#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_19
#ইয়াসমিন_খন্দকার
সুনীতি ও অভিকের জীবন একসাথে বেশ ভালো ভাবে অতিবাহিত হতে থাকে। সিলেটে আসার পর ৩ মাস অতিবাহিত হয়েছে। দুজনের সম্পর্ক আরো মজবুত হয়েছে। একে অপরের মন রাঙিয়ে দিয়েছে দুজনে। “আপনি” থেকে “তুমি” ডাকে নেমে এসেছে সুনীতি। এখন সে অভিককে তার নাম ধরেই ডাকে।
অভিক ও সুনীতির আগামী সপ্তাহে আবার ঢাকা ফেরার কথা আছে। তবে তার আগে আজ অভিককে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশনে যেতে হবে। যার জন্য সে এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে সুনীতির মনে ভয় জেকে বসেছে। কারণ সে শুনেছে এই মিশনটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হতে চলেছে। মূলত সিলেটের সীমান্ত এলাকায় একটা চক্র সক্রিয় অবস্থানে আছে। তারা ভারতের আসামের একটা চক্রের সাথে মিলে দেশের মধ্যে অবৈধ মাদক এবং অস্ত্রের আমদানি করছে। এই বিষয়ে গোপন কিছু তথ্য এসেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে। আজ রাতেও এই চক্রের পরিকল্পনা আছে সীমান্ত দিয়ে কিছু নিষিদ্ধ মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করানোর। তাই সেই চক্রকে ধরার জন্য সীমান্তে সেনাবাহিনীকে একটা গোপন মিশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অভিক প্রস্তুত হচ্ছিল। সুনীতির চিন্তিত মুখ দেখে সে বলে,”এতটা দুশ্চিন্তা করো না নীতি। আমি এর আগেও এমন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে গিয়েছি। আমার কোন ক্ষতি হয়নি।”
সুনীতি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমি তো দুশ্চিন্তা করতে চাইছি না কিন্তু দুশ্চিন্তা নিজে থেকে আমার মাথায় এসে জেঁকে বসছে। জানি না কেন..নিজের মা-বাবাকে হারানোর পর থেকে আমার মাথায় সবসময় সেই দূর্বিষহ ঘটনাই ঘুরপাক খায়। অবচেতন মনে স্বজন হারানোর বেদনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বর্তমানে আমার আপন বলতে তো তুমিই আছ অভিক..তাই আমি এখন তোমাকে আর হারাতে চাই না।”
অভিক সুনীতির চিন্তাটা বুঝতে পারছে। কিন্তু এটা তো তার দায়িত্ব। যা তাকে পালন করতেই হবে। অভিক সুনীতির কাছে এসে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি কথা দিচ্ছি..আমার কিছু হবে না। আমি খুব শীঘ্রই ফিরব। আগামী সপ্তাহে তো আমাদের ঢাকা ফেরার কথা। ঢাকায় ফিরে এবার আমরা একসাথে শহর ঘুরব।”
“সত্যি?”
“একদম।”
অভিকের কথায় সুনীতি ভরসা পায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকব।”
অভিক আবেগের বশে সুনীতির কপালে আলতো করে চুমু খায়।
তাদের এই ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে হঠাৎ করে আরাফাত সেখানে চলে আসে। সে এখানে মূলত এসেছিল অভিককে ডাকার জন্য। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে সে লজ্জায় ফিরে যেতে নেয়। ভুলবশত তার হাত লেগে একটা ফুলঝুরি পড়ে যায়। অভিক ও সুনীতি চমকে উঠে একে অপরের থেকে দূরে সরে আসে। আরাফাত আমতাআমতা করে বলে,”সরি..ভুল সময়ে চলে এসেছি।”
অভিক কটমট দৃষ্টিতে আরাফাতের দিকে তাকায়৷ আরাফাত একটা শুকনো ঢোক গিলে। সুনীতি লজ্জা পেয়ে সেই স্থান থেকে একপ্রকার দৌঁড়ে বিদায় নেয়। ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ে এবং দরজা লাগিয়ে দেয়। সুনীতি চলে যাবার পর অভিক এগিয়ে এসে আরাফাতের মাথায় গাট্টা মে*রে বলে,”তোর কি কোন আক্কেল নেই? দিলি তো ওকে লজ্জা পাইয়ে।”
“আমার কি দোষ? তোরা দরজা লাগিয়ে রোম্যান্স করতে পারিস না। আমার মতো সিঙ্গেল মানুষ এসব দেখে কত কষ্ট পায়, তুই কি বুঝবি?”
অভিক ক্রোধিত হয়ে বলে,”দাঁড়া, আঙ্কেল, আন্টিকে বলে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি।”
“হ্যাঁ, দোস্ত। জলদি কর। তাহলে আমি একটু শান্তি পাই। সিঙ্গেল লাইফ আর ভালো লাগছে না।”
এভাবে কথায় কথায় তাদের সময় চলে যায়। আরাফাত ঘড়ি দেখে বলে,”আমাদের যাবার সময় হয়ে গেছে। চল, আমাদের এখন বের হতে হবে।”
অভিক বলে,”তুই একটু থাক। আমি নীতির থেকে বিদায় নিয়ে আসি।”
বলেই অভিক সুনীতির রুমের সামনে এসে দরজায় নক করে। সুনীতি দরজা খুলে দিতেই অভিক বলে,”আমি এখন বের হচ্ছি। তুমি সাবধানে থেকো।”
“আপনিও সাবধানে থাকবেন। একদম অক্ষত অবস্থায় যেন আপনাকে ফিরে পাই।”
অভিক হালকা হাসে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সুনীতিকে কাছে টেনে তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। দীর্ঘক্ষণ চুম্বন করে সুনীতিকে ছেড়ে দিয়ে বলে,”যো হুকুম মেরে আকা।”
~~~~~~~~~~~~~~~
অভিক, আরাফাত সহ বাকি সবাই সেনাবাহিনীর একটা জিপে করে সীমান্ত এলাকার দিকে যাচ্ছিল। ওখানে গিয়ে কিভাবে কি করবে সেই ব্যাপারে সবাই আলোচনা করছিল। এমন সময় অভিকের কাছে বিগ্রেডিয়ার আলমগীর ইসলামের কল আসে। অভিক যেহেতু এই মিশনের হেড তাই তিনি তাকে কিভাবে মিশন পরিচালনা করতে হবে সেই বিষয়ে সব পরামর্শ দেন। অভিক সবটা মনযোগ দিয়ে শোনে। এরপর নিজের টিমের সবাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”সবাই নিজের দৃষ্টি সজাগ রাখবে। মনে রাখবে, দুষ্কৃতকারী দের কোনভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। আমাদের কাছে এখন এটা সুবর্ণ সুযোগ। আজ রাতে ঐ পাচারকারী চক্রকে যেকোন মূল্যে ধরতে হবে।”
সবাই সমস্বরে বলে,
“ইয়েস, স্যার।”
সীমান্ত এলাকায় পৌঁছে সবাই যে যার নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নেয়। আরাফাত ও অভিক একই সাথে পাশাপাশি অবস্থান করছে। এখনো তাদের হাতে কিছুটা সময় আছে। তাই দুই বন্ধু কিছু ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। কথায় কথায় আরাফাত বলে,”তুই কি ভাবিকে এখনো তার মা-বাবার মৃত্যুর আসল সত্যটা জানাস নি?”
অভিক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”না,রে। এখনো জানিয়ে উঠতে পারি নি। আমার কেন জানি নিজের কাছে কেমন কনফিউশান অনুভব হয়। সুনীতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। দুঃখ কাটিয়ে উঠেছে অনেকটাই। এই মুহুর্তে ওকে এসব বলে আবারো দুঃখের দিকে ঠেলে দিতে পারি না।”
“কিন্তু এভাবে লুকিয়ে রাখাও তো ঠিক না। যদি ভাবি কোন দিন আসল সত্যটা জানতে পারে তাহলে তিনি আরো বেশি কষ্ট পাবেন এটা ভেবে যে…তুই ওনার থেকে সত্যটা লুকিয়েছিস।”
“এটাও ঠিক। আবার,ঐ মন্টুকেও এখনো খুঁজে পায়নি পুলিশ। জানি না,ও কোথায় গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে। এবার ঢাকায় গিয়ে আমি ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। ইতিমধ্যেই নিজের চেনাজানা অনেককে লাগিয়ে রেখেছি। গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরাও মাঠে নেমেছে। কিন্তু জানি না, এই শয়তান মন্টু কোন জাহান্নামে লুকিয়েছে যে ওকে খুঁজে পাচ্ছে না।”
“ওকে খুঁজে পেলে তুই কি করবি?”
“ওকে উচিৎ শিক্ষা দেব। সুনীতির মা-বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব। তাদেরকে আমি ন্যায় বিচার পাইয়ে দেব। এতে করে তাদের আত্মা শান্তি পাবে আর সুনীতির কষ্টটাও অনেকে লাঘব হবে। এজন্য আপাতত আমি সুনীতির থেকে সত্যটা লুকিয়ে রাখছি..যেদিন মন্টুকে খুঁজে পাব ওকে উচিৎ শাস্তি দেব সেদিন ওকে সব সত্য জানাবো।”
এভাবে তাদের কথাবার্তার সমাপ্তি ঘটে। হঠাৎ করেই গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। সবাই সচেতন হয়ে যায়। পাচারকারী চক্রের লোকেরাও সচেতন হয়ে উঠেছে। তারা সেনাবাহিনীর অবস্থান বুঝতে পেরে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। কিন্তু সেনাবাহিনীও পিছু হটছে না। যার ফলে পাল্টাপাল্টি বেশ ভালোই যুদ্ধ লেগে গেছে। অভিক ও আরাফাতও ঝাপিয়ে পড়ে যুদ্ধের ময়দানে। কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলে। এরপর হঠাৎ করেই বিপরীত দিক থেকে গোলাগুলি থেমে যায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বুঝতে পারে পাচারাকারীরা হয়তো পালিয়ে গেছে৷ তারা সামনে এগিয়ে যায়। হঠাৎ করেই কয়েকজন সেনাবাহিনীর চিৎকার শুনতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায় আরাফাত ও অভিক। অভিক হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে?”
“আমরা একটা মেয়েকে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছি স্যার!”
“কোন মেয়ে?”
অভিক এগিয়ে গিয়ে দেখে একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তার মুখে ভিন্ন দিকে ফেরানো৷ অভিক মাটিতে বসে পড়ে। মেয়েটির কোন সাড়া না পেয়ে সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। মেয়েটার মুখ নিজের দিকে ফেরাতে উদ্যত হয়। অতঃপর মেয়েটাকে নিজের দিকে ফেরাতেই অভিক চমকে ওঠে। বিস্ফোরিত নয়নে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আনিসা!”
To be continue…….