#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_23
#ইয়াসমিন_খন্দকার
অভিক আজ আরাফাতের পরামর্শ অনুযায়ী আনিসাকে নিয়ে একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে এসেছে তাকে দেখানোর জন্য। বর্তমানে তারা অপেক্ষা করছে কখন সাইক্রিয়াটিস্ট হাসপাতালে এসে পৌঁছাবেন। দুজনেই তার কেবিনের বাইরে বসে অপেক্ষা করছে।
কিছু সময় পর, ডাক্তার চলে আসেন। ডাক্তারকে আসতে দেখে অভিক দাঁড়িয়ে পড়ে। সামান্য হেসে বলে,”আপনিই ডাঃ রহমান?”
ডাঃ রহমানও প্রাণোচ্ছল হেসে জবাব দেন,”জ্বি, আপনি নিশ্চয়ই মেজর অভিক, রাইট?”
“হুম।”
“আরাফাত আমাকে বলেছিল আপনার কথা। আপনার পেশেন্ট কোথায়?”
অভিক আনিসাকে সামনে এনে তার দিকে ইশারা করে বলে,”ও হলো আনিসা৷ ওকেই আপনার কাছে দেখানোর জন্য এনেছি।”
“ঠিক আছে, আপনি ওনাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিন। আমার একা ওনার সাথে কথা বলে ওনার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে হবে। তারপর আমি বলতে পারব ওনার কি ধরনের ট্রিটমেন্ট বা থেরাপি প্রয়োজন।”
বলেই ডাঃরহমান নিজের কেবিনে প্রবেশ করেন। অভিক আনিসাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”তুই এখানে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা ওনার পেছন পেছন।”
আনিসা খানিক ভীতু স্বরে বলল,”তুইও আয় না আমার সাথে। আমার একা যেতে ভীষণ করছে।”
অভিক খানিক বিরক্ত হয়ে বলল,”এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি এখানেই আছি। তুই ডাক্তার রহমানকে বিশ্বাস করতে পারিস। উনি অনেক নামকরা একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। তোর যা সমস্যা হচ্ছে নির্দ্বিধায় ওনাকে বলবি।”
অভিক এত করে বলার ফলে আনিসা কিছুটা সাহস পেল। ধীর পায়ে ডাক্তার রহমানের কেবিনে প্রবেশ করল। অভিক বাইরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।
আনিসাকে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখে ডাক্তার রহমান নম্র সুরে বললেন,”হ্যাভ আ সিট।”
আনিসা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে চুপচাপ বসে পড়ে। ডাক্তার রহমান জিজ্ঞেস করেন,”আপনার নাম?”
“আনিসা আঞ্জুম।”
“বয়স?”
“২৯”
“ওহ। তো বলুন আপনার কি সমস্যা?”
আনিসা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,”আপনি জীবনে কখনো কোন ভুল করেছেন ডাক্তার সাহেব? যার জন্য আপনাকে এখনো অব্দি পস্তাতে হচ্ছে?”
ডাক্তার রহমান মুচকি হেসে বলে,”সকল মানুষের জীবনই ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে। কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আমার জীবনেও এমন অনেক ভুল আছে। যা নিয়ে আমায় আফসোস করতে হয়।”
আনিসা কাঁদো কাঁদো সুরে বলে,”জানেন, ডাক্তার সাহেব। আমার ভুল আমাকে শান্তি দেয় না একমুহূর্তের জন্যেও। প্রতি মুহুর্তে আমাকে তড়পায়। যখনই সেই ভয়ানক স্মৃতি গুলো মনে পড়ে..আমি..আমার ইচ্ছা করে নিজেকে শেষ করে দেই।”
ডাক্তার রহসান শান্ত ও বিনম্র স্বরে বলেন,”কাম ডাউন। এত হাইপার হবেন না। ঠান্ডা মাথায় কথা বলুন। আমি বুঝতে পারছি আপনার অতীতে আপনার সাথে এমন কিছু ইন্সিডেন্ট ঘটেছে যা আপনাকে ট্রমাটাইজ করে রেখেছে। তবে আপনাকে এই ট্রমাকে ওভারকাম করতে হবে। দুচোখ বন্ধ করে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিন। তিক্ত স্মৃতিকে দূরে ঠেলে নিজের জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলো মনে করার চেষ্টা করুন। তাহলেই দেখবেন, আপনি অনেকটা শান্তি পাবেন।”
আনিসা, ডাক্তার রহমানের কথা মতোই কাজ করে। চোখ বন্ধ করে ভালো স্মৃতিগুলো মনে করে। যেই স্মৃতির সবটা ঘিরেই ছিল অভিক!
ডাক্তার রহমান আনিসাকে জিজ্ঞেস করে,”আপনি চোখ বন্ধ করে কি দেখতে পারছেন?”
ডাক্তার রহমানের প্রশ্নের জবাবে আনিসা বলে,”অভি!”
ডাক্তার রহমানের যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়। তিনি আনিসার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”আপনি এখন বাইরে যান এবং আপনার বন্ধু মেজর অভিককে ভেতরে আসতে বলুন।”
আনিসা মাথা নাড়িয়ে বিদায় নেয়। আনিসা চলে যাবার কিছু সময় পর অভিক ডাক্তার রহমানের কেবিনে প্রবেশ করে। ডাক্তার রহমানের সামনে বসে সে জিজ্ঞেস করে,”কি বুঝলেন ডাক্তার?”
“ওনার অতীতে বোধহয় খুব খারাপ কিছু হয়েছিল। যা ওনাকে ট্রমাটাইজ করে দিয়েছে।”
“ওকে এই ট্রমা থেকে বের করার কি কোন উপায় নেই?”
“উপায় আছে।”
“কি উপায়?”
“উপায়টা হলেন আপনি।”
“আমি?”
“হ্যাঁ, আপনি। আপনাকে ঘিরে ওনার অনেক সুন্দর স্মৃতি রয়েছে। যেই স্মৃতিগুলো ওনার ভালো থাকার কারণ। হয়তো ওনার অন্ধকারময় অতীতকে কাটানোর জন্য ওনার আপনার সঙ্গের প্রয়োজন।”
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন?”
“আপনি একটা কাজ করুন, মেজর অভিক। যতটা পারেন মিস আনিসার সাথে সময় কাটান। আপনার সাথে থাকলে হয়তো উনি ওনার ট্রমা অনেকটা কাটিয়ে উঠবেন। মোদ্দাকথা ওনার আপনার কোম্পানির প্রয়োজন।”
“জ্বি, বুঝতে পেরেছি। আপনাকে ধন্যবাদ।”
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সুনীতি অস্থির হয়ে সারা ঘরময় পায়চারি করে চলেছে। ঘড়ির কাঁটায় সময় বর্তমানে বিকেল ৪ টা। অভিকরা ১২ টার সময় বের হয়েছে। এতক্ষণে তো ওদের চলে আসার কথা। সুনীতির ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। সুনীতি একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই সে দেখতে পায় অভিক ও আনিসা একসাথে দাঁড়িয়ে। সুনীতি ভালো করে খেয়াল করে দেখে আনিসার সাথে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। সাথে খাবারের প্যাকেটও আছে। অভিক সুনীতিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিক বিরক্তির সুরে বলে,”এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমাদের ভেতরে তো প্রবেশ করতে দাও।”
সুনীতি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। আনিসা সবগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। অতঃপর কয়েকটা ব্যাগ সুনীতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এগুলো নাও নীতি।”
“কি আছে এখানে?”
“আমি তোমার জন্য কিছু সালোয়ার কামিজ আর শাড়ি পছন্দ করে এনেছি।”
“আপনারা কি শপিং মলে গেছিলেন?”
“হ্যাঁ, শুধু শপিং মল না সেখান থেকে একটা রেস্টুরেন্টেও গিয়েছিলাম। ইশ,সেই কলেজ লাইফের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেল। জানো তো নীতি, কলেজ লাইফেও আমরা এভাবে একসাথে শপিং করতাম,রেস্টুরেন্টে খেতাম আরো কত কি করতাম। অনেকবার তো এমন হয়েছে ক্লাস বাম্প করে সিনেমাও দেখতে যেতাম।”
কথাগুলো শুনে সুনীতির একদম ভালো লাগে না। তবুও সে মেকি হেসে বলে,”আপনারা তো বাইরে থেকে এলেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
বলেই সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। অভিকও যায় তার পেছন পেছন। আনিসা নিজের জন্য শপিং করে আনা জিনিসপত্র গুলো দেখতে থাকে।
সুনীতি ঘরে এসে মন খারাপ করে বিছানায় বসে পড়ে। অভিক এসে তার পাশে বসে। সুনীতির হাত শক্ত করে ধরে হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে বলে,”রাগ করেছ নীতি?”
সুনীতির রাগটা আজ একটু বেশিই। তাই সে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলে,”আমি কেন রাগ করব? আমি কি রাগ করতে পারি? রাগ করা তো আমার জন্য নাজায়েজ!”
“ম্যাডাম আজ একটু বেশিই রেগে গেছে মনে হচ্ছে!”
সুনীতি বলে,”তুমি জানেন, তোমরা গেছ থেকে আমি কত দুশ্চিন্তায় ছিলাম জানো?”
“ভুল হয়ে গেছে নীতি। এমন ভুল আর হবে না।”
এবার সুনীতি একটু গলে গিয়ে বলে,”আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। তা ডাক্তার কি বলল?”
“ডাক্তার বলল যে, আনিসা কিছুটা মানসিক ট্রমায় আছে। আমার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলোর জন্য নাকি ও আনন্দ পায়। এজন্য আমাকে বলল, ওর সাথে বেশি বেশি করে সময় কাটানোর জন্য।”
সুনীতি এটা একদম ভালো লাগল না। তবে সে নিজের খারাপ লাগা প্রকাশ না করে বলল,”এটা আবার কেমন সমাধান?”
“কি জানি! ডাক্তারই বললো, ওর সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে। যাতে ও ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসে। এজন্যই তো ওকে নিয়ে শপিং মলে ঘুরতে গেলাম।”
“ও..”
অভিক এবার সুনীতিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,”তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো। আনিসাকে আমি শুধু বন্ধু ভেবে ওকে সাহায্য করছি এর থেকে বেশি কিছু নয়।”
“আমি তো নিজের থেকেও তোমাকে বেশি বিশ্বাস করি। শুধু একটাই অনুরোধ, এই বিশ্বাসের অমর্যাদা করো না। নাহলে বিশ্বাস শব্দটার উপর থেকেই আমার বিশ্বাস উঠে যাবে।”
To be continue…….
#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_24
#ইয়াসমিন_খন্দকার
অভিক সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট নিয়ে আনিসার রুমে চলে আসে। কিন্তু আনিসার রুমে প্রবেশ করতেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কারণ পুরো রুমের অবস্থা বিধ্বস্ত এবং রুমের কোথাও আনিসা নেই। অভিক হঠাৎ করেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। আনিসার নাম ধরে ডাকতে লাগল। কিন্তু কোন সাড়া আসল না। অভিক এবার হন্তদন্ত হয়ে পুরো বাড়িতে আনিসাকে খুঁজল। কিন্তু কোথাও তার কোন খোঁজ পেল না। ততক্ষণে সুনীতিও এই ব্যাপারে জেনে যায়। সুনীতি এসে অভিককে বলে,”চলো তো, আমরা আনিসা আপুর রুমটা আরেকবার ভালো করে খুঁজে দেখি। এমনো তো হতে পারে ওখান থেকে ওনাকে খোঁজার কোন ক্লু পেয়ে গেলাম।”
“হ্যাঁ, চলো।”
দুজনেই আনিসার রুমে গিয়ে খুঁজতে থাকে। সুনীতির হঠাৎ কি মনে হলো সে আনিসার খাটের নিচে তাকালো। সাথে সাথেই চেচিয়ে উঠে বলল,”আনিসা আপুউউউ!”
সুনীতির চিৎকারে অভিক ছুটে এসে দেখল আনিসা খাটের নিচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সে দ্রুত আনিসাকে খাটের নিচ থেকে উদ্ধার করে বিছানায় শুইয়ে দিল। অতঃপর তার মুখে পানির ছিটা দিল। কিছু সময়ের মধ্যেই আনিসা জ্ঞান ফিরে পেল। অভিককে নিজের সামনে দেখেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সুনীতি এ দৃশ্য দেখে কষ্ট পেল খানিক৷ অভিক আনিসাকে জিজ্ঞেস করল,”তুই ঠিক আছিস তো?”
“আমি একদম ঠিক নেই অভি। আমার অতীত যে আমাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছে না। একজন ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে, একজন ভুল মানুষকে ভালোবেসে আমার পুরো জীবনটা একদম নষ্ট হয়ে গেল।”
অভিক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তোর অতীতের ঘটনা কি এখন আমার সাথে শেয়ার করতে পারবি?”
“হ্যাঁ, পারব।”
” শুরু কর।”
আনিসা গভীর শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,”তখন ছিল আমাদের ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম। আমাদের বাড়ির গলির বাইরে তুই আমায় পৌঁছে দিয়ে চলে যেতি৷ আর গলির ভেতরে প্রতিদিন ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত শিহাব। সে ছিল একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স থার্ড ইয়ারের পদার্থবিদ্যার স্টুডেন্ট ছিল। প্রথম প্রথম আমি তাকে পাত্তা দেইনি৷ কিন্তু একসময় তার প্রতি আমার মনে অনুভূতি জন্ম নিতে শুরু করে। আর এটাই ছিল আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল।”
বলেই কিছুক্ষণ থামে। অভিক আনিসার কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলে,”তুই বলতে থাক।”
আনিসা আবার বলা শুরু করে,”শিহাবের প্রতি আমার দূর্বলতা ও নিজেও অনুধাবন করতে পেরেছিল। তাই তো একদিন সাহস করে আমার পথ আটকে ধরে আমায় জোরপূর্বক একটি পার্কে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে আমাকে এটা স্বীকার করতে বাধ্য করায় যে আমি ওকে পছন্দ করি। এরপর থেকে আমাদের একত্রে সময় কাটানো শুরু হয়। এজন্য আমি তোকে আর আরাফাতকে কম সময় দিচ্ছিলাম। শিহাবের সাথে ঘোরাফেরা করতে করতে আমি ওর প্রতি আরো দূর্বল হয়ে পড়ি। ও আমাকে সবসময় আমার পছন্দের গিফট দিত, আমার ভীষণ যত্ন নিত। আমার সামান্য কষ্টও ওকে বিচলিত করে দিত। এসব বিষয় আমাকে ওর প্রেমে গভীরভাবে পড়তে বাধ্য করেছিল আর শিহাব এটা বুঝতে পেরে আমার সুযোগ নেয়।”
“কি করেছিল শিহাব?”
অভিকের প্রশ্নে আনিসা চোখ বন্ধ করে নিয়ে বলে,”একদিন শিহাব আমায় প্রস্তাব দেয়…প্রস্তাব দেয় যেন আমরা রুমডেট করি..”
বলেই হু হু করে কাঁদতে শুরু করে আনিসা। অভিক নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,”এরপর কি হয়েছিল? তুই কি ওর প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলি?”
আনিসা দুপাশে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে,”না..না অভি..আমি একদম ওর প্রস্তাবে রাজি হইনি প্রথমে। বরঞ্চ ওকে তীব্র অপমান করে চলে এসেছিলাম। এরপর কিছুদিন ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখি। যারপর একদিন ও নিজে থেকে আমার সামনে আসে। আমার পায়ে পর্যন্ত পড়ে যাতে আমি সব ভুলে ওকে ক্ষমা করে দেই। আমি শিহাবকে ভালোবাসতাম তাই না করতে পারিনি৷ আবারো আমি আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নেই। কিন্তু ও আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি অভি।”
“কি করেছিল ও?”
“সেদিন ছিল ৩১ ডিসেম্বর, থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষ্যে ও আমায় বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে চায়। তুই তো জানিস, আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিনি আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন,,তাই আমায় যেতে দিতে রাজি হন নি। তখন আমি আমাদের কলেজের কয়েকটা মেয়েকে নিয়ে যাই বাবার কাছে এবং মিথ্যা বলি যে, আমরা মেয়েরা মিলে আমাদেরই এক বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে থার্টি ফাস্ট নাইট সেলিব্রেট করব। এটা শুনে বাবা রাজি হয়ে যায়।”
,,,,,,
অভিকের মনে পড়ে যায় এটাই সেইদিন ছিল যেদিন সে নদীর পারে সুইসাইড করতে গিয়ে শিহাব ও আনিসাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছিল।
“এই মিথ্যাটা বলে আমি শিহাবকে নিয়ে ঘুরতে বের হই। সারাটা সন্ধ্যা, রাত আমরা গোটা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াই। শিহাব আমাকে ওর বাইকে করে বুড়িগঙ্গার তীরে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে আমরা একসাথে ডিনার করি এবং আমরা আবেগের বশে কিছুটা ঘনিষ্ঠ..”
বলতে গিয়ে আনিসার গলা কেপে ওঠে। আনিসা নিজেকে শক্ত করে নিয়ে পুনরায় বলে,”কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না সেদিন রাতে আমার জন্য আরো কত ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করছিল। সেদিন রাতে শিহাব আমার খাবারে নেশাদ্রব্য মিশিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে আমি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। শয়তানটা এটারই সুযোগ নেয়..ওর মনে যে এতটা জঘন্য পরিকল্পনা ছিল আমি বুঝিনি..আমার ঐ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ও আমার সাথে…”
বলতে গিয়ে আনিসা আবারো থেমে যায়। অভিক, সুনীতি দুজনই চোখ বন্ধ করে নেয়।
“কিন্তু ও শুধু একাই এসব করে ক্ষান্ত হয়নি। সেদিন ওর আরো ৪-৫ জন বন্ধু পালাক্রমে আমায়…আই ওয়াজ গ্যাং রেপড..”
এটুকু বলে গলা ছেড়ে দেয় আনিসা। সুনীতি এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। আনিসা আবারো বলা শুরু করে,”ওদের ভয়াবহতা আরো বেশি ছিল। ওরা এরপর আমাকে ঐ অবস্থায় সিলেটে নিয়ে আসে। এখানে নিয়ে এসে টানা এক সপ্তাহ প্রতিদিন পালাক্রমে আমায়…প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত আমার কাছে নরকযন্ত্রণার মতো ছিল৷ ঐসব পশুদের একটুও মায়া হয়নি আমার উপর। আমাকে অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল। সেই সময় আমি প্রতি মুহুর্তে আল্লাহর কাছে নিজের মৃত্যু কামনা করতাম। কিন্তু আমার মৃত্যু মেলেনি। বদলে মিলেছে অসম্মান আর কষ্ট।”
একটু থেমে সে আবারো বলে,
“আমার বাবা কোনক্রমে জেনে গিয়েছিল যে আমি সিলেটে আসি। তাই সেও আমায় খুঁজতে সিলেটে আসে। আমার আপন বলতে আমার বাবাই তো শুধু ছিল, মাকে তো জন্মের পরই হারিয়েছিলাম। বাবা, যেহেতু একজন পুলিশ অফিসার ছিল তাই খুব সহজেই আমার সন্ধান পেয়ে আমি অব্দি পৌঁছে যায়। কিন্তু তার পরিণতি ভালো ছিল না। শিহাব এবং ওর বন্ধুরা আমার চোখের সামনেই আমার বাবাকে নৃশংস ভাবে খুন করে। আমাকে বাঁচাতে এসে আমার বাবাকে মরতে হয়।”
সুনীতি বলে ওঠে,”কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? আপনার বাবা তো একজন পুলিশ অফিসার ছিল। তাকে মারা তো এতটা সহজ ছিল না।”
“আমিও প্রথমে তেমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। শিহাবের বাবা সিলেটের একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। শুধু তাই নয়, তিনি সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। এখানকার স্থানীয় প্রশাসন তার কেনা গোলাম। আমার বাবা এখানকার যেসব পুলিশ অফিসারের উপর ভরসা করে আমায় উদ্ধার করতে এসেছিলেন তাদের কেউই বাবাকে সাহায্য করেনি। বরং বাবার মৃত্যুর পর তারা সবাই পালাক্রমে আমাকে…”
আর বলতে পারে না আনিসা তার গলা শুকিয়ে আসছে।
অভিক আনিসার কাছে এসে তার কাধে হাত রেখে বলে,”তাহলে এতগুলো বছর তুই কোথায় ছিলি?”
“ঐ শিহাব এতগুলো দিন আমাকে বন্দি করে রেখেছিল। ও আমাকে কষ্ট দিয়ে মজা পেত..তাই এতগুলো দিন আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে। আসলে তো ও একটা সাইকো।”
“তাহলে তুই সেদিন ওখানে কিভাবে পৌঁছালি?”
“আমি খবর পেয়েছিলাম সীমান্ত এলাকায় আর্মিদের সাথে শিহাবের লোকদের ঝামেলা হবে। এজন্য আমি ওত পেতে ছিলাম। ওখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাওয়ায় আমাকে যেখানে বন্দি রাখা হয়েছিল সেখানে দায়িত্বরত অনেককেও সীমান্তে পাঠানো হয়। যার ফলে আমার হাতে সুবর্ণ সুযোগ আছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমি ওখান থেকে কয়েকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসি। আর তারপর কি হলো তোরা তো জানিসই।”
To be continue……