মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৬২+৬৩

0
925

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬২.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

সাদা শার্টটা রক্তে মাখামাখি অবস্থা। কানের ডানপাশ থেকে তরল রক্ত চুইয়ে-চুইয়ে পরছে। মাথাটা প্রচণ্ড ঝিমঝিম করলেও চোখের চাহনি এখনো কঠোর। দশজনের একটা আল্টিমেটাম টিম আপাতত তার ইশারার জন্য প্রস্তুত। যেকোনো সময় শেষ মূহুর্ত্তের গো:লাবর্ষণ হতে পিছপা হবে না। তার চর্তুদিকে ফেরারী আসামীর দলবল আহত-নিহত অবস্থায় মাটিতে পরে আছে। তন্মধ্যে নিহতের সংখ্যাই ঢের বেশি। বিচক্ষণ ভঙ্গির চোখদুটো ডানপাশ থেকে বামপাশে ঘুরালো, চারিদিকের ছকটা আরেকবার ঠিক করে নিলো। মনে-মনে সঠিক হিসাবটা মিলিয়ে দৃঢ়তার সাথে সামনে তাকালো সে, রিভলবারটা টার্গেট মতো সেট করে গম্ভীর আওয়াজ তুললো,

– সারে:ন্ডার করুন!

কথাটা অগ্রাহ্য করতে গিয়ে আশ্চর্যে একগাল হাসলো হান্নান। সামনে দাঁড়ানো পুরুষটা তার আত্মীয় বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে না পুরুষটা তার নাতজামাই। জীবনের গতিময় ধারা এভাবে সত্যের সামনে ছেড়ে দিবে কল্পনাও করেননি তিনি। অদ্ভুত নিয়মের জোরে আজ হেরে বসেছেন। যেই মাহতিমকে তিনি সরল ধাঁচের ব্যক্তি ভেবেছেন, যাকে আলালের ঘরের দুলাল ভেবে নাতনীকে তুলে দিয়েছেন, দিনশেষে সেই সৌম্যদর্শন চেহারার আড়ালে জটিল বুদ্ধি এবং গভীর চিন্তাসম্পণ্ণ মানুষ বেরিয়ে এসেছে। সেই মাহতিম আনসারী আজ সশস্ত্র দলবল নিয়ে তাকে আত্মসমর্পণের হুমকি দিচ্ছে। নিজের অপারগ অবস্থা দেখে কুণ্ঠা বোধ করছেন হান্নান। তারও দেহের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত ঝরে-ঝরে পরেছে, বাতাসের গতিতে মিনিট পাঁচেক পূর্বে বু:লেট লেগেছে। বর্তমানে লাইব্রেরি ঘরের কাছে শেলটার নিয়েছেন, দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকলেও তার নিশ্বাস এখন স্বাভাবিক নেই। বাঁচার তাগিদে তিনি হাঁশফাঁশ করলেও মাহতিমের নিচ্ছিদ্র পরিকল্পনায় বাজেভাবে ফেঁসে গেছেন। অনেক চেষ্টা করেও মাহতিমকে নিহত করতে পারেননি, বারবার তার বুলেটের নিশানা ব্যর্থ হয়েছে। তুখোড় নিশানাবাজ হিসেবে যেই খ্যাতিটা এতদিন কায়েম ছিলো, আজ সেটা ভেস্তে গেছে। দরজার সরু ফাঁকে ডান চোখ রাখলেন হান্নান, ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে ফাঁক দিয়ে বাইরের অবস্থা দেখছেন। পরিষ্কার সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে আছে মাহতিমের, তবুও হাতদুটোর মাঝে রিভলবারটা টার্গেট মতো সেট করা। ঠোঁটের ডান কোণা থেকে লম্বাকারে রক্ত পরছে, সেদিকে তার ভ্রুঁক্ষেপ নেই। ঘেমে সুন্দর মুখটার নাক-গাল লাল হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে ডানকানের পাশ দিয়ে রক্তের স্রোত থেমে নেই। হান্নান শেখের নিরবতা দেখে হঠাৎ গম্ভীর ব্যক্তিটা গলা তুলে হুঙ্কার ছাড়লো। জোর গলায় বলে উঠলো,

– আমি তিন পযর্ন্ত কাউন্ট করবো। কাউন্টডাউন পযর্ন্ত যদি না বের হোন, আমি এ্যাকশনে নামতে লেট করবো না! এখনো সময় আছে ভালোয়-ভালোয় সারেন্ডার করুন।

হান্নান শেখ ফিচেল একটা হাসি দিলো। অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরে মনে-মনে বললো,

– মনের সুখে নামতা গুণতে থাক। আমিতো শা:লা বাইর হইতাম না।

কথাটা বলেই ফাঁক থেকে চোখ নামালেন হান্নান। হাতে থাকা পিস্ত:লটায় দৃষ্টি দিলো সে, পাণ্ঞ্জাবীর পকেট থেকে গুলির স্তুপ নিয়ে পিস্তলটা লোড করে নিলেন। তাঁর মাথায় বীভৎস বুদ্ধিটা ঘুরঘুর করছে। পিস্তলটা ডানহাতের কবজায় নিয়ে দরজা থেকে দূরে সরলেন। তখনই ভেতর থেকে শুনতে পেলেন, মাহতিমের গলাটা কাউন্ট শুরু করেছে। ‘ ওয়ান ‘ শব্দটা শুনতেই দু’কদম পিছিয়ে গেলেন হান্নান, সাথে-সাথে দরজার দিকে পিস্তল তুলে ধরলেন তিনি। মাহতিম সময়ক্ষেপণ না করে ‘ টু ‘ বলে উঠলো, এবার হান্নান আরো এক কদম পিছিয়ে গেলেন। হাতের পিস্তলটা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাঠিন্য মুখে ধরে রইলেন। প্রায় দুই মিনিটের মতো অতিক্রম হয়ে যায়, বন্ধ দরজার বাইরে থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসে না। দুই ভ্রুঁ কুঁচকে হান্নান শেখ চরম আশ্চর্য হলেন! হঠাৎ কি হলো? কাউন্টডাউন থেমে গেলো কেনো? বিষয়টা ঠান্ডা ভাবে দেখা যাচ্ছে না! নিশ্চিতরূপে বলা যায়, বাইরে কিছু হচ্ছে। নয়তো হুট করে ‘ থ্রি ‘ বলাটা এমনে-এমনেই থেমে যাবে না। হান্নান শেখ এখনো পিস্তল তাক করে কৌতুহল চোখে তাকিয়ে আছেন, মাহতিমকে সহজভাবে নেওয়ার ভুল করা যাবে না। কিন্তু আচমকা কাউন্টডাউন থেমে গেলো, এটা কি অশনি ঝড়ের পূর্বাভাস? দরদর করে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। গলাটা গ্রীষ্মের চৌচির মাঠের মতো শুকিয়ে গেছে। একফোঁটা পানির জন্য বুকটা খাঁ খাঁ করছে। তিনি কি কোনো কারণে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছেন? মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে আগেই টালমাটাল হচ্ছেন? চারপাশটা কেমন নিস্তব্ধ লাগছে। একটু আগে যেই শব্দগুলো পুরো বাড়ি মাতিয়ে রেখেছিলো, সেগুলো আর নেই। হঠাৎ ভূতুড়ে কায়দায় সুনশান হয়ে গেছে। হান্নান শেখ পিস্তল ধরা হাতদুটো আস্তে-আস্তে নিচে নামালেন, ধীরপায়ে বিনা শব্দে দরজার দিকে এগুতে লাগলেন। এমন ভাবে পা ফেললেন, যেনো নূন্যতম শব্দ না হয়। দরজার খুব নিকটে গিয়ে এবার কাঠের দরজায় কান পাতলেন। বাইরের মতিগতি বুঝতে যেয়ে ভড়কে গেলেন তিনি। আজব! বাইরেও কোনো শব্দ হচ্ছে না! আচানক সবকিছু একেবারে থমকে গেছে। আরো কয়েক মিনিট দরজায় কান রেখে সুক্ষ্ম কিছুর সন্ধান করলেন, কিন্তু কোনো শব্দই বিলক্ষণ অবস্থার আভাস দিলো না। বাধ্য হয়ে হান্নান শেখ নিজেই আস্তে করে দরজা খুললেন, দরজার দ্বারদুটো ধীরগতিতে খুলে সতর্ক হলেন তিনি। বাইরে সত্যিই কেউ নেই। নেই কোনো অস্ত্রশস্ত্র বাহিনী। মেঝের বিভিন্ন জায়গায় লাশ ছাড়া একটা কাকপক্ষিও নেই। মিনিটের ভেতর এতোগুলো মানুষ কোথায় উধাও হলো? কোথায় গেলো তারা? এভাবে ম্যাজিকের মতো ভেলকি দেখানোর মানে কি? প্রচণ্ড বিষ্ময় নিয়ে পরিস্থিতি বুঝার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন হান্নান, তখনই সবকিছু তছনছ করে পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠলো! দামাল শব্দের চোটে কোনোকিছু বুঝার আগেই চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। ছিটকে ক’হাত দূরে গেলেন, সেটা ঠাহর করতে পারলেন না। চোখ খুলার ব্যকুল চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন তিনি, কাতর ধ্বনিতে চিৎকার দিতেও গলা আঁটকে গেলো। হাতের আঙ্গুলগুলো শিথিল হতেই পিস্তলটা পরে গেলো। অনেক চেষ্টা করে চোখ খুললেন হান্নান, নিশ্বাস নিতেও যেনো ফুসফুস ছিঁড়ে যাচ্ছে। মুখ হা করে নিশ্বাস নিতেই ধীরগতিতে পিছু ঘুরলেন, সম্পূর্ণ পিছন ফিরতেই বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। রক্তাক্ত সাদা শার্ট গায়ে মাহতিম দাঁড়িয়ে আছে, তার ডানহাতে নিচু করা রিভলবারটা দেখা যাচ্ছে। ঘামার্ক্ত মুখটা যেনো রাগে টগবগ অবস্থা! যতটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর লাগছে চোখের হিংস্র চাহনি। এমন ক্রুদ্ধ দৃষ্টির মুখোমুখি আগে কখনো হননি হান্নান, এ যেনো হিংস্র রূপধারী অচেনা কোনো ব্যক্তির সমুখে আছেন। ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো হিংস্র চাহনিটা কোনোভাবেই শান্ত হলো না, হান্নান শেখের দিকে এক কদম এগুতেই ভয়ে হান্নান কুঁকড়ে গেলেন। কোঁকাতে-কোঁকাতে তোতলা সুরে বললেন,

– আ-আ-আমামাকে মে-মে-রো না,

কথাটা উচ্চারণ করে কোনো লাভ হলো না। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিটা সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ দৃষ্টি নড়চড় হয়ে হান্নান শেখের বুকের দিকে থামলো, হান্নান শেখ সেটা লক্ষ করে নিজেও বুকের দিকে তাকালেন। চোখটা বুকের ডানদিকে যেতেই ভয়ে শিউরে উঠলেন তিনি! চোখদুটো বিশাল বড় করে ফের মাহতিমের দিকে তাকালেন। মাহতিম চুপচাপ ভঙ্গিতে হান্নান শেখের তামাশা দেখছে। হান্নান শেখ নিজের শোচনীয় অবস্থা দেখে আকুতি কন্ঠে বললেন,

– আ-আমাকে মে —

বাক্যটা শেষ করার আগেই মাহতিম ধীরগতিতে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। ডানহাতের নিচু রিভলবারটা আচমকা উপরে তুলতে লাগলো। দূর্দশা টের পেয়ে হান্নান শেখ গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলেন। বারবার আকুতি মেশানো কন্ঠে মিনতি করতে থাকলেন, মাহতিমের পেছনে থাকা টিমটা পাষাণের মতো দৃশ্যটা দেখতে লাগলো, কেউ কোনো টু শব্দ উচ্চারণ করলো না। রিভলবারটা দুহাতে উঁচু করে বুকভর্তি নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম, তর্জনী আঙ্গুলটা ট্রিগারে রেখে জোরে এক চাপ দিয়ে বসলো। তীব্র শব্দযোগে নিরবতা চিঁড়ে গেলো, সোজা বুকের বাম পাশটা বুলেটবিদ্ধ হলো। মাহতিম তবুও থামলো না, চোয়াল শক্ত করে অনবরত ট্রিগার চাপতেই থাকলো, একের-পর-এক জোরদার শব্দ শেষে থেমে গেলো মাহতিম। আরেকবার বুকভর্তি নিশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে রিভলবার নামিয়ে ফেললো। বুক ঝাঁঝরা দেহ নিয়ে মাটিতে পরে গেলেন হান্নান। চোখজোড়া বড়-বড় করে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেনো নিশ্চল চোখজোড়ায় বলছেন,

– তোমাকে চিনতে ভুল করেছিলাম মাহতিম। সেই ভুলের মাশুল আজ আমাকে শেষ করে দিলো। যেই কালাম সরদার পুরো গ্রামবাসীকে ধোঁকায় রেখেছিলো, তুমি তার এতোগুলো বছরের সাধনা শেষ করে দিলে। আমার জীবনের অঘটনটা নিজের নাতনী দিয়ে ডেকে আনবো, এই চিন্তা কোনোদিন করতে পারিনি। আজ একটা শহুরা ছোকরার কাছে হেরে যাবো, এটাও আমার শেষ ব্যর্থতা।

মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগলো হান্নান শেখের, বুকের রক্তে পিঠের নিচে বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কেনো জানি দৃশ্যটা দেখে মাহতিম চোখ সরিয়ে ফেললো। বডিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টিমের সদস্যদের ইশারা করলো সে। রিভলবারটা কোমরের পেছনে গুঁজতে-গুঁজতে অলস পায়ে জানালার দিকে গেলো। আকাশটা মেঘে সওয়া, সময়টা সন্ধ্যা। যেকোনো সময় মসজিদের মাইকে আযানের ধ্বনি উঠবে, চারপাশটা একসাথে মধুর সুরে মুখর হবে। বেগুনি আভার আকাশটা নিস্তেজ চেহারা ধারণ করেছে, পাখিদের নীড়ে ফেরার ব্যস্ততা দেখে গভীর শ্বাস নিলো মাহতিম। অনেকগুলো সত্য এখন মেহনূরের সামনে প্রকাশ পাবে। মেহনূরকে নিজের মুখে অকাট্য সত্য বলতে সত্যিই ভয় হচ্ছে। এতো বড় ধাক্কাটা নিতে পারবে? যার আঙ্গুল ছুঁয়ে সে বড় হয়েছিলো, যার ছায়াতলে নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতো, তার বিরুদ্ধে লোমহর্ষক সত্যটা জেনে সহ্য ক্ষমতায় থাকবে? মাহতিম কিছুক্ষণের জন্য অস্থির হয়ে উঠলো, সে জানে না সামনে কি হতে চলেছে। ব্যাপারটা যতো ঠান্ডা লাগছে, এটা তত ঠান্ডা হবে না। চিন্তাভাবনায় মশগুল হতেই হঠাৎ পেছন থেকে ডেকে উঠলো,

– স্যার?

ডাক শুনে মাথা ঘুরালো মাহতিম। টিমের সবচেয়ে কর্মক্ষম ব্যক্তি তার দিকে উশখুশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহতিম বিষয়টা বুঝার জন্য জিজ্ঞেস করলো,

– কিছু বলবে আবিদ? এ্যানি নিউজ?

আবিদ সরল ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে দিলো। বুঝিয়ে দিলো ওরকম কিছু বলার নেই। মাহতিম শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো,

– কিছু বলতে চাইলে বলো। আচ্ছা এ্যাম্বুলেন্স এসেছে? ডেডবডি পাঠিয়েছো?

আবিদ এবার সকল জড়তা ছেড়ে মূল কথায় ফিরলো, চোখ নামিয়ে সম্মান দেখিয়ে বললো,

– স্যার, লোকটা তো আপনার রিলেটিভ, তাই না? মানে, আপনি আপনার রিলেটিভকে এনকাউন্টার করলেন, এটা দেখে অবাক হয়েছি।

মাহতিম কথা শুনে মৃদ্যু হাসলো। পকেটের দু’ফাঁকে হাত গুঁজে বললো,

– সবই লাকের উপর ডিপেন্ড আবিদ। আমার বাবা সবসময় একটা কথা বলতো, ‘ যেই জিনিসটা আমরা মনেপ্রাণে চাই, পুরো কায়নাত সেই জিনিসটাকে কাছে আনার জন্য ষড়যন্ত্র করে থাকে। ‘ বাবা কোত্থেকে এমন অদ্ভূত কথাটা শুনেছিলো, আমি জানি না। কিন্তু এ কথা সত্য, লাইফের স্ট্র‍্যাটেজি কখন-কোথায় মোড় নিবে সেটা বলা যায় না।

আবিদ কথাটায় সায় দিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। তখনই স্পষ্ট চোখে দেখতে পেলো, মাহতিমের বুকের ডানপাশটা র:ক্তাক্ত। কপাল কুঁচকে তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন করলো আবিদ,

– আপনি কি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরেননি? আপনার তো ব্লিডিং হচ্ছে স্যার!

মাহতিম এতোক্ষনে বুকের ব্যথাটা টের পেয়ে চোখ নামালো। শার্টের ডানপাশটায় আসলেই ব্লিডিং হচ্ছে। মাহতিম সেটা বুঝতে পেরে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– ভেস্ট পরেছি আবিদ। চিন্তার কিছু নেই। বুলেটটা চামড়া ছুঁয়েছে, পুরোপুরি ঢুকেনি। দ্রুত মেডিকেল ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করো, আমি আজ রাতেই ফিরতে চাই।

আবিদ কিছুটা প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে বললো,

– আজ রাতেই ফিরবেন? কেসটার ফর্মালিটি যে বাকি আছে।

মাহতিম কনফিউশনটা পরিষ্কার করে বললো,

– আমার কাজ শেষ। আমি আলেক আহমেদের কাছে কেস হ্যান্ডওভার করেছি। ডিপার্টমেন্টে আগেই বলা ছিলো, এই কেসের বাকি ফর্মালিটিস তিনি দেখবেন। মিডিয়ার লাইভ ব্রিফটা যেনো ঠিকঠাক মতো কমপ্লিট হয়। কথা ক্লিয়ার?

আবিদ স্যালুট তুলে বললো,

– ইয়েস স্যার।

.

রেসোর্টের জনহীন পুকুরপাড়ে বসে আছে শানাজ। বৃষ্টির জন্য আবহাওয়াটা বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা। কালো পাড়ের বেগুনি শাড়িটা শীত ঢাকতে পারছেনা। আঁচলটা টেনে গা ঢাকলো শানাজ, হাতের মুঠোয় ফোন ধরে বসে আছে। সৌভিকের কথা মতো বিরাট একটা ঝুঁকি নিয়েছে। এখন জানে না পরিস্থিতিটা কেমন গোলমেলে হবে। নতুন এন্ড্রয়েড ফোনটা সৌভিক পাঠিয়েছে, এখন এতে করেই সমস্ত যোগাযোগ সিদ্ধি হবে। হোম বাটন ক্লিক করে স্ক্রিনে সময় দেখে নিলো। ঠিক আটটার দিকে মেহনূরের আসার কথা। মাহতিম আসার পূর্বেই পুরো ঘটনা বলতে হবে। মেহনূরকে এমন কঠিন সত্যের মুখোমুখি না করলে মাহতিমের সাথে আবার ঝামেলা বাঁধবে। ভাবতেই-ভাবতে হঠাৎ কাধে হাতের স্পর্শ পেলো, চমকে গিয়ে পিছু তাকাতেই মেহনূরকে দেখতে পেলো। শানাজের চমকানো অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসছে মেহনূর। হাসি দেখে শানাজ কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

– তুইযে দিনদিন বেয়াদব হচ্ছিস জানিস? এভাবে কেউ হাত রাখে? এমনেই বাতাসের চোটে টান্সমিটার ব্লাস্ট, তার উপর কারেন্ট কখন আসে কে জানে, এদিকে তুই কালো শাড়ি পরে ভয় দেখাচ্ছিস?

শানাজের ভীতু-ভীতু কথা শুনে পাশে বসলো মেহনূর। শানাজের ডান কাধে মাথা রেখে হাসি দিয়ে বললো,

– তুমি যে ভয় পাবে, এটাই কে জানতো? আমি কিন্তু কালো পরিনি বুবু, আমি গাঢ় নীল পরেছি।ভয় পেলে আমি আসলেই দুঃখিত। আমিতো তোমার কথা মতো চলে এসেছি। রাগ কোরো না, আমি বুঝতে পারিনি বুবু।

যতখানি রাগ নিয়ে শানাজ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েছিলো, ততখানি আদর দিয়ে মেহনূরকে আগলে ধরলো সে। মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে বললো,

– মনটা এখন কোন পর্যায়ে আছে রে? খারাপ নাকি ভালো?

মেহনূর পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। জবাবটা দিতে গিয়ে চুপ থাকলো সে। টলটলে পানির দিকে দৃষ্টি রেখে অদ্ভুত কন্ঠে বললো,

– হয়তো ভালোই আছে।

শানাজ এ কথার জবাবে বেশি কিছু বললো না। বুক ফুলিয়ে গভীরভাবে দম নিলো। আস্তে-আস্তে সেটা বাতাসে ছেড়ে ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নিলো। মেহনূরের মাথায় হাত বুলালো বন্ধ করে গালে হাত রাখলো। অনেকটা স্বাভাবিক অনুভব করলে ঠোঁট খুললো শানাজ,

– মেহনূর, তোকে কিছু জরুরি কথা বলার জন্য ডেকেছি। কথাগুলো বলবো-বলবো করছিলাম, কিন্তু সুযোগ পাইনি। কথাগুলো শুনে তুই কেমন আচরণ করবি বুঝতে পারছিনা, শুধু বোন হিসেবে এটুকু বলবো সবকিছু সত্য-মিথ্যার বিচার করে ভাববি। অবুঝের মতো কাউকে কষ্ট দিস না।

কাধ থেকে মাথা তুললো মেহনূর। অন্ধকারে পুরোপুরি দেখতে না পেলেও শানাজের কন্ঠটা অপ্রস্তুত শোনাচ্ছে। মেহনূর চিন্তিত অবস্থায় ঢোক গিললো, না-জানি বুবু কেমন কথা শুনাতে যাচ্ছে। মেহনূর কিছুটা উদ্বেগের সাথে বললো,

– তুমি কি ব্যাপারে বলতে চাচ্ছো বুবু? আমি কাকে দোষী বানাতে যাবো?

শানাজ বারবার হাল ছেড়ে দিচ্ছে। মন বলছে, কথাগুলো শুনলে মেহনূর স্বাভাবিক থাকবে না, অন্যদিকে মস্তিষ্ক বলছে কথাগুলো না বললে আর সুযোগ পাবে না। শানাজ খুব শান্তভাবে মনের কথা শুনলো, সেই মতো মেহনূরের হাতদুটো নিজের হাতে নিলো। মেহনূরের দিকে চোখ রেখে গলা খাকারি দিলো, হালকা একটু কেশে উশখুশ কন্ঠে বললো সে,

– মেহনূর, আমরা এই দুনিয়ায় সবসময় আমোদে থাকবো না। কখনো হাসবো, কখনো কাঁদবো এটাই জাগতিক নিয়ম। যদি সবসময় হাসি-আমোদে থাকতাম, তাহলে হয়তো কষ্টের পর সুখের আনন্দটা টের পেতাম না। তুই কি বিশ্বাস করিস মাহতিম ভাইয়া একজন ভালো মানুষ? আমার দেখা সবচাইতে ভালো মানুষ উনি। তার মধ্যে কোনোদিন অহংকার দেখিনি। আম্মার কাছে শুনেছি, যেই লোকের মধ্যে হিংসা-অহংকার-মিথ্যার মতো গুণ নেই, সে নাকি ভালো মানুষ। যদি ভাইয়াকে নিয়ে যোগ্যতার হিসাব আসে, তাও বলবো ভাইয়ার মতো বর পাওয়া সাত কপালের ভাগ্য। তুইযে উনার চেয়ে ছোট, তোকে সবসময় ছোটর মতোই আদর-যত্ন করেছে। আজ এই কথাগুলো বলতাম না মেহনূর, শুধু তোর ভালোর জন্য কথাগুলো বলছি। তোর কি মনে আছে? ছোট থাকতে আমাদের গ্রামে প্রায়ই লাশ পাওয়া যেতো? জেলে চাচারা মাছ মারতে গিয়ে লাশ পেতো? দাদাজান মাঝে-মাঝে বলতো ডাকাতরা নাকি লুটপাট করে তাদের মে:রে ফেলেছে।

