মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-২৭+২৮

0
978

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

বিয়ের পরপরই বিচারের জন্য পন্ঞ্চায়েতে চলে গেলো মাহতিম। পন্ঞ্চায়েতের মাঠে কঠোর একটা বিচার করা হবে, যে বিচারে কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে। মাহতিম সেখানে পৌঁছে যেতেই গ্রামের সুপরিচিত পন্ঞ্চায়েত মাঠটা দেখতে পেলো, ‘ পন্ঞ্চায়েত ‘ বলা জায়গাটার কাছে প্রচুর মানুষের ঢল দেখা যাচ্ছিলো। গ্রামের প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ সেখানে উৎসুক মুখে তাকিয়ে আছে। আজ এখানে কি ধরনের বিচার করা হবে, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছে। মোল্লা হান্নান অনেকক্ষণ যাবৎ মৌন অবস্থা পালন করছেন। মাহতিম এবং তরুণের অপেক্ষায় চুপ হয়ে আছেন, এদিকে তাঁর ডানে-বামে বসে আছে মুরুব্বি মতোন ব্যক্তিরা। হান্নান শেখ তর্জনী তুলে মাহতিমের দিকে তাক করলেন, সাথে-সাথেই ইশারা করলেন ডানদিকের চেয়ারগুলোতে বসে পরতে। মাহতিম মৃদ্যুভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকটা বুঝিয়ে দিলো, চুপচাপ ভঙ্গিতে ডানপাশের চেয়ারগুলোতে বসে পরলো। বিচারকার্য শুরু হতেই পুরো ঘটনা পন্ঞ্চায়েতের কাছে ব্যক্ত হলো। মাহতিম এক-এক করে সব ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখ করে দিলো, সবাই সেসব পণ্ড-কাহিনী শুনে কানাকানি করতে থাকলো, কেউ কেউ গর্জে উঠলো তরুণকে মেরে ফেলার জন্য। এমন বৈরি অবস্থা সৃষ্টি হতেই ক্ষণিকের মধ্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো গ্রামবাসী, ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো যুবক-পুরুষ-বূজুর্গ ব্যক্তিরা। হান্নান শেখ দ্রুত তাদের ঠাণ্ডা করে নিজ-নিজ জায়গায় শান্ত হতে বললেন, যোগ্যমতো বিচারের জন্য তরুণকে সবার সামনে হাজির করলেন। তরুণের অবস্থা এতোটাই করুণ ছিলো, তাকে গাড়ি থেকে নামানোর জন্য চারটে মানুষ লেগেছে। মাহতিম যা যা বলেছিলো, তরুণ ভয়ের চোটে সব কথা স্বীকার করে নিয়েছে এক লহমায়, এমতাবস্থায় কিছু শক্ত নিয়ম তৈরি করে তরুণকে জেলে দেওয়ার চিন্তা করলেন হান্নান শেখ। আইন নিজের হাতে তুলে গর্হিত কাজ করার চিন্তা স্থগিত রাখলেন তিনি। তরুণ একটু সুস্থ হলে সদর হাসপাতাল থেকে পুলিশের হাতে চলে যাবে, এরপর যা করার সেটা পুলিশই করবে। দরকার পরলে শক্ত রোলারের ডলা দিয়ে আবার পিটানোর ব্যবস্থা করবে পুলিশ। পুরো কার্যাদি সম্পন্ন করতে-করতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে। কিছু সরকারি কাগজপত্রের জন্য বেশ দেরি হতে থাকে। এই উছিলায় গ্রামে একটা নতুন নিয়ম যুক্ত হয়, কোনো পর-পুরুষ যদি মেয়েদের ইজ্জতে হাত দিতে আসে, তাকে খোলা ময়দানে উলঙ্গ করে পাথর দিয়ে ঘায়েল করা হবে। সেই ঘায়েলের চোটে যদি নরপশুটা মারা যায়, সেটার দায়ভার খারিজ করা হবে নিশ্চয়ই।

বৃষ্টি শেষে আকাশটা চমৎকার হয়ে আছে। গাছের পাতাগুলো ধুয়ে-মুছে সজীব দেখা যাচ্ছে। নাকে ভেসে আসছে মাটির কাদাটে গন্ধ, শ্যাওলাজনিত মিশ্র ঘ্রাণ, মধুযুক্ত ফুলের মিষ্টি-মিষ্টি সুভাস। গ্রামের লোকজন ধীরে-ধীরে নিজেদের গৃহের ফিরার পথ ধরলো, সবাই কেমন জৌলুস মুখে হাসিখুশি ভঙ্গিতে চলে যেতে থাকলো। মোল্লা হিসেবে হান্নান শেখ কতোটা ভরসাযোগ্য ব্যক্তি, সেটা সহজ-সরল গ্রামবাসীর চেহারা দেখে বুঝতে পারলো মাহতিম। আকাশটা এখনো কালোরূপে অন্ধকার হয়ে আছে, রাতে যে আবাল মুষলধারে ঝুম বৃষ্টি নামবে সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যাচ্ছে। মাহতিম বুকভর্তি নিশ্বাস টেনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঠটার শেষপ্রান্তে যেই বিশাল বটগাছটা দাঁড়িয়ে থাকে, সেটার নিচে এসে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি দেখছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার ক্ষণস্থায়ী ঝাঁপটায় গাছের পাতাগুলো দুলে উঠছে খুব, সেই পাতা থেকে টপটপ করে পানি পরছে মাহতিমের সাদা শার্টটায়। জীবনের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ দিন আজ, যেই দিনটার কথা সে কোনোদিন ভুলবেনা। বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে প্রচুর চিন্তা করতো মাহতিম, হয়তো স্বপ্নেও সে ভাবতে পারেনি এখানে এসে এভাবে বিয়ে করে ফেলবে। মন ও মস্তিষ্কের উপর এভাবেও অনুভূতির ছোঁয়া লেগে যাবে। মাহতিম আকাশে তাকানো অবস্থায় চোখ বন্ধ করে নিলো, তখনই গায়ের উপর বয়ে গেলো প্রকৃতির ঠান্ডা বাতাস। শীতল হওয়া মনটা তার পরশ পাওয়ার জন্য আক্রান্ত, তেমনি শান্ত মস্তিষ্কটা তার চিন্তায় বিভোর। বয়সটা অল্প হলেও আগলে রাখার সময় এখন, স্বামী হিসেবে অধিকার খাটানোর চাইতে এইমূর্হুতে তাকে যত্ন করা উচিত। তার ছোট্ট মনের দরজাটা ধীরে-ধীরে উন্মুক্ত করে জড়তা কাটানো দরকার। সেই দরজা যখন সঠিক সময়ে খুলে যাবে তখন ভালোবাসার মুঠো নিয়ে বিশেষ আবেদন করতে দেরি করবেনা মাহতিম। সেদিনই হয়তো অধিকার খাটাতে বাধা কাজ করবেনা, মনের কাছে অন্যায়-তুল্য অপরাধ বোধ হবেনা। হান্নান শেখ সবকাজ শেষ করে হঠাৎ আশেপাশে তাকাতে লাগলেন, মাহতিম একটু আগে সাথে ছিলো, হুট করে কোথাও গায়েব হলো? হান্নান শেখ ব্যতিব্যস্ত হয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিতে যাচ্ছিলো, হয়তো মাহতিম চলে গেছে সেটা ভেবে নিজেও গন্তব্যের দিকে ছুটছিলো। কিন্তু পথিমধ্যে চোখদুটো বটগাছটার দিকে আঁটকে গেলো, চিন্তিত মুখটা নিমিষের মধ্যেই হাসিতে উজাড় হলো। তিনি দ্রুতপায়ে হেঁটে গেলেন গাছটার দিকে, সেখানে পৌঁছানো মাত্রই পেছন থেকে মাহতিমের কাধে হাত রেখে দিলেন। শক্ত-পোক্ত কাধে হঠাৎ ভার টের পেয়ে মুখটা ডানে ঘুরালো মাহতিম, কাধটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বৃদ্ধ হাতটা দেখতে পেলো সে। কাধ থেকে চোখ সরাতেই সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ালো হান্নান শেখের দিকে। হান্নান শেখ কাধ থেকে হাত সরিয়ে মাহতিমের মোটা বাহুতে দুটো আলতো চাপড় মারলেন, ঠোঁটে মুখে হাসি ফুটিয়ে প্রফুল্ল গলায় বললেন,

