মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-২৯+৩০

0
929

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

মাহতিমের বাঁকা হাসিটা দেখে বিমূঢ় হয়ে গেলো মেহনূর। মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করছে এখন। মাহতিমের কাণ্ডকারখানা দেখে প্রচণ্ড লজ্জায় গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। রাতে কখন এই কাজটা করলো বুঝতে পারছেনা সে। মেহনূরের হড়কে যাওয়া মুখটা দেখে খুব মজা পাচ্ছে মাহতিম। মেহনূরকে আরো জ্বালাতন করার জন্য ওর দিকে পা চালিয়ে দিলো, পাণ্ঞ্জাবীর স্লিভগুলো ঠিক করতে-করতে মেহনূরের পিছনে এসে দাঁড়ালো। মেহনূর তাড়াতাড়ি দু’কদম সরবে ভেবেছিলো কিন্তু মাহতিম সেই ভাবনার মধ্যে পানি ঢেলে সবকিছু নস্যাৎ করে দিলো। মেহনূরের পেছনে দাঁড়িয়ে ওর ভেজা চুলগুলোতে হাত বাড়িয়ে দিলো, মাথার তালুতে হাত রেখে সেই হাতটা ধীরে-ধীরে নিচে নামাতে লাগলো। একপর্যায়ে ঘাড়ের কাছ থেকে চুল সরিয়ে বাঁ-কাধের দিকে এক ধীরগতিতে ঠেলে দিলো। মেহনূর তখন আয়নার দিকে শান্তভাবে তাকিয়েছিলো, মাহতিমের প্রতিটি কার্যকলাপ শক্ত হয়ে আয়নার ভেতর দেখতে পাচ্ছিলো। চুলের টুপটাপ পানিতে গোলাপী ব্লাউজটা ভিজে গেছে ওর, ভিজে যাওয়ার কারণে মেহনূরের পাতলা পিঠটার সাথে লেপ্টে আছে এখন। মাহতিম ব্লাউজের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আয়নার দিকে মেহনূরের পানে তাকালো। মাহতিমের ওমন গাঢ়দৃষ্টির চাহনি দেখে মেহনূর তৎক্ষণাৎ চারপাশের সবকিছু গুলিয়ে ফেললো। কোনো বিশেষ মন্ত্র জালে আবদ্ধ হয়ে শুধু মাহতিমের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। মাহতিম সর্বদার মতো নিঃশব্দে নিজের কার্যকৌশল চালাতে থাকলো, মেহনূরের ডান কাধটার দিকে মুখ এগিয়ে ওর কাধের উপর থুতনি রেখে দিলো। ওই থুতনি রাখার সাথে-সাথেই রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সিক্ত হলো মেহনূর, বড়ো-বড়ো আঁখিদুটোর পাতা চট করে বন্ধ করে ফেললো তখন। মাহতিমের সম্মোহন করা অতুল স্পর্শে বশবর্তী হয়ে চুপটি মেরে রইলো মেহনূর। চোখের সামনে ছোট্ট মানুষটার গুটিশুটি অবস্থা দেখে মনে-মনে প্রচুর হাসি পাচ্ছে মাহতিমের, কিন্তু সেই হাসিটা পুরোদমে চেপে রেখে মেহনূরের উদ্দেশ্যে শান্ত কন্ঠে বললো,

– সেদিনের কথা মনে আছে? যেদিন তোমার রুমে ভুল করে এসেছিলাম? আমাকে দেখে তুমি কেমন করে ভয় পেয়েছিলে, কেমন করে চমকে গিয়েছিলে মনে পড়ে? ভুলবশত তোমার রুমে এসেছিলাম বলে সেদিন রাতে জ্বর বাধিয়ে ফেললে। আজ একই রুমে তোমার সাথে দাঁড়িয়ে আছি মেহনূর, সেই পরিচিত আয়নায় তাকিয়ে তোমার ছোট্ট মুখটা দেখছি। এই আয়নাটা তোমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের সাক্ষী বহন করে। সেদিন আমি ছিলাম তোমার জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি, তুমি ছিলে আমার জীবনের অপ্রত্যাশিত তিথি। আমার নজরে তুমি যেমন হুটহাট আগমন করেছো, স্বল্পদিনের মধ্যে তোমার অদৃশ্য গুণ দিয়ে আমাকে লতার মতো বেধেঁ ফেলেছো; তোমার ওই ছোট্ট বুকটার মধ্যেও আমার জন্য প্রচুর ভালোবাসা ইতিমধ্যে স্থান নিয়ে ফেলেছে, ঘণীভূত হয়ে প্রকাশ করার জন্য সময় নিচ্ছে। মেহনূর, আমার কাছে তুমি যেই শান্তিটুকু অনুভব করো, সেটা বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমি বুঝে গিয়েছি। কালরাতে যখন বজ্রপাত হলো, তুমি চাইলে আমার হাতটা সরিয়ে দিতে পারতে। আমি তোমাকে আগলে রেখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সুপ্ত অধিকারবোধে জড়িয়েও রেখেছিলাম। কিন্তু, তুমি সেটা মোটেও করোনি, তুমি আমার বুকটার সাথে পিঠ লাগিয়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পরেছো। আর হাস্যকর ব্যাপার কি জানো? তুমিযে নিজের অজান্তেই তোমার ভরসার হাতটা আমার কাছে তুলে দিয়েছো, সেটা একবারও তুমি টের পাওনি।

