#মম_হৃদয়_বিহারিণী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
১১.
চন্দ্রালোকিত রাত,নদীর শান্ত জল আর তারকাখচিত আকাশ নিস্তব্ধতার মাঝে অপ্রকাশিত প্রেমের গুঞ্জনের সাক্ষী রইল।দুটি হৃদয়ে প্রস্ফুটিত প্রনয়ের অঘোষিত বার্তা বয়ে নিয়ে গেল মৃদু বাতাস।
আমি ধ্রুবর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অন্যপাশে তাকালাম।ওনার দৃষ্টি বর্শার ন্যায় তীব্র আঘাত হানছে বক্ষদেশে।অদৃশ্য সেই প্রহার! চুলগুলো একপাশে এনে নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসলাম আমি।ধ্রুব ধীরে ধীরে বৈটা বইছেন।আমি ওনার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।একটু আগে ওনার কথাগুলো শুনে মন যেমন আপ্লুত হয়েছে তেমনি লজ্জারা এসে ভর করেছে চোখের পাতায়।হঠাৎ ধ্রুবর স্বর শুনতেই আমি একটু চোখ তুলে তাকালাম,
“গান জানো,নির্বানী?”
আমি দুপাশে মাথা নাড়লাম।যদিও একটু আধটু গুনগুনিয়ে গাই তবে সেটা লোকের সামনে বলার অযোগ্য।ধ্রুব এবার বললেন,
“গান শিখো তো।”
আমি কিছু না বলে চুপচাপ রইলাম।উনি মনোযোগ দিয়ে নৌকা চালাচ্ছেন।বোঝাই যাচ্ছে একাজে বেশ পটু।আমি মাঝে মাঝে ওনার উপর আশ্চর্য হই।এমন কিছু কাজ করেন উনি যে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই।
আমি হঠাৎ নদীর জল হাতের তালুতে নিয়ে মুখে নিক্ষেপ করলাম।শীতল জল স্পর্শ করলো আমার মুখশ্রী।ধ্রুব বোধহয় শব্দ শুনে আমার পানে তাকালেন।
নদীর জল থেকে পা তুলে মুখ আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে ওনার দিকে তাকালাম।বৈঠা চালানো বাদ দিয়ে উনি তাকিয়ে আছেন।হঠাৎ নৌকা ঘুরানো শুরু করলেন উনি।রাত গভীর থেকে গভীর হতে শুরু করেছে।বাড়ছে নিস্তব্ধতা।মাঝে মাঝে ঝিঝি পোকাদের কর্কশ চিৎকার কর্ণগোচর হচ্ছে।সেই হাতে ফুরিয়ে আসছে হারিকেনের আলো।দ্রুত বাড়ি ফেরা আবশ্যক।
নদীর পাড়ে নৌকা থামিয়ে আমাকে নামতে ইশারা করলেন উনি।আমি দুরুদুরু বুকে নদীর চরে পা রাখলাম।নৌকা বেঁধে রেখে ধ্রুবও নেমে এলেন।আমার হাত থেকে হারিকেনটা নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলেন আমার হাত।
জোছনায় ওনার মুখশ্রীর শ্রী বেড়েছে কয়েকগুন।গভীর চোখজোড়ায় এসে জড়ো হয়েছে আকাশের সমস্ত তারকা।জানি না কেন,কিন্তু ওনাকে অবলোকন করার ইচ্ছে আমায় ঘিরে থাকে সবসময়।মনে হয় শতাব্দী কেটে যাক কিন্তু এই মুখশ্রী আমার অক্ষিপট থেকে যেন না সরে!
.
সকালের প্রথম রশ্মি চোখের উপর এসে পরতেই ঘুমে বিঘ্ন ঘটলো আমার।চোখে তখন রাজ্যের ঘুম কিন্তু আলোর তীব্রতায় চোখ বুঁজে রাখা দায়।সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি।পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই পরিচিত সেই কক্ষ চোখে ভাসলো।চট করে বা দিকে ফিরে তাকালাম আমি।ঘুমে বিভোর অতিপরিচিত প্রিয় সেই মুখশ্রী ভেসে উঠলো অক্ষিপটে।ওষ্ঠকোণে আপনা আপনি এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।ধ্রুবর গালে অযত্নে বেড়ে উঠা দাড়িগুলো নিজ সৌন্দর্য্যে ফুটে উঠেছে উজ্জ্বল শ্যামলা বরন ওই চেহারায়।ওনার দিকে দুদন্ড তাকিয়ে বিছানা থেকে নামতেই আঁচলে টান অনুভব করলাম আমি।ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরতেই দেখলাম ধ্রুবর হাতের মুঠোয় আমার আঁচলের কোণা।পুরুষালি হাতের শক্ত মুঠোয় পরে বাঁধন ছেড়ে আসতে অক্ষম আঁচলের সেই অংশ।আমি জোরে টান দিয়েও ব্যর্থ হলাম।অবশেষে ওনাকে মৃদুস্বরে ডেকে উঠলাম,
“শুনুন?”
ধ্রুবর ঘুম ছিল গভীর তাই আমার মৃদুস্বরে কোন কাজ হলো না।এবার খানিক জোরে করে ডেকে উঠলাম আমি।
“ধ্রুব,শুনছেন?”
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালেন উনি।হৃদপিণ্ড সজোরে কেঁপে উঠলো আমার।উপন্যাস ও কবিতা ঘুমন্ত নারীদের বর্ণনায় ভরপুর!অথচ একজন ঘুমন্ত যুবককে কতটা নিষ্পাপ আর সুন্দর লাগে এই কথা কেন উল্লেখ নেই?এটা ভেবেই বিদ্রোহ করে উঠলো আমার মন।
ধ্রুব আমার দিকে তাকিয়ে বিষয়বস্তু বোঝার চেষ্টা করছেন।আমি বলে উঠলাম,
“আপনার হাতের মুঠোয় আমার শাড়ির আঁচল।”
উনি শোনা থেকে উঠতে উঠতে সেটা লক্ষ্য করে আমার পানে তাকালেন।হাতের মুঠো আলগা করতে করতে বললেন,
“শুধুমাত্র শাড়ির আঁচল ছাড়ছি!”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।উনি বোধহয় কৌতুহল রেখে দিতে বড় মজা পান।আমি ওনার দিকে বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্নানঘরে প্রবেশ করলাম।হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসার পর ধ্রুব আমার হাতের গামছা নিয়ে যেই স্নানঘরে ঢুকতে যাবে ওমনি দরজায় কড়া পরলো।আমি ভ্রু কুঁচকে দরজা খুলতেই একজন পরিচারিকার মুখ দৃশ্যমান হলো।সে অতি বিনয়ের সাথে জানালো যে শহর থেকে ধ্রুবর দুটো চিঠি এসেছে।আমি ডাকপিয়নকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলার জন্য বললাম।
চিঠি আনার জন্য ধ্রুব নিচে গিয়েছেন।আমি কক্ষে বসে বসে চুলে চিরুনি চালাচ্ছিলাম।সিঁথির সিদুর কপালে লেপ্টে এলোমেলো করে রেখেছিলো আমাকে।সেটা ধুয়ে পুনরায় সিঁথিতে লম্বা করে সিঁদুর পরলাম।সিঁদুর পরা শেষে যেই মাথার চুল বেনি করার জন্য হাতে নিয়েছি ওমনি ভেতরে প্রবেশ করলেন ধ্রুব।আমি চট জলদি পেছন ফিরে তাকালাম।মাথার কেশ ওমনি উন্মুক্ত রয়ে গেল।
“কার চিঠি এসেছে?”
উনি একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বললেন,
“তোমার দাদার।তোমাকে একটা চিঠি আর আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে।
কথাটা বলে উনি আমার নামের চিঠিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।কিন্তু আমার আগ্রহ পরে রইল ধ্রুবর হাতের চিঠিখানায়।আমার কৌতুহল বুঝেই বোধহয় ধ্রুব চিঠিটা বের করে পড়তে লাগলো।ধ্রুব চিঠিটা পুরোটা পরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” অতি শীঘ্রই আমাকে শহরে পৌঁছাতে হবে।বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকারে!”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“অতিশীঘ্র বলতে?কোনদিন যেতে হচ্ছে আপনাকে?”
“তিনদিন পর।”
“কিন্তু বৌভাত হতে তো এখনো প্রায় ছয়দিনের মতো দেরি।আপনি গিয়ে আবার ফিরে আসবেন?”
উনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন।তারপর জবাব দিলেন,
“কাকা মশাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে।আমি আসছি।”
উনি চলে গেলেন কাকা মশাইয়ের সহিত আলাপ করার জন্য।আমি ওনার রেখে যাওয়া চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়ে দাদার দেওয়া চিঠিটা খুললাম।অতি পরিচিত হাতের লেখাগুলো ভেসে উঠলো।আমি মনেমনে সবগুলো শব্দ একে একে পড়তে লাগলাম।
❝প্রিয় ভগ্নি,
এতদিন পরে খবর নেওয়ার জন্য দুঃখিত।আশা করি ভালোই আছিস।তোর বিয়ের দিন ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য ক্ষমা করিস।কিন্তু তুই শীঘ্রই বুঝতে পারবি ভুলক্রমে তোর জীবনে সঠিক মানুষটার আগমন ঘটিয়েছে ভগবান।যদি বিমলের সাথে তোর বিয়ে হতো তবে হয়তো আমি এতটা নিশ্চিত থাকতাম না।যতটা এখন আছি।ধ্রুবকে মন থেকে মেনে নিয়ে মন দিয়ে সংসার কর।বাবা, মা তোর জন্য চিন্তিত।আশা করি তুই ভালো আছিস,ভালো থাকবি।আজ এতটুকুই।
ইতি
তোর দাদা।❞
আমি পত্রটা পরে আস্তে আস্তে সেটা বন্ধ কর নিলাম।তারপর চিঠি দুটো ধ্রুবর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলাম।
.
বৌভাতের দিন আগানো হয়েছে।যেহেতু ধ্রুবকে জরুরি কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হবে তাই সকলের অনিচ্ছা সত্বেও খুব জলদি এই শুভ কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে।আর আজ সেই দিন।
সকাল হতে না হতেই শাশুড়ী মা আমার কক্ষে পরিচারিকাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন।তাদের পাঠানোর উদ্দেশ্য এই আমার কক্ষে বিভিন্ন অলংকার পাঠিয়ে দেওয়া।
আমি সকাল সকাল স্নান ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পাই শাশুড়ী মা দুজন পরিচারিকাকে সাথে নিয়ে আমার কক্ষে দাড়িয়ে আছেন।আমি ওনাকে প্রনাম করে দাড়াতেই উনি গম্ভীর কন্ঠে জানালেন,
“এখানে প্রয়োজনীয় সমস্ত অলংকার রাখা আছে।সাজসজ্জায় যেন কোন কমতি না হয়।গ্রামের অনেক মানুষ আসবে।তাদের মধ্যে থেকে একজনও যেন এটা বলতে না পারে এ বাড়ির বউদের দেহে অলংকার রোচে না।”
আমি চুপচাপ ওনার কথা শুনে গেলাম।আমার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখলেন উনি।এ বাড়ির সকলের মতো আমার দেহে তেমন কোন সাজসজ্জা নেই।যদিও এতদিন ধ্রুবর মা আমাকে কিছু বলেননি।কিন্তু যেহেতু আজ নিজে এসে সমস্ত অলংকার দিয়ে যাচ্ছেন তাই আমার অসম্মতি দেখানো শোভা পায় না।যথারীতি উনি আমাকে নির্দেশনা দিয়ে চলে গেলেন।উনি চলে যাওয়ার পর পরিচারিকা দুজনও অলংকার গুলো রেখে চলে গেলো।আমি অলংকারগুলো একে একে দেখতে লাগলাম।অলংকারের পাশাপাশি একটা লাল টকটকে শাড়িও রাখা আছে বিছানায়।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাড়িটা পরে নিলাম।শাড়ি পরা শেষ হতেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ।আমি উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম,
“কে?”
“তোমার স্বামী!”
আমি গিয়ে দ্রুত দরজা খুলে দিলাম।ওমনি ধ্রুবর সুদর্শন মুখশ্রী ভেসে উঠলো আমার অক্ষিকোটরে।ধ্রুব ভেতরে প্রবেশ করতে করতে গাঢ় চোখে আমার পানে তাকালেন।তারপর বিছানায় রাখা অলংকারগুলোর দিকে তাকিয়ে ফের আমার পানে তাকালেন।ওনার ঠোঁটে উদ্ভুদ হওয়া সুক্ষ হাসির রেখা বোধহয় বলছিলো,
“এবার কোথায় যাবে তুমি?”
আমি নিরুপায় একটা চাহনি দিয়ে ওনার পানে তাকিয়ে আছি।উনি আমার নিকটে এসে দাঁড়ালেন।যেহেতু উনি আমার থেকে বেশ খানিকটা লম্বা।তাই একটু ঝুঁকে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আজ আপনাকে রাগানোর বোধহয় কোন আবশ্যকতা নেই!”
ওনার দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নতমুখে তাকালাম আমি।ওনার চোখের গাঢ় দৃষ্টি,সেই সাথে আপনি সম্মোধন।তীরের তীক্ষ্ণ ফলার থেকে কম নয়।
কথার প্রতিত্তোরে আমি বললাম,
“আপনি আমার উপর মজা নিচ্ছেন?”
ওষ্ঠ চেপে ধরে হালকা হাসলেন বোধহয় উনি।তারপর বললেন,
“আমি প্রতিক্ষায়!তোমার সেরা রুপ দর্শনের জন্য।”
এবার মাথা উচু করে ওনার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,
“তবে আমায় সাহায্য করুন।”
“আদেশ করুন!”
ওনার কথা শুনে মুচকি হেসে উঠলাম আমি।সকলের সামনে গম্ভীর মুখ করে থাকা লোকটা আমার সামনে এমন হাসিখুশি খোশমেজাজে থাকেন এটা কেউ বিশ্বাস করবে?
আমি পিছন ফিরলাম লজ্জায়।তারপর আরশির সামনে এসে বসলাম।সেথায় দৃষ্টি দিয়ে ধ্রুবর প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম।ওনার গাঢ় দৃষ্টি আমাতেই নিবন্ধ!
মাথার দীর্ঘ কেশ বেনি করে নিলাম আমি।তারপর ওনার দিকে ফিরে তাকাতেই উনি অলংকার ভর্তি একটা ডালা নিয়ে আমার নিকটে এসে দাড়লেন।আমি লজ্জার সহিত সেখান থেকে ঝুমকো জোড়া নিয়ে পরলাম।একে একে সমস্ত অলংকার স্থান পেলো আমার দেহে।মাথার টিকলি থেকে শুরু করে পায়ের নুপুর অবধি।সবকিছু পরে নিয়ে আমি ওনার দিকে তাকালাম।ওনার চোখের দৃষ্টি পাল্টেছে ততক্ষণে।ওই চোখের ভাষা বুঝলাম না আমি।সেই গভীর চোখজোড়ায় ডুব দিলে বোধহয় বুঝতে পারতাম।কিন্তু হায়!এ দুঃসাধ্য হয়ে উঠলো না আমার।আমি মাথা নিচু বললাম,
“অসুন্দর কায়ায় কিসের এত নজর?”
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তুমি অসুন্দর হলে আমিও বিদ্যাসাগর!”
আমি সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
“রসিকতা হচ্ছে?”
“তুমি করছো!”
“মোটেও না!যা সত্য তা বলছি।”
কিছু না বলে ধ্রুব আলতা রাখা পাত্রটা হাতে নিলেন।সেটা পাশের কাঠের টেবিলে রেখে তাতে তুলি ভেজালেন।শান্ত স্বরে বললেন,
“এজ এ হাসবেন্ড,আই সুড অ্যাপ্রিসিয়েট ইউ।বাট আই হ্যাভ নো ওয়ার্ডস!”
এতটুকু বলে থামেন উনি।তারপর আমার হাতখানা নিয়ে হাতের পিঠে আলতা আঁকতে আঁকতে বলেন,
“বুঝেছো কি বলেছি?”
“হুম!”
মৃদুস্বরে বলে উঠলাম আমি।সাথে সাথে উনি বলে উঠলেন,
“গুড!”
আমি একটা গোপন শ্বাস ফেলে ওনার দিকে তাকালাম।ওনার হাতের অপটু কলা অঙ্কিত হচ্ছে আমার হাতে।নাকি হৃদয়ে?ওনার উপস্থিততে হৃদয়ের হাল কি একটুও বদলেছে?সেই তো আগের মতো অত্যাচারে ব্যস্ত সেথা!
আমার দৃষ্টি ওনার মুখশ্রীতে বিচরণে এতটাই মনোযোগী ছিল।যে আমার হাতে আলতা আঁকতে থাকা ওনার হাতের কম্পনও চোখে পড়লো না।আমার দৃষ্টিতে কেবল ভেসে উঠলো ওনার চোখের পাতার অস্বাভাবিক কম্পন!
কিছুক্ষণ পরে ঠোঁট কামড়ে ব্যর্থ নজরে আমার দিকে তাকালেন উনি।আমি চট করে দৃষ্টি নত করে নিলাম।ওমনি চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার।হাতে আলতার বিশৃঙ্খল অঙ্কন!
উনি করুন চোখে তাকালেন আমার পানে।ওনার থেকে করুন আমার চোখের দৃষ্টি!আমি ওনাকে কিছু বলতে যাবো তখনি বাইরে থেকে আওয়াজ আসলো,
“ধ্রুব বাবু এবং ওনার পত্নীর দ্রুত নিচে আসার আদেশ আছে।”
আমরা দুজনেই বুঝলাম এই আদেশ কে করেছে।ফের আওয়াজ আসলো,
“ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইছি!”
অনুমতি দেওয়া হলে ভেতরে প্রবেশ করলো রাই, প্রভা ও আভা।আমি চমকে তাকালাম।আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো রাই।আমার কাছে এসে থুতনি স্পর্শ করে মিষ্টিস্বরে বলে উঠলো,
“ঈশ্বর তোমাকে তৈরির সময় বোধহয় অতিরিক্ত সময় নিয়েছিলেন!এমন সৌন্দর্য সচরাচর চোখে পরে না।”
অত্যন্ত রুপবতী একজনের নিকট এমন প্রশংসা পেয়ে লজ্জায় নেতিয়ে গেলাম আমি।লজ্জার ভার এতই যে চোখ তুলে তাকানোর জো নেই।
এ বাড়িতে প্রথম দিন আমার গায়ের রঙ ময়লা বলে কটুক্তি করে উঠা আভাও আজ আশ্চর্যজনক ভাবে প্রশংসা করে উঠলো।তারপর তিনজনে মিলে আমাকে নিচতলায় বসার ঘরে নিয়ে এলো।আগে থেকেই বসার ঘর পূর্ণ ছিলো মানুষে।আমি আর চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেলাম না।
বসার ঘরে উপস্থিত হওয়া মাত্র সকলের দৃষ্টি এসে জড়ো হলো আমার উপর।সহসা চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম আমি।এতটা লজ্জা তো আমার বিয়ের দিনও লাগেনি যতটা আজকে লাগছে।আমার আগমনের পরপরই বসার ঘরে একটা গুঞ্জন ছেয়ে গেল।সকলের বলা কথাগুলো মিলেমিশে বিশৃঙ্খল একটা স্বর সৃষ্টি করলো।
আমাকে বসিয়ে দিয়ে সকলে চলে গেল।একা বসে রইলাম আমি।সকলের দৃষ্টি এখন আমার দিকে বুঝতেই ভীষণ অস্বস্তিতে পরে যাচ্ছিলাম।মুহুর্ত যেতেই গুঞ্জনের কিছুটা কমে এলো।কিন্তু পরক্ষণেই চাপা এক গুঞ্জন ফের শুরু হলো।মাথা নিচু করে থাকায় একজোড়া নুপুর পরিহিতা শুভ্র পায়ের নিজের পানে হেঁটে আসার দৃশ্য দেখলাম।এই পায়ের মালকিন কে সেটা বোধগম্য হতেই চোখ তুলে তাকালাম আমি।
ওমনি অক্ষিপটে ভেসে উঠলো শশীর সুশ্রী মুখশ্রী।মনে মনে একটু হাসলাম আমি।ঈশ্বর মনুষ্যের এক বড় উপকার করেছেন।আমাদের হৃদয়ের আসল চেহারা ভাগ্যিস মুখের উপর প্রভাব ফেলে না!
শশীর চলনে দাপটু একটা স্বভাব আছে!কিংবা সেটা তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলে।আমি চোখের পলক ফেলে শশীর পানে ফের তাকালাম।আজ তার পরনে লাল টকটকে শাড়ি।আশ্চর্যের বিষয় তো এই যে আজ সে আটপৌরে শাড়ি পরিধান করেছে!
আমার নিকটে এসে স্থির হয়ে দাড়ায় শশী।মুখে সুক্ষ একটা হাসির রেখা টেনে পর্যবেক্ষণ করে আমাকে।উপস্থিত লোকেদের দৃষ্টি ততক্ষণে দখল করে নিয়েছি আমরা দুজন।অদুরেই শাশুড়ী মা শঙ্কিত নজরে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
আমাকে পর্যবেক্ষণ করে শশীর দৃষ্টি এসে থামলো আমার হাতের উপর।মুহুর্তেই তার ওষ্ঠ ছেয়ে গেল উপহাসের হাসিতে।সেটা লক্ষ্য করেই আমি।হাতটা তুলে দেখলাম।শশী আফসোসের একটা সুর টেনে বলে উঠলো,
“যার কাধে জমিদার বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব সপে দেওয়া হবে।সে আদোতে হাতে আলতা আঁকতেও অপটু!বড়ই আফসোসের বিষয়।”
আমি স্বাভাবিক ভাবেই তাকালাম শশীর দিকে।কিন্তু ক্রমেই সরু হয়ে এলো আমার দৃষ্টি।আমি হাতে ধ্রুবের এঁকে দেওয়া আলতার উপর নজর বুলিয়ে বলে উঠলাম,
“আফসোস তো আপনি করবেন,শশী।যখন আমার হাতের আলতার এমন নকশার কাহিনি জানবেন।আমার তো সন্দেহ,আপনি আফসোসে না দ্বিতীয়বার প্রাণ ত্যাগের চেষ্টা করে বসেন!”
আমার ছোঁড়া তীর যে একেবারে নিশানায় এসে লেগেছে সেটা শশীর মুখমণ্ডলের পরিবর্তন দেখেই বোঝা গেল।আমার কথার অর্থ বোধহয় পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি শশীর।সে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
“মানে?”
“মানে এই সেটা নিয়ে একটু আগে আপনি উপহাস করলেন।সেটা আমার স্বামীর হাতের ছোঁয়া।উনি নিজে আমার হাতে আলতা এঁকে দিয়েছেন!”
আমার কথা শুনে শশীর কিরূপ অনুভূতি হলে বোঝা গেল না।তবে সে বলে উঠলো,
“বেশিদিন তোমার স্বামী আর তোমার থাকবে না!এই জমিদার বাড়ি আর ধ্রুবর মস্তিষ্কে থেকে চিরতরে তোমায় আমি মুছে দিব।”
“চেষ্টা করুন।অবশ্যই এটা শুধুমাত্র আপনার অপূর্ণ একটা স্বপ্ন হয়ে রয়ে যাবে,শশী।”
চলবে…
ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।