– বাড়ি যাওনি তাহলে?

মাহতিম বৃদ্ধের হাসি দেখে নিজেও খানিকটা হেসে দিলো। মাথাটা ডানেবামে ‘ না ‘ সূচকে দুলিয়ে হাসি মুখে বললো,
– আপনাকে ছেড়ে গেলে আমার মান-ইজ্জত থাকবেনা নানা। আপনার নাতনীগুলো খুবই ফাজিল, আমাকে একদম শূন্য করে দিয়েছে। পকেটে ছিটেফোঁটা টাকা নেই, আমি একদম ফতুর। আপনার নাতনীর জন্য কিভাবে শাড়ি কিনি বলুন? স্বামী হিসেবে কিছুই দিতে পারছিনা, কি লজ্জার কথা!

হান্নান শেখ হোহো করে হেসে দিয়ে সঙ্গে আসতে বললেন। সেখানকার সবচেয়ে বড় মার্কেটের দিকে শাড়ি কিনতে নিয়ে গেলেন। মাহতিম এদিকে শাড়ি পছন্দ করতে ব্যস্ত হলে হান্নান শেখ টুপ করে পান্ঞ্জাবীর দোকানে ঢুকে গেলেন। বাড়িতে সবাই কঠিনরূপে দুজন ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করছে, কখন মাহতিম এসে স্বস্তির খবর শোনাবে সেটা নিয়ে তীব্র চিন্তায় ডুবে আছে। সকালের সেই ঘটনার পর সুরাইয়া রুমের বাইরে আসেনি, শেফালী যদিও নানা ছুতো দেখিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুঁড়েছে, কিন্তু সুজলার চোখ রাঙানি দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত কেটে পরেছে। আজ বাড়িতে কেমন ঝড় উঠবে সেটা হয়তো কেউই জানেনা, সদ্য বিবাহিত দম্পতি নিয়ে মুখর অবস্থা সবার। মেহনূর একা-একা রুমের মধ্যে বসে আছে, জানালার ধারে হেলান দিয়ে প্রকৃতির মায়ায় প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ অনুভব করছে। আজকের ঘটনার জন্য নিজেকে সমানভাবে দায়ী ভাবছে মেহনূর। সে যদি ওদের সাথে রেসোর্টে না যেতো, তাহলে আজ এরকম ঘটনার সম্মুখীন হতো না নিশ্চয়ই। একে-একে সবাই কষ্ট পেয়েছে ওর ঘটনার জন্য। শেফালীর কূটনীতি থেকে শুরু করে সবার আচরণে কষ্ট পেয়েছে দাদাভাই। মানুষটা সবার সামনে শক্ত হয়ে থাকলেও নিজের বিছানায় গেলে দুঃখী হয়ে যায়। প্রচণ্ড ভারাক্রান্ত মনে পরপারে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, একদিন হুট নিরালা-ভুক্ত হয়ে যাবেন। চলে যাবেন সকলের অগোচরে, সকল মায়া-বন্ধন ত্যাগ করে যাত্রা করবেন, কিন্তু স্মৃতি রেখে যাবেন অনেক।

রাতটুকু গভীর হওয়ার জন্য ঘড়িতে আটটা বাজলেই চলে। এর মধ্যে যদি ঝুম বৃষ্টির কবল হয় তাহলে তো কথাই নেই। সৌভিকরা ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে রাতের খাবারটা খেয়ে নিয়েছে, সাময়িক বিশ্রামের জন্য সাবার রুমে এসে আড্ডা বসিয়েছে। সেগুন কাঠের খাটটা জুড়ে গোল হয়ে বসেছে সবাই। জানালাগুলো বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বৃষ্টির প্রবল ঝাপটায় ভূতুড়ে আওয়াজ হচ্ছে। বাড়িতে পিনপতন নিরবতা ছেয়ে থাকলেও সাবার রুম থেকে বেশ শোরগোল শোনা যাচ্ছে। ফারিন বিছানার হেডসাইডে পিঠ ঠেকিয়ে কোলে বালিশ তুলে নিলো, সবাই ওদিকে হাসাহাসি করে আড্ডা দিতে থাকলে ফারিন নীতির কানে নিচুস্বরে বললো,

– ভাই দেরি করছে কেনো? ওদিকে যদি মেহনূর ঘুমিয়ে যায় তখন?

ফারিনের আওয়াজটা নিচুস্বরে হলেও নীতির কান ডেঙিয়ে সেটা সিয়ামের কানেও গেলো। সিয়াম কথাটা শুনতে দেরি ওমনেই নীতিকে কঠিনভাবে থামিয়ে দিলো। নীতি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলে সিয়াম ওকে অগ্রাহ্য করে ফারিনের উদ্দেশ্যে বললো,

– ওই ফারিন! তোরে বলছিনা ছোট মানুষের মতো থাকবি? এট্টুখানি বয়সে পাকনা পাকনা কথা বলোস ক্যান? বড় ভাই কি করবো না-করবো ওইসব নিয়া কোন্ সাহসে টাল্টু-বাল্টু করোস? থাপড়ায়া একেবারে চাপার দাঁত খুইলা ফেলমু।

সিয়ামের কথায় আড্ডা থেমে গেলো সবার। সবাই কৌতুহল দৃষ্টিতে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ফারিন তখন ভেঙচি কেটে বিরক্ত মুখে বলে উঠে,
– তুমি আমাদের কথায় নাক গলাচ্ছো কেনো? তোমার নাকের গলনাঙ্ক কি বেশি? বেশি হলে সেটা কেমিষ্ট্রি ল্যাবে লাগাও, আমাদের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকাচ্ছো কেনো?

সিয়াম ওর কথা শুনে ক্ষুদ্ধ গলায় কিছু বলবে ওমনেই বিপরীত দিক থেকে তৌফ বলে উঠলো,

– ও মামু, তুমি এতো খুচাখুচি করতাছো ক্যান? খাওয়ার চাপ লাগছে? কলাপাতা আনুম?