মেহনূর প্রতিটা বাক্য শোনার পরও শান্ত হয়ে রইলো। চোখের পাতা আগের মতোই বন্ধ করে থাকলো। শুধু অস্বাভাবিক ভাবে একটা ব্যাপার পরিলক্ষিত হলো, মেহনূর তখন অনবরত ঢোক গিলে গলা ভিজাচ্ছিলো। মাহতিম কিছুসময় নিরব থাকার পর আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, মেহনূরের কাধ থেকে থুতনি সরিয়ে গলার দিকে একপলকের জন্য তাকালো। জায়গাটা গোলাকার বৃত্তের মতো লাল হয়ে আছে, ক্ষুদ্র কালো তিলটা কেন্দ্রবিন্দুর বৃত্তের মাঝখানে ঠাঁই নিয়েছে। কালরাতে ওই তিলটাই কিভাবে যেনো আবেশে ডুবিয়ে দিয়েছিলো, ওইটুকু সৌন্দর্যের কাছে মুগ্ধ হয়ে একটু বেপরোয়া আচরণ করেছিলো মাহতিম। নিজের অবস্থার উপর বিভ্রান্ত হয়ে ঘুমন্ত মেহনূরের গলায় ঠোঁট বসিয়ে দাঁত চাপিয়েছিলো। মাহতিম সেই দাগটার উপর নিবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে রাতে অবস্থাটা চিন্তা করতে থাকলো। কিন্তু সেই চিন্তার প্রহর এমন হয়ে উঠলো হঠাৎ মেহনূর অপ্রতিভ আচরণের মতো কেঁপে উঠলো। পরপর তিনবার একইজায়গায় স্পর্শ পেয়ে দারুণ উৎকন্ঠায় জর্জরিত হয়ে কুণ্ঠিত হলো মেহনূর। মেহনূরের সংকোচ ভরা অবস্থা দেখে মাহতিম গলা থেকে মুখ সরিয়ে ফেললো, চটপট করে ওর কাছ থেকে দু’পা পিছিয়ে ফ্লোর থেকে গামছা তুলে নিলো। মেহনূর ততক্ষণে স্বাভাবিক স্থিতিতে ফিরে আসলে দ্রুত রুমের অন্যদিকে চলে যায়। মাহতিমের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য আলমারির দ্বার খুলে এমনে-এমনেই হাতাপিতা করতে থাকে। মাহতিম আধভেজা গামছাটা ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে স্ফীত একটা হাসি দিয়ে চলে যায়। রুমের ভেতর থেকে চলে যাওয়ার শব্দ শুনে বুকভর্তি নিঃশ্বাস ছাড়ে মেহনূর। লোকটা যে কথায়-কাজে-কর্মকাণ্ডে দারুণ লজ্জায় ফেলতে পারে, সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই এখন।

.

মাহতিমের আদেশমতে আজ এগারোটার দিকে রওনা দিবে সবাই। এখান থেকে বিদায়ের পাট চুকিয়ে মেহনূরকে সঙ্গে নিয়ে শহরগামী হবে। সকাল থেকেই সেটার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। নীতি থেকে শুরু করে মাহদি পযর্ন্ত লাগেজ গুছিয়ে ফেলেছে। একে-একে সব মালপত্র জিপ-মাইক্রোতে তুলে নিয়েছে সবাই। হান্নান শেখ অনেক অনুনয় করলেন থাকার জন্য, কিন্তু মাহতিমের কাছ থেকে আসল ঘটনা শোনার পর তিনি আর বাধা দিলেন না। মেহনূরের বিদায় বার্তা শুনে খুশীতে গদগদ হয়ে গেছে শেফালী। বাড়ি থেকে আপদ বিদায় করতে পেরে নিজেকে রাণীর মতো চিন্তা করছেন। এখন থেকে সুরাইয়াকে অধিক আদরের সিংহাসনে বসিয়ে দিবেন। সকলের কাছেই বানিয়ে দিবেন মেহনূরের চেয়েও মধ্যমণি। শেফালীর এই দূধর্ষ চিন্তার পেছনে কতখানি উগ্রস্বভাব ছিলো সেটা কেউ জানতো না। এমতাবস্থায় মেহনূরকে যখন মারজার মেয়েতুল্য এবং মাহতিমের স্ত্রীরূপে আজীবনের জন্য বিদায় জানাচ্ছিলেন, তখন শেফালী শেষবারের মতো মাহতিমকে আড়ালে ডেকে আনলো। মাহতিমও বিদায়কালে দ্বিমত ভাব না রেখে শেফালীর সাথে একটু দূরে এলো। হান্নান শেখ নিজ দায়িত্বে সবার গাড়িতে উঠার তদারকি দেখছেন, সবাই ঠিকঠাক মতো উঠেছে কিনা, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা সেদিকে তীব্র মনোযোগ নিক্ষেপ করেছেন। এদিকে শেফালীর উগ্র ইন্ধনটা বুঝতে পারলেও মাহতিম কিছু বললো না। শেফালী শুধু একটাই কথা জোর খাটিয়ে বললো,

– তুমারে আমি একটা কথাই বলবার চাই। তুমি সুরাইয়ারে যেইভাব করিয়া কষ্ট দিছো, সেই কথা কিন্তু শ্বশুর মশাইরে জানাই নাই। আজকা যদি রের্সোটের ওই ঘটনা আব্বার কানে লাগায়া দিতাম, তোমার বিয়া কিন্তু জীব্বনেও মেহনূরের সাথে হইতো না। তুমি ঠিকই সুরাইয়ারে বিয়া করবার লিগা বাধ্য থাকতা।

শেফালীর আউল-ফাউল কথা শুনে মাহতিম ভ্রুঁ উঁচিয়ে তাকালো। এই মহিলা যে এতো বেশি পরিমাণে ফালতু সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। কিন্তু আজকের এই কথা শুনে সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো মাহতিম। শেফালীর মতো মহিলাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করা উচিত। এই মহিলার অতীত জানার পরও হান্নান মোল্লা কিভাবে মোল্লাবাড়িতে জায়গা দিয়েছেন, সেটা মাহতিম কিছুতেই বুঝতে পারছে না। শেফালীর এমন কথা শোনার পর ডানে তাকালো মাহতিম, সবাই কি সুন্দর হাসিখুশি-উল্লাসে মেহনূরকে বিদায় জানাচ্ছে সেই দৃশ্যটা একপলক দেখলো। এরপর সেখান থেকে চোখ ঘুরিয়ে শেফালীর দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকালো, অল্প উচ্চতার মহিলা দেখে মাথা একটু নিচে নামিয়ে নিলো।প্যান্টের ডান পকেট থেকে হাত বের করে তর্জনীটা একদম চোখ বরাবর তুলে শক্ত কন্ঠে বললো মাহতিম,

– আপনি আমাকে চিনেন না, আমার ক্ষমতা সম্পর্কেও জানেন না। আমি যে এক তুড়িতে আপনার তাসের ঘর ভেঙ্গে দিতে পারি, সেটা হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না। আপনার মতো বেহায়াজাত মহিলার জন্য প্রত্যেকটা পরিবারে ঝগড়া লেগে থাকে, ভাইয়ে-ভাইয়ে যু’দ্ধ লাগে, কেউ কারোর মুখটা পযর্ন্ত দেখতে পারেনা। আপনি যে শেখ বংশের বড় ছেলের সাথে কোন্ কাহিনী করেছেন আমি কিন্তু জানি। নিজের ছেলেকে কিভাবে বিদেশে পাঠিয়েছেন সেটারও ক্লিয়ার ডিটেলস আমার ওয়ালেটের লেফটে সাইডে ঘুমাচ্ছে। একটা জিনিস শিওর করে দিচ্ছি শেফালী মামী, যেই মাহতিমকে আপনি ভালো ভেবেছিলেন, সেই মাহতিম কিন্তু ডেন্ঞ্জারাস মানুষ। ক্ষমতা আমার পকেটে থাকে, যদি পকেট থেকে টেনে আনার ব্যবস্থা করেন, তাহলে শুনে রাখেন, আপনার পুরো চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে আমার টাইম লাগবেনা।

মাহতিম গরম গলায় কথা শুনিয়ে তর্জনী নামিয়ে নিলো। শেফালীর কাছ থেকে মাথা উঠালো ঠিকই, দৃষ্টি সরালো না সে। শেফালীর অবস্থা তখন ভয়ে-আতঙ্কে শোচনীয় হয়ে গেছে। মাহতিমের পেশা সম্বন্ধে না জেনেছে সেটা কোনোভাবেই রাজনীতির সাথে যুক্ত না। কিন্তু পেশাটার নাম এতোই কঠিন, ওর উর্বরমস্তিষ্ক মনে রাখতে পারেনা। শেফালী বড় একটা ঢোক গিলে নিজের সংযত রেখে জোরপূর্বক হাসি দিলো, কিন্তু সেই হাসিতে মাহতিমের মুখের অবস্থা পরিবর্তন হলো না। শেফালী চোখ ছোট করে স্বহাস্যে হেসে দিয়ে মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললো,

– তুমি জানি কিসে কাম করো?

মাহতিমের মেজাজ আগুনের মতো দগদগ করছিলো। এই দুমুখো মহিলাকে লাত্থি মেরে ঝাঁটা দিয়ে বিদায় করা উচিত। এমন মহিলা সমাজের জন্য অভিশাপ, পরিবারের জন্য কলঙ্ক। কিভাবে সেকেন্ডের ভেতর প্রসঙ্গ উলটে স্বাভাবিক আচরণ করছে! মাহতিম মুখটা কঠোর করেই গরজ গলায় বললো,

– আপনার মতো মূর্খ-ধূর্ত মহিলা আমার পেশাটা মনে রাখতে পারবেনা। আপনার মতো মহিলা শুধু সংসারে আগুন লাগিয়ে নিষ্পাপ সাজতে পারবে, দরকার পরলে নিজের দোষটা সুন্দর করে আরেকজনের ঘাড়ে চাপাতে পারবে। আর আপনাকে একটা জিনিসের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই, মেহনূরের ঘটনা নিয়ে বাড়িতে যদি পিন না লাগাতেন তাহলে হয়তো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করাটা পসিব্যাল ছিলো না। তাছাড়া সুরাইয়ার শাস্তি ওর নিয়তির উপর ছেড়ে দিলাম, কিন্তু আপনার শাস্তিটা ঠিকই নিশ্চিত করবো। অপেক্ষা করুন।

মাহতিমের শেষ কথাটা শুনে শেফালীর মুখ থেকে হাসি চলে গেলো। এমনভাবে হাসিহীন হলো, যেনো খারাপ কিছুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। মাহতিম আর সময় নষ্ট না করে জিপে চড়ে বসে। শেফালীকে কোন্ বিপদের ইঙ্গিত দিয়ে গেলো এখনো ধরতে পারছেনা শেফালী। কিন্তু মাহতিমের কথাগুলো শোনার পর এখন বিদেশ পড়ুয়া ছেলে সজলের জন্য চিন্তা হচ্ছে। মাহতিম জিপে উঠে বসতেই মেজাজটা আরো চটে গেলো! মারজা কোনোভাবেই মেহনূরকে জিপে যেতে দিবেনা। একটানা দীর্ঘ জার্নি, তার উপর কড়া রোদের মধ্যে মেহনূরের অবস্থা খারাপ হতে পারে। এসব চিন্তা করে মারজা মেহনূরকে জিপে পাঠাতে নারাজ। এদিকে জিপের স্টিয়ারিং দুহাতে আঁকড়ে রাগে গজগজ করছে মাহতিম। মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে মাইক্রোর দিকে ক্ষুদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মারজাও মাইক্রোর জানালা দিয়ে চোখ রাঙিয়ে পালটা দৃষ্টি ছুড়ে তাকিয়ে দেখছে। মা-ছেলের এমন অর্ন্তদৃষ্টি দেখে সবাই নির্বাক হয়ে গেছে, হান্নান মোল্লা এমন উটকো পরিস্থিতি দেখে তাড়াতাড়ি দু’দলকে শান্ত করার জন্য মাহতিমের কাছে যায়। মাহতিমের কাধে হাত রেখে নরম সুরে বললেন,

– মারজা মা ঠিক করেছে মাহতিম। তুমি একটু দাদুর কথা চিন্তা করে দেখো। তোমাদের যেতে যদি চারঘন্টা লাগতো তাহলে আমি বাধা দিতাম না। কিন্তু এখানে অনেক সময় লাগবে, ও এতোসময় জিপের মধ্যে ঠিকমতো চোখ বুজতে পারবেনা। বারোটার দিকে কি রোদ উঠে জানো তো? গাড়িতে করে গেলে মারজা ওকে দেখে রাখতে পারবে। তুমি ঠান্ডা হও।

হান্নান শেখের যুক্তি শুনে মাহতিম কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করলো না। চুপচাপ সেটা মেনে নিয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে সায় বুঝিয়ে দিলো। মাহতিমের অবস্থা দেখে ড্রাইভিং সিটে বসা সিয়ামের হাসি পেলো। পাশে বসা তৌফের কানের কাছে হাসি চেপে ফিসফিস করে বললো,

– বদ্দা চেতি গেছে।

সিয়ামের মুখ থেকে চাটগাইয়া ভাষা শুনে হাসি আটকাতে হিমশিম খাচ্ছে তৌফ। উপরের দাঁত দিয়ে খুব কষ্টে নিচের ঠোঁট কামড়ে রেখেছে, হাসির দোটানায় ফেঁসে গিয়ে দুগাল ফুলিয়ে থেমে-থেমে ফিসফিস শব্দ হচ্ছে। সেই ফিসফিস আওয়াজ শুনে ঠিক পেছনের সিটে থাকা মাহদি ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো। মোবাইল গেমটা পজ করে মাথা পিছু ঘুরিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো, এরপর সামনে ঘুরাতেই তৎক্ষণাৎ তৌফের উদ্দেশ্যে বিরক্ত কন্ঠে বললো,

– তৌফ ভাইয়া তুমি ফিস ফিস করে দূর্গন্ধ ছড়াবেনা!

মাহদির কথায় অকপটে হাসি থেমে গেলো তৌফের। মাহদি দূর্গন্ধ দিয়ে কি বুঝালো কেউ সেটা বুঝতে পারেনি। সবার দৃষ্টি এখন মাহদির দিকে কেন্দ্রীভূত থাকলে মাহদি গলা খাকাড়ি দিয়ে ভাবসাব ভঙ্গিতে বললো,

– আমার দিকে তাকাচ্ছো কেন?

মাহদির প্রশ্ন শুনে ফারিন ওর মাথায় চাট্টি মেরে বললো,

– তোর কথার মানে কি বলদা? কি বুঝাতে চাচ্ছিস?

ফারিনের কথা শুনে মাহদি মনে-মনে আরো বিরক্ত হলো। ওদের মতো গণ্ডমূর্খের দল আর দুটো দেখেনি। মুখটা বিরক্তিতে ডুবিয়ে রেখে এটিটিউট নিয়ে বললো,

– তোমরা আসলেই একেকটা গাধা! ‘ বাদ ‘ শব্দের মধ্যে ‘ ব ‘ কেটে ‘ প ‘ বসাও। যা বুঝতে পারবে, সেটাই তৌফ ভাইয়া ফুলস্পিডে ফিস ফিস করে দিচ্ছে।

ফারিন ওর উত্তর শুনে চিন্তা করবে তার আগেই সিয়াম তৌফের দিকে ঝুঁকে এসে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো, নিচু কন্ঠে বলে উঠলো,

– শালার ব্যাটা পাদ দিতাছোস? এক্কেরে চামড়া তুলমু এই কাজ করলে!

সিয়ামের রাগত চেহারা দেখে তৌফ নিজে রাগবে, না গালিগালাজ করবে, বুঝে উঠতে পারছেনা। মাহদি যে এমনভাবে ফাসিয়ে দিবে সেটা চিন্তার বাইরে ছিলো। ওর ঘাড়টা ধরে ধরে মটকাতে পারলে ঠিক হতো, কিন্তু এখন মেহনূরের সামনে জোর গলায় কিচ্ছু বলতে পারছেনা। শানাজের সাথে চুপিচুপি দুটো কথা সারার জন্য ইচ্ছে করে পেছনের সিটে বসেছে সৌভিক। সবাই যখন মেহনূরের সাথে কথা সেরে নিচ্ছিলো, শানাজ তখন সৌভিকের জানালার কাছে হাত রেখে দিলো। দৃষ্টি সামনে রেখে এমন ভান ধরলো যেনো হাতটা আনমনে রেখে দিয়েছে। সৌভিকও অন্যমনষ্কের ভঙ্গি ধরে শানাজের হাতটার উপর নিজের হাত রেখে দিলো। গাড়ির পেছনের সিটে একা বসা সৌভিক চট করে শানাজের হাতটা পাঁচ আঙ্গুলে খামচে ধরলো। যতটা তীব্রভাবে ধরলে হাতটা লাল টকটকে হয়ে যায়, সৌভিক ঠিক তেমনভাবেই ধরে থাকলো। সৌভিক সামনে দিকে তাকিয়ে থাকলেও শানাজ এখন জানালা দিয়ে সৌভিকের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌভিকের গাল ধরে মুখটা নিজের দিকে ফেরাতে ইচ্ছে করছে, সৌভিক যে ইচ্ছে করে শানাজের দিকে তাকাচ্ছেনা বুঝে গেছে সে। শানাজ সজল চোখে তাকিয়ে থাকতেই শাড়ির আচঁলটা চোখ মুছার জন্য গালে তুললো, ওমনেই আচঁল দিয়ে মুখের একপাশ ঢেকে স্বর নামিয়ে বললো,

– একটাবার তাকাও সৌভিক। সামনে তাকিয়ে থেকো না। তুমিতো আমাকে ভুলে যাবে। সেখানকার আবহাওয়ায় গেলে আর আমাকে মনে করবেনা। আমার মতো অঁজপাড়া গাঁয়ের মেয়েকে নিশ্চয়ই ভুলে যাবে।

কথাগুলো বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে বাজলো! মাথার মধ্যে এমনভাবে রি রি করতে লাগলো সৌভিক তৎক্ষণাৎ শানাজের দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। শানাজের লাল-লাল অশ্রুসিক্ত চোখদুটো দেখে ঢোক গিলতেও পীড়া হচ্ছে। শানাজের হাতটা ছেড়ে দিতেই থমকে গেলো শানাজ। এদিকে গাড়ি ছাড়ার জন্য কথা উঠে গেছে, সৌভিক তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেট থেকে কিছু বের করে শানাজের ডানহাতটা ধরলো। সিয়াম গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। সৌভিক চকচকে সিলভার রঙের বস্তুটা তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ধরতেই শানাজের মধ্যমা আঙ্গুলের পরের আঙ্গুলটায় সুড়সুড় করে ঢুকিয়ে দিলো। চকচকে বস্তুটা আঙ্গুলের সম্পূর্ণ ঢুকে যেতেই গাড়ি শো করে চলে গেলো। শানাজ চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সেই ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেলো নীতি, মাহদি, তৌফ জানালা দিয়ে উকি মেরে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে, বাড়ির সবাই সেই একইভাবে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে দিচ্ছে। সবার থেকে দূরে থাকা শানাজ শুধু শেষের সিটটার দিকে তাকালো, সৌভিক ওদের বিদায় জানালো না। গাড়িটা উঠোনের গরম ধূলো উড়িয়ে গেটের দিকে চলে গেলে সবাই পা ঘুরিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেলো। শুধু শানাজ বারবার ঝাপসা চোখ মুছে ব্যকুলচিত্তে চলে যাওয়া গাড়িটা দেখতে থাকলো, সৌভিককে শেষবার দেখার জন্য মনে-মনে অনুনয় করছিলো, আকুলিবিকুল করছিলো, তীব্ররূপে দেখতে চাচ্ছিলো। গেটটা দিয়ে বেরুবে ওমনেই এক ঝলকের মতো সৌভিক মাথা বের করে শানাজের দিকে হাতের একটা চার নাম্বার আঙ্গুলটা দেখাতে লাগলো। ইশারাটুকু করতেই সৌভিকের মুখটা মিলিয়ে গেলো। শানাজ কান্না আঁটকানোর জন্য মুখে আচঁল চেপে ধরতেই গাল গড়িয়ে বড়-বড় প্রস্থের অশ্রু পরতে লাগলো। অশ্রুপূর্ণ চোখ খুলে কাঁপতে থাকা ডানহাতটা ধীরে-ধীরে চোখের সামনে তুললো। ঠিক তখনই আবিষ্কার করে ফেললো, আঙ্গুলে স্থান নেওয়া চকচকে বস্তুটা সৌভিকের দেওয়া বিশেষ আংটি ছিলো।

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩০.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

গ্রামের সরলতা ছেড়ে শহুরে জন্ঞ্জালে প্রবেশ করলো মেহনূর। গাড়িটা যখন বউ বাজারের রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছিলো, তখন কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো বুকের ভেতরটা অজানা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। পুরোনো দিনের মজবুত বন্ধনটা আচমকা ছিড়ে অন্য দুনিয়ায় সংযোগ হয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে সিয়াম বাদে সবাই তখন ঘুমে ঢুলে আছে। মারজা ডানহাতে মেহনূরকে আগলে রেখে সিটের পেছনে মাথা ছেড়ে দিয়েছে, সেও জার্নির একটানা ক্লান্তিতে তন্দ্রামগ্নে ডুবে আছে, মেহনূরের হাতদুটো নিজের কোলে টেনে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে মারজা। এদিকে মেহনূর কোনোভাবেই চোখের পাতা বুজে ঘুমের জন্য স্থির হতে পারছেনা। সাদা শাড়ির লাল পেড়ে আচঁলটা সরতে-সরতে মাথার মাঝ বরাবর ঠেকে আছে ওর, চলন্ত গাড়ির স্বচ্ছ জানালা দিয়ে শোঁ শোঁ করে হিমশীতল বাতাস ঢুকছে তখন। মেহনূর জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে উদাস আকাশে তাকিয়ে আছে, অপরিচিত দুনিয়ায় নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। মা, বড়মা যা যা শিখিয়ে দিয়েছে, সেগুলো ঠিকঠাক মতো পালন করতে না পারলে কতটা ব্যর্থ হবে, সেটা নিয়েই যত চিন্তা। মেহনূর যখন এসব চিন্তায় বিভোর ছিলো, তখন আশেপাশে কিচ্ছু খেয়াল করেনি সে। ঠিক তখনই বাতাসের বেগটা আচমকা বেড়ে গিয়ে মেহনূরের মাথা থেকে আচঁলের শেষ ঘোমটাটুকু সরিয়ে দিলো। মেহনূর দ্রুত খসে পরা আচঁলটুকু মাথায় টানার জন্য হাত উঠাবে, ঠিক তখনই জানালার বাইরে দৃষ্টি গিয়ে ঘোমটার হাতদুটো থেমে যায় ওর। মাইক্রোর পাশাপাশি সমান তালে, সমান বেগে শান বাজিয়ে কালো জিপটা ছুটছে। জিপের ড্রাইভিং সিটে যে মানুষটা বসে আছে, তার ভাবগতিক দেখে মেহনূর সেদিকে স্থিরপানে তাকিয়ে আছে। মাহতিম জিপের গোল স্টিয়ারিংটা শক্তভাবে আকঁড়ে বেশ দাম্ভিকতার সাথে জিপ চালাচ্ছে। গাঢ় বেগুনির শার্টটা কাঠামো-দেহের খাপে-খাপে সেঁটে আছে ওর, কালো প্যান্টের সাথে সবসময়ের মতো বেল্ট বেধেঁছে মাহতিম। ড্রাইভিংয়ের জন্য শার্টের স্লিভদুটো মোটা করে গুটিয়ে রেখেছে সে। যতবার স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ড্রাইভ করছে, ততবার হাতের বাম ঘড়িটা সূর্যের আলোতে রিফ্লেক্ট হয়ে মেহনূরের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। মাহতিমের চোখদুটো কালো সানগ্লাসের আড়ালে ঢেকে আছে আজ। তীক্ষ্ম-ধারালো দৃষ্টি দিয়ে ক্ষণেক্ষণে জিপের গতিবিধি ঠিক রাখছে এখন। মাহতিমের ওমন অবস্থা,বেশভূষা,তেজীয়মান চিন্তাচেতনা দেখে নিজেকে খুব তুচ্ছ ভাবছে মেহনূর। প্রথমত লোকটার সাথে কিছুই মিলেনা ওর। সে থেকেছে শহরের মধ্যে, মেহনূর বেড়েছে গ্রামের ভেতর। তার চিন্তা-চেতনা আধুনিক যূক্তিকেন্দ্রিক, অন্যদিকে মেহনূরের ভাবনা খুবই স্বল্প। মেহনূর এসব ভাবতে-ভাবতে মাথার ঘোমটাটা টেনে নিলো। জানালার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কোলের দিকে নামিয়ে রাখলো। মনের ভেতর তীব্র জড়তার ঝড় চলছে, সেই অশান্ত ঝড়ে মন-মস্তিষ্ক বেকাবু কায়দায় যুদ্ধ করছে। মেহনূর সেইযে চুপটি মেরে গাড়িতে উঠেছিলো, এখনো সে অবস্থায় নিরব হয়ে আছে। মাহতিম বারবার ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে মেহনূরের দিকে তাকাচ্ছে, ওর অবস্থা দেখে যতদূর বুঝতে পারলো, কোনো বিষয় নিয়ে মেহনূরের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমেছে। মাহতিম ওর দৃষ্টি আর্কষণ করার জন্য হর্ণ সিস্টেমে হাতের তালু চেপে মৃদ্যুভঙ্গিতে হর্ণ বাজালো। সিয়াম তখন কপাল কুঁচকে লুকিং মিররে তাকালে তখনই পেছনের ভিউ দেখে ড্রাইভ করা অবস্থায় হেসে দিলো। সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই মেহনূর ততক্ষণে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সানগ্লাসের আড়ালে থাকা চোখদুটো দেখতে না পেলেও মাহতিমের মুখটার দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইলো। মাহতিম ফাঁকে-ফাঁকে দু’দফা মেহনূরের দিকে তাকিয়ে শেষে জিপের স্পিড বাড়িয়ে সিয়ামের পাশাপাশি আসলো। সিয়াম ক্ষণিকের জন্য মাহতিমের দিকে তাকালে মাহতিম সেসময় ছোট্ট একটা ইশারা করলো। সেই ইশারাটা কি ছিলো সেটা মেহনূরের পক্ষে বোধগম্য ছিলো না, কিন্তু সময়ের পাল্লা ভারি না হতেই সিয়াম গাড়ির স্পিড এমনভাবে বাড়িয়ে দিলো, সবাই গাড়ির অমাত্রিক ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম থেকে চমকে উঠলো। তৌফ গাড়ির জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে হা করে ঘুমাচ্ছিলো, কিন্তু গাড়ির এমন আকস্মিক স্পিডে হড়বড় করে চমকে উঠে সিয়ামের দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকালো। কাঁচা ঘুম নষ্ট করার জন্য মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেছে তৌফের। এদিকে সিয়াম তৌফের দিকে ভেটকি মেরে তাকালে তৌফ আহত পশুর মতো ছটফট করে পা থেকে জুতা খুলতে থাকে। সিয়াম ওই দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে আটকায়, একহাতে ড্রাইভ করতেই অন্যহাতে তৌফের সাথে হাড্ডাহাড্ডি অবস্থা চলতে থাকে। একটু আগে যারা ঘুম থেকে উঠেছিলো তারা আবার ঘুমে ঢুলে পরে। সবাই আবার ঘুমে নিমগ্ন হলে কেউ দুজনের অবস্থা দেখতে পায় না, মেহনূর ওমন পাগলের কারখানা দেখে একবার তৌফের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার উজবুকের মতো সিয়ামের আকুতি-মিনতির দৃশ্য দেখছে, অথচ প্রতিবার কিছু বলতে যেয়ে থেমে যাচ্ছে মেহনূর। একপর্যায়ে তৌফের চোখ মেহনূরের দিকে চলে যায়, আর সাথে-সাথেই মেহনূরের দিকে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে হাত থেকে জুতা ছেড়ে দেয়। সিয়ামও মারাত্মক লজ্জা পেয়ে শান্তভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে থাকে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য মনে-মনে তৌফকে দোষারোপ করে।

দুপুরের সূর্যটা মধ্যগগণ ছেড়ে পশ্চিমের দিকে হেলে পরেছে । তপ্তময় জৌলুস ছেড়ে ডুবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। চারিদিকের কোলাহল ছাপিয়ে কান জ্বালাময় হয়ে গিয়েছে। মেহনূর গাড়ির ভেতর এসির নিচে থাকলেও ব্যস্ত শহরের যানজট দেখে প্রচুর অবাক হচ্ছে। আকাশে দীপ্তমান সূর্যটা থাকতে-থাকতে মাইক্রোটা পাকা ধরেছে এখন। ঠিক মিনিট দশেকের মতো টান দিতেই গাড়িটা খোলা গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকলো। গেটের কাছে দুজন দারোয়ান দেখতেই হঠাৎ মেহনূরের মনে হলো, গেটটা যেনো ওদের অপেক্ষাতে খোলা ছিলো। সিয়াম একদম বাড়ির সামনে এনে থামালে সবাই চটপট গাড়ি থেকে নেমে যায়। মাহদি সবার আগে নেমে একদৌড়ে মেহনূরের পাশ থেকে দরজা খুলে দেয়। মেহনূরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিজের ছোট হাতটার মধ্যে মেহনূরের হাতটা গুঁজে নেয়। মেহনূর আশ্চর্যভাবে চারিদিকে চোখ বুলাতে থাকে, পায়ের নিচে দামী পাথরের রাস্তা বাঁধানো, চোখের সামনে বিলাস-বহুল দোতলা ভবন। ভবনটা এতোই উঁচু আশেপাশের তিন-চারতলা বিল্ডিংয়ের মতো সমান। মেহনূর মাথাটা ডানে ঘুরাতেই সবুজ ঘাসের মাঠতুল্য জায়গা দেখতে পেলো। পুরো বাড়িটা যে গাছ দিয়ে বাউন্ডারি করা সেটা এমন সন্ধ্যের টাইমেও বোঝা যাচ্ছে। মেহনূরের অবাক করা চাহনি দেখে মাহদি মুচকি একটা হাসি দিয়ে ওকে ভেতরে নিয়ে যায়। মেহনূর একপা-একপা করে সামনের দিকে এগুচ্ছে, ওমনেই বুকের বক্ষপিন্ঞ্জরটা ধপাস-ধপাস করে লাফিয়ে উঠছে। মেহনূর প্রতিটি পদাঙ্কের দিকে দৃষ্টি রেখে মাথা নিচু করে সম্মুখ দরজার সামনে চলে আসে। ডানহাতটা মাহদির তত্ত্বাবধানে থাকলেও বাঁহাতটা কে যেনো চট করে ধরে, মেহনূর জোরে-জোরে শ্বাস নিতেই বামে তাকিয়ে মারজাকে দেখতে পায়। মারজা চোখে-মুখে তৃপ্তিজনক হাসি ফুটিয়ে মেহনূকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। মেহনূরকে স্বস্তি অনুভব করানোর জন্য নিজের সাথেই আগলে রাখে। মেহনূর বাইরে থেকে যতটা আশ্চর্য হয়েছিলো, বাড়িটার ভেতরটা দেখে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে নির্বাক হয়ে যায়। নীতি, প্রীতি সবাই হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পালটানোর জন্য যার যার রুমে চলে যায়। এদিকে মেহনূরকে নিয়ে মারজা তখন নিজের রুমে চলে আসে। নিজের বিছানায় মেহনূরকে বসিয়ে আলমারির দ্বার খুলতে ব্যস্ত হয়, মেহনূরের জন্য পছন্দসই শাড়ি ঠিক করতেই শান্তসুরে বলে,

– আমার একটাই ইচ্ছে ছিলো, আমার বউটা যেনো ছোট্ট হোক। এতোটাই ছোট হবে, ওকে আমি আদর-যত্ন করে বড় করবো, রঙ-বেরঙের শাড়ি পড়াবো, চুল বেধেঁ দিবো, খাওয়া থেকে থেকে শুরু করে সবকিছু শুধু আমি দেখবো। কিন্তু তোমাকে আনতে এতো দেরি করবে এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

মারজা কথাটুকু শেষ করতেই আলমারি থেকে আকাশী রঙের শাড়ি বের করলো। সেটা হাতে নিতেই আলমারি বন্ধ করে মেহনূরের কাছে চলে আসলো। মেহনূর তখন চুপ করে শ্বাশুড়ির কথা শ্রবণ করছিলো। মারজা যে স্বচ্ছ মনের মানুষ এ সম্বন্ধে বড়মা বেশ আগেই বলে দিয়েছে। কিন্তু আজ আবারও মনে হচ্ছে মারজা সত্যিই ভালো মনের মহিলা। মেহনূরকে চুপ থাকতে দেখে মারজা ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকলো, মেহনূরের শান্ত নয়নের দিকে দৃষ্টি রেখে হাসিখুশি মুখে বললো,

– আমি জানি মেহনূর, মাহতিমের সাথে থাকা নিয়ে তোমার মধ্যে কি কাজ করে। এই ভয়টা বিয়ের রাতেও ছিলো, এখনো সেটা আছে। আমি আমার ছেলেকে চিনি বলে সেদিন রাতে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করিনি। আমি বাবামশাইকে বলে এসেছি, তিনিও আমার মতামত শুনে রাজি হয়েছেন। তুমি যতোদিন মন থেকে ভয় দূর না করছো, মন থেকে সবকিছু না চাচ্ছো, ততদিন পযর্ন্ত মাহতিম আর তুমি আলাদাই থাকবে। মাহতিম নিজেও এ সিদ্ধান্ত শুনে মত দিয়েছে, এজন্য তুমি যতদিন চাও, যেভাবে চাও এ বাড়িতে নিজের মতো করে থাকো। তোমাদের বিয়েটা হুট করে হলেও তোমাদের বোঝাপড়াটা হুট করে ঝুলিয়ে দিতে চাইনা, তোমরা দুজন আমার কাছেই থাকবে, আমার কাছেই থাকবে। আমি চাইনা তুমিও মাহতিমের মতো দূরে-দূরে থাকো। অন্তত তোমাকে নিয়ে এই বাড়িটায় একটু হলেও শান্তি পেতে চাই মেহনূর। তাই যতো কিছুই হোক, তুমি কোনো বিষয় নিয়ে মন খারাপ করো না।

মারজার কথা শুনে মেহনূর সসম্মানে চোখ নামিয়ে নিলো। দৃষ্টি নত করে নিজের সুপ্ত ইচ্ছাটা আনমনে বুঝিয়ে দিলো। মারজা আর কিছু না বলে মেহনূরকে হাতমুখ ধুতে পাঠিয়ে দিলো। মেহনূরের জন্য নির্দিষ্ট করা রুমটা দেখার জন্য চলে গেলে মেহনূর কিছুসময় পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। গায়ে আকাশী রঙের সুতির শাড়ি জড়িয়ে অনেকক্ষণ পর শান্তি পেলো মেহনূর। কিন্তু সমস্যা একটাই, ম্যাচিং ব্লাউজটার হাতা কনুই ছুঁই-ছুঁই। মেহনূর ব্যাপারটা নিয়ে তেমন মাথা না ঘামিয়ে মারজার ড্রেসিংটেবিলের সামনে গেলো। খোপায় বাধাঁ চুলগুলো খুলতেই হঠাৎ দরজা খুলে প্রবেশ করলো নীতি। নীতিকে দেখে মৃদ্যুভঙ্গিতে হেসে দিতেই নীতি সহজাত মিশ্র হাসিতে এগিয়ে আসলো। মেহনূরের চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে দিতেই হাসিমাখা সুরে বললো,

– ভাইয়ার রুম দেখেছো? তোমার রুম জানো ভাইয়া ইচ্ছে করে ছাদের রুমটা দিয়েছে। কত করে বললাম ছাদের রুমটা দিও না, আমার রুমটাই দিয়ে দাও। ভাইয়া আমার কথাই শুনলো না। আমার তো সামারের ভ্যাকেশান শেষের দিকে, ভাইয়া চলে গেলেই এদিকে আমার ফ্লাইটের টিকিট কাটতে হবে। শুধু-শুধু ওই রুমটা দেওয়ার মানে হয়?

মেহনূর সারাক্ষন চুপ থাকলেও মাহতিমের কথা শুনে মনে-মনে প্রশ্ন জাগলো। মাহতিমের বিষয়ে কিছু জানার জন্য নীতিকে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো,

– আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? যদি কথাটা শুনে মনে কিছু না করেন, তাহলে বলবো, নাহলে বলবো না।

নীতি প্রশ্নের ধরন দেখেই বুঝে যায়, মেহনূর কি বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে। মেহনূরের কথায় সভ্যসূচক হাসি দিয়ে সরল সুরে বলে,

– আমাকে ‘ আপনি ‘ করে বলতে হবেনা ভাবী। আমি যেহেতু আপন ভেবে ‘ তুমি ‘ করে বলছি, তুমিও আমাকে আপন ভেবে ‘ তুমি ‘ করে বলো। তুমি নিশ্চয়ই ভাইয়ার ব্যাপারে জানতে চাও, ভাইয়া কি করে, কোথায় যাবে এটা নিয়ে প্রশ্ন করতে চাচ্ছো। আসলে আমি হেল্পলেস, ভাইয়া আমাদের সবক’টা ভাইবোনকে বলে দিয়েছে তোমাকে এ বিষয়ে কিছুই না বলতে। কেনো না করেছে সেটাতো জানিনা, কিন্তু ভাইয়া সম্ভবত তোমার সাথে লুকোচুরি খেলতে চাচ্ছে।

মেহনূর ভালোভাবে বুঝে গেছে ওরা সবক’টা ভাই পাগল। ভাইয়ের কথায় উঠে-বসে, ভাইয়ের কথায় নাচে-গায়। এমতাবস্থায় কিছু জিজ্ঞেস করা যা, না করাও তা। মেহনূর নিরুত্তর মুখে সায় বুঝিয়ে দিলে নীতি ছোট্ট একটা চালাকি করে। মেহনূরের হাত ধরে বাড়ি ঘুরানোর নাম করে সোজা মাহতিমের রুমে আনে। মেহনূর রুমের প্রতিটা জিনিস দেখে আশ্চর্য হয়ে তাকালে শেষমেশ দুই দেয়ালের কোণাকুণি জায়গার দিকে হা করে তাকায় মেহনূর। দেয়ালের সাথে সেঁটে থাকা বস্তুটা দেখে সাথে-সাথে তর্জনী তুলে সেদিকে ইশারা করে নীতিকে আতঙ্কগ্রস্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে,

– ওটা কি? ওটা এখানে কেনো? উনি, উনি, উনি —

মেহনূরের অস্থির মাখা মুখটা দেখে ফিক করে হেসে দেয় নীতি। সেই দেয়ালটার দিকে হাসিমাখা ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় তখন, বস্তুটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই বুক ফুলিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নেয়। শ্বাসটা টেনে নিতেই সেটা সশব্দে ছেড়ে দিতে থাকে। শ্বাসটা ছাড়তে-ছাড়তেই বস্তুটার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় শান্ত কন্ঠে বলে,

– একটা মানুষের বন্দুকের টিপ যে কতটা ভয়ংকর, এটাই তার চাক্ষুষ প্রমাণ। তুমি ধীরে-ধীরে সব জানতে পারবে ভাবী। খুব শীঘ্রই তুমি তরতাজা বুলে’টের আওয়াজ শুনতে পাবে।

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO