মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-২৪

0
722

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২৪
.
প্রত্যাশার কথার প্রত্যুত্তরে পৃথুলা কিছু বলল না। চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিল। প্রত্যাশা বলল,
“এখন পর্যন্ত আমার দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ অভ্র ভাইয়া। ওনার মত মানুষ আর একটাও হয় না। স্ত্রীকে কি করে ভালবাসতে হয়, সম্মান করতে হয় সেটা ওনার কাছ থেকে শেখা উচিৎ। আর ওই বিভোর! কি একটা বালছালের সাথে প্রেম করলি তুই! তোর ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য একমাত্র অভ্র ভাইয়া। ওই বিভোইররা না। যে মানুষটা তোকে এত ভালবাসে তারও তো তোর ভালবাসা পাবার অধিকার আছে, তাই না? ভালবাসার মূল্য কেবল ভালবাসা দিয়েই দিতে হয়। ওমা! কথা বলতে বলতে চা কখন শেষ হয়ে গেছে টেরই পাইনি। আরেক কাপ খাবি?”
“না।”

প্রত্যাশা কাপদুটো নিয়ে কিচেনে চলে গেল। কয়েকমাস আগে হোটেলে অভ্রর বলা কথাটা মনে পড়ল পৃথুলার। ‘আমি মন বাড়িয়ে তোমার মন ছুঁতে চাই। যেদিন ছুঁতে পারব সেদিনই নাহয় তোমাকে কাছে টানার সাহস দেখাব।’
পৃথুলা বিড়বিড় করে বলল,
“ছুঁয়েছে অভ্র। তোমার মন ছুঁয়ে ফেলেছে আমার মনটাকে।”

ফোন বাজছে পৃথুলার। অভ্র ফোন করেছে। পৃথুলা হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করে কানে ঠেকালো,
“হ্যাঁ, বলুন।”
“পৃথা, আজ কি তোমাদের বাসায় থেকে যাবে?”
“কেন?”
“আসলে অফিসে অনেক কাজ আছে। আমি রাত ন’টার আগে বের হতে পারব না।”
“ও। তাহলে আমি একাই চলে যাই।”
“আরে না। একা আসবে কেন? কাল এসো।”
“না, আজকেই যাব।”

অভ্র হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ঠিকাছে। আমি উৎসকে ফোন দিয়ে বলছি তোমাকে নিয়ে আসতে।”
“উৎস আবার কষ্ট করতে যাবে কেন? আমিই…”
“একা আসতে পারবে, তাই তো? কিন্তু একা আসার দরকার নেই। উৎস গিয়ে নিয়ে আসবে।”
“ঠিকাছে।”
“রাখছি তাহলে।”
“শুনুন!”
“বলো।”
“ফেরার সময় একটু ফুলের দোকানে যাবেন।”
“ফুলের দোকানে কেন?”
“একটা বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবেন।”
“বেলি ফুলের মালা দিয়ে কী করবে?”
“উফ্ এত্ত কথা বলেন কেন আপনি!”
অভ্র হেসে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আনব।”
.
রাত সাড়ে নয়টায় বাসায় ফেরে অভ্র। জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। পৃথুলা খাবার বেড়ে দিয়ে চলে যেতে নেয়। অভ্র জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছ? খেতে বসো।”
“আমার খিদে পেয়েছিল ভীষণ। তাই আগেই খেয়ে নিয়েছি।”
“ওহ।”

পৃথুলা রুমে চলে গেল। খাওয়াদাওয়া শেষে অভ্র বেডরুমের দিকে পা বাড়াল৷ আজ অফিসে প্রচুর ধকল গেছে৷ এখন একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। অভ্র বেডরুমের সামনে গিয়ে আবিষ্কার করল দরজা ভেতর থেকে আটকানো।

অভ্র দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
“পৃথা, পৃথা ঘুমিয়ে পড়েছো?”
ভেতর থেকে পৃথুলা আওয়াজ দিল,
“পাঁচ মিনিট দাঁড়ান।”
“কেন?”
“দরকার আছে।”
“পাঁচ মিনিট আমাকে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?”
“চাইলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসতে পারেন।”

অভ্র ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে সাত মিনিট পর দরজা খুলে দিল পৃথুলা। অভ্র ভেতরে ঢুকেই একটা ঝটকা খেল। পৃথুলার পরনে একটা সোনালি পেড়ে কালো পাতলা জর্জেটের শাড়ি, ব্যাকলেস ব্লাউজ। হাতে কয়েকটা কালো কাচের চুড়ি। কানে কালো পাথরের একজোড়া ঝুমকো। চুলগুলো খোঁপা করা।

কালো অভ্রর প্রিয় রঙ। প্রিয় রঙে এই মেয়েটাকে দেখে চোখ ঝলসে যাচ্ছে অভ্রর। যদিও পৃথুলার মুখে প্রসাধনীর ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু আপাতত ওর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা মেকআপকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে সদ্য ফোটা একটা কালো গোলাপ।

অভ্র যেন পলক ফেলতেও ভুলে গেল। সটান দাঁড়িয়ে রইল, নড়ল না একটুও। পৃথুলা এগিয়ে এসে অভ্রকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর তাকালো অভ্রর দিকে। অভ্র নিজেকে সামলে নিল। এভাবে তাকিয়ে থাকলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলবে। পৃথুলার মতিগতি আজ কিছু বোধগম্য হচ্ছে না ওর।

“আমার বেলি ফুলের মালা কোথায়?”
অভ্র মালাটা এনে পৃথুলার দিকে বাড়িয়ে দিল। পৃৃথুলা মালাটা হাতে নিল না। পেছন ঘুরে বলল,
“খোঁপায় পরিয়ে দিন।”

অভ্র বুঝতে পারছে না পৃথুলার আজ হয়েছে টা কি! পৃথুলা বলল,
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? পরিয়ে দিন।”
অভ্র মালাটা পৃথুলার খোঁপায় পরিয়ে দিল। পৃথুলা অভ্রর দিকে ফিরে বলল,
“কেমন লাগছে আমাকে?”

অভ্র কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল পৃথুলার দিকে। এরপর বলল,
“কি হয়েছে তোমার একটু বলবে প্লিজ?”
পৃথুলা মুচকি হেসে অভ্রর দিকে এগিয়ে গেল। অভ্রর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“ভালবাসি প্রিয়।”

বলেই মুখ গুঁজল অভ্রর বুকে। কথাটা বুঝতে অভ্রর খানিকটা সময় লেগে গেল। বুঝতে পেরে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল বিজয়ের হাসি। দুহাতে জাপটে ধরল পৃথুলাকে। কয়েকমিনিট কাটল এভাবেই, নিরবতায়। কিছুক্ষণ পর অভ্র পৃথুলার মুখটা দুহাতে আঁজলা করে ধরে বলল,
“আজ তাহলে অধিকার ফলানোর সাহসটা দেখিয়েই ফেলি।”

পৃথুলা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল। অভ্র ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিকাছে, তুমি সময় নাও।”
বলে পৃথুলাকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল।

পৃৃথুলা হা করে রইল। মনে মনে ভয়ংকর একটা গালি দিল অভ্রকে। অভ্র পৃথুলার মুখভঙ্গি দেখে অবাক বনে গেল। একটু আগে সে ছিল এক রকম আর এখন অন্যরকম। এই মেয়েজাতটাকে বোঝার সাধ্যি কোনো পুরুষেরই নেই বোধহয়!

অভ্র ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে পৃথা?”
পৃথুলা দাঁত কটমট করে বলল,
“আপনি একটা ব্যাক্কল, মাথামোটা। ‘তুমি সময় নাও পৃথা’। আমি চাইছি আপনার কাছে সময়?”
অভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“তুমি এই কারণে এমন রেগে গেছো!”
পৃথুলা উত্তর দিল না। অভ্র বলল,
“কিন্তু তুমি তো ‘হ্যাঁ’ বলো নি। আমি কি করব?”
“লজ্জার কারণে বলিনি। আর আপনি….। আসছে সাধুপুরুষ। হুহ।”

বলে আলনা থেকে একটা সুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু ওয়াশরুমে ঢোকা হলো না। অভ্র পৃথুলার হাত ধরে কাছে টেনে এক ঝটকায় পৃথুলাকে কোলে তুলে নিল। মৃদু হেসে নেশাতুর কণ্ঠে বলল,
“আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে, হুম? এই সাধুপুরুষ আজ আর সাধুপুরুষ থাকবে না। বীরপুরুষ হয়ে যাবে।”

______
কয়েক বছর পর…..
আজ অভ্রদের বাড়িতে খুশীর আমেজ চলছে। মায়ের আদরের মেয়ে আর ভাইদের পরম স্নেহের একমাত্র বোন অর্থির আজ বিয়ে। সেই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ুয়া ছটফটে পিচ্চি মেয়েটা আজ বউ হয়ে কারো ঘর আলোকিত করবে।

অর্থির হবু বরের নাম প্রহর। ছেলেটা দেখতে সুদর্শন। আচার-আচরণ অমায়িক। প্রহরের মা অর্থিকে দেখার পর বিয়েতে একটু আপত্তি করেছিলেন৷ তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে যেমন ফরসা, ছেলের বউও ফর্সা হবে। তাই অর্থির গায়ের রঙ নিয়ে আপত্তি করেছেন। কিন্তু ছেলের কাছে তার আপত্তি ধোপে টিকল না। প্রহর অর্থিকে ছাড়া আর কোনো মেয়েকে বিয়ে করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাই ছেলের পছন্দের মান রাখতে অর্থির সাথে বিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন তিনি। তবে প্রহরের বিশ্বাস, অর্থি নিজগুণে তার শাশুড়ির মন জয় করে নেবে।

বরযাত্রী এসেছে কিছুক্ষণ আগে। পুরো বাড়িজুড়ে মেহমান গিজগিজ করছে।
প্রহরের মেয়ে কাজিনদের সাথে জম্পেশ আড্ডায় মেতেছে উৎস। পৃথুলা ছোট্ট উশাকে কোলে নিয়ে উৎস’র কাছে গেল।
“এইযে দেবরসাহেব, এখানে বেয়ানদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন, আপনার মেয়ের খবর রেখেছেন কি? নাও তোমার মেয়েকে ধরো।”
উৎস হেসে উশাকে কোলে নিয়ে টুপ করে মেয়ের গালে একখানা চুমু খেল। প্রহরের চাচাতো বোন ইপ্সিতা বলে উঠল,
“ও মাই গড! আপনার মেয়েও আছে! আপনাকে দেখেতো মনে হয় আপনি এখনো বিয়েই করেননি।”
উৎস অসহায় মুখ করে বলল,
“আসলে অল্প বয়সে মায় বিয়া দিয়া দিছে আমারে। তাই এই বয়সেই বাচ্চার বাপ হয়া গেলাম।”

পৃথুলা আর দাঁড়াল না সেখানে। হেসে চলে এলো ওখান থেকে। পূর্ণতাকে কিছু খাওয়াতে হবে। মেয়েটা সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি। সারাক্ষণ দুষ্টুমিতে মেতে থাকে।
.
চলবে____