সিয়াম এবার দারুণ ভাবে রেগে গেলো। কিন্তু তৌফকে পালটা কিছু শুনানোর পূর্বেই সুজলা এসে দরজায় দাঁড়ালো। মাহতিমের আগমন নিয়ে খবর দিতেই সবাই হুড়মুড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, একদম নিচে নেমে আঙিনায় এসে দেখলো, হান্নান শেখ ও মাহতিম দুজনেই কাকভেজা হয়ে এসেছে। দুজনের হাতেই সাদা রঙের দুটো পাস্টিকের ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। মাহতিম ভেজা চুলগুলো আঙ্গুলে ঝারতে-ঝারতে নীতিকে কাছে আসতে বললো, হান্নান শেখ চৌকির উপর ব্যাগ রেখে ক্লান্ত শরীরে বসে পরলেন। সুজলা ও মারজা দুজন এসে হান্নান শেখ ও মাহতিমের কাছে দুটো গামছা দিলো, মাহমুদা রান্নাঘরে খাবার গরম দিতে চলে গেলো। হান্নান শেখ পোশাক পাল্টে খাবার টেবিলে বসে পরলেন। মাহতিমের হাতে নতুন কেনা পান্ঞ্জাবী তুলে দিয়ে ওকে পোশাক বদলাতে বলে দিলেন। মাহতিম শার্ট-প্যান্ট পালটে নিচে খেতে চলে এলো, নীতিকে দিয়ে মেহনূরের রুমে নতুন শাড়িটা পাঠিয়ে দিলো। হান্নান শেখ ও মাহতিম একসাথে রাতের খাবার শুরু করলো, সুজলা ইচ্ছে করে মেহনূরকে রুম থেকে বের করে আনলো। মেহনূর লজ্জায় কারো দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলো না, এর মধ্যে বড়মার জোড়াজুড়িতে সে নিচে আসলো ঠিকই, কিন্তু মাহমুদার পেছনে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহতিম খাওয়ার মাঝপথে চোখটা একটু নিচু রেখে মেহনূরের অবস্থানটা বুঝে নিলো, লাল শাড়ির লাল আঁচলটার অস্তিত্ব দেখে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। প্লেটে লোকমা পাকাতেই হান্নান শেখের উদ্দেশ্যে বললো,

– নানা, আজকে আমি আপনার সাথে ঘুমাবো। আমার রুমটায় তৌফ ঘুমাবে বলেছে। আপনার সাথে শুলে কি কোনো সমস্যা হবে?

মাহতিমের কথা শুনে দোতলা থেকে হা করে তাকালো সবাই। একযোগে সবাই তখন হাপিত্যেশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তৌফ চোয়াল ঝুলানো অবস্থায় চোখ বড় করে ফেললো। দুইমিনিট স্তব্ধ দৃষ্টিতে নিরবতা পালন করে আশ্চর্য কন্ঠে বলে উঠলো,

– ভাই, আমারে একটু বিষ দে তো। আমি একটু বিষ খাই। শালায় এইটা কি বললো ভাই? আমি কবে ওর রুমে ঘুমাইতে চাইলাম? ওর বিছানা কি মধু লেপ্টায়া আছে? আমি থাকতে চাইলাম কবে?

তৌফের কথার সূত্র ধরে সাবির তখন বলে উঠলো,

– ভাই যে ভাবীর রুমে ঘুমাতে চাচ্ছে, এটা তুমি বুঝো না? স্বাভাবিক হও। আর বিষ খেতে চাইলে এখানকার টয়লেট থেকে এক চামচ হলুদ পদার্থ তুলে খাও। এই বিষের মধ্যে সব ভিটামিন তো পাবাই, সাথে গন্ধের ঠেলায় আগেই মরে যাবা।

সাবিরের পক্ষ নিয়ে সিয়াম এবার বলে উঠলো। আশ্চর্যের সীমা অতিক্রম করে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– সাবির ঠিক বলছে মামু। ওমাগো বইলা মরার চেয়ে ওমাগু বইলা মইরা যা। জানোস? জীবনে আমি বহুত পাপ করছি, কিন্তু এই ধরনের মিথ্যা কথা বলিনাই ভাই। নিজেরে আমি কুটনামি অফিসের হেড ভাবি, অথচ এই হারামি আমারেও ছাড়ায়া গেছে। কি ধরনের মিথ্যা গো বাবা!

সৌভিক ও নীতি নিজেদের মধ্যে হতাশা ভঙ্গিতে নিশ্বাস ছাড়লো। দুজনেই একসাথে কপালে হাত রেখে ওদের কথাবার্তারধরন দেখে হাহুতাশ করতে লাগলো।
হান্নান শেখ মাহতিমের কথাটা শুনতে পেয়ে ফাজলামির আচঁটা ধরে ফেললেন। ভাজা মাছ থেকে ক্ষুদ্র অংশ ভেঙ্গে নিতেই বড় কাঁটাটা চোখে পরলো তাঁর, তিনি কাঁটাটা বাঁহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনীতে চেপে তুলে ফেললেন। মেহনূর যে ভীষণ লজ্জায় আরো চুপসে যাচ্ছে, সেটা ওর নড়াচড়া দেখেই বুঝতে পারলেন। ভাতের শেষ লোকমায় মাছ পুড়ে হাসির সুরে তিনি বললেন,

– আমার দাদুর রুমে ঘুমাতে গেলে সে-তো তোমায় তাড়িয়ে দিবে না। এখন বাকিটা তোমার ইচ্ছা। আমার খাওয়া তো হয়ে গেলো, এখন একটু বিশ্রামে যাই।

হান্নান শেখ মিনিটের মধ্যেই হাত ধুয়ে রুমের দিকে চলে গেলেন। খাওয়া পর্ব শেষ হয়ে গেলে মাহতিম নীতিকে ডেকে চুপিচুপি ওকে কাজ দিয়ে দিলো। শানাজ ও সাবার হাতে আরো কিছু নোট গুঁজিয়ে মেহনূরকে সাজানোর জন্য পাঠিয়ে দিলো। মাহতিম নিজের রুমে ফিরে বিছানায় গা ছেড়ে দিলে হঠাৎ ওর পকেট থেকে ফোন বাজতে লাগলো। সাদা পান্ঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করে সেটা রিসিভ করে বললো,

– হ্যালো,

কলের এপাশ থেকে উত্তর পেতেই অপর পাশ থেকে বলে উঠলো,

– আপনি আর ভ্যাকেশান পাবেন না মাহতিম আনসারী। আমরা দুঃখিত, আপনি শীঘ্রই আপনার ফিল্ডে জয়েন করুন। এটা হেড অফিসের নির্দেশ, আপনার মেইলে নোটিশ পত্র পাঠানো হয়েছে।

মাহতিম কথাটা শোনার সাথে-সাথে আশাহত ভঙ্গিতে চোখ কুঁচকে ফেললো। ঠোঁট গোল করে চোখা করতেই শব্দ করে নিশ্বাস ছাড়লো। ওপাশ থেকে ‘ হ্যালো হ্যালো ‘ করতে-করতে কলটা একপর্যায়ে কেটে গেলো, কিন্তু মাহতিম কান থেকে ফোন সরালো না, চোখ খুলেও তাকালো না। ওইভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে চুলে হাত ঢুকিয়ে রাখলো সে।

