মন রাঙানোর পালা পর্ব-৪৬

0
177

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_46
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অভিক ও সুনীতির জীবন এখন তাদের আদরের মেয়ে অভিক্ষাকে ঘিরে ভালোই কাটছে। অভিকাও এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। ওর বয়স এখন ৬ মাস। অল্প অল্প হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে পারে। সুনীতি নিজের মেয়েকে নিয়ে অনেক খুশি থাকলেও অহনার কথা ভেবে তার বুকটা ধক করে ওঠে। অহনা এতগুলো দিন যেন কতটা কষ্টে অতিবাহিত করছে তার খবর সুনীতি জানে। সুনীতির মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয়, যদি সে ক্ষমতা পেত তাহলে অহনার জীবনটা আবার নতুন করে গুছিয়ে দিত। কিন্তু সেটা তো এত সহজে সম্ভব নয়। অহনা তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে সে একাই বাকি জীবনটা নিজের সন্তানকে নিয়ে কাঁটিয়ে দেবে। এসমস্ত কথা ভেবেই সুনীতি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

আজ সে অহনার সাথে দেখা করতে এসেছে। অহনার মামার বাড়িতে গিয়েই সবার প্রথম সে পরিলক্ষিত করে অহনাকে অনেকটা রুগ্ন লাগছে। এখন তার প্রেগ্যান্সির ৯ মাস চলছে, এই অবস্থায় যতটা সবল থাকা উচিৎ ততটা সবল অহনা নয়। সুনীতি অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুই কি নিজের একটুও খেয়াল রাখিস না?”

অহনা সুনীতিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে তার কোলে থাকা অভিক্ষার গালে আদর করে বলে,”আমার অভিক্ষা মামনীটা কেমন আছে? খুব শীঘ্রই তোমার একটা খেলার সাথী আসতে চলেছে দুনিয়ায়।”

ছোট্ট অভিক্ষা না জানি অহনার কথার মানে কি বুঝল। কিন্তু সে খিলখিল করে হাসতে লাগল। যেই হাসি দেখে অহনার নয়ন জুড়িয়ে গেল। সে বলল,”মাশাল্লাহ, কি সুন্দর হাসি। আমার বাচ্চাটাকে কি আমি এতটা সুখী রাখতে পারব?”

অহনার কথার জবাবে সুনীতি বলে,”তুই একটু বেশিই চিন্তা করছিস অহনা। এতটা ভাবারও কিছু হয়নি। দেখবি তোর সন্তান অনেক সুখী হবে। আমরা সবাই আছি তো।”

অহনা একটু ভরসা পায়। কিছু একটা মনে পড়তেই সুনীতিকে বলে,”জানিস, এই কয়েক মাস ধরে আমি লক্ষ্য করছি কেউ যেন গোপনে আমার অনেক খেয়াল রাখছে। প্রতি মাসের শুরুতে আমার জন্য বিভিন্ন ফলমূল ও স্বাস্থ্যকর খাবার পাঠায়,আমার জন্য ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট ঠিক করে দেয়। কিন্তু এসব কে করছে কিছু বুঝতে পারছি না।”

সুনীতি একটা হতাশার শ্বাস ফেলে। সে জানে এসব কে করেছে। তার মনে পড়ে যায় আরাফাতের মৃত্যুর কিছুদিন পরের ঘটনা।

ফ্ল্যাশব্যাক,
সাগর সুনীতির কাছে এসে বসে জানতে চায়,”আপু, অহনার কি খবর? উনি ভালো আছেন তো?”

“ওর কি ভালো থাকার কথা সাগর? তুমি তো সবই জানো। কিভাবে ওর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল।”

“এসব কিছুর জন্য আমিই দায়ী আপু। আমার জন্যই আজ অহনার এই দশা।”

“তুমি শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছ কেন?”

সাগর তখন সুনীতিকে অহনার বিয়ের দিনের সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে সুনীতি হতবাক হয়ে যায়। সাগর বলতে থাকে,”আমার জন্যই সেদিন আবির এমন একটা জঘন্য কাজ করেছিল। যার জন্য অহনাকে সবাই খারাপ ভাবছে। আমিই অপরাধী।”

সুনীতি সাগরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,”তুমি নিজেকে দোষ দিও না৷ এখানে যা কিছু হয়েছে তা নিয়তি ছিল। তুমি তো চাইলে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতে কিন্তু সেটা না করে যা মহানুভবতা দেখিয়েছ সেটাই অনেক। কজন পারে, এভাবে নিজের ভালোবাসা বলিদান দিতে?”

“কিন্তু এসব করে কি লাভ হলো আপু? সেই তো অহনার নামে দূর্নাম বের হলো। আমি চাই, এখন সব সত্যিটা সবাইকে বলে দিতে। তারপর যা হবার হোক।”

সুনীতি কিছুক্ষণ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করে বলে,”এমনটা করতে গেলে হিতে আরো বিপরীত হতে পারে। এখনো কেউ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছে না কিন্তু তুমি যদি এখন সবাইকে সবটা বলো তখন তোমাকে আর অহনাকে নিয়ে একটা নোংরা কাহিনি তৈরি করবে সবাই। তখন সত্যটা কেউ মানতে চাইবে না। এতে অহনার জীবন আরো কঠিন হবে।”

“তাহলে এখন আমি কি করব? অহনার জীবনকে সহজ বানানোর কি কোন উপায় নেই? ওর কষ্ট যে আমি সইতে পারছি না।”

“তুমি যদি অহনাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকো তাহলে তুমি দূরে থেকে ওর খেয়াল রাখো। ওকে একা অনুভব করতে দিও না। এখন ওর মানসিক ও শারীরিক সাপোর্টের প্রয়োজন। তোমাকেই সেটা হয়ে উঠতে হবে। আর আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব, তোমার এই ভালোবাসা যদি পবিত্র হয়, যদি এতে কোন খাদ না থাকে তাহলে যেন তোমার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়!”

অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সুনীতি অহনাকে বলে,”তুই তো পারিস, অতীত নিয়ে পড়ে না থেকে জীবনকে নতুন ভাবে সাজাতে!”

অহনা বলে,”এসব তুই কি বলছিস?”

“এখন তুই গর্ভবতী, তাই এই অবস্থায় কিছু সম্ভব নয়। কিন্তু সন্তান জন্মানোর পর তুই তো নতুন করে..”

“আমি শুধু আরাফাতকেই ভালোবাসি। ও ছাড়া আমার জীবনে আর কারো স্থান নেই।”

“জীবন আবেগ দিয়ে চলে না রে। এমনো তো হতে পারে অন্য কেউ তোকে ভীষণ ভালোবাসবে!”

“আমাকে নাহয় ভালোবাসবে কিন্তু আমার সন্তানকে ভালোবাসবে এবং ভালো রাখবে এমন কাউকে কি আমি পাব?”

“আল্লাহ সহায় হলে, পেয়ে যেতেও পারিস।”

অহনা আর এই বিষয় নিয়ে কথা বাড়ায় না। আর কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলেই তাদের কথা সমাপ্ত হয়।

~~~~~~~~
সেদিন রাতেই হঠাৎ করে অহনার ব্লিডিং শুরু হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে জরুরি ভিত্তিতে সিজার করতে হবে। নাহলে বাচ্চা এবং মা দুজনেরই জীবন সংকট হবে। অহনার মা তো একদম কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সুনীতিও এই খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে ছুটে আসে। অভিক তখন সিলেটে ছিল বিধায় আসতে পারেনি। সৌভাগ্যক্রমে সাগর কিছুদিনের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল। সুনীতি এটা জানত, তাই সে সাগরকে ফোন করে বিষয়টা জানালো। সাগর দ্রুত ছুটে এলো হাসপাতালে। অহনার মামা অসুস্থ থাকায় তিনি হাসপাতালে আসেন নি। অহনার মামাতো ভাইও কিছুটা অজ্ঞ এসব বিষয়ে। সাগর হাসপাতালে এসেই অহনার জন্য রক্তের ব্যবস্থা করল। এছাড়া সার্বক্ষণিক চিকিৎসকদের সাথে কথাবার্তা বলল। অবশেষে অপারেশন সাকসেসফুলি হয়ে গেল। অহনা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো। অহনা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। কিন্তু অহনার বাচ্চাটা প্রি-ম্যাচিউর বেবি হওয়ায় বেশ সমস্যা দেখা দিলো। তাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে রাখা হলো। এরমধ্যে আবার নিউমোনিয়া দেখা দেখায় পরিস্থিতি আরো বাজে হয়ে গেল। অহনা এই সময় প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল৷ তখন সাগর অহনার পাশে ছিল। তাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। প্রতিদিন অহনার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করা লাগত। সাগর সবসময়ই অহনার সাথে যেত। এতে অহনা অসহায় বোধ করত না৷ সাগর যেন অহনার ভরসার স্থল হয়ে উঠছিল। কিছুদিনের মধ্যেই অহনা আর সাগরকে নিয়ে অহনার মামির সন্দেহ হয়৷ তিনি অহনাকে এসব নিয়ে খোটা দিতেই অহনা ভীষণ অপমান বোধ করে এবং সাগরকে ভীষণ বাজেভাবে অপমান করে বলে তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিত। সাগর সেদিন কিছু বলে না। কিন্তু তবুও সে আড়াল থেকে সবসময় অহনার পাশে থেকেছে। যা অহনা বুঝতে পেরেছে।

অহনার মেয়েকে নিয়ে ২ বছর যাবৎ বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করতে হয়েছে নানা সমস্যায় সবসময় সাগর দূর থেকে অহনাকে সাহায্য করেছে। অহনা সাগরের এই খেয়াল রাখার প্রবণতা দেখে আন্দাজ করতে পেরেছে অনেক কিছুই। কিন্তু সমাজের কথা ভেবে পিছিয়ে থেকেছে।

আজ সুদীর্ঘ ২ বছর পর, কি হবে তাদের সম্পর্ক? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তাদের এই সম্পর্কের সমীকরণ? তা জানার অপেক্ষায় আছে সবাই। সাগর এবার একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর কোন লুকোচুরি নয়। সে নিজের পরিবারকে অহনার ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে। এমনিতেই পরিবার থেকে বিয়ের চাপ আসছে। অহনার কথাটা জানানোর পর যা হবার হবে। অহনা যদি তাকে ফিরিয়ে দেয় তো আজীবন একা থাকবে। তবুও সাগর এত সহজে হার মানবে না। এটাই তার পণ।
To be continue…….