মন রাঙানোর পালা পর্ব-৪৮ এবং শেষ পর্ব

0
3

#মন_রাঙানোর_পালা
#Last_Part
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অহনা ও সাগরের বিয়ে উপলক্ষে চারিদিকে চলছে সাজসজ্জা। একটা কমিউনিটি সেন্টারে তাদের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই ভীষণ আনন্দের সহিত আনন্দ উদযাপন করতে ব্যস্ত। অহনা যেন জীবনে নতুন শুরুর আনন্দ পেতে যাচ্ছে। অহনার মাও নিজের মেয়ের জীবনের নতুন প্রারম্ভের সাক্ষী হতে চলেছেন।

তবে সবথেকে বেশি খুশি তো আমাদের সাগর। তার এতদিনের একতরফা ভালোবাসা যা তাকে গুমরে মেরেছে আজ তা সফলতার মুখ দেখবে। এর থেকে বেশি আনন্দের আর কি হতে পারে। আজ সাগরের একটা কথা ভীষণই মনে পড়ছে। মন থেকে চাইলে সব পাওয়া যায়। তাই হয়তো আল্লাহ আজ সাগরের এত বড় ইচ্ছা পূরণ করতে চলেছেন।

সাগর বরবেশে একদম তৈরি হয়ে নিয়েছে। অপেক্ষা তার কনে আসার। সাগরের অপেক্ষা আর সইছে না। এরইমধ্যে সুনীতি অহনাকে ধরে নিয়ে এলো। বধূবেশে অহনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তার পরণে একটি লাল বেনারসি শাড়ি। সাগর মুগ্ধ হয়ে গেল অহনার এই রূপ দেখে। অহনার মা আমায়রাকে কোলে নিয়ে আছেন। আমায়রা এখনো খুব ছোট হওয়ায় বুঝতে পারছে না আজ কি হচ্ছে।

অভীক তার মেয়ে অভীক্ষাকে কোলে নিয়ে একদিকে তাকিয়ে আছে। একটু দূরেই ইভা ও সাজিদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে সারজিস। অভীক্ষা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সারজিসের দিকে। অভীক্ষা নিজের মেয়েকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,”কি দেখছ মামনী?”

বছর তিনেকের অভীক্ষা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,”নীন(নীল) তোখ(চোখ)”

অভিক স্মিত হাসে। অহনাকে সাগরের পাশে বসানো হয়। কাজি বিয়ের কার্যক্রম শুরু করে দেন। একটু পর কাজি কবুল বলতে বললে সাগর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে কবুল বলে দেয়। কিন্তু অহনাকে কবুল বলতে বলায় সে কিছু সময় নেয়। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। একবার নিজের মেয়ে আমায়রার দিকে তাকায়। সে নিজে পরিবারহীন হয়ে যেভাবে বড় হয়েছে নিজের মেয়েকে সেই জীবন দিতে চায়না। অহনা চায়, তার মেয়ে সবার ভালোবাসায় বেড়ে উঠুক। আর এই পরিবার যখন তার মেয়েকে এত সহজে মেনে নিচ্ছে তখন তো তার আর এই নিয়ে কোন চিন্তাই নেই। অহনা সাগরকে যতটুকু বুঝেছে, সে যে আমায়রাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আমায়রাও বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে না। সর্বোপরি অহনা নিজেও একটা সুন্দর জীবন পাবে। এসব কিছু ভেবে অহনা চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির সহিত বলে,”আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”

ব্যস, সবাই আনন্দে হাসি দেয়। সাগরের খুশিও দেখার মতো ছিল। এ যেন অমূল্য কিছু পাওয়ার আনন্দ।

বিয়ের পর আসে বিদায়ের পালা। অহনার মা সাগরের হাত ধরে অনুরোধ করে বলেন,”আমার মেয়েটাকে একটু সুখে রেখো বাবা। ও যে বড্ড সুখের কাঙাল। জন্মের পর থেকে অনেক দুঃখ সয়েছে। এবার যেন ও একটু সুখের দেখা পায়।”

“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি, অহনাকে আমি নিজের জীবন দিয়ে আগলে রাখব। সাথে আমায়রাকেও।”

বলেই সাগর আমায়রাকে নিজের কোলে তুলে নেয়। কোলে নিয়েই আদর করতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে সবারই চোখ জুড়িয়ে যায়। অহনার মায়ের চোখে তো একদম জল চলে আসে।

~~~~~~~~~~~~
বাসর ঘরে আমায়রাকে কোলে নিয়ে বসে আছে অহনা। একটু আগেই ও ঘুমিয়েছে। কিন্তু ওকে কোথায় রাখবে সেটা বুঝতে পারছে না অহনা। এরইমধ্যে সাগর এসে অহনাকে বলে,”তুমি ওকে আমাদের মাঝেই শুইয়ে দাও।”

“কিন্তু আজ তো..”

জড়তার কারণে থেমে যায় অহনা। সাগর মুচকি হেসে বলে,”আমার কোন সমস্যা নেই। ও তো আমাদেরই মেয়ে। তাই আমাদের মাঝে থাকতেই পারে।”

সাগরের মুখ থেকে “আমাদের মেয়ে” কথাটি শুনে থমকে যায় অহনা। সাগর অহনার পাশে বসে বলে,”আজ তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই, যা না বললে হয়তো আমি শান্তি পাবো না। এই অপরাধবোধ যে আমায় সবসময় জ্বালিয়ে মারে।”

“আমি জানি, তুমি কি বলতে চাও।”

“জানো?”

“সুনীতি আমায় সব বলেছে। যে আমার আর আরাফাতের বিয়ের দিন আসল ঘটনা কি ঘটেছিল!”

সাগর দুচোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”আমি সবকিছুর জন্য ভীষণ লজ্জিত। আমার জন্য তোমাকে কতই না,,”

“তোমার ক্ষমা চাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি কেন ক্ষমা চাইছ? এখানে তো তোমার কোন দোষ ছিল না। বরং তুমি সেদিন আমায় ফিরিয়ে দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলে। হ্যাঁ, তুমি এতদিন কথাটা গোপন রাখার জন্য আমার খারাল লেগেছিল কিন্তু সুনীতি আমায় সবটা বুঝিয়ে বলায় আমি বুঝতে পারি।”

সাগর স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে অহনার হাতটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার হাতে চুমু খেয়ে বলে,”ব্যস, আমার জন্য এটাই যথেষ্ট। এখন শুধু আমি বাকিটা জীবন তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমার মন রাঙিয়ে দিতে চাই। সবাই জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ পায় না, আমি পেয়েছি। এটা হারাতে চাইনা।”

‘আমিও।’

বলেই দুজনে একসাথে হেসে উঠে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~
অভিক অভীক্ষাকে ঘুম পাড়ানোর অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু অভীক্ষা কিছুতেই ঘুমাচ্ছে না। একদম অভিকের গলায় লেপ্টে আছে। অভিক নিজের মেয়ের এহেন কাণ্ড সুনীতিকে দেখিয়ে বলে,”দেখেছ, মেয়েটা কতটা জেদি হয়েছে! আমাকে ছাড়তেই চাইছে না!”

সুনীতি হালকা হেসে বলে,”ও বোধহয় বুঝতে পেরে গেছে যে কাল তুমি আবার আমাদের ছেড়ে ক্যাম্পে চলে যাচ্ছ। তাই ছাড়তে চাইছে না। তুমি একটা কাজ করো তোমার মেয়েকে তোমার সাথে নিয়ে যাও।”

“শুধু মেয়েকে কেন? মেয়ের মাকেও নিয়ে যাব ভাবছি। যাবে কাল আমার সাথে?”

সুনীতি বলে,”যেতে তো আমিও চাই। কিন্তু বাড়ির এদিকে সব তো সামলাতে হবে। বাবার শরীর বেশি ভালো মা, মা একা সবকিছু সামলাতে পারেন না। তাই আমাকে এখানেই থাকতে হবে।”

অভিক সুনীতিকে বলে,”তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব নীতি। তুমি যেভাবে আমার পরিবারকে সামলাচ্ছ তা ভোলার মতো নয়!”

সুনীতি হালকা হেসে বলে,”এটা তো আমারও পরিবার। আমি সামলাব না তো কে সামলাবে?”

সুনীতির কথায় অভিকের মন জুড়িয়ে যায়। সে আচমকা সুনীতিকে নিজের কাছে টেনে নেয়। অভীক্ষা তখনো ঘুমায় নি। তাই সুনীতি চোখ দিয়ে ইশারা করে। অভীক্ষা অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল এই সুযোগে অভিক সুনীতির কপালে চুমু খেয়ে বলে,”ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্যে। আমার জীবনটা এতটা সুন্দর করে তোলার জন্যে। আমাকে আমার রাজকন্যা উপহার দেয়ার জন্য।”

সুনীতিও বলে,”তোমাকেও ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য। বিপদে-আপদে আমার ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর জন্য, সর্বোপরি আমার মন রাঙিয়ে দেয়ার জন্য।”

সুনীতি, অভিক, অভীক্ষা তিনজনে একসাথে দাঁড়িয়ে। কি সুন্দর একটা সুখী পরিবার। আজ যেন তাদের কাহিনি পরিপূর্ণ! অভিক নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি চাই, আমার জীবনে জীবনে সর্বোচ্চ সুখী হোক। কোন দুঃখ যেন ওকে স্পর্শ না করে। এজন্য আমাকে যা করতে হয় আমি করব।”

সুনীতি বলে,”তুমি চিন্তা করো না, আমি আমরা দুজনে মিলে আমাদের মেয়েকে সেরাটা দিয়ে বড় করে তুলব।”

বলেই তারা দুজনে অভীক্ষার গালে চুমু খায়৷ ছোট্ট অভীক্ষা বাবা-মায়ের আদর পেয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। আর সেই হাসি দেখে জুড়িয়ে যায় তার মা-বাবার দুচোখ। হয়তো একদিন এই হাসি অন্য কারো চোখও জুড়িয়ে দেবে!

~~~~~~~~The End