মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-১৮+১৯

0
879

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

মাইক্রো গাড়িটা দশহাত ডিসট্যান্স নিয়ে এগিয়ে আছে। বেশ দূরত্ব নিয়ে পেছন থেকে মাহতিমের জিপ চলছে। ভোরের বাতাসটা স্নিগ্ধ-শীতল হয়ে গা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। পূবের সূর্যটা ধীরেধীরে অন্ধকার চিড়ে উদিত হচ্ছে। রাস্তাঘাট বড্ড শান্ত-নিরব-নির্বিকার। কোথাও কোনো মানুষ নেই। রাস্তার দুপাশে ক্ষেতের-পর-ক্ষেত দেখা যাচ্ছে, মাঝে-মাঝে চোখে পরছে খালের মতো জায়গা। রাস্তার কাছাকাছি টিনের ঘরবাড়িগুলো বড্ড ভূতুড়ে কায়দায় শান্ত হয়ে আছে। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। গাড়ির বেগতিক স্পিডের জন্য রাস্তার ধারে ঘুমন্ত কুকুরগুলো চমকিত ভঙ্গিতে মাথা উঠিয়ে দেখছে। দুটো গাড়ি যখন সরু রাস্তা ছেড়ে বউবাজারের দিকে উঠলো, তখন গাড়ির স্পিডটা যেনো একটুখানি কমলো। জিপে উঠার পর থেকে মাহতিম আনসারী যে একদম চুপ মেরে আছে, মেহনূর সেটা ভালোভাবে বুঝতে পারছে। এই লোকটা খুবই দক্ষপূর্ণ হাতে জিপের সমস্ত টেকনিক সামলাচ্ছে। চোখদুটো শান্ত-কঠোর হয়ে সামনের দিকে সজাগ হয়ে আছে। গাঢ় নেভি ব্লু টিশার্টটা আঁটসাঁট হয়ে গায়ে সেঁটে আছে, পরনের প্যান্টটা ধবধবে সাদা কালার পরেছে। চোখে কালো সানগ্লাস এবং হাতের বাঁ কবজিতে স্মার্ট ওয়াচ পরা আজ। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। মুখের দাড়িও যেনো কামিয়ে নতুন করে এসেছে, পরিস্কার চকচকে ক্লিনকাট গাল দেখা যাচ্ছে। মেহনূর আড়চোখে লক্ষ করলো, লোকটা যেনো একবারও বামে ফিরে তাকালো না, সেইযে বাড়ির উঠান থেকে গম্ভীর মুখে জিপে উঠলো, তখন থেকে একটা কথাও জিজ্ঞেস করলো না। স্বস্তিতে নিশ্বাস ছাড়লো মেহনূর। বাকি পথটা যদি এভাবে কাটে তাহলে শান্তিতে সেখানে পৌছাঁতে পারবে। কিন্তু এই মূহুর্তে প্রধান সমস্যা হলো, প্রচুর শীত করছে। ভোরের সকালটা গ্রামাঞ্চলে শীতের মতোই লাগে। কালো শাড়ি পড়ুয়া মেহনূর খুব সাবধানে পিঠের পেছন দিয়ে আচঁল টেনে আনলো, সেই আচঁলটায় গা ঢেকে হাতদুটোও ঢেকে নিলো। কিন্তু এতেও যেনো শীত নিবারণ হচ্ছেনা। দুপাটি দাঁত শক্ত করে ঠোঁট কুচঁকে রইলো মেহনূর। সিটে পিঠ লাগিয়ে মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিলো। রাতেরবেলা উপন্যাস পড়তে গিয়ে বেশ দেরি করে ঘুমিয়েছে, তাই নির্ঘুম থাকার কারণে জিপে উঠার পরপরই ঘুমের জন্য হাই তুলছে। মাহতিম সানগ্লাস পরা থাকলেও মেহনূরের কীর্তিকাণ্ড সবই আড়চোখে দেখছে। সানগ্লাসটা শুধুমাত্র ধূলো এড়ানোর জন্য হলেও বর্তমানে মেহনূরের চোখেও ধূলো মেরে দিচ্ছে। মেহনূর কি করছে, না-করছে সবই সরু দৃষ্টিতে চুপচাপ ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করছে। মাহতিম একবার চিন্তা করলো, ওকে একবার সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করবে কিনা, কিন্তু পরক্ষণে ওর ইগনোর আচরণ স্মরণ করে কোনো কথাই আর জিজ্ঞেস করলো না। পথিমধ্যে মেহনূর চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেছে, হাতদুটো ঘুমের জন্য শাড়ির খাবলে ধরা অংশটুকু ছেড়ে দিয়েছে। রাস্তার আঁকাবাঁকা ঝাঁকুনির জন্য বারবার বাঁদিকে রাস্তার পাশে মাথা হেলে যাচ্ছে ওর। মাহতিম ড্রাইভ করার সময়ে হুট করে বায়ে নজর দিতেই তাড়াতাড়ি ওর দিকে হাত এগিয়ে ধরলো। মেহনূর ঘুমের ঘোরে কিচ্ছু টের পেলো না তখন। আবারও সিটে মাথা লাগিয়ে শরীর ছেড়ে দিলো। এদিকে ওর অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে উঠলো মাহতিম। বারবার ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ওর দিকে সর্তক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। মেহনূর সিটবেল্ট বাধেনি, যদি গা-টা একবার ছেড়ে দেয়, তাহলে এক্ষুণি চলন্ত জিপ থেকে রাস্তায় পরবে! মাহতিম কয়েক মিনিট সময় নিয়ে চিন্তা করতে লাগলো, জিপের স্পিডটাও কমিয়ে এনে ওর দিকে নজর দিতে থাকলো। একপর্যায়ে খুবই ধীরগতিতে জিপ থামিয়ে রাস্তার পাশে এনে রাখলো। স্টিয়ারিংয়ের উপর ডানহাত রাখা মাহতিমের, বাঁ হাতটা মেহনূরের মাথার দিকে। সেই বাঁহাতটা সরিয়ে এনে গাড়ির চাবিটা খুলতে লাগলো। মেহনূরের দিকে দৃষ্টি রেখে চোখ থেকে সানগ্লাস সরিয়ে ফেললো, ডানহাতে চশমার দুই ডাট বন্ধ করে সেটা অপ্রয়োজন হিসেবে সামনে রেখে দিলো। এদিকে মেহনূর গভীর নিদ্রায় বিভোর হয়ে আছে, ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে শরীর ছেড়ে ঘুমাচ্ছে। মুখটা বাঁদিকে ফেরানো বলে মাহতিম খুব সাবধানে ওর থুতনি ধরে ডানে ফেরালো। ওমনেই সে লক্ষ করলো, মায়াজালে আবদ্ধ করার মতো ঠোঁটদুটো আজ চকচক করছে। ডাগর-ডাগর চোখদুটোতে চিকন কালো রেখা যাচ্ছে, যেই রেখা চোখের শেষপ্রান্তে এসে সম্মোহন কায়দায় বেঁকে গেছে। আজ মেহনূর চোখে আইলাইনার লাগিয়েছে। কমলার উপর তেল বা জেল লাগালে যেমন চকচক করে উঠে, মেহনূরের ঠোঁটদুটো তখন স্বর্ণরৌদ্রের ঝিলিক পেয়ে চকচক করছে। গালের তর্জমা এতোটাই সুক্ষ্মভাবে করেছে যে, রুমাল দিয়ে ঘষা দিলেও সেই গালের কোনো পরিবর্তন দেখা যাবেনা। মাহতিম ওর মুখের দিকে সুক্ষ্ম চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ ওর দিকে ডানহাত বাড়িয়ে দিলো। সেই হাতটা ধীরে-ধীরে মেহনূরের ঘুমন্ত মুখের উপর চলে আসছিলো। গালের উপর আঙ্গুলের আলতো পরশ লাগিয়ে মাহতিম ওর দিকে অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে রইলো। ঘুমন্ত মেহনূর গালের উপর আলতো স্পর্শ পেয়ে খুবই মৃদ্যুভাবে কেঁপে উঠলো, কিন্তু ঘুমের জন্য চোখ আর খুললো না। মাহতিম ওর গাল থেকে হাত সরিয়ে কোলের দিকে দৃষ্টি দিলো। শীতের জন্য আঙ্গুলের নখগুলো নীল হয়ে ছিলো। মাহতিম সেই হাতের উপর তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল বসিয়ে চেক করতে লাগলো। আসলেই শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। গায়ে যেই শাড়িটা পরেছে সেটাও তেমন মোটা না। সুতির কালো শাড়ি, যার পাড়টা বেশ মোটা। মোটা পাড়টার রক্তজবার মতো লাল, সেই লাল রঙের উপর সোনালী বুননের কারুকাজ। মাহতিম ওর হাত থেকে আঙ্গুল সরিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালো। যদি সামান্যতম অধিকার থাকতো, নিজের দেহে যতটুকু উষ্ণতা আছে সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে শীত নিবারণ করে দিতো। মাহতিম ওর মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়লো। সামনে তাকিয়ে দেখলো, সৌভিকদের গাড়ি যথেষ্ট দূরে চলে গেছে। মাহতিম কিছু একটা চিন্তা করে আবার জিপে চাবি ঢুকালো। জিপটা যথাসম্ভব ধীরে স্টার্ট দিয়ে মেহনূরের ঘাড়ের পাশ দিয়ে বাম হাত ঢুকিয়ে দিলো। ওর বাম হাতটা মেহনূরের বাম বাহুটা আলতো করে ধরলো। ধরতেই জিপটা স্টার্ট দিয়ে চালাতে লাগালো মাহতিম। মেহনূরের গায়ে সিটবেল্ট বাধাটা সম্ভব না, ওর পিঠের পেছনে চাপা পরে আছে কালো বেল্টটা। তাই মাহতিম কায়দা করে ওর বাহুটা ধরে থাকলো, ডানহাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা ধরলো।

.

মাইক্রোর মধ্যে ভীষণ রেগে আছে সাবির। সুরাইয়ার গালে ঠাস করে দুইটা চ-ড় মারতে পারলে কলিজায় মারাত্মক শান্তি লাগতো। ওর মতো থার্ড ক্লাস মেয়ে আর হয়না। আগে জানলে জীবনেও এটাকে ট্যূরের জন্য আনতো না। সৌভিকও বিরক্ত মুখে ড্রাইভ করছে। ট্যূরের জন্য বের হয়েও মেজাজ চরম বিগড়ে আছে। নীতি অধৈর্য্য হয়ে ঘুমের জন্য মিথ্যা অভিনয় করছে। প্রীতি না পারতে ওর চাপাবাজির কথা গিলছে। শানাজ, সাবা কিছু বলতে পারছেনা। সিয়াম, তৌফ, সামিক ও ফারিন নিজেদের মধ্যে ফোনের কনভারসেশন চালাচ্ছে। ফারিন মেসেজের বার্তায় বললো,

– ভাই আর টলারেট করতে পারছিনা। মিথ্যা বলারও একটা লিমিট থাকে! এই মেয়ে তো সেই লিমিটও লাত্থি মেরে সরিয়ে দিয়েছে। কিছু করো ব্রো!

ফারিনের অবস্থা পড়ে সবার আগে তৌফের মেসেজ আসলো,

– বিশ্বাস কর ফারিন! আমি আগে জানলে ওরে বাথরুমের মধ্যে আটকায়া আসতাম! কিন্তু —

তৌফ এটুকু মেসেজ পাঠাতেই বাকি মেসেজটুকুর জন্য টাইপ করতে থাকলো। কিন্তু ততক্ষণে সিয়াম দুটো রাগের ইমোজি পাঠালে তৌফ টাইপিং বন্ধ করলো। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ভীষণ রাগ দেখিয়ে গজগজ ভঙ্গিতে সিয়াম বললো,

– আমি বিসমিল্লাহ্ বইলা ওরে গুয়ের টাংকি বরাবর লাত্থি মারতাম ! এরপর যেই বিশ্রী অবস্থাটা হইতো ওইটা সুন্দর কইরা ক্যাপচার করতাম।

সিয়ামের কথায় ঠোঁট টিপে হাসলো সবাই। কিন্তু হাসির আভাসটুকু কাউকে বুঝতে দিলো না। ফারিন সবার সাথে মেসেজ করতেই হঠাৎ মাহতিমের কথা মনে পরলো। মাথা ঘুরিয়ে তৎক্ষণাৎ পিছু ফিরে দেখলো, মাহতিমের জিপটা এখন একদমই দেখা যাচ্ছেনা। মাহতিমের কিছু হলো কিনা সেটা জানার জন্য চটপট ওর নাম্বারে কল করলো ফারিন। মাহতিম ড্রাইভ করা অবস্থায় লেফট পকেটে ভাইব্রেট অনুভব করলো। কিন্তু দুইহাতে দুই কাজ করতে থাকলে ফোনটা আর ধরলো না। ফারিন কিছুটা উদ্বিগ্ন হলেও আর কল করলোনা। এদিকে সুরাইয়া সৌভিকের উদ্দেশ্যে বললো,

– ভাইয়া তুমি গাড়ি থামাও। রাস্তার পাশে কি সুন্দর দৃশ্য যাচ্ছে! আমি কয়টা ছবি তুলবো।

সুরাইয়ার নির্বুদ্ধিতা দেখে ফারিন ওই মূহুর্তেই চটে উঠলো! ওর দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাগী গলায় বললো,

– তোমার সমস্যা কি? কি শুরু করছো? তুমি কি দেখছো না আমরা ট্যূরের জন্য বের হয়েছি? বারবার এমন আহ্লাদী ঢঙ দেখাচ্ছো কেনো? আমাদের কি তোমার মায়ের মতো হাবলা পেয়েছো? যখন যেটা করতে বলবে, সেটাই আমরা লাফিয়ে-লাফিয়ে করবো?

ফারিনের তেজালো কন্ঠ শুনে নীতি চটপট চোখ খুলে তাকালো। প্রীতিও বিষ্ময় চাহনিতে ফারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারিন ওদের চেয়ে ছোট হলেও কাজের বেলায় মারাত্মক রাগ দেখাতে পারে। এই মূহুর্তে সুরাইয়া ওর চেহারা দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে চুপ মেরে আছে। ফারিন ওর চুপটি দেখে দৃঢ়কন্ঠেই বললো,

– তোমার আচরণ যে বেলাল্লাপনা সেটা কি জানোনা? ফালতু মেন্টালিটির মেয়ে, নিজের কানটা একটু খুলে শুনো! এখানে যদি সামান্যতম আওয়াজ করো, আমি এক্ষুনি মাহতিম ভাইকে ডেকে তোমার খবর করিয়ে ছাড়বো! মাহতিম ভাই কিন্তু তোমায় একদম দেখতে পারেনা! তুমি যদি এখানে এসেও তেড়িবেড়ি করেছো, ভাইয়া এক আছাড় মেরে তোমার হাড্ডি গুড়া করে দিবে!

ফারিনের কাটকাট কথা শুনে সুরাইয়াও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে গরম গলায় বললো,
– তোমার সাহস তো কম না! আমাদের বাড়িতে এসে আমাকেই ভয় দেখাচ্ছো? আমি দাদুকে যদি বিচার দেই, তাহলে তোমাদের সবাইকে সোজা করে দিবে।

ফারিনও একধাপ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো,
– তোমার দাদাভাইকে বলে দিও আনসারী কখনো ভয় পায় না। আমার ভাইকে রাগিয়ে দিলে সে তোমার দাদাকেও মান্য করবেনা।

এ কথা শুনে সুরাইয়া যেনো ক্ষান্ত হলো না। ঝগড়ার জন্য গায়ে পরে লাগতে যেয়ে ফারিনের হাত মুচড়ে ধরলো! চলন্ত গাড়িতে এমন অপ্রকৃতিস্থ কাণ্ড দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকালো! সৌভিক বারবার ওদের শান্ত হওয়ার জন্য চিল্লাচ্ছে, নীতি পাশ থেকে সুরাইয়ার হাত ধরে সরাতে যাচ্ছে, কিন্তু সুরাইয়া আরো হিংস্র হয়ে ফারিনের হাতে নখ বসিয়ে দিচ্ছে! একপর্যায়ে এমন হাতাহাতি বেড়ে গেলে ফারিন কোনোমতে হাত ছুটিয়ে ঠাস করে এক থাপ্পর মারে! সুরাইয়া থাপ্পর খেয়ে আরো রেগেমেগে ওর দিকে দাঁত চিবিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে! ওদের দুজনের অবস্থা যখন সাংঘাতিক মাত্রায় পৌঁছে গেলো, তখন সৌভিক বাধ্য হয়ে গাড়ির ব্রেক কষে মাইক্রো থেকে নামলো! এক টান দিয়ে মাইক্রোর দরজা খুলে ফারিনকে দ্রুত ছাড়িয়ে মাইক্রো থেকে বের করলো! অন্যদিকে নীতির সাইড থেকে দরজা খুলে দিলো সিয়াম। নীতিও বাইরে বের হলে সুরাইয়ার হাত ধরে নামলো। দুজন দুপ্রান্তে দাড়িয়ে অনবরত হাঁপাচ্ছিলো। সৌভিক তাড়াতাড়ি ফারিনের জন্য বোতল এনে ওকে শান্তভাবে খাইয়ে দিলো। ফারিন যখন সৌভিকের দিকে হাত বাড়িয়ে বোতল চাইলো, তখন কবজির জায়গাটায় খামচির দাগগুলো দেখতে পেলো। সৌভিক ওর হাত টেনে কপাল সামান্য কুঁচকে বললো,

– ওই ডাইনী তোকে খামচি মেরেছে?

ফারিন রাগীদৃষ্টিতে রাস্তার ওপারে সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ফারিনের ওমন চাহনি দেখে আর কিছু বললো না সৌভিক। চুপচাপ গাড়ি থেকে ফাস্ট-এড-বক্স এনে মলম লাগিয়ে দিলো। অন্যদিকে সুরাইয়া যখন গাড়ি থেকে নামলো, তখন শানাজও চরম ক্রুদ্ধ হয়ে গাড়ি থেকে বের হলো। হাঁপাতে থাকা সুরাইয়ার দিকে কঠিন একটা চড় কষিয়ে মারলো শানাজ! টানা দুইটা চড় খেয়ে বাকবুদ্ধি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো সুরাইয়া। গালে হাত রেখে শানাজের জন্য কিছু বলবে ওমনেই শানাজ তর্জনী উঠিয়ে কঠিন সুরে বললো,

– তুই যদি বাড়াবাড়ি করিস আমি এক্ষুনি তোকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবো! তোর আচরণ, তোর স্বভাব, তোর কথাবার্তা সবকিছু লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে। তুই জানিস তুই ফারিনের সাথে কি করেছিস? মেয়েটা কি এমন ভুল কথা বলেছে তুই ওর উপর ঝাঁপিয়ে পরলি? আজ একটা কথাও তুই বলবি না! একটা কথা বলবিনা! মেজো মা তোকে কি শিখিয়ে পিকনিকে পাঠিয়েছে আমি জানিনা, কিন্তু পরবর্তীতে আর যদি এরকম কিছু দেখি তোকে আমি খুব মারবো। তুই সাবধানে থাক!

শানাজ কথাগুলো বলে সশব্দে গাড়িতে উঠে বসলো। সাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে একই সুরে বললো,

– ওর কোনো কাজে তুই হেল্প করবিনা। আমার ফোনটা এখন থেকে তুই রাখবি। ওর হাতে ভুলেও যেনো না দেখি। দরকার পরলে মেহনূরের কাছে মোবাইল রেখে কাজ করবি। মনে থাকে যেনো।

বোনদের এমন শাষন অবস্থা দেখে সবাই একটু শান্ত হলো। আবারও নিজ-নিজ জায়গায় উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেললো। সুরাইয়া মূঢ় ভঙ্গিতে নীতির জায়গায় বসেছে এখন। জানালার পাশে বসে চুপ করে আছে। নীতি এখন মাঝখানে বসে ফারিনের মাথাটা টেনে কাধে হেলিয়ে রেখেছে। ফারিনও নীতির হাত ধরে চোখ বন্ধ করে দিয়েছে। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য মাইক্রোর আমেজটা ক্ষুণ্ণ হলো। তাই পরিস্থিতি বদলানোর জন্য গাড়িতে একটা ফুল ভলিউমে গান ছাড়লো। এ্যালেন ওয়াকারের ‘ Faded ‘ গানটা ছেড়ে দিতেই সবাই জার্নিটা নিজ মনে উপভোগ করতে লাগলো। গাড়ির সর্বত্র যেনো সুর ছড়িয়ে পরলো, Where are you now, Where are you now, Where are you now.

.

গ্রামের দৃশ্য চলছে দুপাশে। সবুজ গাছপালা যেনো সাক্ষী হিসেবে থাকছে। অরণ্যময় গ্রামের পিচঢালা পাকা রাস্তার উপর তুমুল স্পিডে জিপ ছুটছে। বাতাসের ঠান্ডা ঝাঁপটা মুখের উপর পরছে বারবার। রাস্তায় যতবার বাঁক নিতে হয়েছে, ততবারই ধরতে হয়েছে ঘুমন্ত মেহনূরের বাহু। পাঁচ আঙ্গুলে হালকাভাবে চেপে ধরতেই পায়ের নিচ থেকে কতবার সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠেছে, সেই জ্ঞানটুকু নেই মাহতিমের। অদম্যভাবে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় মেহনূরের দিকে তাকানো বন্ধ করেছে। বারবার নিজের মনে আওড়ে যাচ্ছে, আর মাত্র কিছুক্ষণ ডুড! ডোন্ট বি ডিসট্রেক্ট, তুই ওর দিকে আর তাকাবি না! মাহতিম সত্যিই আর তাকালো না। চোখের উপর সানগ্লাস এঁটে নিজেকে আরো শক্ত করে নিলো। রেসোর্টের সরু মেটো পথটা দেখতে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। জিপ সেদিকে ছুটিয়ে দিতেই পাঁচ মিনিটের ভেতর রেসোর্টের সামনের এসে থামলো। মাইক্রো গাড়িটা খালি পরে আছে, তার মানে সবাই এতোক্ষনে ঘুরাঘুরি করে ফেলেছে। মাহতিম এবার মেহনূরের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। ঘুমন্ত মেহনূরকে জাগাতে গিয়ে উচ্চশব্দ আর করলো না। চুপচাপ ওর মুখটার দিকে ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেলো, চোখের সানগ্লাসটা মাথায় বসিয়ে মেহনূরের বাহু থেকে হাত সরাতে লাগলো। খুবই সাবধানে ওর ঘাড়ের পেছন দিয়ে হাত বের করে আনলো। পুরো হাতটা মারাত্মক ঝিমঝিম করছিলো ওর। ব্যথাটা কমানোর জন্য কনুইয়ের মাঝে ভাঁজ করে দুবার হাত টানা মারলো। এরপর মেহনূরের জন্যে ওই অবস্থাতেই গলা চড়িয়ে বললো,

– ঘুম থেকে উঠো। হ্যালো? তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? তোমাকে উঠতে বলা হয়েছে, এক্ষুনি উঠো।

মাহতিমের চড়ানো গলার আওয়াজ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠলো মেহনূর। আধো-আধো চাহনিতে কপাল কুঁচকে মাহতিমের দিকে তাকালো। কয়েক মিনিট ওই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই শেষে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো। মাহতিমও পালটা দৃষ্টি ছুড়ে ওর নিদ্রাভঙ্গ মুখটা দেখছে। ঘুম থেকে ডেকেছে বলে পেঁচার মতো মুখ করে রেখেছে। মাহতিমের দিকে ঘুম-ঘুম চাহনিতে গলা নামিয়ে বললো,

– কোথায় আছি? বুবুরা কোথায়?

মেহনূরের অবস্থা দেখে মাহতিমের প্রচুর হাসি পেলো। নিজের হাসিটা সামলে নিয়ে মেহনূরের দিকে গম্ভীর মুখে তাকালো। ওকে ভয় দেখানোর জন্য দৃঢ় কন্ঠে বললো,

– আমার জায়গায় তরুণ হলে যা করতো, সেটাই করতে অন্য জায়গায় নিয়ে এসেছি। এখানে কোনো মানুষ নেই। কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না। আমার কাজে যদি ভালোয়-ভালোয় সম্মতি দাও, তাহলে তোমার জন্য কোনো কষ্টদায়ক সিচুয়েশন করবো না।

মেহনূর নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক স্থির করে ঢোক গিলছে। মেহনূর ভয় পেতে শুরু করেছে কিনা এখনো মাহতিম শিওর হতে পারছেনা। তবুও আর সময় নষ্ট না করে জিপ থেকে লাফ দিয়ে নামলো মাহতিম। জিপের সামনে দিয়ে ঘুরে এসে মেহনূরের দিকটায় এসে দাঁড়ালো। মেহনূর এখনো অবুঝ দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহতিম আর কাহিনী না করে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। চোখ দিয়ে হাতের দিকে ইশারা করে শান্ত-স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– হাত বাড়িয়েছি, হাতটা ধরে নামো। যদি একটুও অবাধ্যতা করো, তাহলে এই হাত দিয়েই আন-এক্সপেক্ট কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবো।

মেহনূর আবারও ঢোক গিললো। জিহবার আগাটা দিয়ে ঠোঁট সামান্য ভিজিয়ে নিলো। দৃষ্টিনত করে হাতের দিকে তাকিয়ে খুব সাহস করে কোল থেকে হাত উঠালো। মেহনূরের নরম হাতটা আরো একবার ধরার জন্য প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় নিশ্বাস ভারী হচ্ছিলো মাহতিমের। নিজের ভেতরকার অবস্থা কাহিল হয়ে গেলেও অনড় অবস্থায় অটল হয়ে রইলো সে। মেহনূর নিরুপায় হয়েই হোক বা মাহতিমের ভয়ের চোটে, সে নিঃশব্দে মাহতিমের হাতটা প্রতিটি আঙ্গুল দিয়ে আঁকড়ে ধরলো। নামার জন্য সমস্ত ভর মাহতিমের শক্ত হাতের উপর ছেড়ে দিতেই মাহতিমের প্রশস্ত বুকটা অজানা প্রাপ্তিতে দুমড়ে-মুচড়ে এলো। সাথে-সাথেই তুমুল উত্তেজনায় বুকভর্তি লম্বা নিশ্বাসের টান পরলো মাহতিমের, তাড়াতাড়ি নিজেকে সংবরণ করার জন্য নিশ্বাস টেনে সেটা নিঃশব্দে ছেড়ে দিতে লাগলো। নেশা কি ভর করছে শরীরে? নাকি নেশার উপাদান দেহের কোষাগারে পৌঁছে গেছে?

– চলবে

#FABIYAH_MOMO

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

বিশাল রেসোর্টটা গাছপালা দিয়ে আবৃত। রাস্তাগুলো সবুজ ঘাস দ্বারা বিস্তৃত। জায়গাটা সম্পূর্ণ কোলাহলমুক্ত এবং পুরোপুরি জনশূন্য। সবাই যখন ঘুরে-ঘুরে পুরো রেসোর্ট দেখে ফেললো,তখন দুপুরের তপ্তময় সূর্যটা মধ্যগগণে ঠাঁই নিলো। দুপুরের খাবার তৈরিতে ম্যানেজার এসে মেনু নিয়ে গেলো, সেই সঙ্গে গোসলের জন্য সবকিছু দেখিয়ে গেলো। রেসোর্টের ভেতর আটটা কটেজ, প্রতিটি কটেজে দুটো করে রুম আছে। মাঝখানে খোলা সবুজ মাঠ, ডানদিকে সারিবদ্ধ তিনটা কটেজ রয়েছে। ছেলেরা আলাদা ভাবে থাকার জন্য দূরের তিনটা কটেজ পছন্দ করলো। মেয়েরা নিজেদের জন্য অপজিট দিকের পাচঁটা কটেজে চলে গেলো। সবাই নিজেদের রুম গুছিয়ে আলমারিতে কাপড় তুলে গোসলের জন্য বের হলো। মাঠের মাঝখানে দুইপক্ষ উপস্থিত হলে সৌভিক সবার আগে চন্ঞ্চল মুখে বললো,

– তোমরা সাঁতার জানো? চলো পানিতে নামি।

সৌভিকের উত্তেজনায় পানি ঢেলে বাধা দিয়ে বললো মাহতিম,

– একদম না। আজকে জার্নি করেছিস, আজকেই পানিতে নামার কথা উঠাবি না।গোসল সেরে সবাই রুমে যেয়ে রেস্ট নিবি। এটলিস্ট কাল পানিতে নামার চিন্তা করবি।

মাহতিমের কথার উপর কেউ স্পর্ধা দেখাতে পারলো না। এখানে বাথরুম সংখ্যা মাত্র দুইটা, তাও দুটো বাথরুম একসাথে সেট করা। কাজেই বাথরমের জন্য ভোগান্তিতে একটু হলেও পরতে হলো। সবাই লাইন ধরে গোসলের জন্য সিরিয়াল লাগিয়ে বসলো। সেই সিরিয়াল মোতাবেক মাহতিমের সিরিয়াল লাস্টে এসে ঠেকলো। মাহতিম খুবই শান্ত মুখে বলে দেয় গোসল নিয়ে তাড়াহুড়ো নেই। কাজেই ঠিকঠাক মতো সবাই যেনো গোসল সেরে নেয়। রুমে এসে বিছানার উপর ক্লান্ত দেহ রাখলো মাহতিম। চোখদুটো বন্ধ করে কপালের উপর কবজি তুলে রাখলো। পিলপিল করে সময় চলে যেতেই গোসলের জন্য মাহদি ওকে ডাকতে এলো। মাহতিমকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় দেখে মাহদি না ডেকেই বাইরে চলে গেলো। বাইরে গিয়ে সাবিরকে বললো, মাহতিম এখন ঘুমাচ্ছে, কেউ যেনো এখন ভাইয়াকে না ডাকে।

তেজীময় সূর্য তেজ হারিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলতে লাগলো। চারদিকের তাপদাহ অনেকখানি কমে গেলো। গোলাপী রঙের স্নিগ্ধ পর্দায় পুরো নীল আকাশ ঢেকে গেলো। পাখির কলরবে মুখর হলো রেসোর্টের পরিবেশ, গাছগুলোতে প্রচুর পাখি ডানা ঝাপটানি দিচ্ছে। বিকেলের আযানটা শেষ হতেই সৌভিক-নীতি-শানাজরা নদীতীরে ঘুরতে গেছে। মাহদি নিজমনে ঘুমন্ত মাহতিমের পাশে সিওসি খেলছে। অনেকক্ষনণ পর মাহতিমের ঘুমের রেশ পাতলা হলো। চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে ধীরে-ধীরে চোখের পাতা খুললো, ছোট-ছোট চোখে চারপাশে তাকাতেই আধো অন্ধকারে জানালার পাশে মাহদিকে দেখতে পেলো। সেই ঘুম জড়ানো শান্ত কন্ঠে মাহতিম ওর উদ্দেশ্যে বললো,
– তুই আমার রুমে কি করছিস?

মাহদি পেছন থেকে কন্ঠ শুনে তড়িৎ গতিতে মাথা ঘুরালো। ও পেছনে ঘুরতেই মাহতিম দুহাতের তালুতে ভর দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাহদির হাতে নিজের মোবাইল ফোনটা দেখে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,

– তুই ওদের সাথে ঘুরতে যাসনি?

মাহদি ড্যাবড্যাব করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মাহতিমের দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে সিওসি খেলা স্টপ করে ফোনটা ওর দিকে এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক সুরে প্রসন্ন ভঙ্গিতে বললো,

– তুমি একা রুমে থাকবে দেখে আমি ওদের সাথে যাইনি। ধরো মোবাইল ধরো। ব্যালেন্স নেই, টাকা ভরে ফোনটা আবার দুইমিনিটের জন্য দিও।

ভ্রুঁ উঁচিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো মাহতিম। ফোনের ব্যালেন্স শেষ করে আবার গেম খেলার জন্য হুকুম করছে। কিন্তু সেই কথাটা দূরে ঠেলে বর্তমানে ওর উদার অবস্থা দেখে বিষ্মিত হলো। দুই চক্ষু দিয়ে ওর আপাদমস্তক বুলিয়ে কৌতুহল গলায় বললো,

– তোর ভেতরে এতো দরদ আসলো কিভাবে?

মাহদি ওর হাতটা টেনে ঘাঁয়ের জায়গাটা দেখিয়ে বললো,

– তুমি হাতের জন্য খাবার খেতে পারো না ভাইয়া। তাই খাইয়ে দেওয়ার জন্য বসে আছি। তোমাকে খাইয়ে দিয়ে আমি ওদের কাছে চলে যাবো।

মাহতিম নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলো। এইটুকুনি মাহদি ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে, কখন ভাইকে খাইয়ে দিবে সেটার জন্য ঘুরাও বন্ধ রেখেছে। মাহতিম কিছু বললো না, ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নামতে লাগলো। ফ্লোরে দুপা ফেলে দাঁড়িয়ে যেতেই মাহদির উদ্দেশ্যে বললো,

– তুই ওদের কাছে যা। আমার হাতে কোনো ব্যথা নেই। তাছাড়া এখনো আমি গোসল করিনি। আমি এই মূহুর্তে খাবো না। তুই ওদের কাছে যেয়ে ঘুরাঘুরি কর, যা।

মাহদি অটলভাবে বলে উঠলো,
– আমি যাবো না। তুমি গোসল করো, আমি মেহনূর আপুর কাছে যাচ্ছি। তোমার গোসল শেষ হলেই ম্যানেজার বেটাকে খাবার আনতে বলে দিবো।

মাহতিম ভ্রুঁ কুঁচকানো অবস্থায় মৃদ্যু হাসলো। সেই হাসিতে গোসলের জন্য কাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। এদিকে সৌভিকরা নদীরের পাড়ে বসে গোল আড্ডা বসিয়েছে। সুরাইয়াকে নিয়ে শানাজ-সাবা অন্যদিকে বসেছে। এটা নিয়ে প্রথমে দ্বিমত যুদ্ধ চললেও পরে নীতির কথায় দুই দল আলাদা হয়ে বসেছে। এই সুযোগে ফারিন মিলে কটেজের জন্য প্ল্যান বানানোর প্রস্তাব দিলো। সামির এবার নিচু সুরে সবার উদ্দেশ্যে বললো,

– এবারের প্ল্যান কিন্তু ক্রিটিক্যাল হবে। সবাই একটু বেশি সর্তক থাকবে। মাহতিম ভাইয়ের কান যে খরগোশের মতো সজাগ, আর বিড়াল মতো তীক্ষ্ম, এটা সবাই জানো। ভাইয়ের চোখে ধূলো দেওয়াটা চাট্টিখানি ব্যাপার না। যে করেই হোক, মেহনূরকে এবার ভাইয়ের দিকে ঠেলতে হবে। ভাইয়ের অবস্থা দেখে যা বুঝলাম, সে মোটামুটি লাইনে এসে গেছে। এখন শুধু পল্ট্রি-মুরগির ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিলেই কাজ ফি-নি-শ। এটার জন্য, মেহনূরকে এখন ধাক্কা মেরেই ভাইয়ের কাছে পাঠাতে হবে।

কথার মাঝখানে দাঁড়ি বসিয়ে নীতি প্রশ্ন করে বসলো,

– মাহতিম ভাইকে দুচোখে দেখতে পারেনা মেহনূর। একটাবার চিন্তা কর, মাহতিম ভাইয়ের বডি দেখে সামিকের এক্স পযর্ন্ত বেহায়া হয়ে গেছিলো। কতোদিন ভাইয়ের পিছে ঘুরঘুর করেছে অথচ পাত্তা পায়নি। আর এদিকে সামনা-সামনি ওপেন চেষ্ট দেখার পরও মেহনূরের মধ্যে ফিলিংস আসেনি।

নীতির কথার যুক্তি টেনে তৌফ খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
– মেয়েদের পটানোর জন্য লুইচ্চা মার্কা কাণ্ড করতে হইবো। আমি খালি আশ্চর্য হই, এই শা-লা মাহতিম চুতুমরানি এতো ভদ্র সাইজা আছে কেন? শা-লা তো একনাম্বার খাচ্চর। আড্ডায় থাকলে কি দুষ্টু মার্কা কথা বলতো, লজ্জায় আমি নিজেই উইঠা যাইতাম। ওই বান্দা সুন্দরীখানায় একেবারে সাধু সাইজা গেছে, এগ্লা ভাবতেও বুকটা ব্যথা করতাছে ভাই।

তৌফের কথায় চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো সৌভিক। অন্যমনস্ক সুরে ভাবুক স্টাইলে বললো,

– মাহতিম তো চরম অসভ্য, কিন্তু ওইরকম উগ্র অসভ্যতামি ও করেনা। এখানে যেই রূপ দেখতেছি এটা আসলেই মানা যায় না। ও কি ট্রাম কার্ড ফেললো নাকি? আমি আসলেই বুঝতে পারছি না। মাহতিম যদি চালাকি করে সিরিয়াসলি সেটা ধরা-বুঝার বাইরে! কোনো সুযোগই সেটা টের পাওয়ার।

হঠাৎ সৌভিকের পিঠে দুম করে কিল মারলো সিয়াম। ভ্রুঁদুটো মারাত্মক কুঁচকে বিরক্ত মুখে বললো,

– কাঠের খড়ম দিয়া যদি তোদের ঘিলুটা পারাইতে পারতাম! তোরা কি এইখানে চুলের প্ল্যানিং করতে বসছোস? মাহতিম কি করতাছে, কি করবো ওগ্লা ভাইবা কাজ আছে? মেইন পয়েন্টে আইসা প্ল্যান বানাইতে পারোস না? শালা খবিশের দল!

সিয়ামের কথা শুনে এবার সবাই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। মনে-মনে সবাঈ ক্ষুদ্ধ হয়ে গেলেও সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে তৌফ মুখ খুললো,

– আমার প্লাস্টিকের জুতা যদি তোর মেইন পয়েন্টে মারি, জানোস তো কি হইবো? এক্কেবারে গলাকাটা মুরগীর মতো দাপাইতে থাকবি!

সিয়াম সাথে-সাথে বাম ভ্রুঁ উঁচু করে তীক্ষ্ম সুরে বললো,

– বল দিয়া ক্রিকেটের স্ট্যাম্প ফালাইতে পারেনা, হাবলাকান্ত আইসে মেইন পয়েন্টের টার্গেট শিখাইতে! ওরে বা*, মুখটা খারাপ করাইস না। তুইযে পিনিক উঠলে কি করোস, ওইটা আর বাচ্চাগুলার সামনে বললাম না। এখন মাহতিমের হিসাব ধর, ওর ক্যালকুলেশন মিলা।

সিয়ামের কথায় ফুঁসে উঠলেও সৌভিক তৌফকে থামতে বললো। তৌফ চুপ করে প্রীতির দিকে তাকিয়ে জিহবাটা আলতো ভিজিয়ে নিলো। শুষ্ক কন্ঠে ঢোক গিলে স্বাভাবিক সুরে বললো,

– আজকের দিনটা ড্রপ যাক। আপাতত কিছু করিস না। ও একটু এডজাস্ট করুক, কাল দুপুর থেকে কাহিনী শুরু করলে বেস্ট হয়। আমার মাথায় সলিড বুদ্ধি এসেছে, রাতে সবার সাথে আলাপষকরতে বসবো। ঠিক এগারোটার দিকে আমার কটেজের ভেতর চলে আসবি। ঠিকাছে?

তৌফের কথার উপর নিজের বাক্য জুড়ে ফারিন চৈতন্য ভঙ্গিতে বললো,

– তোমাদের কাছে একটা রিকুয়েস্ট, ভাইয়ার কাছে সুরাইয়ার ব্যাপারটা জানতে দিও না। ভাইয়া জানলে হিতাহিত কাহিনী ঘটতে পারে। আপাতত এটা স্কিপ করো, আর শানাজ আপুদের বলে দাও তারাও যেনো ভাইয়ার কাছে গোপন করে।

সবাই একসঙ্গে মাথা দুলিয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ জানালো। এরপর অন্য ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলো। এদিকে শানাজ কড়া করে সুরাইয়াকে শালীনতা বুঝিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে তিনটা দিন সবার সাথে ভালোভাবে কাটাবে অক্ষরে-অক্ষরে শিখিয়ে দিচ্ছে। শেফালী ওকে যা-যা আবোলতাবোল বুঝিয়েছে, সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে-মনে সুরাইয়া খুবই বিরক্ত হচ্ছে। এসব অহেতুক কথা শুনার চাইতে কটেজে ফিরে শুতে ইচ্ছে করছে। শানাজের কথায় প্রচণ্ড অধৈর্য্য হয়ে শেষমেশ সুরাইয়া অভিনয় করে বললো,

– বুবু আমার মাথা টলছে। আমি একটু ঘুমাতে যাই? তোমরা ওদের সাথে আড্ডা দিতে থাকো, আমি কটেজে ফিরে যাই। ওখানে মেহনূর তো আছে, তাই চিন্তা করতে এসো না। আমি গেলাম হ্যাঁ?

শানাজের কোনো উত্তর না শুনেই ছুটে গেলো সুরাইয়া। ওর কটেজটা সাবার সাথে দ্বিতীয় রুমটায় ফিক্সড করা। সুরাইয়া সেখানে পৌঁছতেই আবার শয়তানি বুদ্ধির জন্য ছেলেদের কটেজের দিকে তাকালো। ফাজলামি করার জন্য দাঁত বের হাসি দিতেই পা টিপে-টিপে ছেলেদের কটেজের দিকে গেলো। ইচ্ছে করে সবার রুমে ঢু মেরে মাহতিমের কটেজ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু প্রথম কটেজের প্রথম রুম যে মাহতিমের ছিলো, সেটা একটুও ধরতে পারলো না সুরাইয়া। শেষদিক থেকে চেক দিতে-দিতে মাহতিমের কটেজে চলে আসলো, ওর রুমের দিকে চুপি দিতেই অন্ধকার আবিষ্কার করলো। রুমে যেটুকু আলো দেখা যাচ্ছিলো, সেটুকু অবশ্যই স্পষ্ট দেখার জন্য যথেষ্ট না। তাছাড়া সূর্যের আলো পশ্চিমে হেলে পরেছে, তাই চারদিকে অন্ধকার আচ্ছন্ন করেছে। সুরাইয়া মাহতিমকে একাকী দেখার জন্য মিটিমিটি হাসি দিয়ে কোমরের কাছে দুইহাত বেধেঁ ভেতরে পা দিলো। অন্ধকার রুমে আরেকটু ঢুকে চারিদিকে সরুচোখে দেখতে লাগলো। কিন্তু তখনই পেছন থেকে রুমের দরজা আটকানোর শব্দ হলো। সুরাইয়া চমকে গিয়ে যেই পেছনে ঘুরে তাকালো ততক্ষণে ও অন্ধকার রুমে বন্দি হয়ে গেলো! বিকট চিৎকার দিয়ে অন্ধকারকে ভয় পেয়ে হাউমাউ করে কাদঁতে লাগলো সুরাইয়া। রেসোর্টের রুমগুলো এতো শক্ত ও মজবুত, সেখান থেকে একটা আওয়াজও অপরপ্রান্তে গেলো না। দরজা থাবাতে-থাবাতে সুরাইয়া আরো চিল্লিয়ে কাঁদতে থাকলো। ওই মূহুর্তেই দরজার বাইরে মাহতিম দাঁড়িয়েছিলো। পকেটে দুহাত গুঁজে নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে প্রতিটা চিৎকার শুনতে লাগলো। কিছুক্ষণ ক্ষোভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঘাড়ের ব্যায়াম হিসেবে অদ্ভুত কাজ করলো। মাথাটা ধীরগতিতে একবার ডানে, আরেকবার বামে কাত করলো। সেদিন এভাবেই একটা মেয়েকে রুমে আঁটকে দিয়েছিলো, এভাবেই ওই মেয়েটা দরজা খুলার জন্য অনুনয় করেছিলো, বারবার জঘন্য স্পর্শের কবলে পরে নিজেকে অসহায় ভেবেছিলো। প্রতিটা অশ্রুফোঁটা ঝরঝর করে দুগাল বেয়ে ভিজে যাচ্ছিলো। সে ছাড়া পেয়ে নিস্তেজ শরীর নিয়ে সত্য গোপন করে ফেললো। সেই জঘন্য সত্য আপন দাদাভাইও জানতে পারলোনা, নিজের নাড়ী ছেড়া মায়েরও দুকানে শোনার সুযোগ হলোনা । আজ একইভাবে মূখ্য অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিছুটা অন্য কায়দায়, কিছুটা অন্য ভঙ্গিতে। আর সেই দৃশ্যের মতো আজ কিছুটা স্থান চেন্ঞ্জ হয়েছে। সেদিন সুরাইয়া বাইরে দাড়িয়ে উপভোগ করেছে। আজ সেই জায়গায় মাহতিম দাঁড়িয়ে তৃপ্তির শ্বাস টানছে। তরুণের কাছ থেকে প্রতিটা স্বীকারোক্তি পুনরায় স্মরণ করছে, সেই দগ্ধ-পীড়িত বুকের যন্ত্রটা আজও বেকাবু স্পিডেই চলছে। আজ সুরাইয়ার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে ব্রেনে দুটো বু-লে-ট ঢুকিয়ে দিতো নি-র্ঘা-ত! এখনো হিসাব বাকি। মাহদির ভাষ্যমতে আরেকটা হিসাব নেওয়া এখনো বাকি।

#চলবে

#FABIYAH_MOMO