পুরো মোল্লাবাড়ি নয়টার ভেতর সুনশান হয়ে গেছে। সারাদিনের ধকল শেষে সবাই রুমে ঘুমিয়ে পরেছে। বাইরে এখন তুখোড় বৃষ্টি নেই, কিন্তু ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো এখনো টুপটাপ পানি পরছে। বিছানায় নতুন বউয়ের বেশে বসে আছে মেহনূর। গায়ে সাদা রঙের জামদানী শাড়ি, যার চওড়া পাড়টা টকটকে লাল। মাহতিমের অপেক্ষায় সময় গুজরান করতে-করতে মাথার ঘোমটা সরিয়ে বৃষ্টি দেখছে মেহনূর। ঘন্টাখানেক ধরে ঘুমে ঢুলু চোখে জেগে থাকার চেষ্টায় আছে। মায়ের কড়া নির্দেশ স্বামী না আসা পযর্ন্ত ঘুমাতে নেই। সেজন্য না চাইতেও জেগে থাকতে হচ্ছে। জবুথবু হয়ে বসে থাকতেই কানে দরজা খোলার আওয়াজ আসে, সেই আওয়াজের সাথে ভেসে আসে ইশারাসূচক কাশির শব্দ। মেহনূর ওর আগমন বঝতে পেরে তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে নিলো, লম্বা ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসলে ছিটকিনি লাগানোর আওয়াজ পেলো। আদৌ কি মাহতিম এসেছে? মনের মধ্যে এমন প্রশ্ন উদয় হলে মেহনূর ঘোমটার আড়ালে খুব সাবধানে মাহতিমকে দেখার চেষ্টা করে। ভয়-লজ্জা-জড়তার জন্য মেহনূর শুধু এটুকু বুঝতে পারলো মাহতিম ধবধবে সাদা পান্ঞ্জাবী পরে এসেছে। লম্বাটে মানুষটা খুব আস্তেধীরে বিছানায় উঠে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। মাহতিমের ওমন নিঃশব্দ অগ্রসর বুকের হৃৎপিণ্ড ধুপ করে বেড়ে গেলো ওর, বক্ষস্থল পযর্ন্ত শুষ্ক হয়ে উঠলো মেহনূরের। বারবার ঢোক গিলতে থাকলে ততক্ষণে মাহতিম ওর কাছে এসে বসে, হাতদুটো এগিয়ে ঘোমটার দুইপ্রান্ত ধরে ধীরে-ধীরে উপরের দিকে তুলে ফেলে। মেহনূর চোখাচোখি হওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে মাথা নত করে। সেকেন্ডের ভেতর আবার চোখ খুলে নিজেকে শান্ত রেখে মাহতিমের দিকে কাঁপা-কাঁপা হাতদুটো বাড়িয়ে দেয়। মাহতিম কোনো কিছু বুঝতে না পেরে ওর হাতের দিকে তাকায়, পরক্ষণে ওর নিচু করা মুখটার দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে। মেহনূর মায়ের কাছে যে পারিবারিক নির্দেশ পেয়েছিলো, সেটা ঠিকঠাক মতো পালন করার জন্য মাহতিমের দিকে বাড়িয়ে রাখলো। মাহতিম কিছুটা কৌতুহলী মনে মেহনূরের ছোট হাতদুটোতে নিজের হাতদুটো মিলিয়ে দিলো। মেহনূর বড় একটা ঢোক গিলে জড়তাপূর্ণ অবস্থায় মাহতিমের হাতদুটো ধরলো, সেই হাতদুটো ধীরগতিতে কাছে টেনে নিজের দুচোখের পাতায় ছুঁইয়ে নিলো। মাহতিম অবাক হয়ে মেহনূরের কাজগুলো দেখছিলো, চরম বাকশূন্য হয়ে তাকানো ছাড়া কোনো উপায় ছিলোনা তখন। মেহনূর খুবই কোমলভাবে আঁকড়ে ধরা হাতদুটো চোখ থেকে নামিয়ে ফেলে, সম্মানসূচকে হাতদুটোয় সজ্ঞানে ঠোঁটের উষ্ণচাপে চুমু দেয়। মাহতিম ঘটনার চরম আকস্মিকতায় তৎক্ষণাৎ বুক ফুলিয়ে লম্বা নিশ্বাস টানে, অস্বাভাবিক হয়ে থমকে যায় সে। মেহনূরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মেহনূর ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে নিচু করা মাথাটা মাহতিমের দিকে তুলতে থাকে, স্বচ্ছ দৃষ্টিটা ধীরেসুস্থে উপরে তুলতেই ফ্যালফ্যাল ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাহতিম কিছুক্ষণ স্তব্ধ অবস্থা কাটানোর পর মেহনূরের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
– নিচে যাবে চলো।

মেহনূরের ফ্যালফ্যাল চাহনিটা তৎক্ষণাৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেলো। মাহতিমকে পালটা প্রশ্ন না করে চুপ করে তাকিয়ে রইলো। মাহতিম ওর কোলটার দিকে হাত এগিয়ে ডানহাতটা শক্ত করে ধরলো, বিছানা থেকে নামার জন্য তাগাদা দিয়ে ফেললো। মেহনূর শেষমেশ কৌতুহল আঁটকাতে না পেরে প্রশ্ন করে বললো,
– নিচে যাবেন কেনো?

প্রতিউত্তরে মাহতিম শুধু হাসি ফিরিয়ে দিলো। মেহনূর কোনো উত্তর না পেলেও মাহতিমের আদেশ মেনে ওর হাত ধরে নিচে নেমে এলো। মাহতিমের পিছু-পিছু হেঁটে এসে দেখলো, মাহতিম সদর দরজা খুলে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। মেহনূর আবার ওকে প্রশ্ন করলে এবারও শূন্য উত্তরে ফিরে আসে। মাহতিম ওকে খুব সাবধানে কলপাড়ে নিয়ে গেলো, মেহনূর কোনোভাবেই ভেবে পাচ্ছেনা, এই লোক কলপাড়ে কেনো আনলো? মাহতিম ওর হাতে একমগ পানি তুলে দিয়ে এতোক্ষন পর বললো,
– অযু করো মেহনূর আফরিন। উত্তমরূপে অযু করো।

এমন কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পরলো মেহনূর। ভ্রুঁদুটো মারাত্মক কুঁচকে বিষ্ময় নিয়ে তাকালো, এদিকে পান্ঞ্জাবী দুইহাতা তুলে কাজ শুরু করেছে মাহতিম। সেই দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণ নিরব থেকে অযু করে ফেললো মেহনূর। অযুর পর্ব শেষ করে দুজনেই রুমে ফিরে এলো, মেঝেতে দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে একটায় দাঁড়ালো মাহতিম। আরেকটায় মেহনূরকে দাড় করিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলো। নব-জীবনের সূচনা হিসেবে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে দুই রাকাত সালাত আদায় করলো। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু করার জন্য পবিত্র সত্ত্বার নাম নিলো দুজনই।

মেহনূর এখনো আশ্চর্য হয়ে আছে, আশ্চর্য মুখেই বিছানায় বসে মাথা নিচু করে আছে। মাহতিম রুমের লাইট নিভিয়ে জানালা দুটো খুলে দিয়েছে, অন্ধকার আকাশটা বজ্রপাতের আলোতে দিনের উজ্জ্বলে আলোকিত হয়ে উঠছে। রুমটা অন্ধকার করতেই অজানা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হলো মেহনূর। মাহতিমের আগমনটা আবারও নিঃশব্দে হতেই মাহতিম ওর গালদুটো ধরে ছোট্ট মুখটা উপরে তুলে ফেললো। ড্যাবড্যাবে চাহনির মাঝে আকাঙ্ক্ষীত দৃষ্টি মিলিয়ে শান্ত সুরে বললো মাহতিম,

– তোমাকে আমি সময় দিতে প্রস্তুত মেহনূর। তোমার কাছে শুধুমাত্র একটা আবদার করবো। তুমি কি আমার কথাটা রাখবে?

কন্ঠের আকুল রাখা ব্যকুল সুর শুনেই ঢোক গিললো মেহনূর। কি উত্তর দিবে সেটা নিয়ে চিন্তা করার আগেই মাহতিম ওর দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো, মেহনূর আচঁলটা খামচে ধরতেই মাহতিম বলে উঠলো,

– কোমরের কাটা জায়গাটায় একটামাত্র চুমু খাবো মেহনূর। আমাকে শুধু এইটুকু অধিকার দিয়ে দাও।

– চলবে

#FABIYAH_MOMO

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

মাহতিমের কথায় প্রচণ্ড লজ্জা পেলো মেহনূর। এই লজ্জায় নত হয়ে চোখটা পযর্ন্ত তুলতে পারলো না। মাহতিমের কথায় কি উত্তর দিবে, মেহনূর যেনো বুঝতে পারলো না। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টির পৈশাচিক আওয়াজে গা কেমন ছমছম করে উঠছে। কালো কুচকুচে আকাশটা এমনভাবে ফেটে যাচ্ছে, যেনো দিনের আলোতে পুন্ঞ্জীভূত হচ্ছে বারবার। খোলা জানালার জন্য বাইরের ভয়াবহতা রুমের ভেতরে চলে আসছে এখন। আলোহীন রুমটার ভেতর থেমে-থেমে আসছে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের আলো। মাহতিম কিছুসময় চুপ থেকে সাদা পান্ঞ্জাবীর বোতামে হাত দিলো। মেহনূরের নতমুখটার দিকে দৃষ্টি রেখে প্রথম দুটো বোতাম খুলে ফেললো। মেহনূর আড়চোখে এমন অবস্থা দেখে কচ্ছপের শক্ত খোলসের মতো ভেতর‍ে গুটিয়ে যাচ্ছিলো। মাহতিম স্লিভদুটো ঠিক করার জন্য হাতাদুটো কবজি পর্যন্ত নামালো, এরপর ঠিকঠাক মতো গুটানোর জন্য আবার ভালোভাবে ফোল্ড করতে লাগলো। কনুইয়ের কাছে মোটা করে গুটাতেই মেহনূরের দিকে এগিয়ে গেলো মাহতিম। মেহনূরকে পালটা প্রতিক্রিয়ার সুযোগ না দিয়ে ওর দু’কাধ শক্ত করে ধরলো, মেহনূর তখন কাধের কাছে ভার অনুভব করতেই মাহতিমকে দেখার জন্য মুখ তুলে তাকালো, ঠিক তখনই আকাশের আলো নিভে গিয়ে চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেলো। মেহনূর কিচ্ছু দেখতে পেলো না তখন, অদৃষ্ট অবস্থায় তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ দুম করে ধাক্কা খেলো। নিজের সাথে কি হলো সেটা বুঝে উঠার আগেই মাথার নিচে নরম বালিশের অস্তিত্ব বুঝতে পারলো। কাধের কাছে এখনো সেই শক্ত হাতের ভার লাগছে, মাহতিম নিজের শক্ত হাতদুটো দিয়ে মেহনূরের কাধ খাবলে রেখেছে। মেহনূর বড় করে ঢোক গিলতেই চোখের পাতা খুলে তাকালো। উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতেই মাহতিম ওর মুখের দিকে একটুখানি নুইয়ে এলো, কাছে আসার এমন আকস্মিক মূহুর্ত দেখে বুকের যন্ত্রটা যেভাবে ধপাস-ধপাস করে লাফাচ্ছে, ধুকপুকনি যেভাবে অস্বাভাবিক হারে ছুটে চলছে, তাতে মেহনূরের ঠোঁট থেকে গলার স্বর পযর্ন্ত গুলিয়ে গেছে। খরার মতো শুকিয়ে গেছে গলদেশের অবস্থা। বারবার ঢোক গিলেও শুষ্ক গলা সিক্ত করা যাচ্ছেনা। নাকের কাছে মাহতিমের নেশালো পারফিউমের ঘ্রাণ এসে আচ্ছন্ন করে দিলো ওকে। মনের অগোচরে চোখ বন্ধ করে ফেললে পুরোপুরি বশীভুত করে ফেললো মেহনূরকে। গায়ের উপর বিশাল দেহের মানুষটা বেশ দূরত্ব রেখে মুখের উপর ঝুঁকে আছে, তার বলযুক্ত হাতদুটো বেশ কোমলভাবে কাধে স্থান নিয়েছে, উত্তেজিত নিশ্বাসগুলো মুখের উপর অনুভব হচ্ছে ওর। মেহনূরের ছোট্ট মনটা প্রবল ঝড়ের মতো বিক্ষোভ সৃষ্টি করছিলো। সেই ঝড়টা আকস্মিকভাবে আরো তোলপাড় শুরু করলে সমস্ত ইন্দ্রিয় অশান্ত হয়ে উঠলো। মেহনূরের চিকন নাকটার হাড্ডির উপর থুতনি বসিয়ে দিলো মাহতিম। একেকটা প্রখর নিশ্বাস মেহনূরের চোখের উপর ফেলতে থাকলো সে। মেহনূরের কপালের দিকটায় পুরোপুরি এগিয়ে যেতেই চোখ বন্ধ করলো দুজনই। টানটান কপালের লাবন্যময় চামড়ায় ওষ্ঠযুগলের গাঢ় পরশ অনুভব করলো মেহনূর, ওমনেই জড়তার আবেশে ডুবে গিয়ে তীব্রভাবে মিইয়ে গেলো সে। চোয়াল শক্ত করে চোখদুটো ভেতরের দিকে খিঁচে ফেললো মেহনূর। মাহতিম ওর কাধ থেকে বাঁহাত সরিয়ে ধীরে-ধীরে কানের পেছনটায় চারটা আঙ্গুল রেখে দিলো, অবশিষ্ট বৃদ্ধাঙ্গুলটা গালের দিকে রাখতেই আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মেহনূরের গাল বুলিয়ে যাচ্ছিলো। তীব্র উৎকন্ঠার নিশ্বাসগুলো বেশ জোরেসোরে চোখ বন্ধ অবস্থায় ছাড়ছিলো মাহতিম। কপালে ওষ্ঠ-চুম্বনের কার্যসিদ্ধি সম্পন্ন করে তৎক্ষণাৎ তপ্তস্পর্শ সরিয়ে ফেললো। চোখ মেলে মেহনূরের খিঁচুনি দেওয়া চোখের দিকে শান্তভাবে তাকালো। ওই খিঁচুনি দেওয়া চোখদুটোতে তাকিয়ে থেকে সেখানেও ছাপিয়ে দিলো ওষ্ঠযুগলের ছোঁয়া। মেহনূর দারুণ কুন্ঞ্চিতবোধে ক্লিষ্ট হয়ে দাঁত শক্ত করে ঠোঁট কুঁচকে ফেললো। মেহনূরের জড়সড়-করুণ অবস্থা দেখে মাহতিম না পারতে হেসে দিলো। সেই সৌন্দর্য্যমণ্ডিত হাসিটা ঠোঁটে সর্বোপরি যুক্ত রেখে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,

– তোমার এই লজ্জা কাতর মুখটা লোভনীয় লাগছে মেহনূর। লোভনীয় জিনিসটা বুকটার মধ্যে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু —

কথার প্রসঙ্গ মাঝপথে থেমে গেলে আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। বৃষ্টির তোড়জোড় আওয়াজ এবং বজ্রপাতের ক্ষীণ শব্দ ছাড়া কোনো কথা যেনো আসছে না। মাহতিমের এমন চুপটি দেখে মেহনূর খুব সংশয় নিয়ে চোখ খুলে তাকালো। অন্ধকারে সবকিছু অদৃষ্ট হলেও আচমকা আকাশ ফেটে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের আলো এসে ঢুকলো। সেই আলোতে মাহতিমের মুখটা দেখতে পেয়ে আবার সেটা অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। মাহতিম ওর কানের পেছন থেকে হাত সরিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে দিলো, বামপাশে থাকা মেহনূরের হাতটা ভাঁজে-ভাঁজে ধরতে লাগলো। মেহনূর নিজের হাতের উপর ধীরস্থিরে কার্যাদি টের পেয়ে মাথাটা সেদিকে ঘুরিয়ে একপলক তাকালো। মাহতিম যে খুব কায়দামতো আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে নিচ্ছে সেটা বিদ্যুপৃষ্ঠের আলোতে একঝলক দেখতে পেলো। মেহনূর সেদিকে উদ্বেগপূর্ণ চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে মাহতিম ওর মুখের দিকে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– এইমূর্হতে তোমার কাছ থেকে চুমুর অধিকারটা চাইতাম না মেহনূর। নিশ্চয়ই তুমি আমার কথা শুনে আমাকে চরম অসভ্য ভেবে ফেলেছো। ভাবছো লোকটার চরিত্র আসলেই খুব খারাপ, বিয়ে করতে দেরি, অধিকার খাটাতে দেরি করলো না। মেহনূর, এই সময় আমাকে খারাপ ভাবে নিও না। আমার হাতে সময় কম, তোমাকে তিনটা দিনের বেশি সময় দিতে পারবো না। একটু আগে ফিল্ড থেকে খবর এসেছে। ভেবেছিলাম তোমাকে আরো কিছুদিন সময় দিতে পারবো, কিন্তু আমি ব্যর্থ। ওরা আমার এ্যাপ্লিকেশন ফিরিয়ে দিয়েছে, আমি এখানে কিছুই করতে পারবো না। তোমার মনে এখনো আমার জন্য শক্ত অনুভূতি হয়নি, যেটুকু আছে সেটুকু হালকার-উপর-ঝাপসা হয়ে আছে। কাজেই আমি যদি এখন চলে যাই, তুমি যে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়বে সেটা আমি জানি। খারাপ লাগছে একটা ব্যাপারে, তুমি আমার জন্য পাকাপোক্ত ভাবে কিছুই ফিল করো না। আমি যে চলে যাচ্ছি, এ ব্যাপারে তোমার খারাপও লাগবেনা।

মাহতিমের কথা কিছুই ধরতে পারলো না মেহনূর। শুধু এটুকু সে বুঝতে পারলো, মাহতিম খুব শীঘ্রই নিজের কর্মজীবনে ফিরে যাচ্ছে। মাহতিম কর্মজীবনের কোন্ স্তরে কাজ করছে সে সম্বন্ধে এখনো কিছু জানেনা মেহনূর। আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে হাতটা শক্ত করে ধরলো মাহতিম। মূহুর্ত্তের ভেতর হাতটা কাছে টেনে আনলো সে, মেহনূরের উপর থেকে সরে গিয়ে কোমরের কাছটায় গেলো। মেহনূরের কোমরটার দিকে ডানহাত বাড়িয়ে সেদিনের মতো কিছুটা অংশ উন্মুক্ত করে নিলো। ব্লাউজটা একটু উপরে তুলে শাড়িটাও কিন্ঞ্চিত নিচে নামিয়ে ফেললো, ঠিক সাথে-সাথেই কাটাস্থানটা চোখের সামনে দেখতে পেলো মাহতিম। ওমন সুন্দর চামড়ার উপর লম্বাটে কাটাদাগটা বুঝা যাচ্ছে, মাহতিম একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডানহাতের তর্জনী দিয়ে কাটাদাগটা স্পর্শ করতে থাকে। সেখান থেকে তর্জনী সরিয়ে আলতোভাবে বৃদ্ধাঙ্গুল চেপে ধরে। মেহনূরের দিকে মুখ তুলে ব্যথিত দৃষ্টিতে বলে,
– এখনো ব্যাথা করে?

মেহনূর সরল চাহনিতে তাকিয়ে থেকে মাথাটা ‘ না ‘ ভঙ্গিতে নেড়ে উঠে। মাহতিম তার উত্তরটুকু পেয়ে আবার জায়গাটার দিকে তাকায়, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে দু-একবার ছুঁয়ে মাথাটা নিচের দিকে ঝুঁকায়। মুঠোয় থাকা মেহনূরের হাতটা আলতোভাবে ধরে, চোখদুটো বন্ধ করে কাটাদাগটার উপর নমনীয় ঠোঁটদুটোর চাপ দেয়। কোমরের উপর মৃদ্যু চাপের অনুভূতিতে সংকোচ-উৎকন্ঠায় মেহনূর সংকুচিত হয়ে যায়। মাহতিমের বলপূর্ণ হাতটাকে নিজের সরু-সরু আঙ্গুল দিয়ে লতার মতো আঁকড়ে ধরে মেহনূর, ভেতরের দহনক্রিয়ায় উদ্বেলিত হয়ে পরে তখন। মেহনূরের কোমল চামড়া থেকে স্পর্শ সরিয়ে মেহনূরের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। মেহনূর চোখ খুলে তাকালে ততক্ষণে মাহতিম স্বাভাবিক রূপে বিছানায় শুয়ে পরে। পায়ের নিচ থেকে কাথাটা টেনে বুক পর্যন্ত ঢেকে ফেলে। ব্যস্ত সুরে মেহনূরের দিকে বলে,

– ঘুমাও, আমি আর বিরক্ত করবো না। কাথাটা অর্ধেক ছেড়ে দিচ্ছি, দরকার পরলে টেনে নিও।

মাহতিম কথাটুকু শেষ করে মেহনূরের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমালো। মেহনূর সেই পিঠটার দিকে অপলক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে নিজেও শেষমেশ অন্যপাশ ফিরে শুলো। মাঝখানে সামান্য দূরত্ব রেখে দুজন দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মাহতিম সারাদিনের ধকল শেষে বিছানায় শুতেই ঘুমানোর জন্য দেরি করলো না। শরীরের সব ক্লান্তি শেষে একটু বিশ্রামের জন্য ঘুমে তলিয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ। এদিকে মেহনূর শত চেষ্টা করেও চোখে ঘুম আনতে সক্ষম হলো না। যখনই চোখদুটো ঘুমে ঢুলে আসে, তখনই বজ্রপাতের ঠাস-ঠাস আওয়াজে গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠে। এতোক্ষন বজ্রপাতের শব্দ কম হচ্ছিলো, কিন্তু এখন তীব্রভাবে শব্দ হওয়াতে বিছানা সুদ্ধো কেঁপে-কেঁপে উঠছে। ছোট থেকে বজ্রপাতের ভীতি আছে ওর, কান ফাটিয়ে বিকট শব্দ হলে অপ্রতিভ অবস্থায় পরে যায় মেহনূর। কানে দুহাতের তালু চেপে আছে, শব্দ না শোনার বৃথা চেষ্টা হিসেবে চোখ কুঁচকে আছে। এদিকে বাজের শব্দ যেনো প্রতিযোগিতার মতো হচ্ছে। কার চেয়েকে বেশি শব্দ করবে, সেটা নিয়ে যু’দ্ধ চলছে। ভয়ের চোটে চোখও বুজতে পারছেনা মেহনূর। ভয়ে-ভয়ে চোখদুটো খুললে আকাশ চিড়ে দিনের আলো ফুটে উঠলো। ওমনেই মেহনূর প্রচণ্ড আতঙ্কে ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাহতিমের পিঠের দিকে ধেয়ে আসলো। কাথার ভেতরে গা লুকিয়ে পিঠের সাথে গুটিশুটি মেরে থাকলো। মাহতিম তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুমে মত্ত ছিলো, কিন্তু পিঠের কাছে বিড়াল ছানার মতো নড়াচড়া টের পেলে চট করে চোখ খুলে তাকালো। ভ্রুঁদুটো সামান্য কুঁচকে ঘাপলা বোঝার চেষ্টা করলো। মেহনূর কেনো নড়াচড়া করছে, সেটা প্রথমে স্পষ্ট না হলেও শেষে বজ্রপাতের বিষয়টা ধরতে পারলো। কয়েক মিনিট চুপ থেকে মাহতিম ওই অবস্থায় শান্ত সুরে বললো,

– ওদিকে মুখ ঘুরাও।

আদেশসূচক কথা শুনে মেহনূর দৃষ্টি উপরে তুললো, মাহতিম ওকে দূরে ঠেলতে চাইছে দেখে ওর মনটা ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলো। মেহনূর নির্বাক হয়ে ভাবশূন্য হয়ে গেলে মাহতিম ওকে আবার বলে উঠলো,

– তোমাকে কিছু বলেছি মেহনূর আফরিন। তখন যেভাবে শুয়েছিলে, ওভাবে মুখ ঘুরিয়ে শোও।

মেহনূর হতভম্ব চাহনিতে তাকিয়ে থেকে ধীরে-ধীরে পিছনের দিকে সরে গেলো। একপর্যায়ে অন্যপাশে মুখ ঘুরাতেই আগের মতো চুপচাপ ভঙ্গিতে শুয়ে পরলো। ভয়ের কারণে কুণ্ঠিত মনটা ভাঙ্গা কাঁচের মতো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো ওর। মাহতিম কি ওর কাছে অব্যক্ত কিছু চেয়েছিলো? যেটার জন্য সে রাগ পুষিয়ে অভিমান দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো? মেহনূর ভারী একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে নিলো ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণে চরমভাবে আশ্চর্য হয়ে গেলো সে। মাহতিম ওকে পেছন থেকে স্বল্প দূরত্ব রেখে আগলে ধরেছে, একটা হাত মেহনূরের গলার নিচে সাবধানে রেখে দিচ্ছে। কাথাটা দিয়ে গলা পযর্ন্ত ঢেকে দিয়ে কানের কাছে মুখ এনে বলে,

– ভয় নেই, আমি আছি। বেশি ভয় লাগলে আমার হাতটা ধরতে পারো।

মেহনূর কন্ঠের শিহরণে চমকে উঠলে দ্রুত চক্ষুজোড়া বন্ধ করে ফেললো। তৎক্ষণাৎ একটা বাজের শব্দ হলে জীর্ণশীর্ণ মনে গলার নিচে পেশিবহুল হাতটা দুহাতে খাবলে ধরলো। মাহতিম খানিকটা হেসে দিয়ে বালিশে মাথা রেখে দিলো। মেহনূরের ভয়ার্ত অবস্থা দূর করার জন্য পেশিবহুল হাতটা দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকলো। অন্যহাতটা দিয়ে মেহনূরের খোঁপাটা খুলে চুলগুলো আঙ্গুলে পেঁচাতে লাগলো, আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মাথার চামড়ায় স্পর্শ করতেই আলতো সুরে বললো,

– তখন আমার হাতে চুমু কিভাবে দিলে? একটুও লজ্জা করলো না?

মেহনূর গলা ভিজিয়ে ঢোক গিলে শান্ত ভাবে উত্তর দিলো,
– আম্মা বলেছিলো।

মাহতিম উত্তর শুনে আহাম্মকের মতো তাকালো। চুলের চামড়ায় স্পর্শ করা বাদ দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– তোমার মা তো দেখি সাংঘাতিক মহিলা। সে কি করে জানলো তোমার চুমু পেলে আমি খুশী হবো?

কথার খোলাখুলি অবস্থা দেখে খুক করে কেশে উঠলো মেহনূর। গলাটা একটু খাকারি দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,

– স্বামীকে সম্মানিত ব্যক্তি বুঝাতে এই নিয়ম পালন করতে হয়।

মাহতিমও ওকে জেরা করার জন্য প্রশ্ন করে বললো,

– তুমি কি তাহলে সম্মান করো?

কোনো উত্তর এলো না মেহনূরের কাছ থেকে। মাহতিম ব্যকুলরূপে অপেক্ষা করলো, কিন্তু আর শোনা হলো না উত্তরটা। মেহনূর গভীর নিদ্রায় ডুবে গিয়ে শরীর ছেড়ে দিলো। ধীরগতিতে শরীরের ভারটা মাহতিমের বুকের সাথে মিশে যেতে থাকলো। গলার কাছ থেকে খাবলে ধরা হাতদুটো ঢিলা হয়ে খসে পরলো। মাহতিম ওর ঘুমের উপস্থিতি বুঝতে পেরে নিজের বুকটার সাথে মেহনূরের পিঠটা পুরোপুরি মিলিয়ে দিলো। মাথা থেকে হাত সরিয়ে চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে দিলো, কেশবহুল মাথায় চোখ বন্ধ করে নাক ঘষতে লাগলো কিছুক্ষণ। কেশের মোহে রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছিলো মাহতিম। ছোট-ছোট উষ্ণ-স্পর্শ করছিলো মেহনূরের কেশের মধ্যে। কেশের রাজ্য থেকে মুখ সরিয়ে বালিশ থেকে মাথা উঠালো। মেহনূরের ঘুমন্ত মুখটার দিকে দৃষ্টি রেখে মনে-মনে বললো,

– কাছে আছি বলে গুরুত্ব বুঝতে পারছো না। দূরে চলে গেলে কি করবে?

তীব্র আক্ষেপে নত হয়ে মাহতিম ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছাড়ে। গলার কাছ থেকে হাত সরিয়ে এলোমেলো চুলগুলো গলা থেকে সরাতে থাকে। ওমনেই কালো বিন্দু-তুল্য তিলটার দিকে চোখ আটকে যায় ওর। মেহনূরের ঘুমন্ত মুখটা আরেকবার দেখে নিতেই আনমনে হেসে ফেললো। মাহতিম গলার দিকে ঝুঁকে গেলে মেহনূর সাথে-সাথে ঘুমের ঘোরে চাপা আর্তে ‘ আম্মা ‘ বলে উঠলো। দেহের ক্লান্তি আর ঘুমের জোর এতোটাই বেশি ছিলো মেহনূর আবার বেঘোরে ঘুমের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে গেলো। কিছুই টের পেলো না তখন।

.

ভোরের আকাশটা নির্মল এখন। পাখির কিচিরমিচির ডাকে চারপাশ মুখরিত। গতরাতের বৃষ্টিতে সব ধূলো-ময়লা ধুয়ে গেছে। গাছের পাতাগুলো সবুজ রঙে সজীব হয়ে উঠেছে। প্রাণবন্ত হয়ে গেছে আশেপাশের পরিবেশ। গ্রামের মানুষগুলো ঘুম শেষে জাগ্রত হচ্ছে এখন। কর্মকাণ্ডে যোগদানের জন্য কলপাড়ে প্রাতঃকাজ সম্পণ্ণ করছে তারা। গৃহিনী মহিলারা ঝাড়ু হাতে কোমর নুইয়ে উঠোন সাফ করছে, পুরুষরা তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে দাঁত পরিস্কারের কাজ সারছে। পরিশ্রান্ত প্রকৃতি সকালের প্রথম রোদে ঝলমলিয়ে উঠেছে। হান্নান মোল্লা গতরাতে ঘুমাতে পারেননি, মেজো বউয়ের কাজকর্ম দেখে একমূর্হতের জন্য স্বস্তি পাননি। সুজলা সবসময়ের মতো আগে উঠে ঘর-দুয়ার দেখতে থাকলো। মাহমুদা সকালের নাস্তা তৈরিতে আটা নিয়ে বসে পরলো। বাকিরা খুবই আরাম-আয়েশে ঘুমে ডুবে থাকলো, বিশেষ করে শেফালী আরো দেরি করে ঘুম থেকে উঠলো। মেহনূর ঘুমে ঢুলু চোখদুটো শান্তভাবে খুললো, বড় একটা হাই তুলে হাতের তালুতে হাই ঢেকে নিলো। চোখদুটো কচলে হঠাৎ মাহতিমের কথা মনে পরলো। সাথে-সাথে ধপ করে বিছানা থেকে উঠে আশেপাশে তাকাতে লাগলো, কিন্তু মাহতিম রুমের কোথাও নেই। মেহনূর এলোমেলো চুলগুলো খোপা পাকাতেই গা থেকে কাথা সরিয়ে নিলো। বিছানা থেকে নেমেই টেবিলের দিকে বন্ধ জানালাটা খুলে দিলো। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো সে। আকাশের উদাসী ভাব আজ আর নেই, মেঘাচ্ছন্ন রূপ এখন সাদা-সাদৃশ্যে ছেয়ে আছে। দূরের তেপান্তরে সোনালী রোদের ঝিকিমিকি চলছে। মেহনূর সেখান থেকে সরে এসে গোসল করে আসে। গায়ে সাদা শাড়ির সাথে গোলাপী রঙের ব্লাউজ পরে। ভেজা চুলগুলো গামছায় পেঁচিয়ে সোজা রুমে এসে ঢুকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছতে থাকে। মেহনূর একমনে চুল মুছতে থাকলে পেছন থেকে শেফালী নিঃশব্দে রুমে ঢুকে পরে। কোনোযূপ অনুমতি ছাড়া রুমে ঢুকাটা ওর নিত্যদিনের বাজে স্ব’ভাব। মেহনূরকে ভয়াবহ ভাবে চমকে দিয়ে শেফালী চড়া গলায় তাচ্ছিল্যের হাসিতে বললো,

– তোর কপালে বিয়া জুটলো তাহিলে?

মেহনূর থতমত দৃষ্টিতে আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে শেফালীর দিকে তাকালো।শেফালীর দিকে চোখ উঠানোর সাহস করেও চোখ উঠাতে পারলো না মেহনূর। চুল থেকে গামছা সরিয়ে দ্রুত হাতটা নিচে নামিয়ে ফেললো। শেফালী এক কদম এগিয়ে এসে নতুন শাড়িটার ফেব্রিক দেখতে লাগলো। তিন আঙ্গুলে চেক দিয়ে হাসতে-হাসতে বললো,

– কম দামী কাফুর।

এরপর যা হলো সেটার জন্য ঢপ খেলো দুজনই। শেফালী খুব চালাকি করে মেহনূরের হাতটা মুচড়ে ধরার চিন্তায় ছিলো, যেটা সে সুযোগ মতো সবসময় করতে আসে। কিন্তু সে চিন্তায় পানি ঢেলে মাহতিম ব্যস্তভঙ্গিতে রুমে ঢুকে। শেফালীর চালাকি এক লহমায় বুঝতে না পারলেও ভালো কিছু যে করতে আসেনি, সেটা ভালোভাবে বুঝেছে। শেফালীও মাহতিমের হূটহাট আগমন দেখে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহতিম রুমে হাসিমুখে ঢুকেছিলো, কিন্তু শেফালীর উপস্থিতি দেখে মেজাজটা চরমভাবে বিগড়ে গেলো। শেফালীকে ইচ্ছামতো অপমান করে তাড়াতে পারলে শান্তি লাগতো। মাহতিম নিজেকে ধাতস্থ করে সহজাত কন্ঠে বললো,

– আপনার আগমন যে ভালো লাগলো না মামী। আপনি এখানে কি করতে এসেছেন? এখানে কি প্রয়োজন? সেটা বললে একটু হেল্প করতে পারতাম।

শেফালী এমন কথার প্যাঁচ দেখে কি উত্তর দিবে খুঁজে পাচ্ছিলো না। অহেতুক কারণে শুধু হিহি করে হেসে দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে কেটে পরলো। শেফালী চলে গেলে মেহনূর নিজের কাজে পুনরায় মনোযোগ দিলো। আয়নায় চুল মুছতেই আড়চোখে মাহতিমকে দেখতে পেলো। একদম হালকা নীল রঙের পাণ্ঞ্জাবী পরেছে মাহতিম, যার গলার কলারটা গাঢ় নীল। মেহনূরের কিছুটা পেছনে দাড়িয়ে সেও আয়নায় তাকিয়ে চুলের ব্যাকব্রাশ করছে। মেহনূর আড়চোখে তাকানো বন্ধ করে গামছায় কানটা মুছে নিচ্ছে, কিন্তু গলার দিকে নজর পরতেই তৎক্ষণাৎ ভ্রুঁদুটো কুঁচকে গেলো। গলার কাছে কালো তিলটার উপর লাল হয়ে আছে। গোল করে রক্ত জমে জায়গাটা কেমন হয়ে গিয়েছে। মেহনূর কপাল কুঁচকে জায়গাটার উপর আঙ্গুলে বুলাচ্ছিলো। কৌতুহল মনে বারবার জায়গাটার উপর জোরে চাপ দিচ্ছিলো, কিন্তু আয়নার দিকে নজর যেতেই প্রচণ্ড আশ্চর্য হয়ে গেলো। মাহতিম আয়নায় তাকিয়ে দাম্ভিকতার সাথে পাণ্ঞ্জাবীর বোতামগুলো লাগাচ্ছিলো, কিন্তু মেহনূরের চাহনি দেখে সাথে-সাথে বাঁকা ঠোঁটে হেসে দিলো মাহতিম। মাহতিমের কপটাচারী হাসি দেখে কপালের ভাঁজগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেলো মেহনূরের। আকাশচুম্বী বিষ্ময় নিয়ে হা হয়ে গেলো সে।

– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO