মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৩৮+৩৯

0
871

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

নিরবে-নিভৃতে সতেরটা শাড়ির নিঃশেষ করার ঘটনা বাড়ির মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলো। সেই সঙ্গে চাহর হয়ে গেলো রুমটার ভেতর অজ্ঞাত কেউ তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। পুরো ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখার পর মারজার অবস্থা বাকশূন্য। তিনি ডাক্তারের কাছ থেকে চেকআপ সেরে সদ্য বাড়িতে পা ফেলেছেন, পা ফেলতেই তিনি জঘন্য ঘটনার বিবরণ শুনে হতবাক। তিনি রীতিমতো ভেবেই পাচ্ছেন না, মেহনূরের ব্যক্তিগত জিনিসের প্রতি এতো ক্ষোভ কিসের? মেহনূর পুরো ব্যাপারটা বিশদ ভাবে জানালেও মারজা অদ্ভুতকাণ্ডের মতো নিরব রইলেন। কোনোপ্রকার বাক্য খরচ না করে ছাদের রুমটা দেখে এলেন, উপস্থিত সকলের পানে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শেষে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললেন,
– তুই আমার রুমে আয়। এক্ষুনি আসবি। রান্নাঘরের দিকে যাবি না, মাহতিমের রুমেও ঢুকবিনা। সোজা আমার রুমে এসে দেখা করবি।

কথার ধাঁচ দেখে চোখ ছোট করে তাকালো রজনী ইবনাত। মুখে কিছু না বললেও মনে-মনে ঠিকই মূখ্য ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছে। সবাই যেখানে উপস্থিত ছিলো, অনামিকা সেখানে উপস্থিত ছিলো না। এটা নিয়ে কারোর মনে সন্দেহ না জাগলেও আসল ব্যক্তির মনে ঠিকই সন্দেহটা পাকাপাকি হয়েছে। মারজার প্রস্থানের পর রজনীও সেখানে মূহুর্তক্ষণ না দাঁড়িয়ে চলে যায়। নিজের রুমের দিকে আসার আগে চলন্ত পাদুটো অনামিকার রুমের কাছে থেমে যায়। দু’কানে এয়ারপড গুঁজে বিছানার হেডসাইডে পিঠ হেলিয়ে বসে আছে অনামিকা। চোখদুটো শান্তভঙ্গিতে বন্ধ করা, ঠোঁটদুটো যেনো গানের তালে-তালে নড়ছে, নিঃশব্দে আলোড়িত হচ্ছে কম্বলের ভেতরে থাকা পাদুটো। রজনী এ দৃশ্য দেখে দরজায় নক করলো না, কঠিন মেজাজে রুমে ঢুকে দারুণ ক্ষিপ্রতায় ঠাস করে দরজা বন্ধ করলো। তীব্র শব্দে বিছানা কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো অনামিকা, হড়কে গিয়ে কান থেকে এয়ারপড দুটো খুলে এলো, হাতের ফোনটাও কোলে পরে গেলে চোখ-মুখ ক্রুদ্ধ করে দরজার দিকে তাকালো। নিমিষেই সমস্ত রাগ যেনো তরলে পরিণত হলো অনামিকার, ছোট্ট একটা ঢোক গিলে আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে লাগলো, কিন্তু ব্যর্থতা চারিদিক থেকে আগলে ধরলে নিরুত্তেজ দৃষ্টিতে তাকালো সে। রজনীর দিকে আমতা-আমতা করে গলা ভিজাতেই সঙ্কোচ সুরে বললো,

– ফু-ফু-পি তুমি এসেছো? দরজাটা খুব জোরে লাগালে কেনো?

রজনী বিছানার কাছে এসে চট করে অনামিকার দিকে এগিয়ে এলেন। বিছানার হেডসাইডে একহাত রেখে অনামিকার মুখ বরাবর ঝুঁকলেন। রজনীর কঠিন দৃষ্টি দেখে অনামিকৃ ভীতপূর্ণ উদভ্রান্ত চাহনিতে গুটিয়ে গেলো, রজনী তার অন্যহাতটা এগিয়ে খপ করে অনামিকার চোয়াল চেপে ধরলেন। অনামিকাকে বিন্দুমাত্র গোঙানোর সুযোগ না দিয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলতে লাগলেন,

– রাতের বেলা পাকনামো করতে কে বলেছিলো? ওখানে গিয়েছো কোন্ সাহসে? আমি হাজার বার বলেছি আমি কোনো ভুল চাই না। মারজা ভাবী ঠিকই তোমাকে সন্দেহ করে ফেলেছে। একমাত্র তুমিযে এমন বিকৃত মস্তিষ্কের মতো কর্মকাণ্ড করতে পারো, সেটা উনার অজানা নয়।

রজনীর বড় বড় নখগুলো গালের চামড়ায় দাগ বসে যাচ্ছিলো, নখের তীব্র জ্বালা-যন্ত্রনায় আকুতি দৃষ্টিতে তাকালো ফুপুর দিকে। আপন ফুপুর আচরণ যে কতটা কঠিন, কতটা পাশবিক হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই তার জন্য গোপন বিষয় নয়। রজনী সত্যিই মেহনূরের আশ-পাশ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলো, সঙ্গে এটাও বলেছিলো সে যেনো কূটকৌশল না খাটাতে যায়। অনামিকা বুঝতেই পারছেনা, এবার মাহতিম নেই জেনেও কেনো তার ফুপি চেপে-চেপে চলছে। এমন পিছিয়ে-পিছিয়ে নিরব থাকার মানে কি? এসবের মূল সারাংশ আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকছে? অনামিকাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো রজনী ইবনাত। জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে দরজার দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন, দরজার নব্ ঘুরিয়ে ফাঁক করে ফেললে একপলকের জন্য পিছু ফিরে তাকালেন। অনামিকা তখন বিপদমুক্ত হওয়ার আভাসে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ছিলো, স্বাভাবিক কায়দায় স্থির হতেই হঠাৎ একজোড়া ক্রুদ্ধদৃষ্টি দেখে আবার ভয়ে শুকিয়ে গেলো। নিজের শঙ্কিত অবস্থাকে আড়াল করার চেষ্টায় জোরপূর্বক হাসি দিলো অনামিকা। কিন্তু কোনো লাভ হলো না, অনিমেষ নেত্রে চেয়ে থাকা অগ্নিদৃষ্টিটা ততক্ষণে পা চালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে।

.

নতশীর্ণ মুখে দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো মেহনূর। শ্বাশুড়ির তলব-ধ্বনি শুনে মনটা ভয়ে আক্রান্ত। মাথায় ঘোমটা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সেটা আপাতত শ্বাশুড়ির নির্দেশে পালিত হয়না। মেহনূর আচঁলখানা পিঠের উপর টেনে নিয়ে শ্বাশুড়ির মস্ত বিছানার দিকে এগুতে লাগলো। দৃষ্টিদুটো চকচকে টাইলসের উপর স্থির থাকলেও আড়চোখে মারজার কঠিনমূর্তিটা দেখে নিলো। বিছানায় আসন করে বসে জানালার দিকে মুখ করে আছে মারজা, পিঠ দিয়ে আছে মেহনূরের দিকে। মেহনূর পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসে খাটটা অতিক্রম করে মারজার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। মারজা একপলক চাহনিতে মেহনূরের দিকে তাকালেন, মেহনূরের সংকুচিত হৃদয়ের উদ্বেগ অবস্থা দেখে পাশে বসার নির্দেশ দিলেন। শ্বাশুড়ির আদেশে শির ঝুঁকানো অবস্থায় বিছানায় বসলো মেহনূর, ওমনেই তার মুখোমুখি হয়ে সুতীক্ষ্ম চাহনিতে আঁটসাঁট হয়ে বসলেন মারজা। অন্যসময় মেহনূরের হাতদুটো মাতৃতুল্য কোলের উপর দৃঢ়ভাবে টেনে নিতেন, সুকোমল হাতদুটো ধরে স্নেহের চুমু দিতেও দেরি করতেন না। আজ ব্যতিক্রম কাণ্ড ঘটানোর পাশাপাশি তিনি কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বললেন,

– রুম থেকে আর কিছু খুইয়েছে? হারিয়েছে কিছু?

মেহনূর একটু সময় নিয়ে ভেবে নিলো, এরপর নতমুখেই মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে জবাব বুঝিয়ে দিলো। মারজা উত্তর পেয়েও স্বস্তিসূচকে ফিরলেন না। জেরার প্রসঙ্গটা বজায় রেখে মেহনূরকে আবার প্রশ্ন করে বললেন,
– তোর সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করেছে? মন ঝেড়ে উত্তর দিবি। আমার কাছে কিচ্ছু লুকানোর চেষ্টা করবি না।

মেহনূর এবার মাথা তুলে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। শান্ত-নিবিড়ভাবে বললো,
– না মা, আমার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি। আমি মিথ্যা বলছি না।

মারজা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর মেহনূরের পেছনে থাকা দেয়ালঘড়িটার দিকে একপলক তাকিয়ে এবার মেহনূরের পায়ের দিকে তাকালেন। ভারী একটা নিশ্বাস ছাড়তেই রুমটার ভেতর নিশ্বাসের শব্দ ছড়িয়ে পরলো। তিনি মেহনূরকে আড় ভেঙ্গে কিছুই বললেন না, পায়ের অবস্থা দেখে নির্দেশ দিলেন বিছানা না উঠতে। কথাটুকু শেষ হওয়া মাত্র নিজেই বিছানা ত্যাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এমন অত্যাশ্চর্য আচরণ দেখে আস্ফালন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় উপায় ঠাহর করতে পারলো না মেহনূর। মারজা মন শক্ত করে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে পা বাড়িয়ে গেলেন, ওড়নাটা মাথার উপর ভালোমতো টেনে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত রুমটার ভেতরে ঢুকলেন। কোনোপ্রকার সৌজন্যতা না দেখিয়ে একেবারে রজনীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। রজনী ফোনে ব্যস্তভঙ্গিতে কথা বলছিলো, দরজা দিয়ে মারজাকে ঢুকতে দেখে সে আর কথা বলতে চালাতে পারলো না, ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চট করে কলটা কেটে দিলো। মারজার মুখের অবস্থা দেখে সন্দেহাতীত ঘটনা নিয়ে বিচলিত হলো রজনী, তবুও যতদূর সম্ভব সেটা আড়াল করে কৌতুহল গলায় বললো,

– কিছু হয়েছে মারজা আপা? আপনার মুখ এমন মলিন দেখাচ্ছে কেনো? আপনি কি মেহনূরের —

কথার মাঝপথে ছিদ্র বসিয়ে কঠোর আভাসে বললেন মারজা,
– অবশ্যই কিছু হয়েছে। আমার পিঠ-পেছনে এরকম ঘটনা আশা করা যায়নি ভাবী। আমি যখন বাড়ির বাইরে থাকি, তখন পুরো বাড়ির দায়ভার আপনার উপর দিয়ে যাই। আপনি আমার অনুপস্থিতিতে কেমন খেয়াল রেখেছেন? আমি নিতান্তই অসুস্থ মানুষ। ঔষুধের জোরে টিকে আছি। তাই বলে এমন দিন দেখতে হলো? আমারই বউয়ের রুমে ওসব তছনছ অবস্থা? আমিতো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।

মারজার উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে কিছুটা স্বাভাবিক হয় রজনী। পুরো বিষয়টাকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে সামাল দেওয়ার জন্য মিথ্যা চিন্তার অভিনয় করে বিচলিত সুরে বললো,

– আমার ভুল হয়েছে আপা। অনামিকার জন্য লজ্জায় এখন মুখ দেখাতে পারছিনা। ও রাগের ঝোঁকে কাজটা করে ফেলে আপা। ওর বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। এদিকে ভাইজানেরও শেষমূর্হতে কাজের খবর এসে যায়, আপনিতো জানেন ভাইজান পলিটিক্সের মানুষ। দিনে কতলোকের সাথে উঠাবসা করা লাগে তার হিসেব নেই। তাই জন্য ভাইজান অনামিকাকে বাধ্য হয়ে না করে দেন। ও বুঝতে পারেনি, রাগের মাথায় কাজটা করার পর হুঁশ ফেরে। ততক্ষণে যা হওয়ার সব হয়ে গেছে। আমার কাছে রাতে এসেই কান্না জুড়ে দিয়েছিলো। আপা আপনার হাতদুটো ধরি, আপনি মেয়েটাকে মাফ করে দিন। মেহনূরের শাড়ির ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি, বিকেলের মধ্যেই হোম ডেলিভারী করিয়ে দিবো।

রজনী এখানেই ক্ষান্ত হলো না, যতপ্রচার বশীভুত কথাবার্তা আছে সব একে-একে ফলানো করে মারজার মন সিক্ত করলো। মারজা ক্রুরহৃদয়ে এসেছিলেন ইচ্ছামতো কথা শোনাবেন বলে। পরক্ষণে ব্যাপারটা এমনভাবে উলটে যায়, মারজা তখন সমস্ত রাগ ঝেড়ে বিগলিত হৃদয়ে চলে যান। মারজাকে আজকের মতো জব্দ করতে পেরে বুকের উপর থেকে দশ টনের পাথর সরে গেলো রজনীর, ভারমুক্ত হয়ে হাঁফ ছাড়তে-ছাড়তে ধপ করে ডিভানে বসলো সে। মারজা যেমন সরল-সহজ মন নিয়ে চলাফেরা করে, তেমনি আকস্মিক রাগ নিয়ে আগমন হলে সেটা সামলা নেওয়া তেমন কঠিন কিছু না। সমস্যা হলো, অনামিকা যদি আবারও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারগুলো ঘটায় তাহলে সোজা মাহতিমের কান অবধি পৌঁছে যাবে। বাড়ির প্রতিটি কাজে মূখ্য কর্তা হিসেবে এখন মাহতিমই গণমান্য, তার একটা কথার উপর দ্বিতীয় কথার প্রলেপ পরার সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই সে স্বাভাবিক চিন্তাধারার ব্যক্তি, হাসিখুশী থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু রাগ যখন তুঙ্গস্পর্শী হয় তখন সেটা নিচে নামানো দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাকে থামানো, বুঝানো, শান্ত করার জন্য নিজেরই ধৈর্য্য যেনো অসহায় হয়ে যায়, অধৈর্য হয়ে বিগড়ে যায় মেজাজ। যার মুখটা হাসিতে ভরপুর, তার রাগটা ততই ভয়ংকর।
.

গ্রামের চিরপরিচিত পরিবেশ নিয়ে যদ্দূর বর্ণনা খাটে, তাতে হয়তো সরল-সহজ জীবনযাত্রার দৃশ্যপট ফুটে উঠে। চিত্রিত হয় সবুজে ঘেরা মেঠোপথের রাস্তা, মানসপটে ভেসে উঠে সরলভাবে রোজগার করা পুরুষ কর্তার শ্রম। দিনের শুরুটা সূর্যাদয়ের সঙ্গে আরম্ভ হয়েছিলো, জাগতিক কর্মকাণ্ডগুলো শুরু হয়েছিলো স্বাভাবিক নিয়মে। খাঁ খাঁ করা খরাক্রান্ত জমি, মাথার উপর জলন্ত সূর্যপিণ্ড দাপুটে রাঙা ছড়াচ্ছে। জমির একদিকে টিনের বাংলাবাড়ি বানানো, বাড়িটাও পুরোনো হয়ে টিনের উপর জংয়ের আস্তরণ পরেছে। আশেপাশে কোনো জনবর নেই, দূর-দূরান্ত শুধু ফসলি জমির জায়গা। যারা ফসলী জমিতে এতোক্ষণ কাজ করছিলো, তারাও দুপুরের আহার সারার জন্যে বাড়িমুখী হয়েছে। নির্জন ধূ ধূ করা মাঠের সেই বাংলাবাড়িতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে এক লোক। যার বয়সটা চল্লিশ পেরিয়ে পয়তাল্লিশের কাছাকাছি এসেছে। পড়নে ময়লা লুঙ্গি, গায়ে পাতলা ধরনের গোল ছলার গেন্ঞ্জি। সাদা গেন্ঞ্জিটা এখন আর সাদা নেই, সাদা রঙকে ভিজিয়ে-ভিজিয়ে রক্তিম রঙে চুপচুপে হয়ে গেছে। চোখের ডানকোণা ফেটে র’ক্ত ঝরছে অনবরত, মুখ দিয়ে ঝরছে বিন্দু-বিন্দু র’ক্ত, হাতদুটো পিছমোড়া করে বাধঁলেও পাদুটো শক্ত শিকলে পেঁচিয়ে রেখেছে। নিশ্বাসের গতি এতোটাই ধীর ভাবে চলছে, লোকটা নিশ্বাস নিতেও যেনো ম’রণ যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। বুকের ছাতি যেনো ফেটে যেতে চাইছে তার, গলা শুকিয়ে খরার মতোই রুক্ষ হয়ে গেছে, চক্ষুর লোলুপদৃষ্টি যেনো ঝাপসা-ঝাপসা। হঠাৎ মাথার উপর কঠিন ব্যথা অনুভব করলে চিৎকার করতে গেলো লোকটা, কিন্তু আফসোস, গলা ভেদ করে শেষ শব্দগুলো যেনো কুন্ডলী পাকিয়ে আঁটকে যাচ্ছে। চিৎকার করতে যেয়ে ব্যর্থ হলে জোরে-জোরে কাশতে থাকে লোকটা, তখুনি ঝাপসা দৃষ্টির সামনে টিনের বদ্ধ দরজাটা দু’ধার বরাবর খুলে গেলো। উন্মুখ দুয়ার দিয়ে ঢুকলো কয়েক জোড়া পদযুগল। ঝাপসা দৃষ্টিতে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা লোকটা, গোঙানির মতো চেঁচাতে গেলে ঠোঁটের কিনারা দিয়ে তরল রক্ত পরতে লাগলো তার। মাথাটা নিচে নোয়ানো থাকলেও আকস্মিকভাবে আবারও চুলে টান খেয়ে মাথা তুলে তাকালো, বুজে আসা চোখ দিয়ে পিটপিট করে তাকাতেই অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলো সামনে এখন কে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা হলফমাত্র দেরি করলো না, ভয়ে-আতঙ্কে উপস্থিত সবার সামনেই হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো। টিনের ঘরটার ভেতর লোকটার ক্রদনধ্বনি দফায়-দফায় বেজে উঠছিলো, পদযুগল এসে একদম কাছাকাছি থামলো। কেবল একজোড়া বৃদ্ধ পা এসে দু’কদম বেশি এগিয়ে এলো। লোকটা কান্না স্ফীত না করে হাউমাউ করেই বলতে লাগলো,

– আমারে ছাইড়া দেন হুজুর। ও হুজুর, আমি ভুল করছি আমারে মাই’রেন না। আমি আপনারে কিডনী বেইচা হইলেও টেকা পরিশোধ কইরা দিমু। আমারে এইবারের লিগা ছাইড়া দেন হুজুর, আমি কারুর কাছে কিচ্চু কইবার যাইতাম না। এই দেহেন কিরা কাইটা কইতাছি, আমি কালকাই আপনের টেকা দিয়া যামু। আমারে মাই’রেন নাগো হুজুর। আমার বউ পোলাপাইন ক্যামনে চলবো? আমি ছাড়া ওগোরে কেউ দেখতো না হুজুর।

বৃদ্ধ পদজোড়ার ব্যক্তিটা কথাগুলো নিরবে শুনলেন, শোনার কয়েক মূহুর্ত স্থির থেকে মাটিতে নতজানু হয়ে বসলেন। মাটিতে বসার দৃশ্য দেখে চেলারা সবাই হৈহৈ করে মাদুর-পাটি বিছিয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু বৃদ্ধ লোকটার আঙ্গুলী নির্দেশ দেখে সবক’টা সেখানেই থেমে গেলো। ক্ষতবীক্ষত লোকটা অশ্রু টলটল চোখে বৃদ্ধর সহানুভূতির আভাস পেয়ে শান্ত হতে লাগলো, কান্নার হিড়িকে কাঁপতে-কাঁপতে বললো,

– হুজুর…

চোখের পলকে সবকিছু বীভৎস অন্ধকারে ছেয়ে গেলো, কানের ভেতর মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করতে-করতে মাথাটা ঝিমিয়ে এলো। ঝাপসা দৃষ্টিটা আরো সংকুচিত হতে-হতে ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে নরলো। চোখের সামনে প্রহেলিকার অন্ধকারে ছেয়ে গেলো লোকটার, ফে’নকি দিয়ে তরতর র’ক্ত-বন্যা জায়গাটা সিক্ত করতে লাগলো। নতজানু অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ, মাটিগুলো ঝাড়া দিতে-দিতে চেলাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন,

– ওর বাড়ির কেউ জানে?

উক্ত চেলাটা ব্যস্তভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
– না, মোল্লা হুজুর। ওর বাড়িতে কেউ জানে না। জানে ওয় আবার গান্ঞ্জা টানতে উধাও হইয়া গেছে। কেউ ওর খবর মালুম করতে পারবো না মোল্লা হুজুর। আমি আপনারে নিচ্চিন্ত দিতাছি। ওর আষ্টগুষ্ঠিও ওর খবর উদ্ধার করতে পারবো না। আপনে ঠান্ডা মাথায় বাড়িত যান। বাকিডা আমরাই দেখতাছি।

গম্ভীর মুখে মাথা নাড়িয়ে হাতদুটো কোমরের কাছে বেঁধে নিলেন হান্নান শেখ। যেই ভঙ্গিতে তিনি এখানে এসেছিলেন, একই ভঙ্গিমা বজায় রেখে চুপচাপ সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনজন চেলা আগে থেকেই পথঘাটের অবস্থা দেখে এসেছে, রাস্তায় মোসাদ্দেক চাষা ছাড়া আর কেউ ক্ষেতে ফিরেনি। তারা হান্নান শেখকে অন্য রাস্তার খবর দিয়ে সেদিক বরার বাড়ি ফিরতে বলে দিলেন, হান্নান শেখ আবারও ধূর্ততার সাথে সকল গ্রামবাসীর চক্ষু আড়ালে কাজ সেরে এলেন। নিজের বাড়িতে ফিরে কলপাড়ে গিয়ে সাদামাটা ভাবেই হাতমুখ ধুলেন, সুজলাকে একগ্লাস পানির চাহিদা প্রকাশ করে নিজের ঘরের দ্বার ঠেলে ঢুকলেন। ঘরের এককোণে থাকা আলনা থেকে শুকনো গামছা নিয়ে মুখ মুছতেই সুজলা পানির গ্লাস নিয়ে হাজির। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ‘ আব্বা, আপনার পানি ‘ বলতেই হান্নান শেখ প্রসন্ন হাসিতে বললেন,
– বাইরে দাঁড়ানোর দরকার নেই বড় বউ। ভেতরে এসে গ্লাসটা রাখো।

সুজলা ঘরে ঢুকে ছোট্ট কাঠের টেবিলে গ্লাস রাখতেই হান্নান শেখ কনুই পযর্ন্ত হাত মুছতেই বললেন,
– আমার নাতনীটার কোনো খবর আনছো বড় বউ? শানাজের সাথে যোগাযোগ হয়?

সুজলা উদাস মুখে চোখ নামিয়ে বললো,
– আব্বা, শানাজের ফোনটা কেমন নষ্ট হয়ে গেছে। ওটা নাকি কাজ করেনা। সুরাইয়া রাগ দেখিয়ে ফোনটা যে আছাড় মারলো, ওটা আর ঠিক হয়না।

হান্নান শেখ ভাবুক ভঙ্গিতে গামছাটা সুজলার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সুজলা শ্বশুড়ের ভেজা গামছাটা নেড়ে দেওয়ার জন্য চলে গেলে হান্নান শেখ তার ইজিচেয়ারে গিয়ে বসলেন। চোখদুটো শ্রান্তিতে ঢুলে আসছে, ইজিচেয়ারে দোল খেতে-খেতে তিনি জীবনের মস্ত বড় ভুলটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। মারজাকে যখন বিয়ে দেওয়া হলো, তখন হয়তো জানাই ছিলো সে সেনাসদস্যের স্ত্রী হয়েছে। মারজার সাথে যোগাযোগ চ্ছিন্নতার বিশেষ কারণ হয়তো এটাই ছিলো, মারজার স্বামীর পেশাগত জীবন। হান্নান শেখ স্বেচ্ছায় মারজার সাথে যোগাযোগ রাখেনি, কিন্তু মারজার সেই স্বামীই যখন দুনিয়ায় নেই, তখন এসব নিয়ে আর চিন্তায় পড়তে হয়নি। মারজা বহু বছর পর তার ভিটেবাড়িতে ঘুরতে এসেছিলো, স্বপরিবারে না এলেও যাদের নিয়ে এসেছিলো, বেশ ভালো করেই খাতির করেছে হান্নান শেখ। এখানেই তিনি বিশাল বড় ভুলটা করে ফেলেন। যেই ছেলেকে তিনি সহজচিত্তের সুপুরুষ ভেবেছিলেন, ওই ছেলে সহজের কাতারে কোনোদিন পরতোনা। মারজার ছেলেকে নিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক করার ইচ্ছা তার ছিলো না, ওরকম মনোবৃত্তিই তার উদয় হয়নি। মারজা যখন নিজ থেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন, তখন আশেপাশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে মেহনূরকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেন। আচ্ছা, মেহনূর কি আদৌ এ বিয়েতে মন থেকে রাজী ছিলো?

.
দেশের সর্বত্র নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। আকাশে সূর্যের দেখা নেই। ভারি-ভারি মেঘের আড়ালে ঢাকা পরেছে সূর্যটা। খুব যে একটা ঠান্ডানুভব হচ্ছে তাও অবশ্য না। মেঘগুলো যেনো বিষণ্ণতায় উত্তীর্ণ হয়ে সূর্যকে আড়াল করে দিয়েছে। তার উপর পৃথিবীর এ প্রান্তে আজ কড়া আলো পরেনি। সময়ের আবহকাল ছুটতে-ছুটতে দিনপন্ঞ্জিকার মাসগুলো পালটে দিচ্ছিলো। জাদুদণ্ডের কারসাজির মতোই পেরিয়ে যাচ্ছিলো ঋতুময় চক্রটা। মারজা দিনকে-দিন অসুস্থ হয়ে পরছিলেন, মাথার যন্ত্রণার জন্য নানাপদের ঔষুধ গিলতে হত। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি শয্যাশায়ী থাকতেন, প্রচণ্ড যন্ত্রনায় কাতরাতে-কাতরাতে একপর্যায়ে ঘুমে ডোজে ঘুমিয়ে পরতেন। মেহনূর চারটা মাসের ভেতর পুরো আনসারী নিবাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। চুপচাপ-নিরবে কাজ সেরে যাওয়াই মেহনূরের আসল কর্ম ছিলো, নিজেকে সংসারের হালে মিলিয়ে নিলে আস্তে-আস্তে অনেক কিছুই বুঝতে শিখলো। জীবনের গম্ভীরতা আজও তাকে কঠিনভাবে ভুগাচ্ছে, সে এখনো কারোর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারেনি। মারজার সাথে যতটুকু হৃদতাপূর্ণ মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কেবল মাহদির সাথে একটু-আধটু। রজনী যে কিসের জন্য নিরব থাকতো, সেটা আস্তেধীরে বুঝতে লাগলো অনামিকা। চার-চারট মাস কচ্ছপের খোলসের মধ্যে মাথা গোঁজ করে আছে রজনী, কাঙ্ক্ষিত সময়টার জন্য যেনো বাঁকা হাসিতে অপেক্ষা করছে সে। পন্ঞ্চম মাসটার শুরুর দিকে ভিডিও বার্তায় যুক্ত হলো আটজন, আজ তাদের সম্মেলনে মাহদি যুক্ত নেই। সময়টা বাংলাদেশ টাইম রাত দুটোর দিকে চলছে, অন্যদিকে আমেরিকায় চলছে সকাল বারোটার মতো। দু’দেশের দু’প্রান্ত থেকে মোবাইল-পিসি-ল্যাপটপে একত্র হলো সবাই, প্রথমে হাসি-ঠাট্টায় কুশল চললো কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে চিন্তিত বিষয়ধারা চলে এলে ফারিন প্রথম প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো,

– আচ্ছা তোমরা একটা কথার জবাব দিবে? আমি জাস্ট ফ্যাড আপ হয়ে গেছি, তবুও কোনো আন্সার বের করতে পারলাম না। রজনী মামীকে কেনো আমরা ভয় পাচ্ছি? কেনো আমরা ওই মহিলাকে ভয় পাচ্ছি? আমি নীতি আপুকে কোয়াশ্চ্যানটা করলাম, বাট নো আন্সার। তৌফ ভাইয়াকে কোয়াশ্চ্যানটা করলাম, সে এ্যাজ-অলয়েজ আমাকে ঝারি মারলো। আমার প্রশ্নের উত্তর কেউ দিবে? প্লিজ আমি কোনোভাবেই তোমাদের ভীতু হওয়ার রিজ্যান ধরতে পারছিনা। তোমরা কেনো আমাকে ছোট-ছোট করে আন্সারটা দিচ্ছো না? আমিতো মুখচোরা না, পেট-পাতলাও না।

ভিডিও কলের আওতায় সবাই যেনো চুপ রইলো। চুপটি থাকার পর নীতির কাছেই বিষয়টা উদ্ভট ঠেকতে লাগলো। আসলেই তো, কেনো ফারিনকে এ বিষয়ে বলা হচ্ছে না? আর কতো চুপিচুপি? নীতি সব চিন্তা উপেক্ষা করে গলা পরিষ্কার করে নিলো, কানের এয়ারপডটা ঠিকঠাক করে শান্ত গলায় বললো,
– ফারিন শোন, রাগ করিস না। তোকে না বলার পেছনে তেমন কোনো কারণ নেই, কিন্তু টেনশনে ছিলাম যদিনা আবার প্রবলেম ক্রিয়েট করে দিস। শোন তাহলে, রজনী মামীর ভা —–

কথাটা ভয়ংকর ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে চট করে বলে উঠলো সিয়াম,
– তুই চুপ কর্। তোর ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে কান দিয়ে র’ক্ত বের হইবো। আমি বলি, রজনী বেডির ভাই একটা তুখোড় মাল। রাজনীতি করে, একনামে সবাই চিনে। তুইও দামী মালটারে চিনোস। নাম আর ভাঙ্গায়া বললাম না। আগুন-আগুন যুদ্ধ লাগলে কেমন অবস্থা হইবো চিন্তা করছোস? চিন্তা করোস নাই। মাহতিম যদি শান্ত থাকতো ওরে নিয়া টেনশন কাজ করতো না, ওর মেজাজের উপর বিশ্বাস নাই ফারিন। যদি একবার খারাপ হয় জানো’য়ারের মতো সবগুলারে ছিঁ’ড়া ধরবো। ওই বেডিরে আমরা ভয় পাই না ফারিন। ভয় পাই ওই লোকটারে। ওই লোক খুবই পাওয়ারফুল। আমার নিজের বাবা পযর্ন্ত ওই লোকটার কাছে যাওয়ার আগে দশবার ভাবে। নাহলে অনামিকারে আমরা ছাড়তাম? ওরে না চুলের মু’ঠি ধইরা কাদার মধ্যে ডুবাতাম! সাহস আছে ঠিকই, কিন্তু ভয়টা কোনদিকে করতেছে এইটা একটু বুঝিস ফারিন। সবাই আমাদের বাইরের অবস্থা দেইখা ভাববো, আমরা এমন দাপট দেখাই, অথচ সামান্য দুইটা ডাই’নীর কাছে কুঁজো হয়ে আছি ক্যান। ভাই, আমরা যতোই তোপ দেখাইতে যাইনা ক্যান, এইসব মানুষ ক্যামনে যে বুকের উপর কলি’জা টাইনা ধরবো আন্দাজও করতে পারবিনা।

ফারিন কোনো কথাই বলতে পারলো না। আস্তে করে কলটা কেটে গিয়ে অফলাইন চলে গেলো।
.

ঋতুচক্রের সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া যেনো বিচিত্র রূপে পালটে গেছে। নীলচে আকাশ যেনো ভারী-ভারী মেঘের বেশভূষায় গা ঢেকে নিয়েছে। আকাশটাকে ধূসরবর্ণে মূর্ছিত করে নিভিয়ে দিয়েছে দিনের আলো। ঠান্ডা শীতল হাওয়া যেনো জেঁকে বসেছে শহরের বুকে। শহরের নগরীতে যেনো হিমেল হাওয়ার তোড়জোড় চলছে। ঘড়ির সময়সীমা হিসেবে বেলা তিনটে বাজে, অথচ প্রকৃতির অবস্থা দেখলে মনেহয় সান্ধ্যাহ্নিক প্রহর। মেহনূর নির্মলচিত্তে সমস্ত কাজ সেরে আবারও প্রাণ-প্রনয়ের শূন্য শয্যায় বসে আছে। বসে-বসে উবু হয়ে মাহদির দেওয়া নতুন ডায়েরীতে নিজের শব্দ-সম্ভাষণ লিখছে। রুমের ভেতরকার অবস্থা আজও আবছা অন্ধকার, যদিও সবগুলো জানালা খুলে দেওয়া। উন্মুক্ত জানালার পর্দাগুলো উত্থাল হাওয়ায় উড়ছে, টালমাটাল প্রকৃতির রূপ যেনো সস্নিগ্ধ ধারায় প্রফুল্ল। গাঢ় রেগুনি রঙের জামদানীটা কি ভেবে যে বাঙালী কায়দায় পরেছে জানা নেই, তবে বেগুনী ব্লাউজটার হাতটা এবার যেনো খাটো। মাথায় আজ ভুলবশত ঘোমটা দিয়েছিলো মেহনূর, কিন্তু বাতাসের দাপটের কাছে হার মেনে একনিমিষেই মাথা থেকে সরে গেলো ঘোমটার কাপড়। এক ঝটকায় সরতে গিয়ে মেদহীন পিঠটার উপর থেকেও আচঁলখানা খসে পরলো, উন্মুক্ত হয়ে উঠলো ব্লাউজ ও শাড়ির মধ্যবর্তী কোমরের অংশটা। লিখতে গিয়ে ভারী বিরক্ত হলো মেহনূর, কলমটা ডায়েরীর পাতায় ফেলে হাত উলটে আচঁলখানা টানতে গেলো, কিন্তু বৃথা হয়ে চেষ্টাটুকুতে হাল ছেড়ে দিলো মেহনূর। রাশি-রাশি চুলগুলো খোপায় মুড়ে কাধের কাছে জড়সড় করে বেঁধেছিলো, সেখান থেকে চুল ছুটতে-ছুটতে অনেক চুলই কানের দুইধার দিয়ে বেরিয়ে পরেছে। ডায়েরীর পাতায় আবার মনোযোগ দিলো মেহনূর, প্রতিটা শব্দ যেনো হৃদয়ের আদর মাখিয়ে লিখছে। অশান্ত হাওয়ায় মত্ত প্রকৃতিটা মেহনূরের সাথে যেনো লুকোচুরি করে খেলছে। হাওয়ার সেই চন্ঞ্চলতা-অস্থিরতা-উন্মত্ততা সশব্দ সমারোহে শোঁ শোঁ করতে থাকলে চারিদিক থেকে মুখর হতে লাগলো গাড়ির বিকট হর্ণের আওয়াজ। বাতাসের শোঁ শোঁ হাসিটার সঙ্গে নিরব যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে দাপুটে হর্ণটা, সূদূর থেকেই যেনো বাজাতে-বাজাতে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে জানান দিয়ে আসছে। আগমনী সূত্রে সংকেত যেনো বাতাসের শব্দ চিড়ে পৌঁছে দিতে চাচ্ছে। উৎকট আওয়াজের যন্ত্রণায় চিকন দুটো ভ্রুঁ তৎক্ষণাৎ কুঁচকে এলো, সুকোমল ওষ্ঠাধর কঠোরভঙ্গিতে শক্ত হয়ে উঠলো। কলমটা আবারও ছেড়ে দিয়ে খোলা জানালার থেকে তাকালো মেহনূর। বিরক্তিতে চূর্ণ হয়ে কঠিন কিছু কথা বলতে নিচ্ছিলো, ওই সময়ই খেয়াল করলো কলমের নিপটা অজান্তেই বেরিয়ে গেছে, এদিকে ভকভক করে কালি বেরিয়ে ডানহাতটা কালিঝুলিতে বিশ্রী অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে হর্ণের শব্দ একবিন্দু হ্রাস হয়নি। মেহনূর আবারও খোলা জানালা দিকে শব্দ উৎসের জন্য কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। ইচ্ছা করছিলো এখুনি জানালা দিয়ে দেখে আসতে, কিন্তু কালির দূর্দশা দেখে হাতটা ধোয়ার জন্য বাধ্য হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো মেহনূর। তখনই বাতাসের সোল্লাসে বাইরে থেকে চিল্লানো সুরে ছুটে এলো কন্ঠধ্বনি,

– মেহনূর আফরিন, আনসারী হেয়ার!

#চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

– মেহনূর আফরিন, আনসারী হেয়ার!

চিৎকারের কল্লোলধ্বনি চর্তুদিকে জানান দিলো সে এসেছে। বাতাসের সাথে বেজে উঠলো পরিচিত কন্ঠের তেজীভাব। আজ বহুদিন, বহুকাল পর নীড়ের মাঝে ফিরেছে। ফিরেছে হাতে গোণা চারটি মাসের ব্যস্তময় কর্মজীবন কাটিয়ে। বাতাসের উত্থাল-পাত্থাল বৈরি অবস্থা প্রকৃতিকে অশান্ত করে দিচ্ছে, আশেপাশের ধূলো উড়িয়ে অন্ধকারকে ডেকে আনছে, আকাশের সূর্যহীন নিষ্ক্রিয় অবস্থা বারিধারার প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন। দিনের অবশিষ্ট আলোটুকু এক লহমায় চোখের পলকে নিভে গেলো, অন্ধকারকে ডেকে এনে বৃষ্টির সোল্লাসকে বরণ করলো। বড় বড় ফোঁটায় ঝপ করে বৃষ্টি নামলো তখন। মেদিনী ভিজিয়ে সিক্ত করলো ধূলোর কারসাজিকে। ওয়াশরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে আকস্মিক বর্ষণের দিকে তাকিয়ে আছে মেহনূর। হাতদুটো বেসিনের ট্যাপের নিচে সাবানমুক্ত করার জন্য ধীরেসুস্থে ধুচ্ছে, হাতের মুঠোদুটো কচলে-কচলে ধুতেই মনের ভেতর আওড়াতে লাগলো, ‘ তুমি আজ কেনো এলে বৃষ্টি? তোমাকে দেখলে বারবার ওই মানুষটার কথা মনে পরে। জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে যখন তোমাকে ছুঁতে যাই, তখন প্রথম ছোঁয়ায় যে শিরশির অনুভূতিটা হয়, যেই আনন্দাপ্লুত সুখটা মনের উঠোনে দোল লাগিয়ে দেয়, যেই একটুকরো হাসিটা ঠোঁটের উপর চনমনিয়ে ফুটে উঠে, তাঁর স্পর্শ পেলে, হাসি দেখলে, কন্ঠ শুনলে আমার কেমন অনুভব হয় তাতো বোঝানো অসম্ভব। আমিতো তাঁকে কিছুই বলতে পারিনা। আমার এই না-বলা ভাবটা কবে শেষ হবে জানি না। আমার না-বলা কঠিন অনুভূতির কথাগুলো যদি প্রকাশ হয়ে যেতো, যদি কখনো উনি জানতে পারতেন আমি উনার প্রতিটি স্পর্শ-গন্ধ-কথা মনের কোণে সযতনে রেখে দিয়েছি, তখন কি
উনি আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকাতেন? উনার ওই শূন্য বুকটার উপর একটুখানি টেনে নিতেন না? আমার এই অর্ন্তমুখী স্বভাবটা আমার অন্তরটাকে বিরোধী বানিয়ে দিয়েছে, পদেপদে বিমুখ বানিয়ে আজ কতখানি ক্ষতি করে দিয়েছে তাতো লোকের কাছে দেমাকী, অহংকারী উপাধি হিসেবে খোটা পেয়েছি। আর কি চাইবার আছে কিছু? ‘

নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করে জানালা থেকে দৃষ্টি সরালো মেহনূর। জোরে এক লম্বা নিশ্বাস ছাড়লো। হাতের কালিগুলো হালকা হয়েছে বটে, তবে পুরোপুরি মিটে যায়নি দেখে বিরক্তিতে হ্যান্ডওয়াশে আবার চাপ দিলো। ফোস করে একটুখানি লিকুইড হাতের তেলোয় আসতেই পুনরায় ফেনা তুলে কালির জায়গাটা ধুতে লাগলো। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে বাঁহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ডানহাতের তালুটা সমানতালে ঘষতে থাকলো মেহনূর, ওমনেই দরজায় টুকটুক করে শব্দ করে উঠলো। সহসা হাতদুটো থমকে বেসিনের আয়নার দিকে দৃষ্টি তুললো মেহনূর, আয়নার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে পেছনে থাকা বদ্ধ দরজার উদ্দেশ্যে একপলক ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। তখনই বাইরে থেকে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,
– দরজা খোলো মেহনূর।

মেহনূর বিরক্তিতে সেদিকে আর বিশেষ ভাবে পাত্তাই দিলো না। উলটো আকস্মিকভাবে রাগ দেখিয়ে কাজে লিপ্ত হলে হাত ধুতে-ধুতে বললো,

– আমাকে বিরক্ত করবেন না। দরজায় শব্দ করা বন্ধ করুন, এখান থেকে চলে যান।

মেহনূর ভ্রুঁ কুঁচকে কঠিন ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে কাজ করতে থাকলে আবারও বাইরে থেকে বাক্যসুর ভেসে এলো,

– আমি তোমাকে বিরক্তি করছি? রুমটা তো আমার। তুমি কাকে চলে যেতে বলছো?

প্রচণ্ড বেখেয়ালি ছিলো মেহনূর। এমনেই কালির উটকো যন্ত্রনার জন্য রাগ লাগছে, তার উপর বাইরে থেকে এরকম উদ্ভট কথা শুনে বিরক্ত হয়েই জবাব দিলো,

– হ্যাঁ, আপনাকেই চলে যেতে —-

ট্যাপের নিচে কচলাতে থাকা হাতদুটো থেমে গেলো এবার। বুকটায় ধড়াস করে কড়াঘাত বাজতেই গলা শুকিয়ে এলো মেহনূরের। অত্যাশ্চর্য চাহনি নিয়ে ধীরে-ধীরে মাথা তুলে আয়নার দিকে তাকালো, শান্ত-স্থির-স্বাভাবিক নিশ্বাসগুলো ক্রমশ অশান্ত-অস্থির-অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। গলা শুকিয়ে যেনো ঠোঁটের বাষ্পটুকুও শুষে ফেলেছে, খরার মতো শুষ্ক ঠোঁটদুটো মুখের ভেতরে পুড়ে জিভ দিয়ে সিক্ত করলো মেহনূর। ছলছল করে ট্যাপের পানিটাও বন্ধ করার মতো হেলদোল নেই তার , থেমে-থেমে জোরে নিশ্বাস টানতেই বুকটা ক্রমাগত উঠা-নামা করছে। মেহনূর কাঁপা-কাঁপা গলনালিতে বহুকষ্টে ঢোক গিলে মাথা পিছনে ঘুরালো। ট্যাপটা ওভাবেই ছেড়ে মূঢ় ভঙ্গিতে নির্বাক দৃষ্টিতে দরজার দিকে পা বাড়াতে লাগলো। হাঁটতে গিয়ে যেনো ওয়াশরুমের ফ্লোর থেকে ভুলবশত শাড়ি না ভিজে না, সেজন্য বাঁহাতে কুচিগুলো ধরে ধীরগতিতে শাড়িটা উপরে তুললো। দরজার মুখোমুখি এসে ডানহাত এগিয়ে খট করে ছিটকিনি খুললে দরজাটা তখন সরু মতোন ফাঁক হলো। মেহনূর আরেকবার নিজেকে আশ্বস্তরূপে স্বাভাবিক করার উছিলায় চোখ বুজে ঢোক গিললো, দরজার রূপালি হ্যান্ডেলটা ধরে হালকাভাবে টান দিয়ে নিচুদৃষ্টিতে রুমের ভেতরে পা ফেললো। মুঠোয় ধরা কুচিগুলো ছেড়ে দিয়ে নত দৃষ্টিটা উপরে তুলতে লাগলো মেহনূর, উপরে তুলতেই তৎক্ষণাৎ শূণ্য বিছানার দিকে নজর আঁটকে গেলো। দৃষ্টিজোড়া আর উপরে তুলতে পারলো না। শরীরের উপর তখনই বয়ে গেলো ঠান্ডাশীতল হাওয়া, ফুলানো বুকের নিশ্বাসটা ওই ছোট্ট বুকের মধ্যেই আঁটকে গেলো, হাতদুটো সাথে-সাথে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেলো মেহনূরের। যেই বিছানায় একটু আগে ডায়েরী-কলম-বই ছাড়া অন্য কোনো বস্তু ছিলো না, এখন সেখানে নেভি ব্লু শার্টটা খুলে রাখা আছে কোমরের কালো কুচকুচে বেল্টটা শার্টের একপাশে জায়গা নিয়েছে। ব্রাউন রঙের ঘড়িটাও উলটো হয়ে নির্বিকারে ঠাঁই নিয়েছে যেনো। পুরো রুমের ভেতর কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরেছে, নিশ্বাস টানলেই যেনো তিরতির করে মোহনীয় সুভাষটা ইন্দ্রীয়শক্তিকে পৌঁছে যাচ্ছে। মেহনূর অবলীলায় বিশ্বাস করতে বাধ্য, এই মূহুর্তে কি হতে যাচ্ছে। নিজের বেখেয়ালি ভুলের জন্য আবারও তার সাথে রুষ্ট আচরণ করেছে মেহনূর। দফায়-দফায় খারাপ ব্যবহার পেয়ে নিশ্চয়ই মানুষটা স্থির মেজাজে থাকবেনা। তাঁর রুক্ষ আচরণের কঠোরতা না দেখলেও চড়া মেজাজের শঠ ধ্বনি ঠিকই শুনেছে মেহনূর। বিছানায় যেভাবে শার্ট-বেল্ট-ঘড়ি ফেলে রেখেছে, তাতে মনেহচ্ছে রোষানলে দীপ্ত হয়েই ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছে সেগুলো। মেহনূরের অবচেতন সুপ্ত মনটা বারবার জানিয়ে দিচ্ছে, জানালার কাছেই হয়তো মানুষটা রক্তিম মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভেতরটা এখনো অন্ধকারে ডুবে আছে, জানালা দিয়ে বৃষ্টির উন্মত্ত বারিধারার ঝমঝম শব্দ ভেসে আসছে, ফ্লোরস্পর্শী লম্বা-লম্বা পর্দাগুলো এখনো হালকা হাওয়ায় উড়ছে। মনের উপর বল প্রয়োগ করে ভয়ের রেশটা কিন্ঞ্চিৎ কাটালো মেহনূর। তাঁকে একটুখানি দেখার জন্য চোখের ভয়যুক্ত চাহনিটা ধীরে-ধীরে বাঁদিকে ঘুরাতে লাগলো, জানালার অভিমুখে ঘুরাতেই এতোক্ষণ যেই অবস্থাটা মনের উপর হালকাভাবে উত্থাল করছিলো, সেটা তীব্রভাবে মনের কুটিরে হামলে পড়লো। জানালার কাছে নির্বিঘ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম। শোঁ শোঁ করে বৃষ্টির সঙ্গে আসা হিমেল হাওয়াটা তার উন্মুক্ত দেহটাকে প্রাণনাশক বানিয়ে দিয়েছে। সৌষ্ঠব্য দেহের পেশিগুলো শার্টহীনতার কারণে আরো তীব্রভাবে পরিদৃষ্ট। তাঁর হাতদুটো সে বুকের কাছটায় দাম্ভিকতার ভঙ্গিতে, নয়তো ক্ষোভের রোষে ভাঁজ করে রেখেছে। জানালার দুদিকের পর্দাগুলো তাঁর উপস্থিতিতে কেমন চন্ঞ্চলীভূত হয়ে নাচছে। মেহনূর ওই লম্বামূর্তি দেখে দুঠোঁট চেপে ডুকরে কেদেঁ উঠলো। মাথাটা নত করে ভেজা চোখে তার দিকে এগুতে লাগলো। নিঃশব্দ কদমে মানুষটার এগুলেও সেই রোষাক্রান্ত মানুষটা ঠিকই কানের কর্ণধারে পদধ্বনি টের পাচ্ছে। গূঢ় অভিমানের চেয়ে মনের মধ্যে রাগের উত্তাপটাই আজ বেশি। বেহায়ার মতো গাড়ি থেকে না বেরিয়েই মেহনূরকে চিৎকার করে ডাকলো, অথচ মেহনূর একবারও জানালা দিয়ে চুপি দিলো না। আনসারীর নিবাসের প্রতিটা জানালা দিয়ে বাড়ির চাকর-বাকর, মা, মাহদি, বিশেষ দুই অতিথি কৌতুহলের চাপে মুখ বাড়িয়ে দেখলো, কিন্তু নিজের প্রাণান্তিকা প্রণয়ী বউ তাকে একপলক দেখলো না। ইচ্ছা ছিলো, বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকার সময় এমন বদমাইশ ধরনের কাজটা করলে মেহনূর লজ্জায় রাঙা হয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু, বাস্তবে যেটা হলো সেটা অপমান ছাড়া কিছুই হলো না। জানালার ঠিক এই পর্দাগুলোই উড়লো, সেখানে কেউই এলো না। অবজ্ঞার রেশ যদি এখানেই শেষ হতো, তবে মাহতিম নিজের অশান্ত মনকে বুঝ্ দিতে পারতো। কিন্তু এখানে এসেও তার চেয়ে দ্বিগুণ অবহেলার স্বীকার হলো। চারটা মাসের ইতি টানার পর, মাহতিম আশায় ছিলো এবার হয়তো মেহনূর দূরত্বের গুরত্ব বুঝবে। যেই সুক্ষ্ম একফালি দূরত্ব তাদের প্রণয়পর্বে ফাঁক ছিলো, সেটা মেহনূর নিজেই ঘুচিয়ে আদর করবে। সেটার পরিবর্তে মেহনূর তাঁকে চলে যাওয়ার বাসনা ব্যক্ত করে বুঝালো। চারটা মাসের ভেতর কতরাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে, কতবার ঝিমুনি চোখ নিয়ে কাজ সেরেছে, নিজের আবেগের দুয়ার আবদ্ধ রেখে দুটো ইচ্ছের কথা পযর্ন্ত ফোনালাপে জানায়নি। এতোকিছু কার জন্য করলো? মাহতিম বৃষ্টির প্রবলধারার দিকে আর তাকিয়ে রইলো না, চোখদুটো নিবিড়তায় আচ্ছন্ন করে বন্ধ করলো। কানে পায়ের আওয়াজটা তীব্র হতে-হতে কাছে এসে থেমেছে। কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য রুমটা শান্ত, স্তব্ধ হয়ে থাকলো, বৃষ্টির পতনধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। মাহতিমের কাছাকাছি এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর, কথা বলার জন্যই মূলত এতোসময় যাবৎ সময় নিচ্ছিলো। কি কথা দিয়ে গা ঢাকা দিবে সেটা কোনোভাবেই হাতড়ে খুঁজে পাচ্ছিলো না। শেষমেশ কিছু একটা বলার উদ্দেশ্যে গলাটা একটু সাফ করতেই আস্তে-আস্তে বলে উঠলো মেহনূর,

– হাতমুখ ধুয়ে নিন। আপনার খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিচ্ছি।

মাহতিম চোখ না খুলেই নিগ্রহের সাথে বললো,
– খাবো না। তুমি তোমার রুমে যাও।

কথাটা তীরের মতো বিঁধে উঠলো, সাথে-সাথে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। চারটা মাস ধরে নিজেকে এই রুমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভেবেছে, যদিও এই রুমের উত্তরোত্তর ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক তেমন অটুট হয়নি, তাই বলে সে কখনো নিজেকে অযোগ্য ভেবে কার্পণ্য করেনি। কন্ঠের আভাস ও কথার অবস্থা দেখে মন থেকে পরিস্কার হলো মাহতিম আসলেই শান্ত নয়। মেহনূরকে যেতে না দেখে এবার শঠতা বজায় রেখে ধমকে উঠলো মাহতিম,
– তুমি তোমার রুমে যাও মেহনূর আফরিন! আর অবহেলা দেখিয়ে আমার যন্ত্রণা বাড়াতে এসো না। প্লিজ আউট! যেতে বলেছি যাও!

ধমকের কঠোরতা দেখে ওই মূহুর্ত্তেই কয়েক পা পিছিয়ে গেলো মেহনূর। আশ্চর্য হয়ে হতে গিয়ে বাকশূন্য হয়ে গিয়েছে সে। আনমনে পিছাতে-পিছাতে চোখের পলকেই পা ঘুরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো মেহনূর। দরজাটা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হতেই চোখ খুলে তাকালো মাহতিম। মুখটা বাঁকাধের দিক এনে আবার জানালার বাইরে দৃষ্টিপাত দিলো।

.
মারজা এখনো আহাম্মক হয়ে আছেন। তাঁর ছেলে যে এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলো, কিভাবে ছুটির ব্যবস্থা করলো, আপাতত কিচ্ছু মাথায় ঢুকছেনা। অনবরত পানি খেয়ে-খেয়ে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছেন, মাহতিম কি অনামিকার জন্য ফিরে এলো? নাকি মেহনূরের টানে বাড়িমুখী হলো? মাহতিমের কার্যকলাপ দেখে যেটাই অনুমান করতে যান, দিনশেষে দেখা যায় সেটার উলটোটটা করে দেখায়। এই ছেলে ঠিক তার বাবার আদল পেয়েছে। বাবাও যেমন ফট করে একটা কাজ করে বসতো, মাহতিমও চট করে কাজ করে দেখায়। মারজাকে চিন্তিত দেখে রুমের দরজার মুখে দাঁড়ালো রজনী, সে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাইনিং স্পেসের দিকে পা বাড়িয়েছিলো, কিন্তু মারজার রুমে এভাবেই চোখ ফেরতে গিয়ে তাকে চিন্তিত দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। রজনী কিছুকৈষণ আপনমনে ভেবে নিয়ে দরজায় এবার শব্দ করলো, মারজার চিন্তাগ্রস্থ দুনিয়াটা তার দিকে আর্কষণ হলে রজনী হাসি দিয়ে বললো,

– আপা, খাবেন না?

মারজা চিন্তার রেশটা এখনো কাটাতে পারেননি, তাই সদুপরি হাসিটা দিয়ে একটু বেগ পেতে হলো উনার। রজনীর দিকে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললেন,
– আমিতো খেয়েছি ভাবী। মেহনূর একটু আগে এসে খাইয়ে গেলো।

রজনী এটা ভালো করেই জানতো, মেহনূর এখন সংসারের দিকে তৎপর হয়েছে। মেয়েদের সুখের জন্য সর্বোপরি চাবিকাঠিটা তাদের শ্বাশুড়ির হাতে থাকে, মেহনূরের মতো গেঁয়ো ধুরন্ধরটা ঠিক এখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। এরা সরল-সোজা সেজে থাকে ঠিকই, কিন্তু তলে-তলে ষোলকলা ঠিকই বুঝতে জানে। রজনী কথার হাওয়াটা পরোক্ষ করে একটু খোঁচা দিয়ে বললো,

– আপা, আপনি মনে কিছু না করলে একটা কথা বলতে চাই। আপনাকে নিজের মানুষ ভাবি বলেই কথাটা বলা। মাহতিম তো কমবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলো এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপা আপনার কি মনেহয়না আপনারা ওকে নিয়ে একটু বেশি আহ্লাদ করছেন? মেয়েটা গ্রামের বলে বেশি সোহাগ দিবেন, পরে দেখা যাবে সবার মাথায় চড়ে চুল ছিঁড়তে শুরু করেছে। পুরুষ মানুষদের কোনো ভরসা নেই আপা। পুরুষ আর ছাগল সুযোগ পেলে মুখ দিতে ভুলবেনা। এদের বেঁধে রাখার টেকনিক —

রজনীর তির্যক ইঙ্গিতের কথাটা চট করে কেটে দিলেন মারজা। তিনি যথেষ্ট কৌশলী হয়ে ব্যাপারটা অনুকূল্য সূচকে বললেন,
– আপনি পুরুষকে ছাগলের সাথে তুলনা করলেন ভাবী। তারা যদি সুযোগ সন্ধানী হতো তাহলে তাদের জগতের নিয়মটা বিচিত্রই হতো। কোনো সভ্য পুরুষ সমাজে থাকতো বলে মনেহয় না, আর বিয়ে নামক বিশ্বাসটাও হয়তো পাশ্চাত্য দেশের মতো ছকি-নকি খেলার মতো দেখতো।

রজনী হাসি দিয়ে ব্যাপারটা আড়াল করার চেষ্টায় বললো,
– আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন আপা। কথাটা আমি বলিনি। কোনো এক বিশিষ্ট লেখক কথাটা বলেছিলো। আমি সেটাই এখানে —

আবারও নির্বিকারে কথা কাট করে নিজের মত পেশ করলেন মারজা,

– লেখকের উক্তি আর কথা খাপ-খাওয়ানো পরিবেশের জন্য বহাল ভাবী। সবখানে যে ওই কথাগুলো ব্যবহার হবে এমনটা তারা নিজেরাও বলেন নি। যেগুলো অসভ্য,কু’জাত ধরনের পুরুষ ওগুলোর স্বভাব ওই মুখ দেওয়ার মতোই। ভালো ঘরের সন্তানরা ওসব চিন্তার ভেতরও আনে না। আমি সন্তান পেটে ধরেছি তো, আমি জানি আমার সন্তানের স্বভাবটা কেমন। যেই বাড়িতে গিয়ে দিনের-পর-দিন থেকেছি, ওই বাড়িতে মুখ দেওয়ার মতো অবস্থা ভালোই ছিলো। আমার একটা সন্তানও ওরকম জঘন্য কাজ করেনি। ছেলে বিয়ে করতে চেয়েছে, বিয়ে করিয়ে দিয়ে বউ তুলে এনেছি।

মারজার কথা শুনে ভেতরে-ভেতরে জ্বলে উঠলো রজনী। ঠোঁটের উপর প্রাণবন্ত মিথ্যা হাসি ছাপিয়ে এমন ভান করলো যেনো সে মারজার কথায় সন্তুষ্ট। আজ রজনী চুপটি থেকেই কড়া কথাটা হজম করে নিলো। অপেক্ষায় আছে কবে মারজাকে চিকিৎসার ফ্যাসিলিটিসের জন্য এ্যাব্রড পাঠানো হবে। মারজার বিদেশ যাওয়ার সময়টা কিভাবে ঘনিয়ে এসেছে, সেটা হয়তো আর কেউ তেমন খেয়াল করেনি। এক-এক করে বাড়ি থেকে সব সদস্য কমিয়ে মূখ্য কাজটায় খুব সুন্দর করে হাতটান করবে রজনী। শুধু একবার এই মারজা ভিসার কাজটা শেষ করুক, দ্রুত হাট গুটিয়ে চিকিৎসার জন্য যাত্রা ধরুক, বাকিটা এভাবেই কন্ট্রোলে চলে আসবে।
.
অনেক তোষামোদের পর মারজার অবস্থা দেখে ডাইনিং টেবিলে বসলো মাহতিম। আসার পর থেকে সেইযে রুমে ঢুকেছে, এরপর আর বের হয়নি। খাওয়ার প্রতি মোটেই ইচ্ছাকর্ষণ নেই, তবুও মায়ের প্রত্যক্ষ জোড়াজুড়ি দেখে মায়ের হাতেই কয়েক লোকমা খেতে বসলো। অনামিকা কঠোর ডায়েট করছে দেখে রাতে সে খেতে আসেনি, কেবল এক গ্লাস দুধ খেয়ে মাহতিমের সাথে কুশলাদি করে চলে গিয়েছে। রজনী চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে, বিশেষ দৃষ্টিটা মাহতিম ও মেহনূরের উপর বর্তায়মান। অন্যদিকে ভ্রুঁ কুঁচকে মুখ ফুলিয়ে মা ও ভাইয়ের তামাশা দেখছে মাহদি। মাহদির পেছনেই চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর। প্লেটে ভাত মেখে রাখলেও মায়ের আহ্লাদী অবস্থা দেখে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে মাহদি। জ্বলজ্বল করা রাগী দৃষ্টিদুটো একবার ভাইয়ের দিকে, আরেকবার মায়ের দিকে ছুঁড়ছে। শেষমেষ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে গজগজ করে উঠলো মাহদি,

– ভাইয়াকে উতুবুতু করে খাওয়াচ্ছো, আর আমাকে খাইয়ে দিতে বললে তখন, ‘ এখান থেকে যা, বড় হইছিস না ‘ বলে দূরদূর করে সরিয়ে দাও। তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না মা। একদম ভালোবাসো না। তুমিযে ভাইয়ার জন্য পাগল আবারও প্রমাণ হলো। আমিও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো। সেদিন তুমি কাঁদলেও আমি ফিরে আসবো না। এই কথা আমি বউকে ছুঁয়ে বলে দিলাম!

কথাটা রাগের মাথায় অকপটে বলেছিলো মাহদি, কোনোরূপ না ভেবেই ফটফট করে বলে দিচ্ছিলো। ওমন অশুভ কথায় মেহনূর চমকে উঠে তাড়াতাড়ি মাহদির মুখটা চেপে ধরলো, দারুণ রাগ দেখিয়ে চ’ড়ের ইঙ্গিত করে বললো,

– খুব লাগাবো কিন্তু। এগুলো কিসব কথা হ্যাঁ? আর যদি কখনো এরকম বলতে শুনি, যদি শুনেছি এরকম বিশ্রী কথা মুখে এনেছো, তোমার সাথে কোনোদিন কথা বলবো না। আর কখনো বলবে এসব? বলো এসব বলবে?

মেহনূরের ঈষৎ ক্রোধ দেখে মাহদি মিটিমিটি হাসলো, কিন্তু মাহতিম যেনো ভ্রুক্ষেপই করলো না। শেষ লোকমা মুখে পুড়ে চট করে পানি খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাহতিম। খাবার চিবোতে-চিবোতে চেয়ার সরিয়ে পা বাড়াতেই মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

– ওই বদমাশটার মুখে দু’লোকমা ঢুকিয়ে দাও মা। নাহলে ওটা ফ্যাচফ্যাচ করতেই থাকবে।

মেহনূরের দিকে একবারও দৃষ্টি না দিয়ে এবার মাহদির দিকে গরম চোখে বললো,
– তুই আমার সামনে এসব বলা থেকে শতহাত দূরে থাকবি। পাদুটো ধরে এমন আছাড় মা’রবো, জন্মের শিক্ষা পেয়ে যাবি। তোকে সাবধান করে দিলাম। কাউকে ছুঁয়ে-ফুঁয়ে যা-তা কথা বকে যাবি, এক ঘুসি মেরে চাপার খুলে ফেলবো।

দাঁতে দাঁত চিবিয়ে স্বগোতক্তি করে সেখান থেকে প্রস্থান হলো মাহতিম। পুরো রাগটাই যে পরোক্ষভাবে মেহনূরকে দেখিয়ে গেলো সেটা মাহদি বুঝতে পারেনি। মারজা কিছুক্ষণ দু’ভাইয়ের অবস্থা দেখে নালিশী অবস্থা পালন করলেন, মাহদিকে পাশের চেয়ার ডেকে ঠিকই খাইয়ে দিলেন। রান্নাঘরের অবস্থা দেখার নাম করে সেদিকে গিয়ে চোখ ঢাকা দিলো মেহনূর। এতোক্ষণ চোখ-মুখের অবস্থা দেখে মারজা আপাতত সন্দেহ না করলেও মাহতিমের অযৌক্তিক রাগ দেখে কলহের গন্ধটা আঁচ করলো রজনী। নিজের মনে হাসতে গিয়ে হঠাৎ অনামিকার দিকে নজর পরলো। সে নিজের রুমের দরজার সাথে ডানহাতটা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনামিকার সাথে দৃষ্টি বদল হতেই দুজনেই আপন মনে বাঁকা হাসিতে হেসে দিলো।

.

গভীর রাত্রির প্রথম প্রহর চলছে। শীতের আবহকালে বাইরের প্রকৃতিটা যেনো কুয়াশার ধুম্রজালে আবদ্ধ। আকাশে কোনো চাঁদ নেই, চন্দ্রপ্রভার কিরণ নেই, মনের মধ্যে পুলকাভাবের কারণ নেই। চাঁদহীন আকাশটার উপর কতক্ষণ দৃষ্টিপাত করতেই হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা পকেট থেকে বের করে কলার নামটা পরোখ করলো, কানে ফোন ঠেকাতেই প্রথম উত্তরটা দিলো,
– হ্যালো,

ওপাশ থেকে সৌজন্য কন্ঠে নোমান বললো,
– আপনার জরুরী ফাইল আর লাগেজটা কি আজই পাঠাবো স্যার? আমি এয়ারপোর্টে বসে আছি। ইমার্জেন্সী টিকিট নাকি নেই। কি করবো এখন?

মাহতিম দ্বিরুক্তিভাব প্রকাশ না করলে বললো,
– আজ পাঠাতে পারলে আজই। আমার জন্য আজই দরকার। টিকিট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি এয়ারলেন্সে যোগাযোগ করছি, তারা টিকিটটা সময়মতোই দিবে। তুমি শুধু সবকিছু রেডি রাখো।

এদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে মেহনূর। রুমে ঢুকবে নাকি ঢুকবেনা এ নিয়ে ভীষণ দ্বিধায় পড়েছে সে। এর মধ্যে চারপাশ নিরব হওয়ায় মাহতিমের কথোপকথন সবই রুমের বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। মেহনূর কান সজাগ না করলেও টিকিটের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠেছে। টিকিট কিসের জন্য দরকার? মাহতিম কি চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে? মেহনূর পাগলের মতো মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে নিজেকে বুঝিয়ে নিলো, মাহতিম নিশ্চয়ই যাচ্ছেনা। সে এগুলো ভুল বলছে, হয়তো অন্য কাউকে টিকিটের কথা বলছে। হ্যাঁ, এটাই হবে। ওদিকে কলের বিপরীত থেকে টিকিটের ঝামেলা সামলাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাসে বললো নোমান,
– থ্যাংকিউ স্যার। আমি কাল সকালের দিকেই আপনার ফাইল আর লাগেজ নিয়ে হাজির হচ্ছি। স্যার, আপনি কিভাবে বাড়িতে লাগেজটা তুলবেন?আমি কি সাহায্য করবো?

মাহতিমও দ্বিধাক্ষণ বিলম্ব না করে আশ্বস্ত সুরে উত্তর দিলো,
– ওটা তোমার দেখতে হবেনা। আমি সকালের দিকেই বের হচ্ছি। রেডি থাকো তাহলে। লাগেজটার বন্দোবস্ত নিয়ে ভেবে রেখেছি, তুমি জাস্ট টিকিট কনফার্ম দাও।

নোমানের কথা শেষ হতেই মাহতিম কল কেটে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুটো বেজে পাঁচ মিনিট। ঠিক তিনটা বাজলে একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসতে হবে। তিনটার পর মনেহয়না জেগে থাকার কথা। আরো পন্ঞ্চান্ন মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, তিনটা না বাজলে ভুলেও সেখানে যাওয়া যাবেনা। মাহতিম জানালাটা আটঁকে দিয়ে পর্দা টেনে দিলো, রুমটার ভেতর অবস্থা অন্ধকারে ঘনিয়ে গেলো। বুকের চেইনটা একটান দিয়ে খুলে গা থেকে জ্যাকেট খুললো মাহতিম। পড়নের সাদা শার্টটা সেইযে হাতমুখ ধুয়ে পরেছিলো, সেটা খুলে গেন্ঞ্জি পরতে একদম ইচ্ছে করছেনা। শীতের জন্য মূলত ইচ্ছাটা নেই। বিছানায় বসে হেডসাইডের সাথে পিঠ ঠেকালো মাহতিম, পাদুটো লম্বা করতেই ক্রস করে রাখলো। হাতের ফোনটা নিয়ে পন্ঞ্চান্ন মিনিট কাটানোর জন্য মগ্ন হলে এদিকে ভেজানো দরজাটা ক্যাচ করে খুলে যেতে লাগলো। ফোন থেকে চোখ সরে দরজার দিকে তাকালো মাহতিম, ওমনেই চোখের কৌতুহল দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠলো। সেদিক থেকে বেপরোয়া ভঙ্গিতে দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় ফোনের সাদা স্ক্রিনে মনোযোগ দিলো, দরজাটা আস্তেধীরে বন্ধ করার আওয়াজ পেলো মাহতিম। শব্দটা পেতেই নিভিয়ে রাখা রাগটা আবার জ্বালিয়ে নিয়ে তিক্ততার সুরে বললো,

– কোন্ তামাশা দেখাতে এসেছো? সকালে এক তামাশা দেখিয়ে শান্তি পাওনি, এখানে তু —

ঠোঁটের উপর চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলোর চাপ পেয়ে কথা থেমে গেলো মাহতিমের, আচমকা সমস্ত রাগের জোয়ার যেনো তলিয়ে গেলো তার। ফোলা ফোলা ওই লালবর্ণের চোখকে কেন্দ্র করে নিকষ মায়ায় ডুবতে বাধ্য হলো মাহতিম। নিজের সাথে কি হলো নিজেও তখন টের পেলো না।

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অংশ সংখ্যা ০২.

ঠোঁটের উপর চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলোর চাপ পেয়ে কথা থেমে গেলো মাহতিমের, আচমকা সমস্ত রাগের জোয়ার যেনো তলিয়ে গেলো তার। ফোলা ফোলা ওই লালবর্ণের চোখকে কেন্দ্র করে নিকষ মায়ায় ডুবতে বাধ্য হলো মাহতিম। বাতিহীন রুমের ভেতর অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটে গেলো তখন, সেটা নিয়ে চিন্তাও করতে পারলো না সে। একজোড়া অশ্রুপূর্ণ চাহনির মাঝে বাক্য হারিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো, এই প্রথম নিজের উপর জোর খাটানো অধিকার দেখে চুপ হয়ে গেছে মাহতিম। খুবই কাছে, খুবই নিকটে থাকা মুখটার স্নিগ্ধ চোখজোড়া আজ বন্ধ, সেই বন্ধ চোখ থেকে পাপড়ি চুয়ে চুয়ে পানি পরছে, মোটা মোটা অশ্রু ফোঁটাগুলো নির্বিকারে চোয়াল বেয়ে নিচে পরছে, পুরো মুখটা যেনো লালচে আভায় আচ্ছন্ন, নিচের ঠোঁটটা এমনভাবে দাঁতে চেপে রেখেছে যেনো অসহ্য যন্ত্রনাটা কঠিনভাবে গলাধঃকরণের চেষ্টায় আছে। মাহতিম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছিলো না, মুখ দিয়ে কথাও বলতে পারছিলো না, পরিস্থিতিটা কেমন করে স্বাভাবিক হবে সেটাও যেনো জানা নেই তার। ওই পাপড়ি চুয়ে গাল ভিজিয়ে অশ্রু ঝরার দৃশ্য দেখে বুকের মধ্যে যেনো উত্তপ্ত ছুড়ির আঘাতের মতো বিঁধছে। মাহতিম তার হাতের ফোনটা বিছানায় ছেড়ে মেহনূরের গালের কাছে হাত আনলো, কিন্তু হাতটা গালের উপর রাখলো না। অবহেলার অভিমানটুকু এখনো সতেজ হয়ে মনের কোঠায় জেঁকে আছে, বারবার অন্তরের কোমল জায়গায় কেউ কড়াঘাত করে বলছে ‘ থেমে যা, তুই পুরুষ মানুষ, তুই অবলার কাছে ধরা দিবি না। নত স্বীকার করবি না। থাম! ‘ মাহতিম কাঠ হয়ে কিছুক্ষণ ওভাবেই স্থির হয়ে রইলো, বিবেকের দোরগোড়ায় নানা অজুহাত এসে তাকে দূঃসহ যন্ত্রনার ভেতর ফেলে দিচ্ছে। খানিকটা সময় তিরতির করে পেরিয়ে গেলো, গভীর নিশুতি রাত্রিকালীন প্রহর যেনো আরো নিঃশব্দতার ভুবনে তলিয়ে যাচ্ছে। যেখানে মাহতিমের ভেতরে অভিমান-অপেক্ষা-অবজ্ঞার সুরগুলো হিংস্রতার দুনিয়ায় ধাবমান, অন্যদিকে তখন অব্যক্ত-অপ্রকাশ্য-অবসন্ন হৃদয়ের ব্যকুলতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে মেহনূরের। সচল মস্তিষ্কের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিচেতনার মাহতিম প্রিয়তমার একটা ইশারার জন্য অপেক্ষমাণ, সামান্যতম ইঙ্গিতপূর্ণ অবস্থা দেখলে বুকের মধ্যে টেনে নিতে দেরি সহ্য করবে না। আজ কোনো বিধি-নিষেধ, ন্যায়নীতি, আদেশ-আজ্ঞাদেশ কিচ্ছু মান্য করবে না মাহতিম। চার মাসের যেই অসহ্য দহনের অন্তঃক্রীয়ায় সে দগ্ধ ছিলো, সেটা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে উদ্দীপিত হয়ে আশান্বিত চাহনিতে মুখিয়ে আছে। অনেক চিন্তাভাবনার হিসাব কষে শেষমেশ নিজেকে চূড়ান্তরূপে খোলাশা করার উদ্দেশ্যে ঠোঁট থেকে হাত সরালো মাহতিম। হাত সরানোর অনুকম্পন টের পেয়ে অশ্রুসিক্ত ফোঁপানো মুখায়বটা তার দিকে চক্ষু কপাট খুলে তাকালো। নিস্তব্ধ রুমটার শব্দহীন অবস্থার ভেতর দৃঢ় কন্ঠে বললো মাহতিম,

– তোমাকে নতুন করে কিছুই বলার নেই মেহনূর। জেনেশুনে যেহেতু তোমার মতো ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে বিয়ে করেছি, এতে দোষটা আমারই। আমারই দোষ যে, তোমার উপর নিজের সমস্ত কিছুর ভার রাখতে চেয়েছিলাম। আমার প্রোফেশনাল লাইফের সব ট্রার্মে সাকসেস এ্যাচিভ করতে পারলেও তোমার কাছ থেকে নূন্যতম যোগ্যতাটুকুও জুটলো না মেহনূর। হয়তো তোমাকে ফোর্স করেছি দেখে তুমিও ভয়ের চোটে আমাকে অনুভূতির আশ্বাস দিয়ে ফেলেছো। তোমাকে দোষ না দিলেও তোমার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ কাজ করছে। রাগ লাগছে, অসহ্য লাগছে।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো ঝেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করলো মাহতিম। বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লম্বা লম্বা নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো, দৃষ্টিদুটো বিছানার উপর মলিন ভাবে স্থির হয়ে গেছে। ছোট ছোট টুকরোর মতো তার মনটা আজ চূর্ণবিচূর্ণ, চোখ বন্ধ করে যাতনার প্রতিটি দং’শিত নিশ্বাস ঠোঁট খুলে ছাড়ছে মাহতিম। অনবরত নিশ্বাস ছাড়তেই ব্যথার গ্লানিটুকু ভেতরে চেপে অতি কষ্টে ধীরভাবে বলতে লাগলো,

– আমাকে ছেড়ে যেতে পারো মেহনূর। তোমাকে বাধা দিবো না।

হাতের উলটোপিঠে কেবল চোখ মুছতে যাচ্ছিলো মেহনূর, কর্ণধারে বিষাক্ত কিছু শোনার পর মূর্ছার মতো স্থির হয়ে গেলো সে। চোখ মোছার হাতটা ধপ করে কোলের উপর পরে গেলে শরীর নিংড়ে যেনো শেষ শক্তিটুকু কেউ শুষে নিচ্ছে। অবশ-অচল-অকেজো অবস্থার মতো দেহটা যেনো যেকোনো সময় টলে পরবে, মাথাটা মা’রাত্মক ঝিমঝিম করছে। অনেক চেষ্টা শেষে শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলালো মেহনূর, আস্তে-আস্তে ঢোক গিলে গলদেশটা ভিজিয়ে মাহতিমের দিকে স্বাভাবিক ভাবে তাকালো। অ’সভ্য উপাধি পাওয়া মানুষটা এখনো তার নিচু মাথাটা তুলেনি, কি সুন্দর নিঃসঙ্কোচে বলে দিলো ‘ ছেড়ে যাও ‘। মেহনূর হতবিহ্বল অবস্থায় থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটা এগিয়ে মুঠোবন্দি করা হাতটা ধরলো, শক্ত হাতটা কুড়িয়ে নিতেই হঠাৎ মাথা তুলে কপালে ভাঁজ ফেলে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো মাহতিম। ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো,
– কি করছো মেহ —

কথাটুকু অর্ধপূর্ণ হয়ে গলায় আঁটকে গেলো মাহতিমের, সে আর কথাটা সম্পূর্ণ করার সুযোগ পেলো না। শীতের শিশির ফোঁটা যেমন পাতার বুকে আশ্রয় পেয়ে সেখানেই জ্বলজ্বল করে নিজের দীপ্ত মহিমা ছড়িয়ে দেয়, তেমনি মাহতিমের শক্ত-প্রশস্ত বুকটার উপর নিজের চাপা অনুভূতি উন্মুক্ত করে মনের কিষ্টে-দহনে হু হু করে কেঁদে উঠে মেহনূর। সাদা শার্টের বেশে ঢেকে যাকা মাহতিমের দেহটা আজ নিজের কাছে রাখার চেতনায় খামচে ধরেছে। ওই দীর্ঘাটে মানুষটার পেশিবহুল পিঠটাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরলো মেহনূর, তার বুকটার মধ্যে নির্দ্বিধায়-নির্বিঘ্নে মুখ গুঁজে দিলো সে। পিঠের উপর সাদা শার্টটাকে মুঠোর মধ্যে খামচে ধরতেই নখের আকস্মিক ব্যথায় তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। ওমনেই দুপাটি দাঁত শক্ত করে ব্যথাটা হজম করে চোখ খুলে তাকালো। মাথাটা ঈষৎ নিচু করে নিজের বুকের দিকে তাকাতেই কান্নায় ফুলে-ফুলে উঠা মেদহীন পিঠটার দিকে চোখ পরলো তার। গাঢ় বেগুনী রঙের ব্লাউজটা যথেষ্ট পাতলা, সেই সঙ্গে শীত নিবারণের জন্যও যথেষ্ট অনুপযুক্ত পোশাক। চুলের খোপাটা খুলে ঘাড়ের নিচে ঝুলে আছে, ব্লাউজ ও শাড়ির মধ্যবর্তী অংশটুকু উন্মুক্ত হয়ে কোমরের টানটান চামড়াটা পরিদৃষ্ট। রুমে থাকা মৃদ্যু মাত্রায় সচল এসির হিমে স্বল্প উন্মুক্ত পিঠের সমস্ত পশম কাটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শরীরটাও ভয়াবহ ঠান্ডা মেহনূরের। মাহতিম দ্রুত তার খুলে রাখা জ্যাকেটটা হাত বাড়িয়ে ডানপাশ থেকে নিতে গেলে বাধা দিলো মেহনূর। অস্ফুট সুরে ফুঁপিয়ে উঠলে আঁটকে আসা গলাতেই বলতে লাগলো,

– আমার হাতে কালি লেগে গিয়েছিলো, আমি কালি পরিষ্কার করতে ওয়াশরুমে ছিলাম। আমার ভাগ্য খারাপ, আমার জানতাম না আপনি আমায় ডেকেছেন। আমি সত্যিই পানির আওয়াজের জন্য আপনার ডাক শুনতে পাইনি। যদি একবার বুঝতাম, যদি একবার জানতাম আপনি চলে এসেছেন, আমি কখনোই ওই ভুলগুলো করতাম না। আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবেন না। দোহাই, আমাকে মাফ করুন। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার সাধ্যটুকু আমার নেই। আমি নিজেই স্বাভাবিক থাকবো না। আমার অবস্থা আপনি ছাড়া কে বোঝে বলুন? কেউতো আপনার মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরের অবস্থা বুঝে না। আমি কিচ্ছু পারিনা, কিচ্ছু পারিনা, ঠিকঠাক মতো কিছু বলতেও পারিনা। আমার কথাও এলোমেলো হয়ে যায়। আমি কোথায় যাই বলুন? আম্মা, বড়মা, বুবু, দাদাভাই কেউ এখানে নেই। প্রতিদিন দেখতাম, আপনি সবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, আমি পাগলের মতো অপেক্ষায় থাকতাম। অথচ দেখতাম, আপনি কল কেটে দিতেন। আপনার সাথে একটু কথা বলার জন্য কত অপেক্ষায় থাকতাম আপনি জানেন না। যাওয়ার দিন যখন ভুলবশত কিছু বলে ফেললাম, সেটার জন্যও আপনি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। আপনি বিয়ের আগে ভালো ছিলেন, বিয়ের পর আপনি আমাকে আর মূল্য দেন না। আপনি আমাকে ছাদের রুমে একা-একা থাকতে বলছেন, আমি শত ভয় পাওয়া সত্ত্বেও দ্বিমত করিনি। একা একাই ওই রুমটার ভেতর থেকেছি। যতো বারই দুঃস্বপ্ন দেখতাম, মনে মনে ওই অন্ধকার ঝুপড়িতে আপনাকে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতাম, আপনাকে আমি পেতাম না। আপনাকে ছাড়া আমার এই শহরের মধ্যে থাকার সাহস নেই, আমি গেঁয়ো, অচল, গাধা। আমি কারোর সাথে সখ্যতা করতে পারিনা, আমি কিচ্ছু করতে পারিনা, কাউকে মন খুলে দুটো কথা বলতে পারি না, আমার চুপচাপ আচরণ দেখে সবাই আমাকে অহংকারী ভাবে। আমি কি করবো বলুন? আমি নিজেও জানিনা কিভাবে কি করবো, আমি কখনো মানুষের সাথে মিশিনি। আপনি শাস্তি দিতে চাইলে কঠোর কঠোর শাস্তি দিন, আমাকে মে:রে ফেললেও আমি কিচ্ছু বলবো না, কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবেন না। গ্রামের গেঁয়োদের মতোই রেখে দিন, উপন্যাসের ওই অবলাদের মতোই ফেলে রাখুন, আমি ওই অবলাদের মতোই ঘরের এককোণে থেকে যাবো। তবুও ছেড়ে যাবো না।

জমাটবদ্ধ কথাগুলো ব্যক্ত করে প্রচণ্ড ক্লান্ত অনুভব করছে মেহনূর, নাক টেনে একটু সুস্থির অনুভব করলে চোখের ফোলাভাবের জন্য এখন চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। নাক বন্ধ হওয়ার ফলে ফিসফিসিয়ে মুখ দিয়ে নিশ্বাস টানছে, মাথা ভারী হয়ে প্রচণ্ড টনটন করে ব্যথা করছে। পিঠের উপর হাতদুটো শিথিল করতেই মুঠো থেকে সাদা শার্টটা মুক্ত হয়ে গেলো, নিস্তেজ পরিবেশটা সুনশান শব্দে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পরিণত হলো। দূর থেকে হুটহাট ট্রাক চলার গমগম শব্দ ভেসে আসছে, সেই সঙ্গে দু-একটা বেতাল সুরের হর্ণও শোনা যাচ্ছে। মেহনূর অনেকক্ষণ পর স্বাভাবিক হওয়ার জন্য বুক থেকে মাথা উঠাতে গেলো, কিন্তু ক্লান্তির জন্যই হোক, বা অন্য কোনো কারণে, সে কোনোভাবেই মাথা তুলতে পারলো না। প্রথমে ভেবেছিলো, মাথা ভারী হওয়ার কারণে এমন সমস্যাটা হচ্ছে কিন্তু সেই চিন্তাকে ফাঁকা করে আসল ব্যাপারটা ধরতে পারলো মেহনূর। অনুমানটা ঠিকঠাক ধরতেই হঠাৎ কানের কাছে মৃদ্যু সুরের কন্ঠ শুনতে পেলো,

– রাতটুকু থেকে যাও। আমি কিচ্ছু করবো না।

চোখ খুলেও অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছে না মেহনূর, হাতটাও ছাড়াতে পারছে না সে। মাহতিমের বাহু বেষ্টনের মাঝে বন্দি হয়ে ছটফট করারও সুযোগ নেই আজ। যদি মাহদি এই রুমে ভুলবশত ‘ ভাই,ভাই ‘ করতে-করতে ঢুকে যায় তাহলে এলাহিকাণ্ড ঘটে যাবে। মেহনূর আগাম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মাহতিমের পিঠে হাত ছুঁয়ে-ছুঁয়ে বলতে থাকে,
– মাহদি আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না। আমি ওকে মোবাইল ধরিয়ে বুঁদ করে চলে এসেছি। ওকে একটু দেখে আসি, ছাড়ুন।

মেহনূর বহু চেষ্টা চালিয়ে হাতদুটো টেনে এনে মাহতিমের বুক বরাবর ধাক্কা দিলো, লাভের-লাভ কিছুই হলো না, উলটো বাহুযুগলের মাঝে চাপ খেয়ে দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। মেহনূর বারবার অনুনয় বিনয় করতে লাগলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য, মাহদি যদি দেখে ফেলে তাহলে মারজার কানে যেতে এবার কেউ বাধা দিতে পারবে না। এদিকে মাহতিম এক কান দিয়ে ঢুকাচ্ছে, অন্য কান দিয়ে সুড়ঙ্গের মতো সুড়সুড় বের করে দিচ্ছে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সত্যি সত্যিই রুমের বাইরে থেকে ‘ ভাইয়া, ও ভাইয়া ‘ বলে ডাক শোনা গেলো। কন্ঠটা চিনতে পারলো দুজনই, দুজনই মারাত্মক চমকে উঠে হাতজোড়া শিখিল করে দরজার দিকে তাকালো। মাহতিমের তো ইচ্ছে করছে ফাজিলটাকে পিটিয়ে তক্তা বানাতে, এদিকে মেহনূর তো ভয়েই জব্দ। দরজার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুজনই একে-অন্যের মুখের পানে তাকালো, মেহনূরের অবস্থা দেখে মাহতিমের বড্ড হাসি পাচ্ছে। প্রেম করার সময় যেমন বাবার ভয়ে মেয়ে লুকিয়ে থাকে, তেমনি একটা ভাবভঙ্গী ধরে ভীতু বনে আছে মেহনূর। মেহনূরের কপালের উপর থেকে ছোট ছোট চুলগুলো ডানহাতের তর্জনী দিয়ে সরিয়ে দিতেই হাসতে-হাসতে বললো মাহতিম,

– ঘরে স্বামী রেখে দেবরের সাথে লুটোপুটি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, আমার মান-সম্মান, ইজ্জত, অর্জন সব শেষ করলে?

মেহনূর কপট রাগ দেখিয়ে ভ্রুদুটো কুঁচকালো। ক্ষীণ রাগের রেশে বলে উঠলো,
– আপনি কার সাথে কিসের তুলনা দিচ্ছেন?

মাহতিম হাসি থামিয়ে চোখ স্বাভাবিক করলো। আপাতত উত্তর না দিয়ে মেহনূরকে কম্বলের নিচে আপাদমস্তক ঢেকে শুতে বললো। মেহনূর কথার পিঠে প্রশ্ন ছোঁড়ার সাহস পেলো না, ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া প্রশ্ন ছোঁড়ার নিয়ম স্বামীর সাথে খাটানো ঠিক না। বড়মার কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা নিয়ে সেই মতেই কাজ করলো মেহনূর। এদিকে দরজা খুলে হুলস্থুল ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকলো মাহদি, রুমে ঢুকতেই ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর সুরে বললো,

– ভাইয়া, এই তুমি আমার বউকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো? ও নিজের রুমে নেই, মায়ের রুমেও নেই, কিচেনও নেই। কোথায় ও!

মাহতিমও পালটা উত্তর ছুঁড়ে দাম্ভিকতার সাথে বললো,
– রাতে কি টাটকা চড় খেতে এলি? লাগাবো? লাগালে কিন্তু ওই সাইড দিয়ে ভাত চিবাতে পারবিনা।

আলমারির ডান দ্বারটা খুলে কাঠের ড্রয়ারটা টান দিলো মাহতিম। মাহদির কথাটা স্পষ্ট ভাবে কানে শুনেছে সে। ফা’জিলের ‘ বউগিরি ‘ স্বভাব আজ কেমন করে ছুটিয়ে ছাড়বে সেটার জন্য জম্পেশ একটা শিক্ষা রেডি করছে। কম্বলের নিচে ভয়ে কাহিল অবস্থা মেহনূরের, যদি কম্বলটা খপ করে টান মারে তাহলেই খেলা শেষ। মাহদি নিজের উত্তর না পেয়ে মুখ কাঠিন্য করে কোমরে দুহাত রাখলো, ভাইয়ের কাছে কয়েক কদম এগিয়ে এলে মাহতিম ঠাস করে ড্রয়ার লাগিয়ে আলমারির দ্বার বন্ধ করলো। মাহতিম কাঙ্ক্ষিত বস্তুটাকে ডানহাতে কায়দা করে পেঁচাতে থাকলে পেছন থেকে মাহদি ফের বলে উঠলো,

– তুমি আলমারীতে ওকে লুকিয়ে রেখেছো তাইনা?

চোখ দুটো খিঁচুনি দিয়ে হাসি আঁটকালো মাহতিম, ভুলেও পিছু ফিরে তাকালো না। পেছন থেকে ভাইয়ের অবস্থাটা ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলে হঠাৎ কম্বলের দিকে নজর চলে গেলো। কম্বলের ওমন ভূতুড়ে কাঁপুনির নড়াচড়া দেখে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শিউরে উঠলো মাহদির। হরর সিরিজের দৃশ্যপট মনে পরতেই ‘ ও মাগো, ভাইয়া ‘ বলে চিৎকার দিয়ে তৎক্ষণাৎ মাহতিমকে পেছন থেকে জাপটে ধলো। হুট করে চিৎকারের কারণ বুঝতে পারলো না মাহতিম, সাথে-সাথে মাহদির দিকে ঘুরে দাঁড়ালে মাহদিকে কারণ দর্শাতে বললো। মাহদি ঢোকের-পর-ঢোক গিলতেই চোখমুখ খিঁচে তর্জনী তুলে বিছানার দিকে ইশারা করলো। ইশারা করতে দেরি ওমনেই ঘরের বাইরে পা চালিয়ে ভোদৌঁড়ে ছুঁটে পালালো। দুহাতে কম্বল সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মেহনূর, হাসতে-হাসতে মুখ দিয়ে কথাই বেরুচ্ছে না তার। মাহতিমও সেই অবস্থা নিজের হাসি সামলাতে না পেরে হো-হো হেসে দিয়েছে। আচমকা হাসি থামাতে-থামাতে মাহতিমের দিকে মুগ্ধনেত্রে স্থির হয়ে গেলো মেহনূর। অস’ভ্য, নি’ষ্ঠুর, বে’পরোয়া মানুষটার হাসিটা হেসে আজ মেহনূর উপন্যাসের চরণযুগল মনের ভুবনে আওড়াতে লাগলো,

মলিন মুখে ফুটুক হাসি, জুড়াক দু-নয়ন।
মলিন বসন ছাড়ো সখা, পরো আভরণ।

( সংগৃহীত চরণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
.

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .