মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-০৬

0
36

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
৬.
“ধ্রুব সাহেব এসে গেছেন,মা ঠাকুরুন।”

কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আমি চমকিত হয়ে উঠলাম।বুকটা কেঁপে উঠলো আচমকা।শাশুড়ী মা স্মিত হেসে পরিচারিকাকে ইশারায় যাওয়ার আদেশ দিলেন।আমি রুদ্ধশ্বাসে দাড়িয়ে আছি ঘোমটা ধরে।একটু পর সুপারি কাটা শেষ হলে শাশুড়ী মা কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে বসার ঘরের দিকে গেলেন।আমি সেমুখো হলাম না।ওনার কক্ষ থেকে বেরিয়ে সোজা তিন তলায় ধ্রুবর কক্ষে চলে আসলাম।বুকটা দুরুদুরু কাঁপছিল।হৃৎস্পন্দন তো বেড়ে একাকার!আমি বুঝলাম না বক্ষদেশের এই নিপীড়ন,কিংবা বুঝেও তা অস্বীকার করলাম।সেদিন উনি এভাবে শহরে চলে যাওয়ায় ওনার প্রতি একপ্রস্ত অভিমান জমেছে আমার মনে।হয়ত যখন উনি কাপড় পাল্টাতে এসেছিলেন তারপরই বেরিয়ে গিয়েছিলেন।তখন তো আমি উনার সামনেই ছিলাম।একবার বলা যেত না যে,

“নির্বানী আমি শহরে চলে যাচ্ছি।”

এতটুকু ভেবেই থম মেরে বসে রইলাম আমি।এটা ভেবে কি জন্য এত অস্থির হচ্ছি আমি?আমাদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে তাতে এসব স্বাভাবিক ধরাই তো যায়!ওনার আমার প্রতি কোন অনুভূতি নেই এটা বাস্তব। তবে আমি এত ব্যাকুল কেন হচ্ছি?
নিজ মনে উদ্ভট প্রশ্নে নিজেই বিরক্ত হলাম। চোখ বুঁজে শাসালাম বেয়াদবটাকে।অথচ আমার হৃদপিণ্ড তখনো স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি রক্ত পাম্প করছে।শুধুমাত্র ওনার আগমনের সংবাদই যদি এতটা ভয়ংকর হয়,তবে উনি সামনে উপস্থিত হলে সেটা কি প্রাণঘাতী হবে?

বসার ঘরে তখন উৎসবের ন্যায় পরিবেশ তৈরি হয়েছে।নিচ থেকে একটা কলরবের স্বরে ভেসে আসছে।আমি জানতাম না শাশুড়ী মা জানেন যে আজকে উনার ছেলে আসবেন।সাধারণত এবাড়ির রসুইঘরে আমার যাওয়া হয় না।তাই আজ বিশেষ বিশেষ পদ রান্নার খবরটাও পাইনি আমি।তাহলে হয়ত কিছুটা আন্দাজ করতে পারতাম।
আমি বিভিন্ন চিন্তা মাথায় নিয়ে পাইচারি করছিলাম।একসময় অস্থির চিত্তে বসে পড়লাম বিছানায়।বিছানায় ঠিক বিশাল জানলারটার পাশে বসেছি আমি।এখান থেকে অনেক দূরের নদী চোখে ভাসে।সম্ভবত এই গাঁয়েই নদী।আমি আগে কখনো এমন নদী দেখিনি।আঁকাবাঁকা হয়ে আপন স্রোতে ভেসে চলা স্রোতস্বিনীকে আমি দূর থেকেই অবলোকন করি।গোধূলিতে সুর্যাস্ত এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।সুর্যের অস্ত যাওয়া প্রতিফলিত হয় নদীর জলে।

আজ এখনো গোধূলি হয়নি।মধ্যান্ন পার হয়ে বিকেলের প্রারম্ভ হচ্ছে।প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আধো সোনালী আলো।আমি জানালা গলে যতদুর দৃষ্টি যায় অবলোকন করছিলাম।হঠাৎ পায়ের শব্দে আমার মনোযোগ হটে।আমার হাতের চাপে বিছানার চাদরে ভাজ পরলো।আচমকা এলোমেলো একটা হাওয়া এসে ফেলে দিলো মাথার ঘোমটা।অনুভব করলাম এঘরে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার আগমন ঘটেছে সপ্তাহ খানেক পরে।কিন্তু একটা অচেনা পুরুষালি কন্ঠে পিলে চমকে উঠলো,

“আরে বাহ!এখনো বিয়েই হলো না আর বউয়ের মতো বরের অপেক্ষা করা শুরু করে দিয়েছো,শশী দি।ওপস সরি হবু বৌদি।”

চোখ বুঁজে ছিলাম আমি।অচেনা কন্ঠে এমন বাক্য কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই চকিতে লোকটার দিকে ফিরে তাকালাম।সম্পূর্ণ অচেনা একটা কায়া ভেসে উঠলো অক্ষিপটে।ভ্রু যুগল আপনা আপনি কুঁচকে এলো।লোকটাও বোধয় আমাকে আশা করেনি।থমকে গেল যেন সে।ভালো করে দেখলো আমাকে।গৌর বর্ণের থেকে একটু চাপা বর্ণা আমি,খোঁপা করা চুল,মাথা ভর্তি সিঁদুর, হাতে শাখা আর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকা আমি।পরনের আটপৌরে শাড়িতে ভালোভাবে নজর বুলিয়ে তার চোখে বিস্ময় খেলে গেল যেন।তাকে এভাবে গাঢ় চোখে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে দেখে বসা থেকে উঠে দাড়ালাম।বিকালের নরম আলো এসে পড়ছিলো আমার চোখেমুখে।লোকটার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলাম,

“কে আপনি?অনুমতি না নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছেন কেন?”

আমার গলার স্বর শক্ত ও ক্ষুব্ধ শোনালো।তার বলা শেষাক্ত শব্দই বোধহয় কোমল আমির সত্তায় একটু রাগ মিশিয়ে দিয়েছে।প্রশ্নটা করে জবাবের প্রতিক্ষা করতে করতে আমি লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।
মাথায় কৃষ্ণবর্ণ ঝাঁকড়া চুল,গায়ের রঙটা ধ্রুবর থেকে একটু চাপা হবে।চোখে আবার চশমা,হন্তভম্ব মুখশ্রীতে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ হঠাৎ ধীরে ধীরে লীন হতে লাগলো।
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অচেনা যুবকটি আমাকেই পাল্টা প্রশ্ন করলো,

“আমি কে?মনে হচ্ছে এ বাড়িতে প্রথম বেড়াতেন এসেছেন।তাই বাড়ির কর্তাকে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে।”

ভ্রু যুগল আরো কুঁচকে এলো আমার।বাড়ির কর্তা!এ বাড়ির,জমিদারির উত্তরাধিকার তো ধ্রুব।এ কে এসে নিজেকে বাড়ির কর্তা দাবি করছে?
এবার লোকটার উত্তরের আশা না করে আমি বলে উঠলাম,

“সে আপনি নিজেকে যাই বলেই দাবি করুন না কেন।এখান থেকে বেরোন।”

“শহর থেকে এসেছেন বুঝি?শুদ্ধ বাংলার ছোঁয়া কন্ঠে।”

লোকটার উপর আমি চরম রেগে উঠলাম।সামনে একটু এগিয়ে বললাম,

“আচ্ছা বেয়াদব তো আপনি!একে তো অনুমতি না নিয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করেছেন।তার উপর আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেয়াদবি করে যাচ্ছেন।”

আমার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো লোকটা।তারপর পুরো কক্ষে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে দেখে বললো,

“আমি তো ভুল কক্ষে আসিনি।বোধয় অন্যকারো কক্ষকে নিজের বলে দাবি করছেন আপনি।”

আচমকা কক্ষে কারো প্রবেশের শব্দে আমরা দুজনেই দরজার দিকে তাকালাম।দীর্ঘদেহী উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ নিরেট যুবক দখল করলো আমার অক্ষিপট।আমার দিকে তাকানোয় চোখাচোখি হলো দু’জনের।শুকনো একটা ঢোক গলাধঃকরণ করলাম।আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অচেনা যুবকটির দিকে তাকালো এবার ধ্রুব।স্বাভাবিক তবে প্রশ্নাত্মক কন্ঠে শুধালো,

“তুই এখানে?”

ধ্রুবর প্রশ্নে ইশারায় হ্যা বুঝিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা বললো,

“ইয়েস ভুল কক্ষে আসিনি।মনে হয় আপনিই ভুল কক্ষে এসে গেছেন।”

কথা শুনে আমি আর ধ্রুব একে-অপরের দিকে তাকালাম।আচমকা ধ্রুব গলা ঝেড়ে বলে উঠে,

“শুভ,এটা ওরই কক্ষ।”

ধ্রুবর কথায় শুভ এবার খানিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“কে ইনি?”

সাথে সাথে ধ্রুবর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি।

“মিসেস ধ্রুব দেবনাথ!”

কথাটা কর্ণগোচর হওয়ার পরপরই চোখ বড় বড় তাকলো শুভ।তার দৃষ্টি একবার আমার পানে তো একবার ধ্রুবর পানে ছুটতে লাগলো।ধ্রুবর চেহারায় কোন প্রতিক্রিয়া নেই।বরং সে যেন শুভর এমন অবাক হওয়া উপভোগ করতে লাগলো।কিছুক্ষণ একবার আমার পানে আরেকবার ধ্রুবর পানে তাকানোর পর বললো,

“হোয়াট!কিন্তু তুমি তো শশীদিকে বিয়ে করতে চলেছিল?”