মেহনূর এমন উদ্ভট কথার আগামাথা না বুঝলেও শানাজের কথায় সায় দিলো। শান্ত গলায় বললো,

– হ্যাঁ, মনে আছে।

আবার ঠোঁট ভিজালো শানাজ। ঢোক গিলে বললো,

– আমাদের গ্রামটা ভালো নেই রে। গ্রামটা এখন জঘন্য মানুষের কাজকর্মে নষ্ট হয়ে গেছে। আজ পযর্ন্ত যতগুলো লাশ পাওয়া গেছে, যারা-যারা নিখোঁজ হয়েছে, সবার পেছনে রহস্য লুকিয়ে আছে। যেই রহস্য গ্রামের সরল মানুষরা এখনো জানে না। প্রায়ই আমাদের গ্রাম থেকে বাচ্চা চুরি, বিভিন্ন বয়সী যুবতীর নিখোঁজ খবর আসতো। অমুক-তমুক জায়গায় লা:শ পাওয়া যেতো। কেউ-কেউ জন্মের মতো এমন উধাও হতো, তার টিকিটার পযর্ন্ত খোঁজ পাওয়া যেতো না। এসব ঘটনা কাকতলীয় ছিলো না মেহনূর। প্রত্যেকটা ঘটনার পেছনে একজনই দায়ী ছিলো। একজন মানুষই যুগ-যুগ ধরে এসব কুকর্ম চালিয়েছে।

শানাজের কথায় সন্ধি হারিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকালো মেহনূর। প্রচণ্ড কৌতুহল নিয়ে অস্থির ভাবে বললো,

– তোমার কি মাথা খারাপ? অতো পুরোনো ঘটনার সাথে বর্তমানের মিল করছো কেন? গ্রামে তো এখন কিছুই হয় না। আগে যেগুলো হতো, তাও ডাকাত বা শত্রুতার জেরে হতো। এছাড়া তো কিছুই না।

শানাজ অবাক চোখে বললো,
– তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?

দ্রুতগতিতে মাথা দোলালো মেহনূর। সাথে-সাথে বলে উঠলো,

– না, অবিশ্বাসের কথা আসছে কেন? তুমি কি ভুলে গেছো, হান্নান মোল্লা থাকতে কোনো অন্যায় হতে পারে না? কেনো এমন কথা বলছো বুবু?

হতভম্ব হলো শানাজ! একটা বদমাশ লোকের জন্য মেহনূরের প্রচণ্ড বিশ্বাস দেখে ক্ষেপে উঠলো সে। অজান্তেই সে ঝাঁঝের সাথে চিৎকার করে বললো,

– ওই হান্নান মোল্লা আস্তো একটা জানোয়ার! পাষাণ! ওই জানোয়ারের মধ্যে মনুষ্যত্বের ছিঁটেফোঁটাও নেই! তুই ওই জানোয়ারকে চিনিস? এক ইন্ঞ্চিও চিনিস না! ওই জানোয়ার নিজের স্বার্থের জন্য তোর বাপকেও জিন্দা রাখেনি! ছোট বাবা যে বেঁচে নেই, আজ এটা জেনে নে। আর কোনোদিন তোর বাপকে দেখতে পাবিনা! কোনোদিন না!

বলতে-বলতেই ধরা গলায় কেঁদে দিলো শানাজ। একবারও খেয়াল হলো না, কথাগুলো শোনার পর মেহনূর কি করছে। চোখ তুলেও দেখলো না, মেহনূর যে স্তব্ধ হয়ে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। সে যে চোখের পলক ফেলাটাও ভুলে গেছে, অন্ধকারে দেখতে পেলো না শানাজ। একটুও দেখতে পেলো না।

চলবে .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ .
#পর্বসংখ্যা_৬৩ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

বিকট সাইরেন বাজিয়ে এ্যাম্বুলেন্স চলছে। চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। খালিচোখে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, সুনশান রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। গা ছমছম করা পরিবেশের ভেতর এ্যাম্বুলেন্সের শব্দটা ভয়ংকর লাগছে, অন্ধকার ফুঁড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে গাড়িটা তোড়জোড় কায়দায় ছুটছে। চলন্ত গাড়ির ভেতর লেডি ডাক্তার বসা, সঙ্গে একজন নার্স কাজ করছে। লেডি ডাক্তারটা ছোট্ট কাঁচের শিশি থেকে লম্বা সিরিন্ঞ্জটা ভর্তি করলো। মুখে মাস্ক লাগানো অবস্থায় সামনের পুরুষটির দিকে তাকালো। পুরুষটার মুখটা এখন কাঠের মতো কঠিন দেখাচ্ছে, কানে ফোন লাগিয়ে থেমে-থেমে কাউকে ইন্সট্রাকশান দিচ্ছে। কিছু-কিছু কথা শুনে রাগে ঠোঁট শক্ত করছে, আবার কিছু কথা শুনে বাঁ ভ্রুঁটা উঁচু করে নাক ফুলাচ্ছে। লেডি ডাক্তারটা সিরিন্ঞ্জ ভরা শেষে শিশিটা আগের জায়গায় রেখে দিলো, মুখ ঘুরিয়ে পুরুষটির দিকে তাকাতেই হঠাৎ নার্সের দিকে খেয়াল হলো। মেয়েটা চোরা চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে। শান্ত-মুগ্ধ দৃষ্টিটা নরমভাবে চোখ ঘুরাচ্ছে। লেডি নার্সটা মেয়েটার অবস্থা দেখে ক্ষুদ্ধ হলো, মনে-মনে কঠিন কিছু আওড়ালে শেষমেশ পুরুষটির উদ্দেশ্যে বললো,

– আনসারী, ফোনটা রাখো। তুমিযে আমার আন্ডারে আছো এটা ভুলো না। দেখি হাতটা দাও।

জরুরী কথায় বাধা পেয়ে চোখ ঘুরালো মাহতিম। অন্য কোনো ডাক্তার হলে সে সত্যিই ক্ষেপে উঠতো! কিন্তু এ দফায় সে ক্ষেপলো না। এরই মধ্যে লেডি ডাক্তারটা আবার ফোন রাখতে ইশারা করলো। মাহতিম শান্ত মুখে ওপাশের ব্যক্তিকে কিছু বলে কল কেটে দিলো, ফোনটা রেখে তার বাঁহাতটা চুপচাপ ডাক্তারের দিকে এগিয়ে দিলো। ডাক্তারটা কয়েক সেকেন্ড ইনজেকশনটা চেক করে সূক্ষ্ম সূঁচটা জায়গামতো ঢুকালো। মেডিসিন পুশ করতে-করতে বললো,

– তুমি আর ভালো হলে না। যেই রিস্কি কাজ নিয়ে পরে আছো, আরেকটু হলে ওটিতে ঢুকতে হতো। তোমার কি ওয়াইফের জন্য একটুও টেনশন হয় না? বুলেট কোথায় টাচ লেগেছে জানো?

পুশ করা শেষে জায়গায় তুলা চাপলো মাহতিম। স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতে দৃঢ়তার সাথে বললো,

– লাগলেও কিছু করার থাকতো না। হায়াতের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উপরওয়ালার কাছে। এদিকে আমার-আপনার কোনো হাত নেই। আজ বেঁচেছি, কাল মরবো এটাই নিয়ম।

মাহতিমের কাটকাট কথা শুনে নিশ্বাস ছাড়লো ডাক্তার। মাহতিমের সাথে কোনোদিনই যুক্তি দেখিয়ে পারেন না। সরল-সোজা কথাটা খুবই জঘন্যভাবে প্যাঁচাতে জানে মাহতিম, এমন-এমন যুক্তি উপস্থাপন করে, তখন বাধ্য হয়ে সামনের ব্যক্তিকে মুখ থুবড়ে পরতে হয়। মাহতিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিরুত্তাপ কন্ঠে বললো,

– রুমানা ম্যাম, আমার ওয়াইফটা খুবই সেন্সিটিভ। আশাকরি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।

ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা কেউ না বুঝলেও রুমানা ঠিকই বুঝলো। নার্সের বোকা চাহনি উপেক্ষা করে শান্ত গলায় বললো,

– না বুঝার উপায় আছে? তোমার ওয়াইফ যদি সেন্সলেস হয়, তাহলে আসল কালপ্রিটটা তুমি নিজেই। শার্ট খোলো, যদি স্টিচ লাগে তাহলে এখুনি এ্যাম্বুলেন্স ঘুরাতে বলবে।

ঢোক গিললো নার্সটা। শার্ট খোলার কথা শুনতেই বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। কান গরম লাগছে। লজ্জায় তাকাতে চাইছে না সে, তবুও মনের উপর তাল হারিয়ে চোখ তুললো নার্স। মাহতিম আজ্ঞামতো শার্টের টপ বাটনে হাত দিয়েছে। মুখের থেকে চোখ সরিয়ে মৃদ্যু হেসে দুহাতে বোতাম খুলতে-খুলতে বললো,

– আই এ্যাসোর ইউ ম্যাম, আমার স্টিচ লাগবে না।

রুমানা সার্জিক্যাল মাস্কের আড়ালে ক্ষীণ রাগ দেখিয়ে বললো,

– তুমি নিশ্চয়ই ডাক্তার নও আনসারী! আমাকে দেখতে দাও। যদি স্টিচ লাগার মতো সিচুয়েশন হয়, আমি পিছপা হবো না।

শার্ট খুলা পর ভালোমতো বুকের ডানপাশটা দেখতে লাগলো। হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস পরে একটা কাঁচি নিলো রুমানা, কাঁচির মুখে তুলা নিয়ে ধীরে-ধীরে ক্ষতটা পরিষ্কার করলো। বুলেটপ্রুফ ভেস্টটা যতোই মজবুত হোক, গুলিটা কাছ থেকে করায় ভেস্ট ফুঁটো হয়ে চামড়ায় এসে ঠেকেছে। ভাগ্যিস সেটা চামড়া গলিয়ে বুকে ঢুকেনি। রুমানা দক্ষ হাতে ক্ষতর কাছে ঔষুধ ছুঁইয়ে দিলো, পরিশেষে তুলা দিয়ে ক্ষতর মুখটা বন্ধ করলো। সেবা-শূশ্রুষার পর্ব শেষ হলে সহকারীর দেওয়া খয়েরী শার্ট পরলো মাহতিম। টিমটিমে হলদে বাতির নিচে স্লিভদুটো দ্রুত ভাঁজ করতে থাকলো। নার্স মেয়েটা আড়চোখে মাহতিমের দিকে তাকাচ্ছিলো। রুমানা চল্লিশোর্ধ্ব হলেও তার মেয়েলি সত্ত্বা নার্স মেয়েটার অবস্থা বুঝতে পারছে। ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ঠান্ডা মানুষ হিসেবে মাহতিমকে চেনে সে। পুরো ব্যক্তিত্বের ভেতর আচারনিষ্ঠ ব্যাপারটা প্রকাশ পায়। মেপে-মেপে কথা বলার গুণটা দেখার মতো। আবার সময়মতো যোগ্য কথার পিঠে যুক্তি ছুঁড়তে ভুলে না। মাহতিম সবার কাছে শক্ত মেজাজের মানুষ, যার সাথে কাজ ছাড়া অন্য কথা যায় না। রুমানার প্রতিটা কথা চুপচাপ শোনার পেছনে মাহতিমের বাবা দায়ী। মাহতিমের বাবা রুমানার স্বামীর বন্ধুতুল্য ছিলো। সেই পুরোনো সম্পর্কের জেরে রুমানা আজ মাহতিমকে চেনে। কিন্তু তাজ্জবের ব্যাপার হলো, মাহতিমের বাবার সাথে মাহতিমের স্বভাব কিছুটা হলেও আলাদা। যেখানে মাহতিমের বাবা সবার সাথে মিলেমিশে চলতো, সেখানে মাহতিম তার ডিপার্টমেন্টের কাছে শক্ত। বাপ-ছেলের এমন অদ্ভুত নজির দেখে প্রায়ই অবাক হয় রুমানা। এ্যাম্বুলেন্সটা ঝুপড়ি অন্ধকারের কাছে থেমে গেলো। সাইরেনটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। মাহতিম ফোনটা পকেটে পুড়ে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুললো, এক লাফ দিয়ে নিচে নামতেই মুখ ঘুরিয়ে পিছু ফিরলো। রুমানার দিকে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে যেতে লাগলো মাহতিম। হঠাৎ পা থামিয়ে পিছু ঘুরলো সে। ডান কপালের কাছে দুই আঙ্গুল ছুঁয়ে ‘ স্যালুট ‘ ইশারা করলো। মাহতিমের কাণ্ড দেখে হেসে ফেললো রুমানা। গাট্টা মারা ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে হাসতে-হাসতে বললো,

– বাবার মতো ফাজলামি করবে না আনসারী।

বেশ দূর থেকে সদ্য পড়া রেইনকোটের ব্যক্তিটা উত্তর দিলো,

– আপনাকে সম্মান জানিয়েছি ম্যাম। থ্যাংকিউ ফর দ্যা লিফ্ট।

.

বৃষ্টিতে কাঁচা রাস্তাটা কর্দমাক্ত। জায়গায়-জায়গায় গর্ত ভরে পানি জমেছে। অন্ধকারটা নিকষ বলে সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। ঔষুধের কড়া ডোজে মাথাটা ভার-ভার, বুকের ডানপাশটা এখনো বেশ ব্যথা। এই ব্যথার জন্য ডানহাতটা বেশি নাড়াতে পারছেনা। রেইনকোটের হুডিটা চোখ পযর্ন্ত টেনে নিলো মাহতিম। গায়ে এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টির প্রলেপ লাগছে, বৃষ্টিটা কেনো যে থামছেনা বুঝতে পারছেনা সে। রাস্তা থেকে চোখ তুলে সামনে তাকালো, রেসোর্টের মেইন গেটটা চোখ সওয়া আধারে চিনতে পারলো। ধীরগতিতে এগিয়ে গিয়ে দরজায় দুহাত রাখলো সে, আলতো করে ধাক্কা দিতেই দ্বারদুটো খুলে যেতে থাকলো। ভেতরে পা দিতেই মাহতিম চর্তুদিকে অন্ধকার আবিষ্কার করলো। সবগুলো কটেজের আলো নিভে আছে, কোথাও কোনো আলো নেই। কেবল বিদ্যূৎপৃষ্ঠের আলোয় আকাশ চিড়ে যাচ্ছে, সকালের মতো আলো বিকিয়ে আবার অন্ধকার হচ্ছে। ওইটুকু আলোর মাঝে কটেজের দিকটা খেয়াল করলো সে, কোনটা মেহনূরের কটেজ হতে পারে সেটা বুঝা মুশকিল। সবাই এখন গভীর ঘুমে ডুবে আছে, কাউকে ডেকে তুলাটা শোভা পায় না। মাহতিম দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই বাতাসের জোরদার হুঙ্কার উঠলো। শোঁ শোঁ করে তোড়জোড় হাওয়া বইলে হঠাৎ কটেজের কাছে শব্দ হতে লাগলো। রুমের জানালাগুলো বাতাসের ঝাপটায় দাপাদাপি করছে। মাহতিম দ্রুত চোখের সামনে হাত রেখে ঝাপটা বাঁচিয়ে দেখলো। ওমনেই দুই নাম্বার কটেজটা দেখে নিশ্চিত হলো সে। বাতাসে জানালার কপাট খুলতেই জলন্ত মোমের শিখাটা দেখতে পেলো মাহতিম। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আলোর শিখাটা দেখলো। ঠোঁটের কোণে চিরচেনা হাসিটা ফুটে উঠলে সেদিক বরাবর পা বাড়ালো। কটেজের সিড়িতে পা ফেলেই দরজার দিকে গেলো সে, গা থেকে রেইনকোট খুলে নবে হাত দিলো। খুবই নৈপুণ্যের সাথে দরজা খুললো মাহতিম, একটুও শব্দ না করে চটপট ভেতরে ঢুকে গেলো। দরজাটা চাপিয়ে দিতেই টেবিলে চোখ পরলো। লম্বা মোমের মাথায় আলোর শিখা জ্বলছে, বাতাসের জন্য দপদপ করে হলদে শিখাটা লাফাচ্ছে। পুরো ঘরটার ভেতর সম্মোহনী পরিবেশ। কাউকে বশ করা জন্য মোক্ষম সুযোগ। মাহতিম চোখ তুলে বিছানার দিকে তাকালো। সবসময়ের মতো লম্বা দীঘল চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। বিছানা ডেঙিয়ে ফ্লোরের উপর স্তুপ হয়ে আছে। মোমের হলদে আলোয় একপলক দেখার জন্য মন ছটফট করছিলো। ঘুমন্ত মুখের পবিত্রতা দেখার জন্য, ছোঁয়ার জন্য মাহতিম যেন ব্যকুল। ডানকাত হয়ে শুয়ে আছে মেহনূর। তারই দেওয়া গাঢ় নীলের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। মাহতিম খুব আস্তে করে পা এগিয়ে চললো, বিছানার কাছে এসে চুপচাপ বসলো। মেহনূরের মুখটা চুলের নিচে লুকিয়ে আছে, কালো-কালো চুলের নিচে উজ্জ্বল চামড়াটা লুকোচুরি খেলছে। মাহতিম তর্জনী দিয়ে সবগুলো চুল কানের পেছনে গুঁজে দিলো। মুখ নামিয়ে গালের উপর দু’ঠোঁট ছেড়ে দিলো, চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। বাঁহাত এগিয়ে মেহনূরের গলা জড়িয়ে ধরলো, গালের উপর ঠোঁটযুগলের চাপ বসিয়ে চুমু খেলো সে। উষ্ণ স্পর্শের কাছে তন্দ্রা কাটলে চোখ খুললো মেহনূর।সেই মাদকপূর্ণ পারফিউমের সুগন্ধটা আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। বুক ফুলিয়ে লম্বা নিশ্বাস নিলো মেহনূর, চোখ বন্ধ করে মাহতিমের উপস্থিতিটা গাঢ় বুঝলো। নিশ্বাসটা ছেড়ে চোখ খুলে মাহতিমের দিকে ফিরলো। নিমিষেই দুটো মুখ দুজনের পানে থামলো। জানালা থেকে আগত বাতাসের মোমের শিখাটা নড়ছে, রুমের মধ্যে সেটার জন্য আলো ঘুরাঘুরি করছে। কিছুক্ষণ দুজনের ভেতর মৌনতার সময় চললো। মেহনূর সামনে থাকা মুখটার দিকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তাকালো। কপালে সাদা ব্যান্ডেজ করা। ঠোঁটের ডান কোণাটা টকটকে লাল হয়ে আছে। ঠোঁট থেকে চোখ সরিয়ে চোখের দিকে তাকালো, মাহতিমের গভীর চোখদুটোর মাঝে দৃষ্টি মিলিয়ে দিলো। জীবনের সকল অধ্যায় আজ বন্ধ হয়ে শুধু একটা অধ্যায় খুলে রইলো। এই একটা অধ্যায় ছাড়া আর কোনো হিসাব নেই মেহনূরের। বাইরে থেকে চিরচেনা মানুষগুলো অধ:মের মতো পরিচয় দিয়েছে। যাদের ছায়াতলে বীজ থেকে বৃক্ষ হয়েছে, আজ তারা অমা:নুষ! শানাজের মুখ থেকে সব শোনার পর একটুও কাঁদেনি মেহনূর। কেনো জানি ভেতরটা শুষ্ক-বিরান লাগছিলো। জনশূন্য চরের মতো খালি-খালি ঠেকছিলো। কথাগুলো শোনার পর একটা স্বাভাবিক মানুষের মতো চিৎকার করে কাঁদা উচিত, হাউহাউ করে কাঁদাটাও ব্যতিক্রম কিছু হতো না, আজ মেহনূর একফোঁটাও চোখের পানি ফেলতে পারেনি। যেখানে শানাজ বলতে-বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলো, সেখানে আজ শান্ত ছিলো সে। কথাটার ভয়াবহতা তাকে নির্বাক বানিয়ে দিয়েছে, তাকে বিমূঢ় অবস্থায় বাজেভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। সেখান থেকে উত্তরণের পথ আজ দিশেহারা। মেহনূরকে অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ দেখে মাহতিম নিজ থেকে বলতে নিলো, ঠিক তখনই ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বাঁধ সাধলো মেহনূর। ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে বালিশ থেকে মাথা তুললো। কিছুটা উঁচু হয়ে মাহতিমের দু’চোখের পাতায়, দুটো গালে, কপালের ব্যান্ডেজের উপর ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। শান্ত মনে প্রশান্তির ছাপ পেয়ে চোখ বুজলো মাহতিম, ঠান্ডা-ঠান্ডা মূহুর্তে উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে মনটা বড় কাঙাল হয়ে যাচ্ছে। এই গভীর রাতের আদরগুলো সবটুকু ক্লান্তি শুষে নিচ্ছে, ব্যথায় ক্লিষ্ট হওয়া দেহটা ভারমুক্ত হচ্ছে। বালিশে মাথা রাখলো মেহনূর, মাহতিমও চোখ খুলে তাকালো। মাহতিমের দিকে সরল দৃষ্টি রেখে আকুল কন্ঠে বললো,

– আপনার বুকটায় ঘুমাতে চাইলে রাতটুকুর জন্য দিবেন?

মাহতিম নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মেহনূরের উপর থেকে সরে বিছানা থেকে নামলো। পকেট থেকে মোবাইল, ঘড়ি, ব্লুটুথ ডিভাইস বের করে টেবিলো রাখলো মাহতিম। এদিকে হাত খোপা পাকাতে-পাকাতে বিছানা থেকে নামলো মেহনূর। দরজাটা ঠিক মতো লক করা জন্য সেদিকে এগিয়ে গেলো। নবের মধ্যে বাটন টিপে দরজা লক করলো। জানালার কাছে গিয়ে পর্দাটা সুন্দর করে টেনে দিলো। বিছানার দিকে ফিরে আসতেই কপাল কুঁচকালো মেহনূর। মাহতিমের উন্মুক্ত বুকটার দিকে ব্যান্ডেজ দেখে উদ্বিগ্ন চোখে তাকালো। মাহতিম চাহনিটা বুঝতে পেরে দু’হাত দুপাশে মেলে দিলো, মেহনূরকে কাছে আসার ইঙ্গিত দিলে ধীরে-ধীরে বিছানার কাছে আসলো মেহনূর। মৌন অবস্থা ধার্য রেখে মাহতিমের পাশে শুলো, কিন্তু বুকের দিকে এগোনোর সাহস পেলো না। মাহতিম মেহনূরের অপ্রস্তুত মুখটা দেখে অভয় দিয়ে বললো,

– ডানপাশটা ইন্ঞ্জুর্ড, বাঁ-পাশটা এখনো ফিট। আসো মেহনূর, ভয় পেও না।

মেহনূর আবার ব্যান্ডেজের দিকে তাকালো, বড় একটা ঢোক গিলে বললো,

– আপনার ঘুম প্রয়োজন। আজকে থাকুক।

মাহতিম তাচ্ছিল্যের সাথে বাঁ ভ্রুঁ উঁচু করলো। সেই মেজাজেই বললো,

– তুমি আমাকে বাধ্য করার চেষ্টা করছো। আমার রাগ তুলে দিও না। আসতে বলেছি! কোনো কথা না বলে চলে এসো।

কন্ঠের দাপট দেখে মিইয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চলে আসলো মেহনূর। উন্মুক্ত বুকের বাঁপাশটায় মুখ লুকিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সাথে-সাথে বলপূর্ণ হাতদুটো দু’দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো, ছোট্ট ছানার মতো গুটিশুটি মেয়েটাকে ঢেকে দিলো মাহতিম। তার মাথায় আঙ্গুল বুলিয়ে-বুলিয়ে ঘুমানোর জন্য আরাম করে দিলো। বৃষ্টির শব্দ কমে এসেছে, বাইরে এখন প্রচুর ঠান্ডা। সেই ঠান্ডার হাওয়াটা ফাঁকফোঁকর পেয়ে রুমের ভেতর ঢুকছে। রুমের ঠান্ডা পরিবেশে চোখ জুড়ানো ঘুম আসছে। মাহতিম ঘুমের জন্য চোখ বুজতেই হঠাৎ বুকের কাছে কান্নার দমকটা টের পেলো! তাড়াতাড়ি মুখটা নিজের দিকে তুলতেই প্রশ্ন করলো সে,

– তুমি কাঁদছো?

মেহনূরের চোখে স্পষ্ট কান্নার আভাস! মাহতিম কিছু বলার পূর্বেই মেহনূর অশ্রুমাথা চোখে ধরা গলায় বললো,

– উনার কবরটা কোথায় দেওয়া হবে?

বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মাহতিম। আজ উত্তরের ঝুলিটা আসলেই খালি।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO