মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-২১

0
588

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লেখক- ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২১
.
রাতে খাওয়ার টেবিলে উৎস বিরিয়ানি মুখে দিয়েই বলল,
“বাহ্! বিরিয়ানি টা দারুন রেঁধেছো আম্মু। চিকেনটা ফ্রাইটাও দারুন হয়েছে। পুরো লাজাবাব।”
আঞ্জুমান হেসে বললেন,
“আমি রাঁধিনি। পৃথুলা রেঁধেছে।”
“তাই নাকি? ভাবি তো মাশাআল্লাহ ভালোই রান্না জানে।”

খাবার টেবিলে মোটামুটি সবাই রান্নার প্রশংসা করেছে কেবল অভ্র ছাড়া। অর্থি বলল,
“বড় ভাইয়া, তুমি বললে না তো ভাবি কেমন রান্না করেছে।”
অভ্র মৃদু হেসে বলল,
“আমি আর কি বলব! তোরা সবাই তো প্রশংসার ফুলঝুড়ি নিয়ে বসেছিস। প্রসংসা করার মত আর কোনো শব্দ আমার জন্য বাকি রেখেছিস?”
কথাটাতে বেশ মনঃক্ষুন্ন হলো পৃথুলা। সবাই প্রসংসা করল অথচ যার জন্য রান্না করল তার মুখ থেকেই ভালো কিছু শুনলো না।

ডিনার শেষে সব গুছিয়ে বেডরুমে আসে পৃথুলা। অভ্র সোফায় বসে কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে। পৃথুলা দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। অভ্র ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে একনজর পৃথুলার দিকে তাকাল। পৃথুলার মুখটা থমথমে।

অভ্র নজর সরিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী হয়েছে ম্যাডামের? মন খারাপ?”
পৃথুলা জবাব দিল না৷ অভ্র এবার পৃথুলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“পৃথা, এভরিথিং ওকে?”

পৃথুলা ভেংচি কাটল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ওর ভেংচি কাটা অভ্রর নজর এড়ালো না। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে বলবে তো?”
পৃথুলা এবার শোয়া থেকে উঠে বসল। বলল,
“আচ্ছা আমার রান্না কি খুব খারাপ?”
“নাহ৷ এ কথা কে বলল?”
“ভালোও তো বলেন নি। একটু রান্নার প্রশংসা করলে কি হতো?”

পৃথুলার কণ্ঠে অভিমান ঝড়ে পড়ছে। ওর ছেলেমানুষী দেখে অভ্র ফিক করে হেসে ফেলল। পৃথুলা এখন আর আগের মত নেই। অনেকটা পাল্টে গেছে। আগের পৃথুলা ছিল রোবটের মত। যার মাঝে রাগ, অভিমান, ছেলেমানুষী কিছুই ছিল না। রোবট পৃথুলা একটু একটু করে মানুষে পরিণত হচ্ছে।

অভ্র ল্যাপটপটা রেখে পৃথুলার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“এই কারণে মহারাণীর অভিমান হয়েছে? আসলেই আমি কাজটা ঠিক করিনি। প্রসংসা না করে খুব অন্যায় করে ফেলেছি। এজন্য মহারাণী আমাকে যা শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেব। বলুন, আমাকে কি শাস্তি দেবেন?”

পৃথুলার গোমড়া মুখে হাসি ফুটে উঠল। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল,
“কালকে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে।”
অভ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পৃথুলা অভ্রকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“পড়াশুনার বাহানা দেবেন না। কাল শুক্রবার। অফ ডে। ক্লাস নাই।”
অভ্র হেসে বলল,
“যথাজ্ঞে। মহারাণীর আদেশ শিরোধার্য।”

আলমারি খুলে একটা হলুদ রঙের শাড়ি বের করল পৃথুলা৷ শাড়িটা বের করে আলমারি বন্ধ করতে গিয়ে সাজিয়ে রাখা অভ্রর শার্টগুলোর দিকে নজর গেল ওর। কিছু একটা ভেবে ওখান থেকে ধূসর রঙা একটা শার্ট নিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল পৃথুলা। শার্টটা খানিকক্ষন উল্টে পাল্টে দেখে কামিজের উপরই শার্টটা পরে নিল। এদিক সেদিক ঘুরে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল। তারপর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বর দিকে একটা ফ্ল্যাইং কিস ছুঁড়ে দিল।

আচমকা অট্টহাসির শব্দ শুনে দ্রুত পেছনে তাকালো। অভ্রকে হাসতে দেখে থতমত খেয়ে গেল পৃথুলা। ধাতস্থ হতেই দ্রুত শার্ট খুলে বিছানায় রেখে শাড়িটা নিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

শাড়ি পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে অভ্রকে রুমে দেখা গেলনা। বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল পৃথুলা। ইশ্ তখন কি লজ্জায়-ই না পড়েছিল!

পৃথুলা ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে বসল৷ আচ্ছা একটু সাজলে কেমন হয়? কিছুক্ষন ভেবে চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা ম্যাট লিপস্টিক লাগালো। মুখে আর কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। নিতম্ব সমান চুলগুলো আঁচড়ে বেণী করার সময় অভ্র ঢুকল রুমে।
পৃথুলাকে হলুদ শাড়িতে মানিয়েছে বেশ। একদম হলদে পরীর মত লাগছে। অভ্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পৃথুলার দিকে।

বিভোর যখন এভাবে পৃথুলার দিকে তাকাতো তখন ওর অস্বস্তি লাগতো খুব। আজ তেমন লাগছে না। হয়তো অভ্র ওর স্বামী বলেই। আশ্চর্যজনকভাবে পৃথুলা উপলব্ধি করল, বিভোরের কথা মনে পড়ায় ওর খারাপ লাগছে না৷ আগে যখনি বিভোরের স্মৃতি মাথায় আসতো মুহূর্তেই কান্নায় ভেঙে পড়তো সে। কিন্তু ইদানীং তেমনটা হচ্ছেনা৷ তবে কি বিভোরের অস্তিত্ব তার মন থেকে একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে? কয়েকবছরেও যাকে মন থেকে সরাতে পারেনি, কয়েকদিনেই তা হয়ে যাচ্ছে! কিভাবে সম্ভব?
“লুকিং বিউটিফুল।”
পৃথুলার ভাবনায় ছেদ পড়ল অভ্রর কথায়। লাজুক হেসে বলল,
“থ্যাংকস।”
“তবে শার্টে তোমাকে আরো ভালো মানায়।”
পৃথুলার মুখ থেকে হাসি উবে গেল। মুখটা চুপসে আমষেটে হয়ে গেল।
“কাল অফিস থেকে ফেরার সময় তোমার জন্য কয়েকটা শার্ট কিনে নিয়ে আসব। কি বলো?”
পৃথুলার এবার লজ্জ্বায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। শাড়ির আঁচল খুঁটতে খুঁটতে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
“আমি তো এমনিই পরছিলাম।”
অভ্র সে কথায় পাত্তা দিল না। তার মত করে বলে চলল,
“তোমার পছন্দের রঙ কি কি বলো? সে রঙের শার্ট আনব।”
এবার পৃথুলার মেজাজ বিগড়ে গেল। অভ্রর দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বলল,
“ফাজলামো করছেন? আমি শার্ট পরেছি তাতে কি হয়েছে? আপনার ইচ্ছে হলে আপনি শাড়ি পরেন। যত্তসব।”
অভ্র হেসে বলল,
“বাপরে! এত রাগ তোমার! আচ্ছা স্যরি! চলো।”

দিলারা বেগম আর আঞ্জুমান বলে বেরিয়ে পড়ল দুজন।
অভ্র গাড়ি বের করতে নিলে পৃথুলা বাধা দিয়ে বলল,
“গাড়িতে যাব না।”
“তাহলে?”
“বাইকে ঘুরব। উৎস ভাইয়ার বাইকটা নিয়ে চলুন।”
অভ্র একটু ভেবে বলল,
“ঠিক আছে। তুমি একটু দাঁড়াও। আমি উৎস’র কাছ থেকে বাইকের চাবি নিয়ে আসি।”

কিছুক্ষন পর অভ্র বেরিয়ে এলো। বাইকে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাবে?”
পৃথুলা অভ্রর পেছনে বসে ডান হাতটা আলতো করে অভ্রর কাঁধে রেখে বলল,
“উমম… চলুন খামারবাড়ি যাই।”
“খামারবাড়ি! সেতো অনেকদূর।”
“অনেকদূরই যাব। চলুন তো।”
অভ্র হেসে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

খামারবাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে পাঁচটা বেজে গেছে। পশ্চিমাকাশে রক্তিম সূর্যটা তখন ধীরে ধীরে ডোবার পায়তারা করছে। চরফ্যাশন প্রধান সড়ক থেকেও প্রায় ষোলো কিলোমিটার দূরে এই জায়গাটা। লম্বা সময় পর ওরা সেখানে পৌঁছালো৷ বাইক থেকে নেমে দশ টাকা করে দুটো টিকিট কেটে সেখানে ঢুকল ওরা।

চারিদিকে সবুজাভ গাছপালা। ফুলগাছ গুলোতে নানা জাতের, নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। কয়েকটা প্রজাপতি দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে ফুলের আশেপাশে।

জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। ছুটির দিন হওয়ায় আজ মানুষের এত আনাগোনা। কর্মজীবী মানুষের সপ্তাহে এই একটাদিনই তো ফুরসত মেলে। তাই সময় কাটানোর জন্য চলে এসেছে প্রতিদিনকার ব্যস্ত মানুষগুলো। কেউ একা ঘুরতে এসেছে, কেউ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘুরতে এসেছে, কেউ এসেছে বন্ধুবান্ধব আর কেউ প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে।
.
পাশাপাশি হাঁটছে অভ্র-পৃথুলা। মৃদুমন্দ হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে পৃথুলাকে। বাতাসে তিরতির করে উড়ছে ওর হলুদ শাড়ির আঁচল। অভ্র অপলক তাকিয়ে দেখছে পৃথুলাকে৷ এই মেয়েটাকে যত দেখে ততই মুগ্ধ হয় সে। আশেপাশের কোনো কিছুই অভ্রর খেয়ালে নেই। সে পৃথুলাকে দেখতেই ব্যস্ত।

হাঁটতে হাঁটতে আচমকা একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিল অভ্র। পৃথুলা খপ করে অভ্রর হাত ধরে ফেলল।
“কী হলো?”
পৃথুলার প্রশ্নে অভ্র মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
“কিছু না।”
পৃথুলা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো অভ্রর দিকে। তবে কিছু বলল না।

কাছেই কোনো একটা মসজিদে আসরের আজান হচ্ছে। পৃথুলা শাড়ির আঁচলটা মাথায় টেনে নিল। এখন পুরো বউ বউ লাগছে ওকে।
.
চলবে___