মন রাঙানোর পালা ২ পর্ব-২৮+২৯

0
48

#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_28
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অভীক্ষা তার মা সুনীতিকে নিয়ে চলে এসেছে আসাম রাজ্যে। চা-বাগানে আবৃত আসাম রাজ্য শুধু চা-বাগান নয়, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা সহ অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রকৃতি যেন ঢেলে সাজিয়েছে এই রাজ্যকে। অভীক্ষা ও সুনীতি চোখ ভড়ে দেখছে এই সৌন্দর্য। এর মাঝেই সুনীতি বলে উঠল,”জানো অভীক্ষা, আমার মনে হচ্ছে আজ এখানে এসে আমি খুব উত্তেজনা অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, মূল্যবান কিছু ফেরত পেতে চলেছি। হাওয়া বদল করতে এসে যেন আমার জীবন বদলে যেতে চলেছে।”

অভীক্ষা হালকা হেসে বলে,”এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করো মা। এটা তোমার শরীরের জন্য ভালো হবে।”

সুনীতি মাথা নাড়িয়ে সহমত জানায়। এরইমধ্যে হঠাৎ করে সুনীতি বলে ওঠে,
“আচ্ছা, মা। চলো কাল আমরা কাল করিমগঞ্জের কয়েকটা চা-বাগানে ঘুরতে যাই। যদিও এখানকার চা-বাগান গুলো আসামের অন্যান্য জেলার মতো সুবিশাল নয় তবে আমি শুনেছি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রূপনগর নামক একটা গ্রামে উন্নত জাতের কিছু চা-বাগান গড়ে উঠেছে যা যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন। আবার কাল নাকি ওখানে চা উৎসবও পালিত হবে। দেশ বিদেশের হাজার হাজার দর্শনার্থী ভীড় করবে কাল ওখানে। তো আমি ভাবছি, কাল আমরাও সেখানে ঘুরতে যাব। তুমি কি বলো?”

“বেশ, তাহলে তো যাওয়াই যায়। আমারও ব্যাপারটা ভালোই লাগছে শুনতে। বিশেষ করে এমন প্রত্যন্ত একটা গ্রামে যখন এত বড় উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে তখন আশা করছি এটা ভালো কিছুই হবে।”

সুনীতিকে কেন জানি অনেকটা অন্যমনস্ক লাগছিল। আসামে পা রেখেছে থেকে তার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। হৃদস্পন্দনের গতি বেড়েছে খানিক। মনও এখন খানিকটা চঞ্চল। কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে তার এই মানসিক অবস্থা? তাহলে কি এই আসাম সত্যিই কোন বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে?!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আসামের করিমগঞ্জ জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম রূপনগর। এই গ্রামটা বাংলাদেশ সীমান্তের বেশ কাছেই। নিতান্তই অপরিচিত এই স্থানটি ইদানীং শিরোনামে উঠে এসেছে এর চা-বাগানের জন্য। যদিও কিছু বছর আগেও এই গ্রামের বিস্তীর্ণ ভূমি পড়েছিল চাষ অনুপোযোগী, পরিত্যাক্ত স্থান হিসেবে৷ তবে একজন মানুষের প্রচেষ্টায় এই গ্রামের পুরো মানচিত্রই যেন বদলে যায়। তিনি এই গ্রামের বেকার ও কর্মক্ষম যুবকদের সম্পূর্ণ নিজ উদ্যেগে কাজে লাগিয়ে বিস্তীর্ণ আগাছাপূর্ণ জমি ছাপ করিয়েছেন। অতঃপর সেই জমির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সার ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে চাষ উপযোগী করে গড়ে তুলেছেন। এরপরই সেই জমিতেই গড়ে তুলেছেন চা-বাগান। তারই উদ্দ্যেগে গোটা গ্রামের মানুষ আজ দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। হয়েছে আজ সাবলম্বীও।

নিজের ব্যাপারে এত সুনাম অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দেন গ্রামের সবার কাছে ওস্তাদজি নামে পরিচিত সেই ব্যক্তিটি। তবে তার অবদান যে এই গ্রামের জন্য অনস্বীকার্য তা এই গ্রামের বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিতে কার্পণ্য করবে না।

সেই ওস্তাদজির মনও আজ ভালো নেই। সকাল থেকে সরাইখানাতে বসে কিসব যেন ভেবে চলেছেন তিনি। ওস্তাদজির একনিষ্ঠ ভক্ত কালিয়া নিজের ওস্তাদকে এমন নির্জীব দেখে তাই তো আর চুপ থাকতে পারে না। ওস্তাদজির কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে ওস্তাদজি আপনার? সকাল থেকে আপনাকে এমন অন্যমনস্ক লাগছে কেন? আপনার কি শরীর খারাপ করছে? ডাক্তার ডাকব কি?”

ওস্তাদজি বলেন,”আমাকে নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ো না, কালিয়া। আমি একদম ঠিক আছি অন্তত শারীরিক দিক থেকে। কিন্তু মানসিক দিক থেকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করছি। জানি না, এর কারণ কি। তবে কোন না কোন কারণ তো রয়েছেই।”

“আপনার মন খুশি করার জন্য আমায় কি করতে হবে ওস্তাদ জি? আপনি যদি বলেন, আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও আপনাকে খুশি করব।”

ওস্তাদজী হালকা হেসে বলেন,”পাগল ছেলে! তোকে কিছু করতে হবে না। যা গিয়ে বিশ্রাম নে। কাল গ্রামে চা উৎসব সেটা মনে আছে? দেশ-বিদেশের কত অতিথি আসবে। তাদের সামনে আমাদের রূপনগরকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে হবে তো নাকি? এই উছিলায় যদি এখানে পর্যটন শিল্প বিকাশ লাভ করে তাহলে তো আমাদেরই লাভ। গ্রামের আরো কত অসহায় মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে!”

“ঠিক আছে, ওস্তাদজী। আমি দেখছি ওদিকটা। আপনি কিছুটা বিশ্রাম নিন।”

বলেই কালিয়া বেরিয়ে যায়। ওস্তাদজী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,”ইয়া রব! তুমি কি লিখে রেখেছ আমার ভাগ্যে? কেন এমন উৎকন্ঠা বোধ হচ্ছে? নিজের ২০ বছরের স্মৃতিতে তো কখনো এমন উৎকণ্ঠা বোধ হয়নি। তাহলে এই উৎকণ্ঠা কিসের ইঙ্গিত?”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নতুন দিন, পৃথিবীর বুকে এক নতুন সূর্যের আগমন। সুনীতি ও অভীক্ষা আজ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে রূপনগরের উদ্দ্যেশ্যে। তাদের মূল উদ্দ্যেশ্য, রূপনগরের বিখ্যাত চা-উৎসবের সাক্ষী হওয়া।

এদিকে রূপনগরের মানুষের জীবন কাটছে নানান ব্যস্ততায়। তাদের যেন আজ দম নেওয়ারও ফুরসত নেই। সকাল থেকেই সবাই কোমড় বেঁধে নেমে পড়েছে চা উৎসবের শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতিতে। তাদের মূল উদ্দ্যেশ্য পর্যটকদের দৃষ্টি আকরাম করা। তাই তো আজ চা-বাগান গুলো সেজে উঠেছে নতুন উদ্যমে। অনেকে বিভিন্ন ধরনের চায়ের স্টলও বসিয়েছে। এছাড়া গ্রামের স্থানীয় কিছু নারী-পুরুষ প্রস্তুতি নিচ্ছে এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সামনে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী নাচ “ঝুম নৃত্য” উপস্থাপন করার জন্য। এছাড়া রূপনগরের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার যেমন, ভেড়ার বিরিয়ানী, ভেড়ার সব্জি-রুটি এবং ভেড়ার রোস্টও তৈরি করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। অতএব, সবাই ভীষণ ভাবে প্রস্তুত এই চা উৎসবকে একটি সুন্দর মোড় দিতে।

গ্রামের সাধারণ মানুষ যখন উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত তখন অন্যদিকে, সুনীতি গ্রামে প্রবেশ করেই থমকে গেল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। অভীক্ষা নিজের মায়ের অস্থিরতা খেয়াল করে বলল,”কি হয়েছে মা? তোমাকে এমন লাগছে কেন? সবকিছু ঠিক আছে তো?”

সুনীতি হালকা হেসে বলে,”হুম, আমি ঠিক আছি।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে একদম ঠিক ছিল না। আকাশে মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। রূপনগর গ্রামে যেদিকেই চোখ যায় শুধু মনোরম সৌন্দর্যমন্ডিত চা-বাগান। যেই চা-বাগান বদলে দিয়েছে এই পুরো গ্রামের কয়েকশো মানুষের ভাগ্য। রূপনগরের প্রবেশের পথেই দাঁড়িয়ে ছিল কালিয়া সহ এই গ্রামের আরো কিছু যুবক। ঘুরতে আসা সকল পর্যটককেই তারা ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে এবং সাথে করে বিনামূল্যে পান করাচ্ছে এই গ্রামের বিখ্যাত চা।

সুনীতি সেই চা খেয়ে যেন অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করে। যেন চেনা এক স্বাদ খুঁজে পায় এই চায়ের মাঝে ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠে,”কে বানিয়েছে এই চা?”

কালিয়া হেসে বলে,”এই চা তো আমার ওস্তাদজী বানিয়েছে। কেন ভালো হয়নি খেতে?”

সুনীতির অস্থিরতা বাড়ে। সে বলে,”কোথায় আপনার ওস্তাদজী? তার সাথে কি দেখা করা যাবে?”

কালিয়া সহ আরো কিছু ছেলে যারা ছিল তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। অভীক্ষা সুনীতির এহেন ব্যবহার দেখে বলে,”কিছু কি হয়েছে মা? তুমি এমন করছ কেন?”

কালিয়া আন্তরিক হেসে বলে,”আপনারা আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ঝুমুর নৃত্য আর বিভিন্ন খাবার উপভোগ করুন। ওস্তাদজী আজ এই অনুষ্ঠানে নিজের বক্তব্য এবং সংগীত পেশ করবেন। চাইলে তখন তার সাথে দেখা করতে পারেন।”

সুনীতির ব্যাকুলতা বাড়ে। সে বলে,”তার আগে কি দেখা করার কোন সুযোগ নেই?”

“দুঃখিত, ম্যাডাম। কিন্তু আমরা অপারগ।”

অভীক্ষা বুঝতে পারে না তার মা কেন এমন একজন আগন্তুকের সাথে দেখা করার জন্য এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে। তবে ব্যাপারটা তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। কারণ আশেপাশের সবাই কেমন ভাবে যেন তাকাচ্ছে তাদের দিকে। এজন্য অভীক্ষা বলে,”মা, তুমি চলো আমার সাথে ভেতরে। সঠিক সময় হলে ঠিকই ওনার সাথে দেখা হবে।”

নিজের মেয়ের কথাতেও যেন আশ্বস্ত হতে পারে না সুনীতি। যেন ভাগ্য আজ এক খেলা খেলতে প্রস্তুত! যেই খেলা বদলে দেবে অনেকের জীবনের গতিপথ।

To be continue……

#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_29
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি অস্থির হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের পানে। তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ দ্রুত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই রূপনগর গ্রামের মানুষেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী ঝুম নৃত্য এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শন করতে শুরু করে দিয়েছে। যা দেখে সবাই আজ ভীষণ খুশি। বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকরা চারপাশের পরিবেশ দেখে দারুণ ভাবে মুগ্ধ। অভীক্ষাও সব অনুষ্ঠান দেখছে মনযোগ দিয়ে। কিন্তু সুনীতির তো এসব অনুষ্ঠানে কোন মনই নেই। সে তো আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই সময়ের জন্য যখন এই গ্রামের সেই তথাকথিত ওস্তাদ জি স্টেজে উঠে সবার সামনে গান পরিবেশন করবে। তাকে দেখার জন্যই ছটফট করছে সুনীতির অবুঝ মন। সুনীতি আনমনেই বলে ওঠে,”আমার কেন মনে হচ্ছে..এতদিন পর আবারো নিজের হারানো মানুষটাকে ফিরে পেতে পারি? এটা কি আদৌতেও সম্ভব? নাকি সবটাই আমার মনের ভুল। তা আর মাত্র কিছুক্ষণ পরই জানা যাবে।”

এদিকে অভীক্ষা সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”মা, তোমাকে কিন্তু আমি অনেকক্ষণ থেকে খেয়াল করছি। কেন তোমার অস্থিরতা কোন মূল্যেই কমছে না? এর পেছনের কারণ কি?”

সুনীতি নিশ্চিত না হয়ে অভীক্ষাকে কোন কিছু জানাতে চাইছে না। তাই সে বলে,”সময় হলে ঠিকই তুমি সবটা বুঝত পারবে মামনী। আপাতত শুধু এটা জেনে রাখ যে, আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পরিবর্তন আসতে পারে আজ। আমি যা সন্দেহ করছি তা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের জীবনটা এরপর আবারো আগের মতোই অনেক সুন্দর হবে। ”

অভীক্ষা সুনীতির মুখে এহেন কথা শুনে কিছু বুঝতে পারে না। সে নিজের মতো অনুষ্ঠানে মনযোগ দেয়। এরইমধ্যে তার হঠাৎ তেষ্টা পাওয়ায় সে সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”মা, আমি একটু পানি খেয়ে আসছি। তুমি এখানেই থেকো, কেমন?”

“আচ্ছা, তুমি গিয়ে পানি খেয়ে আসো। আমি এখানেই আছি।”

অভীক্ষা পানি খাওয়ার জন্য একটু দূরে আসে। কিন্তু সবাই অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত থাকায় কোথাও পানির সন্ধান পাচ্ছিল না সে। তাই মূল অনুষ্ঠান থেকে একটু দূরে এসে পানির খোঁজ করতে থাকে। হঠাৎ করে একটি কলপাড় দেখে তার মনে আশা জেগে ওঠে। সে দ্রুত তার কাছে গিয়ে কল থেকে পানি খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আফসোস, কল থেকে পানি বেরই হয়না। অভীক্ষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”আমার ভাগ্যে বোধহয় আর পানি খাওয়া নেই।”

বলেই সে ফিরে আসতে নেবে এমন সময় পেছন থেকে এক গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনতে পায়,”তুমি কি পানি খেতে চাও?”

কন্ঠস্বরটা শুনেই পিছন ফিরে তাকায় অভীক্ষা। দেখতে পায় এক মধ্যবয়সী পুরুষকে যে স্মিত হেসে তার পানেই চেয়ে আছে৷ অভীক্ষা তার পানে তাকিয়ে বলে,”জ্বি, কিন্তু কলে তো পানিই নেই।”

বৃদ্ধ এবার খানিকটা এগিয়ে আসায় তার মুখটা খানিক স্পষ্ট হয় অভীক্ষার কাছে। অভীক্ষার কাছে এই লোকটার চেহারা অনেকটা চেনা চেনা মনে হয়। যেন কোন এক চেনা মানুষের চেহারার মিল খুঁজে পায় এই চেহারায়। কিন্তু সঠিক ভাবে কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু অবাক স্বরে বলে,”আপনার সাথে আমার খুব চেনা একজনের চেহারার ভীষণ মিল পাচ্ছি মনে হচ্ছে?”

মধ্যবয়সী লোকটা স্মিত হাসি বজায় রেখে বলে,”কার?”

“সেটা জানিনা, কিন্তু পাচ্ছি।”

লোকটা এবার কিছুটা দূর থেকে একটা পিড়ি নিয়ে এসে অভীক্ষার সামনে রেখে অভীক্ষার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমি একটু এখানে বসো, মেয়ে। আমি কোন ব্যবস্থা করছি।”

বলেই তিনি ধুপধাপ পা ফেলে একটা সরাইখানার ভেতরে যান। কিছু সময় পর সেখান থেকে এক গ্লাস সরবত ও কিছু মিষ্টান্ন নিয়ে বের হয়ে বলেন,”এর থেকে বেশি কিছুর ব্যবস্থা করতে পারলাম না। ”

অভীক্ষা বলে উঠল,”আমার তো শুধু এক গ্লাস পানিরই প্রয়োজন ছিল। তবুও যে আপনি আমার জন্য এতটা ব্যবস্থা করেছেন এটাতেই আমি আপ্লুত। সত্যি, এই গ্রামে এসে এখানকার মানুষদের চমৎকার ব্যবহার ও আতিথেয়তা আমায় মুগ্ধ করেছে। এই অভিজ্ঞতা আমি কখনো ভুলব না। যেন মনে হচ্ছে এখানে সবাই আমার কতই না আপন!”

মধ্যবয়সী লোকটা এবার হঠাৎ করে বলে ওঠেন,”জানো মেয়ে,তোমাকে দেখেও কেন জানি আমার মনে হচ্ছে খুব আপন কেউ..জানিনা এটা কেন হচ্ছে..বা তুমি এই বিষয়টাকে কিভাবে নেবে। এই যেমন দেখো..চিনি না জানিনা তোমাকে কিরকম “তুমি” করে বলছি। এই তুমি ডাকটা কতই না আপন! আমার মন থেকে কেন জানি তুমি ডাকটাই আসছে। তুমি কিছু মনে করো না।”

অভীক্ষা বলে ওঠে,”আরে না না..আমি তো আপনার মেয়েরই বয়সী। আপনি আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন। জানেন, আমি জীবনে কখনো বাবার সান্নিধ্য লাভ করিনি। অনেক ছোটবেলায় আমি নিজের বাবাকে হারিয়েছি। বাবার ভালোবাসা কেমন হয়, সেটা খুব কমই উপলব্ধি করেছি৷ তবে এই যে, আপনি আমাকে এত যত্ন করে এসব খাবার এনে দিলেন আমার কাছে মনে হলো, আজ যদি আমার বাবা থাকতেন তিনিও এইভাবে আমার খেয়াল রাখতেন!”

লোকটি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন,”বাবা!”

এরপর কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে পিনপতন নীরবতা বজায় থাকল। অভীক্ষা খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”আপনার সাথে পরিচিত হয়ে অনেক ভালো লাগল। ভালো থাকবেন।”

বলেই সে চলে আসে। মধ্যবয়সী লোকটা তার যাওয়ার পানেই তাকিয়ে থাকে।

~~~~~~~~~~~~~~
এদিকে অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ পর্যায়ে কালিয়া মঞ্চে উঠে বলল,”তো আমাদের রূপনগরের এই বিশেষ চা উৎসব প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। আমাদের পক্ষ থেকে আজকের সর্বশেষ পেশকাশ হবে, সেই মানুষটার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া, যার জন্য আমাদের রূপনগর আজ এতটা সুন্দর হয়ে উঠেছে। আজ আমরা যে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি তার পেছনে যার অবদান সবথেকে বেশি তার সাথে এবার পরিচয় হবার পালা। তিনি হলেন আমাদের সকলের প্রিয় ওস্তাদজী। তো চলুন, এবার তার সাথে পরিচয় হয়ে নেয়া যাক। যেই মানুষটা আজ থেকে ২০ বছর আগে আমাদের গ্রামে ঠিক যেন স্বর্গদূত হয়ে এসেছিলেন। অতঃপর বদলে দিয়েছেন আমাদের পুরো গ্রামের মানচিত্র। তো আমি আর বেশি কথা না বলি, আমাদের ওস্তাদজী এবার তার খুব পছন্দের একটা গান পরিবেশন করার মাধ্যমে নিজেই আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে নেবেন।”

সুনীতির অস্থিরতা বেড়ে যায়। সে আকুল দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে চেয়ে ছিল। এরইমধ্যে মঞ্চে ওঠেন এক মধ্যবয়সী পুরুষ। যার গায়ে বাউলের সাজ, মুখে বড় বড় সাদা দাঁড়ি। তিনি মঞ্চে উঠেই গাইতে শুরু করলেন,
❝চাতক প্রায় অহর্নিশি…
চেয়ে আছি কালো শশী..
চাতক প্রায় অহর্নিশি…
চেয়ে আছি কালো শশী..
আমি হব বলে চরণ-দাসী,….
হব বলে চরণ-দাসী,….
ও তা হয় না কপাল-গুণে…
ও তা হয় না কপাল-গুণে.
আমার মনের মানুষের সনে..
আমার মনের মানুষের সনে…
মিলন হবে কত দিনে…
মিলন হবে কত দিনে….
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে..❞

ধীরে ধীরে বহুল কাঙ্খিত সেই চেহারাটা স্পষ্ট হতে থাকে সুনীতির সামনে। গলার স্বরটা শুনেই তো চিনে ফেলেছে নিজের একান্ত আপন মানুষটাকে। এখন যতোই দাঁড়ি গজাক বা চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ুক কিছুটা তবুও সুনীতির চিনতে অসুবিধা হয়না যে রূপনগরের ওস্তাদজীই তার অভিক। সুনীতি যেন কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলে। দুঃখ-সুখের অনুভূতি একত্রে ঘিরে ফেলেছে তাকে। কিছু মুহুর্ত পূর্বে চোখ থেকে ঝড়ে পড়া এক ফোঁটা অশ্রুও যেন দুঃখ-সুখের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। সুনীতি চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে চিৎকার বলে উঠল,”অভিক…”

বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না দ্রুতবেগে স্টেজে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো অভিককে। সবাই হতবিহ্বল হয়ে দেখল এই দৃশ্য। অভীক্ষার চোখেও হতবিহলতা। এদিকে হঠাৎ করেই প্রকৃতি অস্থির হয়ে উঠল। দ্রুত বেগে বাতাস বইতে রইল। প্রকৃতিও যেন আজ পুর্নমিলনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
To be continue…….