শুভর প্রশ্নে আমার পানে তাকায় ধ্রুব।ওনার তাকানোতে চোখ নামিয়ে নেই আমি।কিন্তু ওনার দৃষ্টি যে আমার থেকে হটেনি তা বেশ টের পাচ্ছিলাম।ধ্রুব এভাবেই আমার পানে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠলো,

“বিয়ে করার কথা ছিল,বিয়ে তো করিনি!”

“আমার মাথা ঘুরছে!এসব কখন হলো?
আমাকে কেউ জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না?”

ধ্রুব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাড়া দেখিয়ে বললো,

“হয়েছে তোর?যা এবার।তোর ঘরে গিয়ে রেস্ট কর।”

শুভ ঠোঁট উল্টে তাকালো তার দিকে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“ঠিক আছে।”

তারপর তার দৃষ্টি এসে বর্তালো আমার দিকে।আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।সে বললো,

“সরি!এ কক্ষে প্রবেশের আগে অনুমতি নেওয়ার কারণ যে চলে এসেছে সেটা জানা ছিল না।”

এতটুকু বলে সে কক্ষ ত্যাগ করে সশব্দে।আমি একটু ঘুরে জানালার পানে তাকালাম।হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক নিপীড়ন আবারও শুরু হলো। হৃদয়ের জ্বালাতনে চোখ বুজলাম।কিন্তু এবার চোখে এই হৃদয়ের নিপীড়নের কারণ ভেসে উঠলো।আকাশি রঙের শার্ট পরিহিত যুবক সুদর্শন যুবক ভেসে উঠলো চোখ বুজতেই।হঠাৎ তার গলার স্বর,

“নির্বানী?”

চোখ খুলে তাকালাম।শুকনো ঢোক গিলার জন্য সাড়া দিতে বিলম্ব হলো।ক্ষনকাল পেরোতেই বলে উঠলাম,

“জ্বী..ই!”

এরপর নিরবতা বয়ে গেল কক্ষ জুড়ে।ধ্রুব কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।আমি ধৈর্য হারালাম।ঘুরে তার দিকে তাকালাম সহসা।দৃষ্টি সরালেন উনি।একটা শুকনো ঢোক গিলে আমি একটু অভিমানী কন্ঠে বললাম,

“যদি কিছু বলার নাই থাকে তবে ডাকাডাকি করবেন না।”

আমার কন্ঠে অভিমানের আঁচ পেয়ে মনে মনে উনি যেন প্রসন্ন হলেন।বললেন,

“রাগ করেছো আমার উপর?”

আমি তাকালাম উনার দিকে।শার্টের হাতাটা গুটানো কনুইয়ের কাছে,বলিষ্ঠ হাতের অনেকটা ফুটে উঠেছে তাতে।লোকটার মুখে লুকানো একটুকরো হাসি।আমার দিকে তাকিয়ে আছেন নির্লজ্জের ন্যায়।আমি তার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে দাড়ালাম।বললাম,

“আমি কে রাগ করার?”

“তবে কি অভিমান করেছো?”

আমি চুপ করে রইলাম।আমার মৌনতা যেন তার সামনে স্বচ্ছ দর্পনের ন্যায় সব বললো।আমি বলে উঠলাম,

“পরীক্ষা কবে শেষ হলো আপনার?

” আজকেই!”

তার কন্ঠে একটা অস্থিরতা খুঁজে পেলাম।সেটা এবার লুকালেন উনি।ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করতে করতে বললেন,

“শহর থেকে চিঠি এসেছে তোমার।তোমার দাদা পাঠিয়েছে।”

আমি এবারও ওনার পানে তাকালাম না।অভিমানে ভরে ছিল আমার হৃদয়।উনি আবার বললেন,

“আমি কিছু এনেছি তোমার জন্য।একবার এদিকে তো তাকাও, নির্বানী।”

আমি রয়েসয়ে ওনার পানে তাকালাম।উনার হাতের জিনিসটা দেখে চমকিত হলো আমার হৃদয়।ওনার হাতে একজোড়া রুপোর নুপুর। তাতে সূর্য কিরণ পরে চকচক করছে।ধ্রুবর ওষ্ঠকোণে সুক্ষ্ম হাসির রেখা।উনার গাঢ় দৃষ্টি আমার উপর বিদ্যমান।আমি খুশি হয়ে ওনার চোখে তাকালাম।সেই চোখে ছিল চাতকের ন্যায় তৃষ্ণা।যা ধীরে ধীরে মিটাচ্ছেন উনি।

চলবে…..