মন রাঙানোর পালা পর্ব-১৬

0
3

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_16
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি অভিকের ফেরার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আর দু-একদিনের মধ্যেই অভিকের ফেরার কথা। সুনীতির যেন এই সামান্য সময়টুকুও আর তড় সইছে না। সে বারংবার নিজের রুমে পায়চারি করে চলেছে। এরইমধ্যে সামিউল খন্দকার হঠাৎ তার রুমে এসে বলে,”কি রে? সকাল থেকে তোকে এত উদগ্রীব লাগছে কেন? তোর কি কিছু হয়েছে?”

“না, তেমন কিছু না।”

“শোন, ভালো কথা। আজ অভিকের বাবার সাথে কথা হলো৷ অভিক তো দু-একদিনের মধ্যেই ফিরছে। ওর কাছে আবার খুব বেশিদিনের ছুটি নেই। এসেই ৩ দিন পর চলে যাবে। সেজন্য উনি বলেছেন এরমধ্যেই অনুষ্ঠান করে তোদের বিয়ের ব্যবস্থাটা করতে। এজন্য তো কিছু কেনাকাটা করতে হবে৷ তোর আম্মু বলছিল আজ বিকেলে মার্কেট করতে বের হবো।”

সুনীতি বলে,”ঠিক আছে, ব্যাপার না। আমি তৈরি হয়ে থাকব।”

সুনীতি বিকেল নাগাদ তৈরি হতে শুরু করল শপিং কর‍তে যাওয়ার জন্য। একটার পর একটা সালোয়ার-কামিজ বের করছে কিন্তু একটাও তার পছন্দ হচ্ছিল না। শেষে বিরক্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়লো। এমন সময় নয়না খন্দকার তার রুমে এসে তাকে এভাবে বিছানায় বসে থাকতে দেখে বললো,”কি হয়েছে মামনী? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”

সুনীতি খানিক অস্বস্তি প্রকাশ করে বলল,”এখানে এত ড্রেস কিন্তু একটাও আমার পছন্দ হচ্ছে না। বুঝতে পারছি না কোনটা পড়ে যাব।”

নয়না খন্দকার মাথা চাপড়ে বললেন,”তুমি আর বড় হলে না, মামনী৷ এসো আমি তোমায় একটা পছন্দ করে দিচ্ছি।”

বলেই নয়না খন্দকার একটা সাদার উপর লাল নকশা করা খুব সুন্দর একটা সালোয়ার কামিজ পছন্দ করে দিলেন এবং বললেন,”এটা পড়ে দেখো, মামনী৷ তোমায় অনেক সুন্দর লাগবে।”

“এইজন্যই তোমায় এত ভালো লাগে মা। তুমি আমার পছন্দটা আমার থেকেও বেশি বোঝো।”

“এবার তুমি নিজের পছন্দ নিজেই বুঝতে শেখো,মামনী। সবসময় তো আর এভাবে আমাকে পাশে পাবে না।”

নয়না খন্দকারের এই কথা শুনে সুনীতি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”এমন কথা বলিও না, মা।”

“পাগল মেয়ে। তোমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে৷ আজ হোক বা কাল তোমাকে তো আমাদের ছেড়ে যেতেই হবে৷ তখন নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে।”

“তোমাকে ছাড়া আমি কোথাও যাব না, মা। আমি যেখানেই যাব তোমাকে সাথে নিয়ে যাব।”

নয়না খন্দকার মেয়ের এসব পাগলামী দেখে বলেন,”কারো মা-বাবা কিন্তু আজীবন থাকে না।”

“মা!”

“আচ্ছা,ঠিক আছে। এখন চটজলদি তৈরি হয়ে নাও। আমাদের তো যেতে হবে নাকি!”
~~~~~~~~~~~~~~~~~
শপিং মলে এসে নিজের পছন্দমতো কেনাকাটা করতে লাগল সুনীতি৷ হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল একটা সুন্দর নীল বেনারসিতে। অভিক একবার তাকে বলেছিল, অভিকের প্রিয় রং নীল। এটা ভেবেই সে মুচকি হাসে।

অতঃপর নয়না খন্দকারকে বলে,”মা, দেখো তো এই শাড়িটা কেমন?”

“বাহ, বেশ ভালো তো।”

“বিয়ের জন্য এই বেনারসিটাই নেই?”

“তোমার যদি পছন্দ হয় তো নাও।”

সুনীতি সহাস্যে ঐ বেনারসিটাই কিনে নেয়। সুনীতি যখন এতটা হাসিখুশি ছিল তখন দূর থেকেই কেউ শকুনের দৃষ্টিতে গিলে খাচ্ছিল তাকে। যার শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা।

সে আর কেউ নয়, মন্টু। এক সপ্তাহ আগেই সে জেল থেকে পালিয়েছে। তারপর থেকে গা ঢাকা দিয়ে বেরাতে হচ্ছে। সুনীতির উপর তার একটা চাপা ক্ষোভ রয়ে গেছে। কারণ সুনীতির জন্যই আজ তার এই অবস্থা। সুনীতিকে এত হাসিখুশি দেখে তার আক্রোশ বাড়ল। তীব্র আক্রোশ নিয়ে বলল,”আমাকে ফেরারি আসামী বানিয়ে তুই এত সুখে থাকবি সেটা তো হতে পারে না। আমি যদি শান্তিতে থাকতে না পারি তাহলে তোকেও শান্তিতে থাকতে দেব না।”

বলেই সে আড়াল থেকে সুনীতিদের উপর নজর রাখতে থাকে। সুনীতিরা শপিং মল থেকে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে। অতঃপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মন্টু বর্তমানে ট্রাকচালক হিসেবে কাজ নিয়েছে। ওরা বেরিয়ে যাবার পরই মন্টু ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওদের গাড়ির পেছন পেছন। কিছুদূর এগোনোর পর মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দেখে মন্টু নিজের মাথায় একটা কুৎসিত ষড়যন্ত্রের নকশা করে ফেলে।

সামিউল খন্দকার গাড়ি চালাচ্ছিলেন আর তার পাশে বসে ছিলেন নয়না খন্দকার। সুনীতি পিছনের সিটে বসে আজকের করা শপিংগুলো দেখছিল৷ সবকিছু ভীষণ স্বাভাবিক চলছিল হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে ভীষণ জোরে তাদের গাড়িতে ধাক্কা দেয়৷ যার ফলে তাদের গাড়ি দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। সকলের আত্মচিৎকারে ভাড়ি হয়ে ওঠে আশেপাশের আকাশ বাতাস। তূলনামূলক জনশূন্য স্থান হওয়ার লোকের সাহায্য করতে ছুটে আসতে দেরি হয়ে যায়। যার মধ্যেই ঘটে যায় অনেক বড় অঘটন।

~~~~~~~~~~~~~
সুনীতি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। জ্ঞান ফিরতেই নাকে ফিনাইলের তীব্র গন্ধ এলো। বুঝতে বাকি রইল না সে হাসপাতালে রয়েছে। হঠাৎ করেই সুনীতির চোখের সামনে সেই বাজে মুহুর্তের স্মৃতি ভেসে উঠল। সে চিৎকার করে উঠে বসতে চাইল কিন্তু পারল না। কর্তব্যরত চিকিৎসক সুনীতির অবস্থা বুঝতে পেরে বলেন,”আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন।”

সুনীতি কাপা কাপা হাতে মুখ থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারটা সরিয়ে বলে,”আমার মা, আমার বাবা..ওনারা কোথায়?”

হঠাৎ করেই ডাক্তারের মুখে আধার নেমে আসে। তবুও তিনি বলেন,”ওনারা ঠিক আছেন। আপনি শুয়ে থাকুন। আর একটু সময় পর আপনি ওনাদের সাথে দেখা করতে পারবেন।”

সুনীতি লক্ষ্য করে তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। সে আর কিছু না ভেবে পুনরায় শুয়ে পড়ে। কিন্তু পরিপূর্ণ স্বস্তি পায়না।

কিছু সময় পর আহসান চৌধুরী এবং রাহেলা খাতুন আসেন সুনীতির কেবিনে তার সাথে দেখা করতে। তাদেরকে দেখে সুনীতি উঠে বসে মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে বলে,”আঙ্কেল, আন্টি..আপনারা এসেছেন? মা-বাবা কোথাও? ওদের বেশি চোট লাগে নি তো? ওরা কি খুব আহত? আমাকে একটিবার ওদের সাথে দেখা করিয়ে দাও না।”

রাহেলা খাতুন আড়ালে নিজের চোখের জল মোছেন। কিছু কারণে সুনীতির উপর রেগে থাকলেও তিনি এতটাও অমানুষ নন যে এরকম পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকতে পারবেন।

আহসান চৌধুরী আলতো করে সুনীতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”তুমি এখন অসুস্থ, আগে একটু সুস্থ হও তারপর তোমার মা-বাবার সাথে দেখা করিও।”

সুনীতি মানতে চায়না। সে বলে,”আমি একদম ঠিক আছি আঙ্কেল। আপনি প্লিজ আমাকে মা-বাবার সাথে দেখা করিয়ে দেন। নাহলে আমি একটুও শান্তি পাব না।”

আহসান চৌধুরীকে এবার দমে যেতে হলো। একপলক রাহেলা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি ওকে নিয়ে এসো।”

রাহেলা খাতুন সুনীতির কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সুনীতির হাত থেকে ক্যানুলা খুলে সাবধানে রাখলেন। অতঃপর বললেন,”তুমি নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখার চেষ্টা করো। এটা মনে রেখো, ভাগ্যে যা আছে তা কোনভাবেই আটকানো যায় না।”

রাহেলা খাতুনের কথা শুনে সুনীতির বুক ধক করে ওঠে। মনে এলো হাজারো বাজে চিন্তা। সুনীতি আনমনেই বলে উঠল,”তাহলে কি মা-বাবার বড় কোন ক্ষতি হয়ে গেল?”

সুনীতি কয়েক কদম হেটেই উত্তেজিত হলো৷ বলতে লাগল,”মা-বাবাকে কোন রুমে রাখা হয়েছে? আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলুন না।”

আহসান চৌধুরী একটা রুমের সামনে এসে থামলেন। রুমের বাইরের লেখাটা সুনীতির চোখে পড়ল। সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না৷ নিজের শরীরের যতটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল তা দিয়েই দৌড়াল। হোচট খেতে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মনে পড়ল মায়ের বলা,”নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে” কথাটা।

সুনীতি সেই কক্ষের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার সামনে সাদা কাপড়ে মোড়ানো দুটো নিথর দেহ। যেই দেহ দুটির মালিক ছিল সামিউল খন্দকার এবং নয়না খন্দকার। সুনীতি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারল না। সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

To be continue…….