মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৬০+৬১

0
736

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬০.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

একটা কালো ছায়া স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কোনো নড়াচড়া করছেনা ছায়াটা! মূহুর্ত্তেই লাফ দিয়ে উঠলো মাহতিম! বুঝতে পারলো সে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। সর্বনাশ! দ্রুত কোমরের পিছনে ডানহাত চালান দিলো, কোমরে গোঁজা পিস্তলটা দক্ষ হাতের কবজায় এনে সোজাসুজি তাক করলো! লাইব্রেরির কাছটায় জান্তব ছায়াটা অন্ধকার থেকে উঠে আসছে, গম্ভীর ভাবে ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে, ঠিক মাহতিমের দিকেই দৃষ্টি রেখেছে। মাহতিম পিস্তলটা নাক বরাবর ধরে টার্গেট ঠিক করলো, যদি ছায়াটা সন্দেহজনক ব্যাপার ঘটায় তাহলে এক মূহুর্তও দেরি করবে না। মাহতিমের পেছনে খোলা দরজা, সেখান দিয়ে সন্ধ্যার ফ্যাকাশে আলো ঢুকছে। চোখ সইয়ে তাকিয়ে থাকতেই ছায়াটার মুখ পরিদৃষ্ট হলো, ঠোঁটে বিদঘুটে হাসি ঝুলিয়ে দাঁত বের করে আছে। ভাবটা এমন মাহতিমকে দেখে যেনো দারুণ বিনোদন পেয়েছে। মুখটা দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো মাহতিম! হাতের পিস্তলটা মূর্হতের জন্যও টার্গেট বরাবর সরালো না, কন্ঠে দাম্ভিকতা ফুটিয়ে তেজের সাথে বললো,

– তুই এই বাড়িতে কিভাবে ঢুকলি?

প্রশ্ন শুনে মুখটা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। হাসতে-হাসতে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললো সে। মাহতিম পুরোপুরি সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, একটুও অসতর্ক হওয়া যাবে না। হাসিটা কোনোমতে চেপে মুখ তুললো লোকটা, মাহতিমের দিকে তাকাতেই মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো। কয়েক হাত দূরত্ব রেখে তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,

– তাইলে আমারে চিনতে পারছেন? আপনের ব্রেইন তো দেখি মাশাআল্লাহ। আইচ্ছা আমার নাম কি কন তো দেহি?

দাঁতে-দাঁত পিষলো মাহতিম। পিস্তলের বাঁটটা দিয়ে সজোরে মাথার বারি লাগাতে ইচ্ছে করছে! জবাবটা সাথে-সাথে না দিয়ে চুপ থাকলো মাহতিম, শয়,তানের সাথে মুখ নাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু অপরপক্ষের ব্যক্তি মাহতিমের চুপ থাকাকে মান্য করলো না, আবার একগাল হাসি দিয়ে গুমর ভাবে বললো,

– আনসারী সাহেব দেহি চুপ কইরা আছে। নাম কি মনে নাই? ভুইলা গেছেননি ভাই সাহেব?

রাগে মাহতিমের ভেতরটা টগবগ করছে। নির্ঘাত শয়,তানটার মাথায় কুবুদ্ধি আছে, ও সোজা ধাতের লোক না। সময় নষ্ট না করে মাহতিম শক্ত গলায় বললো,

– তুই সাইদুল বা:ন্ঞ্চোত না?

গালি খেয়ে হোহো করে হেসে উঠলো সাইদুল। মাহতিমের মুখে ‘ গালি ‘ শব্দটা কতটা বেমানান এটাই যেন হাসির ছলকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। মাহতিম কৌশলের সাথে একপা সামনে এগুলো। হাস্যরত সাইদুলকে একটুও ঠাহর করতে দিলো না। চুপ করে এগিয়ে যেতেই আরেকটু সাবধানতা অবলম্বন করলো, সাইদুল যখন হাসি থামিয়ে তাকালো ততক্ষণে পরিস্থিতি বিগড়ে গেছে। আকস্মিকভাবে নিজের উপর ঝাঁপিয়ে পরলো কিছু, চোখ মেলে তাকানোর সুযোগও পেলো না। পিস্তলের শক্ত বাঁট দিয়ে জোরে বারি খেলো, ব্যথায় আর্তনাদ করে আহাজারি করলো সে! জানটা বুঝি বেরিয়ে গেছে! চিৎকারের তীব্র ধ্বনিটা শূন্য বাড়িটায় ঝনঝন করে বেজে উঠলো। শব্দটা অন্ধকার বাড়ির দেয়ালে-দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। মাথায় এক চোট মেরেই সাইদুলকে ধরাশায়ী করলো মাহতিম। অন্ধকারটা ভালোই কাজে লেগেছে, তাড়াতাড়ি আঙিনার বাতিটা জ্বালিয়ে দিতেই পুরো বাড়িটা ফকফকা হয়ে গেলো। চৌকির একপাশে পরে আছে সাইদুল, মাথার ডানদিকটা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে, প্রচণ্ড ব্যথায় গোঙাতে-গোঙাতে একপর্যায়ে বেঁহুশ হলো সে। আবারও মোল্লাবাড়িটা নিঃশব্দ-নিঃসাড় হয়ে পরলো। চারধার ছাপিয়ে দূরের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসলো। তার মানে কাটায়-কাটায় পাক্কা এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এতোক্ষনে নিশ্চয়ই সবার রেসোর্টে পৌঁছার কথা। সবাই ঠিকঠাক মতো পৌঁছালো কিনা আপডেট শোনা দরকার। পকেট থেকে ফোন বের করে কল বসালো মাহতিম। বাঁ-কানে ফোন রাখতেই কোমরের কাছে প্যান্টের সাথে পিস্তুল গুঁজতে নিলো। চোখ তুলে সাইদুলের দিকে নিরস্ত দৃষ্টি রেখে কলিং টোন শুনতেই পেছন থেকে খসখসে আওয়াজ হলো! টান-টান নার্ভে সতর্ক হলো মাহতিম! কান থেকে ফোন সরিয়ে চটজলদি পিস্তল খাবলে ধরলো। পেছন ঘুরে তাকাতেই কল কেটে পিস্তল তাক করলো, ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সাদা পাণ্ঞ্জাবী। এনার্জী বাল্বের আলোয় চতুর মুখটা গম্ভীর দেখাচ্ছে। দু’হাত পিছমোড়া করে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় নতুনের মতো সাদা টুপি, মুখের ভাবভঙ্গি অনিশ্চিত। মাহতিম কয়েক মিনিট নিশ্চলভাবে তাকিয়ে থাকতেই বাঁকা হাসি দিলো। পিস্তলটা ধীরে-ধীরে নামাতেই নিটোল হাসিতে বললো,

– খালিহাতে আসাটা ঠিক হয়নি।

চট করে বাক্য ছুঁড়লো,

– কে বললো এ কথা? যে বলেছে সেতো একটা বলদ। তোমার কি মনেহয় আমি খালিহাতে বেড়াই?

মোবাইলটার দিকে না তাকিয়ে সেটা পকেটে রাখলো মাহতিম। পিস্তলটা এখনো হাতে রাখলেও যেকোনো মূহুর্তের জন্য রেডি। হান্নান শেখ স্বাভাবিক ভাবে এগুতে নিলো, কিন্তু বাধা দিলো মাহতিম। ঝাঁঝের সাথে বলে উঠলো,

– সামনে আগাবেন না কালাম সরদার। একটা পা আগালে আমি ট্রি:গার চাপতে বাধ্য হবো।

তীর্যক চাহনিতে মাহতিমের দিকে তাকালো হান্নান।হাতে একটা পিস্তল নিয়ে যেই সাহস দেখাচ্ছে, সেটা গুড়াতে মাত্র এক মিনিট লাগবে। ও নিজেও জানেনা ওর কপালে আজ মুক্তি নেই। মোল্লাবাড়ির চারপাশে সেও ধূর্ত ফাঁদ পেতেছে। সেই ফাঁদে ভয়ানক ভাবে পেঁচিয়ে গেছে মাহতিম। নিজের অজান্তেই এতো বড় বোকামি করেছে যে, সেটার জন্য একটু পরেই পস্তাতে হবে। কাউকে নিচু চোখে দেখতে নেই এটা মানুষ জানে না। নিচু করে দেখা মানেই অপরপক্ষকে সুযোগ দেওয়া। যদি সুযোগটা খাপে-খাপে লাগানো যায়, তাহলে সফল হতে দেরি নেই। হান্নানকে চুপ থাকতে দেখে বাঁ ভ্রুঁ-টা উঁচু মাহতিম, তার তীক্ষ্ম চাহনি দেখে ভড়কানো হাসি দিলো হান্নান। কিছুটা উত্তাপের সাথে বললো,

– বাড়ির মানুষগুলোকে যেখানে পাঠিয়েছো, তাদের ফিরে আসতে বলো। আমি চাই মীমাংসাটা তোমার-আমার মধ্যে হোক। কল করে গাড়ি ঘুরাতে বলো।

অটলভাবে তাকিয়ে থাকলো মাহতিম। দৃষ্টিটা হান্নানের উপর নিক্ষেপ করে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো, আন্দাজের চৌকির নাগালটা বুঝতে পেরে শান্তভাবে বসে পরলো। বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস টেনে ঠোঁট গোল করে ছেড়ে দিলো, হান্নান শেখের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেললো, মেঝের দিকে তাকিয়ে থুতনিটা চুলকাতে-চুলকাতে বললো,

– শি:ট নানা!

এরপর চোখ তুলে হান্নান শেখের দিকে তাকালো, অসহায় ভাবভঙ্গির নাটক করে বললো,

– টু মাচ্ লেট। গাড়ি তো লোকেশন মোতাবেক পৌঁছে গেছে, এখন যে কি করি! ওহহো, আরেকটু আগে বললে আপনার নাতনীর সাথে দেখা করিয়ে দিতাম। কি মিস্টেকটাই হয়ে গেলো! কি করি বলুন তো? কোনো উপায় আছে?

হান্নান শেখ গম্ভীর মুখে বললো,

– তুমি কি জানো, তুমি এই মূহুর্তে কার সামনে সাহস দেখাচ্ছো? এই সাহসটা চরম মাশুল গুণাবে সেটা তুমি জানো না। তোমাকে হাতের কাছে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম মাহতিম। আজ এসেছো তাও মুখে বড় বড় কথা বলছো। তোমাকে সাবধান করছি, এখনো সময়ও আছে। ওদের ফিরিয়ে আনো, নাহলে পরিস্থিতি এমন বাজে করবো তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।

মাহতিম দমলো না। ভীতু-ভীতু অভিনয় ছেড়ে আসল তর্জনে ফিরলো, চোখের কোটর শক্ত করে বললো,

– আপনার আস্তানায় ছোবল মে:রেছি। এবার তো থামবো না।

কঠিন সাহস দেখে আশ্চর্য হলো হান্নান। কিছুক্ষণের মধ্যে যেই কালবৈশাখির ঝড়টা বইবে, সেটা কি ধারণা করতে পারছে? পুরো বাড়ির চারদিকে মাকড়সার মতো সুক্ষ্ম জাল বুনে গেছে সেটা কি জানে? তখনই বাঁ পকেটে কাঁপুনি অনুভব করলো মাহতিম। ফোনটা ইনকামিং কলের জন্য ক্রমাগত বিপ্ করে যাচ্ছে, হান্নান শেখের দিকে একপলক তাকিয়ে ফোনটা রিসিভের চিন্তা করলো। বাঁ-পা সোজা করে পকেট থেকে ফোন বের করলো, দৃষ্টিটা হান্নান শেখের দিকে রাখার জন্য স্ক্রিনে তাকালো না। স্ক্রিনে সবুজ আইকনটা সোয়াইপ করে কানে রাখলো মাহতিম, হালকা গলায় সাড়া দিলো,

– হ্যালো,

বিপরীত পাশের কথা শোনার জন্য থামলো মাহতিম। মাহতিম শান্ত হয়ে সাড়াটা দিয়েছিলো, অথচ পরিস্থিতি তাকে শান্ত থাকতে দিলো না। কলের প্রতিটা কথা শুনে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো সে, সামনে থাকা ধূর্ত লোকটা মিটমিটিয়ে হাসছে। ওপাশ থেকে জানান দিলো, দশটা লাশের স্তুপ পেয়েছে। লাশগুলো চিহ্নিত করা যাচ্ছেনা। কলটা কাটতেই প্রশ্ন করলো মাহতিম,

– গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে —

কথাটুকু শেষ না করলেও হান্নান শেখের হাসিতে উত্তর পেয়ে গেলো। সারা গায়ে হিম ছড়িয়ে পরলো ওর। এমন কঠিন মূহুর্তে মেহনূরের চেহারা ভাসছে। ওই মাসুম চেহারার সাথে এই লোকের পাষাণ চেহারাটা মিলাছেনা। জীবনের এমন কাকতলীয় ঘটনা দেখে নিজেই হতভম্ব। মানুষ কি আসলেই মুখোশ পরতে পটু? মেহনূর এসব ঘটনা মানতে পারবে? ও যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক। অন্তত এই জঘন্য সত্যটা লুকিয়ে পড়ুক। মাথার ধবধবে সাদা টুপিটায় হাত দিলো হান্নান, সেটা মাথা থেকে সরিয়ে সুন্দর করে পাণ্ঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে বললো,

– আসার সময় কয়েকটা কু:পিয়ে আসছি। মনে হলো ওরা এই গ্রামের না। এখন কার কপালে শনি পরছে একটু পরেই খবর পাবে।

সাথে-সাথে ফোন বাজলো মাহতিমের। মাহতিমের বুকটা হুহু করতেই ফোন রিসিভ করলো, ওপাশ থেকে নিস্তেজ কন্ঠে বললো,

– স্যার, মেয়েগুলোকে উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু বিপ্লব দাদা —

চোখ বন্ধ করতেই হিন্দু ধর্মের লোকটাকে মনে পরলো। ভীষণ অমায়িক আচরণ ছিলো, কখনো উদ্ধত স্বভাব দেখায়নি। মাঝে-মাঝে যখন কথাবার্তা হতো, মনে হতো লোকটা স্বচ্ছ মনের মানুষ। যখন যা কমান্ড পেতো, সবই সাদরের সাথে গ্রহণ করতো, কখনো পালটা প্রশ্ন করেনি। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হবে, এটা যেনো জাগতিক নিয়ম। আক্ষেপের সাথে মনে-মনে আওড়ালো মাহতিম, বুক থেকে ভারী নিশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে বললো, আপনাকে কখনো ভুলবো না দাদা। আপনিও সালেহের সাথে বিদায় হলেন।

আবারও ফোন বাজতে লাগলো ওর। বিরস মুখে ফোনটার দিকে তাকাতেই হান্নান শেখের দিকে তাকালো। বাজতে থাকা ফোনটা আরেক সংবাদ এনেছে, কথাটা শোনার আগে হান্নান শেখের মুখটা পড়তে মন চাইছে। হান্নান শেখ আবারও হাতদুটো পিছমোড়া করে বেধেছে, এখন নির্দিষ্ট সীমানার ভেতর অলস পায়ে পায়চারী করছে। মাহতিমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো সে,

– কলটা ধরে ফেলো। এবার হয়তো সুখবর পেতে পারো।

বিশ্বাস হলো না কথাটা। অবিশ্বাস নিয়ে কলটা রিসিভ করলো মাহতিম, আবারও ছোট্ট স্বরে ‘ হ্যালো ‘ বলতেই চট করে চোখ বন্ধ করলো। নিচের ঠোঁটটা উপরের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরতেই কল কেটে দিলো। মুখ তুলে তাকালো,

– খেলা কি আরো খেলবেন?

পায়চারী ব্যক্তি জবাব দিলো,

– আমার এতে আপত্তি নেই। শুরুটা তুমি করেছো, শেষটা আমি করতে চাচ্ছি। এই বাড়িতে আসাটা ভাগ্যের জোরে হয়েছিলো, কিন্তু ইচ্ছা করে যখন মেহনূরকে গুটি বানালে তখন তোমাকে ছাড় দেওয়া চলে না। আমি যদি একটুখানি হদিশ পেতাম, তাহলে ওইদিনই —

বাকি কথাটা বলতে গিয়ে বুক কাঁপলো না। দাম্ভিকতার সাথে বললো মাহতিম,

– আগে তোকে গা:ড়বো, তারপর এখান থেকে বিদায় হবো!

.

রাত্রিকালীন সময়। মাইক্রোর ঝাঁকুনিতে এখনো শরীর টলাচ্ছে। রাস্তা যে এতো খারাপ ছিলো ভাবতে পারেননি। পুরো রাস্তা শান্তিতে এলেও মেটো পথটুকু পেরিয়ে আসতে ভালোই ভোগান্তি হয়েছে। গ্রাম্য রেসোর্টটা আসলেই চমৎকার। গ্রামের বুকে শহরের ছোঁয়া লেগেছে সেটা এই প্রথম দেখলেন। পুরো রেসোর্টটা আলোয়-আলোয় পূর্ণ, প্রতিটা কামরা পরিষ্কার ভাবে উজ্জ্বল। পানিরও সুব্যবস্থা রয়েছে। মাহতিম তাদের থাকার জন্য বেশ ভালোই বন্দোবস্ত করেছে। ছেলেটার কাজকর্ম দেখে মুগ্ধ হলেন মাহমুদা। মারজা আপা যে ভাগ্য করে এমন সন্তান গর্ভে নিয়েছেন, তা নানা কর্মের মাধ্যমে ফুটে উঠে। রেসোর্টের খোলামেলা পরিবেশে আসার পর অবচেতন মনটা শান্ত হয়নি। বারবার মেহনূরের বিক্ষিপ্ত মুখটা দেখে বিচলিত হচ্ছেন। কেবল স্বামী-সংসারের দায়ভার বুঝতে শিখেছে মেহনূর, এখনই যদি কপালে একটা দূর্গতি ধেয়ে আসে তাহলে কে উদ্ধার করবে?

.

বিছানায় শরীর হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলো। মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। রাতটা ধীরে-ধীরে গভীরে তলাচ্ছে। গরম হাওয়াটা একটু-একটু করে কমছে, ঠান্ডা হচ্ছে পরিবেশ। কি হচ্ছে আজ? কি হতে পারে? মাহতিম তো গতরাতেও কাছে ছিলো, কিন্তু আজ রাতে নেই। গ্রামে সে মিশনের জন্য এসেছে এটা শোনার পর শান্তিতে নেই। এটা যেনো গা ছমছমে শব্দ। ভাবতে গেলেই প্রতিটা পশমে ভয়ের কাঁটা জাগে। অস্থিরতায় ঘুম নেই, এমন অবস্থায় মাথাও ঠান্ডা হচ্ছে না। উদ্ভট চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। ডানহাতের মুঠোয় মোবাইল ফোনটা চেপে আছে, একটা কলের জন্য বুকটা খাঁ-খাঁ করছে। রাতটা অসহ্যকর লাগছে, অসহ্য ভাব কাটাতে চোখ বুজলো মেহনূর। পাশ ফিরে ডান কাত থেকে বাম কাতে ফিরলো। গালে নিচে হাত রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘুমের মধ্যেও ভয় গ্রাস করছে। এ কেমন যন্ত্রণা? হৃৎপিন্ডটা কি ছিঁটকে বেরুবে? ধুকপুকনির জন্য নিশ্বাসটাও বেসামাল। ব্লাড প্রেসার বুঝি বেড়ে গেছে। বুকে এখন চাপও লাগছে। ফ্যানে নিচে থাকলেও চুটিয়ে ঘামছে মেহনূর। কপালের দুপাশ বেয়ে ঘার্মাক্ত স্রোত নামছে। আঁচলটা টেনে কপাল মুছার ইচ্ছা জাগলো না। আবার পাশ ফিরে বাম কাত থেকে ডান কাত ফিরলো। মুঠোর ফোনটা চোখের সামনে এনে মাহতিমের পুরোনো ম্যাসেজটা ওপেন করলো। আবার পড়লো মেহনূর,

NICHE ASHO. KAWKE BOLTE JEYONA. ANTICEPTIC LIQUID NIYE PLEASE DRUTO ASHO.

DON’T PANIC.

NEW SIM.

M. ANSARI

শেষের শর্ট ফর্মটা দেখে ঠোঁট নেড়ে পড়লো মেহনূর। এই প্রথম স্বামীর নামটা নিজ আয়ত্তে মনে-মনে বললো,

– মাহতিম আনসারী, যেখানেই থাকুন সুস্থ ভাবে ফিরে আসুন। আপনাকে নিয়ে এই ভয়-ভয় পরিস্থিতিতে থাকতে পারছিনা। আপনি সবাইকে পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু দাদাভাইকে কেন পাঠালেন না? আপনি আর দাদাভাই মিলে বদমা:শদের সমস্যা ঠিক করছেন? দাদাভাইয়ের কিন্তু খুব সাহস। সে আপনার পাশে থাকলে আপনার কোনো ভয় নেই। কিন্তু, একটা তো খবর দিবেন তাইনা?

স্ক্রিনের আলোটা নিভে গেছে। মেহনূর এখনো ভয়ে তটস্থ। সময়ের কাটা পেরুতে-পেরুতে রাতটুকু কেটে গেলো। মেহনূর অজান্তে ঘুমিয়ে পরলো। ক্লান্ত মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত খাটানোর ফলে ক্লান্ত হয়ে পরেছে, আপনা-আপনি ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেছে। স্বপ্নের ধুম্রজালে দেখথে পেলো ফর্সা মুখ, ঠিক একটা বুড়ো-বুড়ো চেহারা। বুড়োটা হাত বাড়িয়ে হাসি দিয়ে বললো,

– দাদুভাই, চলো এখান থেকে চলে যাই।

স্বপ্নের মধ্যেই অবাক হলো মেহনূর। খুবই অবাক হলো। কেমন উদ্ভট কথা বললো দাদাভাই। এমন কথা তো আগে বলেনি।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

দিনের শুরুটা ইলশেগুঁড়ির বৃষ্টিতে বাধা পরলো। কাদায় ভরে উঠলো নির্জন আস্তানা। গ্রামের মানুষ ভয়ে যার-যার বাড়িতে লুকিয়ে আছে। থেমে-থেমে চলছে গো:লাগু:লির শব্দ। পুরো গ্রামটা মানবশূন্য হয়ে আছে, যেনো কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ইতিমধ্যে বাতাসে-বাতাসে খবর পৌঁছে গেছে মোল্লাবাড়িতে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। একদল সশ:স্ত্র বাহিনী গ্রামের প্রবেশমুখটা বন্ধ করে দিয়েছে, মোল্লাবাড়ির চারিদিকে ঘিরে আছে ব:ন্দুকধারী মানুষ। কি হচ্ছে, কেনো হচ্ছে আপাতত এই প্রশ্ন নিয়ে গ্রামবাসীরা উত্তেজিত। প্রাণের ভয়ে কেউই বাড়ির বাইরে পা দিচ্ছে না। আকাশে চেহারা সকাল থেকেই করুণ, সেটা কয়লা মতো অন্ধকার হয়ে আছে। আবহাওয়ার অবস্থা দেখলে ভয়ে গা শিরশির করে, নিরবতা চিঁড়ে একটু পরপর প্রচণ্ড জোরে শব্দ হচ্ছে, কেউই স্বস্তিতে নিশ্বাস নিতে পারছেনা। গ্রামের বুকে এমন অভিজ্ঞতার শিকার হবে ভাবতে পারছেন না বৃদ্ধা। নাম রোজিনা বানু, বয়স বাষট্টি। এগারো মাসের নাতিকে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছেন, বড়-বড় দুটো নাতনী ওপাশের রুমে জড়াজড়ি করে মায়ের কাছে বসে আছে। সবার বুকেই ভয়, সবার মধ্যেই প্রচণ্ড উদ্বেগ কাজ করছে। রোজিনা বানু টিনের দেয়ালে ছোট্ট একটা ছিদ্রের কাছে চোখ রেখেছেন, চুপচাপ বাইরের অবস্থা দেখার চেষ্টা করছেন। দাদীকে ওভাবে দেখতে দেখে পেছন থেকে মেজো নাতনী বলে উঠলো,

– দাদী, দাদী শোনো। ও দাদী,

মেজো নাতনীর কন্ঠ শুনে চোখ ঘুরালেন রোজিনা। চিন্তাগ্রস্থ অবস্থার ভেতর প্রশ্ন করে বললেন,

– কিছু কবি?

জোরে-জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললো নাতনী। দাদীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নের ঝুড়িটা খুলে দিলো,

– হ কমু। তুমি না কইছো যুদ্দের সময় এইরম শব্দ হইছিলো? এহন যেই কান ফাডাইন্না শব্দ হইতাছে তহনো কি এইরম শব্দ হইতো?

রোজিনা বানু স্মৃতির ইতিহাস টেনে-টেনে বর্তমানে খুঁজে আনলেন। কোলের নাতিকে দুহাতের ভেতর মৃদ্যুভাবে দুলাতে-দুলাতে বললেন,

– হ হইতো। তহন আরো জোরতে শব্দ হইতো। এই শব্দ হেই শব্দের কাছে কিছুই না।

ভ্রু কুঁচকে নাতনী বললো,

– কি কও এডি? তাইলে কি বাইরে অহন যুদ্দ লাগেনাই?

রোজিনা বানু নাতনীর অকপটভাবে বলা দেখে হেসে ফেললেন। ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে বললেন,

– যুদ্দ লাগবো ক্যা রে মা:গী? যুদ্দ লাগোনের কিছু হইছে? দ্যাখ গা পুলিশে আইছেনি। পুলিশ যখন চুর খুঁইজ্জা পায় তহন এমনে আহে। চুর ধইরা-বাইন্দা লইয়া যায় গা।

নাতনীর মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। নিভু-নিভু কন্ঠে বললো,

– দাদী, আমার বাপজান কি আর আইতো না?

হঠাৎ জীর্ণ হাতদুটো থেমে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে অবুঝ নাতনীর দিকে তাকালেন বৃদ্ধা। কোলের শিশুটা আরাম হারিয়ে কেঁদে উঠতেই আবার হাত দুলাতে শুরু করলেন। চোখের সামনে মৃত ছেলের স্মৃতিটা এখনো স্পষ্টভাবে মনে আছে। কে বা কারা যেনো মেরে ফেলেছে, এ নিয়ে হান্নান মোল্লার কাছে বিচারের জন্য গেলেও মোল্লা সাহেব সুরাহা করতে পারেননি। খুব শীঘ্রই অপরাধী ধরা পরবে এমন একটা কথা বলে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু আজ পযর্ন্ত খুনের হদিস মেলেনি। কানাঘুসোয় শুনতে পেয়েছেন তার ছেলে নাকি চড়া সুদে টাকা নিয়েছিলো। এ তল্লাটে কে এমন টাকার ব্যবসা করে তা কেউই জানে না। এমনকি অজ্ঞাত সেই ব্যক্তিটা কে, এটাই ঠিক অস্পষ্ট। সবার ধারণা যার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলো, সেই ব্যক্তি লোক মারফত খু:ন করে দিয়েছে। ব্যক্তিগত সহিংসতা থাকলেও সেটা যে এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে, ভাবা মুশকিল! রোজিনা বানু এটুকু অনুমান করতে পারেন এ গ্রামে ক্ষমতাপ্রাপ্ত লোক একজনই আছে। সেই লোক আরো দশটা গ্রামকে ক্ষমতাবলে পিষিয়ে রাখতে পারে। আজ যদি মোল্লাবাড়িতে গো:লাগু:লি হয়েই থাকে, তাহলে কি উক্ত ব্যক্তি ধরা পরেছে? গম্ভীর মুখে বুকভর্তি দম নিলেন রোজিনা। বামে মুখ ঘুরিয়ে বদ্ধ জানালার দিকে দৃষ্টি রাখলেন। ডান চোখে হালকা মতোন ছানি পরলেও অন্য চোখটা ভালো। এই ছানি কাটানোর জন্য একমাত্র ছেলে কোত্থেকে টাকা ধার করেছিলো তিনি জানেন না। ছেলেকে অনেক জিজ্ঞেস করেও নামটা জানতে পারেননি। শহরে গিয়ে চোখের ছানি কেটে এলেও অন্য চোখেরটা কাটাতে পারেননি। একটা চোখের পিছনে সবটুকু ধারের টাকা শেষ হয়ে যায়, আজ সেই ছেলে নেই। কিন্তু ধারের টাকায় ডানচোখটা ফকাফকা পরিষ্কার। এখন নির্ঝঞ্ঝাট দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পারেন। আজ দৃষ্টির পাশাপাশি শ্রবণেন্দ্রীয় সচল। তিনি যে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন, তার মাতৃমন জানান দিচ্ছে আজ প্রতিশোধের ষোলকলা পূর্ণ হবে। বাতাসে-বাতাসে মৃ:ত্যুর মিছিল আজ বহুদিন পর সমাপ্তি টানবে।

.

টিভি চ্যানেল গুলো থেমে নেই। প্রতিটা চ্যানেলে-চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে। সবকটা চ্যানেলে শীর্ষ সংবাদটা ফলাও করে দেখানো হচ্ছে। রিপোর্টদের কল্যাণে কিছু শট ক্যাপচার করে লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তার জন্য কাউকে কাছে ভিড়তে দেয়নি। দূর থেকে জুম করে যতটুকু পেরেছে টিভির পর্দায় এনেছে, বাকিটা আর সম্ভব হয়নি। উন্মুখ জনগণ সর্বশেষ তথ্য পাওয়ার জন্য টিভির চ্যানেল বারবার ঘুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ‘ সর্বশেষ ‘ নামক তথ্য পাওয়া যায়নি। সবার মধ্যে উত্তেজনার দশা তিলতিল করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ‘ কি হবে সামনে ‘ একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, চিন্তায় অনেকের মধ্যে উদ্বেগপূর্ণ অবস্থা। বহুল আলোচিত পলাতক আ:সামীকে ঘিরে ধরেছে নিরাপত্তাবাহিনী, কিন্তু এখনো দূধর্ষ গোলাগুলি থামেনি। মহিমপুর গ্রাম থেকে একের-পর-এক হদিস বের করেছে, উদ্ধার করেছে কয়েক টন ড্রা:গস্, ট্রাকভর্তি নারী-যুবক-শিশু এবং সর্বশেষ অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক অ:স্ত্রের সম্ভার উদ্ধার করেছে। দলের তত্ত্বাবধানের থাকা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা এতোদিন পর সূত্র বের করেছে। উদ্ধার কার্য শেষ হয়েছে ঘন্টা খানেক হলো। কিন্তু ফেরারি আসামী এখনো নিজেকে আত্মসমর্পণ করেনি। ভেতরে একদল দক্ষ-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফোর্স ঢুকেছে ঠিকই, এখনো তাদের কাছ থেকে আপডেট আসেনি। সবাই স্ব-স্ব স্থানে সতর্কতা অবলম্বন করছে, কেউই ব্যাপারটা হালকা ভাবে নেয়নি। গ্রামের সহজ-সরল, খেটে খাওয়া মানুষগুলো ভীতিকর অবস্থায় ঠেকে আছে। কেউ বাড়ির বাইরে বেরুনোর সাহস দেখাচ্ছে না। মোল্লাবাড়িতে অবস্থানরত মানুষরা কোথায় আছে, এ নিয়ে নানা মতবিরোধ চলছে, তর্ক হচ্ছে, কিন্তু কেউই সঠিক জবাব দিতে পারছে না। সাধারণ মানুষের কাছে টিভির পর্দায় এমন খবর দেখাটা লোমহর্ষক বটে! বহুদিন পর এমন একটা অভিযান চলছে, সেটা সত্যিই দমফাটা উত্তেজনার কাছাকাছি। নিরাপত্তাবাহিনী এখনো চুপ করে আছে, কোনো সলিড তথ্য রিপোর্টারের কাধে দেয়নি। তাদের কাছে খবর এসেছে, অভিযান শেষ হলে ব্রিফে আসবে তারা। সেখানে সকল প্রশ্নের যাবতীয় উত্তর দেওয়া হবে। কিন্তু এই মূহুর্তে কি হচ্ছে সেটা জানানোর জন্য অনেকটাই উন্মাদ আচরণ করছে রিপোর্টাররা। তাদের পুরো দলটাকে থামিয়ে রেখেছে নিরাপত্তা বাহিনী, স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে অভিযান শেষ না পযর্ন্ত কিচ্ছু জানানো হবেনা।

টিভির পর্দায় ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে সৌভিক। তার সম্পূর্ণ চিন্তা কেবল মাহতিমকে ঘিরে। এই অভিযান যে মাহতিমের আন্ডারে লিড হচ্ছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু মাহতিম কি ঠিক আছে? বারবার বলছে গো:লাগু:লি এখনো শেষ হয়নি, তার মানে মাহতিম এখনো ডেন্ঞ্জার জোন ছাড়েনি? অফিসের কেবিনে বসে প্রচণ্ড চিন্তায় ছটফট করছে সৌভিক। সকালের নাস্তাটা এখনো হোয়াট ডেস্কের উপর পরে আছে। যখন থেকে খবর পেয়েছে মাহতিম ওদের রেসোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছে, তখন থেকেই ভয়াক্রান্ত। কবজির কাছ থেকে গ্রে স্লিভটার বোতাম খুললো সৌভিক, ডানহাতে স্লিভটা ভাঁজ করতে-করতে কনুইয়ে এসে রাখলো। এখন লান্ঞ্চ টাইম শুরু হয়েছে, কিন্তু টেনশনে পেটের খিদা ম:রে গেছে। অপর হাতটার স্লিভ ফোল্ড করে রকিং চেয়ার থেকে উঠে গেলো, চেয়ারটা পাক খেয়ে গোল-গোল ঘুরতে থাকলে সৌভিক হেঁটে এসে জানালার কাছে দাঁড়ালো। দিনের বেলা হলেও টিমটিমে লাইট জ্বলছে। রুমটা এয়ার কন্ডিশন্ড। জানালা গুলো সব বন্ধ। কিন্তু ভেতরের ছটফটানির জন্য জানালা খুলতে বাধ্য হলো। জানালাটা আনলক করে স্লাইডিং গ্লাসটা বাম দিকে ধাক্কা মারলো, তখনই মুষলধারে বৃষ্টিপাতটা চোখে পরলো। আকাশটা কালো হয়ে আছে, ঝমঝম শব্দে শহর মাতিয়ে বৃষ্টি পরছে। মুখ ঘুরিয়ে টিভির দিকে তাকালো সৌভিক, মাইক হাতে রিপোর্টারটা একই খবর বলে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া অন্ধকার হলেও বৃষ্টি ঝিরিঝিরি। দেশের এই প্রান্তে ধুমছে বৃষ্টি হলেও অন্যপ্রান্তে সেরকম বৃষ্টি নামেনি। টিভির দিকে চাইতেই জায়গাটা চিনতে পারলো সৌভিক। এটা গ্রামের পন্ঞ্চায়েত বসার অংশ। সেই বটগাছটা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে সে। তার মানে সাংবাদিকের দল মোল্লাবাড়ির কাছে যেতে পারেনি। শানাজকে কল দিতে খুব ইচ্ছা করলো, কিন্তু অবস্থা খারাপ বলে কল দিলো না। এসির হাওয়া ক্রমশ জানালা ডেঙিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টির ঠান্ডা প্রকৃতি অদ্ভুত কারণে ভয় লাগছে। কে জানে গ্রামের মাটিটা লাল হয় কিনা, নিষ্ঠুর মানুষের রক্তের পাশাপাশি নির্দোষ মানুষের র:ক্ত উজাড় হয় কিনা। ভারী নিশ্বাস নিয়ে আস্তে-আস্তে ছাড়লো সৌভিক, সব চিন্তা দুমড়ে-মুচড়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। আগে-পিছে চিন্তাভাবনা না করে শানাজকে কল করলো, বৃষ্টির দামাল চোটে ছাঁট এসে জানালা দিয়ে ঢুকলো। চোখদুটো বন্ধ করলো সৌভিক, ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে থাই গ্লাসটা টেনে দিলো। নিজের ডেস্কের কাছে ফিরে আসতেই রকিং চেয়ারে বসলো। কলটা ওপাশ থেকে শেষ মূহুর্তে রিসিভ করলে কথা আগালো সৌভিক,

– হ্যালো, শানাজ?

নেটওয়ার্কের জন্য ঘ্যারঘ্যার জাতীয় শব্দ শুনতে পেলো। কিন্তু তখনই শানাজের কন্ঠটা কেটে-কেটে ভেসে এলো,

– হ্যাঁ বলো, কেমন আছো?

ভণিতা করলো না সৌভিক। সোজাসুজি মূল কথায় চলে এলো,

– ওখানে টিভি আছে?

শানাজ কৌতুহল হয়ে পালটা জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো? টিভিতে তুমি এসেছো? হঠাৎ টিভির খবর নিচ্ছো কেনো?

স্বাভাবিক হলো সৌভিক। শানাজ যেহেতু এখনো জানে না, তার মানে কেউই জানে না। ওকে এখুনি জানানো দরকার। ব্যাপারটা আগ বাড়িয়ে খারাপের দিকে যাওয়ার চাইতে সময় মতো দেখা দরকার। সৌভিক শান্ত হয়ে বললো,

– তোমাদের বাড়িতে গো:লাগু:লি হচ্ছে। তুমি যদি টিভি —

কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কথা আওড়ালো শানাজ,

– আমি এ ব্যাপারে জানি সৌভিক। আম্মা আমাকে সব বলেছে।

সৌভিক চকিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। আশ্চর্য হয়ে বললো,

– কার আম্মা? মানে? তুমি কি বলছো শানাজ? এ ব্যাপারে তুমি কিভাবে, মানে কি করে, ওহ্ মাই গড্! তুমি কি সব জানো? ভাবীকে জানিয়েছো?

সৌভিকের অশান্ত গলা শুনে আশ্বস্ত করলো শানাজ। অস্থির সৌভিককে শান্ত করে বললো,

– মেহনূরকে ভুলেও জানাবো না। ও শুনলে কি করবে কে জানে। আম্মা বলে দিয়েছে আপাতত চুপ থাকতে। আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে আছি। জানিনা মেহনূর শুনলে কি অবস্থা হবে। ও ব্যাপারটা একদমই নিতে পারবে না। ছোট থেকে দাদাজান ওকে বেশি আদর করতো। আমাদের চেয়ে দাদাজানকে বেশি মানতো সৌভিক। তুমি হয়তো জানো না, দাদাজান যদি মাহতিম ভাইয়ার ব্যাপারে অমত করতো, তাহলে ও চুপচাপ সেটা মেনে নিতো, আজ হয়তো ওদের বিয়েই হতো না। আম্মার কথাটা শোনার পর মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। শুধু আল্লাহ্-আল্লাহ্ করছি ভাইয়া যেনো ফিরে আসুক, এখানে ভাইয়ার কোনো দোষ নেই। আমাদের চোখে যুগ-যুগ ধরে পট্টি পরানো ছিলো, এখন যখন খুলে গেছে সেটা মানতে আমাদের কষ্ট হবেই। কি করবো সৌভিক? আমরা কার কি ক্ষতি করেছিলাম যে আজ আমাদের এমন দিন দেখতে হলো?

সৌভিক চুপ থেকে ঠান্ডা ভাবে বুঝিয়ে বললো,

– তোমরা কারো ক্ষতি করোনি। ইন ফ্যাক্ট, তোমাদের দাদা যে বাটপার, এটাও তোমরা জানতে না। তোমাদের কাছে সবই লুকানো ছিলো শানাজ। মাথা ঠান্ডা করো, টেনশন কোরো না। বাকিরা সবাই জেনেছে?

শানাজ নিরুদ্বেগ ভাবে বললো,

– আম্মা শুধু আমাকে জানিয়েছে। আমাকে সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে, আর কেউ যেনো না জানে।

সৌভিক সম্মতির সুরে বললো,

– এখন কিছু বোলো না শানাজ। আল্লাহ জানে, মোল্লাবাড়িতে কি হচ্ছে। তোমাদের বাড়িতে এখনো গোলাগুলি অফ হয়নি। মাহতিমটা যে কেমন আছে,

কন্ঠে বিষাদ নেমে এলো। সৌভিক আর কথা বাড়াতে পারলো না। চোখদুটো টিভির দিকে স্থির থাকলেও মনটা মাহতিমের জন্য অস্থির হয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে ডেস্কের দিকে তাকালো সে, হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– তোমার মা কি আমাকে মেনে নিবে? আমার কিন্তু গার্ডিয়ান নেই। কাকার ব্যবসায় খাটাখাটনি করি, এটুকুই সম্বল। আমার যা আয়-রোজগার তা কিন্তু শৌখিন ভাবে চলার মতো না। সংসার করতে গেলে যতটুকু দরকার সবটুকু পূরণ করতে পারবো। কিন্তু,

বাকি কথাটা শোনার জন্য তাড়া দিলো শানাজ,

– কিন্তু কি? বলো? চুপ করে আছো কেনো?

সৌভিক রকিং চেয়ারে পিঠ ছেড়ে বললো,

– আমার নিজের কোনো বাড়ি নেই। তুমি বিয়ে করলে তখন একটা ফ্ল্যাট কিনে নিবো। কিন্তু, বাড়ি কবে করবো জানি না।

শানাজ রাগ দেখিয়ে বললো,

– তুমি আমাকে দূরবস্থার হিসাব বুঝাচ্ছো কেনো? তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও না। আমি কি কখনো আবদার করেছি? এটা চাই, ওটা চাই করেছি?

শানাজের রাগত সুর শুনে হাসলো সৌভিক। ব্যাপারটা ঠান্ডা করার জন্য অন্য প্রসঙ্গ টেনে বললো,

– রাগ কোরো না, আমি এমনেই কথাগুলো বললাম। আমার তো আবার কথা বলার মানুষ কম, এজন্য তোমাকেই বলেছি। আমাকে একটা কথা বলবে শানাজ? ভাবী প্রথম-প্রথম চুপ থাকতো কেন? মাহতিম ম্যাটারটা জেনেছে, কিন্তু ও আমার কাছে শেয়ার করার সুযোগ পায়নি। ভাবী সেই মিস্টিরিয়াস আচরণের কারণ কি শানাজ? ব্যাপারটা কি খোলাখুলি বলবে?

শানাজ ফোনটা কানে চেপে ক্ষণকালের জন্য চুপ থাকলো। ব্যাপারটা সৌভিকের কাছে বলার পূর্বে কথাগুলো সাজিয়ে নিলো। পুরোনো দিনের কথা হলেও এতে গূঢ়তা লুকিয়ে আছে। সুরাইয়ার কানে পৌঁছে গেলে ফের কেলেঙ্কারি হতে পারে। শানাজ একটু সতর্ক হয়ে বলতে লাগলো, অনেকটা শিক্ষিকার মতো ভঙ্গি ধরে বললো,

– প্রথমত এসব বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় কারোর কাছে বলতে যেও না। যদি মাহতিম ভাইয়া নিজে থেকে তোমাদের জানায়, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এমনিতে যদি না জানায়, তাহলে তুমি এ বিষয়ে কাউকেই বোলো না। আমি তখন ছোটই ছিলাম। আমার বয়স ঠিক কত ছিলো মনে নেই। মেহনূরও তখন ছোট। আমরা চারবোনই স্কুলে যেতে শুরু করেছিলাম, আমাদের আনা-নেওয়ার কাজ করতো ফজলু কাকা। উনি গোয়ালঘরের কাজ করতো, আবার দাদাজানের নানা কাজে সাহায্য করতো। দাদাজানের পরে ফজলু কাকার সাথে ওর খুব ভালো মিল ছিলো। কাকাও ওকে এতো আদর করতো, মেহনূর স্কুলে যা-যা শিখতো সব এসে কাকাকে বলতো। আমরা সবাই সেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম, মেহনূর তখন ভালোই চটপটে ছিলো। বিশ্বাস করো সৌভিক! ওইদিন যদি একবার জানতাম মেহনূরের চটপটে ভাবটা আজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবো, তাহলে জীবনেও ওকে একা ছাড়তাম না। ও আমাদের সঙ্গ ছেড়ে কখন ক্লাসের দিকে ছুটে গিয়েছে আমরা টের পাইনি। স্কুল ছুটির সময় এতো ভীড় ছিলো যে ওকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি খুঁজতে-খুঁজতে হয়রান হওয়ার পর সাবা, সুরাইয়াকে নিয়ে গেটের বাইরে চলে যাই। সেখানে ফজলু কাকাও ছিলো না। ভয়ে আমার অবস্থা আরো নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলো, একা-একা রৌদ্রের ভেতরে তাড়াতাড়ি বাড়িমুখো হই। দাদাজানের কাছে খবর পাঠাই, দাদাজানও পাগলের মতো সব ফেলে এসে মেহনূরকে খুঁজতে লাগে। কিন্তু দাদাজান আর আমি যখন স্কুলে পৌঁছাই, তখন —

তীব্র উত্তেজনায় ফেটে পরলো সৌভিক! শানাজকে চেঁচানির সুরে তাড়া দিলো,

– তখন কি? তখন কি হয়েছিলো? প্লিজ শানাজ!

সৌভিক শুনতে পেলো শানাজ ফিসফিস শব্দ করছে। শানাজ কি কাঁদছে? ঘটনার চূড়ান্ত মূহুর্তে কি এমন হয়েছিলো? আবারও তাড়া ঠুকলো সৌভিক, অস্থিরচিত্তে উশখুশ করে বললো,

– খারাপ কিছু?

প্রশ্নটা শুনে তেড়ে আসার মতো মুখ খুললো শানাজ। এক চিৎকার দিয়ে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বললো,

– অবুঝ একটা পিচ্চিকে বাথরুমে নিয়ে যায় কেনো, জানো? পুরো স্কুল মাঠ খালি ছিলো, কেউ ছিলো না। শুধু বাথরুমের দুটো দরজা বন্ধ ছিলো। দাদাজান ওইদিকে যাওয়ার আগে হঠাৎ একটা দরজা থেকে খুব কান্নাকাটি শুনতে পায়। এরপর যখন দরজা ভেঙ্গে ঢুকি, তখন দেখি ফজলু কাকা ওই বাথরুমে। কাকা ততত-খ-ন, কাকা তখন একা ছিলো না। কাকার সাথে সোনালী নামের আরেকটা মেয়ে ছিলো, ওই মেয়ের পুরো শরীর র:ক্তা —

সৌভিক স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। কথাটা পুরোপুরি না বললেও বাকিটা বোঝা শেষ। কতক্ষণ চুপ করে ছিলো জানা নেই, শানাজের মৃদ্যু স্বরের কান্নায় সৎবিৎ ফিরলো ওর। স্বাভাবিক হওয়ার তীব্র চেষ্টা করে শানাজকে শান্ত হতে বললো, শানাজ একটু বিরতি নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,

– মেয়েটা মেহনূরের ক্লাসে পড়তো। মেহনূর যে তখন পাশের বাথরুমে ছিলো, এটা কাকা জানতো না। বাথরুমের দেয়ালে একটা সরু চিড় ছিলো, যেটার জন্য ওই বাথরুমে কেউ যেতো না। এজন্য বাথরুমটা পরিষ্কার ছিলো, মেহনূর এটা ভালো করে জানতো বলে সেদিন ওই বাথরুমে ছুট দেয়। আর তখনই বাইরে থেকে ভুলবশত ছিটকিনি আঁটকে যায়, এরপর ওই চিৎকার শুনে যখন চিড়ের ফাঁকে তাকায়, তখন সবকিছু — । ওর চোখের সামনেই একটা ফুলের মতো মেয়ে দূষিত হয়ে যায় সৌভিক। চারটা ঘন্টা বাথরুমের ভেতর আঁটকা ছিলো, আমরা যখন উদ্ধার করি তখন পুরোনো মেহনূরকে খুঁজে পাইনি। টানা ছয়দিন টাইফয়েডের জ্বরে ভুগে, সুস্থ হতে-হতে মাস খানিক সময় লাগে। আর অন্যদিকে সোনালী ধুকতে-ধুকতে মা:রা যায়। সোনালীর পুরো স্মৃতিটা মেহনূরের ভেতরে গভীরভাবে আঁচড় কেঁটে দেয়, ও প্রায়ই ঘুমের মধ্যে চমকে উঠতো। ভয়ে সারারাত ঘুমাতো না। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পড়া সবকিছু নষ্ট হতে থাকে, ধীরে-ধীরে ও অস্বাভাবিক ভাবে চুপ হয়ে যায়। দাদাজান ছাড়া ভুল করেও কোনো ছেলে মানুষের সামনে যেতো না, সবসময় লুকিয়ে-লুকিয়ে থাকতো। নিজের মধ্যে থাকতে-থাকতেই কবে অন্য স্বভাবে চলে যায়, নিরব হয়ে যায়, আমরা বুঝতে পারিনি। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলাও একপর্যায়ে ছেড়ে দেয়। ওর জীবনটা শুধু একটামাত্র ঘটনার জন্য পালটে যায় সৌভিক, এরপর থেকে ও আর স্বাভাবিক মেয়েদের মতো আচরণ করে না। ওকে নিয়ে মানুষ প্রচুর নাক ছিটকাতো, কিন্তু আমরা তো জানি ওর ভেতর দিয়ে কিসের ঝড় বয়েছে। ওর বিশ্বাস ভেঙ্গেছে, আস্থা ভেঙেছে, মানুষকে ‘ মানুষ’ বলে চেনার ইচ্ছাও ম:রে গেছে। বিশ্বাস ভাঙ্গলে মানুষই পালটে যায় সৌভিক, মানুষ আগের মতো থাকতে পারে না। যদি দাদাজানের সত্যটা জেনে যায়, তখন যে আবার — .

সৌভিক দুপাটি দাঁত শক্ত করে চোখ বুজে ফেললো। শানাজের অসম্পূর্ণ কথা এবারও বুঝা শেষ। কি হবে এখন? সত্য জানতে আর মাত্র কিছু সময় বাকি। যদি হান্নান শেখের ব্যাপারটা জেনে আবার বাক হারিয়ে ফেলে, তখন কি — । ভাবতে পারলো না সৌভিক। এখন শানাজের মতো তারও মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .