঝগড়া না করি। আমাদের মধ্যে আগে যা হয়েছে সেসব ভুলে যাব। আমরা বন্ধু হয়ে যাব! অনলি ফ্রেণ্ডস। প্লিজ প্লিজ!”
“ফ্রেণ্ডস? আমাদের এইজ পার্থক্য জানেন? আপনি বড় জোর আমার বড় ভাই হতে পারেন৷ তাতে অবশ্য আমার সমস্যা নেই। আমার তো ভাই নেই। আপনাকে ভাই বানানোই যায়।”
উৎস করুণ মুখে বলল,
“তাই বলে ভাই বানায় দিবা!”
প্রত্যাশা স্মিত হেসে সরে গিয়ে পৃথুলার পাশে দাঁড়াল।

আঞ্জুমান ফোন দিলেন তার বান্ধবী মনামীকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই আঞ্জুমান বললেন,
“কি রে কোথায় তুই? আর কতক্ষন লাগবে?”
“আমি এসে গেছি ডিয়ার। উপরে আসছি।”
আঞ্জুমান কল কাটার এক মিনিটের মাথায়ই তার সামনে হাজির হলেন মনামী মেহনাজ। তার পরনে একটা পাতলা জর্জেট শাড়ি। হাতাকাটা স্লিভলেস ব্লাউজ পরা। শাড়ির ভেতর দিয়ে শরীরের গঠন অনেকাংশই বোঝা যাচ্ছে মনামী মেহনাজের।

মনামী আর আঞ্জমানের বয়স কাছাকাছি। কিন্তু মনামীর ড্রেস-আপ, গেট-আপ দেখে তা বোঝার জোঁ নেই। পোষাক, সাজগোজের দিক দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার চেয়ে এগিয়েই আছেন।

মনামীকে দেখে দিলারা বেগমের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পরল। অতিমাত্রায় স্টাইলিশ এই ভদ্রমহিলাকে একদমই পছন্দ হয় না দিলারা বেগমের। হাজার হলেও আঞ্জুমানের বান্ধবী, তাই কিছু বলতেও পারেন না।

মনামী দিলারা বেগমকে দেখে হেসে বললেন,
“হ্যালো আন্টি। কেমন আছেন?”
দিলারা বেগম মনে মনে বললেন,
“খবিশ মাতারি। আদব কায়দা কিচ্ছুই জানে না। সালাম না দিয়া আইছে হিলু আন্টি কইতে।”
মুখে বললেন,
“বালাই আছি। তুমি কিমুন আছো?”
“জ্বি ভালো।”
আঞ্জুমান অভ্রকে ডেকে বললেন,
“অভ্র, দেখে যা কে এসেছে।”
অভ্র মনামীকে দেখে হাসিমুখে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
মনামী সালামের জবাব দেবার ধার ধারলেন না।
“আ’ম সো ফাইন বেটা। তোমার কি খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ। বিয়েতে আসেননি কেন আন্টি?”
“একটু ব্যস্ত ছিলাম। বাই দ্যা ওয়ে, নতুন বউ কোথায়?”
আঞ্জমান বললেন,
“আয় আমার সাথে। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।”

আঞ্জুমান মনামীকে নিয়ে স্টেজে গেলেন। পৃথুলাকে দেখিয়ে বললেন,
“এই হচ্ছে আমার পুত্রবধূ পৃথুলা ইসলাম।”
এরপর পৃথুলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ও মনামী। আমার বাল্যকালের বান্ধবী। ব্যস্ততার কারণে বিয়েতে থাকতে পারেনি। আজ না আসলে তো ওর সাথে কথাই বলতাম না।”
বলেই হাসলেন আঞ্জুমান। পৃথুলা স্মিত হেসে সালাম দিল মনামীকে। মনামী সালামের উত্তর দিলেন না৷ তিনি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন পৃথুলার দিকে। বজ্রাকণ্ঠে বললেন,
“তুমি! তুমি পৃথুলা না?”
.
চলবে___